#একজন রূপকথা
#পর্ব_৮
#নুশরাত জেরিন
কবিতা নীল শাড়ি পরেছে, সাথে নীল কাচের চুড়ি। আয়নার সামনে দাড়িয়ে কপালে কালো টিপ পরে নিলো। চেহারা নেহাৎ খারাপ নয় তার। কথার চেয়েও গায়ের রং উজ্জ্বল, তবুও কথাকে কেনো যে এত সুন্দর লাগে। কবিতা মুখ চোখ কুঁচকালো। আজ বাড়িটা ফাঁকা আছে৷ কথা বেড়িয়েছে রোজিনা বেগমের সাথে। সামনের বাসায় বিয়ের দাওয়াত। কবিতাকেও সাথে যেতে বলেছিল, সে নিজেই যায়নি, ভার্সিটিতে জরুরি ক্লাসের কথা বলে রয়ে গেছে।
শোভন একটু পরেই বাড়ি ফিরবে, একটু আগে বাড়ির ফোনে কল করেছিলো।
কবিতা গুনগুন করতে করতে আয়নায় নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখলো। কলিং বেল বেজে উঠলো। নিশ্চয়ই শোভন এসেছে, কবিতা উৎফুল্ল হয়ে দৌড়ে গেলো। রোজিনা বেগম ফিরে এসেছেন। হটকারিতায় প্রেশারের ঔষধ খাবার কথা মনে ছিল না, বিয়ে বাড়ি গিয়ে অসুস্থ লাগছিলো। বিয়ে বাড়ি বেশি দুরে নয়, হাটা পথ। কথাকে রেখেই বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাকে দেখে কবিতার মুখে অন্ধকার নামলো। রোজিনা বেগম তীক্ষ্ণ নজরে দেখে বললেন,
“ভার্সিটি যাওনি?”
কবিতা আমতা আমতা করলো,
“না মানে, যেতে চেয়েছিলাম, হঠাৎ শরীর খারাপ করলো…!
” শরীর খারাপ থাকলে সেজেছো কেনো?”
কবিতা থতমত খেয়ে এদিক ওদিকে নজর বুলালো। আজকের দিনে এমন একটা পরিস্থিতি হবে সে ভাবতেও পারেনি, কত সুন্দর মুহূর্ত কল্পনা করে রেখেছিলো সে…
একটু হাসার চেষ্টা করলো। হাসিটা ঠিক ফুটলো না, ভয়ে ভেতরটা শুকিয়ে এসেছে, এমন সময় হাসি আসে?
“কেনো আন্টি ভালো দেখাচ্ছে না?”
“আমার প্রশ্নের উত্তর এটা নয়।”
“তুমি আজ এমন ব্যবহার কেনো করছো? তুমি না বলেছিলে আমি তোমার মেয়ে? দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র মেয়ে তোমার বুঝলে!”
রোজিনা বেগমের কন্ঠ আরেকটু ঝাঁঝালো শোনালো,
“তুমি একা নও কবিতা, কথাও আমার আরেকটা মেয়ে। ”
—
শোভন অফিস যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। তার মন আজ ভালো। অফিসের এক উড়ো খবর কানে এসেছে, তার প্রমোশন হতে পারে। মাসখানেক এত খেটেছে অফিসের পেছনে, বসের সুদৃষ্টি পরেছে। শোভন নিজেও লক্ষ্য করেছে, বস আগের তুলনায় তার সাথে খুবই নমনীয় গলায় কথা বলে।
কথা পেছন থেকে বলে উঠলো,
“আজ এত খুশি দেখাচ্ছে, ব্যপার কী?”
“আরেকটা বিয়ে করতে যাচ্ছি না? বোঝোই তো এইসময় একটু খুশি থাকতেই হয়।”
বলেই সে এক চোখ টিপে ধরলো। মুখে দুষ্টুমির হাসি। অন্যসময় হলে কথা ও হেসে ফেলতো, আজ হাসতে পারলো না, মুখটা গম্ভীর হয়ে সরে যেতে চাইলো। পারলো না, শোভন এক হাতে আটকে রেখেছে।
“রাগ করলে?”
কথা মুখ ঘোরালো। শোভন ততক্ষণে দু’হাতের মাঝে তাকে বন্দি করে ফেলেছে। মেয়েটা আগে এমন ছিল না, সে ছিলো সোজা সাপটা ধরনের। রাগ, অভিমান করলেও মুখের ওপর ঠাস করে বলে দিত। আজকাল তার কী যে হয়েছে! কিছু বলার আগেই অভিমানে একেবারে ফুলে ওঠে। মুখ ফুটে কিছু বলেও না।
সে বলল,
“রাগ করছো কেনো কথা, আমি তো দুষ্টুমি করলাম!”
“তাই বলে এসব বলবেন?”
শোভন হেসে ফেললো,
“তুমি আগে কিন্তু একদমই এমন বাচ্চা টাইপের ছিলে না কথা, যথেষ্ট ম্যাচিওর ছিলে।”
“আপনার তো বাচ্চা টাইপ বউই পছন্দ। ”
“উহু, তোমার মতো বউই আমার পছন্দ, আগে যা ছিলো সব বাদ।”
কবিতা দরজায় কড়া নাড়লো।
কথা শোভনের হাতের বেষ্টনী আলগা করে ছিটকে সরে দাড়ালো।
শোভন বলল,
“কিছু বলবে কবিতা?”
