#একটুখানি ভালোবাসা
#পর্ব_১
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
রাত প্রায় দু’টো বাজতে চলেছে। রেললাইনের পথ ধরে হেঁটে চলেছি আমি। হঠাৎ সামনে থেকে নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে আসে। কিছুটা এগিয়ে গেলাম। কয়েকজন ছেলে দু’টো মেয়েকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর মুখে বলছে,
‘- আজ তোকে কে বাঁচাবে শুনি? আমাদের ভাইয়ের হাত থেকে পালানো এতোই সোজা? চল আজ ভাই তোর সাথে বিছানা গরম করবে।
বাক্যটি বলেই ছেলেগুলো উচ্চস্বরে হেঁসে ওঠে। ওদিকে মেয়ে দু’টোর মুখে একরাশ ভয়ের ছাপ। কেঁদে কেঁদে ছেলেগুলোর কাছে রেহাই পেতে চাচ্ছে। রাগে আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে একটা বদঅভ্যাস বিদ্যমান রয়েছে। আর সেটা হলো নিজের চোখের সামনে কোনো নারীর প্রতি অসম্মান হতে দেখলে আমার রাগে শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। দু’হাত পিছনে দিয়ে ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কর্কশ কণ্ঠে বললাম,
‘- কিরে এত রাতে মেয়ে দু’টোকে বিরক্ত করছিস কেন?
ছেলেগুলো আমাকে দেখতে পায়নি। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় তেমন একটা দেখা যায় না। তারউপর হুডি পড়ে মাথায় টুপি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
বখাটে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন এগিয়ে এসে সামান্য ধাক্কা মেরে বলল,
‘- কে রে তুই?
ধাক্কা মারার ফলে দু’হাত পিছিয়ে গেলাম।
আমি যথেষ্ট চেষ্টা করলাম নিজের রাগটাকে দমিয়ে রাখতে।
শান্ত কণ্ঠে আবারও বললাম,
‘- মেয়ে দু’টোকে ছেড়ে দে!
ছেলেটি আবারও এগিয়ে এসে বলে,
‘- তোর সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। তুই জানিস আমরা কার লোক?
একটা মুচকি হেঁসে বললাম,
‘- শেষবারের মতো বলছি! যদি নিজেদের ভালো চাস তাহলে মেয়ে দু’টোকে ছেড়ে দে। নয়তো এই চেহারা নিয়ে বাড়িতে গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারবি না কেউ।
‘- ছাড়বো না। কি করবি শুনি?
মাথা থেকে হুডির টুপি টা নামিয়ে ফেললাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির চোখের দিকে তাকালাম। ছেলেটা ভয়ে ঢোক গিলে ফেলে।
‘- ভা ভাই আপনি?
‘- বাহ এতো তাড়াতাড়ি হাওয়া বেরিয়ে গেল? এরপর যদি আর কখনো এরকম দৃশ্য দেখতে পাই! তাহলে সেদিন প্রাণের মায়া ছেড়ে দিস। চোখের সামনে থেকে চলে যা।
‘- ভাই আর কখনো এমন ভুল হবে না। যাচ্ছি ভাই। আসসালামু আলাইকুম।
ছেলেগুলো একপ্রকার দৌড়ে পালিয়ে গেল। অনেকটাই কৌতূহল নিয়ে মেয়ে দু’টোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
চোখেমুখে এখনো ভয়ের ছাপ লেপ্টে রয়েছে। কারো চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
‘- আপনারা কারা? আর এতো রাতে এই স্টেশনে কি করছেন?
কোনো জবাব দিল না কেউ-ই। হয়তো ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো।
‘- চলুন আপনাদের বাসায় এগিয়ে দিয়ে আসি৷
আশ্চর্যের বিষয় হলো তারা কোনোভাবেই রেসপন্স করছে না।
কিছুটা রেগে গিয়ে বললাম,
‘- আরে কথা তো বলবেন! এভাবে বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
আমার রাগী কণ্ঠ শুনে ছোট মেয়েটা কেঁদে ফেলে আর বড় মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে।
নিজেরই খারাপ লাগলো। ছোট্ট একটা মেয়ে আমার কারণে কাঁদছে। আমি মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম৷ মেয়েটির থেকে ছাড়িয়ে তাকে আমার কাছে টেনে নিলাম। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,
‘- ভয় পেও না বাবু। আমাকে বলো কি হয়েছে তোমাদের।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার কারণে মেয়েটি একটু শান্ত হলো।
‘- ভাইয়া আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আপু বাড়ি ভাড়া দিতে পারেনি বলে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমরা কোথায় যাব জানি না।
‘- তোমাদের মা বাবা কোথায় থাকে? তারা কি তোমাদের দেখাশোনা করে না?
‘- ভাইয়া আমাদের তো মা বাবা নেই। আপু বলেছে তারা নাকি আকাশের তাঁরা হয়ে গেছে। আর কখনো ফিরে আসবে না।
বড় মেয়েটির নাক টেনে কাঁদার শব্দ পেলাম। হয়তো মা বাবার কথা মনে করে কাঁদছে। যার মা বাবা নেই সেই বুঝে পৃথিবীটা কতো রঙিন 😅।
আমি এবার বড় মেয়েটির সামনে দাঁড়ালাম।
‘- আপনার আপত্তি না থাকলে আমার সাথে যেতে পারেন।
মেয়েটি একটু পিছিয়ে গেল। হয়তো ভয় পেয়েছে।
‘- আরে ভয় পাবেন না। নিরীহ মানুষের ক্ষতি করব এমন শিক্ষা আমার মা আমাকে দেয়নি। আমার বাড়িটা অনেক বড়। তবে থাকার মানুষ নেই।
আবারও ছোট মেয়েটির সামনে গিয়ে ওর থুতনিতে হাত বুলিয়ে শীতল কণ্ঠে বললাম,
‘- আজ কতগুলো বছর পরে কেউ আমাকে ভাই বলে ডাকলো। এর অমর্যাদা করি কি করে বলুন। আসুন আমার সাথে।
তারপর তারা দু’জনই আমার সঙ্গে হাঁটা ধরে। এতক্ষণে তাদের মন থেকে ভয়টা কিছুটা কেটে গেছে। তবে আমি অনেকটাই অবাক হয়ে রইলাম। এতকিছু হয়ে গেলো তবুও কোনো কথা বলছে না মেয়েটা। বড়ো অদ্ভুত বিষয়। সে কি পুরুষদের সঙ্গে কথা বলে না নাকি আমার সাথেই এমনটা করছে?
হাঁটতে হাঁটতে ছোট মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘- তোমার নাম কি গো বুড়ী?
ওমা মেয়েটি কোমরে দু’হাত দিয়ে রাগী কণ্ঠে বলল,
‘- এই ছেলে আমাকে বুড়ী বলবে না একদম। আমি বুড়ী না বুঝেছো? আমাকে তোমার বুড়ী মনে হয়? বুড়ো তো তুমি! তুমি জানো না কাদের বুড়ী বলতে হয়? যাদের বয়স অনেক বেশি তাদের বুড়ী বলে বুঝেছো। গাধা একটা।
মেয়েটির কথা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ 😦। এমনভাবে বলছে যেন সে তার ছোট্ট ভাইকে শাসন করছে। কিছু মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে আমার নিজেরই বোন আমাকে শাসিয়ে কথা বলছে। বেশ ভালোই লাগলো পিচ্চিটার পাকা পাকা কথাগুলো।
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলি,
‘- বড়ো ভুল করে ফেলেছি যে। আর এমন ভুল করব না। এবার বলো তো তোমার নামটি?
‘- আমার নাম মিহি।
‘- আর আপনার নাম?
আশ্চর্য! মেয়েটি কোনো কথাই বলছে না।
মিহি বলে ওঠে,
‘- আপুর নাম মাধবীলতা।
আমার মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে গেল,
‘- মাশা-আল্লাহ। তোমার আর তোমার আপুর নাম তো বেশ চমৎকার।
‘- তোমার নাম কি ভাইয়া? আর তুমি কী করো?
‘- আমার নাম স্পর্শ। আর আমি কাজ করি।
‘- তোমার নামও অনেক সুন্দর ভাইয়া।
পিচ্চিটা আমার হাত ধরে তিড়িংতিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে।
এদের দেখে মনে হয় এরা আপন বোন। একজন অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে, আর আরেকজন বোবার মতো সেই চুপটি করে রয়েছে।
কিছু সময় অতিক্রম করার পর বাসায় ফিরলাম। দারোয়ান চাচা গেট খুলে দিলেন। সবাইকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। তারা দুজন আবারও ভয় পেয়ে গেল। কারণ বাড়ির চারপাশে গার্ডরা হাতে মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভিতরে নিয়ে গেলাম।
বাড়িতে ঢুকার সাথে সাথে আবীর এসে বলল,
‘- স্যার এরা কারা? আর আপনি এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলেন?
আবীর আমার সবচেয়ে বিশ্বাসী লোক। সবসময় আমার সাথে থাকে।
‘- এইতো একটু বাইরে হাঁটতে গিয়েছিলাম। আর এদের কিছু বখাটে ছেলেরা বিরক্ত করছিল। আর আজ থেকে এরা এখানেই থাকবে। তুমি ওদের ঘরটা দেখিয়ে দাও। আর ওদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো। আমি ঘুমোতে গেলাম। ওদের খেয়াল রেখো।
মিহির থুতনিতে হাত বুলিয়ে বললাম,
‘- আপু তোমরা ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো কেমন।
এই বলে আমি আমার ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন আবীর পিছুডাক দিয়ে বলে,
‘- স্যার আপনি খাবেন না?
পিছনে ঘুরে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বললাম,
‘- খিদে নেই আবীর।
‘- এভাবে আর কতদিন নিজেকে কষ্ট দেবেন?
‘- আরে তেমন কিছু না। তুমি খেয়েছ?
জানি না আবীরের চোখে পানি দেখতে পেলাম।
‘- স্যার আপনার মতো ভালো মানুষ যদি পৃথিবীর সবাই হতো,,,,,! নিজে খাননি অথচ আপনার কাজের লোক খেয়েছে কিনা সেই চিন্তা করেন।
বলেই চোখের পানি মুছে ফেলল।
আবীরের কাছে গিয়ে বলি,
‘- কেন শুধু শুধু নিজেকে ছোট করছ বলো তো? তোমাকে তো আমি কাজের লোক ভাবি না কখনো। নিজের ভাই মনে করি তোমায়। এরপর আর কখনো এধরণের কথা যেন না শুনি।
আমি আবারও নিজের ঘরে যেতে থাকি।
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে,,,
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,