একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৬১

0
346

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_61
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সমুদ্র নিজের বাবার সামনে থেকে উঠে ধীরে ধীরে পুষ্পা চৌধুরীর সামনে যায়। পুষ্পা চৌধুরী মাথা নিচু করে ছিলেন। সমুদ্র তার সামনে গিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,”এখন তুমি খুশি হয়েছ তাই না মম? এটাই তো চেয়েছিলে তুমি! এখন সবকিছুর উপর তোমার একার রাজত্ব৷ যাও সবকিছু একা ভোগ করো।”

“বাবাই..”

“আমি তোমার মুখ থেকে আর কিচ্ছু শুনতে ইচ্ছুক নই মম। আমি আজ আমার ড্যাডকে হারিয়েছি। ভেবে নেব এখন থেকে আমি অনাথ।”

“এসব কি বলছ তুমি বাবাই। আমার কথা শোনো..”

“আমার আর কিছু শোনার নেই।”

এরমধ্যে সায়মা চৌধুরী পুষ্পা চৌধুরীর দিকে আঙুল তুলে বলেন,”এই মহিলা আমার ভাইকে মে’রে ফেলেছে। এ আমার ভাইয়ের খু**নি। কাল আমার সামনে ভাইয়াকে যা তা বলে অপমান করেছে। ভাইয়া এসব কিছু সহ্য করতে পারে নি।”

সবাই ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় পুষ্পা চৌধুরীর দিকে। এমনকি সমুদ্রও। নিজের ছেলের এমন দৃষ্টি সহ্য হয়না পুষ্পা চৌধুরীর। তিনি ব্যাথায় জড়ানো কন্ঠে বলে,”বাবাই..মমকে কিছু বলার সুযোগ দাও।”

সমুদ্র চিৎকার করে বলে ওঠে,”আমার কোন মম নেই। মা*রা গেছে আমার মম।”

পুষ্পা চৌধুরী হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন সমুদ্রের দিকে। এই ছেলেটাকে তো নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসেন তিনি। আর আজ তার চোখে এমন ঘৃণা। যেই ছেলে মা বলতে অজ্ঞান ছিল তার কাছে আজ তার না জীবনদশাতেই মৃত!

সমুদ্র বলল,”একজন সন্তানের কাছে তার বাবার লাশের ভার কত তুমি বুঝবে না মম। কারণ তোমাকে কোনদিন এই ভার বহন করতে হয়নি।”

পুষ্পা চৌধুরী আজ কিছু বলতে পারছেন না। চুপ করে বসে পড়েন। সমুদ্রের আরো অনেক কিছু বলার ইচ্ছা ছিল কিন্তু পারল না। বাবার মৃত্যুর শোক তাকে ভেতর থেকে একদম ভেঙে দিয়েছে।

সময় গড়িয়ে চলে। সজল চৌধুরীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সমুদ্র নিজের বাবার খাটিয়া বহন করে চলে যায় কবরস্থানের উদ্দ্যেশ্যে। পুষ্পা চৌধুরী তখনো মেঝেতেই বসে ছিলেন। কোন রেসপন্স করছিলেন না। যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়েছেন। সায়মা চৌধুরী এসে তাকে বলেন,”দেখেছ ভাবি, তোমার মিথ্যা অহংকার আর দম্ভ আজ তোমায় কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ভাইয়ার জীবন কেড়ে নিল এই দম্ভ। নিজের ছেলের চোখেও তোমাকে ঘৃণ্য বানিয়ে দিল। তবুও কি তুমি বদলাবে না?!”

~~~~~~
সজল চৌধুরীর লাশ দাফন করে সমুদ্র উদভ্রান্তের মতো অবস্থায় বাড়িতে ফিরে আসে। এসে দেখে রায়ান সাহেব, সৌভিক, প্রণালী সবাই এসে উপস্থিত। প্রণালী সমুদ্রকে দেখেই ছুটে যায় তার দিকে। সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। এই ক’দিনেই যে সজল চৌধুরী তার মনে অনেকটা যায়গা করে নিয়েছিল। লোকটা তাকে মা বলে ডাকত। রায়ান সাহেব এগিয়ে এসে সমুদ্রের কাঁধে হাত রেখে বলেন,”তোমাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। আমি কিছু জরুরি কাজে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। তোমার বাবার খবরটা পাওয়ার পরই ছুটে চলে আসি ঢাকায়। কিন্তু বড্ড দেরি করে ফেললাম। শেষবারের মতো ওনাকে দেখতেও পেলাম না। তবে প্রণালীর কাছ থেকে সব শুনলাম। তোমাদের যে এত কষ্টে থাকতে হয়েছে জানতাম না। তুমি এসব কথা আমাকে বা তোমার বাবাকে জানাতে পারতে! তাহলে হয়তো পরিস্থিতি এত খারাপ হতো না।”

সমুদ্র বলে,”এখন তো সব জেনে গেছেন আঙ্কেল। এখন আপনি চাইলে নিজের মেয়েকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে পারেন আমি কোন বাঁধা দেব না। এমনিতেও আমার আর কোন ভবিষ্যৎ নেই।”

প্রণালী বলে ওঠে,”একদম এমন কথা বলবেন না! আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।”

“আমার কাছে থাকলে যে তোমায় চরম দারিদ্রের মধ্যে থাকতে হবে। মানিয়ে নিতে পারবে তো?”

প্রণালী বলে,”পারব।”

রায়ান সাহেব বলেন,”এসব কথা উঠছে কেন সমুদ্র? আমার কি কম সম্পত্তি আছে? এগুলো আমি কার জন্য করেছি? আমার ছেলে-মেয়ের জন্যই তো। তুমি তো আমার জামাই তোমার হক আছে এসবে।”

সমুদ্র বলে,”মাফ করবেন আমায়! আমি আপনার থেকে কোন সাহায্য নিতে পারব না। আপনি চাইলে নিজের মেয়েকে যা খুশি দিতে পারেন কিন্তু আমি নিতে পারব না।”

“এমন করে বলছ কেন?”

“কারণ আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই তাও সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায়। এর জন্য হয়তো অনেক পরিশ্রম করতে হবে। তবে আমি সেই পরিশ্রম করতে রাজি আছি। আমার আপনার কাছে বেশি কিছু চাইনা। শুধু এটুকুই চাই যেন আপনি আপনার মেয়েকে আমার ভরসায় দিন। আমি যতটুকু পারব ওকে খুশি রাখব।”

“কিন্তু..”

রায়ান সাহেব কিছু বলার আগে সৌভিক বাবু তার পিঠে হাত রেখে বলেন,”ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দে। ওরা ঠিকই নিজেরা নিজেরা ভালো থাকবে।”

রায়ান সাহেব আর কথা বাড়ালেন না।

~~~~~~~~~~~~~
সমুদ্র সকল আত্মীয় স্বজনের থেকে বিদায় নেয়। সবশেষ সায়মা চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলে,”তুমি সবসময় আমায় অনেক ভালোবাসা দিয়েছ ফুপি। যার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না। তুমি আমার জন্য দোয়া করো, যেন আমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি।”

সায়মা চৌধুরী সমুদ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”ভাইয়ার বুক ভরা দোয়া আছে তোর জন্য। মরতে মরতেও উনি তোর কথা ভাবছেন। আমিও দোয়া করব তোর জন্য। মানুষের মতো মানুষ হ বাপ। নিজের বাপ-দাদার মুখ উজ্জ্বল কর।”

সমুদ্র সবার থেকে বিদায় নিলেও পুষ্পা চৌধুরীর সাথে দেখা করে না। প্রণালীর হাত ধরে চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে ধরে। এমন সময় পু্ষ্পা চৌধুরী এসে উপস্থিত হন সেখানে। সমুদ্রকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,”কোথায় যাচ্ছ তুমি বাবাই? নিজের এত সম্পদ থাকতে তুমি কেন আলাদা করে লড়াই করবে। এসব কিছু তো তোমারই পূর্ব পুরুষের সম্পদ। আমি সবকিছু তোমার নামে করে দেব। প্রণালীকে নিয়েও কোন আপত্তি করবো না। তুমি এখানেই থাকো। এভাবে সবকিছু ছেড়ে যেও না।”

সমুদ্র স্পষ্ট বলে দেয়,”আমার এসব কিছুই লাগবে না মিসেস পুষ্পা চৌধুরী। এসব কিছু আপনি রেখে দেন। এই সহায় সম্পত্তি নিয়ে ভীষণ অহংকার না আপনার। এসব নিয়েই আপনি কবরে যাইয়েন।”

“বাবাই..”

সমুদ্র বলে,”আপনি বড্ড দেরি করে ফেলেছেন। যদি আপনি আরো আগে সবটা উপলব্ধি করতে পারতেন তাহলে আজ আমায় আর এভাবে নিজের বাবাকে হারাতে হতো না। এখন আমার আর এসবকিছুর দরকার নেই। আমি নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে পারব। এই সম্পত্তি আপনিই সামলান। যতদিন পারেন রাজ করে চলুন।”

বলেই সমুদ্র প্রণালীর হাত ধরে বেড়িয়ে যায় চৌধুরী ম্যানশন থেকে। একে একে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনও বিদায় নেয়। দিনশেষে পুরো বাড়ি ফাকা হয়ে যায়। পুষ্পা চৌধুরী একা ভীষণ একা হয়ে পড়ে। হয়তো বাকি দিনগুলো তার একাকীত্বে আর আফসোস, আত্মগ্লানির মধ্যেই চলে যাবে।

~~~~~~~~
সমুদ্র ও প্রণালীর দিনগুলো এরপর বেশ হাসি-কান্নার মধ্য দিয়ে যায়। সমুদ্র নিজের মতো একটা ব্যবসা করার উদ্যেগ নেয়। এজন্য পুঁজির দরকার ছিল। রায়ান সাহেব সাহায্য করতে চাইলে সমুদ্র সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাই রায়ান সাহেব একটা বুদ্ধি খাটান। নিজের এক বন্ধুর মাধ্যমে সমুদ্রকে টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন বিনা সুদে এবং একই সাথে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য কোন চাপ দিতে মানা করেন। তবে এসব বিষয় সমুদ্রের থেকে গোপন রাখেন। এভাবে কয়েক মাস পেরিয়ে যায়। সমুদ্র ছোটোখাটো একটা বিজনেস শুরু করে। সৌভাগ্যক্রমে এতে লাভের মুখ দেখে এবং তাদের দিন বদলে যায়।

এরমধ্যে একদিন শান্ত আসে প্রণালীর সাথে দেখা করতে। তবে এই শান্তর সাথে আগের শান্তর অনেক পার্থক্য। আগের থেকে অনেকটা শুকিয়েছে অনেকটা কষ্টে দুঃখে জর্জরিত সে। প্রণালী তো প্রথমে শান্তকে দেখে রেগে গিয়ে নানারকম কথা বলে। শান্ত সব মনযোগ দিয়ে শুনে বলে,”আমি জানি আমি অনেক অন্যায় করেছি। আর এখন সেই অন্যায়ের শাস্তিও পাচ্ছি। লারার মৃত্যুর পর থেকে আমার জীবনে দুঃখের শুরু হয়েছে। লারার মৃত্যুর জন্য হয়তো আমি দায়ী ছিলাম কিন্তু বিশ্বাস করো ওকে আমি খু**ন করিনি। ওর পরিবার আমার বিরুদ্ধে কেস করে। সেই জন্য আমায় জেলে গিয়ে থাকতে হয়। আমার মায়ের জমানো সব টাকা শেষ হয়ে যায় কেস লড়তে। এদিকে জেল থেকে খবর আসে আমার বাবা(আবির) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এতে মা আরো ভেঙে পড়েন। গতকাল মাও আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমি এখন সম্পূর্ণ একা। আজ আমি বুঝতে পারছি লারা আমার জীবন কতটা জুড়ে ছিল। ওর জন্য ভীষণ আফসোস হয়। ওর কাছে আর ক্ষমা চেয়ে ওঠা হবে না তবে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি প্রণালী। সবকিছুর জন্য আমায় ক্ষমা করিও যদি পারো। কিছুদিন পরেই আমি সৌদিতে যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে কাজ করে খাব। ধর্মের পথে ফিরতে চাই আমি৷ অনেক পাপ করেছি। আশা করি,আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইলে পাপ লাঘব হবে। ভালো থেকো তুমি। সুখে সংসার করো। আল্লাহ তোমার জীবন সুখে ভড়িয়ে দিক।”

বলেই বেরিয়ে আসে শান্ত। প্রণালী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে। সত্যিই জীবন বড়ই অদ্ভুত। কখন কাকে কি রকম পরিস্থিতিতে নিয়ে গিয়ে ফেলে তা বলা যায়না।

to be continue…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে