#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_1
#ইয়াসমিন_খন্দকার
নিজের হবু বর হিসেবে এলাকার নব নির্বাচিত এমপিকে দেখে চমকে উঠলো প্রভা। চমকে তাকালো নিজের সামনে দাঁড়ানো বলিষ্ঠ দেহী ৩২ বছর বয়সী পুরুষটির দিকে। তার নিজের বয়সও বর্তমানে ৩০ ছুঁইছুঁই। এতদিন নানা কথা বলে নিজের বিয়ে আটকে রেখেছিস সে। কিন্তু এবার! তার বাবা নিশ্চয়ই এবার কোমড় বেঁধে নামবে এই বিয়েটা দেওয়ার জন্য। আর কিছু ভাবতে পারল না প্রভা। চুপচাপ নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। তার বাবা আকরাম খান ভীষণ রেগে গেলেন মেয়ের এমন ব্যবহার দেখে। ধমকে বলে উঠলেন,”তোমাকে এখান থেকে যাওয়ার অনুমতি কে দিয়েছে প্রভা?”
প্রভা থামল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,”আমি কারো অনুমতির পরোয়া করিনা। আমি নিজের ইচ্ছেয় এখানে এসেছিলাম আর নিজের ইচ্ছাতেই যাব।”
আকরাম খান এবার রেগে নিজের স্ত্রী প্রজ্ঞা বেগমের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”মেয়েকে এই শিক্ষাই দিয়েছ? এতগুলো লোকের সামনে নিজের বাবাকে এভাবে বলছে?”
প্রজ্ঞা বেগম চোখ পাকিয়ে তাকালেন প্রভার দিকে। তার বছর ৩০ এর মেয়ে একজন ডাক্তার। স্বাধীনচেতা রমণী। তবে তার মানে এই নয় তাকে শাসন করার হক তার নেই। প্রজ্ঞা বেগমও নিজের মেয়েকে ধমকে বললেন,”বাবার সাথে এমন ভাবে কথা বলছ কেন তুমি? কিছু বলি না জন্য মাথায় উঠে গেছ? ওনারা নিজে তোমায় দেখতে এসেছেন। আর তুমি এভাবে ডেংডেং করে ওনাদের সামনে থেকে চলে যাচ্ছ। ভদ্রতা-সভ্যতা কি সব ভুলে গেছ?”
“না। ভুলিনি। আর ভুলিনি জন্যই এখনো নিজের মেজাজ শান্ত রেখেছি।”
“প্রভা!!”
“আমি যদি আগে জানতাম বাড়িতে তোমরা এমন রঙ্গমঞ্চ তৈরি করবে তাহলে আজকের দিনটা আমি হাসপাতালের করিডোরেই কাঁটিয়ে আসতাম।”
বলেই হনহন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। নবনির্বাচিত এমপি চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করল সবকিছু। তার ধারণাই সঠিক। এই ১২ বছরে কোন কিছুই বদলায় নি। এখনো এই মেয়ে সেই আগের জেদ, রাগ বজায় রেখেছে। তবে মেয়েটা বদলেছে অনেক। নম্র, ভদ্র, চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটার মধ্যে রুঢ়তা এবং উগ্রতার আগমন ঘটেছে। অবশ্য এটা হওয়ারই ছিল।
সে উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর ভদ্র ভাবে আকরাম খানের উদ্দ্যেশ্যে বলল,”আমি তাহলে আজ চলি আঙ্কেল।”
“আমার মেয়ের ব্যবহারে কিছু মনে করো না বাবা। তুমি তো সবটাই জানো।”
“হ্যাঁ, জানি। আর জানি বলেই কিছু মনে করছি না। আপনারা কেউ ওকে জোর করবেন না। আমি ওকে মানানোর চেষ্টা করব।”
“আচ্ছা।”
~~~~~
ঘরে এসেই শাওয়ার নিতে চলে আসল প্রভা। বাথরুমে এসেই বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। ধীরে ধীরে শক্ত খোলস খুলে বেড়িয়ে আসলো সে। প্রভা আহাজারি করে বলতে লাগল,”কেন আল্লাহ কেন? আজ এতগুলো দিন পর কেন আমায় আবার তিক্ত অতীতের মুখোমুখি করালে? আমি তো সব কিছু ভোলার চেষ্টা করছিলাম। আজ আবার সব স্মৃতি তাজা হয়ে গেল। আবারো যেন আমার রাতজাগার অসুখ ফিরে আসবে। আমি আর পারছি না, আর না!”
~~~~
সূর্য উঁকি দিচ্ছে পুবের আকাশে। প্রভা আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লো। অতঃপর গায়ে জড়িয়ে নিল সাদা এপ্রোনটা। এপ্রোন পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজেকে পরখ করে দেখতে লাগল। বয়স তার ৩০ পেরিয়েছে ক’মাস আগে। কিন্তু চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। বড়জোর ২৪-২৫ এর তরুণী লাগে। প্রভা আয়নার সামনে থেকে সরে আসল। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,”এই রূপ যৌবনের কি সত্যি আমার কোন দরকার আছে? কার জন্য এই রূপ, লাবণ্য? আমি কি জন্য বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে?!”
“প্রভা,,”
নিজের মায়ের ডাকে হুশ ফিরল প্রভার। পিছনে ফিরে তাকিয়ে বলল,”কিছু বলবে? আমি এখন বেরোবো।”
“তুমি কি নিজের জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দিবে না?”
প্রভা কিছু বলল না। বলার মতো অবস্থাতে সে ছিলোও না। প্রভাকে চুপ দেখে প্রজ্ঞা বেগম কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,”যা হয়েছে সব ভুলে যাও। আর কত দিন এভাবে একা থাকবি তুই? জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে কি সমস্যা?”
প্রভা বলে উঠল,”অতীতকে ভোলা এত সহজ না, মা। আমি চাইলেও স্মৃতিগুলো তো মুছে যাবে না।”
“জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।”
“কিন্তু আমার জীবন থেকে আছে ১২ বছর আগেই। আমি চাইলেও সেসব ভুলতে পারব না।”
বলেই প্রভা আর এক মুহুর্ত নষ্ট না করে সামনে এগোলো। প্রভা বেরিয়ে যাবার পরই প্রজ্ঞা বেগম কাঙ্খিত নম্বরটিতে। ওদিক থেকে রিসিভ হতেই তিনি বললেন,”প্রভা বেরোলো। আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। তুমি চেষ্টা করে দেখো, যদি তোমার কথা শোনে।”
~~~~
বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর আসতেই প্রভার দেখা হলো নিজের প্রিয় বান্ধবী অনুরাধার সাথে। অনুরাধাকে দেখে একগাল হাসল প্রভা। বলল, “অনু তুই! কেমন আছিস? কতদিন পর বাবার বাড়িতে এলি। শ্বশুর বাড়ি থেকে তো নড়তেই চাস না।”
“আমি তো ভালোই আছি। তুই?”
“আমিও ভালো। তোর মেয়ে তো অনেক বড় হয়েছে রে।”
বলেই অনুরাধার মেয়ের গাল টিপে দিলো।
“হুম, এবার ৩ বছর হলো।”
“ও মনে হয় অনেক শান্তশিষ্ট তাইনা?”
“শান্তশিষ্ট না ছাই! এখন এমন দেখছিস জন্য। বাড়িতে তো আমি আর সৌভিক ওর যন্ত্রণায় বাঁচি না।”
“সৌভিকদা ভালো আছেন?”
“হুম, ভালো।”
“বাহ, তাহলে তো ভালোই। তুই বেশ ভালোই সংসার করছিস।”
“তা তো বটেই। তবে যাই বলি আর তাই বলি, তোকে দেখে এখন কেউ আর বলবে না তুই আমার বান্ধবী। এখনো চেহারা কিরকম ধরে রেখেছিস। বাই দা ওয়ে, তুই কি চিরকুমারী থাকার সিদ্ধান্তে এখনো অটল?”
প্রভার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সে বললো,”থাক এসব কথা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
প্রভা যেতে নিতেই তার হাত চেপে ধরল অনুরাধা। বলল,”বিয়ের কথা উঠতেই কেন এভাবে পালিয়ে যাস?”
“অনু ছাড় আমায়।”
“না, ছাড়বো না। তুই এত জেদি কেন রে? নিজে যা ভালো ভাবিস তাই করিস।”
“আমি তো এমনই।”
“আগে তো এমন ছিলি না? সেই নম্র, ভদ্র, ইনোসেন্ট মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল?”
প্রভা কিছু বলল না। প্রভার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো অনুরাধা। সে ভাবতে লাগল অতীতের কিছু সুন্দর আবার কষ্টের স্মৃতি। একই পাড়ায় বড় হয়ে ওঠা দুই বান্ধবী প্রভা আর অনুরাধা। তাদের দুজনের ধর্ম ভিন্ন। কিন্তু ধর্ম কখনো তাদের বন্ধুত্বে বাধা তৈরি করতে পারে নি। স্কুল, কলেজে তাদের বন্ধুত্ব অটুট থেকেছে। তারপর দুজনের গন্তব্য বদলে গেলেও বন্ধুত্বে ফাটল ধরে নি। কিন্তু কলেজ জীবনের কিছু মর্মান্তিক ঘটনা বদলে দিয়েছে প্রভার জীবন। যা ভাবলে এখনো বুক আঁতকে ওঠে অনুরাধার।
হঠাৎ করেই অনুরাধার চোখে জল চলে আসে। প্রভা অনুরাধার চোখে জল দেখে বলে,”কিরে হঠাৎ এভাবে কাঁদছিস কেন?”
“তুই কিভাবে সব সহ্য করে এত বছর বেঁচে আছিস প্রভা? আমার তো তোর কথা ভাবলেই কান্না পাচ্ছে। ১২ বছর আগে…..”
“অনু প্লিজ! আমায় কাজে যেতে হবে। এখন এসব কিছু মনে করতে চাইছি না৷ দুঃখবিলাস করার আরো সময় পাবো।”
“তোর পুরো জীবনটাই কি দুঃখবিলাস করে কা’টিয়ে দিবি?”
প্রভারও এবার খুব কান্না পেল। কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রেখে বললো,”তা ছাড়া!”
ব্যস, এটুকু বলেই সামনের দিকে রওনা দিলো। প্রভা চলে যাবার পর অনুরাধা ফোন দিল প্রজ্ঞা বেগমকে। হতাশ স্বরে বললো,”সরি আন্টি, আমি পারলাম না। ওকে বোঝানোর সাধ্যি আমার নেই। ওর যায়গায় নিজেকে কল্পনা করলেই আমি আতকে উঠি। সেখানে ওকে কিভাবে বোঝাবো।”
প্রজ্ঞা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন,”জীবন এমন কেন অনুরাধা? আমার মেয়ের জীবনে কি আর শান্তি আসবে না? আমার হাসিখুশি, নম্র, ভদ্র মেয়েটা কি আজীবন এমন কাঠখোট্টা, কঠোর হয়েই থাকবে?”
To be continue…