একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৬০

0
368

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_60
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সমুদ্র বেরিয়ে পড়েছে নতুন কাজ খুঁজতে। তবে অভাগার ভাগ্য বোধহয় এত সহজে বদলায় না৷ সারাদিন ঘুরেও সে কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ পেল না। ওদিকে প্রণালী আর সমুদ্র সকাল থেকে না খেয়ে আছে কারণ তাদের কাছে খাবার কেনার মতোও টাকা নেই৷ সমুদ্রর ভীষণ অসহায় বোধ হতে লাগল। এমন সময় সে দেখল রাস্তায় কনস্ট্রাকশানের কাজ চলছে। সমুদ্রের মনে একটা ভাবনা এলো। এ ছাড়া তার সামনে কোন পথ খোলা ছিল না। যদিও জীবনে কখনো ভাবেনি এই পর্যায়ে তাকে আসতে হবে। তবে পেটের খুদার কাছে সব তুচ্ছ!

~~~~~~~~
সায়মা চৌধুরীর চিৎকার শুনে পুষ্পা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে নিচে নেমে আসেন। এসেই বিরক্ত গলায় বলেন,”কি হয়েছে তোমার? এত চেচাচ্ছ কেন?”

সায়মা চৌধুরী বললেন,”দেখো না ভাবি, ভাইয়া কোন কথা বলছে না। আমার খুব ভয় করছে।”

“সরো আমায় দেখতে দাও।”

পুষ্পা চৌধুরী সজল চৌধুরীর নিঃশ্বাস চেক করে দেখেন নিঃশ্বাস পড়ছে কিন্তু খুব ধীরে। তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। বলে ওঠেন,”দ্রুত এম্বুলেন্স ডাকতে হবে। ওকে ইমিডিয়েটলি হসপিটালে নিতে হবে।”

“ভাইয়ার কিছু হয়ে যাবে না তো ভাবি?”

“এই প্রশ্নের উত্তর শুধু ডাক্তারই দিতে পারবে। তুমি ওখানে নিয়ে এসো সোফায় শোয়াতে হবে ওনার হাতে পায়ে মালিশ করতে থাকো। আমি এম্বুলেন্সে কল করছি।”

পুষ্পা চৌধুরীও যেন আজ ভীষণ উতলা হয়ে উঠেছেন স্বামীর এই অবস্থা দেখে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~
সমুদ্র যখন রাস্তায় বালি বোঝাইয়ের কাজ করছিল তখন তার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। সে খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছিল গরীব মানুষদের কত কষ্ট। আজীবন আভিজাত্যে জীবন গেছে তার। কখনো অভাব অনটন অনুভব করে নি। না চাইতেই সবকিছু পেয়ে গেছে। তবে আজ সে তিক্ত বাস্তবতা নিজের চোখে দেখছে। এতদিন গরীব মানুষদের কত অবহেলা করেছে সে, তাদের সমাজের কীট মনে করেছিল। আপনাদের মনে আছে প্রণালীর সাথে সমুদ্রের প্রথম সাক্ষাতের ঘটনা? সেই সমুদ্র আর এই সমুদ্রের মধ্যে আজ কত তফাৎ। সৃষ্টিকর্তা বুঝি সবাইকে তার কর্মের ফল সুদে আসলে ফেরত দেওয়ার জন্যই তাদের জীবনে বিপদ-আপদ দেন। যাতে তারা বাস্তবতাটা উপলব্ধি করতে পারে। যেমন এখন সমুদ্র পারছে। দু মুঠো খাবারের জোগাড় করার জন্য কত খাটতে হচ্ছে।

সমুদ্র কাজ করতে করতে হঠাৎ বুকের বা পাশে তিক্ত ব্যাথা অনুভব করল। গতকাল রাত থেকে কেমন জানি ব্যাথা করছে। মনেও কেমন জানি কু গাইছে। সমুদ্র ট্যালিপ্যাথির কথা শুনেছিল। তাহলে তার সাথে এখন এমন কিছুই ঘটছে? ট্যালিপ্যাথির কারণেই কি তার মনে হচ্ছে তার কোন আপন জনের বিপদ আসন্ন? এসব ভাবতে ভাবতেই সে কাজ করছিল। কাজ শেষে সে নিজের পারিশ্রমিক নিয়ে একটি হোটেলে গিয়ে খাবার কিনে নিলো। আজ এই খাবার দিয়েই তার এবং প্রণালীর ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে। সমুদ্রের সামনে হঠাৎ প্রণালীর মুখশ্রী ভেসে ওঠে। বেচারি মেয়েটা নিশ্চয়ই সকাল থেকে না খেয়ে ভীষণ কষ্টে আছে। সমুদ্র তো তার দায়িত্ব নিয়েছিল। সমুদ্রের জন্যই তো প্রণালী নিজের বাবার কাছে যায়নি। সেখানে গেলে তাকে এত কষ্টে তো থাকতে হতো না। আভিজাত্যে থাকত। তবুও মেয়েটা কোন অভিযোগ করছে না। শুধু সমুদ্রের কথাই ভাবছে। চাচ্ছে যেন সমুদ্র নিজের বাসায় ফিরে যায়। সমুদ্র বেশ বুঝতে পারে তাকে কষ্টে দেখতে না পেয়েই এমন কথা বলে। সমুদ্র এই সব কথা ভেবে মুচকি হেসে বলে,”পাগলী মেয়েটা! ও বোঝেই না ওকে ছাড়া আমি একদম ভালো থাকব না।”

খাবার নিয়ে সমুদ্র হাজির হয় তাদের বাসায়। প্রণালী সমুদ্রের আশাতেই বসে ছিল। সমুদ্র আসতেই প্রণালী হাসি মুখে বলে,”আপনি এসেছেন?”

“হুম। তুমি ঠিক আছ তো? সকাল থেকে না খেয়ে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে?”

“একদম না। আমার একটুও কষ্ট হয়নি। আপনার বরং খুব কষ্ট হয়েছে। সারাদিন নিশ্চয়ই খুব খাটুনি গেছে? কোন নতুন কাজ পেলেন?”

সমুদ্র কোন উত্তর না দিয়ে বলে,”আমি খাবার এনেছি। তুমি বসে পড়ো। একসাথে খাই!”

প্রণালী বুঝল সমুদ্র প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই সে-ও আর বেশি না ঘাটিয়ে থালা এনে সেখানে খাবার বাড়ে নিজের আর সমুদ্রের জন্য। তারপর দুজনে একসাথে বসে খেতে শুরু করে। সমুদ্র দেখে প্রণালী অল্প করে খাচ্ছিল। এটা দেখে সে বলে,”এসব দিয়ে খেতে নিশ্চয়ই তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? কি করবো বলো যা টাকা ছিল আমার কাছে তা দিয়ে এতটুকুই হয়েছে।”

“আরে না। এমন নয়। আসলে আমি বাইরের খাবার তেমন খেতে পারিনা। তাই ভাবছি এবার নিজেই রান্নাটা শিখে নেব। পাশের বাসার ভাবি নাকি খুব ভালো রান্না করে। তার থেকে রান্নাটা শিখতে হবে।”

“আমি ভীষণ অপেক্ষায় আছি তোমার হাতের খাবার খাওয়ার জন্য।”

এভাবেই কথাবার্তা এগোতে থাকে তাদের দুজনের। খাওয়া শেষ করে সমুদ্র প্রণালীকে বলে,”জানো কাল রাত থেকে আমার মনটা কেমন করছে। মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে। আচ্ছা বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো?”

প্রণালী বলে,”যদি তোমার বাড়ির জন্য মন খারাপ হচ্ছে তাহলে যাও না বাড়ি থেকে ঘুরে আসো। তাহলে হয়তো তোমার মনের এই খুতখুতানি দূর হবে।”

“আমি ঐ বাড়িতে এখন আর ফিরব না প্রণালী। আমি প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছি আমি সেদিনই ফিরব যেদিন আমার মম সসম্মানে তোমায় ঐ বাড়িতে ফিরিয়ে নেবে। যেভাবে উনি তোমায় অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন তার দ্বিগুণ সম্মানে তোমায় ফেরত নেবে।”

প্রণালী সমুদ্রের দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকায়। অত:পর বলে,”আপনার মায়ের সাথে নাহয় আপনার সমস্যা কিন্তু বাবা-ফুপি তাদের সাথে তো সমস্যা নেই? আমি নাহয় এখনই যাবো না কিন্তু আপনি যান না ওদের সাথে দেখা করে আসুন। বাড়িতে না যান বাড়ির বাইরে তাদের আসতে বলুন।”

“তাহলে কি এমনটাই করব?”

“হ্যাঁ। এমনটাই করুন। আপনি নিজের পরিবারের সাথে দেখা করে আসুন। এতে আপনিও মানসিক শক্তি পাবেন। পরিবারের সাপোর্ট টা যে এখানে বড়। তাছাড়া আপনার মনে যখন এমন চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তখন..”

“ঠিক আছে, তাহলে আজই গিয়ে দেখা করে আসব।”

~~~~~~~~~~
খাওয়া দাওয়া শেষে একটু পরই সমুদ্র বেড়িয়ে পড়েছে নিজের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে। মাঝে সে অনেকবার সায়মা চৌধুরী এবং নিজের বাবাকে ফোন করেছে কিন্তু তারা কেউই ফোনটা রিসিভ করেনি। সমুদ্র বুঝতে পারে না এর কারণ কি। এদিকে চৌধুরী ম্যানশনের সামনে এসে সে দেখে বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভিড়। সমুদ্র আরো ধন্দে পড়ে যায়। ভিড় ঠেলে বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার পায়ের তলা থেকে যেন মাটিই সরে যায়।

সামনেই সজল চৌধুরীকে সাদা কাফনে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। সমুদ্র নিজের বাবাকে এই অবস্থায় দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়। সামনেই সায়মা চৌধুরী মাতম করে চলেছেন। পুষ্পা চৌধুরী একদিকে চুপচাপ বসে আছেন। সমুদ্রকে দেখতেই সায়মা চৌধুরীর আর্তনাদ আরো ভারি হলো। তিনি আহাজারি করে বললেন,”শেষবেলায় ভাইয়া তোকেই দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু তার এই ইচ্ছা পূরণ হলো না।”

সমুদ্রের কানে এখন এসব কোন কথা যায় না। সে বশে পড়ে সজল চৌধুরীর দেহের সামনে। তার মস্তিষ্ক ফাকা হয়ে আসছে। মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার সাথে কাটানো সমস্ত সুন্দর স্মৃতি। বাবার মৃতদেহ জড়িয়ে ধরলো। তারপর একদম ছোট বাচ্চার মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

“আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে শেখালে
তুমি জীবনের পথ চলা
নিজে না খেয়ে তুমি খাওয়ালে
শেখালে কথা বলা

বাবা তুমি আমার যত খুশির কারণ
বলো তোমার মতো করবে কে শাসন
বাবা তুমি আমার বেঁচে থাকার কারণ
নেই তোমার মতো কেউ এতোটা আপন

দু পা, দু পা এগিয়ে, তোমার হাত ধরে
পথ চলতে শিখেছি
জানি না কতোটা বাধা তুমি একা সয়েছো
বুঝতে দাও নি কিছু

আজ আমি হয়েছি বড়
নিজের মতো করে বুঝি সবই
অজান্তে কত কি ভুল করেছি
তুমি ক্ষমা করো আমায়

বাবা তুমি আমার যত খুশির কারণ
বলো তোমার মতো করবে কে শাসন
বাবা তুমি আমার বেঁচে থাকার কারণ
নেই তোমার মতো কেউ এতোটা আপন”
to be continue…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে