#একজন_অপরাজিতা (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা
“আমি যেদিন বাবার…”
বাক্যটা অসম্পূর্ণ রইল। অপরাজিতা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ক্ষণেক বসে রইল অধোমুখে। এরপর আবারও বলতে শুরু করল,
“সেদিন জীবনে প্রথমবার নিজের কৃতকর্মের জন্য প্রবল অনুশোচনা হয়েছিল। মনে হয়েছিল মস্ত ভুল করেছি। তবুও শোয়েবের দিকে তাকালে ভাবনাটাকে মন প্রশ্রয় দিতে চাইত না। কিন্তু শোয়েবের আচরণ যেন তার পর থেকেই বদলে যেতে শুরু করেছিল। সবসময় আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত। ও হয়তো ধরেই নিয়েছিল আমার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। যা কিছু ও করুক বা বলুক আমাকে মুখ বুজে সব মেনে নিয়ে ওর সাথেই থাকতে হবে। আমার নিজস্ব সত্তা আছে, সেটা মেনে নিতেই যেন ওর প্রবল আপত্তি শুরু হলো। আমি সারাজীবন মাথা নিচু করে চলার মতো কোনো কাজ করিনি কোনোদিন। এমনিতেই তখন আমার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না, তার উপর ওর এমন আচরণে আমি ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।”
আবারও নীরবতা নেমে এলো ঘরজুড়ে। অপরাজিতার ঠোঁটে ম্লান হাসি ফুটল। কারো হাসিতে যে এমন অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ থাকতে পারে আমি আজই প্রথম জানলাম। সান্ত্বনা সূচক কোনো কথা মুখে জোগায় না। অপরাজিতা আবারও বলতে শুরু করল,
“আমার এই যে হার না মানার মানসিকতা, এটা ওর সহ্য হতো না। মেল ইগো! যার প্রকৃত অর্থে কোনো আশ্রয় নেই, তার কেন নিজস্বতা থাকবে, ব্যক্তিত্ব থাকবে! ব্যক্তিত্বের সংঘাতে ও আসলে আমার থেকে পিছিয়ে পড়ার ভয়ে ছিল। কিন্তু এটা ওর মাথায় আসেনি যে আমি এসব দ্বন্দ্ব সংঘাত কিংবা হারজিতের প্রতিযোগিতার মাঠে নামিনি। আমি প্রকৃত অর্থেই ওকে ভালোবেসে ওর হাত ধরেছিলাম।”
শোয়েব এখন একবার যদি অপরাজিতার মুখে ভর্ৎসনা ভরা অভিব্যক্তিটুকু দেখতে পেত, নিশ্চিত সে ভস্ম হয়ে যেত।
“এরমধ্যে ওর মোটামুটি একটা চাকরি হলো। প্রথমে আসার পর যে ছোটখাটো একটা কাজ পেয়েছিল সেটা ছেড়ে দিল। আমরা বাসা বদল করলাম। ওর সাথে বড় ঝামেলা শুরু হলো, আমি আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাইলে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কিছু বই কিনে আনলাম ওকে না জানিয়ে। পালিয়ে আসার আগে আমার জমানো কিছু টাকা আমি সাথে এনেছিলাম। বেশিরভাগ অবশ্য ওর হাতেই তুলে দিয়েছিলাম৷ কী মনে করে যৎসামান্য কিছু নিজের কাছে রেখেছিলাম। দুদিন পরেই বইগুলো ওর চোখে পড়ল। আমার চোখের সামনে বইগুলো ছিঁড়ে জ্বা লি য়ে দিয়েছিল।”
বলতে বলতে অপরাজিতার চোখ দুটো আজও যেন জ্বলে উঠল।
“আমি ভাবলাম এটাই শেষ। সব মেনে নিলেও নিজের অসম্মান চেয়ে চেয়ে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু তখনই আবার দৃশ্যপট বদলে গেল। জানলাম মা হতে চলেছি। সব কিছু ছাপিয়ে কী যে আনন্দ হয়েছিল আমার সেদিন। একটা ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্ব তৈরি হচ্ছিল আমার মধ্যে। আমি সেদিন আনন্দে কেঁদেছিলাম পাগলের মতো।”
অপরাজিতা নিজের গল্প বলা শুরুর পর এই প্রথম ওকে সত্যিকারের হাসি হাসতে দেখলাম। তবে সেটা মুহূর্তের জন্যই। সে আবার বলতে শুরু করতেই ওর মুখাবয়বে কতবার যে অভিব্যক্তির বদল দেখলাম,
“সাথে এটাও ভাবলাম এবার নিশ্চয়ই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। যে ভালোবাসার টানে ঘর ছেড়েছিলাম, সেটা তো একেবারে ঠুনকো ছিল না। তাই আরেকবার ভরসা করতে চাইলাম। কিন্তু ও আসলে ভরসার যোগ্যই নয়, ভালোবাসা তো কোন দূর। বুঝতে পারলাম শোয়েব দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত নয়। নিজেদের টানাটানির মধ্যে সন্তান নিতে আপত্তি করতে লাগল। সংসারের টানাটানি যে নিছকই অযুহাত সেটা বুঝতে আমার কোনো বেগ পেতে হয়নি। ওর আসল উদ্দেশ্য ছিল আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া। কারণ বিয়ের পরে পরে সে-ই সন্তান নেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। হয়তো তখন আমার বাবার মেনে নেবার একটা আশা দেখেছিল। রাজকন্যা তো পেল, রাজ্যই বা বাকি থাকবে কেন! কিন্তু ওর সে স্বপ্ন তো আর পূরণ হবার ছিল না।
“আমার নিজের মধ্যে যে বেড়ে উঠছিল, তার চাইতে আপন পৃথিবীতে তখন আমার আর কেউ নেই। তাকে পৃথিবীর আলো বাতাসে স্বাগত জানাবার আগেই নিশ্চিহ্ন করে দেবার কথা যে বলতে পারে তার জন্য ঘৃণায় আমার সমস্ত হৃদয় ভরে উঠল। আমি তীব্রভাবে প্রতিবাদ করলাম। ফলস্বরূপ গায়েও হাত তুলল। অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করতে পারি না, জানিস তো। কিন্তু ওর সাথে পেরে উঠার মতো শক্তি সেদিন ছিল না। একদিন রাতের অন্ধকারে ভুল মানুষের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলাম, তার খেসারত হিসেবে তেমনই আরেকটা রাতে তার হাত থেকেই মুক্তির জন্য আবারও পালালাম। ওমনই এক নিকষ কালো রাতে।”
শুনতে শুনতে আমি শিউরে উঠলাম। চিরচেনা অপরাজিতার সাথে ঘটনাগুলো আমি মেলাতেই পারলাম না। কেমন একটা যন্ত্রণা হচ্ছিল আমার ভেতরে। ওমন একটা ভুল মানুষের জন্য ওর মতো একটা মেয়ে কিনা এভাবে অন্ধের মতো… আর ভাবতে পারলাম না। সে বলে চলল,
“বাবার ব্যাপারে যেদিন জানলাম, আমি সেদিনই মরে গেছি রে। তখন মনে হতো, ভালোবাসা বলে আসলে কিছু নেই। আমরাই মিছে আল্পনা আঁকি, স্বপ্ন দেখি, বালুচরে ঘর বাধি৷ পলকা বাতাসে কিংবা তুচ্ছ ঢেউ এলেই সব ভেঙেচুরে যায়, ভেসে যায়।”
“ওই বয়সে হয়তো…” আমি নিজে মানতে না চাইলেও কেবলমাত্র সান্ত্বনা দেবার জন্য মুখ খুলতেই মেয়েটা আমাকে থামিয়ে দিল,
“অতি আত্মবিশ্বাস কাল হয়েছিল, বয়সও অল্প ছিল। তাই সবচাইতে বড় ভুলটা হয়তো অনায়াসে করে ফেলেছি। বয়সের দোষ’ই হয়তো বলতে পারে কেউ কেউ, কিন্তু সেটা কেবলই বাজে অযুহাত। আমি আমার নিজের ভুলের জন্য তাই অযুহাত দাঁড় করাতে চাই না, সেটা পছন্দও করি না। যা ঘটেছে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে আমি নিজেই দায়ী। কারণ আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হয়, সময় নিতে হয়, হুট করে কিছু করার আগে অসংখ্যবার ভাবতে হয়। আমি সেসব আমলেই নিইনি। সেক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ হয়েছিলাম আমি।”
এখন মনে হলো অপরাজিতা আসলে এখনো সেই স্কুলের সেই মেয়েটার মতোই স্পষ্টভাষী। যে নিজেকে নিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেও পিছপা হয় না।
তবে আমি বসে আছি নিকষ কালো আঁধার রাতের পরে আসলে কী হয়েছিল তা জানতে। অপরাজিতা সেটা উপলব্ধি করে আবারও বলতে শুরু করল।
…….
(ক্রমশ)