একই সুরে প্রেম আমায় কাঁদায় পর্ব-৬২ এবং শেষ পর্ব

0
469

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Last_Part
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী ও সমুদ্রের জীবনে আরো কয়েকটি বসন্ত এসেছে। সময়ের পরিক্রমায় ৩ টি বছর অতিক্রম করেছে। সমুদ্র নিজের ব্যবসায় উন্নতি করেছে। আগের অভাব অনটন তাদের আর নেই। বরঞ্চ বেশ স্বচ্ছল জীবন যাপন করছে তারা। তাদের দাম্পত্য জীবনও সুখে-আনন্দে ভড়ে উঠেছে। প্রণালী এখন একজন উকিল। কয়েকটা কেসও লড়েছে এবং সাফল্যও পেয়েছে। তবে প্রণালী এখন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। খুব শীঘ্রই তাদের জীবনে আসতে চলেছে নতুন অতিথি। তাই আপাতত কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়েছে সে। এই নিয়ে তাদের খুশির অন্ত নেই। আজ রায়ান সাহেব এবং প্রত্যুষ এসেছে তাদের দুজনের সাথে দেখা করতে। প্রত্যুষকে দেখেই সমুদ্র ঠাট্টা করে বলে,”বাহ, ডাক্তার সাহেব যে। এত ব্যস্ততার মধ্যে আপনার চরণ যে আমার বাসায় পড়েছে এতেই আমি খুশি।”

প্রত্যুষ লাজুক হাসে। সে এখনো আগের মতোই চাপা স্বভাবের৷ খুব একটা কথা বলে না৷ পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস জন্য বাইরে তেমন একটা বেরোয় না। তাছাড়া সামনে তার সেমিস্টার ফাইনাল এক্সাম। এজন্য আরো খাটতে হচ্ছে। তবে আজ সে এসেছে প্রণালীর অনুরোধে। প্রণালী গতকাল রাতে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছে। বলেছে তার নাকি এখন ভয় হচ্ছে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে তার কিছু হয়ে যায়৷ এজন্য বাপ-ভাইকে দেখতে চায়। প্রত্যুষ তো ছোটবেলা থেকে মায়ের ভালোবাসা পায়নি। প্রণালী তাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে। তাই বোনের মুখে এমন কথা শুনে ঘাবড়ে গেছে। কয়েকটা কথাও শুনিয়ে দিয়েছিল। তারপর আজ সে এখানে।

প্রত্যুষ সমুদ্রের সাথে সালাম বিনিময় করে জানতে চায়,”আপি কোথায় জিজু? ওকে কোথাও দেখছি না।”

প্রণালী নিজের পেট সামলে ধীরে ধীরে আসে। প্রত্যুষকে দেখে ভীষণ খুশি হয়। কতদিন পর নিজের ভাইটাকে দেখল। প্রত্যুষ সোজা গিয়ে প্রণালীকে জড়িয়ে ধরল। বলল,”তুমি ঠিক আছো তো আপি? কাল রাতে তোমার কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম। তাই, রেগে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম। কিছু মনে করো না প্লিজ।”

“ধুর পাগল! আমি তো জানি আমার এই শান্তশিষ্ট ভদ্র ভাইটা আমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে। সেজন্যই তো এমন রিয়্যাক্ট করছিল।”

দুই ভাইবোন নিজের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। রায়ান সাহেব ও সমুদ্র তাদের নিজেদের মতো কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় বসে আলাপ করতে থাকে। কেউ নেই দেখে প্রণালী প্রত্যুষকে বলে,”তো বল তোর কি খবর! কোন গার্লফ্রেন্ড হয়েছে?”

“আপি! তুমিও না! এসব কি যে বলো। গার্লফ্রেন্ড তাও আমার। এটা কি সম্ভব?”

“হুম, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমার এই এত হ্যান্ডসাম ভাইটাকে কোন মেয়ে পছন্দ করে না এমনটা তো হতে পারে না!”

“পছন্দ তো করে। অনেকে তো প্রপোজও করেছিল। কিন্তু আমি পাত্তা দেই নি। নিজের সমস্ত ফোকাস আমি পড়াশোনায় রাখতে চাই।”

প্রণালী ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”আচ্ছা, ভাই আমার। ভালো করে পড়। তোকে একজন বেস্ট ডাক্তার হিসেবে দেখতে চাই।”

~~~~~~~
রায়ান সাহেব সমুদ্রের সাথে আলাপের একপর্যায়ে বলে ওঠে,”তোমাকে একটা কথা৷ বলব। যদি কিছু মনে না করো?”

“জ্বি, বলুন। আমি কিছু মনে করবো না।”

“তুমি একবার নিজের মায়ের সাথে কথা বলো। ৩ বছর ধরে তুমি ওনার সাথে কথা বলো না। আমি যতদূর জানি উনি এখন ভীষণ অসুস্থ। আমি মানছি, তিনি অনেক ভুল করেছেন জীবনে। কিন্তু মানুষের জীবনে তো এমন অনেক ভুল থাকে। এই তিন বছরে তো উনি তার প্রায়চিত্ত করেছেন যথেষ্ট।”

“কিন্তু..”

“তুমি সবটা বিবেচনা করে দেখো বাবা। নিজের বাবাকে হারিয়েছ, মা এখনো আছে। তার করা ভুলগুলো ভুলে গিয়ে আপন করে নাও। নাহলে মাকে হারানোর পর আফসোস করতে হবে।”

সমুদ্র সায় জানালো। এবার সে ঠিক করল পুষ্পা চৌধুরীর সাথে দেখা করবে।

~~~~~~~
অনেকদিন পর চৌধুরী ম্যানশনে এসেছে সমুদ্র। তাকে দেখে পুষ্পা চৌধুরী ভীষণ খুশি হয়েছেন। প্রথমে তো তিনি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেন নি। তবে পরে যখনই বুঝেছেন সমুদ্র সত্যি এসেছেন তখন তিনি আহ্লাদে আটখানা।

সমুদ্র পুষ্পা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে,”কেমন আছেন আপনি?”

“এতদিন ভালো ছিলাম না বাবাই। কিন্তু আজ তোমায় দেখে আমি ভীষণ খুশি।”

সমুদ্র ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে পুষ্পা চৌধুরীকে। আগের আভিজাত্য আর নেই তার মাঝে। গায়ে সাধারণ সাদা সুতি শাড়ি, শরীরও অনেক শুকিয়ে গেছে তার। চোখের নিচে কালশিটে। সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস শ্বাস ফেলে বলে,”নিজের যত্ন নেন না একদম?”

পুষ্পা চৌধুরী মলিন হেসে বলে,”কার জন্য নিজের যত্ন নেব? আমার কোন আপনজনই যে আমার কাছে নেই।”

“নিজের দোষেই তাদের হারিয়েছেন।”

“এখন ভীষণ পস্তাচ্ছি।”

সমুদ্র বলে,”আজ আমায় একটা সত্যি কথা বলবেন? আমার দাদা কেন তার সমস্ত সম্পত্তি আপনার নামে লিখে দিয়েছিলেন? এই সত্যটা আমি জানতে চাই।”

পুষ্পা চৌধুরীর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়।
“কিছু কথা না জানাই ভালো।”

“কিন্তু আমি জানতে চাই। বলুন আমায়।”

পু্ষ্পা চৌধুরী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”তোমার বাবা আমার সাথে বিয়েতে রাজি ছিলেন না। তিনি একটা গরীব পরিবারের মেয়েকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তোমার দাদা নিজের আভিজাত্য রক্ষায় এমনটা চান নি। তাই তিনি একপ্রকার জোর করে আমার সাথে ওনার বিয়ে দেন। কারণ আমার বাবা এক ধনী লোক ছিলেন। বিয়ের আগে আমি এসব ব্যাপারে অবগত ছিলাম না। কিন্তু বাসর রাতে জানতে পারি উনি আমায় না অন্য কাউকে ভালোবাসেন। সেদিন ভীষণ কষ্ট হয়েছিল আমার। উনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় মেয়েদের গায়ে ডিভোর্সি ট্যাগ অনেক ভয়ানক ছিল। তাই আমি দাঁতে দাঁত চেপে সংসার করতে থাকি। কিন্তু তোমার বাবা ঐ মেয়েকে ভুলতে পারে নি। বিয়ে পরেও তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যায়। যাকে সহজ ভাষায় বলে পরকীয়া। আমি এসব না পারছিলাম মানতে আর না সইতে। এইসময় তোমার দাদা তোমাকে বাবাকে শায়েস্তা করতে তার সব সম্পত্তি আমার নামে করে দেন। এরপর তোমার বাবা রেগে ঐ মেয়ের সাথে পালিয়ে যেতে চায়। সেই সময় তোমার দাদা বুদ্ধি করে নিজের এক ভরসাযোগ্য কর্মচারীর ছেলের সাথে ঐ মেয়ের বিয়ে দিয়ে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। তোমার বাবা এসব কিছু জানত না। তার কাছে মনে হয়, তার প্রেমিকা তাকে ঠকিয়েছে। এই সময় কাছাকাছি আসি আমি আর তোমার বাবা। কিন্তু তার উপর একটা রাগ আমার থেকেই গিয়েছিল। কারণ সে নিজের প্রেমিকাকে পুরোপুরি ভুলতে পারে নি। এই রাগ থেকে ধীরে ধীরে আমার মাঝে ক্ষোভ বাড়তে থাকে তার প্রতি। তুমি হওয়ার পর এবং তোমার দাদার মৃত্যুর পর সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু আমি হই। তখন আমার মধ্যে আগের সব ঘটনার জন্য প্রতিশোধ স্পৃহা জন্ম নেয়। সেইজন্য আমি তোমার বাবাকে কোনঠাসা করে দেই। আর তোমাকে নিজের মতো মানুষ করি। ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয়ে উঠি। প্রণালীকেও আমি ঠিক এই কারণে মেনে নিতে পারিনি কারণ ও তোমার বাবার পছন্দ করা মেয়ে।”

~~~~
সব সত্য জানার পর সমুদ্র নিজের মায়ের প্রতি নরম হয়। এরমধ্যে আরো কিছু দিন চলে যায়। প্রণালীর কোল আলো করে একটা পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পুষ্পা চৌধুরী নিজের নাতিকে পেয়ে ভীষণ খুশি। প্রণালীকেও এখন তিনি মন থেকে মেনে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভালো। প্রণালী যে একটা নতুন মা পেয়েছে। পুষ্পা চৌধুরীকে তো সবসময় মা বলেই ডাকে। পুষ্পা চৌধুরী সমুদ্রকে ব্যবসার দায়ভার তুলে দিয়ে এখন নিজের নাতির সাথেই অবসর সময় কাটান। রায়ান সাহেবও ভীষণ খুশি নাতির আগমনে। প্রত্যুষও মামা হতে পেরে আনন্দিত।

~~~~~
পরিশিষ্ট
প্রণালী নিজের ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ প্রণালীকে জড়িয়ে ধরে। প্রণালীর কাধে মাথা রেখে সমুদ্র বলে,”ভীষণ ভালো লাগছে। নড়ো না প্লিজ।”

প্রণালী মুচকি হেসে বলে “ঠিক আছে।

সমুদ্র প্রণালীকে আচমকা নিজের কাছে টেনে নেয়। প্রণালীর অধরে স্পর্শ করে বলে,”এতো ভালো লাগে কেন তোমায়?”

প্রণালী বলে,”জানি না।

সমুদ্র হেসে ফেলে। দুজন একসাথে পূর্ণিমার চাঁদ দেখছিল। সমুদ্র হেসে বলে,”এই চাঁদটা তোমার থেকে সুন্দর নয়।”

প্রণালী প্রাণখুলে হেসে বলে,”আমায় এতো ভালোবাসো কেন তুমি? আমার প্রেম তোমায় অনেক কাঁদিয়েছে। তবুও প্রেম যেন বেড়েই চলেছে।

সমুদ্র প্রণালীকে জড়িয়ে ধরে বলে,”প্রেম কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়। আমাকেও কাঁদিয়েছে। তবে তার থেকে বেশি আনন্দ দিয়েছে। প্রেম সম্পর্কিত একটা বিখ্যাত গান আছে শোনো নি?”

“না, কি গান?”

সমুদ্র গাইতে থাকে,
“যদি বারে বারে একই সুরে প্রেম আমায় কাঁদায়
তবে প্রেমিকা কোথায় আর প্রেমই বা কোথায়
যদি দিশেহারা ইশারাতে প্রেমই ডেকে যায়
তবে ইশারা কোথায় আর আশারা কোথায়
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত্ত নিরুপায়।”

বলেই প্রণালীকে কাছে টেনে গভীর চুম্বনে আবৃষ্ট করে। রাত সাক্ষী হয় দুই কপোত কপোতীর পবিত্র প্রেমের।

~The End

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে