#একটুখানি ভালোবাসা
#পর্ব_৬_৭
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
মামার সঙ্গে ভাব বিনিময় করে নিলাম। মামা মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো,
‘- ওরা কারা?
‘- ওরা তোমাদের বাড়ির নতুন মেহমান। এখন কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি চলো! নানু আমার জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো।
‘- মা তো তোর জন্য সেই ভোরবেলা থেকেই তো অপেক্ষা করে রয়েছে তুই আসবি বলে। মা বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছে, হ্যাঁ রে খোকা! আমার নানু ভাই কখন আসবে? আমার তো আর তর সইছে না। কতদিন হয়ে গেল আমার কলিজার টুকরা’টাকে দেখিনা। এখন তাড়াতাড়ি চল। নাহলে আবার আমাকে এতগুলো বকে দেবে।
সবাই গাড়িতে উঠলাম। যাক মাধবীলতার ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে সবাইকে কি জবাব দেবো? সত্যিটা বলে দিলে যদি সবাই আমাকে উল্টোপাল্টা ভেবে বসে? তাহলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আপাতত এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিই। যা হবার হবে।
‘- কিরে এত ভাবুক চাহনিতে কি ভাবছিস?
‘- কিছু না মামা। আজ অনেকদিন পর নানা নানুর সঙ্গে দেখা করব তো তাই অনেক খুশি লাগছে।
মায়াপুরীর মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। আঁকাবাঁকা পথে আপন গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি। চারিদিকে মাঠ’ভরা সোনালি সব ফসল।
হঠাৎই পিছন থেকে মিযহি প্রশ্ন করে ওঠে,
‘- ভাইয়া আমরা কোথায় এসেছি?
মিহি এখনো বুঝতেই পারেনি আমরা কোথায় যাচ্ছি।
‘- আমরা আমার নানু বাড়ি যাচ্ছি বুড়ী।
এবার মিহি মাধবীলতাকে জিজ্ঞেস করে বসে,
‘- আপু আমি আমার নানু বাড়ি কবে যাবো। আমাকে কবে নিয়ে যাবে তুমি? আচমকাই মিহির এমন বাক্যে মাধবীলতার হাস্যজ্বল মুখটা মলিন হয়ে গেলো। তাদের এই পৃথিবীতে আপন বলতে যে কেউ-ই আর বেঁচে নেই। তাহলে তারা যাবে কোথায়?
উত্তর দিতে না পেরে মাধবীলতার চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
মিহি আবার বলে ওঠে,
‘- কী হলো আপু বলছো না কেনো?
‘- আরে মিহি আমার নানু বাড়িই তো তোমার নানু বাড়ি।
মিহি খুশিতে হাততালি দিতে লাগলো।
যাক মিহিকে থামানো গেছে। মাধবীলতার মুখে স্বস্তির ছাপ।
কিছুক্ষণ পর সবাই নানু বাড়িতে চলে এলাম। বাড়ির সকলেই উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। নানা, নানু, বড় মামা, মামি আর তাদের সন্তানসহ সবাই।
আমি গাড়ি থেকে নেমেই নানুকে জড়িয়ে ধরি।
নানু বাড়ি আবেগে কেঁদেই ফেলল। তার একমাত্র মেয়ের ছেলে আমি। কষ্ট তো হবেই এতগুলো বছর না দেখে। নানু আমার কপালে, গালে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিলেন৷
‘- কেমন আছিস নানু ভাই? এতদিন পর মনে পড়লো এই বুড়ীর কথা?
‘- এখন তোমাকে দেখার পর অনেক ভালো আছি নানু। আর কাজের অনেক চাপ তাই আসতে পারিনি। তবে দেখো এইযে এসে গেমাল।
তারপর নানা ভাইকেও জড়িয়ে ধরলাম। একে একে সবার সঙ্গেই ভাব বিনিময় করলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম সবাই আমার পিছনে তাকিয়ে আছে। আমিও পিছনে তাকিয়ে দেখি মাধবীলতা আর মিহি। সবাই হয়তো ভাবছে ওরা কে? এইরে এতক্ষণ তো ওদের কথাই ভুলে গেছিলাম। আমি গিয়ে তাদের এগিয়ে নিয়ে এলাম।
হঠাৎ নানু ভাই আমাকে মারতে মারতে বলল,
‘- তুই আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিস?
‘- আরে তুমি যেমনটা ভাবছো তেমনটা নয়।
‘- তাহলে কেমন কিছু? হায় আল্লাহ আমার এই দিন দেখার বাকি ছিল।
এই হলো গ্রামের বুড়ো বুড়িদের কাহিনী। কিছু হতে না হতেই কপাল চাপড়াবে।
‘- আরে সে আমার বউ নয়।
‘- তাহলে কী?
বাধ্য হয়ে সব বলে দিলাম।
সব শুনে নানু মাধবীলতাকে কাছে টেনে নিয়ে মুখে হাত বুলিয়ে বলল,
‘- মন খারাপ কোরো না বোনটি। এখন তুমিও আমাদের পরিবারের সদস্য।
মাধবীলতা শুধু মুচকি হাসি দেয়।
নানু আবার আমাকে বলে,
‘- হ্যাঁ রে গুড্ডু! মেয়েটা তোর বউ হলেও মন্দ হতো না৷
লও ঠ্যালা! একটু আগেই কপাল চাপড়াচ্ছিল তাদের না বলে বিয়ে করেছি বলে। আর এখন বলছে কি-না বউ হলে মন্দ হতো না। বুড়ীর ভাবগতি বুঝা বড়ো কঠিন।
নানুর কথা শুনে মাধবীলতা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। এই বুড়ী কখন কোথায় কী বলে তার কোনো ঠিকঠিকানা নাই। ব্রেক ছাড়া গাড়ির মতো মুখ ফসকে যা খুশি বলে দেয়।
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ আমার হাত টেনে ধরে। তাকিয়ে দেখি মিহি। মুখটা উপরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘- ভাইয়া তুমি তো তখন বললে তোমার নানু ভাই আমারও নানু ভাই। কিন্তু নানু ভাই শুধু তোমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমাকে জড়িয়ে ধরলো না কেনো?
ইশ কী মায়াভরা বাক্য। এমন নিষ্পাপ চাহনি।
মিহির এমন মিষ্টি চাওয়া নানু ভাইয়ের চোখ থেকে পানি বের করেই ছাড়লো। নানু আর দেরি না করে সাপটে জড়িয়ে ধরে মিহিকে। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। সবার বুঝতে বাকি রইলো না নানু কেনো কাঁদছে। শুধু মাধবীলতা ছাড়া।
নানু মিহির সারা মুখে চুমু দিয়ে বলে,
‘- এখন থেকে তোকে এই বুকেই রাখবো সোনা৷ তুই আর মন খারাপ করিস না।
নানুকে তুলে বললাম,
‘- নানু এরকম বাচ্চাদের মতো কথায় কথায় কান্না করো কেনো বলো তো? চোখের পানি ফেললে কী তুমি অতীতকে ফিরে পাবে? মনকে শক্ত রাখো।
নানু ভাই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,
‘- মনকে বোঝানো কী এতই সহজ কাজ নানা ভাই? মেয়েটা আমার! তাই কষ্টও আমারই হয়।
নানু আবারো ডুকরে ডুকরে কাঁদতে শুরু করল। নানু’কে পুনরায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে তার মাথায় চুমু খেয়ে বললাম,
‘- উফফ নানু! এবার তো কান্না বন্ধ করো প্লিজ। এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করলে মানুষ কী ভাববে বলো? তারচেয়ে বরং ভিতরে চলো। ভিতরে গিয়ে যতখুশি কান্না করো।
সবাই মিলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু এখনো একজনকে দেখতে পেলাম না। তাই মামীকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘-মামী পিচ্চিটা কোথায়?
