#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৮
একাধারে যক্ষ্মা রোগী মতো কেশে চলেছে স্বচ্ছ। থামাথামির কোনো নাম নেয়। মোহ গাড়ি থেকে নেমে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে স্বচ্ছের দিকে। এবার বোধহয় লোকটা সর্বোচ্চ কাশির আওয়ার্ড জিতে নেবে। কাশতে কাশতে তার নাক লাল হয়ে এসেছে। গালের মাঝারি আকারের দাড়ি ভেদ করে দেখা যাচ্ছে আলতো গোলাপি আভা। সারা চোখমুখ লাল হয়ে আসে স্বচ্ছের। এক পর্যায়ে নিজ থেকে কাশি থেমে যায়। স্বচ্ছ অবাক সুরে বলে,
“হাউ সেলফিশ ইউ আর! মানে আমি যে তখন থেকে কেশে যাচ্ছি। তুমি হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে?”
মোহ মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“তো? আপনার কাশি উঠলে আমি কি করতাম? কাশিকে বলতাম যে, ‘এই কাশি এখন স্বচ্ছ ভাইয়কে আক্রমণ করিস না?’ এটা বলতাম আমি?”
“ওয়াও! তুমি তো দেখছি আস্ত একটা বুদ্ধির ঢেঁকি।আরে একজন অচেনা মানুষও সামনে এতক্ষণ কাশলে তাকে অন্যজন পানি এগিয়ে দেয় আর তুমি?”
“আমি এখন পানি কোথা থেকে পাব এখানে? ম্যাজিক করে আনব?”
টেরা কথা শুনিয়ে দেয় মোহ। স্বচ্ছকে দেখলে মুখে সহজ কথা আসতেই চায় না মোহের। সে বুঝতে পারে না এটা ঠিক তার বিরক্তির কারণে নাকি অভ্যেস! স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দেয়,
“অন্তত পিঠে থাবা তো মারতে পারতে!”
“আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না আপনার কাশি উঠল কেন? তাও এমনভাবে যেন আপনি কোনো অন্যায় করেছেন আর ধরা পড়ে গেছেন।”
“কি ধরা প…পড়ার কথা বলছো হ্যাঁ? এটা কোথায় বলা হয়েছে কাশি শুধু অন্যায় ধরা পড়লেই হয়?”
আমতা আমতা করে রাগ দেখিয়ে বলে স্বচ্ছ। মোহ দৃঢ় গলায় বলে,
“না শুধু মনে হলো। আপনি কি পুলিশের কাছে যাবেন নাকি আমায় একা যেতে হবে?”
স্বচ্ছ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বাইক স্টার্ট দিয়ে বলে,
“যাচ্ছি। কাম ফাস্ট।”
মোহ আবারও গিয়ে বসে বাইকে। সে এখনো সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বচ্ছের দিকে। মোহের মন বারংবার বলে চলেছে, ‘মানুষটার নাম স্বচ্ছ বটেই তবে উনি পুরোটা রহস্যময় ও ঘোলাটে।’
বাইক স্টার্ট দিতেই আবারও হাওয়া লাগতে শুরু করে। মাথার ওপরের ঝুঁটি থেকে চুল বেরিয়ে এসে মোহের চোখমুখে লাগায় এক পাহাড় সমান বিরক্তি নিয়ে চোখমুখ জড়িয়ে আছে মোহ। মাঝে মাঝে এক হাত দিয়ে চুল সরিয়ে দিচ্ছে সে। কিছু কিছু জায়গায় ব্রেক করতে হচ্ছে স্বচ্ছকে। যার কারণে মোহের গাল আর মুখ গিয়ে লাগছে স্বচ্ছের কাঁধে। তৎক্ষনাৎ লোকটার শরীরের অদ্ভুত ঘ্রাণ ঠেকছে মোহের নাকে। রৌদ্রময় দিনে যেন আড়ষ্ট করে ফেলছে দুজনকে। একটুখানি একসঙ্গে পথ চলা যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে অনুভূতি। দমকা হাওয়ার মতোই অনুভূতিগুলোও দমকা এসে কড়া নাড়ছে।
চেয়ারে বসে আছে মোহ। বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে আছে সে। পাশেই গম্ভীর মুখভঙ্গি করে বসে আছে স্বচ্ছ। তার বাঁকা দৃষ্টি মোহের দিকে। মোহ আচমকা টেবিলে থাবা দিয়ে বলে ওঠে,
“দেখুন অফিসার, সবটা আপনাকে বলেছি। এখন আপনি এজ শুন এজ কোনো ব্যবস্থা নিন। আমি ওই লোকটার পরিচয় জানতে চাই। ইভেন ওই লোকটা আমার টর্চ লাইটটাও ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছে। চোর কোথাকার!”
কথাটুকু শেষ হওয়ামাত্র জোরে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল স্বচ্ছ। পুলিশ অফিসার মোহকে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
“আপনি আমাকে ঘটনাগুলো বলেছেন। কিন্তু কোনো সূত্র তো পেতে হবে আমাদের। আচ্ছা আপনি লোকটার চেহারা বা এমন কিছু দেখেছেন যেটা দিয়ে তাকে চেনা যায়?”
“চেহারা কি করে দেখব? অন্ধকার ছিল। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছিলাম লম্বায় কিছুটা দানবের মতো। আই মিন এইযে উনাকে দেখুন। উনার মতো।”
স্বচ্ছকে দেখিয়ে বলল মোহ। সঙ্গে সঙ্গে তেতে উঠল স্বচ্ছ।
“মোহ!”
ধমক দিয়ে উঠতেই চমকে উঠে বসে যায় মোহ। স্বচ্ছের উচ্চতা দেখানোর জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। মোহ বিস্ময়ের সাথে বলল,
“কি আজব! আপনি রাগ দেখাচ্ছেন কেন?”
“তুমি আমাকে দানব বলছো ইন্ডাইরেক্টলি?”
কথাটা বলে রাগে ফোঁস ফোঁস করে উঠল স্বচ্ছ। মোহ শুকনো ঢক গিলে জবাব দিল,
“আপনাকে না তো। আমি তো ওই লোকটাকে বলছিলাম। মাঝখানে এমন রিয়েকশন দিয়ে বসলেন যে মানুষটা আপনি।”
“তুমি নিজে বললে ওর হাইট টা দানবের মতো। একেবারে আমার মতো।”
“আরে হ্যাঁ। শুধু কি তাই? চিৎকারটাও আপনার মতো।”
স্তব্ধ নয়নে এবার চেয়ে রইল স্বচ্ছ। বলার মতো কিছু না পেয়ে অদ্ভুত রিয়েকশন দিয়ে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকায় স্বচ্ছ। মোহের দৃষ্টি এখনো স্বচ্ছের দিকে। ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেও পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ যা বলছিলাম। উনার মতোই হাইট, উনার মতোই চিৎকার আর হাতের স্পর্শ টাও…”
বলেই থেমে যায় মোহ। ঠোঁট টিপে চুপটি করে থাকে সে। স্বচ্ছ তার দিকে তড়িৎ দৃষ্টিতে তাকায়। চোখ গরম করে আবারও সামনে নজর দেয়। মোহ কিছু একটা ভেবে আবারও বলে ওঠে,
“হ্যাঁ ওই লোকটার হাতে লিখা চিঠি আছে আমার কাছে। আমি চাইলে ওটা দেখাতে পারি।”
“কোথায় দেখান?”
আগ্রহের সঙ্গে দেখতে চান পুলিশ অফিসার। মোহ মুখটা ভার করে উত্তর দেয়,
“সেটা সাথে আনিনি আমি। কাল নিয়ে আসব। ওই লোকটার পরিচয় আমার চাই-ই চাই।”
“আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”
মোহ আর স্বচ্ছ বেরিয়ে আসে অফিস থেকে। স্বচ্ছ মোহকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় নিজ গন্তব্যে।
বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই অচেনা লোকজনের সামনা-সামনি হতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে মোহ। তার বাড়িতে অচেনা লোকজনের সমাগম একদমই পছন্দ করে না সে। তবুও সে নিজের মুখে বিরক্তি ভাবটা না এনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। একটা প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা, দুজন বয়স্ক মহিলা ও পুরুষ এবং দুজন লোক উপস্থিত আছে। যার মধ্যে চশমা পড়া লোকটা মোহের দিকে ফ্যালফ্যাল করে লজ্জার মাথা খেয়ে তাকিয়ে আছে। অস্বস্তি পড়ে যায় মোহ। সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে মিসেস. নিরার আগমন। তার পেছন পেছন দুজন সার্ভেন্ট নানানরকম ফলমূল ও মিষ্টি এনে সোফার সামনের টেবিলে রাখে। মিসেস. নিরার দৃষ্টি মোহের দিকে পড়তেই দ্রুত মোহের দিকে এগিয়ে আসেন তিনি। তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“আসতে এতো দেরি হলো কেন তোর? সালাম দে ওদেরকে।”
মোহ মিসেস. নিরাকে কিছু বলার সুযোগই পেল না। তার আগেই তাদের সামনে ঠেলে দিলেন উনি। মোহ হাজারো বিরক্তির মাঝে ছোট্ট হাসির রেখা ফুটিয়ে সালাম দিতেই বয়ষ্ক লোকজন সালাম নেয়। তার মাঝেই মিসেস. নিরা বলে ওঠেন,
“কলেজে গিয়েছিল মেয়েটা। আজকালকার মেয়ে। পড়াশোনা না করলে চলে না। বোঝেনই তো।”
সবাই হেঁসে সম্মতি দেয়। মোহ বেকুব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। তার মাথাতে আসছে না এরা কারা? অতঃপর মিসেস. নিরা ফিসফিসিয়ে বলে,
“যা কলির(সার্ভেন্ট) সাথে। ওপরে একটা শাড়ি রেখেছি রেডি হয়ে আয়।”
“কিন্তু এ…এরা কারা মি…”
“কথা বাড়াচ্ছিস কেন? যা বলছি কর। কলি ওকে নিয়ে যাও।”
মোহের কথা না শুনেই তাকে ঘরে নিয়ে আসা হয়। ঘরে আসতে না আসতেই কলিকে ধরে প্রশ্ন করে,
“এই কি হচ্ছে বাহিরে বলো তো? কারা উনারা? আর মিমি আমায় রেডি হতে বলছে কেন?”
“ওরা তো পাত্রপক্ষ। আপনার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে ছোট সাহেবা।”
পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায় মোহের। মাথায় ভেঙে পড়ে আকাশ। বিস্ফোরিত নয়নে কলির দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তেজনায় চিৎকার করে বলে ওঠে,
“হোয়াট ডু ইউ মিন বাই পাত্রপক্ষ? কীসের পাত্রপক্ষ? বিয়ের কথায় বা উঠে এলো কোত্থেকে?”
মোহের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল কলি। পেছন থেকে পাওয়া গেল মিসেস. নিরার কন্ঠ।
“আমি উঠিয়েছি তোর বিয়ের কথা। বিয়ে তো করতে হবে নাকি! যথেষ্ট বড় হয়েছিস।”
চোখজোড়া ছলকে পেছন ঘুরে তাকায় মোহ। চোখে ইতিমধ্যে পানি টলমল করছে তার।
“আমি তো বলিনি যে আমি বিয়ে করব। তুমি কেন বিয়ের কথা উঠাচ্ছো। এখনো আমি পড়াশোনা কমপ্লিট করিনি। আর তুমি বিয়ের বিষয়ে কেন মাথা ঘামাচ্ছো?”
“ঘামাতে হয়, মোহ। তোর মা-বাবা বেঁচে থাকলে আমি মাথা ঘামাতে আসতাম না। কিন্তু ওরা নেই। আমাকেই তোর কথা ভাবতে হবে। আমারও ঘর আছে, সংসার আছে। আমাকে তো সেখানে ফিরতে হবে। আর তোর পড়াশোনা যেহেতু এখানে আমি আমার বাড়িতে নিয়েও যেতে পারব না তোকে। এতো নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস। তাই ট্রান্সফার করানোটাও ঠিক না। তাই সব ভেবে…”
“সব ভেবে তুমি আমার বিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করলে। তোমার সংসার আছে ভালো কথা। তুমি চলে যাও। আমি একা থাকব। আমি এই সময় বিয়ের কথা ভাবতে চাইছি না মিমি।”
মিসেস. নিরাকে থামিয়ে বলল মোহ। তবুও মিসেস. নিরা ছাড়বার পাত্রী নন। একটা মেয়ে কি এতো বড় বাড়িতে একা একা থাকতে পারে? তাই উনার মনে হয়েছে এখন সব থেকে বড় সলিউশন বিয়ে। অন্যদিকে মোহের নাজেহাল অবস্থা। আয়মান থাকতে সে অন্যকারো সাথে বিয়ের কথা ভাবতে পারে না। এখন কি করতে সেসব ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে।
“দেখ মোহ। ঠিক আছে অন্তত এরা যখন এসে পড়েছে তখন তাড়িয়ে তো দিতে পারি না। আমার এই কথাটা রাখ প্লিজ।”
হাজার বারণ করলেও এই অনুরোধটুকু ফেলা দায় হয়ে পড়ল মোহের কাছে। বিরক্ত হয়ে শাড়ি তুলে নিল হাতে। মিসেস. নিরার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল কিঞ্চিৎ হাসি।
রানী গোলাপি রঙের শাড়িটা ফুটে উঠেছে মোহের ফর্সা চেহারায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে পায়ে পা তুলে ফোন নিয়ে বসে আছে মোহ। আয়মানকে বারংবার ফোনের চেষ্টা করেও বিফল হচ্ছে সে। কপালে পড়েছে চিন্তার ছাপ। রাগে কটমট করে ড্রেসিং টেবিলে ফোনটা রেখে দিল। কলি তার চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। মোহের চুলগুলো খুব বেশি লম্বা নয়। প্রায় কোমড়ের একটু ওপরে। একেবারে স্ট্রেট নয় তার চুল। হালকা কোঁকড়ানো। যা তার সৌন্দর্যের বিশেষ দিক। এই চুলের জন্যই যেন তার অন্য রুপ ফুটে ওঠে।
চুল ঠিকঠাক করা শেষে মিসেস. নিরা এসে চুমু খান মোহের কপালে। মোহের মনটা বিষণ্ণ। কথা বলাও হারিয়েছে সে। তা খেয়াল করে মিসেস. নিরা মোহের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“মন খারাপ করিস না রে মা। একদিন বুঝবি তোর ভালোর জন্যই কাজটা করেছি।”
মোহের মন শান্তনা পায় না তাতে। তার চোখ পড়ে তার টেবিলে থাকা সেই অজানা আগন্তুকের চিঠিটার দিকে। মৃদু উড়ছে সেই চিঠি। কেন জানি না আরেকবার চিঠিটা পড়তে ইচ্ছে করছে তার। কারণ তার জানা নেই।
চলবে…