#একজন_অপরাজিতা (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা
আজ নিজের কাজে এতটুকু মন বসাতে পারলাম না সারাদিন। ভাগ্যিস রোহান সাথে এসেছিল। নইলে ডাটা কালেকশন শেষই করতে পারতাম না। ওদিকে হাতে সময়ও বেশি নেই, ড্রাফট কপি জমা দেবার ডেট দিয়ে দিয়েছে।
বেচারার নিজের কাজই পিছিয়ে আছে, তবুও আমার সাথে এসেছে। ওর এতটা আন্তরিকতার বিপরীতে আমার কাছ থেকে একরাশ নির্লিপ্ততা ছাড়া কিছুই পায়নি। তবুও বন্ধুত্বের অজুহাতে আমার সঙ্গ ছাড়েনি। ভালো-মন্দে কোনো মুহূর্তেই নয়। এতটা আমি ডিজার্ভ করি না বোধহয়।
সূর্যটা আজ তেজোদ্দীপ্ত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছিল পৃথিবীতে। তবুও কেমন প্রচন্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। আমি ছাতা আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। ঘেমে নেয়ে রোহানের পাশে হাঁটতে হাঁটতে আমার মন আবার চলে গেল অপরাজিতার কাছে। ওর পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পরে ছুটে গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে।
গিয়ে দেখলাম ওর বাবা একেবারে ভেঙে পড়েছেন, নিজের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মেয়ের খোঁজ করছেন। তিনি মেয়েকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, মেয়ে তার সমস্ত বিশ্বাস গুড়িয়ে সেটার অপব্যবহার করবে, এটা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি।
অপরাজিতার দাদি কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আগে থেকেই বিষয়টা সম্পর্কে অবগত ছিলাম কিনা! কী বলব তাকে! আমার ধারণা ছিল অপরাজিতা আমাকে সব বলে। কিন্তু নিজের জীবনের এত বড় একটা ঘটনা আমার কাছ থেকে বেমালুম চেপে গেল! আমি আদতে ওর বন্ধু কতটা হতে পেরেছিলাম সেটাই তো জানি না!
বিকেলে বাড়িতে এসে মন খারাপ করে শুয়ে ছিলাম, মা আমাকে রীতিমতো ঠেলে তুলে দিলেন।
“অপরাজিতার বাবার স্ট্রোক হয়েছে।”
আমার হৃৎপিণ্ড যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। কানে বারবার মায়ের কথাটা ঘুরেফিরে বাজতে লাগল।
ওইদিন সন্ধ্যার খানিক পরেই খবর এলো, আশরাফ আঙ্কেল আর নেই। স্ত্রীকে হারিয়ে মেয়েকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, মেয়ের দেয়া এত বড় আঘাত তিনি সইতে পারেননি। আমি আরেকবার অপরাজিতার বাড়িতে ছুটলাম।
সেখানে আমার পক্ষে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। অন্ধকারের তোয়াক্কা না করে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। নদীর পাড়ে ঘাসের উপর বসে নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, হুহু করে কেঁদে উঠলাম। নদীর পাড় আমাদের বন্ধু দলটার কত সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী ছিল। সেই নদীর জলেই যেন ভেতরের কষ্টগুলো বিসর্জন দিচ্ছিলাম। ভেতরকার সব যেন দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। সেই কান্নায় আশরাফ আঙ্কেলের এভাবে চলে যাওয়ার জন্য কষ্ট মিশে ছিল, নাকি অপরাজিতার এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের হতাশা সেটা আজও জানি না! তবে আমি বিশাল এক ধাক্কা খেয়েছিলাম। কোথাও যেন বিশ্বাসের ভিত যেন টলে উঠেছিল বন্ধুত্বের উপরে, কাউকে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে।
যারা সব বুঝতে পারে, অন্যের ভুল শুধরে দেয়, তারাই যখন এমন অবুঝের মতো কাজ করে, তার কোনো ব্যাখ্যা থাকে কি? অপরাজিতার উপরে অসম্ভব রাগ হলো। যে ভালোবাসা নিয়ে কত জ্ঞানগর্ভ কথা বলত, সে-ই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনল। ওর বাবার কথা একবারও ভাবল না!
অপরাজিতার ভুল সিদ্ধান্ত একটা হাসিখুশি পরিবারকে ধ্বংস করে দিল। দাদি তাদের গ্রামে চলে যাবার আগে আমার হাত দুটো ধরে বলে গেলেন,
“ও-ই মুখপুড়ী যার সাথে পালাইছে, সে ভালো হইলে একটা কথা ছিল, লাফাঙ্গা পোলার সাথে পলাইল, হাতে ধরে নিজের সর্বনাশ করল।”
শোয়েব ভাইয়ের কাছে আমরা প্রাইভেট পড়তাম। তার সাথে কখন অপরাজিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেটা এতটা গভীর-ই বা কখন হয়েছিল, আমরা কেউ টেরও পাইনি।
অপরাজিতার সাথে এরপর আর কোনোদিন দেখা হয়নি আমার। আবার এত বছর পর ২০১৫ সালে এসে…!
“রোহান, তাড়াতাড়ি হাঁট না!”
“তুই এত অস্থির হচ্ছিস কেন হৃদি? এতদিন অপেক্ষা করেছিস, আর এটুকু পারছিস না?”
আমার অনুভূতি কাউকে বোঝাতে পারব না, কেন যে এমন অসহনীয় অস্থিরতা আমাকে ঘিরে ধরছে আমি নিজেই বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি।
ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল কেন যেন! দরজার কড়া নাড়লাম, টিনশেড ঘরটায় শক্ত কাঠের দরজা। বাইরে ফুলের বাগনটায় নানারকম ফুল ফুটে আছে। আরেকটা প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি মারছে সহসাই। যে সুখের নেশায় অন্ধ হয়ে অপরাজিতা ঘর ছেড়েছিল, সেই সুখ কি সে পেয়েছে!
“আমি ভেতরে যাব না, তুই যা!”
রোহানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, “কেন?”
“তোদের কত কথা জমে আছে, আমি থাকলে মন খুলে কথাগুলো হয়তো বলা হবে না।” রোহানের কথা শেষ হতে না হতেই দরজার ওপাশে শব্দ পেলাম ছিটকিনির।
অপরাজিতা দরজা খুলে প্রবল বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হতভম্ব ভাব কাটতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। জীবনে প্রথমবার ওকে কাঁদতে দেখলাম।
“তুই খুব স্বার্থপর রে অপি।” অসাড়তা কাটিয়ে বলেই ফেললাম।
চোখ মুছে নিজেকে ধাতস্থ করে অপরাজিতা বলল, “সাথে হিপোক্রেট বলবি না, হৃদি?”
“কেন সেদিন ওমন করেছিলি? আঙ্কেল…”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে বলল, “অতি সাবধানি মানুষের হুট করে পা হড়কায়। আমারও মতিভ্রম হয়েছিল।”
রোহান ভেতরে এলো না, আমাকে ইশারা করে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। আমি অপরাজিতার সাথে ভেতরে ঢুকলাম।
ঘরে জিনিসপত্র তেমন নেই, সাদামাটা কিন্তু বেশ পরিপাটি। দু’জন পাশাপাশি বসলাম, আমি প্রশ্ন করলাম,
“কেমন আছিস?”
