একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
378

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_24(Bonus)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রভা নিজের কেবিনে বসে রকস্টার রিহানকে নিয়েই ভাবছিল। কাল দ্বিতীয় বার লোকটার মুখোমুখি হওয়ার পর এবং তার বলা কিছু কথা শোনার পর থেকেই প্রভা ভীষণ দুশ্চিন্তায় ভুগছে। সে জানে না যে এসব কি হচ্ছে এবং কিভাবে হচ্ছে। প্রভার কাছে সবটাই শুধু ধোয়াশা। যেখান থেকে বেরোনোর কোন উপায় সে খুঁজে পাচ্ছে না। প্রভা চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। এমন সময় কারো পায়ের শব্দে সে চোখ মেলে তাকালো। নিজের চোখের সামনে সানা প্রিস্টকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। সামান্য হেসে বললো,”ম্যাডাম আপনি! আসুন ভেতরে আসুন।”

সানা প্রিস্টও হাসি মুখে প্রভার সামনে এসে বললো,”হ্যালো, কেমন আছ?”

“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি হঠাৎ আমআর কেবিনে এলেন? কোন সমস্যা হয়েছে কি?”

“আরে না! তোমার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলতে এলাম।”

“ব্যক্তিগত কথা!”

“হুম। আমার ভাই রিহান প্রিস্টকে তুমি তো কাল দেখলে। তা ওকে তোমার কাছে কেমন লেগেছে?”

প্রভা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,”না..মানে..ভালোই তো”

সানা প্রিস্ট হেসে বলে,”জানো আমার ভাই না একদম পিওর সিঙ্গেল। জীবনে কখনো প্রেমে-টেমে জড়ায় নি। ব্যাপারটা আমার কাছেও অদ্ভুত লাগে। কানাডাতেই ওর জন্ম আর কানাডাতেই ওর বেড়ে ওঠা। যেখানে কানাডায় টিনএজ বয়সেই সবাই ভার্জিনিটি হারায় সেখানে আমার ভাই জীবনে কোনদিন ডেট করেনি। আমার তো আমার ভাইকে নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল। ও বলেছিল ওর মেয়েদের প্রতি কোন ইন্টারেস্ট নেই। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম যে ও গে নাকি। কিন্তু পরে দেখলাম ওর ছেলেদের প্রতিও আগ্রহ নেই। তখন নিশ্চিত হয়েছি কিছুটা। জানো, ও আগে কখনো কোন মেয়ের প্রতিই ইন্টারেস্ট দেখায় নি। কিন্তু কাল পার্টিতে তোমায় দেখার পর তোমার সম্পর্কে আমার কাছে অনেক কিছু জানতে চেয়েছে। আমি তো পুরো হতবাক হয়ে গেছি। এটাই কি আমার ভাই? সত্যিই অবিশ্বাস্য, ঘন্টার পর ঘন্টা ও তোমাকে নিয়েই আমার সাথে কথা বলেছে।”

প্রভা অবাক হয়ে সবকিছু শুনছে। সানা প্রিস্ট হঠাৎ করে বলে ওঠে,”আমার মনে হয় আমার ভাই তোমার উপর ইন্টারেস্টেড। তুমি কিন্তু ওর সাথে ডেট করতে পারো।”

প্রভা বলে,”সরি, এটা সম্ভব নয়। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।”

সানা প্রিস্ট হতাশ হয়ে বলে,”ওহ, কোন ব্যাপার না। সরি, কিছু মনে করো না।”

“আমি কিছু মনে করিনি।”

~~~~~~~
প্রভা হসপিটাল থেকে নিজের ফ্ল্যাটে ফেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। সানা প্রিস্টের বলা কথাগুলোই শুয়ে শুয়ে ভাবছিল সে। তাছাড়া রিহান ছেলেটাও তাকে ভাবাচ্ছে। ছেলেটার গলার স্বরের সাথে রায়ানের এত মিল কেন? আর ও সব সময় নিজের মুখই বা ঢেকে রাখে কেন? কোন প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পায় না প্রভা। বদলে জোটে এক বুক দীর্ঘ শ্বাস। এরই মধ্যে নোটিফিকেশনের টুংটাং আওয়াজ বেজে ওঠে প্রভার ফোনে৷ সে নিজের ফোন হাতে নিতেই দেখতে পায় তার সেই সমস্যা সমাধানকারীর ম্যাসেজ। সামান্য, “Hi” লিখেছে সে।

প্রভা প্রতিত্তোরে লিখে,”এতদিন পর অনলাইনে!”

“হ্যাঁ, আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম।”

“আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই। আমি এখন কানাডায় আছি।”

“সত্যি?” হ্ম

“জ্বি, আপনার সাথে দেখা করতে চাই।”

“দুঃখিত। এটা সম্ভব না। আপনার যদি কোন সমস্যা থাকে তাহলে আমায় বলতে পারেন।”

প্রভা এবার রিহানের কথা মনে করে বলল,”আসলে আমি কানাডায় এসে এমন একজনকে দেখেছি যার সাথে আমার পরিচিত একজনের ভীষণ মিল রয়েছে। কিন্তু আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না যে এই আমার সেই চেনা মানুষটা কিনা।”

“হুহ, বুঝলাম। সমস্যাটা বেশ গভীর। আচ্ছা যার সাথে আপনি আপনার চেনা ব্যক্তির মিল খুঁজে পেয়েছেন তার সাথে কথা বলেন নি?”

“হ্যাঁ,বলেছি।”

“তার সাথে কথা বলে কি মনে হয়েছে? আর সে কি আপনাকে চিনতে পেরেছে?”

“না। সে আমায় চিনতে পারেনি।”

“আপনার মন কি বলছে?”

“আমি কনফিউজড।”

“থাক, এত কনফিউজড থাকতে হবে না। আপনি নিজের কনফিউশান খুব সহজেই দূর করতে পারবেন।”

“কিন্তু কিভাবে আমি নিজের কনফিউশান দূর করব?”

“দেখুন, একটা মানুষকে কিন্তু খুব সহজে চেনা যায়না৷ বিশেষ করে যখন কেউ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। তখন তাকে সঠিক ভাবে চিনতে গেলে আমায় তাদের সাথে মিশে যেতে হয়৷ তাকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই তো বোঝা যাবে সে আপনার পরিচিত কিনা।”

“তাহলে আমার কি করা উচিৎ?”

“আপনার উচিৎ ঐ ব্যক্তিটির সাথে আরো বেশি বেশি সময় কাটানো। তাহলেই আপনি ওনাকে চিনবেন। আপনার মনের সব ধরনের কনফিউশানও দূর হবে।”

“এজন্যই আপনাকে আমার এত ভালো লাগে৷ আমার এমন কোন সমস্যা নেই যার সমাধান আপনার কাছে নেই।”

বিপরীত দিক থেকে আর কোন উত্তর আসে না। প্রভা বুঝতে পারে আর রিপ্লাই আসবেও না৷ তাই সে ফোনটা রেখে দিয়ে বাইরে চলে যায়।

বাইরে এসেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খায় প্রভা। আর তার মুখ ফুটে বের হয়,”সরি।”

তখনই সে নিজের চোখের সামনে রকস্টার রিহানকে দেখতে পায়৷ রকস্টার রিহানকে দেখে সে চুপ করে যায়। রকস্টার রিহান বলে,”হেই, ইনোসেন্ট লেইডি, চোখে দেখতে পান না? এভাবে ধাক্কা খেলেন কেন?”

রিহানের বলা কথা গুলো শুনে প্রভা হারিয়ে যায় ১২ বছর আগের অতীতে। মনে পড়ে যায় রায়ানের সাথেও এভাবে ধাক্কা খেত সে। আর রিহানের বলা ইনোসেন্ট লেইডি ডাকের সাথে রায়ানের বলা সাধাসিধা মেয়ে ডাকেরও মিল খুঁজে পায় সে। প্রভা আর কিছু ভাবতে পারে না। হঠাৎ তার মাথা ঘুরতে থাকে। সে পড়ে যেতে নিতেই রিহান তাকে আগলে নেয়৷ প্রভা রিহানের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”আমার রায়ান!”

প্রভার জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে নিজের রুমে। সানা প্রিস্ট তার মাথার কাছেই বসে আছে। প্রভা উঠে সানার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমি হঠাৎ এখানে কি ভাবে চলে এলাম?”

“তোমার কি হয়েছিল প্রভা? তুমি হঠাৎ কিভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলে? রিহান যখন আমায় ডেকে পাঠালো..”

“আপনার ভাই..”

“ও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়াও, আমি ডাকছি। রিহান ভেতরে এসো।”

রিহান ভেতরে চলে আসে। এসে প্রভাকে বলে,”আপনি এখন কেমন আছেন?”

“ভালো।”

প্রভা সানা ও রিহানকে বসতে বলে। দুজনে বসে পড়ে। দুজনে প্রভার সাথে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা করে। হঠাৎ করে সানা প্রিস্ট বলে ওঠে,”আমার কিছু জরুরি কাজ আছে৷ তোমরা গল্প করো আমি আসছি।”

বলেই সে চলে যায়৷ রিহানও কয়েক পলক চুপ থেকে প্রভাকে বলে,”আপনি নিজের খেয়াল রাখুন৷ আমি আসছি।”

বলেই রিহান বিদায় নেয়। রিহান চলে যাবার কিছু সময় পরেই প্রভা ফোনের রিংটন শুনতে পায়। ডেস্কের উপর একটা ফোন দেখে সে অবাক হয়। কারণ এটা তার নিজের ফোন নয়৷ ফোনটা হাতে তুলে নেয় প্রভা। প্রোফাইল পিকে রিহানের ছবি দেখে সে বুঝতে পারে এটা রিহানের ফোন। হঠাৎ ফোনে এমন একটা জিনিস লক্ষ্য করে যাতে সে চমকে ওঠে৷ কিছুক্ষণ পর রিহান পুনরায় প্রভার রুমে এসে বলে,”আমি বোধহয় আমার ফোনটা রেখে গেছি।”

প্রভার হাতে নিজের ফোন দেখে বেশ ঘাবড়েও যায় সে। প্রভা রিহানের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আর কতদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন আপনি? আমি আপনার ব্যাপারে সব জেনে গেছি। আর আপনি পালিয়ে বেড়াতে পারবেন না।”

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_25
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রভা উঠে বসে রিহানের কাছাকাছি চলে যায়। রিহানের চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অনেক ভয় পেয়ে আছে। প্রভা রিহানের সামনে গিয়ে বলে,”এতদিন কেন সত্যিটা লুকিয়ে রেখেছিলেন আমার কাছে? শেষ পর্যন্ত তো আমি সব জানতেই পারলাম।”

রিহান বুঝতে পারে সে ধরা পড়ে গেছে। তাই আর ভনিতা না করে বলে,”আসলে…”

“আসলে কি? এমনটা আপনি কি করে করতে পারলেন? এতগুলো দিন ধরে আমাকে বোকা বানিয়ে গেলেন! আর সৌভিকদাও আপনার সাথে আছে তাইনা?”

রিহান বলে,”আমি কিছু কারণে সবকিছু গোপন রাখছিলাম। কিন্তু.. ”

“থাক, আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না মিস্টার রিহান। এতদিন ধরে আমার সব সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ মিস্টার সমাধানকারী।”

এই বলে প্রভা রিহানের হাতে তার ফোনটা তুলে দেয়৷ রিহান ফোনটা হাতে নেয়। ফোনটা হাতে নিয়ে সে দেখে ফোনে তার আইডি থেকে সে যে প্রভাকে ম্যাসেজ করে সেটা দেখা যাচ্ছে। হয়তো নোটিফিকেশনের কারণেই প্রভা এটা জানতে পারছে৷ রিহান বলে,”তার মানে ও এটা নিয়েই কথা বলছিল।”

অত:পর সে প্রভাকে বলে,”তার মানে আপনি সেই মেয়ে যাকে আমি সাহায্য করতাম।”

প্রভা অবাক হয়ে বলে,”তার মানে আপনিও এটা জানতেন না। আজকেই প্রথম জানলেন? আমার তো সেটা মনে হচ্ছে না।”

“আমি সত্যিই জানতাম না।”

“সৌভিকের সাথে আপনার কোন যোগাযোগ নেই?”

“এই সৌভিক আবার কে?”

প্রভা হতাশ হলো। সে বুঝতে পারছে না রিহান কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছে না নাকি সব বুঝেও না বোঝার ভান করছে। তাই সে রিহানকে বলে,”আপনি তার মানে সব সত্যিই বলছেন?”

“ইয়েস। আচ্ছা আপনি যে বলেছিলেন যে একজনের সাথে আপনি নিজের খুব চেনা কারো মিল খুঁজে পাচ্ছেন তো সেই একজন কি আমি?”

“হুম।”

“তাহলে পরীক্ষা করে দেখুন আমায়। ”

“আপনাকে বেশি কিছু করতে হবে না৷ শুধু আপনার মুখটা আমায় দেখান৷ তাহলেই সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”

“এত সহজ না ম্যাম! দীর্ঘ ৩ বছর ধরে আমার কোন ফ্যানই আমার মুখ দেখতে পায়নি৷ সেখানে আপনি দুদিনের মেয়ে হয়ে আমায় দেখবেন!”

“তাহলে কিভাবে আমি নিজের কনফিউশান দূর করব?”

“আমি আজ ফ্রি আছি৷ আর আপনিও তো অসুস্থতার জন্য আজ হসপিটালে যান নি। তাই আমি আপনাকে অফার করছি আজ আমার সাথে একটা দিন স্পেন্ড করুন। তাহলেই আপনি সব ডাউট ক্লিয়ার করতে পারবেন।”

প্রভা কিছুক্ষণ ভেবে বলে,”ওকে ডিল।”

রিহান ও প্রভা একসাথে বেরিয়ে পড়ে৷ রিহান নিজের গাড়ি বের করে এবং প্রভাকে তার পাশে বসতে বলে৷ তখন প্রভা আপত্তি জানিয়ে বলে,”আমি আপনার পাশে বসবো না।”

“আমার পাশে না বসলে নিজের কনফিউশান কিভাবে দূর করবেন?”

প্রভা কিছু একটা ভেবে রিহানের পাশে বসে পড়ে। রিহান প্রভাকে সাথে নিয়ে ড্রাইভ করতে শুরু করে। রিহান প্রভাকে জিজ্ঞাসা করে,”বলুন কোথায় যেতে চান?”

“আপনার যেখানে খুশি নিয়ে যান।”

“আচ্ছা। ”

রিহান অনেকক্ষণ ড্রাইভ করে প্রভাকে নিয়ে অটোয়া নদীর তীরে একটা শান্ত পরিবেশে নিয়ে যায়৷ যেখানে খুব একটা জন সমাগম নেই। কারণ রিহান এমন একটা নির্জন পরিবেশই খুঁজছিল। দুজনে নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকে। এই সময় রিহান হঠাৎ করে প্রভার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমি কি আপনার হাতটা ধরতে পারি?”

প্রভা হ্যাঁ বা না কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে রিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিহান সাথে সাথেই বলে,”সবকিছু তো আপনার কনফিউশান দূরের জন্যই।”

“ঠিক আছে ধরুন।”

রিহান প্রভার হাত ধরে অটোয়া নদীর তীর ঘেষে হেটে চলে। অনেক বছর পর সে কোন পুরুষের হাত ধরে হাঁটছে। সর্বশেষ ১২ বছর আগে এভাবে রায়ানের হাত ধরে পার্কে হাঁটছিল সে। আর সেটাই ছিল রায়ানের সাথে তার কাটানো শেষ সময়। কারণ সেদিনই যে রায়ান তাকে চিরতরের জন্য ছেড়ে চলে যায়। প্রভার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে৷ রিহান সেটা লক্ষ্য করে বলে,”আপনি কাঁদছেন কেন প্রভা?”

“একজনের কথা খুব মনে পড়ছে।”

“তাকে খুব ভালোবাসেন বুঝি?”

“কিভাবে বুঝলেন?”

“এই যে তার কথা ভেবে আপনার চোখে জল আসছে।”

“সত্যি ভালোবাসি। তার প্রতি আমার ভালোবাসা এতটাই গভীর যে তাকে হারানোর ১২ বছর পরেও আমি তাকেই ভালোবাসি।”

“হারিয়ে ফেলেছেন মানে?”

প্রভা কিছু বলে না আর৷ চেয়ে থাকে আকাশের দিকে৷ কিছু সময় চুপ থেকে বলে,”এখন যাওয়া যাক!”

রিহান আপত্তি প্রকাশ করে বলে,”না, একটু অপেক্ষা করুন। আরেকটু থাকলেই আমরা সূর্যাস্ত দেখতে পারবো।”

“আমার জীবনের সূর্য তো এমনিই ডুবে গেছে। এখন আর নতুন করে আমায় সূর্যাস্ত দেখতে হবে না।”

এই বলে প্রভা চলে যাচ্ছিল তখন রিহান হঠাৎ করে তার হাত ধরে তাকে আটকে দিয়ে বলে,”কারো জীবনের সূর্য এত দ্রুত অস্ত যায় বা। আমি আপনার জীবনে নতুন করে সানরাইজ নিয়ে আসতে চাই মিস প্রভা।”

প্রভা এবার একটু রাগী স্বরে বলে,”আমার কাউকে লাগবে না কাউকেই না। আমি শুধু আর শুধু আমার রায়ানকেই ভালোবাসি আর আজীবন তাকেই ভালোবাসব।”

“আপনি তো বললেন আপনি নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেছেন।”

“সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। ও আমার সাথে থাকুক বা না থাকুক আমি সবসময় ওকেই ভালোবেসে যাব। আমার ভালোবাসা কখনো বদলাবে না ”

“এসব ডায়লগ সিনেমায় শুনতে ভালো লাগে৷ কিন্তু বাস্তবে আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। আর ১২ বছর আগে তো আপনি টিনেজার ছিলেন। টিনেজার আবেগকে এতো গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।”

“হ্যাঁ, টিনেজার ছিলাম কিন্তু আমার অনুভূতি একদম সত্যি ছিল। যার প্রমাণ আমি আপনাকে দিতে ইচ্ছুক নেই।”

“আচ্ছা, আপনি শান্ত হোন৷ এই বিষয় নিয়ে কথা বা বলি৷ ঐ দেখুন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আমাদের এখানে একটা প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে অটোয়া নদীর তীরে সূর্যাস্তের সময় কোন উইশ করলে সেটা পূরণ হয়। আপনি কোন উইশ করে দেখতে পারেন।”

প্রভা ডুবন্ত সূর্যের পানে চায়। দেখে মনে হচ্ছিল সূর্য অটোয়া নদীতেই ডুবে গেছে। প্রভা সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,”আমি শুধু একটা জিনিসই চাই। আমি নিজের রায়ানকে ফেরত চাই। জানি এটা হয়তো অসম্ভব কিন্তু এটা ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। কিছুই না।”

এই বলে প্রভা স্থান ত্যাগ করে। রিহান তার পিছু পিছু যায়। প্রভা রিহানকে বলে,”সূর্যাস্ত তো হয়ে গেছে। এখন তাহলে যাওয়া যাক!”

“যাচ্ছি। তার আগে আপনি এটা বলুন তো যে আজ সারাদিন আমার সাথে থেকে আপনার কি মনে হলো? আমার সাথে কি আপনার পরিচিত ব্যক্তির কোন মিল খুঁজে পেলেন?”

প্রভা কড়া গলায় বলল,”কোন মিল নেই আপনাদের মধ্যে।”

“আমার সাথে থেকে কি আপনি কিছুই ফিল করেন নি প্রভা?”

“না।”

বলেই প্রভা গাড়িতে উঠে বসে। রিহান অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকায়৷ মলিন হেসে বলে,”তুমি আমায় চিনতে পারলে না প্রভা!”

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_26(ধামাকা)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রভাকে তার ফ্ল্যাটের সামনে নামিয়ে দিয়ে উদাস মনে নিজের বাড়িতে ফিরল রিহান। অত:পর নিজের রুমে এসে উদাস মনে বসে পড়লো বিছানার উপর। নিজের নীল রঙের লেন্স এবং নকল চুলটা খুলে ফেলল। রিহান রূপ ছেড়ে রায়ান রূপে ফিরল সে। কিছুক্ষণ ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিল। প্রভার সাথে আজ কাটানো মুহুর্ত গুলো মনে করে হাসছে। আজকের দিনটা অনেক সুন্দর ছিল। অনেকদিন পর প্রভার সাথে এত সুন্দর সময় কা’টালো। তবে আফসোস এখনো তার প্রভা তাকে চিনলো না। রায়ানের এমন ভাবনার মাঝেই সৌভিক তাকে ফোন করল। রায়ান ফোন রিসিভ করতেই সৌভিক রাগী গলায় বলল,”তুই এমন কেন রে রায়ান?”

“এমন মানে?”

“প্রভাকে এত কষ্ট দিচ্ছিস কেন? মেয়েটা এমনিতেই ১২ বছর অনেক কষ্ট করেছে। এখন তো মেয়েটাকে একটু সুখের মুখ দেখতে দে৷ তুই কোথায় এখন ওকে আগলে রাখবি তা না তুই আরো ওকে বেশি কষ্ট দিচ্ছিস।”

“তুই সব জেনেও এমন কথা বলবি?”

“আমি সব জানি জন্যই তো বলছি রায়ান। তুই আর প্রভার সাথে এই লুকোচুরি খেলা খেলিস না। এবার বন্ধ কর এইসব। মেয়েটাকে এবার আপন করে নে।”

“…”

“একদম চুপ। আর একদম সঠিক সময়ের কথা বলবি না। আমি আবিরের বিরুদ্ধে প্রায় অনেক প্রমাণ একজোট করেছি। আর কিছুদিনের মধ্যেই ওর মুখোশ সবার সামনে খুলে দেব। তুই এখন প্রভার কাছে গিয়ে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ কর।”

“হুম শীঘ্রই সব করব।”

সৌভিক কিছুটা থেমে বলে,”আমাকে এখনো কিন্তু তুই তোর অতীতের ব্যাপারে কিছু বলিস নি। ১২ বছর ধরে কেন তুই মৃত হওয়ার নাটক করছিলি রায়ানা? আমিও তো এতদিন তোকে মৃতই জানতাম। মাত্র ৬ মাস আগে তুই আমার সাথে যোগাযোগ করলি। প্রথম যখন তুই আমাকে ফোন করে জানালি তুই রায়ান আমি তো তখন বিশ্বাসই করতে পারিনি। তারপর যখন তুই ভিডিও কল দিয়ে আমার সাথে কথা বললি তখনই তোকে চিনতে পেরেছি। তুই তখন বললি সবটা গোপন রাখতে৷ আবিরের অপকর্মের ব্যাপারে সব কথা আমায় বললি। তোর কথা মতোই আমি আবিরের আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হলাম। আবিরের বিশ্বাস অর্জন করলাম। কিন্তু এসবের পেছনে আসল রহস্য কি সেটা আমায় বল তো।”

রায়ান এবার ডুব দিলো তার অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোতে।

সেইদিন দূর্ঘটনায় আসলে রায়ান মারা যায়নি। কিন্তু মারাত্মক ভাবে জখম হলো সে। রুহুল আমিন যখন চিকিৎসকের সাথে কথা বলেন তখন তিনি বলেছিলেন রায়ানের চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ পাঠাবে। রুহুল আমিন তখন তাকে জরুরি ভিত্তিতে বিদেশে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন। এদিকে রায়ানের মনে তখন অন্য ভাবনা চলছিল। যেই প্রভাকে সে এত ভালোবাসে সে কিনা তারই প্রাণপ্রিয় বন্ধু আবিরকে ভালোবাসে। এমনকি তার বন্ধু আবিরও প্রভার জন্য তার সাথে ফাইট করল এত সব ধাক্কায় রায়ান অনেক ভেঙে পড়েছিল। তাই সে রুহুল আমিনের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমি বিদেশে যাব কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”

“কি শর্ত?”

“তোমায় সবাইকে জানাতে হবে যে আমি মারা গেছি।”

“রায়ান! এসব কি বলছিস তুই?”

“আমি যেটা বলছি সেটাই করো৷ নাহলে কিন্তু আমি বিদেশে যাব না।”

“রায়ান!!”

এমন সময় ডাক্তার তাকে গোপনে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে,”আপনার ছেলের অবস্থা কিন্তু এখন বেশি ভালো না। যদি ভালো চান তো নিজের ছেলের কথাই শুনুন। নাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে।”

রুহুল আমিন নিজের ছেলেকে খুব ভালোবাসতেন। তাই তিনি ছেলের ভালোর কথা ভেবে রাজি হয়ে যান। যার ফলস্বরূপ ডাক্তার এবং রুহুল আমিন সেসময় মিথ্যা নাটক করেন যে রায়ান মারা গেছে এবং রায়ানকে চিকিৎসার জন্য কানাডায় পাঠানো হয়। সেই সময় সানা প্রিস্টই রায়ানের চিকিৎসা করেছিল। এদিকে রায়ানের মৃত্যুর নাটক সাজানোর জন্য রায়ানের বাবা মিথ্যা বলেন যে তার জানাজা গ্রামে অনুষ্ঠিত হবে এবং সেখানে প্রভা বা অন্য কাউকেই তিনি যেতে দেন না। সেসময় তিনি সবার সাথে রূঢ় ব্যবহার করতে বাধ্য হন।

এদিকে রায়ানের অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। ডাক্তার তো তার বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিল কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে বেঁচে যায়। রুহুল আমিনের মাথায় এসময় সন্তান হারানোর ভয় আরো বেশি জেকে বশে। আর এই জিনিসটারই সুযোগ নেয় রায়ান। সে নিজের বাবাকে অভিনয় চালিয়ে যেতে বাধ্য করে। রায়ান সেইসময় টিনেজার ছিল আর ছোটবেলা থেকে বেশ জেদি হওয়ায় সে ঠিক ভুল বুঝতে পারছিল না। রায়ানের কথাতেই রুহুল আমিন আবিরকে দত্তক নেন এবং তাকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করতে থাকেন। রায়ান এসব কিছু করেছিল শুধুমাত্র প্রভার সুখের জন্য। কারণ সে ভেবেছিল আবির ও প্রভা একে অপরকে ভালোবাসে এবং একসাথে সুখী হতে পারবে। রায়ানও কানাডায় অন্য পরিচয়ে বড় হতে থাকে। সানা প্রিস্টের সাথেও তার সম্পর্ক অনেক ভালো হয়ে যায়। সানা প্রিস্ট রায়ানকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখতে শুরু করে। এভাবে সময় এগিয়ে যেতে থাকে। দীর্ঘ ১১ বছর এভাবেই চলে যায় কিন্তু রায়ান তখনো অব্দি অভিমান করেই দূরে থাকে। এই ১১ বছর কানাডাতেই থেকেছে সে। কখনো বাংলাদেশে ফেরেনি। শুধুমাত্র গোপনে রুহুল আমিনের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। এরপর ১১ বছর পর হঠাৎ একটি ঘটনা তাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। আবিরকে নিয়ে অনেক নিউজই তার সামনে আসছিল। কিন্তু আবির এমপি হওয়ার পর থেকে তার করা বিভিন্ন ভয়ানক অপরাধের খবর পায় রায়ান। সেসময় তার সন্দেহ হয়। রায়ানের সাথে কানাডায় বাংলাদেশের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার দেখা হয়েছিল এর মাঝে। তার মাধ্যমে রায়ান আবিরের উপর নজরদারি করায় এবং এর ফলে তার হাতে আবিরের সম্পর্কে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। আবির যে পুরো চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে সেটা জানা যায়। বাংলাদেশের প্রশাসন অনেক দূর্নীতিগ্রস্থ এবং আবিরের সাথে অনেক উচ্চপদস্থ নেতার যোগাযোগ আছে। তাই এত সহজে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে না এটা রায়ান সহজেই বুঝে গেছিল। এমনকি সে কিছু করতে গেলে আবির যে রুহুল আমিন ও প্রভার ক্ষতি করতেও দুবার ভাববে না এটাও বুঝে যায় রায়ান। তাই রায়ান তখন সৌভিকের সাথে যোগাযোগ করে। অত:পর সৌভিকের মাধ্যমেই আবিরের উপর নজরদারি করতে থাকে। সেই সময়ই রায়ান সৌভিকের মাধ্যমেই জানতে পারে প্রভা আসলে আবিরকে নয় তাকেই ভালোবাসে৷ এটা জেনে রায়ানের অনেক আফসোস হতে থাকে। রায়ান নিজেও বুঝতে পারে যেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার জন্য রায়ানই পরোক্ষভাবে দায়ী। সে যদি এসব নাটক করে দূরে না থাকত তাহলে আবিরও আজ এই ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করতে পারত না। আর না প্রভাকে এত কষ্ট পেতে হত। এইসব কারণেই রায়ান আজো প্রভার মুখোমুখি হতে ভয় পায়। কারণ সে যে প্রভার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে না। প্রভার কাছে যে সে অপরাধী। শুধুমাত্র তার ভুল বোঝার জন্যই প্রভাকে এই ১২ বছর যে কত কষ্টে পার করতে হয়েছে সেটা রায়ান জানে।

এসব ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে রায়ান বলে,”আমি প্রভার সামনে কিভাবে নিজের আসল পরিচয় নিয়ে দাঁড়াবো সৌভিক?”

“তুই এত ভাবিস না। আজ নাহয় কাল তোকে ওর সামনে যেতেই হবে। তাই আর দেরি করিস না রায়ান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রভাকে নিজের আসল পরিচয় জানা। এই রিহান হওয়ার নাটক বন্ধ কর।”

রায়ান বলে,”তুই ঠিক বলেছিস। আমি এবার রায়ান হয়েই প্রভার মুখোমুখি হবো। প্রভাকে নিজের সব কথা জানাবো। এই ১২ বছর অনেক কষ্ট পেয়েছে সাধাসিধা মেয়েটা। আমি ওকে আর কষ্ট পেতে দেবো না।”

বলেই রায়ান ফোন রেখে উঠে দাঁড়ায়। নিজের ঘরের দরজা খুলতেই চমকে যায় সে। কারণ প্রভা ঠিক তার দরজায় দাঁড়িয়ে। প্রভার চোখ অশ্রুতে টলোমলো করছে। প্রভা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,”আপনাকে আমায় আর কিছু বলতে হবে না রায়ান। আমি আপনাকে চিনতে পেরে গেছি।”

to be continue…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে