(ইহা একটি ভালবাসা দিবস স্পেশাল গল্প। দিবসের আগেই দিলাম নয়তো যদি অন্য লেখার জ্যামে পরে যাই।)
আনিসের সাথে আমার বিয়েটা কোন প্রস্তুতি ছাড়াই ঠিক হয়ে গেল। বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বললেন, ‘আমি ছেলে পছন্দ করেছি কালই তোমার বিয়ে। আজ সন্ধ্যায় ছেলের মামা মামী এসে তোমাকে আংটি পরিয়ে যাবেন।’ অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়া কোন মেয়েকে এভাবে একদিনের নোটিসে বিয়ে দেয়া সম্ভব এটা আমার মাথাতেও আসেনি। আর এমনও না যে আমি দেখতে খারাপ, ভালো পাত্র পাওয়া গেছে এক্ষুনি বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। আবার এমনও না আমার পরে আমার আরো কয়েকটা বোন আছে যাদের বিয়ে আমার কারণে আটকে আছে। একমাত্র মেয়ে বলে বাবা ছোটবেলা থেকে আমার সব কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনেন বা আমি কি চাই সেটা বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে কোন আপত্তি উনি শুনবেন না সেটাও অন্য কথার সাথে সাফ জানিয়ে দিলেন। বাবার মুখের ওপরে মা ও কিছু না বলাতে বুঝে নিলাম ব্যাপারটা বাবার একার হুট করে নেয়া কোন সিদ্ধান্ত না।
মামা মামীর সাথে সেই সন্ধ্যায় আনিস ও এনেছিল। লম্বা ছিপছিপে একটা মানুষের শরীরে শুধু ঝকঝকে দুটো চোখ ছাড়া আর কোন বিশেষত্ব নেই। কত দেখতে ভালো স্মার্ট সিনিয়র ভাইদের ফিরিয়ে দিলাম আর শেষমেষ এরকম একটা লেবেন্ডিস টাইপ লোক ছিল আমার কপালে? কিন্তু জানতে পারলাম ও স্কলারশীপ নিয়ে জাপান চলে যাচ্ছে সামনের সপ্তাহে তাই এই তড়িঘড়ি আয়োজন। বাবার কাছেই জানতে পারলাম আনিসের বাবা মা খুব ছোটবেলায় মারা যান, মামা মামীর কাছেই সে মানুষ। সে যাই হোক, আমার কোন মতামত ছাড়া হুট করে উঠ ছেরি তোর বিয়া বলে বিয়ে হয়ে যাওয়াটা মানতে না পারাতে সব রাগ যেয়ে পরলো ঐ বেটা আনিসের ওপর। তদুপরি আমার অবাধ স্বাধীন জীবনে বাঁধ না পরে যায় সেই ভয় ও যে ছিল।
বিয়ে পরবর্তী সাতদিন নিজের গোছগাছ, কাগজপত্র সংক্রান্ত অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আনিস আমাকে সময় দেয়ার চেষ্টা করতো। আর আমি শুধু পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম। দিন গুনতাম সাতদিন কবে শেষ হবে? সময় তো আর বসে থাকেনা, তাই সাতদিন পেরিয়ে আনিসের যাবার সময় হয়েই এলো। আনিস বোধহয় চেয়েছিল আমি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাই কিন্তু শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে আমি এড়িয়ে যাই। দু বছরের জন্য আপদ বিদেয় হয়েছে এই খুশীতে পুরো ঘর জুড়ে একবার নেচে নিলাম। প্লেন ছাড়ার আগ মূহুর্তে আনিস ফোন দেয়, ‘ নীরা, আমি যাচ্ছি।’
‘হ্যা হ্যা সাবধানে যাবেন। ভালো থাকবেন। পৌঁছে ফোন দেবেন।’ এটুকু দায়সারাভাবে বলেই আমার দায়িত্ব সারি।
তারপর একে একে কেটে যেতে থাকে দিন। আনিস রোজদিনই ফোন দেয়। প্রথম প্রথম হ্যা হু করে পাশ কাটিয়ে গেলেও ওর আগ্রহের কারণেই আস্তে আস্তে সহজ হয়ে আসে সম্পর্কটুকু। আনিস কথা বলতো খুবই কম, আমিই দেখা যেত পুরোটা সময় বকবক করতাম। ও জানতে চাইতো, কেমন আছি, কি খেলাম, কেমন গেলো দিন? কিন্তু প্রত্যুত্তরে আমারো যে ওসব কথা জানতে চাওয়া উচিত তা আমার কখনো মাথাতেই আসেনি। বিবাহিত জীবনের পাঁচ মাসের মাথায় হুট করে একদিন আনিস আর ফোন করেনা। নিত্য অভ্যাস হঠাৎ হারিয়ে গেলে কেমন যেন একটা হাহাকারের মতো হয়। আমি খুব অবাক হয়ে সারাদিন মোবাইল চেক করলাম। না কোন কল, না কোন মেসেজ। পরদিনও কোন ফোন যখন এলোনা, আমি লজ্জার মাথা খেয়ে খাবার টেবিলে বাবাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘বাবা আনিসের সাথে কি তোমার কথা হয়েছে?’
– হুম হয়েছে তো গতকাল। ওহ তোর নামে একটা চিঠি এসেছিলো আমার অফিসে। দিতে ভুলে গেছি।
প্রেরকের জায়গায় আনিসের নাম দেখে খাওয়া ফেলে চিঠি নিয়ে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসি।
প্রিয় নীরা,
জানো, আমি না সেই ছোটবেলা থেকে মনে অনেক দুঃখ পুষে বড় হয়েছি। আমার নানু, মামা, মামী এই এতিম আমাকে যথেষ্টই আদর করতেন; কিন্তু বাবা মা ছাড়া বড় হওয়ার কষ্ট বুঝি ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বোঝেনা। তোমার বাবা মা আমাকে গত সাতদিনে যে ভালবাসা দিয়েছেন তা দেখে আমার শুধু তোমাকে ঈর্ষাই হয়েছে, কত না ভালবাসার মাঝে তুমি বড় হয়েছো। আমি জানি আমাকে তোমার তেমন পছন্দ হয়নি। তাই এড়িয়ে গেছো যতটা সময় সম্ভব। যদিও জানিনা কি কারণ। হয়তো আমি খুব বেশী সাদামাটা বলে, নয়তো তোমার পছন্দের কারো মতে নই বলে। তবু ভেবেছিলাম নিজের সবটুকু দিয়ে তোমার মনের মতো হবো। মনে হচ্ছে সেটা আমার দ্বারা হবেনা।
গত কয়েক মাসে আমি নিয়ম করে রোজ তোমায় ফোন দিয়েছি, কিন্তু ভেবে দেখ তো তার বিনিময়ে একটা মেসেজ কি আমি পেতে পারতাম না? আমি সেটা মেনে নিয়েছি। আমি এও জানি আমার নাম্বারও তুমি জানোনা। কখনো জানতেই যে চাওনি। আমি ফোনে রোজ তোমার দিন কেমন গেল জানতে চেয়েছি। তুমি কি একদিন ও জানতে চেয়েছো এই একাকী প্রবাসে আমার দিনগুলো কিভাবে কাটে? তুমি হয়তো ভাবতে পারো এক জীবন যে একাকী বড় হয় তার আবার এতো লোক খোঁজার কি আছে? কিন্তু জানো আমারো ভীষণ ইচ্ছে করে প্রিয় কারো জীবনের প্রায়োরিটি হতে। প্লিজ ভেবোনা তোমায় দোষ দিচ্ছি। তুমি হয়তো এমনই। আর আমিতো নিজের কাছেই শপথ নিয়েছিলাম তোমার মনের মতো হবো। কিন্তু এখন কেমন হ্যাংলার মতো এটা দাও ওটা দাও বলে ঘ্যানঘ্যান করছি। আসলে মানুষ একটু পেলে আরো পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয় সেটাই যে স্বাভাবিক।
তোমাকে কত কি লিখবো বলে মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, অথচ দেখো নিজের দুঃখের কাঁদুনি গাইতে বসেছি। তোমার কিছুক্ষণ কোনদিকে তাকিয়ে থেকে মিষ্টি করে দেয়া হাসিটুকু খুব খুব মিস করি। আমার এক জীবনের সবটুকু পুণ্যের বিনিময়ে হলেও আমি তোমার ভালবাসা প্রাপ্তির অপেক্ষায় থাকবো। তবে তুমি যদি অন্য কিছু বা অন্যরকম কোন জীবনের স্বপ্ন দেখো আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমার পথে বাঁধা হবোনা।
খুব পড়া এবং কাজের চাপ যাচ্ছে তাই নিয়মিত ফোন দেয়া হচ্ছেনা। রাঁধতে যেয়ে সেদিন তাড়াহুড়ায় হাত পুড়েছে তাই হাতের লেখা কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং হয়েছে আশা করি বুঝতে পারবে।
‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো
চলে এসো, এক বরষায়।’
অপেক্ষায় থাকবো একটা পুরো জনম।
– আনিস।
