গায়ের কাপড় ঠিক করুন ভাবী, আমি অন্ধ…..
আচ্ছা, আমি তোর কোন জনমের ভাবীরে? আর বয়সেও তো তোর তেরো মাসের ছোট, আমাকে আপনি করে কেন বলিস?
কমলিনীকে ভাবী ডাকতে আমার ভালো লাগে। অথচ তার সাথে আমাদের আত্মীয়তার কোনো সম্পর্কও নেই। সবাই ভাবে আমি অন্ধ, দেখতে পাই না। কত ডাক্তার, কবিরাজ, হুজুরের পানিপড়া গুলে খাওয়ানো হলো… সবাইকে আমি একটা উত্তরই দিই; দেখতে পাচ্ছি না!
পরিবারে প্রথম প্রথম আগ্রহ থাকলেও এখন কপালের দোষ বলে মেনে নিয়েছে। আমার অন্ধত্ব নিয়ে মা-বাবা প্রায়শই ঝগড়া করেন। এ বলে ওর জন্য আমি এরকম হয়েছি, ও বলে এর জন্য এরকম হয়েছি। আমি উপভোগ করি।
অন্ধের অভিনয় করতে ভালো লাগে, তবে বেশ বেগ পোহাতে হয়।
মানুষ চামড়ার চোখ দিয়ে অনেক কিছু দেখে না, অনেকে আবার আরও এক কাঠি সরস; দেখেও না দেখার ভান করে। আর আমি তো অন্ধের অভিনয়ই করি! সবার কাছে আমি যেন দুধভাত। আমাকে কেউ ভয় পায় না, অপকর্ম করেও মনে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে। আমি তো চোখেই দেখি না! তাছাড়া, কাউকে তো বলতেও যাবো না। আমি যে অন্ধ নই এই কথা সবার অগোচরে রাখার মধ্যেই আমি আনন্দ উপভোগ করি। এ জন্য মাঝে-মাঝে নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
ওই যে, গত মাসের সাতাশ তারিখ; রাতে আমি বাইরে বসে আছি। দেখলাম, রুহেলের বউটা খুব পরিপাটি হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে মাতব্বরের ঘরে ঢুকে পড়লো। আমাকে অবশ্য দেখেছিল, পথিমধ্যে
কুকুর-বিড়াল দেখে মানুষের যেমন ভাবান্তর হয় না ঠিক ওই রকম সাতপাঁচ না ভেবে রুহেলের বউ এগিয়ে গেল।
বেরিয়ে এলো পাক্কা তেতাল্লিশ মিনিট পর!
কী? সময় কীভাবে বললাম? আমার হাতঘড়ি আছে না!
এসব হজম করতে আমার খুব কষ্ট হয়, গোপন কথা বলতে না পারলে পেটের মধ্যে কী যেন শক্ত হয়ে বসে থাকে। নড়তে চড়তে পারি না। বমি বমি ভাব
আসে; কাউকে যে বলব সে উপায় কোথায়?
তবে কমলিনীকে মাঝে মধ্যে বলি, ও হাসে। হাসার সময় ও চোখ বন্ধ রাখে, আমার ভালো লাগে। হাসিও যে একটা শিল্প তা কমলিনীর হাসি না দেখলে কখনও বুঝতেই পারতাম না!
আচ্ছা, ও কি শুধু আমার সামনেই অমন কায়দা করে হাসে? আমি তো চোখেই দেখি না…
নাকি সে জানে, আমি অভিনয় করে যাচ্ছি!
ভালো কথা, ওর নাম কমলা। খুব ছোটবেলা থেকে পরিচিতদেরকে আমি আমার রাখা নামে ডাকি। কেউ কেউ আপত্তি জানালেও কমলিনী কখনো আপত্তি জানায়নি। অথচ ওর আপত্তি জানানোর বেশ কারণ ছিল; ওর বিয়েই হয়নি তবুও তাকে আমি ভাবী ডাকি।
এই মেয়েটা প্রায় সময় উদ্ভট উদ্ভট কাজ করে বসে। সেদিন কাকে দিয়ে যেন বাজার থেকে আলতা এনেছিল। কৌটাটি আমার হাতে দিয়ে বলে; ঠাকুরপো, একটুখানি আলতা লাগিয়ে দাও তো!
আমি অবশ্য খুব সহজেই পার পেয়ে গিয়েছিলাম। হাতে নেয়ার সময় কায়দা করে কৌটার সবটুকু আলতা মাটিতে ফেলে দিয়েছি।
আসার পর থেকেই আজকে তার কথাবার্তা আমার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছিল না। প্রতিদিন আমার থেকে কথা শোনার জন্য সে কতরকম বাহানা করত অথচ আজ তার মুখেই কথার খই ফুটছে। আমি একান্ত বাধ্যগত শ্রোতা হয়ে শুনছি; শুনছি আর হ্যাঁ হু করে উত্তর দিচ্ছি।
: ঠাকুরপো?
– হুম…
: একটা মজার ঘটনা শুনবি?
– হুম
শোন তাহলে, সে রাতে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম, নানান ধরণের চিন্তা করছি। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো… ঠাকুরপো, শুনছিস?
হ্যাঁ…
আচ্ছা, তো আমি ভাবলাম এত রাতে আবার কে আসলো! আবার দরজায় ঠকঠক শব্দ। আমি ভেতর থেকে বললাম কে? কোনো উত্তর আসার বদলে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ কেবল তীব্র হচ্ছে। আমি চুল ঠিক করতে করতে দরজা খুললাম। দেখলাম, এক সাহেব কাকভেজা হয়ে কাঁপছে। ঠাকুরপো, শুনছিস তো?
হুম।
তারপর, বেচারাকে দেখে আমার ভীষণ মায়া হলো। ভাবসাব শহুরের মতো। কিন্তু তুই তো জানিস আমার ঘরে কেবল একটাই খাট। আর সাপটাপে খুব ভয় পাই। ওই রাতে সাহেব আমার ঘরেই ছিল; এক সাথে। আমারও কী জানি হলো! শরীর কেমন জ্বলছিল! কুপির নিভুনিভু আলোতে কেমন শিহরণ জাগছিল!
অথচ ভোরে আমার ঘুম ভাঙার আগেই বেচারা পালিয়ে গেল… ঠাকুরপো, ঘটনাটি মজার না?
না…
তাহলে?
নোংরা, কুৎসিত ঘটনা….
ধুর… তুই ব্যাটা আসলে কাপুরুষ।
দীর্ঘক্ষণ কেটে গেল, কোনো কথা নেই। আজ বোধহয় কমলিনীর মন খারাপ। সে নিঃশব্দে কাঁদছে! আমি ভাবছি, কান্নার কারণ কী হতে পারে? কান্না করছে আর একটা পা আরেকটার সাথে ঘষছে। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকার ভান করলাম।
সে উপুড় হয়ে বসেছিল, হঠাৎ খেয়াল করলাম; বুক থেকে কাপড় সরে গেছে। আমি যেন ভেতর থেকে এক ধরণের ধাক্কা খেলাম। এমন ধাক্কা সব সময় কিংবা সব মুহূর্তে আসে না।
সাপ হিসহিস করলে শরীরে যেমন রিরি করে এই ধাক্কা খাওয়ার পর আমার শরীরেও তেমন রিরি করছিল।
লাঠিটা হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “গায়ের কাপড় ঠিক করুন ভাবী, আমি অন্ধ… না, এখন দেখতে পারছি, ঠিক এই মুহূর্ত থেকে সবকিছু দেখতে পারছি!”
সামনের দিকে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে কমলিনী বলে উঠলো, আমি তোর কোন জনমের ভাবীরে?….
ওসব কথার উত্তর এখন দেয়া যাবে না; মায়ায় পড়ে যাব! এখানে দাঁড়ানোই ঠিক হবে না। দাঁড়ালে পেছনে ফিরতে হবে আর পেছনে ফিরলে দেখব কমলিনী, আমার ভাবী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কান্নার তোড়ে তার বুক ফুলে ফুলে উঠছে….
না, দাঁড়ানো যাবে না। হাঁটার সময় পেছনের দিকেও তাকানো যাবে না। তাকালে মায়া বেড়ে যাবে আর এই মায়া খুব ভয়ঙ্কর, খুব….
একজন কমলিনী
আরাফাত তন্ময়(বুনোহাঁস)।