#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_27
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রভাকে নিজের বুকে আগলে নেয় রায়ান। তাকে শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। কিন্তু প্রভা অনুভূতিহীনের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। রায়ান প্রভাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রভা বলে ওঠে,”আপনাকে আমায় কিছু বলতে হবে না। আমি সব জানি। আপনি আমায় একটুও বিশ্বাস করেন না তাইনা? এইজন্যই বোধহয় এত গুলো বছর ধরে এইসব মিথ্যা নাটক করলেন?”
রায়ান নিরুত্তর। প্রভা মলিন হেসে বললো,”জানেন আপনাকে যেদিন প্রথম দেখেছি সেদিনই আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছি যে আপনিই আমার রায়ান। কিন্তু আমি এতদিন ধরে আপনাকে না চেনার ভান করে গেছি শুধু একটাই কারণে। আমার বিশ্বাস ছিল যে আপনি আমার কাছে এসে নিজের মুখে সব সত্যি আমায় বলবেন। নিজের আসল পরিচয়ে আমার সামনে আসবেন। কিন্তু..আপনি আমার সাথে নাটক করে গেলেন। আমাকে হয়তো আপনার বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয়নি।”
“প্রভা লিসেন..”
“আমার কিছু শোনার নেই রায়ান। আপনার কাছে আমি কোন কৈফিয়ত চাইবোনা। আমার ১২ বছরের কষ্টের ফিরিস্তি নিয়েও বসব না। শুধু আপনাকে একটা কথাই বলবো, আমাকে কি একটুও বিশ্বাস করা যেত না?”
রায়ান কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। সেও তো ভেতরে ভেতরে এতদিন ছটফট করেছে প্রভাকে সবকিছু বলার জন্য কিন্তু পরিস্থিতি তাকে এইসব নাটক করতে বাধ্য করেছে। রায়ান এইজন্য অনেক লজ্জিত৷ সে বারবার করে প্রভার কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে। কিন্তু প্রভার প্রচণ্ড অভিমান হয়েছে। তাই সে রায়ানকে সরাসরি বলে দেয়,”আমার আর আপনার কাছে কিছু শোনার নেই রায়ান। আপনার কাছে আমার শুধু এখন একটাই অনুরোধ। প্লিজ আমায় একা থাকতে দিন। আমি না বলা পর্যন্ত আর আমার সামনে আসবেন না।”
এই বলে প্রভা রায়ানের বাড়ি থেকে চলে যায়। আর রায়ান অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে।
রায়ান বলতে থাকে,”তুমি আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলে না প্রভা। আমি এখন তোমার ভুল কিভাবে ভাঙাবো?”
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আবির পা রেখেছে কানাডার মাটিতে। উদ্দ্যেশ্য প্রভাকে খুঁজে বের করে তার চ্যাপ্টার চিরদিনের জন্য ক্লোজ করে দেওয়া। কারণ আবির জানে প্রভা তার জন্য অনেক বড় বিপদের কারণ হতে পারে। আবির জানত প্রভা এখন কানাডাতেই আছে। কারণ প্রভার কানাডায় আসার কথা ছিল। এরপর নিজের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সে প্রভা বর্তমানে কোথায় আছে সেই সব ডিটেইলস জেনে নিয়েছে। তবে আবির এবার অনেক ভালো চাল চেলেছে। বর্তমানে সে আর কাউকে বিশ্বাস করে না। এজন্য সব কাজ বেশ সাবধানে করেছে। গোপনে পাসপোর্ট, ভিজার আবেদন করেছে। এবার সৌভিককেও কিছু জানায় নি। কারণ কাউকে সে বিশ্বাস করতে পারে না আর। ঢাকায় মিটিংয়ের কথা বলেই সে কানাডায় এসেছে। এখন আবিরের লক্ষ্য একটাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রভাকে খুঁজে বের করে তাকে শেষ করে দিয়ে তারপর আবার দেশে ফেরা।
আবির প্রভার ঠিকানা পেয়ে গিয়েছিল। তাই সেখানেই প্রভার খোঁজ করতে যায়। কিন্তু প্রভা বাসায় ছিল না। তার দরজার সামনে তালা ঝুলছিল। এইজন্য হতাশ হয়ে ফিরে আসছিল সে। প্রভার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে কিছুদুর যেতেই কারো একটা সাথে ধাক্কা খায় সে। বোঝাই যাচ্ছিল লোকটা অনেক তাড়ায় ছিল। লোকটা আবিরকে লক্ষ্যই করে নি। তাই আবিরের দিকে না তাকিয়েই সরি বলে চলে যায়।
এদিকে কন্ঠস্বরটা শুনে আবির দাঁড়িয়ে যায়। কন্ঠস্বরটা তার কাছে অনেক চেনা লাগে। তাই পিছনে ফিরে তাকিয়ে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু আর তাকে দেখতে পায়না। আবির বিড়বিড় করে বলে,”রায়ানের গলা শুনলান মনে হয়।”
তারপর নিজেই নিজের মাথায় চাটি দিয়ে বলে,”ধুর, কিসব ভাবছি আমি? রায়ান তো কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে এখন আবার কিভাবে আসবে ও? নিশ্চয়ই আমারই শুনতে ভুল হয়েছে। না, এসব ভেবে সময় নষ্ট করা যাবে না। আমাকে আগে ঐ প্রভাকে খুঁজে বের করে ওর চ্যাপ্টার ক্লোজ করতে হবে। খুব ভালোবাসে না ও ঐ রায়ানকে? আজ ওকে আমি রায়ানের কাছেই পাঠিয়ে দেব।”
এই বলে গগণবিদারী হাসতে থাকে আবির। তার এই হাসি এত ভয়ানক ছিল যে শয়তানও তার এই হাসি দেখে ভয় পেয়ে যাবে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
প্রভা আজ হাসপাতালেই রোগী দেখতে ব্যস্ত ছিল। প্রভা নিজের কাজের ব্যাপারে অনেক সিরিয়াস। কখনই নিজের পারসোনাল প্রব্লেমের জন্য নিজের প্রফেশনাল লাইফে কোন সমস্যা আসতে দেয় না। তাই আজও মনে অনেক কষ্ট নিয়েই হাসপাতালে এসেছে। নিজের দায়িত্ব সে কোনমতেই অবহেলা করে না।
হঠাৎ করে প্রভার অনেক ক্লান্তি হচ্ছিল তাই সে একটু বাইরে আসে। এমন সময় একজন ওয়ার্ড বয় তার কাছে এসে তাকে বলে,”আপনাকে সানা প্রিস্ট ছাদে ডাকছে।”
প্রভা ওয়ার্ড বয়ের কথা শুনে ছাদে চলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকেই দেখতে পায়না। এমন সময় পেছন থেকে আবির এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”নাইস ঠু মিট ইউ।”
প্রভা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। চিৎকার করতে যাবে তার আগেই আবির তাকে ক্লোরোফম মিশ্রিত রুমাল দিয়ে অজ্ঞান করে দেয়। তারপর দুজন ওয়ার্ড বয়কে ইশারা করতেই তারা লাশ রাখার প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে আসে। আসলে আবিরই এই ওয়ার্ড বয়দের টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে।
আবিরের নির্দেশমতো ওয়ার্ড বয়রা প্রভাকে লাশ রাখার ব্যাগের মধ্যে ঢুকায়। তারপর তাকে নিয়ে যেতে থাকে। যার ফলে কেউ আর সন্দেহই করেনা তাদেরকে। তারা প্রভাকে নিচে আবিরের ঠিক করা একটা এম্বুল্যান্সের কাছে নিয়ে যায়। আবিরও ছিল তাদের সাথে। এমন সময় ডাক্তার অভিষেক চক্রবর্তী তাদের আটকিয়ে বলে, “কি হচ্ছে এখানে?”
ওয়ার্ড বয়েরা ভয় পেয়ে যায়। আবির ব্যাপারটাকে সামলানোর জন্য বলে,”আমার স্ত্রী এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিল। ওর ক্যান্সার হয়েছিল লাস্ট স্টেজ। ওকে আর বাঁচানো যায়নি ”
বলেই কান্নার অভিনয় করতে শুরু করে। ডাক্তার অভিষেকের প্রথমদিকে একটু সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু আবিরের কথা শুনে তার অনেক মায়া লাগে। তিনি আবিরকে শান্তনা দিয়ে বলে,”আপনি কষ্ট পাবেন না। জন্ম-মৃত্যু সব তো সৃষ্টিকর্তার হাতে। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করব আপনার স্ত্রীর আত্না যেন শান্তি পায়।”
বলেই তিনি চলে যান। আবির তাড়া দিয়ে বলে,”তাড়াতাড়ি এটাকে গাড়িতে তোল।”
দুজন ওয়ার্ড বয় মিলে প্রভাকে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়। এরপর তারা আবিরের কাছ থেকে টাকা বুঝে নেয়। আবির প্রভাকে নিয়ে রওনা দেয়। শয়তানী হাসি হেসে বলে,”আজ আমি তোর এমন অবস্থা করব যা তুই কল্পনাও করতে পারবি না।”
~~~~~~~
রায়ান আজ সারাদিন ধরে প্রভাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত। প্রভা নাতো তার ফোন ধরছে আর নাতো তার সাথে যোগাযোগ করছে। প্রভাকে খুঁজতে খুঁজতে হাসপাতালে চলে আসে রায়ান। কিন্তু এখানেও তার কোন খোঁজ পায়না। সে উদাস হয়ে যায়। রায়ান উদাস মনে হাসপাতালের ছাদে চলে যায়। হঠাৎ তার পায়ে কিছু একটার সাথে হোচট লাগায় সে সেটা চেক করতে গিয়ে দেখে একটা ফোন পড়ে আছে। ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে সে বুঝতে পারে এটা প্রভার ফোন। অত:পর হতভম্ব হয়ে বলে,”প্রভার ফোন এখানে কি করছে? আর প্রভা কোথায়?”
এমন সময় রায়ানের ফোন বেজে উঠল৷ সৌভিক ফোন করেছে। রায়ান ফোনটা রিসিভ করতেই সৌভিক বলে,”তুই কোথায় রায়ান? তোকে একটা খারাপ খবর দেওয়ার আছে।”
“কি খারাপ খবর?”
“আবির কানাডায় গেছে।”
“কি? কবে এসেছে? আর তুই এখন আমায় এটা জানাচ্ছিস?”
“আমিও একটু আগেই জানতে পারলাম। ও আসলে কাউকেই বলে যায়নি। তুই সাবধানে থাকিস আর প্রভারও খেয়াল রাখিস। আবির কিন্তু প্রভার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।”
রায়ানের মনে ভয় ঢুকে যায়৷ আবির আবার প্রভার কোন ক্ষতি করলো না তো?
to be continue…
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_28(Bonus)
#ইয়াসমিন_খন্দকার
রায়ান অস্থির হয়ে যাচ্ছিল প্রচুর। প্রভার জন্য তার খুব চিন্তা হচ্ছিল। তাই সে বিন্দুমাত্র কাল বিলম্ব না করে সানা প্রিস্টের কেবিনে তার সাথে দেখতে যায়৷ রায়ান হাফাতে হাফাতে সানা প্রিস্টের কেবিনে প্রবেশ করলে সানা প্রিস্ট রায়ানের দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এই নাও পানি খাও। কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন লাগছে কেন?”