চিঠিটা পড়ে কি যে হলো আমার। পাগলের মতো ফোনবুক ঘাঁটতে শুরু করলাম আনিসের নাম্বারের জন্য। কিন্তু সবগুলো নাম্বারের কল এসেছে আননোন নাম্বার থেকে। উপায়ান্তর না দেখে মায়ের কাছে যাই। বাবাকে বলতে কেমন বাঁধো বাঁধো ঠেকছিল, তার পছন্দের ছেলের ফোন নাম্বারটুকুও টুকে রাখিনি বলে। মা আমাকে আশাহত করে বললো, ‘আমার কাছে তো নাম্বার নেইরে, মা। কাল আনিসের মামার বাসায় দাওয়াত দিয়েছে আমাদের। কাল না হয় ওর মামীর কাছ থেকে নিয়ে দেবো।’
আনিস সেই রাতেও ফোন করেনা। পরবর্তী দিন বিকেল পর্যন্ত আমার যে কিভাবে গেছে আমি নিজেও বুঝি জানিনা। আনিসের জন্য সেই অনুভূতির কি ব্যাখ্যা হয় সত্যিই আমার জানা নেই। আজ একটা ভালবাসা দিবস। বন্ধুদের কাছে কত শুনেছি তাদের ভালবাসা দিবসের গল্প। আমার না ছিল এক জীবনে সেরকম ভালবাসার কেউ, যা ও একটা বিবাহ হলো জামাইর সাথে ভুল বোঝাবুঝি; কোন মানে আছে এসবের? বিকেল হতেই মামার বাসায় যেতে তৈরী হয়ে বসে আছি কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই তুমুল ঝড়ের কারণে। বাবা বলে দিল যেতে পারবেনা এরকম খারাপ আবহাওয়ায়। আমি রীতিমত জেদ ধরে বসে রইলাম আমি যাবই। অবেশেষে রাত প্রায় নয়টার দিকে আল্লাহ আল্লাহ করে রওয়ানা দেই আমরা তিনজন। আনিসের মামা বাড়ির দিকটায় তখনো ঝড়ো বাতাস ছিল। সাথে ঢাকা শহরের অত্যাবশকীয় লোডশেডিং। গাড়ি থেকে নামতেই মামা মামী এগিয়ে আসেন বাতি নিয়ে। মা বাবা নেমে একটু সামনে এগিয়ে যান। শাড়ি পরায় অনভ্যস্ত আমি দুই পা এগোতেই বাতাস আর নোংরা পানি থেকে শাড়ি বাঁচাতে যেয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পরতে পরতে থেমে যাই দুটো শক্ত হাতের বাঁধনে।
– কে? কে?
– আমি আনিস।
সারাদিনের মানসিক ক্লান্তি, দুঃশ্চিন্তা, শ্বশুরবাড়িতে প্রথমবার আসা সবমিলিয়ে কেমন যেন জড়ভড়ত হয়ে থাকা এই আমি আনিসকে জড়িয়ে সশব্দে কেঁদে উঠি।
– নীরা, কি হয়েছে? কাঁদছো কেন? সবাই তাকিয়ে আছে। এই নীরা।
– আপনি ফোন দেননি কেন গত তিনদিন? কোথায় ছিলেন? জানেন আমি কত চিন্তা করেছি?
– সত্যি বলছো? আমি কিন্তু বিশ্বাস করে ফেললাম।
– মানে কি?
– মানে কিছুনা। তোমাকে ভালবাসা দিবসে সারপ্রাইজ দিব বলে ফোন দেইনি। আমার জন্য একটা জীবন এমন করেই ভাববে তো?
– আমার বয়েই গেছে।
মুখে বয়েই গেছে বললেও মনের ভেতর বয়ে চলা উথাল পাথাল আবেগরা আমায় জানিয়ে দিল আমি আনিসের প্রেমে পরেছি। কোনরকম সংকোচ ছাড়া বিয়ের পর এই প্রথম আনিসের হাতে হাত রেখে আমি পা বাড়াই নতুন জীবনের পথে।
জীবন আসলে পদে পদে ভালবাসার উপকরণগুলো ছড়িয়ে রাখে। শুধু জানতে হয় কখন কোথা থেকে তা কুড়িয়ে নিতে হবে। এমন একটা লুকোচুরি আনিস না করলে আমার জানাই হতোনা কোন মানুষকে ভালবাসার শুদ্ধতম অনুভূতিটুকু আদতে কেমন হয়।
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস