#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_42(Bonus)
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রণালীকে বিদায় দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রায়ান সাহেব। প্রত্যুষ তাকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করে। যেখানে তার নিজেরই বোনকে বিদায় দিয়ে একদমই ভালো লাগছিল না। ভীষণ কাঁদছিল সবাই।
এদিকে প্রণালী গাড়িতে বসে ছিল৷ তারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে কিন্তু সে কাঁদতে পারছে না। কারণ শান্ত নামক ঠকবাজের কাছে ঠকে যাবার পর সে প্রতিজ্ঞা করেছে জীবনে আর কোন পরিস্থিতিতেই চোখের জল ফেলবে না। জীবনে যাই ঘটুক, সেটাকে আর পাত্তা দেবে না। জীবন তাকে যেখানে ভেসে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবে। আর সর্বোপরি জীবনে আর কখনো কারো প্রেমে পড়বে না। কারণ ভালোবাসা শব্দটার উপর থেকে তার বিশ্বাস চিরতরে উঠে গেছে। এজন্যই তো এমন একজনকে বিয়ে করেছে যাকে সে ঘৃণা করে। অপ্রিয় হয়েই থাকুক। এমন অপ্রিয় ব্যক্তিরাই বুঝি ভালো। অপ্রিয় ব্যক্তিদের হঠাৎ বদলে যাওয়ার জন্য কাঁদতে হয় না৷ তাদের ব্যবহারেও কষ্ট পেতে হয়না। প্রণালী প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে একই সুরে প্রেমকে সে আর সুযোগ দেবে না তাকে কাঁদানোর। তাই কখনো ভুলেও কারো প্রেমে পড়বে না। প্রণালীর এসব ভাবনার মধ্যেই সমুদ্র হঠাৎ করে বলে ওঠে,”হ্যালো, মাই ওয়াইফ। আমাকে নিজের হাজবেন্ড হিসেবে কেমন লাগছে?”
প্রণালী এক শব্দেই উত্তর দেয়,”জঘন্য।”
“তাহলে বিয়েটা করলে কেন?”
প্রণালী নিরুত্তর। কথা বলতে তার একদম ভালো লাগছে না। এদিকে সমুদ্র প্রণালীর এমন কুল রিয়্যাকশন দেখে রেগে যায়। কোথায় সে ভেবেছিল মেয়েটাকে রাগাবে জব্দ করবে কিন্তু এখান তো মেয়েটাই নিরুত্তাপ থেকে তাকে রাগিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্র প্রণালীকে রাগানোর জন্য বলে,”জানো, আমার না একটা গার্লফ্রেন্ড আছে। আর আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকেই ভালোবাসি। তোমাকে তো বিয়ে করেছি তো শুধু বাবার কথায়।”
“ভালো।”
সমুদ্র এবার আরো রেগে যায়। প্রণালীকে বেশ রেগেই বলে,”এসব জেনেও তুমি কোন রিয়্যাক্ট করছ না কেন? বাই এনি চান্স তুমিও কি কাউকে ভালোবাসো?”
সমুদ্রের কথাটা শুনেই প্রণালীর মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে ওঠে। তাকে হাসতে দেখে সমুদ্র বলে,”তুমি হাসছ কেন?”
“ভালোবাসি শব্দটার উপর আমার বিশ্বাস ভরসা কিছুই নেই। আরো ভালো করে বলতে গেলে ভালোবাসা এই শব্দটাকেই আমি প্রচণ্ডরকম ঘৃণা করি।”
“কেন? কেউ ছ্যাকা-ট্যাকা দিয়েছে নাকি?”
প্রণালী কিছু বলে না। নিশ্চুপ হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্র বুঝতে পারে এই মেয়েটাকে সে এত সহজে জব্দ করতে পারবে না৷ তাই সেও চুপ করে যায়।
…………….
প্রণালী ও সমুদ্রকে বহনকারী গাড়ি এসে পৌঁছে যায় চৌধুরী ম্যানশনের সামনে। সমুদ্র দ্রুত গাড়ি থেকে নামে। নেমেই হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতে যায়। এদিকে বাড়ির সামনেই বরণ ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সায়মা চৌধুরী। তিনি সমুদ্রকে এভাবে একা আসতে দেখে বলেন,”তুই এভাবে একা আসছিস কেন? তোর কোন আক্কেল নেই?”
পিছন থেকে সজল চৌধুরী বলেন,”ঐ ছেলের আক্কেল আর কবে ছিল।”
সমুদ্র অপমানিত বোধ করে গমগম চোখে তার বাবার দিকে তাকায়। সজল চৌধুরী রেগে বলেন,”আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে না থেকে নিজের বউকে নিয়ে এসো ইডিয়েট কোথাকার।”
সমুদ্রও সমান রাগ দেখিয়ে বলে,”তুমি আমাকে বিয়ে করতে বলেছ আমি বিয়ে করেছি। এখন আর আমার থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশা করো না।”
“সমুদ্র! তোমার এত বড় সাহস তুমি আমার মুখের উপর এভাবে বলছ?”
“হ্যাঁ, বলছি। আমাকে আর ডিস্টার্ব করো না তো। আমি অনেক টায়ার্ড এখন ঘুমাতে যাব।”
সমুদ্র চলে যেতে নিতেই সজল চৌধুরী বলে ওঠেন,”এভাবে তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আমাদের চৌধুরী বাড়ির একটা রীতি আছে। আমাদের বাড়িতে নতুন বর-বউকে বরণ করেই ঘরে তোলা হয়৷ দেখছ না, তোমার ফুপি বরণ ডালা হাতে দাঁড়িয়ে?”
সমুদ্র নিজের ফুপির দিকে একবার তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,”তাড়াতাড়ি ঐ মেয়েকে আসতে বলো। আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।”
“ঐ মেয়ে কি? স্ত্রী হয় তোমার?”
সমুদ্র বিড়বিড় করে বলে,”স্ত্রী, মাই ফুট!”
এরমধ্যে প্রণালী গাড়ি থেকে নেমে সেখানে এসে উপস্থিত হয়৷ প্রণালীকে দেখে সায়মা চৌধুরী বরণ ডালা নিয়ে এগিয়ে আসেন। দুজনকে পাশাপাশি দেখে মৃদু হেসে বলেন,”মাশাল্লাহ, কি সুন্দর মানিয়েছে তোমাদের দুজনকে।একদম রাজযোটক। কারো নজর না লাগুক।”
বলেই সায়মা চৌধুরী বরণ করতে উদ্যত হন৷ এমন সময় হঠাৎ কেউ একজন এসে হঠাৎ করে বরণ ডালাটা উলটে ফেলে দেয়। উপস্থিত সবাই চমকে ওঠে। সায়মা চৌধুরী হতবাক হয়ে বলে ওঠেন,”ভাবি তুমি!”
পুষ্পা চৌধুরী রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সজল চৌধুরী এগিয়ে এসে নিজের স্ত্রীকে বলেন,”কি করলে এটা তুমি? আর তোমার না ২ দিন পর ফেরার কথা ছিল।”
পুষ্পা চৌধুরী রেগে যান ভীষণ। কোন কিছু বাধ বিচার না করে সজল চৌধুরীর গালে ঠাস করে থা**প্পড় বসিয়ে দেন। সজল চৌধুরী সবার সামনে এভাবে অপমানিত হয়ে লজ্জায় নুইয়ে পড়েন। সায়মা চৌধুরী চিৎকার করে বলেন,”ভাবি! এটা কি করলে তুমি? ভাইয়ার গালে হাত তুললে?”
পুষ্পা চৌধুরী সায়মার উদ্দেশ্য বলেন,”তুমি চুপ থাকো। ভাইয়ের সংসারে নাক গলাতে লজ্জা করে না? দূর হও এখান থেকে।”
অত:পর পুষ্পা চৌধুরী সজল চৌধুরীর সামনে এসে তার শার্টের কলার চেপে ধরে বলেন,”আমি আরো ২ দিন পর ফিরলে তোমার খুব সুবিধা হতো তাইনা? আমাকে না জানিয়ে আমার ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে! এত সাহস তোমার।”
সজল চৌধুরী পুষ্পা চৌধুরীকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। পুষ্পা চৌধুরী দ্বিগুণ গর্জন দিয়ে বলেন,”ভুলে যেওনা এই চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের সর্বেসর্বা আমি। তুমি আমার অধীনে একজন কর্মচারী মাত্র। কারণ তোমার বাবা এই পুরো চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের দায়িত্ব আমার কাধে দিয়ে গেছেন। আর তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমার ছেলের বিয়ে এভাবে দিলে? হাউ ডেয়ার ইউ?”
প্রণালী অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিল। সে তো বুঝতেই পারছে না তার চোখের সামনে এসব কি হচ্ছে। এদিকে সজল চৌধুরীও চুপ। তার যৌবনে করা একটা ভুলের জন্য তার বাবা তাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেছেন। এমনকি সেই কারণেই তিনি নিজের স্ত্রীর বিরোধিতাও করতে চান না। তার কথা মুখ বুজে মেনে নেন। এমনকি তার সব অপমান। কিন্তু কস্মিনকালেও ভাবেন নি তার স্ত্রী তার সাথে এমন কিছু করবে। নিজের ছেলে-ছেলের বউ সহ এতগুলো মানুষের সামনে তার গায়ে হাত তুলবে!
পুষ্পা চৌধুরী রাগে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিজের বান্ধবীর মেয়ে নিজের ছেলের বউ করবেন বলে ভেবেছিলেন। মেয়েটাকে তার বড্ড পছন্দ। অথচ সজল চৌধুরী এভাবে তার সকল পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলেন। পুষ্পা চৌধুরী ত্রস্ত পায়ে প্রণালীর সামনে গেলেন। এই মেয়েটাকে দেখে এখন তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। তিনি চিৎকার করে বলেন,”তোমাকে আমি ছেলের বউ হিসেবে মানি না। তুমি যেখান থেকে এসেছ সেখানেই ফিরে যাও।”
প্রণালী এমনিতেই বিধ্বস্ত ছিল, অনেক ক্লান্তও। তার উপর পুষ্পা চৌধুরীর এমন গলাবাজি সহ্য হলো না৷ মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল। সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার আগেই সমুদ্র ধরে নিলো। পুষ্পা চৌধুরী এই দৃশ্য দেখে রেগে গিয়ে বললেন,”ছেড়ে দাও এই মেয়েটাকে বাবাই।”
“কিন্তু মম, মেয়েটা তো পড়ে যাবে।”
“আই ডোন্ট কেয়ার বাবাই। আমি যা বলছি তাই করো। নিজের মমের অবাধ্য তো তুমি নও।”
সমুদ্র নিজের মায়ের কথায় প্রণালীকে ছেড়ে দেয়। বিধায় সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে৷ সায়মা চৌধুরী এসে প্রণালীকে আগলে নেয়।
to be continue…
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_43
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রণালীর ঘুম ভাঙলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা নরম বিছানায়৷ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সায়মা চৌধুরী তার সামনে বসে আছে। প্রণালী কাচুমাচু হয়ে বলে,”আপনি এখানে?”
সায়মা চৌধুরী আফসোরের সুরে বলেন,”এটা আমাদের বাড়ির গেস্ট রুম। ভাবি তোমাকে এখানেই থাকতে বলেছে। তিনি কিছুতেই এই বিয়েটা মানবেন না।”
“তিনি কি এই বিয়ের ব্যাপারে জানতেন না?”
“না। ভাইয়া ভাবিকে না জানিয়ে সব ব্যবস্থা করেছে। যাইহোক, তুমি এখানে বিশ্রাম নাও। আমিও এখানেই আছি। কাল সকাল সকাল চলে যাব। ভাবির এত অপমান সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। না জানি তোমাকেও কত অপমান সইতে হবে। ভাইয়ার সবটা বিবেচনা করা দরকার ছিল। ভাইয়া তো জানে ভাবি কেমন। আর ছেলেটাও হয়েছে একদম মায়ের নেওটা। মায়ের কথায় ওঠে আর বসে।”
প্রণালী কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না এসব কথার। তার এমনিতেও এসবে কিছুই যায় আসে না। সে কারো স্ত্রীর মর্যাদাও চায়না। কে তাকে অপমান করল সেটাও প্রণালীকে আর ভাবায় না। শান্তর থেকে পাওয়া আঘাত তাকে এতটাই ভেঙে দিয়েছে যে কোন কিছুই আর গায়ে লাগছে না। প্রণালীর মনে হয়, কেউ যদি তার গলা টিপে মে*রেও ফেলে তাতেও আর তার কিছু যাবে আসবে না। এতটাই অনুভূতি হীন হয়ে পড়েছে মেয়েটা। এজন্যই তো বোধহয় বলে, ভালোবাসা মানুষকে যেমন গড়তে পারে ঠিক সেই একইভাবে ভেঙে মুচড়ে দিতেও পারে!
হঠাৎ করেই গেস্টরুমের দরজায় কেউ ঠকঠক করে আওয়াজ করে। সায়মা চৌধুরী বিরক্ত সুরে প্রণালীকে বলে,”তুমি এখানে বসো। আমি দেখছি কে এসেছে।”
সায়মা চৌধুরী গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পান সজল চৌধুরীকে৷ সজল চৌধুরী প্রণালীকে গেস্টরুমে দেখে বলে ওঠেন,”ও এখানে কি করছে সায়মা? ওর না আজ বাসর রাত। ওর তো সমুদ্রের সাথে থাকার কথা।”
সায়মা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বলেন,”তোমার কি মনে হয় ভাবি ওদের বাসর হতে দেবে? যেখানে উনি এই বিয়েটাই মানতে পারেন নি।”
“এসব বললে তো হবে না সায়মা। ওদের বিয়ে হয়েছে সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না। প্রণালী যেহেতু আইনত ও ধর্মমতে সমুদ্রর স্ত্রী তাই ওদের একসাথেই থাকতে হবে। তুই প্রণালীকে নিয়ে আয়। আমি সবটা ম্যানেজ করছি।”
সায়মা চৌধুরী নিরুপায় হয়ে প্রণালীর কাছে এসে বলেন,”তুমি এসো আমার সাথে। দেখি ভাইয়া কি করতে পারে।”
প্রণালী কোন বাক্যব্যয় না করে উঠে দাঁড়ায়। সায়মা চৌধুরী তাকে নিয়ে যেতে থাকে। সমুদ্রর রুমের সামনে এসে সজল চৌধুরী দরজায় নক করতে থাকেন। সমুদ্র অবশ্য এত তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। সে শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছিল। দরজায় নক করার শব্দে বিরক্ত হয়ে বলে,”আবে কে রে!”
সজল চৌধুরী বলে ওঠেন,”আমি তোমার বাবা সমুদ্র।”
“এত রাতে কি চাই তোমার?”
“দরজাটা খোলো তারপর বলছি।”
সমুদ্র বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে। উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়৷ সজল চৌধুরী বলেন,”তোমার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই? নতুন বউকে গেস্টরুমে রেখে তুমি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ?”
“তো কি করব? মম স্পষ্ট বলে দিয়েছে এই মেয়ের থেকে যেন আমি ডিসটেন্স মেইনটেইন করে চলি। আমি তো মমের অবাধ্য হতে পারবো না।”
সজল চৌধুরী ছেলের কথায় ভীষণ রেগে গিয়ে বলেন,”মেয়েটাকে যখন তুমি বিয়ে করেছ তখন ও তোমার দায়িত্ব। তাই নিজের মায়ের কথায় না নেচে ওর দায়িত্বটা বুঝে নাও। প্রণালী মা, তুমি যাও তোমার স্বামীর রুমে প্রবেশ কর৷ এখন থেকে এই রুমে তোমারও সমান অধিকার।”
সমুদ্র বলে,”নাহ, ও এই রুমে আসবে না। মমের স্পষ্ট নির্দেশ ও যেন আমার ত্রীসীমানায় না থাকে।”
সায়মা চৌধুরী বলেন,”তুই তোর মায়ের কথা শুনে নিজের স্ত্রীর সাথে অবিচার করতে পারিস না। মেয়েটাকে সজ্ঞানে বিয়ে করেছিস তুই।”
সমুদ্র একপলক প্রণালীর দিকে তাকায়। এত কিছু হয়ে গেল তবুও মেয়েটার বিশেষ কোন হেলদোল নেই৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নিজের মতো। যেন তার এসবে কিছু যায় আসে না৷ এসব দেখে তো সমুদ্র ভীষণ চটে গেল। মনে মনে বলল,”এ কি মানুষ নাকি রোবট?”
আর সবার সামনে বলল,”আমি এত কিছু জানি না। মম যতক্ষণ না অনুমতি দিচ্ছে ততক্ষণ ওকে আমি এই রুমে থাকতে দিতে পারব না। আমাকে আর ডিস্টার্ব না করে যাও এখান থেকে।”
সজল চৌধুরী বলেন,”আমি তোমার বাবা, আমার কথাও তোমাকে শুনতে হবে। প্রণালী এই রুমেই থাকবে।”
এরমাঝেই পুষ্পা চৌধুরী সেখানে চলে আসেন। এসেই সমুদ্রের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমার বাবা তো ঠিক বলছে বাবাই। ঐ মেয়েটাকে তুমি বিয়ে করেছ, তোমার রুমে তো ওর অধিকার আছে। ওকে তোমার রুমে থাকতে দাও।”
সমুদ্র চৌধুরী নিজের মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,”মম, তুমি এই কথা বলছ! অথচ তুমিই তো এই মেয়ের থেকে আমায় দূরে থাকতে বলেছিলে। আমি তো তোমার কথামতোই কাজ করছিলাম।”
সজল চৌধুরী বলেন,”যাক! তাহলে তোমার সুমতি হলো।”
তখনই সবাইকে চমকে দিয়ে পুষ্পা চৌধুরী বলে ওঠেন,”ঐ মেয়েটাকে নিজের রুমে থাকতে দিয়ে তুমি আমার রুমে চলে এসো বাবাই। আজ সারা রাত মা-ছেলে গল্প করে কা’টিয়ে দেই।”
সায়মা চৌধুরী বলেন,”এটা তুমি কি বলছ ভাবি? আজ তোমার ছেলের বাসর রাত আর তুমি ওকে নিজের সাথে নিয়ে যাচ্ছ!”
পুষ্পা চৌধুরী রাগী গলায় বলেন,”তোমাকে না বলেছি আমার সংসারে নাক না গলাতে। নিজের নাক সামলে রাখো নাহলে সেটা কে’টে দিতে আমার একটুও হাত কাপবে না।”
এমন অপমানে সায়মা চৌধুরী চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হন। সজল চৌধুরী অনেক সাহস করে স্ত্রীর মুখের উপর বলেন,”তুমি কিন্তু কাজগুলো একদম ঠিক করছ না পুষ্পা। ছেলেটার বিয়ে হয়েছে আর এখনো ওকে আঁচলের তলে রাখতে চাইছ।”
পু্ষ্পা চৌধুরী স্পষ্ট স্বরে বলেন,”এই বিয়ে আমি মানি না। কারণ এই মেয়েকে আমার পছন্দ নয়। আমি আমার ছেলেকে আঁচলের তলেই রাখবো। যেদিন নিজের পছন্দের মেয়েকে ছেলের বউ করে আনব, সেদিন আমি ওর ভার সেই মেয়ের উপর ছেড়ে দেব। তার আগে নয়।”
এই বলে পুষ্পা চৌধুরী সমুদ্রকে বলেন,”বাবাই, তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো আমার রুমে।”
সমুদ্র মায়ের বাধ্য সন্তানের মতো বলে,”তুমি যাও মম, আমি এখনই যাচ্ছি।”
“তাড়াতাড়ি এসো।”
বলেই পু্ষ্পা চৌধুরী তার রুমের দিকে পা বাড়ান। তিনি চলে যাবার পর সমুদ্র নিজের বাবার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”শুনলে তো মম কি বলল? এখন আমাকে যেতে দাও।”
বলেই সে প্রণালীর দিকে একপলক তাকিয়েই চলে যায়। এত কিছুর পরেও প্রণালীর কোন হেলদোল নেই। সজল চৌধুরী প্রণালীর কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”কিছু মনে করো না মা।”
প্রণালী তো আদতে এসব কিছু গায়েই মাখে নি। তাই সে কোন প্রতিক্রিয়াও দেখায় না। সায়মা চৌধুরী বলেন,”এভাবে চুপ থাকলে চলবে না৷ নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে।”
প্রণালী তবুও নিশ্চুপ। একটু পর বলে,”আমি কোথায় থাকব?”
সায়মা চৌধুরী বলেন,”এটা যেহেতু তোমার স্বামীর রুম তাই এখানেই থাক।”
“ওকে।”
বলেই প্রণালী সমুদ্রের রুমের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। এসব লড়াই-টড়াইয়ে তার ইন্টারেস্ট নেই। জীবনে এমনিতেও আর কোন কিছুর পরোয়া করে না। এদিকে সায়মা চৌধুরী সজলকে বলেন,”তুমি কোন ভুল করলে না তো ভাইয়া? এই মেয়ে কিভাবে ভাবিকে জব্দ করবে?”
“সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। মেয়েটা তো অনেক প্রতিবাদী ছিল। হঠাৎ এমন চুপ হয়ে গেল কিভাবে?”
এদিকে প্রণালী ভীষণ ক্লান্ত। শুয়ে পড়তে না পড়তেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
to be continue…
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_44(Bonus)
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রণালী সকালে ঘুম থেকে উঠেই এক নতুন নাটকের সাক্ষী হয়। আর এই নতুন নাটকের নাম বৌভাত। প্রণালীর বৌভাতের জন্য বড় করে উৎসব করতে চাইছেন সজল চৌধুরী। কিন্তু সজল চৌধুরীর সাথে ক্রমান্বয়ে তর্ক করে চলেছেন পুষ্পা চৌধুরী। তিনি যেহেতু এই বিয়েটা মেনে নেন নি তাই কোন রিসেপসনও তিনি মেনে নেবেন না। এই নিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় উঠেছে। সায়মা চৌধুরী প্রণালীর কাছে এসে বলে,”দেখেছ তোমার শাশুড়ীকে? কিরকম ডাইনি মহিলা দেখেছ। এনার সামনে একদম ভেজা বিড়াল হয়ে থাকবে না। নাহলে কামড়ে শেষ করে দেবে। এনার সাথে সমানে সমানে লড়াই করতে হবে। সেইজন্য তোমায় প্রতিবাদ করতে হবে। বুঝলে?”
প্রণালী কিছু বলে না। সে এসব কিছুতে একদমই আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না। তার এই সময় একটু শান্তির দরকার যাতে করে নিজেকে সামলাতে পারে। বদলে ভাগ্যে জুটছে অশান্তি আর অপবাদ। যা তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। প্রণালী যখন এসব ভাবছিল তখনই সমুদ্র পুষ্পা চৌধুরীকে পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলে। যা শুনে আগ্নেয়গিরির মতো লাফানো পুষ্পা চৌধুরী একেবারে শীতল হয়ে যান। ঝগড়া বিবাদ থামিয়ে তিনি আসেন নিজের স্বামীর সামনে। অতঃপর বলেন,”তুমি যদি বৌভাত-টৌভাত করতে চাও, তো করতে পারো। এতে আমার কোন আপত্তি আর নেই।”
এই বলেই তিনি চলে যান। সজল চৌধুরী হঠাৎ নিজের স্ত্রীর এমন ৩৬০° বদলে যাওয়া দেখে ভীষণ অবাক হন। তবে স্বস্তিও খুঁজে পান। যাক, তাহলে একবার যখন রাজি হয়েছে তখন আর ঝামেলা করবে না। এই ভেবেই তিনি সব আয়োজন শুরু করতে হাকডাক শুরু করেন। সায়মা চৌধুরীকেও বলেন,”তুই আমার হাতে-হাতে একটু সাহায্য কর। পুষ্পা রাজি হলেও ও আমায় কোন সাহায্য করবে না। তাই তুই এখন আমার একমাত্র ভরসা।”
“তুমি এক দম চিন্তা করো না ভাইয়া। আমি তো আছি তোমার সাহায্য করাত জন্য। আমি হাতে হাতে তোমার সব কাজে সাহায্য করব।”
এরপর তিনি প্রণালীর কাছে গিয়ে বলেন,”তুমিও তৈরি হয়ে নাও। আমি এখন মেকআপের লোক ডেকে দেব। চৌধুরী বাড়ির বউ বলে কথা। বৌভাতে তো সেরকম ই সাজতে হবে। আর সমুদ্র তুইও তৈরি হয়ে থাকিস।”
বলেই তিনি চলে যান। সবাই চলে যাবার পর সমুদ্র চৌধুরী প্রণালীর দিকে তাকিয়ে শয়তানী হেসে বলে,”আজ আমি এমন চাল দেব যে দেখি তুমি আর কতক্ষণ এমন চুপ করে সব সহ্য করো। আজ তোমার সহ্যক্ষমতারই পরীক্ষা হবে আমার অপ্রিয় স্ত্রী।”
~~~~~~““
বৌভাতের আয়োজনে আজ অবশ্য তেমন কেউ আসে নি৷ যাদেরকে একদম না বললেই নয় তেমন কজনকেই ডেকেছেন সজল চৌধুরী। রায়ান সাহেব প্রত্যুষকে সাথে নিয়ে এসেছেন। এছাড়াও এসেছেন সৌভিক রায় তার পুরো পরিবারকে নিয়ে। রায়ান সাহেব এসেই নিজের মেয়ে প্রণালীর সাথে দেখা করে নেন। মেয়েকে দেখেই জড়িয়ে ধরেন অতি আদরে। মেয়েটার প্রতি ভীষণ মায়া হচ্ছে। মেয়েটার উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তারপর না জানি এখানে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে তার কষ্ট হবে। তাই রায়ান সাহেব মেয়েকে প্রশ্ন করেন,”তুমি ঠিক আছো তো মা?”
প্রণালী স্বাভাবিক ভাবেই বলে,”হুম।”
আর বেশি কিছু বলে না। মেয়েটা ধীরে ধীরে কেমন যেন অনুভূতি শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কোন কিছুতেই কোন রিয়্যাক্ট করছে না। এমন অবস্থায় মেয়েটাকে দেখে তার একদমই ভালো লাগছে না। তিনি চান মেয়েটা আবার আগের মতো হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠুক। তাই তিনি ঠিক করেছেন আজ সমুদ্রর সাথে কথা বলবেন। সমুদ্রকে সব ঘটনা খুলে বলবেন। কারণ তিনি মনে করেন এখন সমুদ্রই পারবে তার মেয়েকে আবার সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে। প্রণালীর সব দুঃখের স্মৃতি মুছে দিয়ে তার মনে নতুন সুখের স্মৃতি তৈরি করতে।
তার এই ভাবনার মধ্যেই তিনি দেখতে পেলেন সজল চৌধুরী এগিয়ে আসছেন তার দিকে। সজল চৌধুরীকে একা দেখে রায়ান সাহেব বলেন,”আপনি একা যে, বেয়ান সাহেবা কোথায়? বিয়ের অনুষ্ঠানেও ওনাকে দেখলাম না। আজও কি উনি আসবেন না?”
“এই তো আমি এসে গেছি।”
বলেই হাসি মুখে সেখানে উপস্থিত হন পুষ্পা চৌধুরী। এসে রায়ান সাহেবের সাথে বেশ ভালো ভাবেই কথা বলতে থাকেন। হাজার হোক সবার সামনে তো তাকে নিজের ভালোমানুষির অভিনয় করতেই হবে। কারণ এখানে যে তাদের বিজনেসের অনেক পার্টনারও আছে। তাদের সামনে নিজের ইমেজ খারাপ করলে চলবে না। তাতে যে লস।
প্রণালী পুষ্পা চৌধুরীর এমন নিখুঁত অভিনয় দেখে অবাক হয়। সবার সামনে কত সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে। রায়ান সাহেবকে তো এমন ভাবে বলছেন যেন সব কিছু স্বাভাবিক। অথচ এই মহিলার কাল যে রূপ সে দেখেছে! কত বড় স্পর্ধা হলে কেউ নিজের স্বামীর গায়ে হাত তোলে। প্রণালী অবশ্য এসবে বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করল না। শান্তর এতদিনের আসল রূপ সে ধরতে পারে নি৷ সেখানে অন্যরাও যে মুখোশের আড়ালে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। যার যা ইচ্ছা করুক, প্রণালীর তাতে কিছু যায় আসে না। সে তো এখন পুরো মরা মানুষের মতোই আছে। যার শুধু দেহটাই জীবিত , মন একদম মরে গেছে। তাই কোন কিছুই তার উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
~~~~~~~
বৌভাত উপলক্ষে আজ একটা পার্টি হোস্ট করা হয়েছে। যেখানে সব কাপলরা ডান্স করছে। এরমধ্যে হঠাৎ করে পুষ্পা চৌধুরী হাতে মাইক নিয়ে সবার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”আজ আমাদের এখানে একজন স্পেশাল গেস্ট আসবে। সে আর কেউ নয়। আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী টিনার মেয়ে টায়রা। টায়রাকে তো আপনাদের সাথে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। সে একজন বৃটিশ-বাংলাদেশী। যে বৃটিনেই বড় হয়েছে এবং সেখানকার একজন বড় ডান্সার। তো সবাই ওয়েলকাম করুন টায়রাকে।”
সবার সামনে এসে উপস্থিত হয় টায়রা৷ তাকে দেখেই সবাই করতালি দেয়। টায়রাকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে যায় সমুদ্র। তারপর বলে,”চলো আমার সাথে ডান্স করো।”
এদিকে সজল চৌধুরী ও সায়মা চৌধুরী দুজনেই অবাক টায়রাকে দেখে। সায়মা চৌধুরী নিজের ভাইকে বলেন,”এই টায়রা পায়রা হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল ভাইয়া? এই টা সেই মেয়েটা না, যার সাথে ভাবি সমুদ্রর বিয়ে দিতে চেয়েছিল?”
“হুম, এটাই তো সেই মেয়ে। কিন্তু এ এখানে কি করছে সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না।”
টায়রা সমুদ্রকে বলে,”হাই, সমুদ্র বেইব। কেমন আছ? আমাকে না বলে এভাবে বিয়ে করে নিলে। আর আমি তোমার আশায় কত সুদর্শন যুবককে রিজেক্ট করলাম। এখন আমার কি হবে?”
“চিন্তা করো না টায়রা সুইটহার্ট। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তুমি অবশ্যই আমাকে পাবে। আগে আমাকে নিজের রিভেঞ্জটা পুরো করতে দাও।”
এরপর দুজনেই কাপল ডান্স করে। যা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে৷ রায়ান সাহেব, প্রত্যুষ, সৌভিক রায় সবাই হতবাক। দুজন ভীষণ ঘনিষ্ঠ ভাবে ডান্স করছিল। পুষ্পা চৌধুরী ভীষণ খুশি। এইজন্যই তো তিনি বৌভাতের জন্য রাজি হয়েছিলেন। এখন তার আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে। সবই তো সমুদ্রের বুদ্ধি।
সমুদ্র টায়রার সাথে ডান্স করতে করতে আড়চোখে প্রণালীকে দেখে। সমুদ্র চৌধুরী ভেবেছিল সবার সামনে এভাবে অন্য রমণীর হাত ধরে ডান্স করলে মেয়েটা নিশ্চয়ই রিয়্যাক্ট করবে। কিন্তু এতো এখনো একদম চুপ। দেখে মনে হচ্ছে কোন কিছুতে ওর বিন্দুমাত্র কোন প্রভাব পড়ছে না।
আর আসলেও প্রণালী সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছে। সমুদ্রের প্রতি তার আলাদা কোন টানই নেই। তাই সে কার সাথে নাচল এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়৷ এই জিনিসটা সমুদ্রকে রাগিয়ে দিলো। এই মেয়েটাকে সে কোনভাবেই জব্দ করতে পারছে না। রেগে ডান্স থামিয়ে টায়রাকে একা রেখে নিজের রুমে চলে গেল সমুদ্র।
to be continue…