অপরাজিতার চোখেমুখে সবসময়কার আত্মবিশ্বাসী অভিব্যক্তি যেন মিলিয়ে গেল সহসা। কেমন একটা ফ্যালফ্যালে চাহনি ফুটে উঠল চোখে। তবে সেটা মুহূর্তের জন্যই। পুরোনো আত্মবিশ্বাস নিমিষেই ফিরে এলো অপরাজিতার চোখেমুখে। তবুও কেন জানি না অচেনা আশঙ্কায় আমার ভেতরটা দুলছিল।
বয়কাট দেয়া অপরাজিতার চুল এখন পিঠময় ছড়িয়ে আছে। চোখে যেন বিষাদের ছাপ। মাঝের এতটা সময়ে মেয়েটা বড্ড বদলে গেছে।
“বেঁচে আছি, শ্বাস টানছি। এর চাইতে বেশি জীবনে আর কী চাই বল।”
বলতে বলতেই ওর মুখে জায়গা করে নিল উদ্ভাসিত হাসি। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “তোর খবর বল তো। কী মিষ্টি লাগছে তোকে। তুই কেমন আছিস ভীষণ জানতে ইচ্ছে হতো।”
“মিথ্যে কথা বলিস না। একবারও তো যোগাযোগ করিসনি।” জমাট অভিমান যেন বেরিয়ে এলো আমার গলা দিয়ে।
“কোন মুখে যোগাযোগ করতাম বল?”
“তোর সব কথা শুনতে চাই অপি। কেন করেছিলি? এখন কেমন কাটছে?”
কিছুক্ষণ মেঝের দিকে দৃষ্টি ফেলে বোধহয় নিজেকে ধাতস্থ করে নিল, এরপর অপরাজিতা খুলে দিল ওর জমানো ঝাঁপি, যেটা এতদিন আবদ্ধই ছিল।
“শোয়েবকে তো দেখেছিস। ওর বাবা-মায়ের ডিভোর্সের পরে টিউশনি করে চলত, ওর স্ট্রাগলটা আমাকে ভীষণভাবে টানল। কেন যেন মায়া হতো বড্ড। সে-ও হয়তো বুঝতে পেরেছিল আমার দুর্বলতাটুকু। একদিন আচমকাই আমাকে প্রপোজ করল, আমি পুরো দু’দিন ভেবে সম্মতি দিলাম। আর কাউকে না বললেও তোকে বলব ভেবেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলার সাহস হয়নি!”
আমি কিছুই বললাম না, আজ সে বলুক। আজ আমার শোনার দিন,
“ওর তখন পড়াশোনা শেষ, চাকরির সন্ধানে ঢাকায় চলে যাবে। তখন নাকি আমাকে হারানোর ভয় পেল। অনবরত ফুঁসলাতে লাগল। ভালোবাসার মোহে সমস্ত বিবেচনাবোধ ভাসিয়ে দিয়ে ওর হাত ধরে ঘর ছাড়লাম। তাতেই আমার ভরাডুবি হলো।”
চোখ আবারও সজল হলো, বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ভালোবাসা অন্ধ, কথাটা কতটা সত্যি সেটা হাড়ে-মজ্জায় টের পেলাম। বিয়ের পর থেকেই বাবার সাথে মিটমাট করতে বলত, প্রায়ই সন্তান নেবার জন্য তাড়া দিত। তাহলে নাকি বাবা মেনে নেবে। আমিও অন্ধের মতো বিশ্বাস করলাম, চার মাস পরে ও-ই বাবার খবরটা নিয়ে আসে।”
আমার মনে প্রশ্ন জমল, শোয়েব কোথায়! যার জন্য ওর মতো মেয়েরও মনের প্রবল বাঁধ ভেঙেছিল৷ ভালোবাসার মোহে অন্ধ হয়ে গয়েছিল! কিন্তু আজ আর কোনো প্রশ্ন করতে হয় না, অপরাজিতা নিজেই খুলে দেয় মনের ঝাঁপি।
মেয়েটা সহসা ডুকরে কেঁদে উঠল, “দুর্ভাগ্যের শুরু তখনই।”
আমি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম, বাকি ঘটনা শোনার জন্য কেমন উদগ্রীব হয়ে বসে আছি। তবে এটুকু বুঝতে পারলাম, শোয়েব ওর সাথে নেই। কেন’র জায়গায় এবার আমার মাথায় এলো, কী হয়েছিল অপরাজিতার জীবনে!
…….
(ক্রমশ)