#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৩
পাহাড়ি পরিবেশ। সোনালী রোদ্দুর ছুঁয়েছে পরিবেশ। দমকা হাওয়া মাঝে মাঝেই প্রকৃতিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। চোখ জুড়িয়ে যাবেই যাবে। জায়গাটা বান্দরবান। গাড়ি ছুটে চলেছে। গাড়ির পেছনের সিটে জানালার ঘেঁষে বসে রয়েছে মোহ। চোখে বড় বড় করে রাস্তার আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছে সে। ঠোঁটে হাসির রেশ। মাঝে মাঝে প্রসারিত হচ্ছে ঠোঁট আবার প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের কারণে আপনা-আপনি হা হয়ে যাচ্ছে ঠোঁটজোড়া। বান্দরবান আসার ইচ্ছেটা অনেক আগে থেকেই ছিল মোহের। প্ল্যানিং ও হয়েছিল এখানে আসার পরিবারের সকলে মিলে। তবে হারিয়ে গেল মোহের পরিবার। একটা ঝড়েই মুষড়ে পড়তে হলো তাকে। হঠাৎ করেই এই ইচ্ছেটা পূরণে হতভম্ব সে। তার চেয়ে দশগুন বেশি খুশি। চেহারাটা খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছে যেন। পাশেই সিটে ঠেস লাগিয়ে বসে আছে স্বচ্ছ। মেরুন রঙের শার্ট ওপরে কালো রঙের কোট পরিহিত স্বচ্ছের ওপরে নাহলেও হাজারবার আঁড়চোখে তাকানো হয়ে গেছে মোহের। তবুও এই সুদর্শন পুরুষের সৌন্দর্য যেন কমার নয়। বারংবার চোখজোড়া যেখানেই পৌঁছায়। স্বচ্ছের একপাশের চুল দিয়ে প্রায় তার বাম চোখ ঢেকে যাচ্ছে। সেটা খেয়াল করে মিটমিটিয়ে হাসে মোহ। স্বচ্ছ চোখ বুঁজে আছে বুকে দুহাত গুটিয়ে। সারারাত মোহ ঘুমিয়ে এসেছে তার বুকে। স্বচ্ছ তখন নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিল। কখনো মোহের মাথায় হাত বুলিয়েছে, কখনো ইচ্ছেমতো চুমু খেয়ে গেছে আবার কখনো কানে বা নাকে ফুঁ দিয়ে ডিস্টার্ব করেছে। এখন তার চোখজোড়া আর মানছে না বুঁজে এসেছে।
জানালার বাহির থেকে নজর সরিয়ে আবারও ঘাড় বাঁকিয়ে স্বচ্ছের দিকে তাকায় মোহ। চোখ বুঁজে আছে লোকটা। রাতের কথা একটুআধটু মনে আছে মোহের। একবার তো স্বচ্ছ কামড় দিয়েছিল মোহের নাকে। এবার তারই প্রতিশোধ নেওয়ার ফন্দি আঁটছে মোহ। সামনের ড্রাইভারকে ভালোভাবে দেখে নেয় মোহ। ড্রাইভার নিজমনে গাড়ি ড্রাইভ করতে ব্যস্ত। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বচ্ছের দিকে আস্তে করে এগিয়ে যায় সে। হালকা করে স্বচ্ছের দিকে হেলে গিয়ে কামড় দেওয়ার জন্য হা করতেই একচোখ খুলে ফেলে স্বচ্ছ।
“আজকাল দেখছি লাভ বাইট দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো। ব্যাপার কি?”
বেলুনের মতো চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে সরে আসতে নেয় মোহ। কিন্তু তার আগেই ফট করেই মোহের পিঠে হাত রেখে নিজের ওপর ফেলে দেয় স্বচ্ছ। এমন আকস্মিকতায় হকচকিয়ে ওঠে মোহ। ফটাফট দূরে সরে যাওয়ার জন্য ছটফটিয়ে বলে ওঠে,
“এটা কি হচ্ছে? আমরা গাড়িতে আছি ভুলে যাচ্ছেন?”
“আমি তো ভুলছি না সুইটহার্ট। তুমি ভুলছো। গাড়িতেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করছিলে দেখলাম তো। এতোটাই ব্যাকুল হয়ে উঠলে যে আমার মতো ঘুমন্ত নিষ্পাপ ছেলেটার ওপরও ভালোবাসার অত্যাচার করতে চলে এলে। এখন চোখ মেললাম তো গানের সুর পাল্টে গেল? দ্যাটস নট ফেয়ার সুন্দরী!”
মুচকি হেঁসে ভ্রু উঁচিয়ে বলে স্বচ্ছ। মোহ গড়গড় করে বলে,
“আমি মোটেই আপনাকে এসব করতে এগিয়ে আসিনি। আমি তো শুধু…”
“তুমি তো শুধু কি? হা করে এগিয়ে আসছিলে কেন? তোমার মতলব আমার ঠিকঠাক লাগছে না। না জানি আমাকে একা পেয়ে কি করে বসো।”
মোহ বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। এই লোকটা কি বলে? এমন কথা শুনতেই সে নড়াচড়া ভুলেছে। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে তারপরেই স্বচ্ছের বুকে কয়েকটা কিল মেরে দেয় মোহ। স্বচ্ছ তাতেও ভ্রুক্ষেপহীন। চোখ ছোট করে মেয়েটার কান্ড দেখে সে বলে,
“যাই করো না কেন এখন লাভ বাইট না দিয়ে গেলে তোমায় ছাড়ছি না।”
“আপনি পাগল হয়ে গেছেন সরুন!”
“আমার পাগলামি, আমার মুগ্ধতা, আমার মাতলামো, আমার উন্মাদনা সবটা যে একজন নারীকেই ঘিরে। সে কি সেটা বোঝে?”
ছটফটানি বন্ধ করে দেয় মোহ। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় তার একদম সন্নিকটে থাকা ধূসর বর্ণের চোখজোড়ার পুরুষটির দিকে। কেমন যেন উন্মাদনা ছড়িছে চারিদিকে। মোহ হারিয়ে যাচ্ছে মানুষটির প্রেমে। অথচ তার সঙ্গে এমন হওয়ার কথাই ছিল না! স্বচ্ছ মোহের বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
“ওহ হ্যালো ম্যাডাম! হোটেলে প্রায় পৌঁছে গেছি। এভাবেই কি আমরা থাকব নাকি হোটেলেও যাব? তুমি থাকতে চাইলে আমার আপত্তি নেই।”
মোহ কিছুটা চকিতে তাকায়। সরে আসতে নিলেও সরে না সে। স্বচ্ছের দিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করে নেয়। আনমনে হয়ে স্বচ্ছের ডান গালে হাত দিয়ে বলে,
“এই দাগটা কীসের? এমন লাল হয়ে আছে কেন? মনে হচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে আছে!”
স্বচ্ছ হাতিয়ে নিজের গালে হাত রাখে। মোহ হাতটা সরিয়ে দেয়। ভবঘুরে হয়ে বলে,
“আবার মনে হচ্ছে কয়েকটা আঙ্গুলেরও দাগ দেখছি। কি হয়েছে?”
“কি হবে আবার? হয়ত কোনোভাবে আঁচড় লেগেছে কারো সাথে। এমনটা তো অস্বাভাবিক কিছু না।”
“আমার তো তা মনে হচ্ছে না।”
সন্দিহান হয়ে বলে মোহ। তার চোখ এখনো স্বচ্ছের গালে স্থির। যেন বেশ গভীরভাবে কেউ আঁচড় কেটেছে নাহলে মেরেছে। কিন্তু লোকটা স্বীকার করতে নারাজ। স্বচ্ছ কিছুটা আমতা আমতা করতে করতে এক সময় সরু দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে। আর নিচু সুরে বলে,
“তুমি তো দেখছি দিন দিন টিপিক্যাল ওয়াইফ হয়ে যাচ্ছো। মানে একটা জিনিস দেখো! সামান্য আঁচড়ে সন্দেহ করে ভেতরে ভেতরে কিভাবে জ্বলে যাচ্ছো তুমি। ব্যাপার কি? এটাতে সিউর থাকো তোমার বর যে কিনা একটাকে সামলাতে পারে না সে পাগল হলেও অন্য কারো কাছে যাবে না।”
“আপনি বেশি বেশি বলছেন।”
“উঁহু না! আমি এক নারীতে আসক্ত আর পরনারীতে আসক্ত হওয়ার কথা ভাববার আগেই যেন মৃত্যু হয় এই আহিয়ান স্বচ্ছের।”
গাড়ি থামে। দুজনেরই চোখে চোখে কথা বন্ধ হয়। মোহকে ছেড়ে দেয় স্বচ্ছ। মোহ মাথা নিচু করে সরে আসে। স্বচ্ছ গাড়ি থেকে নামে। সাথে মোহও নেমে পড়ে। সামনেই বড়সড় দোতালা রিসোর্ট। অবশ্য রিসোর্টের মাঝে এক অন্যরকম সৌন্দর্য আছে। সামনের করিডোর দাঁড়া সংযোগ করা ঘর। তাছাড়া সবগুলো যেন গ্রামীণ কুঠুরি। ব্যাপারটা বেশ মজার লাগল মোহের। বেশ আগ্রহের সঙ্গে দ্রুত এগিয়ে যায় হোটেলের দিকে সে। সামনের ছোটখাটো বাগান। মাঝখান দিয়ে পিচ করা সরু রাস্তা। রাস্তাটা ভিজে। কারণ সবে ভোর হয়েছে। হয়ত শিশির পড়েছে। রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে মোহ স্বচ্ছের অপেক্ষায়। পিছু ফিরে তাকায় মোহ। স্বচ্ছ নিজের মানিব্যাগ পকেটে ঢুকিয়ে আসছে সবে। শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে একটা একটা করে। অন্যমনস্ক সে। এরইমাঝে একটা লাল গাড়ি এসে দাঁড়ায়। দ্রুততার সাথে গাড়ির দরজা খুলে একটা মেয়ে নেমে পড়ে। সাথে একটা লাগেজ নামিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে নেয় সে। সরু রাস্তা থাকার ফলে স্বচ্ছের গায়ের সাথে মেয়েটা ধাক্কা খেতেই বেসামাল হয়ে পড়ে স্বচ্ছ। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে খুব বিরক্তির সাথে তাকায় সে। মোহেরও বিষয়টা কেমন জানি অদ্ভুত ক্ষোভ জাগালো। দ্রুত পা চালিয়ে ছুটল সেদিকে। স্বচ্ছের কাছে এসে দাঁড়ালো মোহ।
“স্বচ্ছ! হোয়াট অ্যা কোয়েন্সিডেন্স! আই কান্ট বিলিভ।”
স্বচ্ছের মুখ থেকেও বিরক্তিভাবটা কেটে যায়। ঠোঁটে ফুটে ওঠে সূক্ষ্ম হাসির রেশ। বেশ প্রফুল্ল মুখটা নিয়ে বলে ওঠে,
“রিয়ানা! আমিও বিলিভ করতে পারছি না তুমি। সিরিয়াসলি? তুমি বাংলাদেশে এসেছো? কবে? তাও বান্দরবান?”
“ইয়েস। আজই তো ল্যান্ড করলাম দেশে। কি করব যতই হক এই দেশের মেয়ে না আমি?”
কথাটা বলে হেঁসে ওঠে রিয়ানা নামক মেয়েটা। স্বচ্ছের হাসিও প্রসারিত হয়। সে যেন কত খুশি এই মেয়েটিকে দেখে। তবে মোহ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। মেয়েটির পরনে আধুনিক পোশাক। গায়ে গেঞ্জি সাদা রঙের তার ওপর জ্যাকেট। আর সাথে জিন্স। বেশ আধুনিক মেয়ে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই রিয়ানা স্বচ্ছের হাত ধরে বসে। মোহও ঢক গিলে তাকায় সেদিকে। কেমন জানি লাগছে তার। অস্বস্তি না রাগ হচ্ছে নিজেই বুঝতে পারছে না। তবে হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে বিষয়টাকে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে মোহ। তবুও কেন জানি তার অসহ্য লাগছে। সুন্দর পরিবেশ অসুন্দর হয়ে উঠছে। কেন?
চলবে…
#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৪
“তুমি এখনো আগের মতোই আছো। লাইক ড্যাশিং, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম। নাকি বলব আরো হ্যান্ডসাম হয়েছো?”
বলেই স্বচ্ছের হাত ধরে হেঁসে দেয় রিয়ানা। স্বচ্ছও হালকা শব্দ করে হাসে। পাশেই নিরব ভূমিকা পালন করছে মোহ। তার ব্যান্ডেজে থাকা হাতটাও বার বার মুষ্টিবদ্ধ করে যাচ্ছে সে। ইচ্ছে করছে এখনি স্থান ত্যাগ করতে। হয়ত এখান থেকে চলে যাওয়াই উচিত। রিয়ানা নামক মেয়েটির সাথে সাক্ষাৎ এর পর স্বচ্ছ যেভাবে কথায় মগ্ন যেন মোহকে তার মনেই নেই। তার হয়ত মনেই নেই পাশে আরেকজন আছে। তাই যেই মোহের একটু আগেই এতো সুন্দর পরিবেশের কারণে হেঁসে উঠে শুধু বেড়াতে মন চাইছিল এখন তারই এসব ফেলে চলে যেতে মন চাইছে আবারও বাড়িতে। কেন এসেছিল সে? না এলে এই অসহ্যকর মেয়েটার সঙ্গে দেখা হত না। মোহ মনে মনে এটাও ভাবছে যে রিয়ানা কি আসলেই অসহ্যকর? নাকি শুধু তারই এমন লাগছে?
মোহ আবারও দৃঢ় দৃষ্টি দিয়ে পরখ করে নিল রিয়ানাকে। এমন আধুনিক ড্রেসআপের সাথে মাথায় উঠিয়ে রাখা সানগ্লাস। হাতে ঘড়ি। সেই সাথে বড় বড় নখে স্টাইলিশ নেইল আর্ট করা, চুলে ব্রাউন কালার করা সাথে একদম স্ট্রেট। আর চেহারাতেও বিদেশী ভাবে ছেয়ে আছে। হয়তবা বিদেশেই বড় হয়েছে। আর কথাবার্তাতে বড্ড স্পষ্ট। একেবারে স্ট্রেট কথা বলছে সে। কথা বলার ভঙ্গিটাও বেশ। সব মিলিয়ে রিয়ানাকে চমৎকার লাগার কথা! তবে মোহের রাগ বেড়ে চলেছে ভেতর ভেতর। ভেতরের রাগটা বাহির দিয়েও পরিলক্ষিত হচ্ছে এবার। কান আর নাকের ডগা লাল হয়ে রয়েছে। এক পর্যায়ে রক্তিম চোখে তাকায় মোহ স্বচ্ছের দিকে।
“ইউ অলসো লুকিং বিউটিফুল। তোমার মাঝেও পরিবর্তন এসেছে।”
“অথচ আমাদের দেখা মাত্র ২ মাস পর হচ্ছে। এতেই এতো পরিবর্তন নোটিশ করছি। হাউ ফানি অ্যান্ড সুইট!”
স্বচ্ছের জবাব কথাটি বলে খিলখিলিয়ে বসে ওঠে রিয়ানা। এবার মেজাজটা তুঙ্গে উঠে যায় মোহের। কান্না পায় তার রাগের চোটে। এই মেয়েটার সামনে নিজেকে কেমন জানি বেমানান লাগছে তার। সাথে স্বচ্ছের পাশেও বেমানান লাগছে। সব মিলিয়ে ভার মুখে রিসোর্টের দিকে ফিরে গটগট করে হাঁটা শুরু করে সে। হঠাৎই তাকে পিছু ডাকে স্বচ্ছ।
“এই মোহ! একা কোথায় যাচ্ছো?”
মোহ স্বচ্ছের দিকে না ফিরেই বাজখাঁই গলায় জবাব দেয়,
“কেন রিসোর্টে যাচ্ছি। আমার তো এখানে অন্যকোনো কাজ নেই।”
“আমাকে দেখো না তুমি? আমাকে না রেখেই গটগট করে চলে যাচ্ছো! কাম হেয়ার। তুমি একা এখানে আসোনি। আমরা হানিমুনে এসেছি। কোথায় আমার হাত ধরে রোমান্টিক ভাব নিয়ে রিসোর্টে ঢুকবে তা না করে একা চলে যাচ্ছে। কাম ব্যাক!”
মোহের রাগটা কমল না। চোখ রাঙিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও স্বচ্ছ ও রিয়ানার দিকে এগিয়ে আসতে হয় তাকে। মোহকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে রিয়ানা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে স্বচ্ছকে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
“হু ইজ দিস, স্বচ্ছ? হাতভাঙা মেয়েটা কে হয় তোমার? হানিমুনে এসেছো এখানে? ইট মিনস… ”
“ইয়াপ। সি ইজ মাই ওয়াইফ মিসেস. মোহ।”
“ওহ হো! এই মেয়েটা তোমার ওয়াইফ? দেখে একদমই মনে হচ্ছে না। এমা হাত ভাঙলো কি করে?”
দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে মোহ। চোখ রাঙায় রিয়ানার দিকে। কেন রে মানুষের হাতে আঘাত লাগতে পারে না? এটা কি অস্বাভাবিক কিছু? এসব মনে মনে বকে চলেছে মোহ। কিন্তু জবাব দিল স্বচ্ছ।
“রিয়ানা, তোমার মনে হলো কি হলো না তাতে তো আমার কিছু করার নেই। সি ইজ মাই ওয়াইফ। হানিমুনে এসেছি এখানে। আর ওর হাতে একটু আঘাত লেগেছে। অনেক বড় মানসিক অশান্তিতে আছে তাই ওকে নিয়ে হানিমুনে এসেছি। তোমার এখানে আসার কারণ কি?”
“একচুয়ালি, তুমি তো জানো যে আমি এমন জায়গা খুব পছন্দ করি। সো বান্দরবান সম্পর্কে সব ভিউ দেখলাম ভালো লাগল। তোমার হয়ত মনে আছে যে আমি ডাক্তারি লাইনে পড়ছিলাম। এট লাস্ট আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তাই ভাবলাম এখানেই শিফট হয়ে যাই। আমি আগেই চলে এসেছি দেশে এখানকার হসপিটালে শিফট হবো। এখন রিসোর্টেই উঠছি। পরে একটা ফ্লাটে উঠে যাব সব ঠিকঠাক হবার পর। বাই দ্যা ওয়ে তোমাদের ডিস্টার্বের রিজন আর না হয়! বাই বাই।”
মুচকি হেঁসে আগেই রিসোর্টে ঢুকে যায় রিয়ানা। সে যাবার পরই মোহও তড়িৎ গতিতে হাঁটা ধরে রিসার্টের দিকে স্বচ্ছকে কিছু না বলেই। তা দেখে স্বচ্ছও তার পিছু পিছু যায়।
রিসোর্টের বাহির থেকে দেখতে গ্রামীণ ঘরের মতো মনে হলেও ভেতরটা আধুনিক। যদিও এসি নেই তবুও ফ্যান চলছে। ঠান্ডা ঠান্ডা মরসুমে ফ্যানও লাগে না অনেক সময়। বেশ বড় একটা বেডে সাদা চাদর বিছিয়ে রাখা সাথে দুটো বালিশ। জানালার বাহির থেকে দেখা যায় মুগ্ধকর পরিবেশ। পাশেই অদ্ভুত সুন্দর ল্যাম্পশিট। ছোট্ট বেতের টেবিল সাথে বেতের চেয়ার। জানালার পাশেও ছোট্ট বেডের মতো ব্যবস্থা করে রাখা। বেডের বিপরীতে আলনা রাখা। সেটাও বেতের। দরজা খুললেই করিডোর। যা মিশে গিয়েছে অন্যসব ঘরের সাথে। খোলামেলা করিডোরে কোনোরকম গ্রীল নেই। রিসোর্টের মেইন রিসেপশনের বিল্ডিংটা পেছনদিকে। সব মিলিয়ে নিরিবিলি একটা পরিবেশ। যদিও কালই নীলগিরিতে যাবার উদ্দেশ্যে বের হবে স্বচ্ছ ও মোহ। সেখানে অন্য রিসোর্ট নেবে তারা। আজকের দিনটা এখানে রয়েছে।
মোহ আপনমনে লাগেজ থেকে কয়েকটা কাপড় বের করে রাখছে আলনাতে। মুখটা এখনো ভার। স্বচ্ছ বেডে আধশোয়া হয়ে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছে মোহকে। মাঝে মাঝে ফোন ঘাঁটছে। এবার ফোনটা রেখে উঠে বসল সে। হালকা কেশে বলে ওঠে,
“রিয়ানা মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় আমেরিকা থেকে। তুমি হয়ত জানো আমি আমেরিকাতে ছোট থেকে অনেক সময় সেখানেই কাটিয়েছি। ইভেন আমার ফ্যামিলিও বেশ কয়েক বছর সেখানে ছিল। সেখানেই রিয়ানার ফ্যামিলি আমাদেড ফ্যামিলি ফ্রেন্ড ছিল। সেখান থেকেই ওর সাথে আমার পরিচয়। বিদেশে বড় হয়েছে সো…”
“আমি কি আপনার কাছে থেকে রিয়ানার ব্যাপারে কিছু শুনতে চেয়েছি?”
স্বচ্ছের কথা সম্পূর্ণ না হতেই বেশ রাগের সুরে বলে ওঠে মোহ। স্বচ্ছ চুপ হয়ে যায়। ভাবতে থাকে মেয়েটার এমন করার কারণ কি? সকালে তো খুব খুশি ছিল। বেশ হাসিখুশি ছিল সে। হঠাৎ করেই এমন হওয়ার কারণ খুঁজে পেল না স্বচ্ছ। একটু ভেবে আন্দাজ করতে পারে সে। সে উঠে দাঁড়ায়। একপা দুইপা করে এগিয়ে আসে মোহের দিকে। মোহ তা পাত্তা না দিয়ে সরে যেতে চাইলে খপ করে স্বচ্ছ মোহের বাম হাত হেঁচকা টানতেই সে সোজা গিয়ে আঁচড়ে পড়ে স্বচ্ছের বুকে। রাগে, অভিমানে, হিংসেটে এবার ফেটে পড়ে মোহ। স্বচ্ছের বুকে কিছুক্ষণ বিড়ালছানার মতো মুখ লুকিয়ে রেখে আচমকায় স্বচ্ছের বুকে কিল মেরে সরে আসার চেষ্টা চালিয়ে বলে,
“সরুন। আমার সাথে এসব ফাইজলামি একদম করবেন না।”
“তো কার সাথে করব? আর কে আছে আমার সুন্দরী?”
“কেন আপনার ওই রিয়ানা!”
রেগেমেগে কটমটিয়ে বলে মোহ। স্বচ্ছ ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। মোহের নাক একটু টেনে দিয়ে বলে,
“তো এটাই ম্যাডামের রাগের কারণ? সি ইজ জেলাস?”
থমকে যায় মোহ। চোখে রাগ মিশে গিয়ে দেখা যায় অস্বস্তির তীব্রতা। স্বচ্ছ এবার মোহকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
“উমম… মাঝে মাঝে আমার বউকে হাসির চেয়ে বেশি হিংসুটে রিয়েকশনেও দারুণ লাগে। চোখেমুখে ওই স্ট্রবেরি ভাবটা ফুটে ওঠে। তো তার এখন বরকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিলিং ও হয়! ও মাই গড… আই কান্ট বিলিভ।”
“আমি মোটেও জেলাস হচ্ছি না।”
“সেটা তো তোমার চোখমুখ বলে দিচ্ছে। আর কি যেন বললে? আমার রিয়ানা? সে আমার কবে থেকে হলো? আমি তো একজনকেই আমার বলে মনে করি। সে আমার একান্তই ব্যাক্তিগত! সে আমার মোহ।”
মোহ আলতো কেঁপে ওঠে। লজ্জার তীব্রতায় মুখ স্বচ্ছের শার্টের আড়ালে লুকাতেই আচানক মোহের কাঁধে বেশ কয়েকটা ঠোঁটের স্পর্শ লাগিয়ে দেয় স্বচ্ছ। আকস্মিক ঘটনায় যেন জমে বরফ হয়ে যায় মোহ। অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায় ভেতরে। শ্বাস প্রশ্বাস প্রগাঢ় হয় তার। আরো একবার মোহের কাঁধে নিজের ওষ্ঠদ্বয় মিলিয়ে দিলে স্বচ্ছের শার্ট খামছে ধরে মোহ। চোখ খিঁচে বন্ধ করে। মোহের কানের কাছে স্বচ্ছ ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“উপপস… মাই ওয়াইফ ইজ ব্লাশিং।”
ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আকাশী রঙের টিশার্ট পরিহিত এক যুবক। তার চোখজোড়া দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। এক হাতে ফোন শক্ত করে ধরে রাখা। পানির দিকে পর্যবেক্ষণ করছে সে একধ্যানে। এক পর্যায়ে দাঁতে দাঁত চেপে ব্রিজের রেলিংয়ে সব শক্তি দিয়ে হাত দ্বারা বেশ কয়েকবার আঘাত করে সে। হাত ফেটে ঝরঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ে রেলিংয়ে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,
“এতো সহজে বাঁচবে না মোহ। মরতে হবে তোমায়।”
রক্তাক্ত হাত দিয়ে নিজের ঝাঁকড়া চুল ঠিক করে নেয় সৌমিত্র। দ্রুত ফোন অন করে ফোন লাগায় কাউকে। ঘাড় বাঁকিয়ে অপেক্ষা করে ফোনটা রিসিভড হওয়ার। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরেই ওপাশ থেকে কল রিসিভড হয়।
“আমি সৌমিত্র বলছি। মম, ভাইয়া কোথায়? খবর পেয়েছি মোহকে হানিমুনে গেছে?”
“তুই কোথায়? তুই কোথায় গেছিস সৌমিত্র? তোকে কত খুঁজেছি তুই জানিস? তোকে পাইনি। আমাকে না বলে কোথায় চলে গেছিস তুই?”
সৌমিত্র তার মায়ের প্রশ্নের তোয়াক্কা করে না। চিৎকার করে বলে,
“স্বচ্ছ কোথায়? কোথায় গেছে মোহকে নিয়ে? আমার সুখ কেঁড়ে নিয়ে কোথায় নিজেদের সুখী রাখতে গেছে? এই প্রশ্নের জবাব তুমি দেবে? নাকি সামনের এই নদীতে আমি সুইসাইড করব?”
চলবে….
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]