অণুগল্পঃ একটি হুইল চেয়ার
পর্ব-০১
© আতিয়া আদিবা
আমার স্বামী প্রতিবন্ধি, ওর দুটো পা নেই। একজন প্রতিষ্ঠিত মেয়ের পক্ষে কোনো শারিরীক বাধাগ্রস্ত ছেলেকে বিয়ে করা কতটুকু যুক্তিগত তা আমি সত্যিই জানি না। লোকে বলে না ভালোবাসা অন্ধ? আসলেই তাই।
আমি অন্ধ! আমার স্বামী শুভ্র বলতেই তার প্রতি ভালোবাসায় আমি অন্ধ।
কিছুক্ষন আগেই পেগনেন্সির রিপোর্ট টা ওকে দেখিয়েছি! পজিটিভ। ও এতটাই খুশি হয়েছে যে ওর চোখ দিয়ে নোনা বৃষ্টি ঝরে যাওয়ার স্থায়িত্বকাল ছিলো অনন্তসময়ের..
হুইলচেয়ার থেকে একটু আগে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি! ও শুধু বয়সেই বড় হয়েছে। কিন্তু আবদার গুলো ছোট্ট অবুঝ শিশুর মতো।
মাথা হাতিয়ে না দিলে তো ও ঘুমুতেই পারে না।
এতো নিষ্পাপ লাগে! যখন চোখের পাতাদুটো এক করে ও স্বপ্নের জগৎ এ বিচরণ করে..!
মাঝে মাঝে ঘুমের মাঝেই চোখজোড়া ভিজে ওঠে ওর। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায় আমার! আমি পারি ওর চাপা কষ্টগুলো স্পর্শ করতে। ওর অনুভূতি গুলো নিজের করে অনুভব করতে।
পরিবারের সাথে সম্পর্কের ইতি তবে থেকেই হয়েছে যবে থেকে আমি এই শুভ্র নামক পা হারা মানুষটির বউ! আমার বাবা যেখানে আমার জন্য মেজর, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ছাড়া কাউকে ভাবতেই পারতেন না সেখানে আমি….!
যাক বাদ দেই সেসব কথা।
আমাদের এই অনন্য ভালোবাসার গল্প এক সময় সবার মতো সাধারনই ছিলো। শুধু ভাগ্যের পরিহাসে আজ আমরা পরিবার থেকে বঞ্চিত! প্রথম তিন বছর খুব কষ্টে কেটেছে।
না ছিলো টাকা পয়সা, না ছিলো থাকার জায়গা.. একটা ব্যাংকে চাকরি শুরু করি কিন্তু বেতন ছিলো মাত্র ৫ হাজার! আজ বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় এসে আমরা দুজনেই আর্থিকভাবে সফল..
ভাবছেন দুজন কিভাবে?
আমার পা হারা প্রতিবন্ধি অবহেলিত স্বামী কিভাবে সফল হয়েছে?
তিনি একজন সফল লিখক..
আর তার এই সফলতা অর্জনের পিছনের গল্পটাই আজ আপনাদের বলবো। তবে তার জন্য ঘুরে আসতে হবে সেই শুরু থেকে।
সাল ২০০১!
ভার্সিটির প্রথম দিন আমার..
বেশ এক্সাইটেড আমি..
সুন্দর করে সাজুগুজুও করেছি..
প্ল্যানটা এরকম আমি ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢুকবো। এন্ট্রিটা হবে স্লো মোশন এ। আর ঠাস ঠাস করে ছেলেরা মাটিতে পড়ে যাবে। ওরনা উড়ে গিয়ে কোনো সিনিয়র ভাইয়ার মুখ ছুঁয়ে দিলেও মন্দ হবে না। আকাশ কুসুম কল্পনায় বিভোর আমি!
এমন সময় মার ডাক_
– নীরা! ও নীরা!
– কি মা?
– নাস্তা করেছিস?
– না মা!
– করবি না?
– ভার্সিটির ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিবো…
আমি আসি, মা!
– নাস্তাটা করে যা বলছি।
আবারো না বোধক উত্তর দিলাম।
– লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাবে।
– হাইরে মেয়ে আমার, লিপস্টিক নষ্টের জন্য নাকি না খেয়ে যাবে! এত লম্বা সময়ের জন্য যাচ্ছিস একটু কিছু…
মাকে কথা শেষ করতে দিলাম না।
তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম।
আর একটু সময় বাসায় থাকলে মা জোড় করেই খাওইয়ে দিবে! আর আমার লিপস্টিক টাও নষ্ট হয়ে যাবে।
ভার্সিটির সামনে নামলাম। ভাড়া মিটিয়ে, বেশ ঢং ঢাং করে গেট দিয়ে ঢুকছি।
অবশ্য বেশিদূর যেতে পারলাম না।
দুর্ভাগ্যবশত একটি মেয়েছেলে সমৃদ্ধ গ্যাং এর সামনে পড়লাম।
মোটা মতো একজন মেয়ে ডাক দিলো। সর্বনাশ করেছে। পরিস্থিতি সুবিধার মনে হচ্ছে না।
_ এই মেয়ে এদিকে শুনে যাও তো।
_ আসসালামু আলাইকুম।
_ ওয়ালাইকুম আসসালাম।
ভার্সিটিতে নতুন নাকি?
_ জ্বি আপি।
_ সিনিয়র দেখলে লেজ গুটায়ে পালানোর চেষ্টা এরপর থেকে আর করবানা। বুঝতে পেরেছো?
উওরে শুধু মাথা নাড়লাম।
– আসবা, এসে সালাম দিবা তারপর আমাদের দাওয়া টাস্ক কমপ্লিট করতে পারলে তবেই যেতে পারবা।
ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছি আপুর দিকে।
কি বিপদে পরলাম! এইসব কি বলে। কোথায় প্রথম দিন একটু পার্ট নিবো ভাবলাম, এরা তো আমার প্ল্যান এ পানি ঢেলে ক্ষান্ত হবে যা বুঝতে পারছি।
অসহায়ের মতো সম্মতি জানালাম।
_আচ্ছা শোনো। ওই যে ছেলেটা দাড়িয়ে আছে, কালো টি শার্ট, ওকে যেয়ে প্রপোজ করো।
আপুর কথা শুনে আমার চোখ দুটো ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসার অবস্থা! ভার্সিটির প্রথম দিনই সিনিয়র কোনো ভাইয়াকে প্রপোজ করতে হবে! একবার মনে হলো এখান থেকে চম্পট দেই। কিন্তু এদের সামনে আবার পড়লে আরো ভয়াবহ র্যাগ দিতে পারে। ভয়মিশ্রিত পায়ে এক পা, দু পা করে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কালো শার্ট পরা ভাইয়াটার মুখ এখনো দেখি নি। তার একদম কাছে চলে এসেছি। উনি এখনো উলটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কানে হেডফোন লাগানো। হাতে একটা বই।
_ আসসালামু আলাইকুম।
( কোনো উত্তর নেই। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনায় মগ্ন। )
_ আসসালামু আলাইকুম।
( এবারো উত্তর নেই। ভীষণ জ্বালা হয়ে গেলো তো! )
আপুটার দিকে তাকালাম। উনি এবং উনার ফ্রেন্ড গুলো ইশারা দিচ্ছে বার বার। টাস্ক কমপ্লিট করতেই হবে।
আমি চোখ বন্ধ করে আস্তে করে হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। আর একটু জোরে করে বললাম।
_ হ্যালো, কালো টি শার্ট ভাইয়া! শুনুন!
ভাইয়াটা ফিরে তাকালো।
_ জ্বি, বলেন!
সময়টা মুহূর্তের মধ্যে থমকে গেলো। কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি গুলো ঝরে পড়ছে। চারিদিকে হঠাৎ করে শুরু হলো মৃদু বাতাস! এভাবে আরো একবার তার সাথে দেখা হওয়াটা যেনো প্রকৃতি ভীষণভাবে উপভোগ করেছে।
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম “শুভ্র”
শুভ্রও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখভর্তি হাজারো প্রশ্ন আর কৌতুহল!
আমি আর কিছু না বলেই উলটো ঘুরে হাটা শুরু করলাম।
_ নীরা দাঁড়াও!
হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। শুভ্র কি আমার পেছোনে পেছোনে আসছে? দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু, জায়গাটা অতি দ্রুত ত্যাগ করা উচিত।
ক্লাসে বসে আছি। আমার পাশে একটা মেয়ে বসেছে। সে অনর্গল কথা বলে চলছে। অবশ্য বেশিরভাগ কথাই তার বয়ফ্রেন্ড রিলেটেড। আজকেই পরিচয় হয়েছে আমাদের। অথচ মেয়েটা কত ফ্রিলি সব কিছু শেয়ার করছে আমার সাথে। ক্লাসে ম্যাম ঢুকলো। পুরো ক্লাস এখন একদম চুপ। পরিচয় আদান প্রদানের পর ম্যাডাম বললো,
_ তোমাদের জন্য মেন্টোর ঠিক করে দাওয়া হবে। তোমাদের ১০ জনের একটা গ্রুপ এর জন্য একজন মেন্টোর। তোমাদের যত জিজ্ঞাসা আছে, সমস্যা আছে তার সমাধান দাওয়ার জন্য ২৪ ঘন্টাই তাদের পাবে।
আমাদের গ্রুপ ভাগ করে দাওয়া হলো এবং বলা হলো ক্যান্টিনে গেলেই আমাদের মেন্টোর এর দেখা পাবো। আমাদের গ্রুপ ক্যাপ্টেন নির্বাচন করা হলো। ওর হাতে মেন্টোর এর নাম ধরিয়ে দিলো ম্যাম। সবাই চললাম মেন্টোর খুঁজতে। ক্যান্টিনে গিয়ে বসলাম। ক্যাপ্টেন গেলো আমাদের মেন্টোরকে নিয়ে আসতে। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে ফোন টিপতে লাগলাম। তখন শাহরিন বললো,
_ এই নীরা, মেন্টোর আসছে। ফোন রাখ।
মুখ তুলে তাকাতেই চক্ষু হলো চড়কগাছ!
“শুভ্র!!!” শুভ্র আমাদের মেন্টোর?!
মেন্টোর এসেই সালাম দিলো।
সবাই একসাথে সালামের উত্তর দিলাম।
সবার নাম পরিচয় জানার পর শুভ্র বললো,
_ তোমাদের কিছু পেপারস সাবমিট করতে হবে। এসাইনমেন্ট দিবে ম্যাম এর মধ্যেই। তোমরা তোমাদের মোবাইল নম্বর লিখে দাও। ফেসবুক বা হোয়াটাসএপ যেটাতেই পারো চ্যাটগ্রুপ করে ফেলো কুইক। আমি নিয়ম বলে দিবো।
সবাই মোবাইল নম্বর লিখে দিলো। বাধ্য হয়ে আমিও লিখে দিলাম।
লক্ষ্য করলাম লুজটা হাতে নিয়ে শুভ্র মিটিমিটি হাসছে।
বাসায় ফেরার জন্য ভার্সিটির বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একটা সিএনজিও খালি নেই। প্রখর রোদ! কয়েকটা কাক ক্লান্ত হয়ে কারেন্টের তারের ওপর বসলো। হঠাৎ একটা বাইক এসে থামলো। হেলমেট খুলতেই সেই চিরচেনা মুখ।
_ বাইকে উঠে বসো, নীরা।
_ বাইকে উঠে বসবো মানে?
_ উঠতে বলেছি উঠো। আমার কথা আছে তোমার সাথে।
_ মানে কি! আমার সাথে কিসে… …
_ কোনো কথা না। উঠে বসো।
আশেপাশে কিছু ছেলেমেয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। কথা না বাড়িয়ে বাধ্য হয়ে বাইকের পিছে বসলাম।
_ ধরে বসো।
একহাত শুভ্রর কাধে রাখলাম।
বাইক স্টার্ট দিলো।
আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম পুরোনো সেই স্মৃতিগুলোতে!
স্কুল পালিয়ে এই ছেলেটার বাইকে করে অনেক ঘুরেছি।
ফুসকা খেতে পচ্ছন্দ করতাম বলে স্কুল ছুটির সময় বানানো ফুসকা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতো শুভ্র। বড় পুকুর থেকে কতবার যে শাপলা তুলে এনে দিয়েছে আমাকে! আর সেবার জন্মদিনে, এতগুলো চকলেট রাত ১২ টার সময় বারান্দা দিয়ে ঢেল দিয়ে দিয়েছিলো।
কতবার বাসায় ধরা খেয়েছি। তবুও আমাদের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলতে দেই নি। হঠাৎ কি থেকে কি যে হয়ে গেলো! আজও উত্তর খুঁজে বেড়াই।
বাইক থামিয়ে শুভ্র নামতে বললো। নামলাম। পার্কের বেঞ্চের ওপর বসলাম দুজন। শুভ্র তাকিয়ে আছে। আমি অভিযোগের সুরে বললাম,
_ যোগাযোগ কেনো বন্ধ করেছিলে? কি দোষ ছিলো আমার?
(চলবে)