Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"একটুখানি ভালোবাসাএকটুখানি ভালোবাসা পর্ব-১৮+১৯

একটুখানি ভালোবাসা পর্ব-১৮+১৯

#একটুখানি ভালোবাসা
#পর্ব_১৮_১৯
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
” আমি দুঃখিত মি. আবীর। স্পর্শ’কে বাঁচাতে পারলেও তাকে আমরা,,,
আবীর আৎকে উঠে বলে,
” তাকে কী? বলুন ডক্টর কী হয়েছে?
” স্পর্শ কোমায় চলে গিয়েছি।
ডক্টরের কথা শুনে আবীর মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। সাগর এসে আবীরকে সামনে নিল। ডক্টর আবারও বলে,
” আসলে উনি এইবার সহ দু’বার মাথায় অনেক গুরুতর ভাবে আঘাত পেয়েছেন। হয়তো আগেরবার আল্লাহর ইচ্ছায় সে বেঁচে যায়। তবে এবার আর কোনো ভালো খবর আশা করা বোকামি হবে। ওনার বাঁচার আশংকা ছিল খুবই কম। আমি তো এটা ভেবে অবাক হচ্ছি যে একটা মানুষের উপর এতটা আঘাত আসার পরও সে আল্লাহর দয়ায় বেঁচে রয়েছে। তবে হ্যাঁ যদি কখনো মিরাক্কেল কিছু হয় তাহলে হয়তোবা সে সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু এর সম্ভাবনা খুবই কম রয়েছে। এখন বাকিসব আল্লাহর ইচ্ছে। ওনার দেখাশোনার দিকে নজর রাখবেন। কোনো কমতি যেন না হয়। আমি আসছি।
ডক্টর চলে গেলেন। আর আবীরের চোখ দিয়ে নিঃশব্দে নোনাপানি গড়িয়ে পড়ছে।
” আবীর ভাই নিজেকে সামলে নিন। আপনিই যদি এই মুহূর্তে এতটা ভেঙে পড়েন তাহলে স্যারকে কে দেখবে বলুন?
” সাগর! বড়ো ভুল করে ফেলেছি ভাই। আমার একটা ভুলের কারণে আজ ভাইয়া এতটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
একদিন কেটে যায়। সবাই এখনো হাসপাতালেই রয়ে গেছে।
মাধবীলতা আবীরের সাথে হাজারো যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয় তখন সে মনে সাহস নিয়ে স্পর্শের বাড়ি চলে আসে। কিন্তু বাড়ি এসেও হতাশ হয় মাধবীলতা। বাড়িতে যে কেউ’ই নেই। বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাধবীলতা। এতদিন যে বাড়িতে সে রাণীর মতো বাস করতো আজ সেই বাড়িতেই সে প্রবেশ করতে পারছে না। অনেক’টা সময় বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করেও যখন কারো দেখা মিললো না। তখন সে চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু’ফোঁটা মুছে আবারও নিজের বাড়ি ফিরে আসে। বাগানের এক কার্নিশে দোলনায় বসে স্পর্শের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকা ছবিটায় হাত বুলিয়ে দেখছে। আর ভাবছে, স্পর্শ তাকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন’ই না দেখোছিল। সবকিছু সে নিজ হাতে ধ্বংস করে ফেলল। কথাগুলো ভাবতেই মাধবীলতার বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। এভাবেই সে নীরবে, নিঃশব্দে, গোপনে অনর্গল অশ্রু’ফোঁটা ফেলেই চলেছে।
এদিকে স্পর্শ হাসপাতালের বিছানায় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। নয়নের মা স্পর্শের কাছে বসে নীরবে কেঁদেই চলেছে।
” আজ আমি যার জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে রয়েছি সেই কি-না এভাবে বিছানায় পড়ে রয়েছে।
সাগর এগিয়ে এসে আবীরকে বলল,
” আবীর ভাই আমরা আজ আসি।
আবীর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলে সাগর সুবর্ণাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়। রিকশায় ওঠার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
” পৃথিবীতে ভালো মানুষগুলো হয়তো খুব কম দিনই বেঁচে থাকে। বড্ড ভালো মনের মানুষ ছিলেন আমাদের স্যার। ওনাকে দেখলেই বুঝা যায় মানুষ কতটা উদার মনের হতে পারে। তখন আমি একদম নতুন চাকরিতে যোগদান করি। আঠারো দিন অফিস করার পর হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে যায়। হার্টের অপারেশন করাতে হতো। একে তো নতুন চাকরি তারউপর আবার মাসও শেষ হয়নি। কীভাবে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। অনেক ভেবে মনে সাহস যুগিয়ে ম্যানেজার স্যারের কাছে গেলাম। অসহায় হয়ে হাত পাতলাম। বললাম আমি আস্তে সব শোধ করে দেবো। তারপরও কাজ হয়নি। ভারাক্রান্ত মনে যখন ওনার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম তখন এক কলিগ বলল বড় স্যারের সাথে দেখা করতে। আমি তখন আরও ভয় পেলাম। ভাবলাম সামান্য ম্যানেজার আমাকে অপমান করল সেখানে মালিকের সামনে কীভাবে দাঁড়াবো? কিন্তু তিনি আমার আশ্বাস যোগালেন। অনেকটা আশা নিয়ে স্যারের কাছে গেলাম। যখন মাথানিচু করে স্যারকে বাবার অসুস্থতার কথা জানালাম! তখন মনে হচ্ছিল আমার থেকে বেশি উনিই উত্তেজিত হয়েছিল। তিনি আমাকে বললেন, আপনার বাবার চিকিৎসার জন্য যত টাকা প্রয়োজন আপনি নিয়ে যাবেন। অনেক বস তো আছে যারা, কর্মচারী হওয়ার সুবাদে টাকা দিয়ে সহানুভূতি প্রদর্শন করেন। কিন্তু তিনি স্বয়ং আমার বাবার সাথে দেখা করেন। সুস্থ মানুষের সঙ্গে কতশত গল্প করলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বাবা অসুস্থ থাকা স্বত্বেও তার মুখে হাসি লেগেই থাকতো। সবই সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র স্যারের জন্য। মানুষের মন কীভাবে জয় করতে হয় সেটার অনেক বড় উদাহরণ আমাদের স্যার। যে মানুষটা সারাজীবন অন্যের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন আজ সেই নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভুলে গেছে।
সাগরের কথাগুলো একমনে শ্রবণ করল সুবর্ণা। সাগরের কাঁধে মাথা রেখে স্বযত্নে চোখের অশ্রু মুছে নিল। সাগরকে বুঝতেও দিল না যে তার চোখে পানি।
এভাবেই কেটে যায় কয়েকটা দিন। তারপর অ্যাম্বুলেন্স করে স্পর্শ’কে তার নানা বাড়ি নিয়ে যায়।
আবীর যখন গেটে কড়া নাড়বে তখন তার হাত কাঁপছিল। সবাইকে কী জবাব দেবে সে? সে কীভাবে বলবে আমার কারণেই আজ স্পর্শ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে?
হাজারো চিন্তা নিয়ে কড়া নাড়লো। মামা এসে গেট খুলে দেয়। সামনে তাকিয়ে দেখে স্পর্শের সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। তারউপর হুইলচেয়ারে বসানো।
স্পর্শ’কে এ’অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠল তার মামা। ছুটে আসে স্পর্শের কাছে। চিৎকার করে বলতে থাকে,
” আবীর কী হয়েছে গুড্ডুর? ওর এরকম অবস্থা কেনো? কী হয়েছে ওর? গুড্ডু? বাবা তোর কী হয়েছে? কথা বল?
মামার সব প্রশ্নের উত্তর “স্পর্শ চুপ”। মামার চিৎকারে বাড়ির বাকি সদস্যরা তড়িঘড়ি করে বাইরে ছুটে আসে। নানু স্পর্শের এমন অবস্থা দেখে যেন থমকে যায়। তার পৃথিবীটা স্থীর হয়ে গেছে। এক’পা দু’পা করে এগিয়ে আসে স্পর্শের দিকে। স্পর্শের সামনে আসতেই একটা চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কান্নার রোল পড়ে যায় সবার মাঝে।
আবীর এক কার্নিশে দাঁড়িয়ে মাথানিচু করে চোখের পানি ফেলছে। তার বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই এতগুলো মানুষের চোখে পানি।
বড় মামা আবীরের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” আবীর এসব কীভাবে হয়েছে?
আবীর জবাব না দিয়ে মাথানিচু করে দাঁড়িয়েই রইলো। মামা আবীরের কলার পাকড়ে ধরে বলে,
” আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি কীভাবে হোলো এসব? কে করেছে আমাদের গুড্ডুর এমন অবস্থা?
মাথা নত রেখে আবীর বলল,
” মামা আসলে,,,,,
” কী হলো থেমে গেলে কেন? বলো কী হয়েছে ওর সাথে?
আবীর সঙ্গে সঙ্গে মামার পা’য়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
” মামা আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি না বুঝে এমনটা করেছি। আমার কারণেই,,,
” এই এক মিনিট? তোমার কারণেই মানে?
আবীর আস্তে সবকিছু খুলে বলে। আবীরের কথা শুনে বড় মামা এবং ছোট মামা! দু’জনের মাথাতেই আগুন জ্বলে ওঠে। বড় মামা দৌড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে একটা শক্তপোক্ত লাঠি নিয়ে আসে। মামার এরকম ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে স্পর্শের নানা ভয় পেয়ে যায়। কোনো অঘটন না ঘটিয়ে বসে। তাই সে তার ছেলেকে আটকাতে এগিয়ে যায়। কিন্তু তাকে উপেক্ষা করে মামা এসে সজোরে আবীরের বুকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করল।
” শু****রের বাচ্চা। যে থালাতে খেয়ে এসেছিস সেই থালাই ফুটো করলি। তোর মতো বিশ্বাসঘাতকের বাঁচার যে আর প্রয়োজন নেই। তোকে তো নিজের ভাইয়ের মতোই ভালোবাসতো রে? কীভাবে পারলি এমনটা করতে?
মারতে মারতে আবীরকে আধমরা করে ফেলেছে। তৎক্ষনাৎ নানা এসে অনেক চেষ্টার পর থামাতে সক্ষম হয়। লাঠি টা কেঁড়ে নিয়ে বলে,
” কী করছিস এটা? পাগল হয়ে গেছিস নাকি? এভাবে মারলে তো মরে যাবে সে। সে তো নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে। আর তাছাড়াও নিজের ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসে ওকে স্পর্শ। যদি কখনো আমার গুড্ডু সোনা শোনে যে তুই ওকে মেরেছিস তাহলে তোকেই তো মেরে ফেলবে।
বড় মামা কেঁদে ফেলে।
” বাবা তুমি পাগল হয়ে গেলে। আমাদের গুড্ডু আর কখনো আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারবে না।
নানা ভাইও অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলতে শুরু করে।
এদিকে মার খেয়ে আবীরের শরীরের অনেক অংশ ফেটে গেছে। তবুও তার মনে কোনো কষ্ট নেই। আবীরকে গেটের বাইরে রেখে সবাই ভিতরে চলে যায় স্পর্শকে নিয়ে। স্পর্শের নানুর এখনো জ্ঞান ফেরেনি। মিথিলা স্পর্শের খবর পেতেই ছুটে আসে। স্পর্শকে এভাবে দেখে মিথিলাও কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে বারবার। তাদের বাড়ির একমাত্র নয়নের মণি ছিল স্পর্শ। নানা নানুর বেঁচে থাকার শেষ সম্বল ছিল স্পর্শ। তাকে এভাবে কেউ’ই মেনে নিতে পারছে না।
মিথিলা আর নানুর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। সবার থেকে বেশি আঘাত পেয়েছে মিথিলা আর নানু ভাই। নানু পাথরের মতো বসে ভাবছে,” অকালেই নিজের মেয়েটাকে হারালাম। ছোট্ট ফুটফুটে নাতনিকেও হারালাম। শেষ সম্বল ছিল এই গুড্ডু’ই। আজ তুইও এভাবে আমাকে একা করে দিলি নানু ভাই!
আবীর সেভাবেই বাইরে পড়ে রইলো। রাত হলে নানা ভাই গিয়ে আবীরকে ঘরে নিয়ে আসে। আবীর নানু ভাইয়ের পা ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,
” নানু আমাকে একটা সুযোগ দিন। আমি সারাজীবন ভাইয়ার পায়ের কাছে পড়ে থাকতে চাই। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। আপনারা আমাকে যেটা ইচ্ছে শাস্তি দিন। তারপরও ভাইয়ার কাছ থেকে আলাদা করে দিয়েন না। নাহলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
নানু ভাই কোনরকমে বললেন,
” ঠিক আছে এবার থেকে উঠে দাঁড়াও। তোমাকে আর কাঁদতে হবে না।
এভাবেই কেটে যায় দু’টো মাস। একদিন মাধবীলতা স্পর্শের কথা ভাবছিল আর আপন’মনে রাস্তার ধার ধরে হাঁটছিল। কাকতালীয়ভাবে সুবর্ণা আর সাগরের সাথে দেখা হয়ে যায় মাধবীলতার। মাধবীলতা কে দেখে সুবর্ণা অনেকটা দ্রুতই চলে আসে তার কাছে।
” মাধবীলতা আপু আপনি এখানে জানেন আমি আপনাকে কত খুঁজেছি? কিন্তু কখনই পাইনি। আপনি কেমন মানুষ বলুন তো? ভালোবাসার মানুষের সুখের সময় ঠিকই পাশে থাকতে পেরেছেন! আর যখন মানুষ’টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে ঠিক তখনই তার হাতটি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন।
সুবর্ণার কথা শুনে চমকে ওঠে মাধবীলতা। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে মানে? তাহলে কী স্পর্শ এখনো বেঁচে রয়েছে? কথাগুলো ভাবতেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে তার। মাধবীলতা সুবর্ণার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে মিনতির কণ্ঠে বলল,
” বোন স্পর্শ কী বেঁচে রয়েছে?
” কেন মরে যাওয়ার কথা ছিল বুঝি? আর আমাকে একটা কথা বলুন! আপনি তো কথা বলতে পারতে না তাহলে এখন কীভাবে কথা বলছেন?
” সেসব কথা পরে বলব! এখন আপনি আমাকে দয়া করে বলুন যে স্পর্শ বেঁচে রয়েছে কি-না? আর কোথায় সে?
” আপনি সত্যিই কিছু জানেন না?
মাধবীলতা চোখের অশ্রু’ফোঁটা মুছে নিজের মনে বলে ওঠে, ” আজ আমার কারণেই হয়তো এতটা দূরত্ব।
” না বোন৷ বলুন না প্লিজ।
মাধবীলতার এমন মিনতি দেখে সুবর্ণা বলল,
” স্যার বেঁচে তো রয়েছে। তবে আর কখনো হয়তো সুস্থ হবে না। উনি কোমায় চলে গেছেন। ডক্টর বলেছে ওনার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এখন তিনি মায়াপুরীতে রয়েছে।
মাধবীলতা দু’পা পিছিয়ে যায়। স্পর্শ কোমায় চলে গেছে। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকে। বাড়ির পথে ছুট লাগালো। বাড়ি গিয়ে দরজা বন্ধ করে সেই একই কাহিনী। চিৎকার করে কান্না। মাধবীলতার সব কথা শুনে তার মা বাবা এখন আর তার সঙ্গে কথা বলেন না। এখন সবাই মাধবীলতাকে পর করে দিয়েছে। মাধবীলতা ঘর থেকে বেরিয়ে মিহিকে ডাকে। মিহি আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” মিহি তুই না বলেছিলে যে তোর ভাইয়ার কাছে যাবি। আজ নিয়ে যাব।
মিহি আনন্দিত হয়ে ওঠে।
” সত্যি বলছো আপু?
” হ্যাঁ রে বোন। তুই গিয়ে জামাকাপড় পড়ে নে। আমরা আজই যাব।
স্পর্শ ঘুমের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। স্পর্শের মাথার পাশে মিথিলা বসে রয়েছে। তার চোখে এখনো অশ্রু। পুরোনো দিনের সেই মিষ্টি স্মৃতিগুলো বারবার ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মিথিলা পড়ায় ব্যস্ত ছিল। এমন সময় স্পর্শ গিয়ে বলে,
” কিরে বুড়ী কী করছিস?
” দেখছিস না পড়ছি।
” হ্যাঁ সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ভালো করে পড়াশোনা করবি বুঝলি? অনেক বড় ডাক্তার হতে হবে তোকে। এই মায়াপুরীর অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবি সবসময়। কোনো অসহায় যেন বিনা চিকিৎসায় না মারা যায়। চেষ্টা করবি প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর। জানিস অন্যের খারাপ সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ালেও একরকম ভালো লাগা কাজ করে। নিজের প্রতিই একটা শ্রদ্ধা চলে আসে।
পুরোনো দিনের কথাগুলো মনে পড়লেই মনে হয় স্পর্শ এখনো চোখের সামনেই সুস্থ রয়েছে। আজ মিথিলা অনেকের দেখাশোনা করে ঠিকই। তবে যার দ্বারা সে অনুপ্রাণিত আজ তাকেই সে সুস্থ করে তুলতে পারছে না। নানু ভাই তো সেই থেকেই পাথর হয়ে রয়েছে। কারো সাথে কথাও বলে না ঠিকমতো। হঠাৎই হাসিখুশি মানুষটাও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে আবীর গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
” আপনি এখানে?
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,

#একটুখানি_ভালোবাসা
#পর্ব_১৯
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
স্পর্শের বাড়ির সামনে মাধবীলতা এবং মিহি দাঁড়িয়ে আছে। আবীর তাদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেবে। তৎক্ষনাৎ মাধবীলতা হাতজোড় করে মিনতি করে বলল,
” ভাইয়া দয়া করে দরজা বন্ধ করবেন না।
আবীর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
” দেখুন আমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম আপনাদের ফাঁদে পা দিয়ে। এখন নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি। জীবনের বিনিময়ে হলেও ভাইয়ার কোন ক্ষতি হতে দেব না।
মাধবীলতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
” ভাইয়া আমি স্পর্শের কোন ক্ষতি করতে আসিনি। আমিও যে ভুল বুঝেছিলাম ওকে। আমাকেও যে ভুল বোঝানো হয়েছিল ওর বিরুদ্ধে।
” দেখুন,,,,!
আবীর আর কিছু বলতে যাবে তখনি বড় মামা এসে জিজ্ঞেস করল,
” আবীর কার সাথে কথা বলছো তুমি দরজায় দাঁড়িয়ে?
মামা এগিয়ে এসে দেখে দরজার সামনে মাধবীলতা দাঁড়িয়ে আছে। মাধবীলতা’কে দেখে তার রাগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাই সে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করল।
” এই মেয়ে তোমার সাহস হলো কী করে এই বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখার? তোমার সাহস কী করে হলো আমাদের বাড়িতে আসার। তুমি জানো যে অপরাধ তুমি করেছ তার জন্য তোমাকে আমি এখনই মেরে ফেলতে পারি?
মাধবীলতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে নানু উপস্থিত হয় এবং বলে,
” কে এসেছে রে খোকা? কার সাথে এভাবে রেগে কথা বলছিস তুই?
মাধবীলতা ছুটে গিয়ে নানুর পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
” নানু ভাই দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাদের সবার বিশ্বাস ভেঙেছি। জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য। তবে আমাকে একটা সুযোগ দাও নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে। বিশ্বাস করো আমাকে ভুল বুঝানো হয়েছে। আমি কোনোকিছু বিচার করার মতো অবস্থায় ছিলাম না তখন। কোনটা ভুল কোনটা সঠিক আমি তা বুঝতে পারিনি।
মাধবীলতা হাউমাউ করে কেঁদেই চলেছে। নানুর চোখে পানি।
” কেনো করলি এমনটা তুই? কী অপরাধ ছিল আমার গুড্ডুর? কী ক্ষতি করেছিল তোর? যার জন্য ওকে মেরেই ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস? আমরা তো তোকে কতটা ভালোবাসতাম, ভরসা করতাম, বিশ্বাস করতাম। এই প্রতিদান দিলি তুই এসবের? প্রতিটি মানুষের মন ভেঙ্গেছিস তুই। আমার ছেলেরা তোর কোনো ক্ষতি করে তার আগে তুই চলে যা এখান থেকে। আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।
নানুর কথাগুলো শুনে মাধবীলতার উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। হয়তো ভাবছে এই বুঝি আমাকে বের করে দিল। সে পা’দু’টো আরো শক্ত করে ধরে বলল,
” আমাকে একটা সুযোগ দাও নানু ভাই। একটাবার আমার কথা শুনো!
” আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। তুই দয়া করে চলে যা। একবার যখন আমার গুড্ডুর বিপদের কারণ হতে পেরেছিস তাহলে আবারও যে ওকে মারবি না তার কী কোনো নিশ্চয়তা আছে? আমরা তোকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে স্পর্শের ঘর থেকে মিথিলা বেরিয়ে আসে। মাধবীলতাকে দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে মাধবীলতার চুলের মুঠি ধরে গালে লাগাতার কয়েকটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়।
” রাক্ষসী আমার ভাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছিস? কেনো রে একবার মেরে কী তোর মন শান্তি হয়নিন? তাই আবারো এসেছিস ভাইয়াকে মারতে। তোকে আজ আমি খুন করে ফেলবো।
বলেই মিথিলা আবারো মাধবীলতার চুলের মুঠি ধরে থাপ্পড় মারতে শুরু করে।
মাধবীলতা কিছু বলছে না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের বোনের উপর এমন অত্যাচার দেখে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে মিহি। মিহি দৌড়ে এসে মিথিলাকে মারতে শুরু করে।
” ছেড়ে দাও আমার আপুকে। আমার আপুকে কেনো মারছো তুমি পঁচা আন্টি? ছেড়ে দাও বলছি।
মিথিলা মিহিকে ধরে দূরে ঠেলে দেয়। মিথিলার মাথা ঠিক নেই। ছিটকে গিয়ে সোফার কোণে মাথা লেগে রক্ত বেরোতে শুরু করল। মিহির আর্তনাদ যেনো আরো বেড়ে যায়।
নানু ভাই মিথিলাকে ধরে থাপ্পড় মেরে দেয়।
” কী করছিস তুই? পাগল হয়ে গেছিস নাকি? এভাবে বাচ্চাদের উপর হাত তুলছিস। ছেড়ে দে ওদের। এভাবে যদি তুইও মারিস তাহলে ওদের আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য রইল কী? ওদের চলে যেতে বল।
এই বলে নানু ঘরে ফিরে যায়। মামা এগিয়ে এসে বলল,
” দেখো ভালোয় ভালোয় বলছি চলে যাও। নাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করতে বাধ্য হবো৷
তবুও মাধবীলতা এক’পাও নড়ছে না। মিথিলা আবারও মাধবীলতার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে বের করে দেয়। পিছন পিছন মিহিও চলে আসে৷ ওদের বাইরে বের করে দিয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। মাধবীলতা অনেকটা সময় ধরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিনতি করে ডাকাডাকি করে। কিন্তু কেউ’ই আর সাড়া দিল না। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কোথায় যাবে, কী করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে না খেয়েই ছুটে এসেছিল মাধবীলতা।
ব্যর্থ হয়ে মাধবীলতা মিহিকে নিয়ে দরজার বাইরে একটা গাছের নিচে বসে পড়ে। ওড়নার ছোট্ট অংশ ছিঁড়ে মিহির মাথায় বেঁধে দেয়। মিহি এখনো ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। মাধবীলতার গাল’দুটো ব্যথায় টনটন করছে। মিহি’কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
” কাঁদে না বোন। একটু পর ব্যথা কমে যাবে দেখো।
” আপু ওরা তোমায় মারছিল কেনো? আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল তোমাকে মারতে দেখে।
মাধবীলতা মিহির মাথা বুকে চেপে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে আর ভাবছে,
” যদি এতটুকুতেই তোর এতো কষ্ট হয় তাহলে আমি যখন ওকে মেরেছি তখন তাদের কতটা কষ্ট হয়েছে? আমার গালে সামান্য কয়েকটা থাপ্পড় পড়াতেই কতটা যন্ত্রণা হচ্ছিল। আর যখন স্পর্শকে ছুরির কোপ দিয়েছি তখন তার কতটা যন্ত্রণা হচ্ছিল? তারপরও সে আমার খারাপ চায়নি। মুখে হাসি টেনে বলেছিল সুখী হও তোমার নতুন জীবনে। মানুষ কতটা ভালোবাসতে পারলে এতো কষ্ট দেওয়ার পরও ঘৃণা করে না।
এভাবেই রাত গভীর হতে থাকে। মিহি ক্ষুদার্থ হয়ে গেছে। বারবার খাবারের কথা বলছে মাধবীলতা’কে।
” বোন রে একটু কষ্ট সহ্য করে থাক। কাল সকালে কিছু না কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
মাধবীলতা মিহির কান্না থামাতে ব্যস্ত। আর এদিকে যে খিদের যন্ত্রণা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই।
আস্তে আস্তে দুজনে ঘুমিয়ে পড়েন।মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় মাধবীলতার। কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপছে দু’জনে।
মাধবীলতা ওড়না দিয়ে মিহিকে পেঁচিয়ে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তবুও ঠাণ্ডা যেন ছাড়তেই চাচ্ছে না।
সকালে ঘুম উঠে নানু ব্যালকনিতে এসে হাই তুলছে। এমন সময় চোখ যায় বাড়ির বাইরে গাছের নিচে। মাধবীলতা মিহিকে জড়িয়ে ধরে ধরে ঘুমোচ্ছে। শীতের সকালে কেঁপেই চলেছে দু’জন।
নানু ভাই একদৃষ্টিতে মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
” আচ্ছা ওদের প্রতি এই অন্যায় টা কী ঠিক করছি আমি? এতটা অমানবিক হয়ে গেছি আমি? পরক্ষণেই আবার ভাবে মাধবীলতাকে নিয়ে আমি কেনো এতো ভাবছি। সে তো আমার নাতিকে মারার সময় ভাবেনি।
সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে যায়। এখনো তারা গাছের নিচেই বসে রয়েছে। এদিকে খিদের যন্ত্রণায় মিহি ছটফট করছে। মিহির এমন করুণ অবস্থা দেখে নানুর মন কিছটা নরম হয়। আবীরকে ডেকে বলে,
” ওদের গিয়ে কিছু খাবার দিয়ে এসো। কাল থেকে হয়তো না খেয়ে আছে। আর মিহি তো কোনো অপরাধ করেনি। সে কেনো শাস্তি পাচ্ছে। খাবার আর পানি দিয়ে এসো।
আবীর নানুর কথামতো খাবার আর পানি নিয়ে মাধবীলতার সামনে যায়। খাবার পাশে রেখে মাধবীলতাকে ডাকে। দু’জন খাবার দেখেই খাওয়া শুরু করে। কে দিয়েছে সেদিকে তাকালো না। এমনভাবে খাচ্ছে মনে হয় কতদিন ধরে ক্ষুদার্থ তারা। দু’জনের এমন করুণ দশা দেখে নানুর মনও কেমন অশান্ত হয়ে। সে ঠকালে কী হবে? ওদের বাড়ির সবাই তো ঠিকই ভালোবেসেছিল মাধবীলতা’কে। খাবার শেষে মাধবীলতা সামনে কারো পা দেখতে পায়। তাকিয়ে দেখে আবীর। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে নেয়।
বিকেলবেলার মিথিলা হুইলচেয়ারে করে স্পর্শকে নিয়ে বাইরে বের হয় আশেপাশের ঘোরানোর জন্য। স্পর্শকে দেখে মাধবীলতা ছুটে আসে। যখনি স্পর্শকে ছুঁয়ে দেবে তখনই মিথিলা ওকে বাঁধা দেয়।
” এই মেয়ে তুই এখনো এখানে? আর খবরদার আমার ভাইয়াকে স্পর্শ করবি না তোর ওই নোংরা হাত দিয়ে স্পর্শ করলে না জানি নতুন কোন বিপদ আসবে। আমার ভাইয়ার থেকে দূরে থাকবি। নাহলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম। নিজের সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা কর। আগে হয়তো তুই এই বাড়ির সকলের নয়নের মণি ছিলি। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। তুই নিজের দোষেই সবার ভালোবাসা হারিয়েছিস। একটা প্রবাদবাক্য শুনেছিস নিশ্চয়ই? পায়ের জিনিস কখনো মাথায় তুলতে নেই।
চলে যায় মিথিলা।
মিথিলার প্রতিটি বাক্য ছিল ধারালো ছুরির মতো। প্রতিটি কথা মাধবীলতার বুকে এসে বিঁধেছে। আজ কতগুলো দিন পরে স্পর্শকে সে এতটা কাছ থেকে দেখেও ছুঁয়ে দিতে পারলো না। এমনিতেই অন্য সময়ে মাধবীলতা যখন চাইতো স্পর্শের বুকে বিড়ালছানার মতো ঘাপটি মেরে মাথা রাখতে পারতো। আর আজ এতটা কাছে থেকেও দূরত্ব’টা যেন এক আকাশ সমান। মিহি মাধবীলতার জামা ধরে টেনে বলল,
” আপু আমি ভাইয়ার কাছে যাব।
মাধবীলতা মিহির গালে হাত বুলিয়ে বলে,
” না রে বোন। ওরা আমাদের যেতে দেবে না।
এভাবেই কেটে যায় আরো দু’টো দিন। মাধবীলতা আর মিহি বাড়ির বাইরেই কাটিয়ে দেয় দু’দিন। নানুর মনে মায়া হয়। একটা সময় সবাই কিছুটা গলে যায় মাধবীলতা আর মিহির কষ্ট দেখে। সকালে বাইরে ঘুমিয়ে ছিল। নানু আবীরকে বলে তাদের ভিতরে নিয়ে আসতে। আবীরও তাই করে। মাধবীলতা গোসল সেরে মিথিলার একটা শাড়ি পড়ে নেয়। মাধবীলতা গোসলে যাওয়ার পরে মিথিলা মিহিকে কাছে ডাকে। কিন্তু মিথিলার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে মিহি। যদি আবারও সে মারে।
” না আমি তোমার কাছে যাব না। তুমি খুব পঁচা আন্টি। তুমি আমাকে মারবে।
মিথিলার মনটা খারাপ হয়ে যায়। রাগের মাথায় অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মিহিকে। মিথিলা গুটিগুটি পায়ে মিহির সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে।
” আর কখনো তোকে কষ্ট দেবো না সোনা। আমার ভুল হয়ে গেছে।
বলেই মিহির কপালে আদর দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । সবাই মিহিকে আদর করলেও মাধবীলতা আর সেই পুরোনো ভালোবাসা পেলো না।
মাধবীলতা স্পর্শের ঘরে গিয়ে দেখে স্পর্শে শুয়ে রাখা হয়েছে। আজ তার জন্যই স্পর্শ চিরকালের জন্য শুয়ে রয়েছে।
মাধবীলতা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে স্পর্শের মাথার কাছে বসে। স্পর্শ এতক্ষণ জেগে থাকলে হয়তো মাধবীলতা তার বুকে মাথা রাখতো। মনে পড়লো সেই পুরোনো দিনের কথা। মাধবীলতা যখনই সুযোগ পেতো তখনি স্পর্শের বুকে মাথা রাখতো। আর স্পর্শ সবসময় মাধবীলতার কপালে আদর দিয়ে দিতো। একবার মাধবীলতা স্পর্শকে প্রশ্ন করে,
” আচ্ছা আপনি সবসময় আমার কপালেই কেনো চুমু দেন।
” তার আগে বলো তুমি সবসময় আমার বুকে মাথা রাখো কেনো?
” আপনার বুকে মাথা রাখলে আমি শান্তি পাই তাই। সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় তাই।
” তোমার যেমন আমার বুকে মাথা রাখতে ভালো লাগে, শান্তি খুঁজে পাও। ঠিক তেমনিভাবে আমারও তোমার কপালই সবচেয়ে বেশি পছন্দের। তোমায় জড়িয়ে ধরে যখন তোমার কপালে আমার ঠোঁটে ছুঁয়ে দিই। তখন মনে হয় সব ক্লান্তি এক নিমেষেই দূর হয়ে যাচ্ছে।
চোখে পানি থাকা সত্ত্বেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে মাধবীলতার। মাধবীলতা একটু ঝুঁকে তার কপাল স্পর্শের ঠোঁটে আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। তারপর কী মনে করে মাধবীলতা স্পর্শের ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যায়। স্পর্শের ঠোঁটে আলতো করে মাধবীলতা তার ঠোঁট রাখে। আস্তে আস্তে গভীরভাবে ঠোঁট বসিয়ে দেয় স্পর্শের ঠোঁটে। গভীর আদর দিতে থাকে স্পর্শকে।(😋😋😋😋🙈🙈🙈🙈)
এমন সময় পিছন থেকে শুনতে পায়,
” কিরে ঘুমন্ত ছেলেটার সাথে আদর সোহাগ করছিস?
নানুর কথা শুনে মাধবীলতা সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শের ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নানুকে দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়ায় মাধবীলতা।
নানু কিছুটা এগিয়ে এসে বলে,
” আফসোস লাগছে তাই না? ঘুমন্ত মানুষকে আদর করছিস। কেনো এমন করলি বল তো?
মাধবীলতার চোখের কোণ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
” নানু আমি বুঝতে পারিনি। আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমার খালার মৃত্যু হয়। আমার খালাতো ভাই আমাকে বলে যে স্পর্শই নাকি তার বাবা মা’কে মেরেছে। সে আমার সামনে কান্নাকাটি করতো সবসময়। কিন্তু আমি এটা জানতাম না যে আমার খালু স্পর্শের মা বাবা এবং বোনকে হত্যা করেছে। খালাতো ভাই আমাকে যা বুঝিয়েছে সেটাই বুঝে এসেছি। তারপর যখন স্পর্শ’কে আঘাত করি। তখন সে সবকিছু খুলে বলে আমাকে। তারপর আমিও সব সত্যি জানতে পারি। এবং নিজ হাতে ওকে মেরে ফেলি। তারপর প্রতিটি রাত কাটাতাম কেঁদে কেঁদে। ভাবতাম আমার ভুলের কারণেই স্পর্শ মরে গেছে। কয়েকবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরে স্পর্শের কথা মনে পড়লে সেটা করতে পারিনি। কেননা স্পর্শ আমাকে প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচতে শিখিয়েছে। আমি অনেককিছু শিখেছি ওর থেকে। তারপর হঠাৎই একদিন স্পর্শের অফিসের এক কর্মচারীর সঙ্গে দেখা হয় রাস্তায়। তার কাছে জানতে পারলাম স্পর্শ বেঁচে রয়েছে। তখন সবকিছু ফেলে চলে আসি এখানে।
কথাগুলো বলেই কেঁদে ফেলে মাধবীলতা।
মাধবীলতার কথাগুলো শুনে নানুর মন কিছুটা হাকলা হলো। রাগও অনেকটাই কমে যায়।
” তোদের সামান্য একটা ভুলের কারণে আজ আমার গুড্ডু টা এভাবে,,,,,!
নানু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে চলে গেল। মাধবীলতার প্রতিটি রাত কাটে স্পর্শের পায়ের কাছে বসে কেঁদেকেটে।
গভীর রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে দু’হাত পেতে ভিক্ষা চায় স্পর্শের সুস্থতা। প্রতি ওয়াক্তে নামাজের শেষে প্রাণভরে কেঁদে ফরিয়াদ করে।
মাধবীলতার এরূপ কাণ্ড দেখে স্পর্শের পরিবারের সকলের মন থেকে মাধবীলতার জন্য জমে থাকা রাগ একেবারেই মুছে যায়। ভুল প্রতিটি মানুষেরই হয়। কেউ জেনে করে আর কেউ বা করে না জেনে।
মাধবীলতা প্রতিদিন একবার করে হলেও তার কপাল স্পর্শের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। কেননা মাধবীলতার কপাল’ই ছিল স্পর্শের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা আদর দেওয়ার জন্য।
এভাবে কাটতে থাকে দিন। একদিন নানু ভাই মাধবীলতা’কে ডেকে বলে,
” এভাবে আর কতদিন একা একা কাটাবি? বিয়ে তো করা উচিৎ তোর। তোরও একটা ভবিষ্যৎ আছে তাই না? আমাদের গুড্ডু সোনা যে কখনো সুস্থ হবে সেটারও তো নিশ্চয়তা নেই। তুই বরং বিয়ে করে নিজের সংসার গুছিয়ে নে বোন।
মাধবীলতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশার কণ্ঠে বলে,
” আমার আবার নতুন করে কিসের ভবিষ্যৎ হবে বলো নানু? নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি! যে মানুষটা আমাকে তার নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতো সেই মানুষটাই আজ আমার কারণে অসুস্থ। এখন আমি তাকে ফেলে কী করে নতুন করে সংসার সাজাতে পারি বলো? আমি চাই না তোমার গুড্ডু ছাড়া আমার আর কোনো ভবিষ্যৎ হোক।
” কিন্তু,,,!
” কোনো কিন্তু নয়। তুমি কী চাও আমি অন্য কারো সংস্পর্শে যাই? আমি শুধু তোমার গুড্ডু সোনার স্পর্শে নিজেকে রাঙাতে চাই। আমি ওর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতেও রাজি।
নানু ভাই টিটকারি মেরে বলে,
” কেনো রে আমার নাতির ছোঁয়ায় কী পেয়েছিস শুনি? জানিস তোর নানা আমায় কীভাবে আদ,,,,,!
” ধুর বুড়ী। তোমার মুখে কিছু আটকায় না। সুযোগ পেলেই শুধু এসব কথা। বুড়ী হয়ে গেছে কিন্তু দুষ্টুমি কমেনি এখনো।
কেটে গেল পাঁচটি বছর। স্পর্শ এখনো সেই আগের মতোই রয়েছে। সবাই একবুক আশা নিয়ে বসে থাকে এই বুঝি তাদের গুড্ডু সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু সবসময় হতাশাই হয় তাদের পুরষ্কার।
মিথিলার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। হাঁটা শিখেছে। গুটিগুটি পায়ে হাঁটে বাবুটা। মিহিও অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। তবে সে তার বাবা মায়ের কাছেই থাকে। মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যায় সবার সঙ্গে।
সেদিন মিথিলার মেয়ে বল নিয়ে খেলছিল স্পর্শের ঘরে। রাতটি ছিল বর্ষার রাত। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। মিথিলার মেয়ে মেহের খাটে উঠে স্পর্শের বুকের উপর উঠে বসে। তারপর আস্তে আস্তে নাকে কামড় দিতে থাকে। হঠাৎই মেহের স্পর্শের কপালে মারতে শুরু করে। সবাই গল্প করছিল। হঠাৎ মিথিলা দেখে মেহের স্পর্শের কপালে মারছে। মেহের যখন স্পর্শকে মারছিল ঠিক তখনি এতটাই জোরে বিদ্যুৎ চমকায় যে মেহের ভয়ে কেঁদে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে মিথিলা এসে মেহের’কে কোলে নেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