একটি হুইল চেয়ার পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
2929

#একটি_হুইল_চেয়ার
( দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব)
_ কোনো দোষ ছিলো না তোমার নীরা।
শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করলো,
_বাবা আমাদের সম্পর্কটা জানার পর আমার ফোন নিয়ে গেছিলো। প্রায় মাস ২ এর মতো আমাকে ফোন ধরতে দাওয়া হয়নি। বাসা চেইঞ্জ করার সময় আমার ডায়রিটা হারিয়ে গেছে। তোমার নম্বরটাও মুখস্ত ছিলো না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তোমার আম্মুর নম্বর পেয়েছিলাম। উনি আমার পরিচয় জানার পর দ্বিতীয়বার আর ফোন ধরেন নি। বেশ কয়েকটা নাম্বার থেকে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি।
_ মা এমনটা করলো?
_ করাটাই কি স্বাভাবিক না? তারা কখনই আমাদের সম্পর্কটার সাপোর্ট এ ছিলো না।
_ তা ঠিক। কিন্তু…
_ কিন্তু কি? তখন কত করে বলতাম। তোমার কোনো বান্ধবীর নাম্বার আমাকে দিয়ে রাখো। এত বেশি জ্বলতে যে কোনো মেয়ের সংস্পর্শেও আসতে দিতে চাইতে না, ফোন নাম্বার তো দূরের বিষয়। তোমাদের বাসায় নিচে গিয়েছিলাম অনেকবার। তোমার দেখা পাইনি। পরে শুনেছি, তোমরাও বাসা চেইঞ্জ করে ফেলেছো।
_ হ্যাঁ। খুলনায় আব্বুর পোস্টিং হয়েছিলো। দ্রুত চলে যেতে হয়েছে।
_ হুম। তাহলে উপসংহারটা কি দাঁড়ালো?
_ কি?
_ দোষ আমারও না, তোমারো না। পরিস্থিতি ছিলো উলটো।
_ হুম বুঝলাম।
_ এখনো আমার ওপর রাগ?
_ না।
_ সত্যি নাকি মিথ্যা?
_ জানি না।
শুভ্র হো হো করে হেসে উঠলো।
_ কানী হলে কবের থেকে? চোখে চশমা!
রেগে গিয়ে বললাম,
_ এই কানী বলবে না বললাম। নিজে কি? হ্যাঁ? নিজে তো কলেজ থেকেই কানা। আসছে আমাকে কানী বলতে।
_ এই যা! এতদিনেও মুখে মধু আসেনি। আগের চেয়ে আরো বেশি ঝগড়াটে হয়েছো মনে হচ্ছে।
_ কি বললে আমি ঝগড়াটে?
_ না, না! মোটেও না। তুমি আমার সেই ছোট্ট পুতুল। যাকে বাইকের পিঠে বসিয়ে এলোপাথাড়ি ঘুরে বেড়াতাম।
_ অনেক মিস করেছি তোমাকে জানো? সময়ের সাথে সব স্বাভাবিক হয়েছে ঠিকই তবে মনের কোনো এক কোণে তোমাকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছেটা বেঁচে ছিলো!
_ আর আজ ইচ্ছেটা পুরণও হলো।
_ আবার হারিয়ে যাবে না তো?
_ কক্ষনো না! হাতটা ধরি নীরা?
_ ধরো!
শুভ্র হাত ধরলো। ওর কাধে মাথা রেখে কেটে গেলো আমার ক্লান্ত দুপুরবেলা। শুরু হলো নতুন করে অতীত ফিরে পাবার অধ্যায়।

বছর কেটে গেলো। আমাদের সম্পর্ক পুরোনো গতি ফিরে পেলো। বেশ সুন্দর সময় কেটে যাচ্ছিলো আমার আর শুভ্রর। রাত জেগে জেগে দুজনে স্বপ্ন বুনতাম। ডুপ্লেক্স বাসা, সাদে বাগান, আর বাগানের ঠিক মাঝখানে একটি দোলনা। সাজানো একটা সংসার হবে আমাদের। জমানো টাকায় প্রতি বছর হবে ট্যুর!
একটা এক্সিডেন্ট ভেঙ্গে দিলো সব স্বপ্ন। পা টেনে নামিয়ে আনলো বাস্তবতার জগৎে!
কক্সবাজার ট্যুর দিয়ে ফ্যামিলির সাথে ফেরার পথে দুটো বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিভে গেলো অনেক গুলো প্রাণ। গুরুতর আহত অবস্থায় শুভ্র ও তার পরিবারসহ আরো ক’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সে যাত্রাতেই চিরতরে ঘুমিয়ে যায় আমার শশুড় শাশুড়ি।
লোকাল হাসপাতাল থেকে ঢাকায় ট্রান্সফার করা হয় শুভ্রকে। পাগলপ্রায় আমি ছুটে যাই ওকে দেখতে। গিয়ে দেখি শুভ্রর বেডের পাশে ঝকঝকে নতুন স্টিলের একটা হুইল চেয়ার!
দৌড়ে হাসপাতালের ছাদে চলে যাই। আমার চিৎকারে সেদিন আকাশ ভারী হয়েছিলো। প্রবল বর্ষন শুধু হারিয়ে দিয়েছিলো অশ্রুকে।
শুভ্র সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফেরার পর পরই আমাদের সম্পর্কের কথা বাসায় জানিয়ে দেই। বাবা অতি দ্রুত আমার বিয়ে ঠিক করে এবং জানিয়ে দেয় তার পচ্ছন্দের পাত্রকে বিয়ে না করলে আমায় ত্যাজ্য করবেন।
শুভ্রকে ফোন দিয়ে সবটা খুলে বলি।
_ তুমি প্রস্তুত থেকো। এটাই আমার সিদ্ধান্ত!
_ নীরা জীবনটা খেলনা নয়! তুমি কি বলছো এসব?
_ আমি শুধু আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। কোনো মতামত জানতে চাই নি। তৈরি থেকো। রাখছি।

পরেরদিন কাজি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। শুভ্রর অপেক্ষায়। ঝলমলে সকাল। রোদের আঁচ খুব একটা তীব্র নয়! বসন্তের গন্ধ লেগে আছে প্রকৃতির আঁনাচে কাঁনাচে। বেশ কয়েকটা বোলতা আমার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। হলুদ লালের সংমিশ্রণে আজ কনে সেজেছি কিনা!
কিছুক্ষন পরেই চারটি অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পেলাম। আমার ভালোবাসা আসছে… তবে সে কোনো পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে নয়! নির্মম বাস্তবতার চারপায়াতে বসে।

আলহামদুলিল্লাহ! বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো। কিন্তু শুভ্রদের জয়েন ফ্যামিলিতে আমাদের জায়গা হলো না। তার বড় চাচার সোজা সাপ্টা কথা,
_ বিয়ে করার আগে আমাদের জানিয়েছিলে তোমরা?
_ আমার বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলো। এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না!
_ দেখেন মা জননি, শুভ্রর বাবা এবং আমি এ সংসারের ঘানি টেনেছি এতদিন। এখন এমনিতেই আমার ওপর চাপ পড়ে গেলো। বাড়তি মানুষের খরচ করা সম্ভব নয়। শুভ্র কিছু করতে পারলে তাও বুঝতাম। পা ছাড়া ওকে কে কি চাকরি দিবে? তাছাড়া গ্র‍্যাজুয়েশন কম্পলিট করতেও মাস কয়েক বাকি! এ অবস্থায় পরীক্ষাও দিবে কিভাবে?
শুভ্র আকুতি করে উঠলো,
_ চাচা, কয়েকটা দিন একটু দয়া করেন। আমি নিশ্চয়ই কোনো একটা ব্যবস্থা করবো।
_ ব্যবস্থা করে এসো।
_ চাচা আমি…
শুভ্রকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
_ জ্বি চাচা, আসলে আমরা বুঝতে পারিনি। এখানে এসে আপনার সমস্যাটা বুঝেছি। আরো আগে বোঝা উচিত ছিলো আমাদের। দোয়া করবেন।
_ অবশ্যই। সুখী হও।
বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। শুভ্রর চোখে পানি চিকচিক করছে। কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে!

শুভ্রর এক ঘনিষ্ট বন্ধুর ফ্ল্যাট এ আমাদের জায়গা হয়। লেলিন ভাইয়ার আম্মু আর ভাইয়া দুজনে থাকতেন। আংকেল অনেক আগেই ইন্তেকাল করেছেন। সেসময় তাদের বাসার যাবতীয় কাজ করতে হতো আমার। কাজের ফাঁকে চলতো পড়াশোনা। শুভ্রর ফাইনাল পরীক্ষার আগ পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকলো সব। কাজের বিনিময়ে থাকার জন্য ছাদ আর দুমুঠো খাবার তখন ছিলো ঢের বেশি!

শুভ্রর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমি অনেক কষ্টে একটা ব্যাংক এ চাকুরি পেলাম। সামান্য কেরানীর চাকুরি। হাতে কিছু টাকা কড়ি ছিলো আমাদের। সোনার কানের দুলজোড়া বিক্রি করেও কিছু পেলাম। সব মিলিয়ে আমরা একটি বস্তির পাশে গিয়ে উঠি। ছনের ঘর, দুটো থালা, একটি গ্লাস আর দুটি পাতিল দিয়েই শুরু হলো আমাদের সংসার! বিছানা বলতে তখন শুধু একটি চাদর ও একটি কম্বল ছিলো। আর আমার বালিশ ছিলো শুভ্রর বুকের মাঝখানটা। রাতে গায়ের ওড়না গোল করে ঘুরিয়ে শুভ্রর মাথার নিচে রেখে দিতাম। নাহলে এই শক্ত মাটিতে শুয়ে ওর ঘাড়ে বড্ড ব্যাথা করবে যে!

প্রতিদিন সকালে চাল, আলু ফুটিয়ে লবন মাখিয়ে খেয়ে উঠতাম। শুভ্র বেশ তৃপ্তি করে খেতো! আমি অফিসে আসার পর শুভ্রর দেখভাল বস্তির কিছু বাচ্চারাই করে দিতো। শুভ্র ওদের সাথে খেলতো, গল্প করতো। আমার ছোট্ট সংসারের বিশাল অংশ জুড়ে ছিলো ওরা।
বছর পার হয়ে যেতে থাকে। টাকা জমিয়ে জমিয়ে একটা চৌকি কিনি। তোশক কিনি। দুটো বালিশ ও কিনি। এতে অবশ্য শুভ্র খুশি হয় না। জিজ্ঞেস করতেই বলে,
_ এখন আমার বুকে কে মাথা রেখে ঘুমাবে শুনি?! শূণ্যতা অনুভব করছি।
_ পাগল ছেলে।
শুভ্রর গ্যাজুয়েশন কম্পলিট হয়ে যায়। তবে সিজিপিএ খুব একটা ভালো ছিলো না। এভাবেই টুকটুক করে এগোচ্ছিলাম আমরা। সারাদিন অফিসে এ কাজ করে রাতে কুপি জ্বালিয়ে পড়তাম। মাঝে মাঝে চাঁদ তার অজস্র জোছনা ঢেলে দিতো এই ছোট্ট কুটির এ। তখন কুপির প্রয়োজন হতো না। জোনাকির আনাগোনা ছিলো। ঘরের ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢুকে এরা জ্বলতো আর নিভতো! শুভ্র জিজ্ঞেস করতো,
_ নীরা, আমরা কি সত্যিই অনেক সুখী?
পেটে প্রচন্ড খুদা নিয়েও বলে উঠতাম,
_ আমরা অনেক সুখী! অনেক!
হাজার কয়েক টাকা দিয়েই মাস কাটিয়ে দিতাম। আর এভাবেই কেটে যেতে লাগলো বছর।

দেখতে দেখতে আমার গ্র‍্যাজুয়েশন কম্পলিট হলো। আর তার পর পরই ব্যাংক এর সিনিয়র একটি র‍্যাংক এর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। বেতন অনেক। ২৫ হাজার টাকা!
পরীক্ষার দিলাম। রিটেনে টিকলাম। ভাইভা দিলাম। চাকরিটাও হলো…
পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করলো।

সেদিন একটা খাট কিনে আনলাম। চৌকি সরাতে যাবো এমন সময় চোখে পড়লো নিচে একটা ডায়রি পরে আছে। খুলে পড়তে শুরু করলাম। আরে এটাতো শুভ্রর লিখা! এতগুলো ছোট গল্প আর কবিতা! শুভ্র লিখেছে?!
লিখাগুলো অনেকটা জোর করেই পরবর্তী বই মেলায় বের করার উদ্যোগ নেই। এর মধ্যেই আমার আরো একবার প্রমোশন হয়। স্যালারি বাড়ে। বাসা চেইঞ্জ করে ভাড়া বাসায় শিফট হই।
শুভ্রর দেখাশোনার জন্য লোক রাখি।
এর মধ্যেই ভালো একটা প্রকাশনির সাথে কথা বার্তা হয়। তারা গল্প ও কবিতাগুলো পড়ে মুগ্ধ!
ফেব্রুয়ারীতে বই বের হয়। সেবার বেস্ট সেলার হয় বইটি ” পর্দার বৃতান্ত! ”
চারিপাশে হইচই পড়ে যায়। নিউজে, পেপারে, অনলাইল পোর্টাল সব জায়গায় শুভ্র আর শুভ্র।

এখন আমাদের নিজস্ব বাড়ি আছে। আরেকটা বাড়ির কাজ চলছে। আমাদের পরিবারের বাকি সদস্যদের জন্য। সেই বস্তির সেনাবাহিনীদের জন্য। যারা আমার অবর্তমানে শুভ্রর সংগী হিসেবে থেকেছে। খেয়াল রেখেছে!
মাঝে মাঝেই বেড়াতে আসে ওরা।
এখন আমরা তৃপ্তি করে মাছ, মাংস খাই! তবে আলু চটকে লবণ দিয়ে খাওয়ার অপূর্ব সেই স্বাদ ভুলি নি।
বাসায় যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছি। সফল হইনি।
আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী আমার শরীরের মাঝেই আছে। এখন শুধু তার পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায় আছি আমরা। তবে প্রথম বাবু হিসেবে শুভ্র মেয়েই চায়। কেননা, মেয়ে বাবু সর্বদাই আল্লাহর নেয়ামত।
শুভ্র বলে,
_ নারি তুমি সর্বদাই শত গুণের অধিকারী,
তুমি শীর্ষ সহ্য ক্ষমতা, তুমি বড্ড সংগ্রামী।
তুমি ভাঙ্গা ঘরের জোনাকি, অন্ধকার দূরকারী,
তুমি দৃঢ় মনোবল, দিপ্তময় আগামী ❤

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে