#এই_ভালো_এই_খারাপ (২৬)
#Jannat_prema
আবদ্ধ ভোরের হাত দুটো ছেড়ে দিলো। নিজের বুকের সাথে ভোরের মাথাটা মিশিয়ে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলো। ভোর চোখ বন্ধ করে আবদ্ধর বুকে মাথা রেখে পিঠ আঁকড়ে ধরেছে। আবদ্ধর মনে হলো, সে যেনো প্রায় অনেকদিন পরে বক্ষস্থলে শান্তি অনুভব করলো। ভোরের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দীর্ঘশ্বাস টেনে ব’লে উঠলো,
” মিস প্রেমার এক্সিডেন্টের দৃশ্যটা যখনই চোখে ভাসে, তখনই আমার বুক কেঁপে উঠে। উনার জায়গায় যদি তখন তুই থাকতি! তখন.. তখন আমার কি হতো ভেবেছিস? পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়তাম আমি। নিঃশ্ব হয়ে যেতাম। তোকে আমি কোনো ভাবে হারাতে চাই না, ভোর পাখি। আমার সবটুকু জুড়ে যে তোর বসবাস। আর কখোনো এমন কিছু করিস না প্লিজ! তোর বেখায়ালিতে আমি অস্থির হই। তের কিছু হলে আমি পাগল হয়ে যাবো। সম্পূর্ণ ভাবে পাগল হয়ে যাবো। ভালোবাসি যে খুব! ”
ভোর নাক টানলো বাচ্চাদের মতো। আবদ্ধর বুকে নাক ডলে বললো,
” তুমিও কি ভাবো প্রেমার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী? ”
আবদ্ধ কপাল বাকালো। এতোক্ষণ সে কাকে কি বুঝালো। ভোরকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে ভোরের দু বাহু চেপে ধরে বললো,
” বাচ্চাদের মতো কথা বলছিস কেনো? এখানে কারো দোষ ছিলো না৷ তোকে বাঁচাতে গিয়ে মিস প্রেমা নিজেই পা্রণ বিসর্জন দিয়েছেন মানে এই না তুই উনার মৃত্যুর জন্য দায়ী৷ মিস প্রেমা নিজেই আমাকে ওটিতে বলে গিয়েছিলেন, আল্লাহ পাক যার হায়াত যতটুকু রেখেছে সে ততদিন বাঁচবে। বাকি সব তো অছিলা। তিনি তোর এতটুকুও দোষ দেয়নি। বরংচ মুছকি হেসে বিদায় নিয়েছেন।”
ভোর অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
” সত্যি প্রেমা এমনটা বলেছে? ”
আবদ্ধ মাথা নাড়লো। যার অর্থ হ্যাঁ। তবুও ভোরের অবচেতন মন মানতে চাইলো না। মাথা নেড়ে বললো,
” তবুও __”
বাকিটুকু বলার অবকাশ পেলো না৷ আবদ্ধ ততক্ষণে ভোরের দু অধরের চুমুতে মনোযোগ দিলো। ভোর লজ্জায় চোখ খিঁচে বন্ধ করে আবদ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো। ভোরের কোমড়ের বাধনটা শক্ত করলো আবদ্ধ। দম বন্ধ হয়ে আসতেই ছেড়ে দিলো৷ ভোরকে পাজাকোলে তুলে রুমে যেতে যেতে বললো,
” তোর ঠোঁটগুলো এতো গোলাপি কেনো? ইচ্ছে হয় ক্ষণে ক্ষণে চুমুর বর্ষণ নামিয়ে দেই। এখন আর কোনো কথা বলবি না। অভিমানে তিন দিন কথা বলিনি দেখে মনে হচ্ছে তিন কোটি বছর তোর সাথে কথা বলিনি। ”
ভোর লজ্জায় রাঙা মুখটা বাকিয়ে বললো,
” উমম! ঢং! অভিমানে উনার পা যেনো মাটিতে পড়ে না। ”
আবদ্ধ বিস্তর হাসি হেসে বললো,
” পড়ে না কে বলেছে৷ এই যে তোকে কোলে নিয়ে রুমে নিয়ে আসলাম। এই তিনদিন অভিমান করে থাকায় কতগুলো আদর মিস গিয়েছে জানিস? প্রায় হাজার খানেক চুমু খাওয়া বাকি। সব কিছু এখন চুকাতে হবে না! আজকে কথা বলার নো চান্স। শুধু রোমান্স চলবে। ”
ভোর লজ্জায় সিঁটিয়ে গেলো। চোখ গরম করে আবদ্ধকে বললো,
” অভদ্র ছেলে কোথাকার! ”
আবদ্ধ ভোরের গলায় মুখ ডুবিয়ে ঘাড়ে কামড় দিয়ে বললো,
” পৃথিবীতে তোদের মেয়েদের কাছে তোদের জামাইরা সব সময় অসভ্যই হয়। বউয়ের সাথে অসভ্যতামি করবো না তো কার সাথে করবো! পরে বলবে জামাই আদর করে না। ”
ভোরের ইচ্ছে করছে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়তে৷ মুখের কোনো লাগাম নেই। ভোর আবদ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
” তবে প্রেমার এতো বড় কৃতজ্ঞটা আমি কখোনো ভুলবো না, আবদ্ধ! খনিকের মাঝে মেয়েটা কেমন মিশে গেলো অন্তরে। ”
আবদ্ধ মাথা তুলে ভোরের চোখের দিকে চাইলো। আবদ্ধর মনে হলো ভোর দিন দিন ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। এই যে ভোরের মায়াবী চোখ দু’টো পানিতে ভরে গেছে। আবদ্ধ পরম আদরে ভোরের চোখ দুটোতে চুমু দিলো৷ কপালে, গালে, নাকে, ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো,
” উনার এতো বড় উপকার আমিও কখোনো ভুলবো না৷ আজকে উনার উছিলায় তুই আমার কাছে। আমার বুকের মাঝে৷ সব সময় দোয়া করবো, উনার পরকাল জীবনটা যেনো সুখের হয়। কিন্তু একটা কথা বলতেই হয়, তুই দিন দিন কেমন ছিঁচকাদুনে হয়ে যাচ্ছিস। ”
আবদ্ধর প্রথম কথাগুলোয় খানিকটা ইমোশনাল হয়ে পড়লেও আবদ্ধর বলা শেষোক্ত কথায় নাক ফুলিয়ে বললো,
” মোটেও আমি ছিঁচকাদুনে হচ্ছি না। ”
” হচ্ছিস তুই! ”
” বল্লাম না হচ্ছি না। ”
” আচ্ছা! তাই? ”
” হুম। ”
” ওলে আমার সোনা বউটা। এদিকে আসো একটু আদর করে দেই। ”
” যাহ! ”
আবদ্ধ হেসে দিলো ভোরের লজ্জায় রাঙা চেহারা দেখে। মুগ্ধ হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিলো পরক্ষণেই ডুবে গেলো ভোরের মাঝে সিক্ত করলো ভালোবাসায়। হাজারো অভিমান শেষে এক হলো দুটো শরীর, দুটো মন। অটুট থাকুক চিরকাল এভাবে।
.
বারান্দায় দাড়িয়ে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগাচ্ছে সকাল। বোনের সাথে সাথে এই তিনদিন তারও অচেনা সেই প্রেমা মেয়েটার জন্য মন খারাপ ছিলো। এখনো যথেষ্ট মন খারাপ লাগছে৷ তার আপুকে বাঁচাতে গিয়ে কিভাবে অকালে চলে গেলো। মেয়েটা তার দুই বছরের সিনিয়র ছিলো। সকাল ভাবলো সময়ের সাথে সাথে সব কিছু আবার সেই আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শুধু হৃদয়ের চিলেকোঠায় থেকে যাবে মানুষের স্মৃতিগুলো। এই তিনদিন আদিল শ’খানেক কল দিলেও সকালের রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না। যার দরুন সে কল রিসিভও করলো না।কলের রিংটোন কানে যেতেই সকাল কপাল কুঁচকে রুমে এসে কলারের নাম দেখে চোখ ছোট ছোট করে তাকলো৷ ” ঝগড়ুটে লোক ইজ কলিং! ”
সকাল ঘড়ির দিকে তাকালো। বারোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি আছে। সকালের ভাবনায় এলো এই লোকটা সব সময় তাকে এমন টাইমে কল দেয় কেনো? সে কি জানে না মানুষ এমন টাইমে ঘুমিয়েও থাকতে পারে। সকাল ফোঁস করে শ্বাস ফেলে দুইবারের সময় কল রিসিভ করলো৷ ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই আদিল চোখ বুঝে বারান্দার দেওয়ালে মাথা ঠেকালো৷ হৃদয়ের হাঁকডাক কমলো৷ সকালকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই ধমকে বলে উঠলো,
” সমস্যা কি তোমার? তিন দিন ধরে কল দিয়েই যাচ্ছি পাগলের মতো রিসিভ করছো না কেনো? ভার্সিটিতেও আসছো না। তুমি কি আমাকে এভয়েড করছো সকাল? বাই এ্যানি চান্স তুমি যদি ভুলেও আমাকে এভয়েড করার ট্রায় করো না! তাহলে তোমার অবস্থা আমি কাহিল করে ছাড়বো। নুবায়ের আদিল কি জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিবো। ”
সকাল হা করে আদিলের সবগুলো কথা শুনলো। তার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না৷ সে কখোন আদিলকে এভয়েড করছিলো? তার ভালো লাগেনি দেখে কল রিসিভ করেনি। সকাল অবুঝের মতোই শুধালো,
” এসব কি বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে আপনার? ”
আদিল গমগমে সুরে বললো,
” হ্যাঁ! এখন তো তোমার কাছে আমাকে পাগল মনে হবেই। সত্যি করে বলো লাইফে কাউকে জুটিয়েছ? আমি তোমাকে আবারো নিষেধ করছি সকাল তোমার লাইফে শুধু তোমার একটাই বয়ফ্রেন্ড থাকবে, আর সেটা হলাম আমি৷ আবার একটাই হাসবেন্ড থাকবে, সেটাও আমি। অন্য কারো দিকে চোখ তুলে তাকালে সেই চোখ জোড়া তুলে মারবেল খেলবো আমি। ”
সকালের প্রচুর বিরক্ত অনুভব হলো৷ এই লোকটার সাথে যবে থেকে দেখা হয়েছে, তবে থেকেই তার লাইফ আর কানটা ত্যানা ত্যানা করে ফেলছে। সারাক্ষণ তার বয়ফ্রেন্ড বলে মজা করে যাচ্ছে৷ সেদিন নাহয় সে সিনিয়রদের কথায় ওই মিথ্যে প্রপোজটা করেছে তাই বলে এটা নিয়ে তাকে এভাবে সব সময় তার গার্লফ্রেন্ড বলে চিল্লাতে হবে! সকাল রাগত্ব স্বরে ব’লে উঠলো,
” দেখুন! একদম বাজে কথা বলে আমার কানের মাথা খাবেন না। ”
আদিল অবাক হলো। মেঝে থেকে উঠে বারান্দার রেলিঙের সাথে ঠেসে দাড়িয়ে অবাক হয়ে বললো,
” আমি আজেবাজে কথা বলছি? ”
” তো আর কে বলবে আপনি ছাড়া। ”
” শুন! আমি মোটেও বাজে কথা বলছি না। ”
” ওহ! তাহলে কি আমি বলছি? ”
” তুমিও বলছো না আর আমিও বলছি না। এখন বলো এই তিনদিন আমার কল রিসিভ করোনি কেনো? ”
” এমনি করিনি। ”
” এমনি মানে? আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড সকালের রানি। আমার কল তোমার রিসিভ করা উচিত ছিলো। ”
সকাল অতিষ্ঠ হলো৷ এবার এই বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড এগুলোর সমাধান করতেই হবে। সকাল নিঃশ্বাস ফেলে ব’লে উঠলো,
” দেখুন, আমরা কেউই একে অপরের বয়ফ্রেন্ড অথবা গার্লফ্রেন্ড না। বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ডরা তো একে অপরকে ভালোবাসে। আমরা কি একে অপরকে ভালোবাসি? বাসি না। না আমি আপনাকে ভালোবাসি আর না আপনি আমাকে ভালোবা__”
” আমি বাসি! আমি তোমাকে ভালোবাসি সকালের রানি। সত্যিকারের ভালোবাসা যাকে বলে, সেই সত্যিকারের ভালোবাসি। ”
সকাল স্তব্ধ হয়ে জমে গেলো। বুকের ভিতর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উত্তালপাতাল করছে৷ কানের ভিতর যেনো তব্দা লেগে গেছে আদিলের কথা শুনে। সকালের মুখের ভাষাটুকু যেনো কোথাও হারিয়ে গেলো৷ আদিল কি বললো এসব! কেনো বললো? নাকি তার সাথে মজা করছে? ফের আদিলের কন্ঠ ভেসে আসলো,
” আমি তোমাকে ভালোবাসি সকালের রানি। ভালোবাসি! ”
চলবে!