রায়ান পানিটা খেয়ে বলে,”প্রভার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনে হয় ওর কোন বিপদ হয়েছে। আমি ওর ফোনটা ছাদে কুড়িয়ে পেয়েছি। তুমি প্লিজ একটু সিসিটিভি দেখে খোঁজ লাগাও।”
সানা প্রিস্ট রায়ানের কথা মতো কাজ করে। যদিও ছাদে কোন সিসিটিভি ছিল না কিন্তু একজন ওয়াড বয় প্রভাকে কিছু বলার পর সে ছাদের দিকে চলে যায় এটা সিসিটিভিতে দেখা যায়। এমনকি সেই ওয়াড বয় যে আরেকজনকে সাথে নিয়ে পুনরায় ছাদ থেকে একটা লাশের ব্যাগ নিয়ে বের হয় সেটাও দেখা যায়। রায়ান উত্তেজিত হয়ে বলে,”এই ওয়াড বয়কে ডেকে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”
সানা প্রিস্ট পুলিশকে এই ব্যাপারে সব জানায়। পুলিশ ওয়াড বয় দুজনকে গ্রেফতার করে এবং তাদের জেরা করতে থাকে। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে বেশি কিছু করতে পারে না। এদিকে রায়ান হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। সে হন্যে হয়ে প্রভাকে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে।
হঠাৎ করে রায়ানের ফোন বেজে ওঠে। রায়ান সেই ফোনটা রিসিভ করতেই আবির বলে ওঠে,”অনেকদিন পর আবার তোর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য হলো দোস্ত।”
রায়ান রেগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। অনেক কষ্টে নিজের রাগ সংবরণ করে বলে,”প্রভাকে তুই কিডন্যাপ করেছিস তাইনা? বল, কোথায় রেখেছিস তুই ওকে?”
“কুল, কুল। এতদিন পর নিজের বেস্টফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিস আর আমার খবর না নিয়ে নিজের প্রেমিকার খবর নিচ্ছিস। দিস ইজ নট ফেয়ার রায়ান। প্রভার কথা বাদ দে। তুই নিজের কথা বল। কিভাবে এত খেলা খেললি তুই? ১২ বছর ধরে মৃত হওয়ার নাটক করলি কিন্তু কোন লাভ হলো না৷ আমি কানাডায় আসার আগেই রকস্টার রিহানের পারফরম্যান্সের একটা ক্লিপ দেখেছি। আর সেটা দেখেই আমি বুঝে গেছি যে রিহানই রায়ান। তোর গলার সুর আমি ভুলিনি দোস্ত। যাইহোক, সব নাটকের এবার শেষ হোক। আমি তোকে একটা ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি তুই সেখানে চলে আয়। আর হ্যাঁ, একদম চালাকি করে পুলিশ আনার চেষ্টা করবি না। নাহলে তোর প্রভাকে আমি শেষ করে দেব।”
“না আবির, তুই এমন কিছু করবি না। তুই যা বলবি আমি তাই করবো।”
“এই তো গুড বয়।”
বলেই আবির ফোন রেখে দেয়। তারপর রায়ানকে ম্যাসেজ করে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দেয়। এরপর সে প্রভার কাছে যায়। প্রভাকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখেছে আবির। প্রভার সামনে বসে বলে,”আজ তোর আর রায়ানের চ্যাপ্টার একসাথে ক্লোজ করব। ঐ বাংলায় একটা কথা আছে না সহমরণ? আজ তোদের সহমরণ হবে।”
প্রভা আবিরের দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আপনার এই ইচ্ছা কোনদিন পূরণ হবে না। আপনার পাপের বিনাশ হবেই। মনে রাখবেন, আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না৷ এতদিন ধরে আপনি অনেক অন্যায় করেছেন। এবার আপনার সব অন্যায়ের ফল আল্লাহ আপনাকে দেবেনই।”
আবির অট্টহাসি দিয়ে বলে,”দেখা যাক।”
~~~~~~~
রায়ান ছুটতে ছুটতে চলে আসে একটি পরিত্যক্ত শপিং মলে। এই ঠিকানাই আবির তাকে ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে দিয়েছে। রায়ান সেখানে এসেই প্রভার নাম ধরে ডাকতে থাকে। তখনই আবির এসে রায়ানের সামনে দাঁড়ায়। রায়ান আবিরের শার্টের কলার ধরে বলে,”প্রভা কোথায় আবির? কোথায় রেখেছিস ওকে?”
“এত প্রভা প্রভা করছিস কেন? একটা মেয়েকে নিয়ে এত আগ্রহ কেন রে তোর? এই মেয়েটার জন্য নিজের ১২ বছর নষ্ট করলি। আহ, কি ভালোবাসা!”
“বাজে বকা বন্ধ কর আর বল আমার প্রভা কোথায়।”
“যমের দুয়ারে গেছে? তুই যাবি নাকি?”
রায়ান নিজের ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। আবিরকে একের পর এক প্রহার করতে থাকে। আবির রায়ানের হাত ধরে তাকে আটকিয়ে দিয়ে বলে,”ব্যাস, অনেক হয়েছে আর না। ঐ দেখ তোর প্রভাকে।”
রায়ান দেখতে পায় আবিরের লোক প্রভার মাথায় বন্দুক ধরে আছে। রায়ান হতাশ হয়ে যায়। আবির হেসে বলে,”কি রে থামলি কেন? মা’র আমায়।”
“আবির তুই প্রভাকে ছেড়ে দে। তোর শত্রুতা আমার সাথে। প্রভাকে এসবের মাঝে টানিস না।”
“ছেড়ে দেব? এত সহজে? নাহ, এবার দেখ তোদের আমি কি হাল করি।”
বলেই আবির একটি রড হাতে তুলে নেয়। তারপর রায়ানকে বেধড়ক মা’রতে শুরু করে। প্রভা রায়ানের নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে। আবিরের মনে কোন দয়া হয়না। সে নির্দয়ের মতো মা’রতে থাকে রায়ানকে। রায়ান প্রভাকে বাঁচানোর জন্য সব মার মুখ বুজে সহ্য করে। কোন প্রতিবাদ করে না। আবিরের রড দিয়ে মে*রে রায়ানকে রক্তাক্ত করে দেয়। রায়ান মেঝেতে শুয়ে গোঙাচ্ছিল। তার রক্তে চারিদিক রঞ্জিত হয়ে গেছে। তার নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। প্রভা আর এসব কিছু সহ্য করতে পারছিল না। এরমধ্যে আবির রায়ানের মাথা লক্ষ্য করে সজোরে একটা আঘাত করে রড দিয়ে। রায়ান মাথায় হাত দিয়ে পড়ে যায়। প্রভা লক্ষ্য করে রায়ানের কান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে৷ প্রভা হতভম্ব। রায়ানের মাথায় এর আগেও আঘাত লেগেছিল দূর্ঘটনার কারণে। আজ আবারো এই আঘাতের ফল কত ভয়াবহ হতে পারে একজন ডাক্তার হিসেবে এটা সহজেই অনুমান করতে পারে প্রভা। সে আর কোন উপায় খুঁজে পায়না৷ রায়ানের বাঁচানোর জন্য এবার আবিরকে আটকাতেই হবে। প্রভা সুকৌশলে তার মাথায় বন্দুক ধরে থাকা ব্যক্তির হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেয়। তারপর আবিরের হাতে,পায়ে গুলি করে। আবির মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এমন সময় সানা প্রিস্টও পুলিশ নিয়ে হাজির হয়। রায়ানই তাকে সবটা ইনফর্ম করেছিল। পুলিশ আবির ওর তার দলের বাকি লোকদের গ্রেফতার করে। প্রভা দৌড়ে রায়ানের কাছে আসে৷ রায়ানের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রভা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে সানা প্রিস্টকে বলে,”রায়ান কোন রেসপন্স করছে না কেন? ওর কিছু হয়ে গেল না তো?”
সানা প্রিস্ট প্রভাকে শান্তনা দিয়ে বলে,”তুমি কোন চিন্তা করো না প্রভা। আমি এখনই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবহার করছি।”
~~~~~~~
সানা ও প্রভা দুজনেই বসে আছে অটির বাইরে৷ ভেতরে রায়ানের চিকিৎসা চলছে৷ প্রভা সমানে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে। সানাও তার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে।
একজন ডাক্তার আসতেই প্রভা তার সম্মুখীন হয়ে বলে,”রায়ান এখন কেমন আছে?”
ডাক্তার হতাশ কন্ঠে বলে,”আমরা নিজেদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার হাতে। তবে ওনার বাঁচার আশা একেবারে নেই বললেই চলে। পরপর দুবার মাথায় সিভিয়ার আঘাত পেলেন।”
~~~~~
২ দিন পর,
রায়ানকে ৭২ ঘন্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এখনো তার জ্ঞান ফেরেনি। প্রভা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে থাকে। একসময় সে বলে,”আল্লাহ তুমি আমার রায়ানকে বাঁচাও। প্রয়োজনে আমার জীবন নিয়ে নাও। তবুও রায়ানকে বাঁচিয়ে দাও।”
প্রভা এরপর রায়ানের কেবিনে যায়। রায়ানের পাশে বসে বলে,”একবার আপনাকে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম রায়ান। আপনাকে পাওয়ার কোন আশা ছিল না কিন্তু আল্লাহ আপনাকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিলো। আপনি আরেকবার লড়াই করে আমার কাছে ফিরে আসুন না। আমাদের যে এখনো অনেক পথচলা বাকি আছে। আমার না অনেকদিনের স্বপ্ন আমাদের একটা সুখের সংসার হবে। আপনাকে ছাড়া যে সেই স্বপ্ন পূরণ হবে না। আপনাকে একবার হারিয়ে আমি আধমরা হয়ে বেঁচে ছিলাম কিন্তু আরেকবার যদি হারাই তাহলে আমি একেবারে মরে যাব। প্লিজ আমায় আর কাঁদাবেন না। আপনার প্রেম যে বারংবার আমায় কাঁদাচ্ছে।”
হঠাৎ করেই রায়ান জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। প্রভা রায়ানের হার্টবিট চেক করে বুঝতে পারে তার হার্টবিট ক্রমশ কমছে। যা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। কিছুক্ষণ পর প্রভা লক্ষ্য করে রায়ানের আর শ্বাস পড়ছে না। প্রভা দূরে সরে যায়। রায়ানের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,”তুমি আবারো আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে রায়ান!”
to be continue…
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_29(বিয়ে স্পেশাল)
#ইয়াসমিন_খন্দকার
চট্টগ্রাম শহরে রায়ানদের বাড়ি সেজে উঠেছে আলোকসজ্জায়। রুহুল আমিন আজ খুশি মনে সবটা তদারকি করছেন। আজ যে তার একমাত্র ছেলের বিয়ে! তাই আয়োজনের কোন ত্রুটি রাখতে চাইছেন না তিনি।
নিজের রুমে বসে তৈরি হচ্ছে রায়ান। তার পরনে একটা সুন্দর কারুকার্য করা পাঞ্জাবি। সৌভিক রায়ানকে দেখে বলে,”তোকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে। প্রভা আজ তোকে দেখে একদম ফিদা হয়ে যাবে।”
রায়ান হেসে বলে,”নতুন করে আর কি ফিদা হবে? ও তো ১২ বছর ধরেই আমার উপর ফিদা!”
অন্যদিকে নিজের বাড়িতে তৈরি হচ্ছে প্রভাও। তার পড়নে গোলাপী রঙের খুব সুন্দর একটা বেনারসি শাড়ি৷ সাথে রয়েছে বিভিন্ন ভারী গহনা। সব মিলিয়ে তাকে আজ একদম রাণীর মতোই লাগছে। অনুরাধা প্রভার কাছে এসে বলে,”তোকে অনেক সুন্দরী লাগছে বউয়ের সাজে! ইশ, যদি আমি ছেলে হতাম তাহলে আমিই তোকে বিয়ে করে নিতাম। দেখবি রায়ান ভাইয়া আজ আবার নতুন করে তোর প্রেমে পড়বে।”
প্রভা মৃদু হাসে। এখন তার চেহারায় সবসময় এই হাসিই বজায় থাকে। দুঃখ যেন বিদায় নিয়েছে তার জীবন থেকে। প্রভা ভাবতে থাকে তার দুঃখের সময়গুলো। সে তো সেদিন ভেবেছিল রায়ানকে দ্বিতীয়বারের মতো হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু মীরাক্কেল ঘটে যায়! রায়ানের সেদিন শ্বাস কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হলেও পরবর্তীতে সে আবার শ্বাস নেয়। এরপর ২ মাস কোমায় থেকে রায়ান একেবারে সুস্থ হয়৷ রায়ান সুস্থ হবার কিছুদিনের মধ্যেই তারা দুজনে বাংলাদেশে ফিরে আসে। আর তখন থেকেই তাদের বিয়ের কথা পাকা হয়। আজ অবশেষে সেই শুভদিন এসেই গেল। যেদিন তাদের চার হাত এক হবে।
~~~~~~~~~~
অনুরাধা ও প্রভার কিছু কাজিন মিলে রায়ানকে গেটে আটকে রেখেছে। রায়ান তাদের সকলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”বলো তোমাদের দাবি কি?”
অনুরাধা বলে,”বেশি না দুলা ভাই। মাত্র ১০ লাখ টাকা দিলেই আমরা গেট ছেড়ে দেব।”
সৌভিক ছিল রায়ানের পাশেই৷ সে বিষম খেয়ে বলে,”এটা একটু বেশিই হয়ে গেল না? এত টাকা তোমরা কি করবে? আমার বন্ধুটার উপর একটু দয়া কর।”
অনুরাধা বলে,”কোন দয়ামায়া হবে না। তোমার বন্ধু এই ১২ বছর ধরে আমার বান্ধবীকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই ওকে তো এত সহজে যেতে দেওয়া যাবে না। সেই তুলনায় ১০ লাখ টাকা তো কমই হয়ে গেছে। আমাদের তো ১ কোটি টাকা চাওয়া উচিৎ ছিল।”
রায়ান কোন কথা না বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকার চেক তাদের হাতে তুলে দেয় এবং বলে,”প্রভার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। আর অপেক্ষা করতে চাইছি না। তাই তোমরা যত তাড়াতাড়ি গেট ছাড়বে ততোই ভালো।”
প্রভার খালাতো বোন মশকরা করে বলে,”বোঝাই যাচ্ছে আমাদের হবু দুলাভাই প্রভার বিরহে একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই তোরা জলদি গেট খুলে দে। নাহলে এই বিরহের জ্বালায় উনি না আবার পুড়ে যান।”
রায়ান এসে বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়৷ কিছু সময়ের মধ্যে প্রভাকেও নিয়ে আসা হয়। প্রভাকে বধূবেশে দেখে রায়ান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। প্রভার দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারে না। সৌভিক তার পিছন থেকে হালকা কেশে বলে ওঠে,”দেখার আরো অনেক সময় পাবি। আপাতত বিয়েটায় মন দে।”
রায়ান তবুও প্রভার দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারছিল না। বড্ড বেহায়া হয়ে উঠেছে যেন।
রায়ান ও প্রভাকে মুখোমুখি বসিয়ে তাদের সামনে একটা পর্দা রাখা হয়। আয়নায় তারা একে অপরের মুখ দেখে৷ কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করেন।
“৫ কোটি মোহরানা ধার্য করে মোহাম্মদ রুহুল আমিনের সুযোগ পুত্র আব্দুল্লাহ রায়ানের সাথে আকরাম খানের সুযোগ্যা কন্যা প্রভা খানের বিয়ে ঠিক করা হলো। মা, এবার তুমি কবুল বলো।”
প্রভা কিছুটা সময় নিয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
রায়ানকে কবুল বলতে বললে সে অবশ্য সময় নেয় না। তড়িঘড়ি করে বলে,”জ্বি, কবুল।”
বিয়ে পড়ানো সম্পন্ন হয়। সবাই একে অপরের সাথে কোলাকুলি করতে থাকে। রায়ান এবার পর্দা সরিয়ে প্রভার দিকে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,”অপেক্ষার পালা শেষ! এবার আমাদের মিলনের প্রহর ঘনিয়ে আসছে।”
প্রভার বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছিল। প্রজ্ঞা বেগম এসে নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। আকরাম খান নিজের স্ত্রীকে সামলে বলেন,”এমন করো না প্রজ্ঞা। মেয়েটা তো অনেক কষ্ট পাচ্ছে।”
এরপর তিনি রায়ানের হাতে প্রভাকে তুলে দিয়ে বলেন,”আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা। ও জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। ওর ১২ টা বছর অনেক কষ্টে কেটেছে। বাকি জীবনটা ওকে সুখে রেখো।”
রায়ান প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলে,”আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়েকে আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখব।”
এই বলে প্রভাকে নিয়ে রওনা দেয় রায়ান। প্রভা নিজের মা-বাবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও গাড়িতে উঠে কান্নায় ভেঙে পড়ে। রায়ান তাকে সামলে বলে,”তুমি একদম কাঁদবে না প্রভা। এতদিন তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ। আজকের কান্নাই যেন তোমার জীবনের শেষ কান্না হয়। আর কখনো যেন আমি তোমার চোখে জল না দেখি।”
~~~~~
প্রভা ও রায়ান রায়ানদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হতেই রুহুল আমিন বরণ ডালা নিয়ে আসেন। তিনি হেসে বলেন,”আজ আমি নাহয় একটু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাই। সাধারণত ছেলের মায়েরাই নতুন বউকে বরণ করে ঘরে তোলে। কিন্তু রায়ানের মা তো বেঁচে নেই। তাই আমিই আমার ছেলের বউকে আমার ঘরের বউকে বরণ করে ঘরে তুলি।”
এই বলে তিনি প্রভাকে বরণ করে ঘরে তোলেন। রুহুল আমিনের বোন রাহেলা খাতুন প্রভাকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেন। তিনি প্রভাকে বলেন,”অনেকদিন বাড়িতে খুশির আমেজ তৈরি হলো। আশা করি তোমরা অনেক সুখী হবে।”
♪♪
কথায় আছে, “অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকায়ে যায়”
আজ যেন এই কথার বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পেল রায়ান। সে এখন তাদের বাসর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সৌভিকের নেতৃত্বে রায়ানের আরো কিছু বন্ধুবান্ধব দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তাদের একটাই দাবি ২০ লাখ টাকা না দিয়ে রায়ান কিছুতেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। বিশেষ করে সৌভিক একরোখা। তার স্ত্রী অনুরাধা সৌভিকের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করে নিয়েছে তাই নিজের মুখ রাখতে তাকে ২০ লাখ নিতেই হবে। রায়ান আর কোন উপায় না পেয়ে সৌভিকের দাবি মেনে নিয়ে ২০ লাখ টাকা দিয়ে তবেই বাসর ঘরে প্রবেশ করে।
প্রভা তখন ঘোমটা মাথায় বসে ছিল। রায়ান প্রভার কাছে গিয়ে তার ঘোমটা তোলে। প্রভার দিকে কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে রায়ান। প্রভা বলে,”কি দেখছেন এভাবে?”
“দেখছি এক রাজকন্যাকে। যে আমার ঘরে রাণী হয়ে এসেছে।”
প্রভা মৃদু হাসে। রায়ান প্রভার গাল আলতো করে ছুঁয়ে বলে,”তোমাকে যে আবার নিজের করে পাবো সে আশা আমি করিনি প্রভা। আসলেই আমি কতো বোকা ছিলাম। আমার বোকামোর জন্য তোমাকে কতোটাই না সাফার করতে হয়েছে! আমি কেন বুঝলাম না তুমি আবিরকে নয় আমায় ভালোবাসো।”
প্রভা বলে,”আজ আমাদের জীবনে অনেক স্মরণীয় একটি দিন। আজ আমরা তিক্ত অতীতের কথা মনে না করি। বরং গড়ে তুলি সুন্দর ভবিষ্যৎ।”
প্রভার কথা শুনে রায়ান অনেক খুশি হয়। আলতো করে তার কপালে চুমু খায়। অত:পর ধীরে ধীরে প্রভার আরো নিকট হতে থাকে। অবশেষে বহু প্রতীক্ষার পর তাদের দুটি দেহ ও মনের মিলন সম্পন্ন হয়। যেখান থেকে তৈরি হতে চলেছে।
to be continue…