#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_36
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রণালী, প্রত্যুষকে নিয়ে আজ সৌভিকদের বাসায় এসেছে রায়ান। সৌভিক, অনুরাধাও এখন ঢাকাতেই থাকে। আজ এখানে আসার অবশ্য একটা রিজনও আছে। আজ সৌভিক অনুরাধার মেয়ে স্নেহার এনগেজমেন্ট। সেই উপলক্ষ্যেই তারা আজ মূলত এখানে এসেছে। প্রণালী তো এসেই স্নেহার সাথে দেখা করতে চলে গেছে। দুজনের মধ্যে বেশ ভালোই সম্পর্ক৷ যদিওবা স্নেহা প্রণালীর চেয়ে বয়সে বড় তবে তাদের সম্পর্কটা একদম বন্ধুর মতোই।
রায়ান আর সৌভিক একে অপরের সাথে গল্পে ব্যস্ত ছিল। প্রত্যুষ একা এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। প্রত্যুষকে একা দেখে তার পাশে আসে অনুরাধা। অনুরাধাকে দেখেই প্রত্যুষ স্মিত হাসে। প্রত্যুষ শুনেছে অনুরাধা তার মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। তাই তো অনুরাধার প্রতি আলাদা টান অনুভব করে। অনুরাধাও প্রত্যু্ষকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তার মনে পড়ে যায় প্রভার কথা। অনুরাধা নিজের চোখের কার্নিশে জমা এক ফোটা অশ্রু মুছে হাসি মুখে প্রত্যুষকে বলে,”তুমি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু খেয়েছ কি? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না। এদিকে এসো আমি তোমাকে খেতে দিচ্ছি।”
প্রত্যুষ কেন জানি অনুরাধাকে মানা করতে পারে না। যদিও তার ক্ষিধে পায়নি তবুও সে বলে,”ঠিক আছে আন্টি।”
অনুরাধা প্রত্যুষকে নিজে খাবার বেড়ে দেয়। প্রত্যুষ বেশ আয়েস করে খেতে থাকে। প্রত্যুষকে তৃপ্তি করে ইলিশ মাছ খেতে দেখে অনুরাধা মুখ ফসকে বলে ফেলে,”প্রভারও ইলিশ মাছ পছন্দ ছিল।”
প্রত্যুষ খাওয়া থামিয়ে অনুরাধার দিকে তাকায়। অনুরাধা বুঝতে পারে সে ভুল সময় ভুল কথা বলে ফেলেছে। তাই বলে,”তুমি খাও, আমি আসছি।”
বলেই সেখান থেকে চলে আসে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সৌভিক ও রায়ানের বিজনেস পার্টনার সজল চৌধুরী সপরিবারে পৌঁছে গেল স্নেহার এনগেজমেন্ট উপলক্ষ্যে। তাকে আসতে দেখেই রায়ান ও সৌভিক এগিয়ে গেলো অভ্যর্থনা জানাতে। সজল চৌধুরীর সাথেই এসেছিল তার একমাত্র ছেলে সমুদ্র চৌধুরী। তাকে দেখে রায়ান হেসে বললেন,”কেমন আছ ইয়াং ম্যান?”
“ভালো আছি, আঙ্কেল। আপনি?”
“আমিও ভালো আছি৷ তোমার ড্যাডের কাছে তোমার ব্যাপারে শুনলাম। কিছুদিন আগেই নাকি তুমি নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরেছ। এবার বাবার ব্যবসায় হাত দাও। উনি আর কতদিন একা সামলাবেন সব?”
সজল চৌধুরী হেসে বললেন,”আমিও ওকে এই কথাই বলি।”
এভাবেই ওনারা কথাবার্তা চালিয়ে যান। এরমধ্যেই সমুদ্রর নজর আটকে যায় কাউকে দেখে। সে ঠিক দেখছে সে? ভালো ভাবে কয়েকবার পরখ করে নিলো। বিড়বিড় করে বলল,”আরে হ্যাঁ, এই মেয়েটাই তো। এর সাথেই তো সেদিন রাস্তায় ঝামেলা হয়েছিল। কিন্তু এ এখানে কি করছে?”
প্রণালী তো নিচে এসেছিল প্রত্যুষের খবর নিতে। ছেলেটা তো এমন গ্যাদারিং একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু নিচে এসেই সবার প্রথম সে সমুদ্রর মুখোমুখি হয়। আর তাতেই পুরাতন স্মৃতি তাজা হয়ে ওঠে। রাগে প্রণালীর হাত নিশপিশ করতে থাকে। সে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই রায়ান এসে প্রণালীকে বললেন,”প্রণালী এই হলো সমুদ্র চৌধুরী। তোমার সজল আঙ্কেলের ছেলে। তোমার মেবি ওকে মনে নেই। ছোট থাকেন দেখেছিলে। ও কিছুদিন আগেই নিউইয়র্ক থেকে এসেছে। আর সমুদ্র ও হলো আমার মেয়ে প্রণালী।”
সমুদ্র মনে মনে বলে,”আই সি। তাহলে এই মেয়েটা রায়ান আঙ্কেলের।”
এদিকে প্রণালীর মাথায় তো আগুন জ্বলছিল। সমুদ্রকে দেখেই তার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। এই স্পয়েল কিডটা কিনা সজল আঙ্কেলের! অথচ সজল আঙ্কেল কত ভালো মানুষ। প্রণালী বুঝতে পারে বিদেশে থেকেই হয়তো এমন স্পয়েল কিড তৈরি হয়েছে। এরইমাঝে সমুদ্র প্রণালীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,”হ্যালো প্রণালী। নাইস ঠু মিট ইউ।”
প্রণালীর তো গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল সমুদ্রর এমন ভালোমানুষি দেখে। আবার খ্যাট খ্যাট করে হাসছে। কিন্তু প্রণালী তো এই ছেলের আসল রূপ জানে। তবে সবার সামনে ভদ্রতা রক্ষার্থে প্রণালী সমুদ্রের সাথে হাত মেলায়।
তবে বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল না। প্রত্যুষকে খোঁজার বাহানায় সেখান থেকে চলো গেলো। সমুদ্রও নিজের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
প্রণালী প্রত্যু্ষকে দেখতে পেল অনুরাধার রুমে। সেখানে বসেই সে অনুরাধার সাথে গল্প করছিল। প্রণালী সেখানে গিয়ে বলে,”আন্টি, স্নেহা দিদি তোমায় ডাকছিল।”
“আচ্ছা, তুমি তোমার ভাইয়ের পাশে বসো। আমি যাই স্নেহার সাথে কথা বলে আসি।”
~~~~~
স্নেহার সাথে শহরের বিখ্যাত ডাক্তার ধ্রুবজ্যোতি রায়ের এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হয়। এরপর আসে খাওয়া দাওয়ার পালা। খাওয়া দাওয়া শেষে সৌভিক রায়ানকে বলেন,”তুই একটু এই দিকে আয় তো। তোর সাথে জরুরি কথা আছে।”
রায়ান সৌভিকের সাথে চলে যায় একটু দূরে। বলেন,”হ্যাঁ, বল। আমায় কি বলার জন্য ডাকলি?”
“আসলে এসব কথা তোকে আমি আগেই বলতে চেয়েছিলাম তারপর ভাবলাম অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পরই বলব। তুই আমায় আবিরের স্ত্রী সন্তানের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলছিলিস না? আমি খোঁজ নিয়েছি।”
রায়ান অস্থির হয়ে বললেন,”খোঁজ নিয়ে কি জানতে পারলি তুই?”
“তুই একটু শান্ত হ। আমি বলছি সব।”
এরপরেই সৌভিক রায়ানকে এক এক করে সব খুলে বলতে লাগল।
“আবিরের স্ত্রী এখন চট্টগ্রামে রয়েছে। তবে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওদের ছেলে এখন ঢাকাতেই রয়েছে। ছেলেটার ছবিও আমার কাছে কাছে। তুই দেখতে পারিস।”
বলেই রায়ানের দিকে একটা ছবি বাড়িয়ে দিলেন সৌভিক। রায়ান ছবিটা দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। হতবাক স্বরে বললেন,”শান্ত!”
সৌভিক বললেন,”তুই এনাকে চিনিস নাকি?”
“এই ছেলেটার নাম শান্ত। ও তো আমার ছেলে প্রত্যুষকে টিউশনি করাতো।”
“কি বলছিস তুই? এই ছেলে তোর ঘর অব্দি পৌঁছে গেছে! রায়ান আমি বলছি তুই ভালো করে এই ছেলের ব্যাপারে খোঁজ লাগা। আমার মনে হচ্ছে এই ছেলের কোন কুমতলব আছে। ভুলে যাস না এটা হলো আবিরের ছেলে। এ নিশ্চয়ই তোর এবং তোর পরিবারের ক্ষতি করতে চাইবে। তুই তোর ছেলে মেয়েকে দেখে রাখিস।”
রায়ান অস্থির হয়ে উঠলেন। এতদিন ধরে নিজের ছেলে-মেয়েদের আগলে রেখেছেন। তবে এবার কি তাদের উপর বিপদের আঁচ পড়তে চলেছে? এমনটা কিছুতেই হতে দেবেন না রায়ান। তার নিজের ছেলে-মেয়েকে আগলে রাখতেই হবে। রায়ানের বেশি চিন্তা হচ্ছে তার মেয়েকে নিয়ে। প্রত্যুষ শান্তশিষ্ট এবং বাধ্য ছেলে। কিন্তু প্রণালী তো হয়েছে একদম জেদি আর চঞ্চল স্বভাবের। তাছাড়া ও আবার বেছে নিয়েছে উকিলের প্রফেশন। সবদিক দিয়েই বিপদ। রায়ান আর কিছু ভাবতে পারলেন না। হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। সৌভিক বলে উঠলেন,”কি হয়েছে রায়ান? তুই ঠিক আছিস তো?”
“একদম ঠিক নেই রে। আমি আর পারবো না। প্রভাকে হারিয়ে এমনিতেই আমি সর্বহারা এখন আমার ছেলে-মেয়েই আমার সব। ওদের কিছু হলে আমার কি হবে? আবির ওর ছেলেকে আমাদের পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে। কয়দিন পর ও নিজেও জেল থেকে ছাড়া পাবে। তখন তো ও হাত ধুয়ে পড়বে আমাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”
“আমি দেখছি ঐ শান্তর ব্যাপারে যদি আরো খোঁজ খবর নেওয়া যায়। তুই শুধু নিজের ছেলে-মেয়ে দুটোর দিকে একটু বাড়তি নজর দে। আর বাকিটা তুই আমার উপরেই ছেড়ে দে ”
“তোর উপরেই সবটা ছেড়ে দিলাম সৌভিক। তুই ছাড়া যে আমার ভরসাযোগ্য কেউ নেই।”
to be continue…
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_37
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রণালী আজ এসেছে শান্তর সাথে দেখা করতে। খুব শীঘ্রই প্রণালীর ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা। তাই প্রণালী চাইছে তার আগেই শান্তর সাথে রায়ানের দেখা করাতে।
শান্তর সাথে পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে প্রণালী। হঠাৎ করে সে বলে ওঠে,”শান্ত, অনেক লুকোচুরি হয়েছে। আর নয়। আমি চাই তুমি এবার বাবার সাথে দেখা করো।”
প্রণালীর মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে ভড়কে ওঠে শান্ত। আমতাআমতা করে বলে,”এত তাড়াহুড়ো না করলেই কি নয়?”
প্রণালী কোন বাঁধাই শুনতে রাজি নয়। এদিকে শান্ত বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করেই বেশ বিভ্রান্ত লাগছে তাকে। অনেক ভেবে চিন্তে শান্ত বলে,”আমি এখনো মানসিক ভাবে প্রস্তুত নই প্রণালী। আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও।”
প্রণালীর রাগ হয় ভীষণ। চাপা কন্ঠে বলে,”আর কতদিন সময় নেমে তুমি? আচ্ছা, যত খুশি টাইম নাও৷ আমি আর কিছু বলবো না।”
বলেই প্রণালী উঠে দাঁড়ায়। শান্তর উপর তার বেশ অভিমান হয়। এইজন্য সে হাটতে শুরু করে দেয় সামনের দিকে। আর শান্ত আসতে থাকে তার পিছন পিছন। এমন সময় হঠাৎ করে তার সামনে এসে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রণালী ভ্রুযুগল কুচকে ফেলে।
সে কিছু বলার আগেই গাড়ি থেকে নেমে আসেন রায়ান। এসেই অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকান প্রণালীর দিকে। প্রণালী রায়ানকে দেখে ভীষণ চমকে যায়। রায়ান হুংকার করে বলেন,”তুমি এখানে কি করছ? আর তোমার সাথে এই ছেলেটা কেন?”
প্রণালী হঠাৎ করে তব্দা খেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো। ভাবল অনেক তো অপেক্ষা করল। আজ যখন সুযোগ এসেই গেছে তখন আর সুযোগটা যেতে দিলে চলবে না। এজন্য সে সিদ্ধান্ত নিলো রায়ানকে শান্তর ব্যাপারে সবটা খুলে বলবে। এদিকে রায়ান রাগ ভড়া দৃষ্টিতে শান্তর দিকে তাকাচ্ছিলেন। ছেলেটাকে দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। কিন্তু এ হলো আবিরের মতো একটা শয়তানের ছেলে। এ ছেলে যে মোটেই ভালো নয় সেটা সহজেই অনুমেয়। তাই রায়ান প্রণালীকে বললেন,”তুমি তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়ো।”
“বাবা…”
“বেশি কথা না বলে যা করছি তাই করো। আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না।”
প্রণালী আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ করে গাড়িতে উঠে বসে। রায়ান শান্তর কাছে গিয়ে বলেন,”তোমার আসল পরিচয় আমি জানতে পেরে গেছি। আর কোনদিন যেন আমি তোমাকে আমার মেয়ে বা আমার পরিবারের কারো পাশে না দেখি। নাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
এই বলে শান্তকে হুমকি দিয়ে তিনি চলে যান। শান্ত নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রায়ান প্রণালীকে নিয়ে চলে যান। প্রণালী চুপ করে বসে ছিল গাড়ির মধ্যে। সে ভেবে নিয়েছে এরপর বাড়িতে গিয়ে যা বলার বলবে। তাই সারা রাস্তায় সে আর কোন কথাই বলল না।
বাড়িতে পৌঁছে গিয়ে রায়ান প্রণালীকে বললেন,”তোমাকে যেন ঐ শান্ত নামের ছেলেটার পাশে আর কোনদিন না দেখি।”
“কেন বাবা?”
“আমি কোন কথা শুনতে চাই না। আমি যা একবার বলেছি সেটাই আমার শেষ কথা।”
“আমার পক্ষে তোমার কথা শোনা সম্ভব নয় বাবা। কারণ….কারণ আমি শান্তকে ভালোবাসি।”
“প্রণালী!!!”
প্রণালী একটুও দমে না গিয়ে বলতে থাকে,”তুমি এমন করছ কেন বাবা? কাউকে ভালোবাসা কি অন্যায়?”
রায়ান উত্তেজিত হয়ে যান। বলেন,”কাউকে ভালোবাসা অন্যায় না। কিন্তু শান্তর মতো ছেলেকে ভালোবাসা অন্যায়।”
“কেন অন্যায় বাবা? শান্ত মধ্যবিত্ত বলে? ওর সাথে আমাদের স্ট্যান্ডার্ড মেলে না জন্য? তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি। ছোট থেকে তো তুমি আমাকে শিখিয়েছ মানুষের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী এসব নিয়ে বৈষম্য না করার জন্য। তুমিই তো শিখিয়েছ, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। তাহলে আজ কেন তুমি আমাকে বলছ শান্তর থেকে দূরে থাকতে? তাহলে সবই কি ছিল তোমার লোক দেখানো কথা?”
“প্রণালী! তোমাকে এখন আমি এত কিছু বলতে পারব না। তুমি শুধু এটাই জেনে রেখো ঐ ছেলের পাশে যেন তোমায় আর না দেখি। নাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
প্রণালী তবুও অদম্য! জেদ দেখিয়ে বলে,”আমি একশোবার শান্তর সাথে গিয়ে দেখা করব। দেখি তুমি কিভাবে আটকাও।”
রায়ান রেগে গিয়ে প্রথমবারের মতো প্রণালীর গায়ে হাত তুলতে যান। যদিও তিনি থেমে যান। তবুও প্রণালী খুব আঘাত পায় এই ঘটনায়। কারণ রায়ান জন্মের পর থেকে আজ অব্দি কখনো তার গায়ে হাত তুলতে চায়নি। এমনকি তার উকিল হওয়া নিয়ে এত বাকবিতণ্ডা হলেও কখনো এমন পরিস্থিতি আসে নি। অথচ আজ! প্রণালী এটা সহ্য করতে পারল না। অশ্রুসিক্ত চোখে দৌড়ে চলে গেল।
রায়ান অসহায় সুরে বলল,”আমার চিন্তাটা যদি তুমি বুঝতে তাহলে এমন করতে না মা। আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। তুমি আর প্রত্যুষ ছাড়া যে আমার কেউ নেই। তাই আমি চাই না। তোমাদের উপর কোন বিপদের ছায়া পড়ুক।”
~~~~~~~~~~~~~~`~~~~~~~~~~~
প্রণালী চুপ করে নিজের রুমে বসে আছে। এমন সময় শান্ত তাকে কল করে। শান্ত ফোন রিসিভ করতেই প্রণালী কাদো কাদো গলায় বলে,”তোমার সন্দেহই ঠিক হয়েছে শান্ত। বাবা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেয়নি।”
শান্ত বেশ নরম গলায় বলে,”তুমি এত চিন্তা করো না। আঙ্কেল যা করছেন তোমার ভালোর জন্যই করছেন। আমি তোমার যোগ্য নই। তোমাকে তো সেটা আগেই বলেছিলাম। তুমি জোর করে সম্পর্কটা করলে।”
“আমি কোন ভুল করিনি শান্ত। তোমার থেকে আমার যোগ্য আর কেউ নেই। আমি যদি বিয়ে করি তাহলে তোমাকেই করব।”
শান্ত মৃদু হেসে বলে,”তাহলে তো এমন পরিস্থিতি আসতে পারে যে আমার আর তোমার পরিবারের মধ্যে তোমায় যেকোন একজনকে বেছে নিতে হবে। তখন তুমি কাকে বেছে নেবে? আমাকে না তোমার পরিবারকে?”
প্রণালী ধন্দে পড়ে যায়। সত্যিই সে তো ভেবে দেখেনি এমন পরিস্থিতিতে কাকে বেছে নেবে। শান্ত বলে,”তুমি তোমার ফ্যামিলিকেই বেছে নিও। কারণ আমি তোমায় সুখী জীবন দিতে পারব না।”
“আমি তোমার সাথে সুখী হতে চাই শান্ত।”
“তাহলে পারবে নিজের পরিবারকে ছেড়ে আমার কাছে আসতে? কি হলো বলো পারবে?”
প্রণালী একটু ভেবে বলে,”পারবো।”
শান্তর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে ফোনটা রেখে দেয়।
~~~~~~~~~~~““““~~~~~~~~~
রায়ান সৌভিকের সাথে আজকের ঘটনাটা নিয়ে কথা বলে। সব শুনে সৌভিক হতবাক হয়ে বলে,”আমি ভাবতেই পারছি না প্রণালীর মতো এত বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে ঐ আবিরের ছেলের ফাদে কিভাবে পড়লো। আমার মনে হয় ছেলেটা প্রণালীর মগজ বেশ ভালো ভাবেই ধোলাই করেছে।”
“কি বলছিস টা কি তুই?”
“আমি তো ভয় পাচ্ছি ঐ ছেলের কথায় প্রভাবিত হয়ে প্রণালী যদি কোন ভুল করে বসে..”
“না। আমি আমার মেয়ের কোন ক্ষতি হতে দেব না। তুই আমায় কোন উপায় বলতে পারবি?”
“একটাই উপায় আছে। ঐ ছেলের কথায় প্রভাবিত হয়ে প্রণালী কোন ভুল করার আগেই প্রণালীর বিয়ে দিতে হবে। তাহলে প্রণালীর দিকে আর ও নজর দিতে পারবে না। আর বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে হবে।”
“কিন্তু এখন এভাবে হঠাৎ করে কিভাবে বিয়ে দেব? একটা ভালো ছেলের খোঁজ তো করতে হবে।”
“আমার কাছে একটা ভালো ছেলের খোঁজ আছে।”
“কে সে?”
“সমুদ্র।”
“মানে? সোহেলের ছেলে?”
“হ্যাঁ। সোহেল বলছিল ওর ছেলের বিয়ে দিতে চায়।”
“আমাকে একটু ভাবার সময় দে।”
“ঠিক আছে। তুই সময় নিয়ে ভাব। সবদিক চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিস।”
to be continue…
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_38
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রণালী নিজের ঘরে মন খারাপ করে বসে ছিল। তার মন মানসিকতা এখন একদম ভালো নেই। ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে। এইরকমই সময় রায়ান প্রবেশ করলেন নিজের মেয়ের রুমে। এসেই প্রণালীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”তুমি নাকি সকাল থেকে কিছু খাও নি? এসব কি নাটক শুরু করেছ?”
প্রণালী কোন কথাই বলে না। রায়ান প্রণালীর পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”আমি তোমার বাবা প্রণালী। আমি কি কখনো তোমার খারাপ চাইতে পারি?”
প্রণালী কাদো কাদো গলায় বলে,”আমি শান্তকে খুব ভালোবাসি বাবা। ওকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারব না।”
“শান্ত ভালো ছেলে নয় মা। তুমি বুঝতে পারছ না কেন? শান্তর বাবা কে তুমি জানো?”
“না, জানি না। আর জানতেও চাইনা। আমি বিয়েটা তো শান্তকে করব। তাহলে ওর বাবার ব্যাপারে জেনে কি করবো?”
“বিয়ে শুধু দুজনের মধ্যে হয়না মা। দুটো পরিবারের মধ্যেও হয়। শান্তর বাবা একজন মারাত্মক অপরাধী। যে অতীতে বারংবার আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে।”
প্রণালী কিছুটা অবাক হয়। তবে শান্তর প্রেমে সে বেশ ভালো ভাবেই ডুবে গেছে। তাই তো সবকিছু কে অবজ্ঞা করে বলে ওঠে,”শান্তর বাবা যেমনই হোক শান্ত খারাপ ছেলে নয়। আমি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ওকে চিনি। ওর মতো ভালো ছেলে আর দুটো হয়না। জানো, ও কোনদিন আমার অনুমতি ব্যতীত আমায় স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। সব সময় আমার ভালো মন্দের খেয়াল রেখেছে। সেই ছেলে কিভাবে খারাপ হয়?”
“তুমি ওর বাবার সম্পর্কে কিছু জানো না জন্যই এমন বলছ।”
“আমি ওর বাবার সম্পর্কে জানি না আর জানতেও চাই না। শান্ত আমাকে আগেই বলেছে ওর বাবা একজন অপরাধী, যিনি জেলের ঘানি টানছেন। ও আমার থেকে কিছু লুকায় নি বাবা। ও নিজেও ওর বাবাকে ঘৃণা করে। আমি সবকিছু জেনে ওর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি। আমি জানি ও কোনদিন আমায় ঠকাবে না। তুমি শুধু একবার রাজি হয়ে যাও বাবা।”
রায়ান রাগী স্বরে বলে,”আমি মরে যাব তবুও তোমার সাথে ঐ শান্তর সম্পর্ক মেনে নেবো না। আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি ঐ শান্ত কিভাবে তোমার ব্রেনওয়াশ করেছে।”
“তুমি ভুল বুঝছ। শান্ত এমন ছেলেই নয়।”
” আমাকে তুমি ঠিক ভুল শেখাতে আসবে না প্রণালী। পৃথিবীটা আমি তোমার থেকে বেশি দেখেছি। আমি যেটা বলেছি সেটাই শেষ কথা, শান্তর সাথে তুমি আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।”
“শান্তকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না বাবা।”
“প্রণালী! তোমার অনেক স্পর্ধা আমি সহ্য করেছি আর নয়! এবার আমি তোমাকে আর কোন সুযোগ দেব না। অনেক অবাধ্যতা করেছ তুমি আর না। আমি খুব শীঘ্রই আমার পছন্দ করা ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেব। আর এটাই আমার শেষ কথা।”
বলেই হনহন করে প্রণালীর রুম থেকে বেরিয়ে যান রায়ান। তিনি যাওয়ার পর প্রণালী নিজের ফোন বের করে। শান্তকে কল দিয়ে বলে,”তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে শান্ত।”
প্রণালীর এমন কথায় শান্ত বলে,”রিলাক্স প্রণালী। যা বলার বলো, আমি শুনছি।”
“আমার মনে হয় বাবা আমাদের সম্পর্কটা কোনদিনও মানবে না। উনি তো আমার সাথে অন্য কারো বিয়ে দিতে চাইছেন।”
শান্ত বলে,”আমার মনে হয় তোমার বাবার কথাই তোমার শোনা উচিৎ।”
“এসব তুমি কি বলছ শান্ত? তোমায় আমি কতটা ভালোবাসি তুমি জানো না?”
“আমি জানি প্রণালী। কিন্তু তোমার বাবাকে দুঃখ দিয়ে তুমি কিছু করো এটা আমি চাই না। তাই আমার মনে হয়, তুমি ওনার কথা শুনলেই ভালো করবে।”
“শান্ত, বাবা তোমাকে ভুল বুঝছে। তোমার বাবার অপরাধের কারণে তোমাকেও খারাপ ভাবছে। এই ধারণা তো ঠিক নয়। তাইনা? বাবার এই ভুল ধারণা বদলানোও সম্ভব না। তাই আমি বলছি কি আমরা বিয়ে করে নেই। বিয়ের পর বাবা যখন আমাদের সুখী দেখবে তখন এমনিতেই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। তখন তিনি এমনিতেই আমাদের এই সম্পর্ক টা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেবেন। প্রেমের সম্পর্ক গুলোতে এমনই তো হয় বলো?”
শান্ত কিছুক্ষণ ভাবে। ভাবার পর বলে,”তুমি আরো ভালো করে ভেবে দেখো প্রণালী। আমি চাই না তুমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে আজীবন পস্তাও।”
“আমি কোন ভুল করছি না শান্ত। আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি রাজি থাকলে খুব শীঘ্রই আমি তোমার হাত ধরে বেরিয়ে যেতে রাজি আছি।”
“ঠিক আছে। তুমি যা চাইছ তাই হবো। তুমি মানসিক ভাবে তৈরি হয়ে নাও। কারণ নিজের পরিবারকে ছেড়ে আসা কিন্তু সহজ নয়।”
“আমি জানি কাজটা সহজ হবে না। কিন্তু কিছু পেতে হলে যে কিছু খোয়াতেই হয় শান্ত। আমি জানি আজ আমি তোমাকে বেছে নিলে একসময় নিজের পরিবারকেও মানাতে পারব। কিন্তু আজ যদি আমি নিজের পরিবারের কথায় তোমাকে ছেড়ে দেই তাহলে আর কখনো তোমায় ফিরে পাব না।”
“আচ্ছা। আমি রাখছি।”
বলেই শান্ত ফোনটা রেখে দেয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সজল চৌধুরীর মুখোমুখি বসে আছেন রায়ান ও সৌভিক। সৌভিকই মূলত প্রণালীর জেদের কথা শুনে রায়ানকে এখানে নিয়ে এসেছেন। এদিকে সজল চৌধুরীও দ্রুত নিজের ছেলের বিয়েটা দিতে চাইছেন।
রায়ান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন,”শুনলাম আপনি নাকি নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইছেন?”
সজল চৌধুরী বলেন,”হ্যাঁ, আসলে আমার ছেলেটা ভীষণ বিগড়ে গেছে যেটা আমি বুঝতে পারছি। এর পেছনে ওর মা মানে আমার স্ত্রী সানিয়ার হাত রয়েছে। ছেলেটাকে এত স্বাধীনতা দিয়েছে যে ছেলেটা গোল্লায় গেছে। এখন আমার মনে হয় ওর স্ত্রীই ওকে ভালো করতে পারবে। কারণ বিয়ে করলে সব ছেলের মধ্যেই একটা দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। কিন্তু আমার স্ত্রী কিছুতেই এই বিয়েটা হতে দেবে না। কারণ সে তার বান্ধবীর মেয়ের সাথে সমুদ্রর বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু মেয়েটা একদম ভালো না। এখন সানিয়া কিছুদিনের জন্য লন্ডন ট্রিপে গেছে। আমি চাই এই সময়ের মধ্যে আমার ছেলের বিয়েটা দিয়ে দিতে। যাতে করে আর সমস্যা না হয়। এজন্য আমি বড় অনুষ্ঠান করব না। শুধুমাত্র কাবিনটা করাতে চাই।”
রায়ান বলেন,”আমিও খুব দ্রুততার সাথে আমার মেয়েটার বিয়ে দিতে চাইছি। আর এখন হাতের কাছে ভালো ছেলে পাওয়া মুশকিল। সমুদ্র আপনার মতো এত ভালো একজন মানুষের ছেলে। সে নিশ্চয়ই ভালোই হবে। তাই আমি চাই সমুদ্রের সাথেই প্রণালীর বিয়েটা দিতে। এখন যদি আপনি রাজি থাকেন তো আমি কথাবার্তা আগাবো।”
“আমি কেন রাজি থাকবো না? প্রণালীকে তো ছোট থেকেই দেখেছি ভীষণ ভালো একটা মেয়ে। আর আপনার সাথে আমার এতদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক এটা আত্নীয়ের সম্পর্কে পরিণত হলে তো আরো ভালো হবে।”
রায়ান ভীষণ খুশি হয়ে যান। অনেকটা নিশ্চিত বোধ করেন। সৌভিক বলেন,”তাহলে আমরা একটা কাজ করি ভালো দিনক্ষণ দেখে বিয়ের কথাটা পাকা করি।”
সজল চৌধুরী বলেন,”আমার স্ত্রী এক সপ্তাহ পর দেশে ফিরবে। তাই আমি চাইছি এক সপ্তাহের মধ্যেই কাবিনটা সেরে রাখতে। তারপর নাহয় সময় বুঝে বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে কেউ তো আর মানা করতে পারবে না।”
সৌভিক রায়ানকে প্রশ্ন করেন,”তোর কি মত?”
“আমি মিস্টার চৌধুরীর সাথে একমত। আমিও চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা হয়ে যাক।”
সজল চৌধুরী বলেন,”আগামী পরশু একটা ভালো ডেট আছে। তাহলে এই দিনই বিয়েটা হয়ে যাক?”
রায়ান সায় সাজান। অত:পর দুজন কোলাকুলি করেন।
to be continue…