#এই_ভালো_এই_খারাপ(২৭)
#Jannat_prema
সকাল থম মেরে বসে আছে খাটের উপর। কপালের বলিরেখায় মৃদু ঘাম জমেছে। বুকের লাব ডাব ক্রমশ লাফাচ্ছে। আগে কখোনো তার এমন অনুভুতি হয়নি৷ এমন অস্থির আগে কখোনো লাগেনি। সকাল চট করে উঠে মিনি টি টেবিল থেকে পানির গ্লাসে বোতল থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে লম্বা শ্বাস ফেললো। তার কল্পনাতেও কখোনো আসেনি আদিল তাকে প্রপোজ করে বসবে। সকাল বুকে হাত রেখেই বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো৷ শেষমেষ কিনা ওই ঝগড়ুটে লোকটা তার প্রেমে পড়েছে৷ যার কাজ ছিলো সারাদিন তার পিছনে লাগা৷ এতোদিন আদিলের বলা কথাগুলো মজা হিসেবে নিয়েছিলো সে৷ কিন্তু এখন বুঝতে পারলো ওই কথাগুলো সত্যি ছিলো। সকালের ইচ্ছে করলো হোহো করে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে৷ মিস্টার নুবায়ের আদিল শেষমেশ ইনায়া হোসেন সকালের প্রেমে পড়েই গেলো৷ সকাল ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে বললো,
” ওহ আদিল মশাই! এবার আপনাকে হাড়ে হাড়ে জ্বালিয়ে ছাড়বো। আমার সাথে ঝগড়া করার শোধ কড়ায় গন্ডায় তুলবো। হিহিহি! ”
অপরদিকে, আদিল কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে হেসে উঠলো৷ মনের কথাগুলো মনের মানুষকে বলতে পেরে যেনো ভিতরটা হালকা লাগছে। অবশেষে সকালের রানিকে বুঝাতে পারলো, সে তাকে ভালোবাসে। এখন অপেক্ষা শুধু নতুন একটা সুন্দর প্রহরের, নতুন এক মিষ্টি অনুভূতির।
আদিল ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখেই বললো,
” আমার প্রথম ভালোবাসা! আমার সকালের রানি! আমার হৃদয়ের রানি! শুধু মাস্টার্সের এক্সামটা শেষ হওয়ার অপেক্ষা। এরপর তোমাকে আমার বাহুডোর রেখে দিবো আজীবনের জন্য। ”
আদিল এলোমেলো ভাবে নিজের ফোনের গ্যালারিতে ঢুকে সকালের হাস্যজ্বল ছবি বের করে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকলো। এই ছবিটা আবদ্ধ আর ভোরের বিয়ের দিনের। যেখানে সকাল তার সবুজের উপর সোনালী রঙের কারুকাজ করা লেহেঙ্গাটা দুহাতে ধরে কার দিকে যেনো তাকিয়ে হাসছিলো। তার কোমড় জুড়ে ছড়িয়ে ছিলো তার মসৃণ চুলগুলো। কপালের দুই পাশে চুলোগুলো ফ্র্যান্স বেণি করা ছিলো৷ আর সে তো তার খয়েরী রঙের লিপস্টিকে লেপ্টে থাকা ঠোঁট জোড়া প্রসস্থ করে হাসছিলো। ঠিক তখনই আদিল থমকে গিয়েছিলে ওই মায়াবী হাসি মুখের মালিকের উপর। নিজ অজান্তেই লুকিয়ে সকালের ছবিটা নিজের মুঠোফোনে ক্যাপচার করে নিলো। আদিল মোবাইলটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে চাইলো সকালকে অনুভব করতে খুব করে। চাইলো সকাল যেনো তার বুকের মাঝে লেপ্টে থাকে। যেখান থেকে সকাল চাইলেও সরতে পারবে না, যতক্ষণ না আদিল নিজের থেকে তাকে ছাড়ছে।
.
নাঈমা নিজের রুমের জানালার ধারে হাটুতে থুতনি রেখে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নারকেল গাছের ডালে বসে থাকা একলা পাখিটার দিকে। পাখিটা এদিক ওদিক তাকিয়ে যেনো কিছু খুজতে লাগলো। নাঈমার অধরে বিষাদের হাসি ফুটে উঠলো। পাখিটাও আজকে তার মতো একা। হয়তো সঙ্গ পাওয়ার জন্য কাউকে চাইছে। সেও তো চাইছে তার পাশে সেই প্রিয় মানুষটাকে। যে সব সময় তাকে কথায় নাজেহাল করে রাখতো। বিরক্ত করে ছাড়তো। এক সময় নাঈমা বিরক্ত হয়ে বলে উঠতো,
” এতো বিরক্ত করছিস কেনো? ”
প্রেমা তখন নাঈমার গাল টেনে বলতো,
” আমি মরে গেলে তোকে আর কেউ বিরক্ত করবে না। ”
নাঈমা তখন রাগ দেখিয়ে চলে যেতো৷ আচমকা নাঈমা ছলছল চোখে হেসে উঠলো। বিরবির করে বলতে লাগলো,
” জানিস প্রেমু! আজ দশ দিন ধরে কেউ আমাকে বিরক্ত করছে না৷ কেউ আমার গাল ধরে টানে না। তোর মতো কেউ আমার রাগ, অভীমান বুঝে না। তোর ধমকগুলোকে মিস করছি অনেক। আর হ্যাঁ সাথে তোর রাগকেও মিস করছি। আজ দশ দিন ধরে আমার কানগুলো বেচঈন হয়ে আছে তোর কন্ঠ শুনার জন্য। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না।”
নাঈমার কন্ঠরোধ হয়ে আসলো। নাক টানলো চোখ মুছলো না৷ ঘাড় বাকিয়ে তাকালো খাটের পাশে থাকা টেবিলের উপর ওয়ালমার্টের দিকে৷ নাঈমার ঝাপসা চোখে ফুটে উঠলো তার আর প্রেমার শাড়ি পড়া হাস্যজ্বল ছবির দিকে। নাঈমার মনে হলো প্রেমার ঠোঁটে ফুটে উঠা হাসিটা প্রাণবন্ত। নাঈমা নিজেও হাসলো। অশ্রুসিক্ত হাসি যাকে বলে।
.
” মিসেস ইনায়াত হোসেন ভোর। আপনি দিন দিন চরম অভদ্রতায় রুপান্তর হচ্ছেন। ”
চুল আঁচড়াতে থাকা ভোর কপাল কুচঁকে ড্রেসিং টেবিলের আয়না থেকে চোখ সরিয়ে খাটের উপর শুয়ে থাকা আবদ্ধর দিকে তাকালো । তার দিকেই নেশালো চোখে তাকিয়ে আছে সে। ভোর দ্রুত চোখ সরালো। আবদ্ধর এমন চাহনি যতবার দেখে ততবার সে লজ্জায় কুঁকড়ে যায়৷ হার্ট বিট বেড়ে যা নিজ অজান্তে। আবদ্ধর চাহনিতে যেনো মাদকতা মিশে আছে৷ আবদ্ধ ভোরকে অন্য দিকে তাকাতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। লজ্জাবতী ভোরকে লজ্জায় ভীষণ আবেদনময়ী লাগে৷ ফুলে যাওয়া লাল গালগুলো কামড়ে দিতে ইচ্ছে করে। যদিও সে মাঝে মাঝে নিজের এই ইচ্ছেটা পূরন করেও ফেলে। তারপরেও মন ভরে না তার। ভোর জানে আবদ্ধ এখন তার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। আবদ্ধ মাথার চুলে ব্যাকব্রাশ করে উঠে বসলো। ভোরের খোলা লম্বা চুলগুলোকে দেখে লোভ জাগলো মনে।প্রবল ইচ্ছে জাগলো মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার।
ভোর লজ্জায় যে আয়নার দিকে তাকিয়েছে আর একবারো আবদ্ধর দিকে নজর রাখলো না৷ লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বিরবির করে বলে উঠলো
” অভদ্র! কিভাবে তাকায় থাকে দেখো! ”
” কি ভাবে তাকায় থাকি? ”
ভোর আচমকা ভয়ে চমকে উঠলো। দ্রুত গতিতে মাথা পিছনে ঘুরিয়ে দেখলো আবদ্ধ ডান ভ্রু উঁচু করে তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। আবদ্ধ হঠাৎ ভোরের দিকে ঝুকে তার দুইপাশ দুই হাত রেখে ফিসফিসানি স্বরে বললো,
” বল কিভাবে তাকিয়ে থাকি। ”
ভোরের পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো। আবদ্ধর ফিসফিস করে কথাগুলো তার হৃদয় কাঁপিয়ে দেয় বারংবার। ভোর ফাঁকা ঢোগ গিলে বললো,
” আ.আমি কি জানি তুমি কি ভাবে তাকাও! ”
আবদ্ধ চট করে ভোরের ঠোঁটে শব্দ করে চুমু খেয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললো,
” নেশালো চোখে তাকাই আমি। তোকে দেখলে আমার দৃষ্টিতে নেশা লেগে যায়। ”
ভোর শীতল চোখে আবদ্ধর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে একবার হাত বুলিয়ে আনমনে হাসলো। আবদ্ধর হুটহাট কাছে এসে ভালোবাসাটা তার ভালো লাগে ভীষণ ভালো লাগে।
.
সিড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় প্রিয়মুখগুলা দেখে ভোর থমকে দাড়িয়ে গেলো৷ সোফায় মিস্টার বাদল সাহেব আর মিস্টার আফিল রহমান, আবদ্ধ বসে বসে হেসে কথা বলছে। নায়েলি বেগমের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে তার মা শ্রাবন্তি আক্তার কথা বলছে। ভোর অবাক চোখে চেয়ে নিচে নামতেই আচমকা সকাল এসে ঝাপটে ধরলো বোনকে। ভোর প্রথমে ঘাবড়ালেও পরক্ষণে হেসে জড়িয়ে ধরলো সকালকে। ইতিমধ্যে সবার মনোযোগ ওদের দুজনের দিকে। ভোর সকালকে জড়িয়ে ধরতে দেখে আবদ্ধ মনে মনে বললো,
” ঠিকই বোনকে কলিজার ভিতর ঢুকিয়ে ফেলছে। অথচ আমাকে জড়িয়ে ধরতে বললে চেহারা এমন লাল করে। আজকে রাতে শুধু তোকে কাছে পাই। তারপর তোকে জড়িয়ে ধরা বুঝাবো। ”
সকাল হেসে মাথা তুলে ভোরের দিকে তাকিয়ে বললো,
” কেমন আছিস, আপু?
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোদের সবাইকে দেখে এখন অনেক বেশি ভালো লাগছে। ”
এরপর বাবা আর মা কে সালাম দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” কেমন আছো বাবা! শরীরের কি অবস্থা? ”
” আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ”
সবার সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পর ভোর গেলো নায়েলি বেগমের সাথে নাস্তার ব্যাবস্থা করতে৷ হুট করে আজকে বাবা মা আসবে সে জানতোই না। ভোর কৌতুহল মনে নায়েলি বেগমকে ব’লে উঠলো,
” আজকে বাবা আর মা আসবে জানতাম না। তুমি জানো ওরা যে আসবে? ”
নায়েলি বেগম বিস্কিটের প্যাকেট ছিড়ার অবস্থায় বললো,
” হ্যাঁ জানতাম তো। ”
ভোর অবাক হ’য়ে বললো,
” আমাকে বলোনি যে, মা! ”
নায়েলি বেগম হাসলেন৷ ভোরের মুখে মা ডাকটা তার ভীষণ ভালো লাগে। উনি চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন,
” এই যে তুই এখন আমার কথা শুনে যেমন চমকেছিস, তোর এই চমকটা দেখার জন্য বলিনি৷ ”
ভোর মুগ্ধ হয়ে শ্বাশুড়ির পানে তাকালো। এরা সবাই তাকে এতো ভালোবাসে কেনো? কেনো এরা সবাই তাকে এতোটা আগলে রাখে৷ ভোর প্রশান্তির শ্বাস ফেলে শ্বাশুড়ির সাথে কাজে মনোযোগ দিলো।
সকাল পা টিপে টিপে আদিলের রুমের সামনে এলো৷ এই লোকটা কি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি৷ সকাল দশটার উপরে বাজছে এখন৷ ভার্সিটি এখন বন্ধ বলে এতোক্ষণ ঘুমাতে হবে। আদিল প্রপোজ করার পরের দিন থেকে সে একবারও ভার্সিটিতে যায়নি। কেমন যেনো লাগছিলো আদিলের মুখোমুখি হবে ভেবে। এর মধ্যে সকালেরও খুব ইচ্ছে করছিলো আদিলকে এক পলক দেখতে৷ তার কথাগুলো শুনতে। অথচ ওই বদমাশ আদিল তাকে প্রপোজ করার পর কল কাটলো সেই কাটাতেই আছে৷ একটাবার তাকেও মেসেজ পর্যন্তও করলো না। আবার আজকে নিচেও তাকে দেখলো না৷ সকালের মনের খচখচানি বেড়ে গেলো আদিলকে দেখার। সকাল নিজের সকল ভাবনা আপাতত বাদ দিয়ে যেই আদিলের দরজায় হাত দিতে যাবে, ওমনি দরজার ভিতর থেকে একটা হাতে তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলো৷
চলবে!