#এই_ভালো_এই_খারাপ(২৪)
#Jannat_prema
চোখ ঝাপটে আবারো চোখ খোলার চেষ্টা করলো প্রেমা৷ মাথার তীব্র আঘাতে বারবার চোখ মুদে আসছে। বুঝতে পারলো তার কপাল গড়িয়ে চোখের উপর দিয়ে তরল পদার্থ টপটপ করে পড়ছে। চোখ পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করে বুঝতে পারলো, কারা যেনো তার দিকে দৌড়ে এগিয়ে আসছে। প্রেমা কিছু বলতে চাইলো। রক্তাক্ত ডান হাতটা উঠানোর শক্তি কুলালো না। তার সব শক্তি যেনো ওই মালবাহী ট্রাকটা নিয়ে গেছে৷ তাকে দিয়ে গেছে প্রচন্ড যন্ত্রণা।
নাঈমা সব কিছু ভুলে ভোরের আগে দৌড়ে এসে প্রেমার রক্তাক্ত মাথাটা নিজের কোলের উপর নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ভোর আর আবদ্ধ ততক্ষণে প্রেমার নিকটে চলে এসেছে। ভোরের হাত পাও অনেকটা ছিলে গেছে । নাঈমা নিজের ওড়না দিয়ে প্রেমার মাথা চেপে ধরে কান্না দমন করে বললো,
” এই প্রেমু! চোখ খোল! চোখ খুলনা, সোনা৷ প্রেমুরে তুই এই রকম করছিস কেনো? আমার ভালো লাগছে না৷ দেখ তোর কত রক্ত বের হচ্ছে! আমার দু হাত ভরে গেছে তোর রক্তে। তোর কিছু হবে না। ”
ভোরের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছে। কাঁপা হাতে প্রেমার হাতের নার্ভ চেক করতেই চমকে উঠলো। আর্তনাদ করে বললো,
” দ্রুত এম্বুল্যান্সকে আসতে বলো। ওর…ওর নানার্ভ খুব ধীধীরে চলছে। ”
আবদ্ধ চমকে উঠলো। দ্রুত এসে প্রেমার হাত ধরে নার্ভ চেক করতেই বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠলো৷ মেয়েটার নার্ভ সত্যি খুব স্লো হয়ে আসছে৷ রক্তে পুরো রাস্তা ভেসে যাচ্ছে। অথচ প্রেমা চোখ ছোট ছোট করে আবদ্ধর ধরে রাখা নিজের হাতের দিকে তাকালো৷ মনে পড়লে সেই প্রথম দিনের কথা। আবদ্ধর সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার সময় ঠিক এভাবে তার হাত ধরে তাকে বাচিয়ে ছিলো সে। তবে সেদিনকার হাতের বাধনটা শক্ত ছিলো৷ আজকের মতে ঢিলে করে ধরেনি। প্রেমা মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করতেই আবদ্ধ প্রেমার গালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে ডাকতে লাগলো,
“মিস, প্রেমা চোখ বন্ধ করবেন না। প্লিজ ওপেন ইওর আইস! মিস প্রেমা! ওহ শিট! তিনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন। দ্রুত উনাকে হসপিটালাইজড করতে হবে। ”
হসপিটালের করিডরে সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছে। অধিক কান্না করায় ভোরের চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। নাঈমা স্থির হয়ে দেওয়ালে হেলে বসে আছে। অথচ তার চোখ দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে। প্রেমার পরিবারের প্রায় সবাই হাসপাতালে হাজির। রিমা সুলতানা মেয়ের বড় সড় এক্সিডেন্টের কথা শুনে একবার জ্ঞান হারালেও জ্ঞান ফেরার পর থেকে অপারেশন থিয়েটারের সামনে মুর্তির মতো বসে আছেন। তাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন নাঈমার আম্মু মিসেস সুমি। উনিও এতোক্ষণ কাঁদছিলেন। অপারেশনের দরজার পাশে দেওয়ালের সাথে মাথা লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছেন প্রেমার বাবা মিস্টার নাসির আহমেদ। প্রেমা তার একটা মাত্র সন্তান। তার কলিজার ধন! আর সেই কলিজার ধন আজকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। ভোর একবার অপারেশন রুমের দরজার দিকে তাকালো।
আবদ্ধও অপারেশন রুমে। সেই যে একবার বলে গেলো, প্রেমার অবস্থা খুব জটিল। ট্রাকের সাথে কানের পাশ দিয়ে মাথায় আঘাত লেগে রাস্তায় পড়ার কারণে মাথার অপজিট পাশটাও ফেটে গেছে। প্রচুর ব্লিডিং হওয়ায় রক্ত প্রয়োজন। কিন্তু রক্ত জোগাড় করে দেওয়ার পর বললো আরেক সমস্যার কথা। প্রেমার শরীরে রক্ত টানতে চাইছে না। বলতে গেলে তার বাচার চান্স হলো বিশ পার্সেন্ট। ভোর দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠলো। তাকে বাঁচাতে গিয়েই তো আজকে মেয়েটার এই দশা। প্রেমার রক্তাক্ত চেহারার সেই মুচকি হাসিটা চোখে ভাসতেই ভোর ভেঙে পড়লো। মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া,করলো ওমন মিষ্টি মেয়েটার যেনো কিছু না হয়। প্রায় তিন ঘন্টা পর আবদ্ধ সহ আরো কয়েকজন সিনিয়র ডক্টর বেরিয়ে আসলো। সবাই এক যোগে এসে দাড়ালো তাদের পাশে। নাঈমা নাক টেনে দু হাতে চোখ মুছে বললো,
” প্রেমু কেমন আছে স্যার? ভালো আছে তো? কিছু বলছেন না কেনো? অপারেশন সাকসেসফুলি হয়েছে তো? ”
ভোর আবদ্ধর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট ভাবে বুঝা যাচ্ছে ওর চোখের কোণে পানি জমেছে। ভোরের বুকটা হঠাৎ অজানা কারণে মুচড়ে উঠলো। মিস্টার নাসির আহমেদ আবদ্ধর ডান হাত মুঠোয় নিয়ে ঢোগ গিলে বললো,
” আমার মেয়েটা কেমন আছে বলো না! কেনো জানি বুকের ভিতরটা হাহাকার করছে। ”
আবদ্ধ একবার ওর পাশে থাকা,সিনিয়র ডক্টরদের দিকে তাকালো৷ তার বুকের ভিতরটা কেমন হাহাকার করে উঠলো৷ এতোগুলা মানুষকে কিভাবে সে সত্যি কথাটা বলবে! আবদ্ধ শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জ্বীভ দিয়ে ভিজিয়ে বললো,
” মিস, প্রেমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি আংকেল! আমাদের বেস্টটা দিয়ে চেষ্টা করেছি উনাকে বাচানোর বাট উনার মাথার আঘাতগুলো এতো জটিল আঘাত ছিলো যে শেষ পর্যন্তও আমরা পারিনি । অতিরিক্ত ব্লিডিং হওয়ায় উনার শরীরের অবস্থা শোচনীয় ছিলো। পরিস্থিতির কোনো কিছুই আমাদের হাতে ছিলো না। উই আ’র এক্সট্রেমলি সরি! ”
রিমা সুলতানা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে ধরতেই উনাকে নাঈমার আম্মু আগলে ধরলেন। মিস্টার নাসির বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন বেঞ্চের উপর। নাঈমা মুখে হাত দিয়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো। আবদ্ধ ভোরের দিকে তাকালো । ভোর অবাক হয়ে আছে। তার মাথার নিউরনগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আবদ্ধ এতোক্ষণ যা বলেছে সব কিছু যেনো কল্পনা লাগছে৷ মিথ্যে মনে হচ্ছে কথাগুলো। নাঈমা হঠাৎ উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো। ফ্লোরে বসে পড়ে কান্না করতে করতে বললো,
” আপনি মিথ্যে বলছেন, স্যার। আমার প্রেমু বেঁচে আছে। ও আমাদের ছেড়ে যেতে পারে না। আমি… আমি জানি ও এখন ভালো আছছে! ও..ও সুস্থ হয়ে যাবে৷ প্রেমুর কিছু হলে আমাকে বকবে কে? ও কার উপর জিদ দেখাবে বলুন তো? প্রেমু না থাকলে কে আমার মন খারাপের কথাগুলো শুনবে, বলুন তো? আমি কিছু জানি না। আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে চাই। ও না থা..থাকলে আমি কার কাঁধে মাথা রেখে শান্তিতে বাদাম খাবো? প্রেমু এভাবে আমাকে একা করে চলে যেতে পারে না। আবদ্ধ স..স্যার প্রেমাকে বলুন আমার সাথে কথা বলতে, ধমকাতে, বকতে, রাগ দেখাতে বলুন না। আমি সব কিছু চুপচাপ শুনবো। ওকে একটা কথাও বলবো না। প্রেমা যতই রাগ, জিদ দেখাক না কেনো আমি জানি ওর মনটা কত নরম। জানেন আবদ্ধ স্যার একবার আমার জ্বর হয়েছিল। প্রেমা সারাটা দিন রাত আমার পাশে ছিলো৷ আমাকে কতটা যত্ন করেছে৷ আচ্ছা আমার যদি আবার জ্বর হয় তাহলে কে আমার এতো খেয়াল রাখবে? ”
নাঈমার কান্না দেখে ভোর আবদ্ধর বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না করে দিলো। তার সহ্য হচ্ছে না নাঈমার আর্তনাদ৷ মেয়েটা কিভাবে কাঁদছে দেখো! কত ভালোবাসে নাঈমা প্রেমাকে। বেস্ট ফ্রেন্ড বুঝি এমনই হয়! একজন ছেড়ে গেলে অন্যজন ভেঙ্গে পড়ে। এই যেমন প্রেমার ছেড়ে যাওয়ায় নাঈমা ভেঙে পড়লো। ভোর আবদ্ধর শার্ট মুচড়ে ধরে জোরে কান্না করে উঠলো। প্রেমার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করতে লাগলো। এই সব কিছু তার জন্য হয়েছে। শুধু মাত্র তার জন্য! আবদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোণে আসা পানিটুকু মুছে ভোরকে আগলে ধরলো। প্রেমার জন্য খারাপ লাগছে তার। ভীষণ খারাপ!
প্রেমার নিথর শরীরটার দিকে তাকিয়ে আছে ভোর। নাঈমা কেমন চিপকে আছে ওর লাশের সাথে। হিচকি তুলে তুলে বিলাপ করছে৷ বর্তমানে তারা প্রেমাদের বাসায়। বাসা ভর্তি মানুষ৷ আবদ্ধ প্রেমার বাবার সাথে কবর খননের কাজে সহযোগিতা করছে। পাশের রুম থেকে রিমা সুলতানার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। নায়েলি বেগমও আছেন সেখানে। আবদ্ধদের বাসার সবাই এসেছে প্রায়। ভোর নাঈমার দিকে এগিয়ে আসতেই নাঈমা হুঙ্কার দিয়ে বললো,
” একদম এদিকে আসবেন না। একদম আমার প্রেমার কাছে আসবেন না৷ আজকে যা হয়েছে সব সব কিছু আপনার জন্য হয়েছে। আজকে প্রেমা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে৷ কেনো বলুন তো? আপনাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রেমা নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিলো। ওই দানবীয় ট্রাকটা প্রেমাকে বাঁচতে দিলো না৷ কত জোরেই না প্রেমাকে আঘাত করলো, যে মেয়েটা চিরতরে ঘুমিয়ে গেলো। এই ঘুম আর ভাঙ্গবে না। দয়া করে আপনি আমার সামনে থেকে চলে যান। আমার অসহ্য লাগছে আপনাকে। আমার… আমার আপনাকে এখন ভালো লাগছে না। প্রেমার কাছেও আসবেন না। আসবেন না দয়া করে। ”
বলতে বলতে নাঈমা কেঁদে ফেললো। ভোর ঠোঁট চেপে কান্না নিবারণ করে পিছিয়ে গেলো। তীব্র অপরাধে কুঁকড়ে উঠলো৷ নিজেকে এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে শেষ করে ফেলতে৷ সত্যি তো তার জন্যই তো আজকে প্রেমা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। চলে গেছে সবাইকে ছেড়ে।
চলবে!
#এই_ভালো_এই_খারাপ(২৫)
#Jannat_prema
” কেনো করলেন এমন? আপনি যে আমার ভোরকে অপরাধী বানিয়ে দিলেন, মিস প্রেমা! আপনার জন্য যে সবাই ভেঙে পড়ছে। আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড মিস নাঈমা যে কেঁদে কেটে অবস্থা খারাপ করে ফেলছে। এই সবগুলোর দায় ভার কে নিবে বলুন? ”
অক্সিজেন মাক্স পড়ে থাকায় হাসতে কষ্ট হলেও মৃদু হেসে পিটপিট করে আবদ্ধর চোখের দিকে চাইলো প্রেমা। ছেলেটার চোখে কেমন এক কষ্ট ভাসছে। মাথার তীব্র ব্যাথায় চোখ খুলে রাখা যেনো দায়। তবুও কষ্টটুকুকে গিলে চোখ দিয়ে আবদ্ধকে কান পাততে বললো। আবদ্ধ ইশারাটা বুঝলো কি না জানা নেয়। তবে এতোটুকু বুঝলো প্রেমা কিছু বলতে চায়। আবদ্ধ ঝুকে প্রেমার কানের কাছে মুখ নিলো। প্রেমা হাসলো৷ এই প্রথম তার আবদ্ধ স্যার তার এতো কাছে এসেছে৷ হোক সেটা অন্য কারণে তবুও তো এসেছে। প্রেমা কাঁপা ডান হাতটা উঠিয়ে অক্সিজেন মাক্সটা মুখ থেকে খুলে ফেললো। মাক্স খোলায় আবদ্ধ কিছু বলতে গেলে প্রেমা চোখ নেড়ে বললো, ” একটু খানি সময়ের জন্য “। আবদ্ধ দমে গেলো কিছু বললো না। চোখ বুঝে ঢোগ গিলে প্রেমা বলে উঠলো,
” আপনাকে বড্ড ভা..ভালোবেসে ফেলেছি স্যার। জা..জানি আপ.আপনি বিবাহিত। ত..তবুও ববাসি। ”
এতোটুকু বলে থামলো। কথা বলতে তার এতো কষ্ঠ হচ্ছে কেনো? মনে হচ্ছে এখনই যেনো জানটা বের হয়ে যাবে। প্রেমার কথায় আবদ্ধ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলোও নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো। প্রেমা ফের বলে উঠলো,
” আজকে য..যদি ভোর ম্যামকে না.. না বাঁচাতাম তা..তাহলে আমার জায়..জায়গায় উনি থাকতেন। আপনার প্রি..প্রিয় মানুষটাকে হারাতেন। আমিও ছোট বে..বেলায় খুব প্রিয় একজন মানুষকে হা..হারিয়েছি। এমনই এক এক্স..এক্সিডেন্টে। কি.. কিন্তু সেদিন আম..আমি তাকে বাচাঁতে পারিনি। শুধু পা..পাথর বনে চেয়ে ছিলাম। ছোট ছি..ছিলাম বিধায় কিছু করতে পা..পারিনি। তবে এখন তো ব..বড় হয়েছি৷ বুঝি সব! জানেন য..যখন ভোর ম্যামের দিকে ট্রা..ট্রাকটা এগিয়ে আসছিলো, তখন আমার চোখে সেই ছো..ছোট বেলার এক্সিডেন্টের দৃশটা চোখে ভাসতেই ভ.ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এই বুঝি আম.আমার মতো কেউ তার প্রি.প্রিয়া মানুষকে হারিয়ে ফেলবে! চা..চাইনি আমার মতোও কে..কেউ তার আপন কাউকে হারিয়ে ফেলুক৷ তবে খুশি লাগছে ভোর ম্যামের কিছু হয়নি। ”
প্রেমা জোড়ে শ্বাস নিলো। তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এতোগুলা কথা বলে গলাটা শুকিয়ে গেলো। আবদ্ধ প্রেমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” পানি খাবেন? ”
” হ্যাঁ! ”
নার্স পানি নিয়ে এগিয়ে আসতেই প্রেমা একটা ছোট্ট আবদার করলো আবদ্ধর নিকট।
” স্যার আপনার হা..হাতে আমাকে একটু পানি খাইয়ে দিবেন? না করবেন না প্লি.. প্লিজ! ”
আবদ্ধ প্রেমার এমন আকুতি ফেলতে পারলো না৷ মেয়েটার,এই সামান্য আবদারটুকু নির্দয়ের মতো ফেলে দেওয়া যায় না। আবদ্ধ নার্সের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে খুব আস্তে করে প্রেমাকে পানি খাইয়ে দিলো। প্রেমা তৃপ্তি নিয়ে পানিটুকু খেয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো। আবদ্ধ স্যার তাকে ভালো না বাসুক অন্তত মৃত্যুর আগে তার একটু যত্ন তো পেলো। পানিটুকু খেয়ে প্রেমা খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করলো। তার কেমন কষ্ট হচ্ছে। শ্বাসের গতিটা বেড়ে যাচ্ছে। আবদ্ধ দেখলো প্রেমা ঘামছে। নিশ্বাস কেমন জোরে জোরে নিচ্ছে। আবদ্ধ চমকে প্রেমাকে ডাকতে লাগলো,
” মিস প্রেমা! চোখ খুলুন প্লিজ! আপনি এভাবে আমাদের অপরাধী বানিয়ে যেতে পারেন না। মিস নাঈমাকে, আপনার বাবা – মা কে ছেড়ে যেতে পারেন না। ”
প্রেমা ভেজা চোখে আবদ্ধর দিকে তাকালো। মুচকি হেসে খুব ধীরে বললো,
” স্যার এক..একটা কথা জানেন তো। আল্লাহ যার হায়াত যত..যতদিন রেখেছে, সে ততদিন বাঁচবে। আর দূর্ঘটনা তো একটা উ.উছিলা মাত্র। এতে আপ. আপনারা কেনো অপরাধী হতে যা.যাবেন।”
শেষের কথাগুলো আর বলতে পারলো না প্রেমা। আবদ্ধ থমকে দাড়িয়ে আছে প্রেমার নিথর হওয়া দেহের পাশে। মেয়েটা কেমন চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেলো চিরতরে। আবদ্ধর চোখের কোণে পানি জমে গেলো। এতো ভালো মেয়েটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেলো। আবদ্ধ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে প্রেমার পাশে বসে বলে উঠলো,
” আপনি খুব বড় অন্যায় করলেন মিস প্রেমা। এভাবে অপরাধী বানিয়ে না গেলেও পারতেন৷ আমার প্রিয় মানুষটাকে সহিসালামতে আমার কাছে দিয়ে আপনি চলে গেলেন! ভালো করলেন না কাজটা আপনি। ”
.
ভোর পা টিপে টিপে রুমে আসলো৷ পুরো রুম অন্ধকার করে রেখেছে আবদ্ধ। নিশ্চয় এখন সে বেলকনিতে। প্রেমার মৃত্যুর আজ তিনদিন। অথচ এই তিনদিন আবদ্ধ ভোরের সাথে হু হা ছাড়া একটা কথাও বলেনি৷ এতে ভোরের অপরাধবোধটা যেনো তিরতির করে বাড়তে লাগলো। রাতেও আবদ্ধ তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোয় না। সে ধরতে গেলে তাকেও ধরতে দিচ্ছে না। অথচ তার সব কিছুর দিকে খেয়াল রাখে৷ সে ঠিক মতো খাবার খাচ্ছে কি না, শরীরের অযত্ন করছে কি না ইত্যাদি। কিন্ত আবদ্ধ তার মনের খবরটা নিচ্ছে না। সে যে প্রতি নিয়ত ধুকে ধুকে ভেঙে পড়ছে৷ বুকের ভিতরটা শুন্যতায় হাহাকার করছে। ভোরের চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। আজকে একটা বিহিত করেই ছাড়বে। কেনো আবদ্ধ এমন করছে তার সাথে৷ আবদ্ধও কি বিশ্বাস করে প্রেমার মৃত্যুর জন্য সে দায়ী! ভোর চোখ মুছে এগিয়ে আসলো বেলকনিতে।
শীতল আবহাওয়ায় আবদ্ধ বেলকনিতে দাড়িয়ে প্রেমার কথাগুলো ভাবছিলো। মেয়েটা কি সহজ ভাবে সব কিছু বলে গেলো৷ একবারো ভোরের দোষারোপ করলো না। উল্টো ভোরকে বাঁচানোর জন্য নিজে জীবন দিয়ে বসে আছে৷ প্রেমার কৃতজ্ঞটা সে কিভাবে ঘুচবে। আদেও কি ঘুঁচাতে পারবে? আচমকা কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পাওয়ায় ভাবনার ঘোর থেকে বের হলো আবদ্ধ। বুঝতে পারলো কাঁধে হাত রাখা মানুষটা তার প্রিয়তমা স্ত্রী। তবে আবদ্ধ পিছনে ফিরলো না। ভোর হতাশ হলো আবদ্ধকে তার দিকে ফিরতে না দেখে। চোখের মনিকোঠায় আবারো শ্রাবণের পানি জমলো৷ ঢোগ গিলে আবদ্ধর পিঠ জড়িয়ে ধরে বললো,
” তুমি এমন করছো কেনো, আবদ্ধ? কেনো আমাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো প্রতিনিয়ত? কি দোষ করেছি আমি? নাকি তুমিও নাঈমার মতো আমাকে প্রেমার মৃত্যুর দোষী ভাবছো? কেনো আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছো, আবদ্ধ? হৃদয়ের এমন পোড়ন আমার সহ্য হচ্ছে না। হচ্ছে না সহ্য!”
কথাগুলো বলেই আবদ্ধর পিঠে মুখ লুকিয়ে কান্না করে দিলো৷ আচমকা আবদ্ধ পিছনে ফিরে ভোরকে দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে ধরলো৷ আবদ্ধর আচমকা কাজে ভোর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আবদ্ধর চোখের রগগুলো লাল হয়ে আছে কপালের নীল রগগুলো ফুলে আছে। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষে ভোরের চোখের দিকে তাকিয়ে ব’লে উঠলো,
” ওহ রিয়েলি ভোর? লাইক সিরিয়াসলি আমি তোকে কষ্ট দিচ্ছি? বরং তুই আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস প্রতিনিয়ত। হৃদয়ের পোড়নে তুই রেখেছিস আমাকে। ”
আবদ্ধর চেপে ধরা নিজের হাতের দিকে তাকালো ভোর। এতো জোরে দু’হাত চেপে ধরেছে যে ব্যাথায় মুখ নীল হয়ে আসছে৷ ভোর কাঁপা কন্ঠে বললো,
” আ.আমি হাতে ব্যা.ব্যাথা পাচ্ছি আবদ্ধ! ”
আবদ্ধ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
” এর থেকেও বেশি ব্যাথা তুই আমাকে দিয়েছিস। কোথায় দিয়েছিস জানিস? এই যে আমার বুকের বাম পাশে যে যন্ত্রটা আছে না, সেখানে ব্যাথা দিয়েছিস তুই। কে বলেছিলো তোকে সেদিন ওভাবে রাস্তার মাঝখানে চলে যেতে? সামান্য একটা মোবাইল ফোনের জন্য রাস্তার মাঝখানে চলে যাবি! আরে এমন একটা মোবাইল ফোন গেলে আরো একটা পাওয়া যাবে। কিন্তু তোকে হারালে তোকে পাবো কোথায়? তুই জানিস তোর দিকে যখন ওই দ্রুতগামী ট্রাকটা এগিয়ে আসছিলো তখন আমার কি অবস্থা হয়েছিলো? পুরো পৃথিবীটা থমকে গিয়েছিলো আমার। মনে হচ্ছিলো আমার নিঃশ্বাসটা বুঝি এখনি বন্ধ হয়ে যাবে। তোকে হারিয়ে ফেলবো চিরতরে। বিশ্বাস কর এক মুহুর্তের জন্য বুঝি তোর কিছু হয়ে গেলো। হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়াটাও যেনো স্থির হয়ে গিয়েছিল। এই যে আমার মাঝে এতো কিছু হয়ে গেলো। তুই বুঝেছিলি একবারো? বুঝিসনি! ”
চলবে!