একজন অপরাজিতা (পর্ব ১) (কেউ কপি করবেন না)
নুসরাত জাহান লিজা
কিছুক্ষণের জন্য আমার সমস্ত অনুভূতি থমকে গেল৷ আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। সেই আত্মবিশ্বাসী মুখটা চিনতে আমার কখনো ভুল হবার কথা নয়। অস্ফুটস্বরে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা নাম,
“অপরাজিতা..”
সম্বিত ফিরতেই অপরাজিতাকে আর খুঁজে পেলাম না। অস্থিরবোধ করলাম। ওর সাথে দেখা করতেই হবে। যেখানেই গিয়েছি, মনে মনে ওকে খুঁজেছি। এক শব্দের প্রশ্নের উত্তর যে পাওয়া হয়নি কোনোদিন।
আজ এভাবে চোখের সামনে দেখব সেটা ভাবিনি। অপরাজিতা আমার হৃদয়ে যেমন অক্সিজেন ভর্তি করে দিয়েছিল, তেমন ভাবে বিশ্বাসের থলিতে একটা ছোট্ট ফুটোও করে দিয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট সে ফুটোটা ধীরে ধীরে অক্সিজেন বাইরে বের করে দিচ্ছিল প্রতিনিয়ত।
বন্ধু রোহানকে নিয়ে মাস্টার্সের থিসিসের ডাটা কালেকশনে এসেছি মোহনগঞ্জে। এই এলাকার প্রাইমারি স্কুলের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় বারান্দায় চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়ালাম। কিন্তু অপরাজিতাকে আর দেখতে পেলাম না।
“কী রে, এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?”
রোহানের কথায় আড়ষ্টতা কাটিয়ে মৃদু হাসি ফোটাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ব্যর্থ হলাম বোধহয়।
“হৃদি, তোকে ঠিকঠাক লাগছে না। পানি খা।”
পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে উৎকণ্ঠিত গলায় কথাটা বলল রোহান। ছেলেটা আমাকে ভীষণ ভালো বুঝতে পারে। এটা আমি বুঝি, কিন্তু ওইযে আমার ভেতরে বিশ্বাসের প্রকোষ্ঠে তৈরি হওয়া ছোট্ট ফুটোটাই যত নষ্টের গোড়া। যা আমাকে কারোর প্রতি বিশ্বাস করতে নিরুৎসাহিত করেছে সবসময়। তবে ছেলেটা আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু। ভুল বললাম, অপরাজিতার পরে।
দু’জনে স্কুল ফেরত কিছু ছেলেকে জিজ্ঞেস করে তার বাড়ির ঠিকানা পেলাম, সে এই স্কুলেরই শিক্ষিকা। ডাটা কালেকশনে ব্যস্ত সময় কাটলেও মন পড়ে রইল অপরাজিতার কাছে, দ্বিতীয়বার হারিয়ে ফেলার আগেই ওর কাছে পৌঁছাতে হবে। দ্রুত কাজ শেষ করে রোহানকে নিয়ে ওর বাড়ি খুঁজতে বের হলাম। কেমন আছে এখন মেয়েটা?
অপরাজিতার উপর আমার অভিমান জমে জমে আকাশ প্রমাণ। অথচ একসময় ভাবতাম আমি বোধহয় ওকে চিনি৷ কতবড় ভুল ভাবনা! মানুষ চিনতে অনেক সময় গোটা জীবনটাও কম হয়ে যায়, সেখানে ছয় বছর নিতান্তই তুচ্ছ! তবে অল্প সময়ের পরিচয়ে তারা এমন গভীর ছাপ ফেলে যায়, যে সারাজীবন হৃদয়ের চোরাকুঠোরীতে সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে।
সেই ২০০২ সালে ওর সাথে প্রথম দেখা হওয়ার ক্ষণটা এই ২০১৫ সালে এসেও এখনো আমার মানসপটে বড্ড উজ্জীবিত। জানুয়ারি মাসের কনকনে ঠান্ডায় সপ্তম শ্রেণির ক্লাস শুরু হলো।
সাথী, মোহনা, টুম্পা, নিশি আর আমি আগেভাগেই স্কুলে যেতাম। এস্যাম্বলি শুরু হবার আগ পর্যন্ত প্রতিদিনের মতো সেদিনও গেটের কাছাকাছি আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের চোখ আটকে গেল বাইরে, স্কুল ইউনিফর্ম পরা একটা মেয়েকে দিব্যি সাইকেল চালিয়ে আসতে দেখে। মাথায় ছেলেদের মতো ছোট করে কাটা চুল, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, মুখে কোমলতার লেশমাত্র নেই। ওকে দেখে আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে গেল! সেই সময় কিছু এনজিও কর্মী ছাড়া আমাদের এলাকায় কোনো মেয়েকে সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালাতে দেখা যেত না। অন্তত আমরা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম না। সেদিন আমাদের পুরোপুরি এড়িয়ে গটগটিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল মেয়েটা।
কিছুদিন পরেই আমরা বুঝতে পারলাম, এই মেয়ে ভীষণ নাক উঁচু। কারণ এই কয়েকদিন পরেও দেখলাম ক্লাসের কোনো গ্রুপের সাথেই তার সখ্যতা নেই।
অনেকেই আড়ালে আবডালে বলত, “এই মেয়ের যে কী ভাব! ভাবের ঠ্যালায় মাটিতে পা পড়ে না! নিজেকে যে কী মনে করে!”
কথাগুলোর সত্যতা সম্পর্কে আমরা মোটেই সন্দিহান ছিলাম না। কারণ সে মোটেও চুপচাপ স্বভাবের কেউ ছিল না। বিকেলে আমরা যখন বৌ-ছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট খেলতাম, ও তখন পাশের মাঠে ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলত। ও-ই বাঁদরগুলো আমাদের কোনোদিন খেলায় নেয়নি। কিন্তু ঠিকই অপরাজিতাকে নিতে উদগ্রীব থাকত। টেপ টেনিস বল ছেড়ে সত্যিকারের ব্যাট আর বল দিয়ে ক্রিকেট খেলার লোভনীয় সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি বোধহয়! আমরা শুধু ড্যাবড্যাবিয়ে ওকে দেখতাম!
অপরাজিতা আমাদের নতুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মেয়ে। চলনে, বলনে আমাদের চাইতে বিস্তর আলাদা। একই পাড়ায় থাকার সুবাদে টমবয় অপরাজিতাকে প্রায়ই চোখে পড়ত খেলার মাঠে কিংবা রাস্তায়, দোকানে, এখানে সেখানে।
টুম্পা মিশুক মেয়ে, হাসি-ঠাট্টা করতে পছন্দ করত। সে একদিন আমাদের সবাইকে ধরে বেঁধে অপরাজিতার কাছে নিয়ে গেল। আজ কথা বলেই ছাড়বে। মেয়েটা প্রতিদিনের মতো দ্বিতীয় সারিতে জানালার পাশেই বসে বাইরে তাকিয়ে ছিল। সারাদিন কী যে ভাবে কে জানে! কেমন ভাবালু দৃষ্টিতে জানালার ফাঁক গলে আকাশ দেখত! বিশাল আকাশটুকুই বুঝি হৃদয়ে ধারণ করতে চাইতো কে জানে! ওর ধ্যান ভঙ্গ করে আমরা দল বেঁধে সেখানে এসে দাঁড়ালাম, টুম্পাই প্রথম জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কারো সাথে কথা বলো না কেন?”
“কী কথা বলব? তোমরা যে ধরনের গল্প করো ওইসব গল্প আমার এক্কেবারে ভাল্লাগে না।” মুখের উপরে এধরণের জবাব স্বভাবতই আমাদের হজম হলো না। আমরা ভীষণ অপমানিত বোধ করলাম।
নিশি তেঁতে উঠে বলল, “আমরা কী ধরনের গল্প করি? কী বলতে চাও?”
“কোন ছেলে কয়বার তাকাল, সিনেমার কোন হিরোকে দেখে তাক লেগে গেছে, এসবই তো আলাপ করো।” আবারও সপাটে যেন কথা দিয়ে আমাদের বোল্ড করে দিলো।
কথাটা অবশ্য পুরোপুরি মিথ্যা নয়, মোহনা আর সাথী দু’জন রীতিমতো মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো সুন্দরী, নিশিও ফেলে দেবার মতো নয়। আমার আর টুম্পার গায়ের রঙ যা একটু ময়লা। তবুও আমরা একসাথে বের হলে অনেকেই আঁড়চোখে তাকাত। মোহনা তো এরইমধ্যে একটা প্রেমের প্রস্তাব পেয়েও বসে আছে। উঠতি বয়সে এমন অত্যাশ্চর্য ঘটলে সেটা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে স্বাভাবিকভাবেই। তাই জিনিসটা আমাদের কারোর কাছেই দোষের মনে হয়নি। সেজন্য আমাদের আলোচনায় এসব ঘুরেফিরেই আসত। তাই বলে আমরা অন্য বিষয়ে আলাপ করি না এমন তো নয়।
মোহনা এবার কাটাকাটা গলায় বলল, “করলে সমস্যা কই? তুমি মুভি দেখ না? তোমার কোনো পছন্দের সেলিব্রিটি নাই?”
“আছে, তবে তারা মুভি স্টার নয়। ব্রায়ান লারা, ওয়াসিম আকরাম, শচীন টেন্ডুলকার, মোহাম্মদ রফিক এরা আমার ড্রিম হিরো।”
আমি বুঝলাম এই মেয়ে ক্রিকেটের পোকা। তবে এমনভাবে বলছে যেন কোনো নায়ককে পছন্দ করলে কেউ অচ্ছুত হয়ে যাবে! রাগ হলেও কথা বাড়ালাম না। এই অসম্ভব নাক উঁচু, অহংকারী মেয়েটার সাথে বাজে তর্কে জড়াতে একটুও ইচ্ছে হলো না।
তখন কি আর জানতাম এই মেয়েটাই একদিন আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে যাবে! আমি টিফিন পিরিয়ডে পড়ার জন্য মাঝেমধ্যেই স্কুলে গল্পের বই নিয়ে যেতাম। আমার বই পড়ার বাতিক সম্পর্কে সকলেই অবগত বলে এসময় কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না।
সেদিন সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভধারিনী’ বইটা পড়ছিলাম, আমি যখন জয়িতা আর ওর বন্ধুদের সাথে নিজেও একটা রেভ্যুলেশন ঘটাবার স্বপ্নে জড়িয়ে পড়ছিলাম, ঠিক তখনই কেউ মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমাকে বাস্তবের দুনিয়ায় নামিয়ে নিয়ে এলো।
“বইটা দারুণ। আর কী কী বই আছে তোমার কাছে?” অপরাজিতা কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি!
সেদিনের অপমানটা তখনো গায়ে লেগে ছিল। কিন্তু কাউকে খোঁচা দেবার ইচ্ছে হলো না বলে সে এ যাত্রায় বেঁচে গেল। আমি নির্লিপ্তভাবে বললাম,
“প্রচুর বই আছে, নাম বলে শেষ করা যাবে না।”
অপরাজিতা খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, “আজ ছুটির পরে তোদের বাসায় যাব।”
এভাবে হুট করে কেউ কারো বাড়িতে যাবার আবদার করতে পারে এটা বোধহয় অপরাজিতা বলেই সম্ভব। উত্তেজনায় নাকি আন্তরিকতায় ‘তুই’তে নেমে গেছে সেটা বোঝা গেল না। তবে আমার শুনতে ভালোই লাগল।
আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুই যে এভাবে ঘুরে বেড়াস, কেউ কিছু বলে না?”
সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই ঘণ্টা পড়ল, পরের ক্লাসের স্যার চলে এলেন।
সেদিন ছুটির পরে সত্যি সত্যি সে আমার সাথে আমাদের বাসায় এলো। আমাদের ছোট্ট লাইব্রেরি ঘরটায় ঢুকে সে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। একদিকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, ডেল কার্নেগী, ম্যাক্সিম গোর্কি, টলস্টয়, আগাথা ক্রিস্টি থরে থরে সাজানো। ও-ই তো শার্লক হোমস, এরকুল পোয়েরো, ফেলুদা, ব্যোমকেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোনো জটিল কেস সমাধানে মত্ত যেন। শীর্ষেন্দু, সমরেশ, সুনীল, সুচিত্রা, হুমায়ুন আহমেদ, আহমদ ছফা, জাফর ইকবালরাও আছেন বহাল তবিয়তে। আমার প্রিয় তিন গোয়েন্দা, ভাইয়ার পছন্দের মাসুদ রানারও জায়গা হয়েছে তাকে।
“কত্ত বই! এগুলো কার সংগ্রহ?”
“দাদুর বেশিরভাগ। তবে আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই কমবেশি বইপাগল।”
“হৃদি, আমি তোর এখান থেকে বই নিতে পারি? পড়া শেষ হলেই ফেরত দেব।”
ওর গলায় বিন্দুমাত্র সংকোচের ছাপ নেই। সম্মতি দিতেই বেছে বেছে কয়েকটা বই নিল। সেই থেকেই বন্ধুত্বের শুরু।
কয়েকদিনেই বুঝতে পারলাম, অপরাজিতার মধ্যে একটা কিছু আছে, যেটা সবার মধ্যে থাকে না। ভীষণ অকপট৷ কেউ কষ্ট পাবে ভেবে আমরা অনেককিছু এড়িয়ে যাই, অপরাজিতার সেসবের বালাই নেই। বৈপরীত্য সত্বেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের সখ্যতা বাড়ল।
অপরাজিতা যখন খুব ছোট তখন তার মা মারা গেছেন। বাবা আর দাদিকে নিয়েই সংসার। বাবা তাই কখনো কোনো বিষয়ে ওকে বাধা দেননি। তার বিশাল স্বপ্ন, মেয়ে একদিন ঠিক আকাশ ছুঁয়ে দেবে৷ এই ডাকাবুকো মেয়েটার মধ্যে যে বিষাদের ঘনঘটা সেটা আগে কখনো বুঝতেই পারিনি।
সময় গড়ায়, সম্পর্ক গাঢ় হয়। বাকিদের সাথেও সে সহজ হয়েছে ততদিনে। এভাবেই ঝলমলে দিনগুলো বয়ে যাচ্ছিল।
এর দু’বছর পরের পহেলা বৈশাখে আমারা দল বেঁধে শাড়ি পরে, খোঁপায় ফুল গুঁজে ঘুরতে বেরিয়েছি। কোত্থেকে এক বখাটে ছেলের দল সামনে চলে এলো। আমরা কথাগুলো গায়ে না মেখে পাশ কাটিয়ে চলে আসতাম, কিন্তু অপরাজিতা কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে শেখেনি। সে ঠিকই প্রতিবাদ করল, আমরাও সাহস পেলাম।
“তোরা মেনি বেড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালাস কেন? প্রতিবাদ করলে এরা কেমন ভেড়া হয়ে যায় দেখলি? এখন থেকে এভাবেই এগুলোকে শায়েস্তা করবি।”
সেই যে সাহস পেলাম, এরপর আর কোনোদিন মাথা নিচু করে পাশটান দেইনি। অপরাজিতা সাথে থাকলেই খুব ভরসা পেতাম। মনে হতো চিন্তা কী, অপরাজিতা ঠিক একটা সমাধান বের করবে। অবচেতনেই একটা বিশাল ভরসার নাম হয়ে যাচ্ছিল মেয়েটা।
ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হতেই মোহনা প্রেমে পড়ল। যাকে বলে গভীর প্রেম। অপরাজিতার বিষয়টা পছন্দ হলো না। সে সবসময় প্রেম, ভালোবাসার ব্যাপারে নাক সিঁটকাতো।
“ভালোবাসা এত সহজ? চেনা নেই, জানা নেই হুট করে কেউ এসে বলল, চোখের দেখায় ভালো লাগল, তাতেই গলে যাব? লুকিয়ে একটা সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর নাম প্রেম না।”
অপরাজিতা পাথুরে গলায় কথাগুলো বলেছিল। তিন মাসের মাথায় মোহনা যখন সব চুকিয়ে বুকিয়ে আবার আমাদের মাঝে ফিরল তখন আমরা নিশ্চিত হলাম বিষয়টা আসলেও এতটা সহজ নয়।
সবমিলিয়ে কী সুন্দর দিনগুলো চোখের পলকে কেটে যাচ্ছিল!
অপরাজিতা ছিল আমাদের মধ্যে সবচাইতে বিচক্ষণ আর বাস্তববাদী। বন্ধুমহলে ওকে নিয়ে একটা প্রচলিত ধারণা ছিল,
“সবাই গোল্লায় যেতে পারি, কিন্তু অপরাজিতা একেবারে কনস্ট্যান্ট! সে মনে হয়, কোনোদিন ভুলই করবে না।”
কিন্তু আমাদেরকে ভুল প্রমাণ করে সে ভুলটা করেই ফেলল, চরম ভুল!
তখন ইন্টারমিডিয়েটের টেস্ট পরীক্ষা চলছিল। আমার অত্যন্ত বাজে স্বভাব ছিল, সারাবছর টেক্সট বইয়ের সাথে সম্পর্ক থাকে না, কিন্তু পরীক্ষা যত এগিয়ে আসে, তত পড়ায় মুখ গুঁজি। আশেপাশের দুনিয়ার কোথায় কী চলছে সেসবের কোনো খোঁজ থাকে না। তাই অপরাজিতার হুট করে বদলে যাওয়াটা আমার চোখেই পড়েনি।
এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেরদিন ঘুম ভাঙতেই ভয়াবহ খবরটা শুনলাম। যার একটা বর্ণও প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।
টুম্পা এসে বলল, “হৃদি, তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস, আর ওদিকে সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
টুম্পার সব কথাতেই রঙ মিশিয়ে বলার অভ্যাস, তাই পাত্তা দিলাম না।
“ঢং রাখ, কী হইছে সেইটা বল।”
“আরে আমাদের অপরাজিতা, শোয়েব ভাইয়ের সাথে পালাইছে।”
চোখে যে একটু আধটু ঘুম ছিল সেটা পালিয়েছে, আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম।
“ফাজলামি করিস না টুম্পা, সকাল সকাল এগুলা ভাল্লাগে না।”
“এইটা ফাজলামি না রে, সত্যি। তুই বাইরে আয়।”
আমি তখনও কেমন আচ্ছন্নের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। সে নিশ্চয়ই মজা করছে। কিন্তু টুম্পার সিরিয়াস মুখভঙ্গি দেখে দমে গেলাম। মানতে না চাইলেও পায়ে পায়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ছোট্ট মফস্বল শহরের এই এলাকায় সবাই সবার পরিচিত, এমন ঘটনা বাতাসের আগে ছড়ায়। সর্বত্র চর্চা হয়। পরিস্থিতি দেখে আমি তখন বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রবল ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারিনি তখনো।
এই ঘটনায় যে সবকিছু এভাবে চোখের পলকে বদলে যাবে, ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে একটা পরিবারে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি তখনো।
আমার মাথায় একটা প্রশ্ন রেখে গেছে অপরাজিতা, একটা শব্দের প্রশ্ন ‘
“কেন?”
আজও এর উত্তর হাতড়ে যাচ্ছি।
……..
(ক্রমশ)