মামী হেঁসে উত্তর দিল,
‘- ও আর পিচ্চি নেই রে বাবা। ভার্সিটিতে পড়ে, অনেক বড় হয়ে গেছে।
‘- সে না হয় বুঝলাম! কিন্তু আসার পর থেকে ওকে দেখতে পেলাম না। কোথাও গেছে নাকি?
‘- না কোথাও যায়নি। তুই অনেক বছর ওর সাথে কথা বলিস নি তো তাই অভিমান করে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলেছে তোর সাথে নাকি দেখা করবে না, কথাও বলবে না।
‘- আচ্ছা এই ব্যাপার? আমিও দেখি কতক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে।
আমি সোজা চলে গেলাম ছাদে। ছাদের এক কোণে আমার মামাতো বোন মিথিলা দাঁড়িয়ে আছে।
পা টিপে টিপে মিথিলার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম আর জোরে একটা চিৎকার করলাম। সঙ্গে সঙ্গে মিথিলা চমকে উঠে পিছনে তাকালো। আমাকে দেখেই বুকে কয়েকটা কিল-ঘুষি মেরে আরেক কোণে গিয়ে দাঁড়ালো।
ওর সামনে দাঁড়িয়ে কান ধরে বললাম,
‘- স্যরি বুড়ী। আর রাগ করে থাকিস না। দেখ আমি চলে এসেছি। এবার অনেকদিন কাটাবো তোদের সাথে।
নাহ মেয়ে কোনোভাবেই কথা বলছে না।
‘- ঠিক আছে কথা যখন বলবিই না তখন থেকে আর কী করব? চলেই যাই।
আচমকাই মিথিলা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। বুঝলাম এরা সবাই এমন কথায় কথায় কাঁদে কেনো?
মিথিলার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলি,
‘- তোদের সবার এতো আবেগ আসে কোথা থেকে? পান থেকে চুন খসলেই কাঁদতে শুরু করে সবাই।
‘- কুত্তা এটা পান থেকে চুন খসার মতো কিছু? তুই ৫-৬ বছর হয়ে গেলো আমাদের দেখতে আসিস নি।
‘- হয়েছে এবার রাগ অভিমান সব বাদ দিয়ে নিচে চল। সবাই কেমন যেন বাচ্চাদের মতো আচরণ করে।
মিথিলা আমাকে মুখ ভেংচি কেটে নিচে নেমে গেলো।
অগত্যা আমিও ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকতেই মাধবীলতাকে সামনে পেলাম। হাতে কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘- কিছু বলবেন?
কাগজটা বাড়িয়ে দিল,
‘- আপনি তখন কোন অতীতের কথা বললেন? আর নানু কোন মেয়ের কথা বলল?
মাধবীলতার কথায় একটু আৎকে উঠলাম।
‘- তেমন কিছু না। সময় হলেই নাহয় জেনে যাবেন।
এমন সময় ঘরে মিথিলা আসে হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে। আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখে ও কেমন আঁড়চোখে তাকালো।
‘- আমার ভাবী নাকি ভাইয়া? ভাবী তো দেখতে অনেক মিষ্টি।
‘- গ্লাস টা রেখে তাড়াতাড়ি চলে যা। সবসময় দুষ্টুমি।
‘- হুহ যাচ্ছি।
আবারও ভেংচি কেটে চলে গেলো। এর মুখ টা এতো বাকা হয় কেনো বারবার? মাধবীলতাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘- আসলে এই বাড়ির সদস্যরা একটু রসিক মানুষ কি-না! ওদের কথায় কিছু মনে করবেন না।
সে আবারও কিছুক্ষণ লিখে কাগজটা হাতে দিয়ে মিথিলার মতো মুখ ভেংচি কেটে চলে গেলো।
হোয়াদ্দা? এ আবার এসব কোথায় শিখলো? ইচ্ছে করে ভেংচি দিল নাকি আপনা-আপনি হয়েছে?
কেটে গেল একটা দিন।
বিকেলবেলা ঘুরতে বের হলো বলে ঠিক করলাম। আমি, মাধবীলতা আর মনে মিথিলা বের হলাম। আসার সময় মিহিকে ডাকলাম কিন্তু এলো না। ড্রয়িং রুমে সে নানুর কোলে বিড়ালছানার মতো চুপটি করে বসে নানুর আদর খাচ্ছে। বিষয়টি দেখে মাধবীলতার মনে এক অন্যরকম ভালোলাগার সৃষ্টি হয়। আসার পর থেকে নানু ভাই মিহি’কে একদম নিজের কাছে নিয়ে নিয়েছে। হয়তো কারো অভাবকে মিহি পূর্ণতা দিচ্ছে।
আঁকাবাঁকা পথে হাঁটছি আর গল্প করছি। একটা সময় নদীর তীরে এসে পৌঁছালাম। ছোট ছোট বাচ্চারা মহানন্দে নদীর পানিতে সাঁতরাচ্ছে। কেউ নদীর এপার থেকে ওপারে সাঁতরে পার হচ্ছে আবার কেউ মাঝ নদীতে গিয়ে হাঁসের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে।
অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য ছোটবেলায় ফিরে গেলাম। একটা সময় ছিল! যখন সময়ে অসময়ে আমিও এভাবে নদীতে ঝাঁপ দিতাম। মনের আনন্দে সাঁতার কেটে পাড়ি দিতাম নদীর এপার ওপার।
‘- এত কী ভাবছো বলতো ভাইয়া?
‘- তেমন কিছু না রে! ছোটবেলার কথা ভাবছিলাম। কতই মিষ্টি ছিল সেই দিনগুলো। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো মনে পড়লে আজও শরীরটা শিউরে ওঠে! জীবনটা যদি সেই ছোট্টবেলায় থমকে যেত?
‘- তোমার জীবন যদি সেই ছোট্টবেলায় থমকে যেত তাহলে আমরা আর এই পৃথিবীতে আসতাম না।
‘- তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। কিন্তু তোর মতো ভূত-পেত্নী পৃথিবীতে না আসলেই ভালো হোতো।
আমরা এভাবে দুই ভাইবোন ঝগড়া করছি আর আমাদের মিষ্টি ঝগড়া দেখে মাধবীলতা মিটিমিটি হাসছে।
এভাবে আরো কিছুটা সময় প্রকৃতির ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাড়িতে ফিরলাম।
সন্ধ্যার কিছুটা পরে লোডশেডিং হওয়ায় সবাই উঠোনে বসে আবছা আলোয় আড্ডা দিচ্ছি। পরিষ্কারভাবে দেখাও যাচ্ছে না। মাধবীলতা আমার পাশেই বসা ছিল।
হঠাৎই আমাদের মাথার উপর দিয়ে কিছু উড়ে যাওয়ায় মাধবীলতা ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,
#একটুখানি_ভালোবাসা
#পর্ব_৭
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
মাধবীলতার গরম নিঃশ্বাস আমার বুকে আছড়ে পড়ছে। মাধবীলতা এভাবে আমাকে আচমকাই জড়িয়ে ধরবে তা আমার কল্পনার ভাবনার ছিল। এদিকে ক্রমশ আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার গরম নিঃশ্বাসে আমার বুকটা পুড়ে যাচ্ছে। এতটাই ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছিল সে। যদিও মাধবীলতা’র জড়িয়ে ধরাটা ছিল শুধুমাত্র একপাক্ষিক। তবুও আমার অনুভূতি জানান দিচ্ছে অন্য কিছু। মস্তিষ্ক সায় না দিলেও মন বারবার বলে উঠছে,
‘- আরে পাগল দু’হাত বাড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে নে। আগলে রেখে দে বুকের অতল গহ্বরে।
তবুও এভাবে একটা মেয়ের অসহায়তার সুযোগ নেওয়াটা মোটেই ভালো কাজ হবে না। তবে আমি যদি উচ্চস্বরে বলি যে,
‘- আমাকে ছেড়ে দিন।
তাহলে বাড়ির লোকজন শুনে ফেলবে।
তাই মুখটা মাধবীলতার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
‘- এভাবে আর কতক্ষণ জড়িয়ে রাখবেন? ছেড়ে দিন।
কিন্তু মাধবীলতা এতটাই ভয় পেয়েছে যে ছাড়াছাড়ির কোন নামই নেই। আবারো তার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
‘- দেখুন ভয় পাওয়ার মত কিছু হয়নি। রাত হলে গ্রামাঞ্চলে বাদুড় উড়ে বেড়ায়। ওটা বাদুড়-ই ছিল হয়তোবা। তাই ভয় না পেয়ে ছেড়ে দিন। আর তাছাড়াও যখন তখন বিদ্যুৎ চলে আসতে পারে। তখন যদি বাড়ির সবাই দেখে যে আমরা এভাবে রয়েছি তাহলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। অন্য কোন সময় নাহয় লোকচক্ষুর আড়ালে আমার বুকে মাথা রাখবেন।
সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতা আমাকে ছেড়ে দিল। হয়তো শেষের কথাটা শুনে লজ্জা পেয়েছে।
মাধবীলতা আমার পেটে একটা চিমটি কেটে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে।
নানু জিজ্ঞেস করল ‘- কী হয়েছে গুড্ডু?
‘- কিছু হয়নি নানু। ওই একটা বড় পিঁপড়ে চুমু দিয়েছে। তাও আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
‘- কী বলিস তুই? পিঁপড়ে আবার কবে থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু দেওয়া শুরু করেছে?
‘- কী যে বলিস কিছুই তো মাথায় ঢোকে না।
‘- ও’ তোমার মাথায় ঢুকবে না। ওইযে বিদ্যুৎ মামা চলে এসেছে।
ওমা! মাধবীলতা আমার দিকে চোখ বাঁকা করে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বোধহয় রেগে গেছে পিঁপড়ে বলায়।
মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন অদ্ভুত সব আচরণ করে! মনে হয় কত বছরের পূর্বপরিচিত আমরা।
একে একে সবাই উঠে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। শুধু রয়ে গেলাম আমি আর মাধবীলতা। সে এখনো সেই দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রয়েছে।
মাধবীলতা হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল,
‘- আমি আপনাকে কখন চুমু খেলাম?
বেশ কয়েকদিন ওর সাথে চলাফেরা করে তার ইশারা মোটামুটি বুঝতে শিখে গেছি।
আমিও উত্তরে বলি,
‘- আমি কখন বললাম আপনি আমাকে চুমু দিয়েছেন?
‘- একটু আগে নানুকে কী বললেন? পিঁপড়ে আপনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়েছে। আমি পিঁপড়ে?
আমি খানিকটা সময় হেঁসে নিয়ে বললাম,
‘- ভুল তো কিছু বলিনি। আপনি আমার বুকে নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়েছেন। বিশ্বাস না হলে নিজেই দেখে নিন।
মাধবীলতা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে ওর ঠোঁটে দেওয়া লিপস্টিকের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাই সেখানে আর একমুহূর্ত না থেকে ছুটে চলে গেল বাড়িতে।
এদিকে মাধবীলতার কাণ্ডে আমার হাসি থামে না।
কিছুক্ষণ পর রাতের খাবার সময় হলে আমিও ভিতরে প্রবেশ করি। সবাই খাওয়া শেষ যে যার ঘরে চলে গেলো। মিথিলাকে বললাম আমার ঘরে কফি পাঠাতে। কিছুক্ষণ পর মিথিলা কফি দিয়ে গেলো
বেশ তাড়াহুড়োয় আছে মনে হচ্ছে।
ঘরে মন না বসায় কফির মগ নিয়ে ছাঁদে গেলাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এতো রাতে ছাদ থেকে কারো কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এতো রাতে ছাদে কে থাকবে? কৌতূহল মেটাতে চারিদিকে চোখ বোলাতে থাকি। হঠাৎ মিথিলাকে ছাদের এক কোণে দেখতে পাই। গুটিগুটি পায়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম৷ মিথিলা কেঁদে কেঁদে কারো সাথে কথা বলছে? কিন্তু ও কাঁদছে কেনো?
শীতল কণ্ঠে ডাক দিলাম,
‘- মিথু?
মিথিলা চমকে উঠে পিছনে তাকায়। আমায় দেখে ভয়ে ঢোক গিললো। থতমত খেয়ে বলে,
‘- ভা ভাইয়া তুই এতো রাতে এখানে?
‘- একই প্রশ্ন তো আমারও! এতো রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলিস? আর কেনই বা কাঁদছিস? কেউ কী তোকে কিছু বলেছে?
‘- না ভাইয়া কেউ কিছু বলেছি। এমনিতেই বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। হঠাৎ চোখে কী যেন পড়লো তাই চোখ দিয়ে পানি পরছে।
এই বলে মিথিলা চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলো।
‘- এই মিথু শোন।
নাহ চলেই গেলো। কিন্তু ও কাঁদছিল কেনো? আসলেই কী চোখে কিছু পড়েছে নাকি অন্য কিছু?
এসব ভাবনাচিন্তা বাদ দিয়ে আকাশ পানে দৃষ্টিপাত করলাম। চাঁদের আবছা আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। মিটিমিটি হাসছে। চাঁদ মামার সঙ্গে গল্প করে কফি শেষ করে ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকালে নামাজ শেষ করে আবারও ঘুমিয়ে পড়ি। তবে ঘুমটা বেশিক্ষণ টিকলো না। বাড়ির লোকেদের কোলাহলে ঘুম ভেঙেই যায়। কিন্তু সবাই বাড়িটাকে এভাবে হাটবাজারে পরিণত করেছে কেনো?
বিছানা ছেড়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে বাইরে বেরোলাম।
সবাই রান্নাবান্নার কাজে হাঙ্গামা লাগিয়ে দিয়েছে।
বড় মামিকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘- এতো রান্নার আয়োজন কেনো মামি?
‘- সেকি’রে তুই জানিস না? আজ তো মিথিলাকে দেখতে আসবে।
‘- দেখতে আসবে মানে? ওকে আবার কে দেখতে আসবে?
‘- ছেলেপক্ষের লোকেরা। তোর বড় ৃামা ওর বিয়ে ঠিক করেছে।
‘- মিথুর বিয়ে ঠিক করেছে আমাকে না জানিয়েই। কই এ’বিষয়ে তো মামা আমাকে কিছুই বলল না! আর তাছাড়াও মিথুর তো পড়ালেখা শেষ হয়নি। এতো বিয়ের তাড়াহুড়ো কেনো?
‘- তোর মামা বলল ছেলে অনেক বড় ডাক্তার। এমন ছেলে নাকি অনেক কম পাওয়া যায় এদিকে। তাই এতো তোড়জোড়।
‘- তোমরা হয়তো ভুলে গেছো মিথু কার বোন! ওর জন্য ছেলের অভাব হবে না নিশ্চয়ই? যাইহোক তোমরা মা বাবারা যখন ঠিক করেই ফেলেছো তখন আর আমি কী বলব! কিন্তু মিথু কী রাজি এই বিয়েতে?
‘- ও রাজি না হয়ে কী করবে? ওর বাবা যা বলবে তাই করবে।
আমি আর কিছু না বলে মিথিলার সঙ্গে মজা করার জন্য ওর ঘরে গেলাম। বিছানার এক কার্নিশে মন খারাপ করে বসে আছে।
‘- কিরে আজ তোকে ছেলে দেখতে আসবে, কিছুদিন পর তোর বিয়ে। আর তুই মন খারাপ করে বসে আছিস?
মিথিলা মলিন কণ্ঠে আমায় জবাব দেয়,
‘- ভাইয়া তুমি এখান থেকে যাও তো! আমার ভালো লাগছে না।
মিথিলার পাশে গিয়ে বসলাম,
‘- আচ্ছা তোর কি হয়েছে আমাকে বল তো। কাল রাতে দেখলাম কারো সঙ্গে কথা বলছিস আর কান্না করছিস। আর এখন তুই মন খারাপ করে বসে আছিস?
মিথিলা আমার প্রশ্নের কোন জবাবই দিচ্ছে না। উল্টো মুখ ঘুরিয়ে নিল।
‘- কী মুশকিল! তুই যদি আমাকে মুখ ফুটে না বলিস তাহলে আমি বুঝবো কিভাবে?
এবার মিথিলা আমার দিকে ঘুরে তাকালো। চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। কিছুটা অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে বলল,
‘- তোমাকে বলে কি হবে? তুমি তো কিছু করতে পারবে না! বাবা ঠিকই আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে।
মিথিলার অশ্রুজল মুছে দিয়ে বলি,
‘- একবার অন্তত মুখ ফুটে বল আমাকে কি হয়েছে তোর। তারপর দেখ আমি কিছু করতে পারি কি’না। তোর মনে আছে ছোটবেলায় যখন তুই কান্না করতি তখন কতরকম বাহানা দিয়ে তোর মন ভালো করতাম। যখন কান্না করতি তখন তোকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে যেতাম। তখন যেমন তোর মন ভালো করতে পেরেছি, কোনো কষ্টকে তোর আশেপাশে ঘেষতে দিই নি। তাহলে আজও দেবো না। তুই শুধু একবার বল আমাকে।
মিথিলা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে।
‘- ভাইয়া আমি এই বিয়ে করব না। বাবাকে অনেকবার বলেছি কিন্তু বাবা আমার কথা শুনেনি। আমি একজনকে ভালোবাসি। ভাইয়া তুমি প্লিজ ওকে আমার কাছে এনে দাও। নাহলে আমি মরে যাব।
‘- এসব অলক্ষুণে কথা বলে না বুড়ী। তুই নিশ্চিন্তে থাক। আমি থাকতে তোর এই বিয়ে কেউ দিতে পারবে না। ভরসা রাখ তোর এই ভাইয়ের প্রতি। তবে ওই ছেলেকে তোর কাছে এনে দেবো কিন্তু একটা শর্তে?
‘- বলো কী শর্ত?
‘- এইযে চোখের এতো অমূল্য পানি আর কখনো নষ্ট করবি না।
‘- ঠিক আছে ভাইয়া।
‘- তাহলে এখন চোখের পানি মুছে একটা মিষ্টি হাসি দে।
মিথিলাও তাই করল। ওর মাথায় একটা চুমু দিয়ে বাইরে এলাম। মিথিলাও পিছনে আসে।
সবাইকে বললাম এসব থামাতে। মামি এগিয়ে এসে বলে ‘- কেনো?
তৎক্ষনাৎ সেখানে মামাও চলে আসে।
মামা এসেই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘- কী হয়েছে সবাই এভাবে জড়ো হয়েছো কেনো? আরে তাড়াতাড়ি রান্নার কাজ শেষ করো।
‘- এখানে কোনো রান্না হবে না মামা!
‘- মানে? রান্না হবে না কেনো? তাহলে ছেলেপক্ষ এসে খাবে কী?
‘- যেখানে বিয়েই হবে না সেখানে ছেলে এসে কী করবে?
‘- পরিষ্কার করে বলো কি বলতে চাও!
‘- আমি কথার মধ্যে নিশ্চয়ই আবর্জনা ঢেলে দিয়ে কথা বলিনি। যে পরিষ্কার করে বলতে হবে। মামা মিথিলা নাকি এই বিয়েতে রাজি নয়। তারপরও আপনি জোর করে ওর বিয়ে দিচ্ছেন? কথাটা কী সত্যি?
‘- কে বলল জোর করে বিয়ে দিচ্ছি? ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে। আর আমি যা বলব আমার মেয়েও তাই করবে।
‘- তবে মিথিলা এই বিয়ে করবে না।
মামা মিথিলার সামনে গিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘- মিথিলা, গুড্ডু এসব কী বলছে? তুই আমার পছন্দমতো বিয়ে করবি না?
মিথিলা ভয়ে আমার পিছনে এসে দাঁড়ায়। অস্ফুট স্বরে বলে,
‘- ভাইয়া যা বলবে আমি তাই শুনবো।
‘- মিথিলা?
মামা একটা চিৎকার দিয়ে মিথিলাকে মারার জন্য এগিয়ে এলো।
‘- দাঁড়ান!
আমিও অনেকটাই চিৎকারের সঙ্গেই মামাকে থামালাম।
‘- তুই আমাকে ধমকিয়ে কথা বলিস? এতবড় সাহস তোর?
‘- আপনাকে ধমকাইনি। মিথিলা আর সেই ছোট্টটি নেই। যে সে কোনো ভুল করলেই তাকে ধরে মারবেন।
হঠাৎ নানা ভাই এসে আমাকে থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল।
‘- নানা ভাই তুমি এই সময় কোনো কথা বলবে না। মামা বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। বিশেষ করে একটা মেয়ের জীবন তো একদমই নয়। মিথিলা যেই ছেলেকে ভালোবাসে তার সাথে বিয়ে দিতে আপনার সমস্যা কী?
‘- আমি যতক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে আছি ততক্ষণ ওই ছেলের সঙ্গে মিথিলার বিয়ে দেবো না। আমার পছন্দ করা ছেলের সাথেই ওর বিয়ে হবে।
‘- তবে আমার কথাও শুনে নিন। আমি স্পর্শ যতক্ষণ এই বাড়িতে জীবিত অবস্থায় থাকবো ততক্ষণ কোন বাপের ছেলে মিথিলার বিয়ে দেয় আমিও দেখবো।
নানু এসে বলল,
‘- কেনো শুধু শুধু ঝামেলা করছিস বল তো নানু ভাই। ছেড়ে দে এসব।
‘- নানু তোমরা তো এটাই চাও যে তোমাদের নাতনী সুখী হোক? তাহলে মিথিলা যেখানে নিজের সুখ খুঁজে পেয়েছে সেখানে যেতে দাও না। আর এই কথাটা তোমার ছেলের মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে দাও। নাহয় ভুলেও যদি উল্টোপাল্টা কিছু হয়। তাহলে আমিও কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারি সেটাও দেখতে পারবে। ছোটবেলা থেকেই আমার জিদের উপর কারো কথা বা ভয়ের কোনো প্রভাব পড়েনি। আর এখনো পড়বে না। তোমার নির্বোধ ছেলেকে বলে দাও, জন্ম দিলেই মা বাবার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
আমি মিথিলাকে নানা ভাইয়ের কাছে দিয়ে বললাম,
‘- নানা ভাই আমি যতক্ষণ না পর্যন্ত বাড়িতে ফিরে আসি ততক্ষণ মিথিলাকে একমুহূর্তের জন্যেও দূরে রাখবে না।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মামার মুখোমুখি হয়ে বলি,
‘- তোমার জন্য ভালো এটাই হয়, যে ছেলেদের বলে দাও যে পথ দিয়ে আসছে! পুনরায় সেই পথ ধরেই ফিরে যেতে। তোমাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। নিজের স্বার্থ ছাড়া যে কোনো কাজ করো না এটা আমার থেকে ভালো অন্য কারো জানার কথা নয়।
এই বলে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা মিথিলার পছন্দের ছেলের বাড়িতে চলে আসি। ওদের বাড়ির মূল ফটকে প্রবেশের সঙ্গেই একটা লোক দৌড়ে এসে আমার গলা বরাবর ছুরি চালিয়ে দিল।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,