কবিতা রুমে ঢুকে বিছানার কোন ঘেঁসে বসলো। ব্যপারটা শোভনের কাছে দৃষ্টি কটু লাগলেও সে টু শব্দ করলো না। কবিতাকে কিছু বললে কথা কষ্ট পাবে।
কবিতা বলল,
“আসলে ভাইয়া, আপনি একটু আমার সাথে আমার ভার্সিটি যেতে পারবেন?”
“কেনো?”
“না মানে, আপাকে বলেছিলাম তো। কিরে আপা? ভাইয়াকে বলিসনি?”
কথা মানা নাড়লো। বিষয়টা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। কবিতা বার বার বলা সত্বেও কিভাবে যে সে ভুলে গেলো।
শোভন বলল,
“কী বলবে?”
“কবিতাকে নাকি কয়েকদিন ধরে একটা ছেলে খুব বিরক্ত করছে, ও নিষেধ করা সত্বেও শুনছে না। সেদিন নাকি ওড়না টেনে ধরেছিলো। তাই যদি আপনি একটু গিয়ে বিষয়টা দেখতেন…!”
“আচ্ছা দেখবো? কবে যাবো তোমার সাথে, আজই?”
কবিতা লাফিয়ে উঠলো, তার চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে,
“হ্যাঁ, আজই।”
—
বাইকে বসার সময় কবিতা সবসময় একটু দুরত্ব বজায় রেখে বসে, নয়ত মাঝে সাইড ব্যাগটা রেখে দেয়। আজ রাখেনি। শোভনের অসস্থি হলেও কিছু বলল না। রাস্তাটা শুনশান, মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। কবিতার কথা মত এই রাস্তায় আসতে হয়েছে, তবে এটা ভার্সিটির রাস্তা না, উল্টোপথ।
দুরে একটা ভ্যানে বৃদ্ধ গোছের এক লোক শরবত বিক্রি করছে, প্রখর রোদে গা পুরে যাবার মত অবস্থা। সকাল সকাল এমন রোদ ওঠার কারণ কী!
কবিতা বাইক থেকে নেমে মিষ্টি করে হাসলো।
শোভন বলল,
“কোথায় ছেলেটা? এখানে তো কাউকেই দেখা যাচ্ছে না?”
কবিতা উত্তর না দিয়ে সামনে হাটতে শুরু করলো। একহাতে তার রেশমি কাচের চুড়ি। কথার আলমারি থেকে চুড়িগুলো নিয়ে এসেছে সে। কথা কখনই চুড়ি পরেনা, শুধু শুধু অবহেলায় ঘরে রেখে দেবে কেনো? কবিতা তো যত্ন করতে জানে, সবাই কী সবকিছুর মুল্য বোঝে!
শোভন আবার বলল,
“এটা তোমার ভার্সিটি যাবার পথ? এখানে আসতে বললে কেনো? ”
কবিতা এবারও উত্তর দিলো না। শোভন জোরে পা চালিয়ে কবিতার পাশ দিয়ে হাটতে শুরু করলো। পেছনে পরে রইলো তার বাইক।
শোভন এবার কিছুটা ধমকের সুরে বলল,
“কী সমস্যা কবিতা? কথা বলছো না কেনো?”
কবিতা সোজা হয়ে দাড়ালো। তার মুখের হাসিটা এখনও আছে। বা হাতটা সামনে বাড়িয়ে বলল,
“দেখুন আমার ঘড়িটা ঠিক আপনার ঘড়ির মতো না?”
শোভনকে প্রতুত্তর করার সুযোগ না দিয়ে আবার বলল,
“আর এই ডানহাতের চুড়ি! আপনি পছন্দ করে কিনেছিলেন তাই না?”
“কথা তোমাকে দিয়েছে? ”
“উহু।”
“তবে পেলে কোথায়?”
“সবকিছু কেনো চেয়ে নিতে হবে? আদায় করে নেওয়া যায় না বুঝি? আপা যে জিনিসের গুরুত্ব বোঝে না, হেলায় ফেলে রাখে, সে জিনিস যদি আমি যত্নে নিজের জন্য ব্যবহার করি। তবে কী খুব বেশি অপরাধ হবে?”
“কথা গুরুত্ব বোঝে বলেই যত্নে তুলে রেখেছিলো কবিতা।”
কবিতা মুখ ফোলালো।
শোভন বলল,
“কথা অসাধারণ একটা মেয়ে জানো কবিতা? প্রচন্ড বোকাও। যে নিজের কথা ভাবে না, তার যারা ক্ষতি করতে চায় তাদের কথা ভাবে। বোকা না হলে কেউ এমনটা করে বলো?
আমি ভাবতাম কথাকে ভালবাসার জন্য পৃথিবীতে দুটো মানুষ আছে, আমি আর তুমি। কিন্তু নাহ্ আমি ভুল ছিলাম। কথাকে ভালবাসার জন্য শুধু আমিই আছি আর কেউই নেই। কেনো নেই কবিতা? কেনো তুমি নেই?”
“কারণ আমি ভালো থাকতে চাই।”
কবিতার দৃঢ় উত্তর শুনে শোভন সোজাসুজি তাকালো। তার চোখ লাল, কেমন ভয়ংকর দেখাচ্ছে তাকে। কবিতা সামান্য ভয় পেলো। শোভন বলল,
“তোমাকে আমি ছোটবোনের নজরে দেখতাম কবিতা, তুমি সেই জায়গাটা নিজে নষ্ট করছো।”
“কিন্তু আমি তো ছোটবোনের জায়গা চাই না।”
“তাহলে কোনো জায়গাই তোমার জন্য রইলো না।”
,
,
চলবে…..