#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৫
“সৌমিত্র বাবা! এমন করিস না তুই। একটু শান্ত হ। দেখ বলে দে তুই কোথায় আছিস? তোর মম অনেক টেনশন করছে রে। তোর ভাইয়াও আজকাল তোর মমের খবর রাখে না। তুইও কি তোর মায়ের কথা একবারের জন্য চিন্তা করবি না?”
বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ওঠেন মিসেস. রেবা ফোনের ওপাশ থেকে। তাতে সৌমিত্রের ভাবভঙ্গিতে কোনো প্রভাব পরে না। সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল। চোয়াল শক্ত করে উত্তর দেয়,
“আই নো মম। সেজন্য ভাইয়ার খবর নিতেই যাচ্ছি। তুমি এখন আমার কুয়েশ্চনের এন্সার করবে কিনা সেট বলো। আমার সামনে অনেক বড় নদী। অনেক স্রোত বইছে। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না ওই চার দেয়ালের মধ্যে। একটু খোলা হাওয়া খেতে ইচ্ছে করে। এমন সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করতে ইচ্ছে করে। আর যাকে পছন্দ তাকে…”
বলেই থামে সৌমিত্র থামে। রক্তমাখা হাতের মুঠো শক্ত করে বলে,
“এতটুকু আমার অন্যায়? আমার চাওয়াকে মানুষ কেন অন্যায় হিসেবে দেখে বলতে পারো? কেন আমার সব চাওয়া নিষিদ্ধ হয় সমাজের কাছে? অনেক হয়েছে মম। এবার যা করার সৌমিত্র নিজে করবে। তোমাকে শেষ বারের মতো প্রশ্ন করছি। ওই ভাইয়া আর মোহ কোথায় গেছে? বলবে হ্যাঁ কি না?”
“বা…বান্দরবান! বান্দরবান আছে ওরা। সেখানেই গেছে। তুই কিছু করিস না সৌমিত্র। দেখ আমি বলে দিয়েছি কিন্তু। নিজের কোনো ক্ষতি করি…”
সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলেন না মিসেস. রেবা। সৌমিত্র ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে কল কেটে দিয়ে ফোনটা একবার দেখে নিল। ফোনটাও তার বিপদের কারণ হতে পারে। সামান্য বাটন ফোন। একটা লোকের কাছ থেকে নিয়ে চলে এসেছে তাকে না বলেই। কাজটাকে চুরি বললে ভুল হবে না। সৌমিত্র ভাবে, তারই বা কি দোষ? ফোন কেন তাকে এমন কোনোকিছু দেওয়া হয়না যা দিয়ে সে নিজের কোনো যোগাযোগ করতে পারবে বা নিজে যেখানে থাকে তার চার দেওয়ালের বাহিরে বেরিয়ে আসতে পারবে! তবুও সেদিন কোনোমতে বেরিয়ে এসেছিল সৌমিত্র। এসেই মোহ আর স্বচ্ছকে একই বিছানায় এতো কাছাকাছি ঘুমোতে দেখে মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেছিল তার। ফলস্বরূপ মোহকে মারতেও গিয়েছিল। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো। সে পড়ে গেল সিঁড়ি দিয়ে নিচে। বেঁচে গেল! তারপর সেখানে স্বচ্ছ তাকে ধাওয়া করেছিল। বেশ কয়েকবার হাতাহাতি আর মারামারিও হয়েছে। স্বচ্ছের গালে আঁচড় কেটেছে আবার থাপ্পড়ও মেরেছিল। তারপর থেকে এভাবেই ছন্নাছারা হয়ে ঘুরছে সে।
হেলেদুলে হেঁটে এসে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় সে। লাল রঙের গাড়িটা ভালোভাবে দেখে নিয়ে গাড়িতে কয়েকটা থাবা দিয়ে অদ্ভুত হেঁসে বলে,
“ইশশ… ডক্টরের গাড়িটা ভালোই কাজে লাগল। আর বান্দরবান পর্যন্ত কাজে লাগবে। লেটস গো!”
গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে ঢুকে পড়ে সৌমিত্র। কতদিন সে কার ড্রাইভ করে না। এতোক্ষণ মোটামুটি বেশ কয়েকজনের সাথে এক্সিডেন্ট হতে হতেও হয় না। বাকিটা রাস্তায় দেখা যাবে।
গাড়ি স্টার্ট দেয় সৌমিত্র। প্রথম থেকেই বলে স্পীডে গাড়ি ড্রাইভ করে ধীরে ধীরে ফুল স্পীড বেড়ে যায় গাড়ির। সৌমিত্র যেন আনন্দে মেতে ওঠে। দ্রুত যেতেই মেইন রোডে সিগন্যাল ব্রেক করে আচানক একটা বৃদ্ধ লোককে গাড়ি দিয়ে আঘাত করে ফেলে সৌমিত্র। সঙ্গে সঙ্গে মুখের মাস্ক ঠিক করে লাগিয়ে নেয় সে। ছোট্ট করে বলে ওঠে,
“বুলশিট!”
পেছন থেকে ট্র্যাফিক পুলিশ সিটি বাজিয়ে উঠতেই আর বিলম্ব না করেই আবারও ফুল স্পীডে গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় সৌমিত্র। এখানে তাকে ধরা দেওয়া যাবে না। তাহলে অনেক বড় ঝামেলাই পড়তে হবে তাকে।
সকালে সূর্য ঝলমল করছে আকাশে। বান্দরবান জায়গাটি বেশ ওপরেই বলা যায়। পাহাড়ি জায়গা। উঁচুনিচু জমি। যেন আকাশ কত নিচে নেমে এসেছে। জানালার পাশে আধশোয়া হয়ে সেটাই দেখছে মোহ। স্বচ্ছ গিয়েছে ওয়াশরুমে শাওয়ার নিতে। মানুষটার সকাল সকাল শাওয়ার নেওয়ার অভ্যেস কত কয়েকদিন থেকেই দেখে যাচ্ছে মোহ। বর্তমানে মোহের মনোযোগ আকাশের দিকে। যেন আকাশের মেঘের ভেলাতেও স্বচ্ছের অবয়ব ভাসছে। এ কেমন বিপদের পূর্বাভাস? ভালোবাসা নামক বিপদের পূর্বাভাস বুঝি? মোহ আপনমনে বলে উঠল,
“আচ্ছা আকাশ, আমি তোমার মাঝেও কেন মানুষটাকে দেখছি। ওই নটি লোকটাকে দেখার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না আমি। এখন কেন যেন যেখানে তাকাই আমার এই চোখজোড়া শুধু তাকেই খোঁজে। আমি তো আগেও একজনকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু এটা কেমন নতুন অনুভূতি? এই অনুভূতির সাথে তো আমি পরিচিত নই!”
বলেই নিরব হয়ে গেল মোহ। পেলো না উত্তর। গাল ফুলিয়ে জানালার কাছে মাথা লাগিয়ে বসেই রইল সে। হুট করেই পানির কয়েকটা ফোঁটা মোহের পিঠে পড়তেই হকচকিয়ে পেছন ঘুরতেই দুটো হাত আঁকড়ে ধরে তাকে। একহাত পেটে বিচরণ করতে থাকে অন্যহাত মোহের গাল স্পর্শ করে। এমন ঠান্ডা স্পর্শে কেঁপে ওঠে মোহ। স্থির হয়ে যায় মূর্তির মতো। মোহের বুঝতে বাকি থাকে না যেই মানুষটি তাকে স্পর্শ করেছে তার স্পর্শ উপেক্ষা করার মতো ক্ষমতা তার নেই। তৎক্ষণাৎ তার কর্ণকুহরে ভেসে আসে সেই অসাময়িক স্নিগ্ধ মাখানো কন্ঠ,
“ওই আকাশটার কি দোষ বলো? দোষ তো মনের। যার দোষ তাকে প্রশ্ন করতে শিখো সুন্দরী।”
“আ…আপনি বেরিয়ে এসেছেন? আমি তাহলে ফ্রেশ হতে যাই সরুন।”
কথাটুকু মোহ বলে ঠিকই কিন্তু কেন যেন স্বচ্ছকে সরিয়ে দিতে পারে না। স্বচ্ছ হাসে আর বলে,
“আমি কেন সরব? তুমি সরিয়ে দাও।”
“আপনি না বলেন আমি মশা? একটা মশা কি করে একটা হাতিকে সরিয়ে দিতে পারবে বলুন তো?”
“নাথিং ইজ ইম্পসিবল। একটা উপায় আছে তাকে সরানোর। এখন কথা হচ্ছে সেটা তুমি পারবে কিনা!”
“কি উপায়?”
বেশ আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করে মোহ। স্বচ্ছ মোহকে আরেকটু বেশি পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে বলে,
“হাতিদের আদর করে দিলে তারা তোমার সব কথা শুনবে জানো তো? তাহলে হাতিকে সরানোর উপায় কি হলো? তাকে আদর করে দেওয়া। তুমি তো সেটা পারবে না। তোমার দ্বারা ওসব হবে না বাদ দাও।”
“আপ..আপনি এসব কথা ছাড়া আর কোনো কথা পান না তাই না?”
আঁতকে উঠে বলে মোহ। স্বচ্ছ আরেকটু এগিয়ে আসে মোহের দিকে। স্বচ্ছের গালের দাড়ির সাথে মোহের গালে ঘোষা লাগতেই চোখ খিঁচে ফেলে মোহ। স্বচ্ছ বলে,
“কি করব বলো? আমার কাছে এতো সুন্দর একটা বউ থাকতে এসব ছাড়া আর কিছু মাথায় আসতে চায় না সে। তার চুল, নাক, ঠোঁট, গাল, কপালে শুধু গভীর পরশ মাখিয়ে দিতে মন চায়। এটা কিন্তু তোমার দোষ মোহ। আমাকে দোষ দিলে চলবে না।”
মোহ মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“মোটেই না। আপনার তো সব মেয়েকে সুন্দর লাগে। আজ একে তো কাল ওকে।”
এবার ফুঁসে ওঠে স্বচ্ছ।
“এই মেয়ে এই তুমি কোথায় দেখলে একে সুন্দর ওকে সুন্দর বলতে।”
“কেন আপনার ফ্যামিলি ফ্রেন্ড রিয়ানা। ওকে তো খুব সুন্দর সুন্দর বলে প্রশংসা করছিলেন। এখন আমিও সুন্দর হয়ে গেলাম? বাহ বাহ!”
ভ্রু উঁচিয়ে থাকলেও মোহের অভিমানী কন্ঠ শুনে ঠোঁট কামড়ে হেঁসে ফেলে স্বচ্ছ।
“ওহ হো! এখনো জেলাস ফিলিং টা রয়েই গেছে ম্যাডামের?”
“কেন থাকবে না? আমাদের নারীদের হিংসে জিনিসটা কত মারাত্মক হয় জানেন? আবার স্বামীর সাথে অন্য কাউকে দেখার বিষয়টা আমাদের মনে কত আঘাত করে।”
“এই পাগলী! আমার সাথে অন্য কাউকে দেখবে কেন? আমি তো একজন ছাড়া অন্য কারো পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবিই নি। তবে আমার বউয়ের হিংসে কিন্তু আমার মারাত্মক সুন্দর লেগেছে।”
একটু থামে স্বচ্ছ। তারপর আবার মোহের গালে ঠোঁট লাগিয়ে বলে,
“আরেকটা কথা। রিয়ানা যদি সুন্দর হয় তাহলে তুমি সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এক নারী। যার পাশে রিয়ানা কেন যেকোনো সুন্দর নারী দাঁড়ালেও আমার কাছে ফিকে পড়ে যাবে। আর তোমাকে যদি কোনো ভীড়ে খুঁজেও না পাই তাহলে এই শরীরের ঘ্রাণ আমাকে জানান দেবে হ্যাঁ আমার হিংসুটে বউটা এখানেই আছে।”
স্বচ্ছের প্রতিটা শব্দ যেন এখনো মোহের কানে বাজছে। কথাগুলো এতো সুন্দর কেন? এতো মোহনীয় কেন? কি জাদু আছে? আবেশে চোখ বুঁজে ফেলে মোহ। আবারও কানে ভেসে আসে স্বচ্ছের কন্ঠ,
“তাহলে বলো এই হাতিকে সরাতে এই মশা কি করবে?”
মোহ ধীরে খোলে। মিটমিটিয়ে হাসে সে। আচানক ঘাড় বাঁকিয়ে স্বচ্ছের ডান গালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়া মাখিয়ে দেয়। অতিরিক্ত চমকে গিয়ে আলগা হয়ে যায় স্বচ্ছের হাতের বাঁধন। ডান হাতটা অটোমেটিক তার ডান গালে চলে যায়। ঘোরের দেশে চলে গেছে সে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এটা কি হলো তার সাথে। সেই সাথে স্বচ্ছের কর্ণকুহরে বেজে ওঠে,
“হাতিটাকে একটা মিষ্টি দিয়েছে। তাতেই সে কপোকাত।”
উচ্চস্বরে হেঁসে পালিয়ে গেল স্বচ্ছের সামনে থাকা ‘মোহ’ সুন্দরী রমণী। স্বচ্ছ হতবিহ্বল হয়ে এখনো হাঁটু গেড়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক প্রশান্তির হাসির রেশ। মোহ ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে। স্বচ্ছ চিল্লিয়ে বলে ওঠে,
“মিষ্টিটা দারুণ ছিল। এমন মিষ্টি প্রতি মিনিটে পেলেও মাইন্ড করব না।”
চলবে…