#একজন রূপকথা
#পর্ব-৩
#নুশরাত জেরিন
বাসরঘরটা সাজানো হয়েছে রজনীগন্ধা দিয়ে। খুব বেশি ফুল জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। শোভন নিজেই পাশের দোকান থেকে কিনে এনেছে, কথা যখন খাবার খেতে ব্যস্ত ছিল তখন নিজেই ঘর সাজিয়েছে। তবে এখন খুব লজ্জা লাগছে। ফুল দিয়ে ঘর সাজানোটা হয়ত একটু বেশি বেশি হয়ে গেলো। মেয়েটা যখন ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করবে,
“এসব কী!”
তখন শোভন কী বলবে! তাছাড়া নিজের বাসর ঘর নিজে সাজিয়েছে ব্যপারটা আরও লজ্জাজনক। এসব কাজ সচারাচর বন্ধু বান্ধবেরা করে, অথচ শোভনের দুই বন্ধুই এখন দেশের বাইরে। তাদের আর্থিক অবস্থা শোভনের তুলনায় বেশ ভালো, আচার ব্যবহারও আলাদা তবুও কিভাবে যে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো!
শোভন আরেকবার ফুলে ঘেরা বিছানাটার দিকে তাকালো। তার রজনীগন্ধা ফুল পছন্দ। কথার কী পছন্দ, অপছন্দ এসব কিছুই শোভন জানে না। জানার চেষ্টাও করেনি। শুধু মাসের পর মাস রাস্তায় দাড়িয়ে দুর থেকে কথাকে দেখে মনের তৃপ্তি মিটিয়েছে।
—
কথা এখনও খাবার টেবিলে বসে আছে। সেদিকে একবার নজর দিয়ে শোভন তার মায়ের ঘরে টোকা মারলো। পর পর তিনবার। রোজিনা বেগম দরজা খুললেন গোমড়ামুখে। তিনি জানতেন শোভন আসবে। যে ছেলেটা মায়ের কথার বিরুদ্ধে কখনও এক চুলও নড়েনি সে কিনা মায়ের কথা অমান্য করে একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে? রোজিনা বেগম কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
শোভন বিছানায় বসে বলল,
“ভাত খাও নাই মা?”
রোজিনা বেগম শান্ত গলায় বললেন,
“তোর বউয়ের খবর রাখ, আমার খবর রাখার দরকার নাই। আমি খেলেই কী আর না খেলেই কী! তোর কিছু যায় আসে?”
“তুমি তো রাজি হইছিলা মা, তোমার মত নিয়েই তো বিয়েতে গেলাম।”
রোজিনা বেগম ক্ষীপ্ত গলায় বললেন,
“ঐটারে রাজি বলিস তুই? দু’দিন না খেয়ে ঘরে বসে ছিলি জেদ করে, অসুস্থ হয়ে পরেছিলি। আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করতাম?”
শোভন হাত আঁকড়ে ধরলো,
“এইবারই শেষ বার তোমার বিরুদ্ধে গেছি মা, আর জিবনেও যাবো না। মাফ করে দাও!”
রোজিনা বেগম শান্ত হলেন। তার একটা মাত্র ছেলে। স্বামী মারা যাবার পর কত কষ্টে মানুষ করেছেন। ভাইদের দারে দারে ঘুরে যখন কোনো লাভ হয়নি তখন নিজেই কাজে নেমেছেন। টিউশনি করিয়েছেন৷ সেই ছেলে তার কথার অবাধ্য হয়েছে সেটা মানতেই তার কষ্ট হচ্ছে। তাও আবার কার জন্য! রূপ গুনহীন একটা মেয়ের জন্য? চেহারা সুরতও আহামরি নয়, কী দেখে ছেলেটা পাগল হলো কে জানে! তারচেয়ে রোজিনা বেগমের সইয়ের মেয়ে রুমা.. কী মিষ্টি দেখতে! সারাদিন ছুটাছুটি করে ঘরটা আনন্দে মুখিয়ে রাখতো। এসেছিলও তো দু’একবার। ছেলেটা ফিরেও তাকাতো না। অতচ তাকালো কার দিকে? রোজিনা বেগমের মনটা বিষিয়ে উঠলো। ছেলের উপর থেকে সব রাগ একেবারে মেয়েটার উপর পরলো। বাড়ি আসতে না আসতেই মা ছেলের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে ছাড়লো।
—
কথা শাড়ি পাল্টে ফেলেছে। সারাদিন কম ধকল যায়নি তার উপর। শরীরটা ভেঙে আসছে, সাথে মনও। আরিফের বদলে যাওয়া রূপ তার সহ্য হচ্ছে না।মনটা ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। ওপরে যতই শক্ত থাকার চেষ্টা করুক না কেনো, ভেতরটা তার নরম, তুললতুলে। সামান্য আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়। যদিও আরিফের সাথে তার সম্পর্কটা অতটাও গভীর নয়। কথা বরাবরই বাস্তববাদী মেয়ে। প্রেম ভালবাসাকে জীবনে ঠাঁই দিতে রাজী ছিলো না সে। তবে আরিফের পাগলামীতে রাজী হতে বাধ্য হয়েছিলো। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, একটা ভালো ঘর, সংসার, বর…এইটুকুই। নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ বা প্রেমিক প্রেমিকার মতো হাতে হাত রেখে ঘুরতে যাওয়া হয়নি কখনও, ভালবাসাটা প্রকাশ করাও হয়নি। যদিও ভালবাসা অদৌ ছিল কিনা কে জানে! ভালবাসার ব্যাখা কথা জানে না। শুধু মামির অত্যাচার থেকে বাঁচতে একটা আশ্রয়ের খোঁজ করেছিলো, আরিফ সেই আশ্রয়ের প্রতিজ্ঞা করতেই নতুন স্বপ্নের জাল বুনেছিলো।
কথা বিছানায় শুয়ে পরলো। চোখ বুজে আসছে। শোভন এখনও আসেনি। সারা বিছানা জুরে ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পরিষ্কার করতে ইচ্ছে করছে না।
শোভন ঘরে এসে দরজায় খিল আটকালো। চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে আবার বেরিয়ে এলো। কথা উঠে বসলো। শোভন বলল,
“ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ো, উঠছো কেনো?”
“আপনি ঘুমাবেন তো?”
“হ্যাঁ।”
কথা বলল,
“আপনার মায়ের একমাত্র ছেলে তো আপনি?”
“হ্যাঁ।”
“তবে তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় বিয়ে কেনো করলেন?”
শোভন আমতাআমতা করলো। মা বিয়েতে রাজী ছিলেন না একথা সে কাউকে বলেনি। কথার পরিবারকে তো না ই। তাছাড়া মায়ের রুমে কথা বলার সময় এমনভাবে বলেছে যেনো কথার কান অব্দি না পৌঁছায়, তবু সে শুনলো কিভাবে। এসব তো তার জানার কথা নয়।
সে বলল,
“তোমায় এসব কে বলেছে?”
“কেউ বলবে কেনো? আমি নিজেই বুঝেছি।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
“আমার বাবা বলতো আমার মানুষ চেনার ক্ষমতা নেই, সহজেই আমি সবাইকে বিশ্বাস করে ফেলি, ঠকেও যাই। চেহারা দেখে মানুষ চেনার ক্ষমতা আমার শূন্যের কোঠায়। কিন্তু এবার কিভাবে যেনো আপনার মায়ের চেহারা দেখেই আমার মনে হলো তিনি আমাকে দেখে খুশি হননি। তিনি হয়তো বিয়েতে রাজি ছিলেন না।
কথাটা সত্যি? ”
শোভন ধীরস্থির ভাবে মাথা নাড়লো। বলল,
“জ্বি। ”
“তবে বিয়েটা কেনো করলেন?”
শোভন উত্তর না দিয়ে উশখুশ করতে শুরু করলো। কথাকে সে ভালবেসে বিয়েটা করেছে। প্রতিদিন রাস্তায় দাড়িয়ে মেয়েটাকে দেখতে দেখতে ইদানীং আর তৃপ্তি মিলতো না, কাছ থেকে দেখার, ছোয়ার আশায় ভেতরটা ছটফট করতো। এসব কথা সে কথাকে বলতে পারবে না। সে ভীতু মানুষ। এর আগেও অনেকবার নিজের মনের কথা মেয়েটাকে বলতে গিয়েও বলতে পারেনি। একবার চিঠি লেখবারও চেষ্টা করেছিলো, ব্যর্থ হয়েছে।
কথা উত্তর শোনার আশায় কিছুক্ষণ শোভনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। উত্তর না পেয়ে বলল,
“আমায় বলতে কোনো সমস্যা? ”
শোভন বলল,
“উহু।”
“তবে?”
“ছাঁদে যাবে?”
উত্তর দেবার পরিবর্তে আচমকা এমন প্রশ্নে কথা একটু নড়েচড়ে উঠলো।
বলল,
“এখন? ”
“হু, আজ আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে, জানো? যাবে আমার সাথে?”
কথা নিষেধ করতে গিয়েও করলো না। সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কিছুটা স্যাক্রিফাইজ করতেই হবে। আজ নাহয় ঘুমটাকে স্যাক্রিফাইজ করলো। যেহেতু বিয়েটা হয়েই গেছে, লোকটা তো তার স্বামী। অন্য সবার মতো প্রথম রাতেই বউয়ের উপর হামলে না পড়ে লোকটা তাকে সময় দিচ্ছে, এর চেয়ে ভালো কিছু আর কী হয়। কথা একদফা মুগ্ধ চোখে শোভনকে দেখলো। চোখ ধাধানো সুন্দর না হলেও দেখতে মন্দ না। এমন একজনের সাথে সারাজীবন অনায়াসে কাটানোই যায়।
হঠাৎ কথার মনটা খুব ভালো হয়ে গেলো। ভেতরে ভাঙা চুরো স্বপ্নরা আবারও যেনো ডানা মেলতে চাইছে।
সে বলল,
“চলুন।”
ছাদে এসে কথার মনটা আরও একদফা ভালো হয়ে গেলো। ছাদটায় কোনো সাজসজ্জা না থাকলেও কেমন মিষ্টি পরিবেশ। চাঁদের আলোয় পরিপূর্ণ চারিপাশ। কথা রেলিং ধরে দাড়ালো। চুলগুলো আরো আগেই খুলে দিয়েছে সে
শোভন দিধাদন্দ সরিয়ে কথার হাতের উপর হাত রাখলো। কথা হাত সরালো না, প্রতুত্তরও করলো না। সে কেবল আরও একবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করলো।
,
,
চলবে….