#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_30(Bonus)
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রভা ও রায়ানের বিয়ের পর পেরিয়ে গেছে ৬ টা মাস। এই ৬ মাসে অনেক কিছু বদলে গেছে। আবিরের সব কুকীর্তি ধরা পড়েছে। তাকে কানাডা থেকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে এবং বাংলাদেশের আদালত তাকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। বর্তমানে সে নিজের কুকর্মের সাজাই ভোগ করছে।
এদিকে বিবাহ পরবর্তী জীবনে অনেক সুখী আছে রায়ান ও প্রভা। তাদের জীবনে ভালোবাসার কোন কমতিই নেই। রায়ান প্রভাকে একদম নিজের সবটুকু দিয়েই আগলে রাখছে। তার গায়ে ফুলের টোকাও লাগতে দিচ্ছে না। এদিকে আবির গ্রেফতার হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার দরুণ তার সংসদীয় আসন ফাকা হয়ে আছে। তাই নির্বাচন কমিশন কতৃক এই আসনে উপনির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রুহুল আমিনের পার্টির লোকেরা চাইছেন রুহুল আমিনের ছেলে মানে রায়ান এবার এই আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়াক। রুহুল আমিনকে এই বিষয়ে বলতেই তিনি সবটা রায়ানের উপরেই ছেড়ে দেন। কিন্তু রায়ানের এসব রাজনীতির প্রতি আগ্রহ না থাকায় সে সরাসরি না বলে দিয়েছে৷ কিন্তু দলীয় নেতৃবৃন্দ আদা জল খেয়ে তার পেছনে লেগেছে। যাতে রায়ানকে এই নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করানো যায়। আজও তারা এসেছিল রায়ানের সাথে দেখা করতে। কিন্তু রায়ান আজও অমত জানিয়েছে। এরপরেই প্রভাকে নিয়ে সে ঘুরতে বের হয়েছে। প্রভা অনেকদিন থেকেই বলছিল সে ঘুরতে যেতে চায়। কিন্তু ব্যস্ততার জন্য হয়ে উঠছিল না। আসলে প্রভা কানাডা থেকে দেশে ফেরার পর আবারও চট্টগ্রাম মেডিকেলেই ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেছে। এই জন্য তাকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। এদিকে রায়ানও তার বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছে৷ আজ অনেক কষ্টে দুজনেই টাইম ম্যানেজ করেছে। তাই এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুজনে ঘুরতে বেড়িয়েছে।
আজ দুজনে সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি করল। প্রভার খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছিল। সে রায়ানকে বলে,”চলুন না আইসক্রিম খাই।”
রায়ান প্রভাকে বলে,”তুমি না একজন ডক্টর৷ তুমি এমন কেয়ারলেসের মতো কথা কিভাবে বলতে পারো? এই ঠাণ্ডায় তুমি আইসক্রিম খাবে?”
প্রভা বলে,”হ্যাঁ, আমি ডক্টর। কিন্তু তার আগে আমি একজন মানুষ। আমার তো একটা স্বাদ আহ্লাদ থাকতেই পারে তাইনা? আর কে বলেছে এখন ঠান্ডা পড়েছে? এখনো তো আবহাওয়া বেশ গরমই।”
রায়ান বলে,”বাহ, আমার ইনোসেন্ট গার্ল তো দেখছি বেশ ভালোই কথা বলতে শিখেছে। এখন তো তোমার সাথে কথা দিয়েও আমি পারব না।”
প্রভা উত্তরে স্মিত হাসে। রায়ান প্রভাকে একটা আইসক্রিম এনে দেয়। অতঃপর বলে,”চলো এখন যাওয়া যাক।”
“হ্যাঁ, চলো।”
প্রভা ও রায়ান যেতে যাবে তখনই তারা হঠাৎ দেখতে পায় রাস্তায় কিছু মানুষ আন্দোলন করছে। বেশ বড়সড় জটলা পেকেছে সেখানে। মানুষজন কিছু প্লাকার্ড হাতে বেরিয়েছে। তাদের দাবি একটাই, এলাকার বেহাল অবস্থার উন্নতি করতে হবে। প্রভা ও রায়ান সেদিকে এগিয়ে যায়। মিছিলে কিছু মানুষ বক্তব্য রাখে। তাদেরই একজন বলে,”দীর্ঘ দিন ধরে এই এলাকায় আবির হোসেন অপশাসন চালিয়েছেন। তার শাসনামলে এখানে কোন উন্নতি তো হয়নি বরং আরো অবনতি হয়েছে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ টাকা লুট, অবৈধ প্রকল্প, ড্রেনেজ ব্যবস্থার অবনতি আমরা দেখতেই পাচ্ছি। বৃষ্টি হলে গোটা চট্টগ্রাম শহর ডুবে যায়। সবমিলিয়ে শহরে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এই অবস্থা থেকে মুক্তি চাই। এইজন্য আমাদের একজন যোগ্য নেতার প্রয়োজন। কিন্তু এখনো অব্দি উপনির্বাচনে যাদেরকে প্রার্থী করা হয়েছে তারা প্রায় সবাই দূর্নীতিগ্রস্থ এবং তাদের জনগণের উন্নতি নিয়ে কোন মাথা ব্যাথাই নেই। তারা শুধু নিজের স্বার্থে লড়ছে।”
এভাবে নানা জনগণ তাদের দূর্ভোগের কথা জানায়। সব শুনে রায়ান ও প্রভা দুজনেরই খুব খারাপ লাগে। সত্যি অপশাসন এবং দূর্নীতি একটি দেশ বা অঞ্চলের উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। রায়ান ও প্রভা আর সেখানে বেশিক্ষণ না থেকে রওনা দেয়। গাড়িতে উঠে প্রভা ও রায়ান দুজনেই চুপচাপ ছিল। রায়ান কোন চিন্তায় মগ্ন ছিল। প্রভার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। রায়ান প্রভার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমিও কি সেটাই ভাবছ যেটা আমি ভাবছি?”
প্রভা বলে,”হুম। আমার মনে হয় আপনার নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিৎ। যাতে করে আপনি এলাকার মানুষের সকল দূর্ভোগ দূর করতে পারেন।”
রায়ান এসব নিয়েই ভাবতে থাকে। সে তাড়াহুড়ো করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। বাড়িতে ফিরেও সে এসব নিয়ে ভাবছিল। এমন সময় রুহুল আমিন তার রুমে আসেন। রুহুল আমিনকে দেখে রায়ান তার সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। একসময় নানা কথা বলতে বলতে সে বলে,”আচ্ছা, আব্বু। তুমি কেন রাজনীতিতে এসেছিলে?
রুহুল আমিন বলেন,”আমি বড় হয়েছি খুব দরিদ্র পরিবেশে। সেই থেকেই আমার মনে জেদ ছিল যে আমি একসময় মানুষের দুঃখ দূর্ভোগ দূর করব। সেই ভাবনা থেকেই রাজনীতিতে আসা। আমি জানি না কতোটা সফল হয়েছি। কিন্তু নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছি।”
রায়ান যেন তার উত্তর পেয়ে যায়। রুহুল আমিনের সামনে মাথা নিচু করে বলে,”তুমি আমাকে দোয়া করো আব্বু। আমি যেন তোমার দেখানো পথে হেটে মানুষের সব দুঃখ দূর্ভোগ দূর করতে পারি।”
রুহুল আমিন খুশি হন। তিনি কখনোই রায়ানের উপর জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চান নি। তাই রাজনীতির ব্যাপারেও তাকে জোর করেননি। কিন্তু রায়ান নিজে থেকেই এই ব্যাপারে এগিয়ে আসায় তিনি অনেক খুশি।
~~~~~
সেদিনের পরই রায়ান মনোনয়ন পত্র তুলে জমা নিয়েছিল। আর স্বাভাবিকভাবেই দল থেকে তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়। বর্তমানে সে ভোটের প্রচারণা চালাচ্ছে জোরদমে। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইছে। রাজনীতিতে সে অনভিজ্ঞ। এইজন্য তাকে বেশ বুঝে শুনে পা ফেলতে হচ্ছে। তার বাবা তাকে অনেক পরামর্শ দিচ্ছে৷ এছাড়া আরো অনেক সিনিয়র রাজনীতিবিদও তার পাশে আছে। প্রভাও রয়েছে রায়ানের পাশে। একজন যোগ্য সহধর্মিণীর মতো সে সবসময় রায়ানের পাশে দাঁড়ায়। নিজের কাজের বাইরে সময় বের করে সে আজ এসেছে রায়ানের হয়ে ভোটের প্রচার করতে। একটি জনসভা থেকে প্রভা বলে,”আমি আমার স্বামীকে মানুষ হিসেবে যতোটা চিনি তিনি অনেক ভালো মানুষ। আমি আপনাদের গ্যারান্টি দিতে পারি আপনারা যদি তাকে ভোট দেন তাহলে আপনারা একজন যোগ্য মানুষকেই বেছে নিতে পারবেন। আর দেখবেন আমাদের চট্টগ্রাম শহর উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাবে। এমনকি উন্নতিতে ঢাকাকেও ছাড়িয়ে যাবে। এখন মানুষ যেমন ঢাকায় যায় তেমনি দেখবেন আমার স্বামী এমপি হয়ে শহরের এমন উন্নতি করবে যে সবাই চট্টগ্রামে আসবে। চট্টগ্রাম শিল্প, শিক্ষাদীক্ষা, পর্যটন সব দিক দিয়েই এগিয়ে যাবে। এখান থেকে দারিদ্র্য একেবারে মুছে যাবে। বিপদে আপদে সবসময় আপনারা আমার স্বামীকে পাশে পাবেন।”
এরকম আরো নানান ভাষণ দেয় সে। হঠাৎ করে তার অনেক ক্লান্তি অনুভূত হয়। প্রথার মাথা ঘুরতে থাকে। আর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রায়ান সাথে সাথেই মঞ্চে উঠে যায়। এরপর তার এক কর্মীকে বলে,”তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করো। প্রভাকে হাসপাতালে নিতে হবে।”
রায়ান প্রভার জন্য অনেক চিন্তা করতে থাকে। তার মনে হয় প্রভার স্ট্রেসের জন্যই এমন হয়েছে। সে পানি নিয়ে প্রভার মুখে ছিটায়। প্রভার জ্ঞান ফিরে আসে। রায়ান প্রভাকে বলে,”তুমি ঠিক আছ তো?”
প্রভা বলে,”হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। হঠাৎ করে কেন জানি মাথা ঘুরে..”
এই বলে হঠাৎ করে প্রভা মুখ চেপে ধরে। তার কেন জানি খুব বমি পাচ্ছে। রায়ান বলে,”কি হয়েছে? এনি প্রব্লেম?”
প্রভা আর কিছু বলার সময় না দিয়ে বমি করা শুরু করে।
to be continue…
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_31
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রভাকে নিয়ে দ্রুত বাড়িতে ফিরে আসে রায়ান। অত:পর প্রভাকে বিশ্রাম নিতে বলে। আজ সে ঠিক করেছে প্রভার খেয়াল রাখবে সারাদিন। তাই খাওয়া দাওয়া করে এসে প্রভার পাশেই বসে। প্রভা রায়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। রায়ান প্রভার হাসা দেখে সন্দিহান হয়ে পড়ে। অদ্ভুত ভাবে তাকায় প্রভার দিকে এবং তাকে জিজ্ঞেস করে,”তুমি এভাবে হাসছ কেন প্রভা?”
প্রভা আচমকা রায়ানের কোলে মাথা রেখে দেয়। রায়ান প্রভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। প্রভা এবার রায়ানের উদ্দ্যেশ্যে বলতে শুরু করে,”দুদিন নেই আমার মাথা ব্যাথা করছিল, সাথে বমি বমি ভাব। প্রথম দিকে আমি এটাকে এসিডিটি ভেবেছিলাম কিন্তু পরবর্তীতে বুঝলাম এটা সাধারণ এসিডিটি নয়। আজ জনসভায় অজ্ঞান হয়ে যাবার পরই আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গেছিলাম। তাও ঘরে এসে প্রেগ্ন্যাসি কিট দিয়ে টেস্ট করলাম। প্রত্যাশিত ফলাফলই পেলাম। আমি মা হতে চলেছি। আর আপনি বাবা হতে চলেছেন রায়ান।”
প্রভার মুখে এই কথা শুনে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে রায়ান। প্রভার উদোম পেটে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,”আমি ভাবতেই পারিনি এত বড় একটা সুখবর পাবো। আমি আজ কত খুশি বলে বোঝাতে পারব না। আমি বাবা…প্রভা আমি…”
রায়ানের এই উত্তেজনা দেখে প্রভাও খুশি হয়। মা-বাবা হওয়ার মতো সুন্দর অনুভূতির কোন তুলনাই হয় না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~
কয়েক দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে নির্বিঘ্নে। এই ক’দিনে রায়ানের খুশির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ এগিয়ে এসেছে। আজই নির্বাচন অনু্ষ্ঠিত হলো। রায়ান নিজের জয় নিয়ে আশাবাদী। এমনিতেই চট্টগ্রাম শহরে রুহুল আমিনের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। আর রুহুল আমিনের উপর ভরসা রেখে তাই তার ছেলে রায়ানও ভালোই ভোট পাবে নিঃসন্দেহে। তার উপর রায়ান নিজেও ভোটে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জনগণকে৷ এবং বিভিন্ন সমীক্ষাতেও জনগণ তার পক্ষেই রায় দিয়েছে। শেষমেশ ভোটের ফল বেড়িয়ে এলো। এই ভোটে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হলো রায়ান। প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীকে প্রায় আড়াই লাখ ভোটে হারিয়েছে সে। পুরো শহর জুড়ে বিজয় মিছিল বের করা হয়। চট্টগ্রামবাসী এখন উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর।
এদিকে এমপি হওয়ার দরুণ রায়ানের ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব পড়লেও নিজের স্ত্রীর যত্নে সে কোন অবহেলা করতে ইচ্ছুক নয়। প্রভার এই সময় অনেক খেয়াল রাখতে হবে। তাই রায়ান প্রভাকে হাসপাতালে যেতে বারণ করেছিল যাতে তার উপর স্ট্রেস কম পড়ে কিন্তু প্রভা তো প্রভাই। নিজের দায়িত্বে সে কিছুতেই অবহেলা করবে না। তবে অনেক বলে কয়ে প্রভার ওয়ার্কিং টাইম কমিয়ে এনেছে সে। তাছাড়া বাড়িতে যতক্ষণই থাকে সে প্রভার যত্ন নেয়ার চেষ্টা করে।
প্রভাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়া, তার খুটিনাটি সব কাজ করে দেওয়া সহ সব দিকেই খেয়াল রাখছে সে। অনুরাধাও প্রভার খবরটা পেয়ে তার সাথে দেখা করতে এসেছে। সাথে এনেছে নিজের মেয়ে স্নেহাকেও। অনুরাধা প্রভাকে বলে,”আমি খুব খুশি হয়েছি তোর খবরটা পেয়ে।”
দুই বান্ধবী মিলে অনেক গল্প করে। অনুরাধা নিজের প্রেগ্ন্যাসির এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করে প্রভার সাথে। যদিও একজন ডাক্তার হিসেবে তার এসব সম্পর্কে ধারণা আছে তবে তবুও নতুন করে এসব জেনে তার ভালোই লাগছে। আসলে প্রথমবার মা হচ্ছে তো তাই অনুভূতিটা অনেক সুন্দর।
৯ মাস পর,
প্রভা ও রায়ান একসাথে সময় পার করছিল। রায়ান এতদিন ঢাকায় ছিল। আজ চট্টগ্রামে ফিরেই প্রভার খেয়াল রাখছে পুরোদমে। আর কিছুদিন পরেই প্রভার ডেলিভারি ডেট। তাই বর্তমানে সে বেড রেস্টেই থাকে সবসময়। আজ কথায় কথায় প্রভা হঠাৎ বলে,”আচ্ছা তোমার কি মনে হয়? আমাদের ছেলে হবে না মেয়ে?”
রায়ান হেসে বলে,”ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। আমি তো চাই যেই আসুক সে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসুক। তবে আমি শুনেছি মেয়েরা বাবার অনেক আদরের হয়। তাছাড়া আমি নিজের মাকে কখনো পাশে পাই নি। তাই মেয়ে হলে আমি একটু বেশিই খুশি হবো। আমার মনে হবে আমার মেয়ে নয় মা এসেছে আমার কাছে।”
প্রভা স্মিত হাসে। নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”আমিও খুশি হবো যদি আপনার এই চাওয়া পূর্ণ হয়।”
রায়ান বলে,”তবে ছেলে হলেও কোন ব্যাপার না। আমার রাজপুত্র, রাজকন্যা যেই আসুক তাকে আমি আগলে রাখবো সাথে আমার রাণীকেও।”
প্রভা রায়ানের উপর ভীষণ মুগ্ধ হয়। এত অসাধারণ ব্যক্তিত্ব রায়ানের যা তাকে সবসময় মুগ্ধ করে। প্রভার নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয় রায়ানের স্ত্রী হতে পেরে। সে এটাও জানে তাদের সন্তানও অনেক ভাগ্যবান/ভাগ্যবতী হবে রায়ানকে বাবা হিসেবে পেয়ে।
দিন গুলো ভালো ভাবেই চলতে থাকে। তখনো প্রভার ডেলিভারি ডেটের এক সপ্তাহ বাকি ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রভার লেবার পেইন শুরু হয়। রায়ান সেইসময় বাড়িতেই ছিল। সে দ্রুত প্রভাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। প্রভাকে এডমিট করা হয় হসপিটালে। অত:পর অটির বাইরে পায়চারি করতে থাকে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকে নিজের স্ত্রীর সুস্থতার। রায়ান অনেকক্ষণ ধরে পায়চারি করছিল। কিন্তু ভেতর থেকে কোন খবর আসে নি৷ রায়ানের চিন্তা বাড়ছিল। সৌভিক, অনুরাধা ওরাও ছুটে আসে হসপিটালে। সৌভিক রায়ানের কাঁধে হাত রেখে বলে,”তুই চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এমন সময় একজন নার্স একটি শিশুকে কোলে করে নিয়ে বাইরে আসে৷ রায়ানের হৃদস্পন্দন বাড়ছিল। নার্স রায়ানের কোলে বাচ্চাটিকে তুলে দিয়ে বলে,”অভিনন্দন স্যার, আপনার মেয়ে হয়েছে। মা-মেয়ে দুজনেই ভালো আছেন। এই নিন আপনার মেয়েকে কোলে নিন।”
রায়ান তার মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয়। আবেগাপ্লুত হয়ে বলে,”আমার রাজকন্যা! আমার মা!”
সৌভিক, অনুরাধা ওরা দুজনেও অনেক খুশি হয়।
প্রভা ও রায়ানের দিনগুলো এরপর অনেক সুখেই অতিবাহিত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই রায়ান ও প্রভা তাদের মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। রুহুল আমিন ধুমধাম করে তার নাতনিকে ঘরে তোলেন।
বাবা হওয়ার পর থেকে রায়ান আরো অনেক বেশি দায়িত্ববান হয়ে গেছে। সবসময় মেয়েকে কোলে রাখছে। রায়ান তার কন্যাশিশুকে মেয়ে কম মা হিসেবে বেশি ভালোবাসছে। আর কাকতালীয়ভাবে রায়ানের মেয়ের সাথে তার দাদীর চেহারার অনেক মিলও আছে। রুহুল আমিন তো নিজের নাতনিকে কোলে তুলে নিয়েই বলেন,”একদম সেই টানাটানা চোখ, নাক সবকিছুই ওর মতোনই।”
রায়ান ও প্রভার মেয়ে কিন্তু অনেক রূপবতীও হয়েছে। এই বয়সেই এত সুন্দরী বোঝা যাচ্ছে বড় হলে অনেক বেশি সুন্দরী হবে সে।
~~~~~
প্রভা ও রায়ানের মেয়ের আকিকার দিন চলে আসে। রায়ান নিজের মেয়ের জন্য আগে থেকেই নাম ঠিক করে রেখেছিল। আকিকার দিন সে বলে,”আমার ও প্রভার মেয়ের নাম আমি রাখলাম রুকাইয়া জাহান প্রণালী।”
রুকাইয়া ছিল রায়ানের মায়ের নাম। নিজের মায়ের স্মৃতি রেখেই এই নাম দিয়েছে সে। প্রণালী নামটা মূলত প্রভাই ভেবেছিল। দুজনেই মতামত দিয়ে এই নাম রেখেছে। রায়ান নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”আমার প্রণালী মা অনেক বড় হবে। নিজের বাবা-মায়ের মুখ অনেক উজ্জ্বল করবে তাই না মা?”
ছোট্ট প্রণালী তখন খিলখিল করে হেসে ওঠে। প্রভাও নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”আমি জানি আমার মেয়ে অনেক সফল হবে জীবনে। আমাদের গোটা পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে। আমি দোয়া করি, ওর ভবিষ্যৎ জীবন অনেক সুখের হোক।”
প্রণালীর ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হবে না দুঃখের তা তো জানা যাবে সামনেই। দেখা যাক, ভাগ্য কোন খেলা খেলে।
to be continue…
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_32
#ইয়াসমিন_খন্দকার
৫ বছর পর,
প্রভা তৈরি হচ্ছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। আজ তার অনেক ব্যস্ত সিডিউল। অনেক রোগী দেখতে হবে। এরমধ্যে হঠাৎ সে লক্ষ্য করল প্রণালী দৌড়ে রুমে প্রবেশ করছে। প্রভা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এই মেয়েটাকে নিয়ে সে আর পারে না। এত ডানপিটে আর চঞ্চল হয়েছে যা বলার বাহিরে। প্রভা বুঝতে পারে না তার মতো শান্ত নারীর গর্ভে এই অশান্ত মেয়ে কিভাবে এলো। প্রণালী রুমে এসেই বিছানায় বসে পড়ল। প্রভার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”আম্মু, আমার আজ হাসপাতালে যেতে খুব ইচ্ছা করছে। তুমি আমাকে নিয়ে চলো না।”
প্রভা ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”ওখানে গিয়ে তুমি কি করবে? তোমার আজ স্কুল আছে না?”
প্রণালী মুখ ভাড় করে বলে,”আমার আজ স্কুলে যেতে একদমই ইচ্ছা করছে না। তুমি আমায় হাসপাতালে নিয়ে চলো না।”
“তুমি বেশ পড়াচোর হয়েছ দেখছি। এসব একদম চলবে না। আমার সাথে চলো আমি তোমাকে স্কুলে নামিয়ে দেব।”
প্রণালী একদম কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। সে আজ কিছুতেই স্কুলে যাবে না। প্রভা নিজের এই জেদি, চঞ্চল মেয়েটাকে সামলাতে ব্যর্থ হয়। এমন সময় রায়ানও রুমে চলে আসে। প্রণালীকে কাঁদতে দেখে সে এসে নিজের রাজকন্যাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”আমার প্রিন্সেস কাঁদছে কেন? কি হয়েছে মা?”
প্রণালী গাল ফুলিয়ে বলে,”আমি আজ স্কুলে যাব না বাবা।”
রায়ান বলে,”কোন ব্যাপার না। আজ আমি তোমাকে নিয়ে নাহয় ঘুরতে যাব।”
প্রভা বলে,”এভাবেই মেয়েকে মাথায় তোলো৷ ওকে আস্কারা দিয়ে তুমি কিন্তু একদম ঠিক করছ না। সামনে ওর এনুয়াল এক্সাম এইসময় ফাঁকিবাজি আমি একদম বরদাস্ত করব না।”
“তুমি এমন করছ কেন প্রভা? একটা দিনেরই তো ব্যাপার। আমি নাহয় ওকে নিয়ে আজ ঘুরতে যাব।”
“কেন? তোমার কাজ নেই? লোকে যদি জানে এমপি নিজের কাজ ছেড়ে সারাদিন নিজের মেয়েকে নিয়ে ঘুরছে তাহলে কিন্তু পরেরবার একটা ভোটও পাবে না।”
“সারাবছর তো জনগণকে সময় দেই। এই একটা দিন নাহয় নিজের মেয়েকে সময় দিলাম।”
প্রভা আর কিছু বলে না। সে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। এমন সময় রায়ান এসে প্রভাকে বলে,”নিজের যত্ন নিও। এইসময় কিন্তু তোমাকে নিজের প্রতি আরো যত্নবান হতে হবে। কারণ তোমার মাঝে যে আরো একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে।”
প্রভা মৃদু হাসে। দ্বিতীয় বারের মতো মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চলেছে সে। কয়েকদিন আগেই জানতে পেরেছে সে মা হতে চলেছে। তাই প্রভার মধ্যে আনন্দের কোন কমতি নেই। সাথে রয়েছে কিছু আশংকাও। যদিও সেই ব্যাপারে রায়ানকে এখনো তার কিছু বলা হয়নি। আজ হসপিটালে গিয়েই প্রভা সবার আগে গাইনি বিশেষজ্ঞ মিসেস চৌধুরীর সাথে কথা বলবে। তিনিই তাকে এই বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবে। প্রভা কিছু একটা মনে করে রায়ানকে বলে,”তুমি ওদের খোঁজ নিয়েছিলে?”
“ওদের মানে?”
“আবির ভাইয়ার স্ত্রী ও সন্তানের?”
প্রভার কথা শুনে রায়ানের চোয়াল শক্ত হয়। আবির নামটাকেই তার ইদানীং সহ্য হয়না। এই আবিরের জন্যই তার জীবনের ১২ টা বছর নষ্ট হয়েছে। শুধু তাই নয় আবিরের খাওয়ানো ওষুধের পাশ্ব-প্রতিক্রিয়ার জন্য রুহুল আমিনও কিছু বছর আগে মারা গেছেন। নাহলে তিনি হয়তো আজও পৃথিবীতে থাকতেন। কিছুদিন আগেই রায়ান জানতে পেরেছে আবির গোপনে একটা বিয়ে করেছিল। সেই ঘরে আবিরের একটা ছেলেও আছে। প্রভা এটা জানার পর দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। প্রভার মনে হয়েছিল আবির হয়তো ঐ মহিলাকেও বোকা বানিয়েছে। কিন্তু রায়ান খোঁজ নিয়ে দেখেছে ঐ মহিলা আবিরের ব্যাপারে সব সত্যি জেনেই তাকে বিয়ে করেছে। এখনো আবিরের জমানো টাকায় বেশ আয়েসি জীবন যাপন করছে। তাই রায়ান আর এই ব্যাপারে কোন কথা বলে না। প্রভাকে শুধু এটুকুই বলে,”ওরা ভালো আছে। তুমি চিন্তা করো না।”
~~~~~~~
নিজের প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে আছে প্রভা। ডা.চৌধুরী প্রভাকে বলে,”আপনি নিজেও একজন চিকিৎসক। তাই অবস্থা যে কতটা ক্রিটিকাল আপনি বুঝতে পারছেন। এই সন্তানটা জন্ম দিতে গেলে আপনার লাইফ রিস্ক আছে। আমার মনে হয় আপনার গর্ভ*পাত করা উচিৎ।”
প্রভা নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”আমি এমনটা চাই না। তাছাড়া আপনিই তো বললেন আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ২০%, তাহলে তো রিস্কটা নিতেই পারি।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না মিসেস আহসান, এটা একটু বেশিই রিস্কি হয়ে যাবে। আপনার এই রিস্ক নেওয়া উচিত হবে না।”
“আমি একজন মা হয়ে কিছুতেই নিজের গর্ভের সন্তানকে মে*রে ফেলতে পারব না। তার জন্য যদি নিজের জীবনটা রিস্কে ফেলতে হয় তাতেও আমার কোন অসুবিধা নেই।”
বলেই প্রভা উঠে দাঁড়ায়। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আর নিজের সিদ্ধান্তে যে সে অটল সেটাও সে ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রভা নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”তুমি চিন্তা করো না। তোমার মাম্মা তোমায় পৃথিবীতে আনবেই। তোমার কোন ক্ষতি হতে দেব না।”
~~~~~~~
কয়েক মাস পর,
আজ প্রভার ডেলিভারি ডেইট। প্রভাকে নিয়ে যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে রায়ান। প্রভা রায়ানকে নিজের অবস্থার ব্যাপারে বলে নি। তাই সে অনেকটা নিশ্চিন্তে আছে। কিন্তু আজ যখন ডাক্তারের কাছে সবটা জানতে পারল তখন রায়ানের পায়ের তলার মাটি সরে গেল। রায়ান যদি আগে জানত প্রভার লাইফ রিস্ক আছে তাহলে সে কখনো প্রভাকে এত বড় ঝুঁকি নিতে দিত না। রায়ান তখন সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকে। প্রভার কোন ক্ষতি হলে যে সে সেটা মেনে নিতে পারবে না। রায়ান কাঁদতে থাকে অনবরত। প্রণালীকে নিয়ে অনুরাধা হাসপাতালে আছে। প্রণালী রায়ানকে কাঁদতে দেখে বলে,”বাবা, তুমি কাঁদছ কেন?”
রায়ান নিজের মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে কাঁদতে থাকে। প্রণালী কিছু বুঝে উঠতে পারে না। এমন সময় একজন ডাক্তার এসে বলে,”অবস্থা ভীষণ ক্রিটিকাল। আমরা মা এবং সন্তানের দুজনেরই লাইফ রিস্ক আছে। তবে আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব। মাকে বাঁচানোর কথা আমরা দিতে পারছি না।”
প্রণালী অনুরাধার কাছে গিয়ে বলে,”ডাক্তার কি বলছে আন্টি? মায়ের কি হয়েছে?”
অনুরাধা এই ছোট বাচ্চাটাকে কিভাবে সামলাবে সেটা বুঝে উঠতে পারে না। সময় যত এগোচ্ছিল রায়ান ততই দূর্বল হয়ে পড়ছিল। প্রভাকে হারানোর ভয় জেকে বসতে থাকে তার মনে। এমন সময় ডাক্তার এসে বলে,”আপনার ছেলে হয়েছে। সে একদম সুস্থ আছে তবে আপনার স্ত্রীর অবস্থা আশংকাজনক। আমরা নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাব। বাকিটা আল্লাহর হাতে।”
এই বলে তিনি চলে যান। রায়ানের মধ্যে এই মুহুর্তে অদ্ভুত অনুভূতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না নিজের ছেলে হওয়ার খবরে খুশি হবে নাকি প্রভার এই অবস্থার জন্য কষ্ট পাবে। কিছুক্ষণ পরেই একজন নার্স এসে তাদের সন্তানকে রায়ানের কোলে দিয়ে যায়। রায়ান নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বলে,”আমার রাজপুত্র!”
সময় গুলো কাঁটতে থাকে দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে। প্রভার অবস্থা এখনো স্থিতিশীল। তার চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার এখনো কোন ভরসা দিতে পারছে না। রায়ান নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। সৌভিক তার কাধে হাত রেখে বলে,”অনুরাধা প্রণালীকে সামলাচ্ছে। তুই চিন্তা করিস না। ভাবির কিছু হবে না।”
রায়ান নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার সন্তানেরা কি মাতৃহারা হয়ে যাবে সৌভিক? আমি ওদের একা কিভাবে সামলাবো? প্রভাকে ছাড়া বাকি জীবনটাই বা কিভাবে কাটাবো? ও কিভাবে এরকম স্বার্থপরতা করতে পারল কিভাবে?”
বলে আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো রায়ান।
to be continue…