এই_ভালো_এই_খারাপ পর্ব-২২+২৩

0
700

#এই_ভালো_এই_খারাপ(২২)
#Jannat_prema

ভিতরটায় উত্তেজনায় ছটফট করছে। একবার পা বাড়ালে দুবার পিছিয়ে যাচ্ছে। বারবার ঢোগ গিলছে। জীবনে প্রথম কাউকে প্রপোজ করতে যাচ্ছে। নাঈমা চোখ মুখ, কপাল কুঁচকে প্রেমার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো ঢং করছে কেনো এই মেয়েটা? এখানে কাজ করতে এসে কাজ না করে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে লাফালাফি করছে। প্রেমা ঢকঢক করে পানি খেয়ে লম্বা শ্বাস ফেললো। সবার মতো হাটু গেড়ে প্রপোজ করতে পারবে না। খুব নরমাল ভাবে ভালোবাসি কথাটা বলে চলে আসবে। ভালো করে জামা, ওড়না সব ঠিকঠাক করে নাঈমার ব্যাগ থেকে ছোট,সাইজের আয়নাটা বের করে নিজের চেহারাটা একবার দেখে নিলো। সব কিছু আবারও ঠিকঠাক দেখে নাঈমাকে বললো,

” আমি স্যারের চেম্বারে যাচ্ছি। ”

” সে তো তুই আধঘন্টা আগে থেকেই যাচ্ছিস। কিন্তু বাস্তবে একবারও গেলি না। ”

প্রেমা দাঁত কেলিয়ে হাসলো নাঈমার কথায়। কপালের সুক্ষ্ম ঘামের রেখাটা টিস্যু দিয়ে মুছে বললো,

” নার্ভাস লাগছে, ইয়ার! ”

” তাহলে থাক প্রপোজ করা লাগবে না। আমরা বরং আমাদের মেডিকেল ক্লাসে চলে যাই। ”

নাঈমার গদগদকণ্ঠ। এই সুযোগে যদি প্রেমা চলে আসে তাহলে সে তিন প্লেট ফুচকা ঝাল দিয়ে খাবে। নিজের মনে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলো নাঈমা। অথচ সেখানে এক বালতি ঘোলা পানি ঢেলে প্রেমা বললো,,

” নো! আজকে আমি স্যারকে আমার মনের কথা বলেই ক্ষ্যান্ত হবো। তার আগে নয়। ”

.

” আসতে পারি! ”

অধিক মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখছিলো আবদ্ধ। মেয়েলি স্বরে মাথা উঠিয়ে দরজার পানে চাইতে চোখ ছোট ছোট করে বললো,

” আসুন! ”

দরজা ঠেলে ধীর পায়ে ভিতরে ঢুকলো প্রেমা। চোখে, মুখে তার লাজুকতার হাসি। বুকের ভিতর অজানা কারণে ধক – ধক করছে। আবদ্ধ হাতের কলমটা টেবিলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে পূর্ণ নজরে প্রেমার দিকে তাকিয়ে বললো,

” কিছু লাগবে আপনার? হঠাৎ আমার চেম্বারে আপনার কি দরকার পড়লো? ”

আবদ্ধর প্রশ্নে বিব্রতবোধ করলো। নিজের ভিতরকার সবকিছু গুলিয়ে ফেললো মেয়েটা৷ হাত পায়ে মৃদু ঘাম জমেছে। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জ্বীভ দিয়ে ভিজিয়ে বললো,

” আআসলে আমি… এখানে কিছু বলতে এসেছি আপনাকে স্যার! ”

প্রেমার কথায় আবদ্ধ বাঁকা হাসলো। জোড়ে শ্বাস ফেলে বললো,

” সামনে রাখা চেয়ারটায় বসুন। ”

এক রাশ নার্ভাসনেস নিয়ে সামনে রাখা চেয়ারটায় বসলো। আবদ্ধ আবারও ফাইল চেক করতে করতে বললো,

” কি বলবেন বলে ফেলুন। নিশ্চয় এভাবে চুপচাপ থাকার জন্য আসেননি? ”

ভিতরে ভিতরে তীব্র অস্থিরে ছটফটিয়ে উঠলো প্রেমা। তার মুখ দিয়ে কেনো কথা বের হচ্ছে না? প্রেমা সহসা বিরক্ত হলো নিজের প্রতি। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। না তাকে বলতেই হবে। বুক ভরে দম নিয়ে সাহস জুগিয়ে বলার আগে আবদ্ধ বলে উঠলো,

” ভালোবাসেন আমায়? ”

আবদ্ধ প্রেমার দিকে তাকালো৷ মেয়েটা তার দিকে চমকিত নয়নে তাকিয়ে আছে। প্রেমা শুষ্ক ঢোগ গিললো। না বুঝার মতো করে বললো, ” মানে? ”

আবদ্ধ হাসলো। থমকে গেল প্রেমার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া। এতো মারাত্মক কারো হাসি কিভাবে হতে পারে৷ এই যে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে সুদর্শন, সুদীর্ঘ আবদ্ধ স্যারের হাসি দেখে। প্রেমাকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবদ্ধ শুকনো গলায় কেশে বললো,

” মানেটা আপনিও জানেন আমিও জানি মিস প্রেমা৷ না বুঝার তো কিছু নেই। আপনার আমার দিকে তাকানো, চালচলন দেখলেই বুঝা যায় ‘ ইউ লাভ মি ‘! এ’ম আই রাইট? ”

প্রেমা মাথা নিচু করে উপর নিচ দুলালো। মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে বললো,

” আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি, স্যার! ”

আবদ্ধ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ব’লে উঠলো,

” ভালোবাসা ভালো মিস প্রেমা। তবে সেটা আপনি ভুল সময়ে ভুল মানুষের উপর বেসে ফেলেছেন। ”

আবদ্ধর কথার মানে না বুঝে মাথা তুলে আবদ্ধর দিকে চাইলো। আবদ্ধ ফাইলে চোখ রেখে বলে উঠলো সেই চরম সত্যি কথা।

” আমি বিবাহিত, মিস প্রেমা! জানেন সেটা? ”

কথাটুকু শ্রবণ হতেই ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে গেলো প্রেমা। চোখে, মুখে তার এক আকাশ পরিমাণ বিস্ময় খেলা করছে। বুকের ভিতরটা কোনো এক নিদারুণ যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো। ভুল শুনেছে ভেবে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

” আআপনি মজজা করছেন, সস্যার? ”

আবদ্ধ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে প্রেমাকে বললো,

” আপনার সাথে আমার নিশ্চয় মজার সম্পর্ক নয়। ”

প্রেমা ছলছল চোখে তিন কদম পিছিয়ে গেলো। বুকের ভিতর ব্যাথা করছে। কিছু অপ্রকাশিত কথাগুলো শুনে মাথার রগগুলো তীব্র ব্যাথায় টনটন করছে৷ প্রেমা অবস্থা কিছুটা বেগতিক দেখে আবদ্ধ দাড়িয়ে টেবিলে থাকা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,

” এই পানিটা খেয়ে নিন। আপনাকে ঠিক লাগছে না। ”

কাঁপা হাতেই পানির গ্লাসটা নিলো। ঢকঢক করে সবগুলো পানি খেয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। আবদ্ধ চুপচাপ দেখে গেলো। ভালোবাসা ভুল নয় তবে ভুল মানুষকে ভালোবাসা ভুল। মেয়েটা হয়তো জানতো না সে বিবাহিত। তারও বা কি করার আছে৷ সে তো ভোরকে ছাড়া তার লাইফে কাউকে কল্পনাও করতে পারছে না। আবদ্ধ কিছু বলতে গেলেই প্রেমা হুহু করে কেঁদে উঠলো। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হৃদয়ের যন্ত্রণায় কেঁদে দিলো৷ জীবনে প্রথমবার কাউকে ভালোবেসে ঠকেছে সে। না আবদ্ধ স্যার ঠকায়নি তাকে। তাকে তো সে নিজেই ঠকিয়েছে৷ কেনো আগে সব কিছু জেনে নিলো না। আগে জেনে নিলে তো তাকে এমন যন্ত্রণা ভো গ করতে হতো না। প্রেমা নাক টেনে চোখ মুছে আবদ্ধর দিকে তাকালো৷ আবারও চোখের কোণে পানি এসে ভীড় করলো। ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না করে বললো,

” আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি, আবদ্ধ স্যার। আমার জীবনে প্রথম অনুভুতি আপনি। প্রথম ভালোবাসার মানুষ। আমার ছন্নছাড়া জীবনে আপনিই প্রথম ভালোলাগার পুরুষ। অথচ দেখুন আপনি আমার ভাগ্যে নেই। আপনি অন্য কারো স্বামী। সেখানে আমি… আমি! আপনাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি স্যার। কিন্তু আপনি তো আরেকজনকে ভালোবাসেন। যে আমার আসার অনেক আগেই আপনার জীবনে এসে গেছে। তবে কেনো এটা আমি মানতে পারছি না? ”

আবদ্ধ এই মুহুর্তে কি স্বান্তনা দিবে ভেবে পেলো না। তবে স্বান্তনা হিসেবে বললো,

” এভাবে কাঁদবেন না। আমার থেকেও বেটার কেউ আপনার লাইফে আসবে। একটা কথা কি জানেন, আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষগুলো তাদের প্রথম অনুভূতিগুলো ভুল মানুষের প্রতি প্রয়োগ করে ফেলে। যেমন এখন আপনি করলেন। আমি আপনার জন্য নই আর আপনিও আমার জন্য নন। আমি যার, আমি তারই আছি। আ’ই হোপ আপনি বুঝতে পেরেছেন! ”

অশ্রুপাত চোখেই মুচকি হাসলো। চোখের পানি মুছে আবদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললো,

” আমার কষ্ট হচ্ছে স্যার। আপনার সামনে যত থাকবো তত আমার কষ্ট বাড়বে। অনুভুতিগুলো আরো প্রখর হবে। আর সেটা আমি কিছুতেই চাই না। আপনার এবং আপনার বউয়ের জন্য শুভ কামনা রইলো।
ভালো থাকবেন। চলি! ”

প্রেমার প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইলো আবদ্ধ। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। এতে তার কিছুই করার ছিলো না। সে যে মন প্রাণ দিয়ে একজনকে ভালোবাসে। তাকেই আজীবন ভালোবেসে যাবে। ভোরের মাঝেই তো তার সব কিছু জুড়ে আছে। যাকে ছাড়া তার প্রতিটা সেকেন্ড অস্থিরতায় কাটে। ভালো লাগে না কিছু। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে অনুভব করা তো দূরের বিষয়।

.

নাঈমা পিলে চমকে উঠলো প্রেমাকে দেখে। শ্যাম বর্ণের মেয়েটার পুরো মুখটা কান্নার কারণে লাল হয়ে আছে। চোখ জোড়াও ফুলে আছে। পরিপাটি মেয়েটা মুহুর্তে কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। নাঈমা অস্থির পায়ে ছুটে আসতেই প্রেমা এক হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিলো। কন্ঠে কঠোরতা ফুটিয়ে বললো,

” তুই জানতি আবদ্ধ স্যার বিবাহিত? আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে ইচ্ছুক নই। যেটা জিজ্ঞেস করেছি, শুধু সেটাই বলবি। ”

নাঈমা টলমলে চোখে বললো,

” তোর কি অবস্থা হয়েছে প্রেমু! আমাকে একবার তোর কাছে আসতে দে। ”

” একদম না! তুই কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলি না। ”

” হ্যাঁ! আমি জানতাম। ইন ফ্যাক্ট তোকে আমি এই কথাটা কত বার বলার চেষ্টা করেছি। তুই শুনলি না। শেষে ভাগ্যের উপর সবটা ছেড়ে দিয়েছি। ”

প্রেমা তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,

” অতঃপর ভাগ্য আমাকে এক নিদারুণ যন্ত্রণা উপহার দিলো। আমার ভালোবাসাটা ভুল মানুষের প্রতি জন্মালো। যে কি না কখোনোই আমার হবার নয়। আমি ঠকে গেছি নামু। চরম ভাবে নিজেকে নিজেই ঠকিয়েছি। কেনো আমি তোর কথাগুলো শুনলাম না? কেনো? ”

নাঈমা প্রেমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ঠিক জানতো এমন কিছুই হবে। প্রেমা হিচকি তুলে বললো,

” আবদ্ধ স্যার আমাকে ভালোবাসেন না৷ বাসবে কিভাবে? তিনি তো তার স্ত্রীকে ভালোবাসেন। তাও কেনো আমার এতো অসহ্য লাগছে৷ এমন অনুভূতির কারণে আমি বিরক্ত হচ্ছি নিজের প্রতি। খুব বিরক্ত! ”

” তুই ভেঙে পড়িস না। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। তোকে এভাবে দেখতে আমারও যে কষ্ট হচ্ছে। এবার থাম বোন আমার। ”

চলবে!

#এই_ভালো_এই_খারাপ(২৩)
#Jannat_prema

সেই কখোন থেকে আবদ্ধর জন্য রেস্টুরেন্টে বসে আছে ভোর। তার ফ্রেন্ডটা চলে গেছে প্রায় বিশ মিনিটের মতো হয়ে গেছে। মেয়েটা ভোরকে একা ছেড়ে যেতেই চাইছিলো না। জরুরি কাজ থাকায় অগ্যতা তাকে যেতে হলো। আবদ্ধ কল করে বললো তার হসপিটাল থেকে কিছুটা দূরেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে আসতে৷ কিন্তু যে আসতে বলেছে তার কোনো খবরই নেই।

” সরি! সরি ফর লেট, জানেমান। ”

ভোর প্রথমে হকচকালেও পরে আবদ্ধকে দেখে বুকে হাত রেখে শ্বাস ফেললো। আবদ্ধ ধপ করে ভোরের অপজিট পাশে মুখোমুখি হয়ে বসলো। ভোর মায়া মায়া দৃষ্টি ফেলে টিস্যু দিয়ে আবদ্ধের ঘাম মুছে দিতে দিতে বললো,

” এভাবে ঘেমে গেলে যে? গায়ের শার্টটাও খানিকটা ঘামের কারণে ভিজে গেছে। সর্দি লাগলে তখন? ”

আবদ্ধ হাসলো। চট করে ফিসফিস করে বললো,

” সর্দি লাগলে রাতের বেলা আদর দিয়ে সেড়ে দিবি। ”

লজ্জায় হাত কেঁপে উঠলো ভোরের। রেস্টুরেন্টের ভিতর বসেও কেমন লাগামহীন কথা বলছে। ভোর বেজায় রাগ দেখিয়ে বললো,

” জানি তো! এখন কত রোমান্টিক কথা বলবা৷ বুঝি না ভাবছো? ঘামে শার্ট ভিজা থাকলে মেয়েরা খুব আকর্ষণ নিয়ে তোমার দিকে তাকাবে। তোমারও মেয়েদের তোমার সিক্সপ্যাক বডি দেখাতে না পারলে শান্তি লাগবে? লাগবে না তো! বুঝি সব বুঝি!

আবদ্ধ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে ভোরের দিকে ৷ এই মেয়ে কথা প্যাচিয়ে কোথায় নিয়ে গেলো। আবদ্ধ শান্ত স্বরে বললো,

” এদিকে আয় তোকে একটা চুমু খেয়ে একটু আমার এই অশান্ত মনটাকে শান্ত করে নেই! সাথে তুইও একটু শান্ত হ! ”

ভোর চোখ পাকিয়ে তাকালে আবদ্ধ হেসে মাথা চুলকালো। ভোর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

” কোথায় কি বলতে হয় জানো না? নির্লজ্জ! ”

” হায়! তোর কথাটা বুকে গিয়ে লাগলো! ”

” অসভ্য! ”

আবদ্ধ হেসে দিলো৷ ভোর লজ্জায় অন্য দিকে তাকালো। ছেলেটা দিন দিন কেমন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে দেখো! ক্ষণে ক্ষণে কিভাবে তাকে বেকায়দায় শরম দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ভোরের ইচ্ছে করে আবদ্ধর বেফাঁস কথায় আলমারির ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকতে । কানে তুলা দিয়ে না শুনার মতো বসে থাকতেও ইচ্ছে করে। আবদ্ধ এক পলক লজ্জায় নেতিয়ে থাকা ভোরের দিকে তাকিয়ে মেনু কার্ড দেখে খাবার ওর্ডার করে বললো,

” মিস প্রেমা আজকে আমার চেম্বারে এসেছিল। ”

লজ্জা টজ্জা সব ভুলে আবদ্ধর দিকে তাকালো ভোর। খানিকক্ষন কিছু মনে করার তাগিদ করলো৷ পরপরই চমকে উঠে বললো,

” জান্নাত প্রেমা! মানে সকালে তোমার পিকে কমেন্ট করেছিল যে সেই মেয়েটা? ”

আবদ্ধ মাথা নাড়লো। ভোর চিন্তিত কন্ঠে বললো,

” কেনো এসেছিলো? কোনো কিছু জানতে? ”

” উহু! প্রপোজ করতে এসেছে। ”

আবদ্ধর নির্লিপ্ত স্বর। ভোর চোখ জোড়া বড় বড় করে বললো,

” ভালোবাসি বলেছে? ”

” বলেছে। ”

” তুমি কি বলেছ! ”

” আমিও ভালোবাসি বলেছি। ”

ভোর নাক ফুলিয়ে আবদ্ধর দিকে তাকালো৷ আবদ্ধর ভাবসাব এমন যে, সে যা বলেছে সব সত্যি বলেছে। ভোর দারুণ ভাবে ক্ষেপে বললো,

” একদম ফাইজলামি করবা না আমার সাথে। নাক ফাটিয়ে দিবো তাহলে। ”

আবদ্ধ দাঁত কেলালো। ভোরকে ক্ষেপাতে এতো ভালো লাগে কেনো? আহা! তার অর্ধাঙ্গিনী রাগলে তার ভিষণ আদর লাগে৷ বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে থাকে৷ এই যে এখন গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে৷ আবদ্ধ জানে ভোরের চোখে পানি ছলছল করছে। তার এতোটুকু কথাতে মেয়েটার কান্না পাচ্ছে। না জানি সে যদি সত্যি সত্যি করতো তাহলে নিশ্চয় কেঁদে কেঁদে তার বুক ভাসিয়ে মেঘনা নদীতে নিয়ে যেতো। আবদ্ধ টেবিলের উপর থাকা ভোরের হাতটা মুঠোয় নিয়ে আলতো ভাবে ঠোঁট ছুয়ে বললো,

” আমার পুরোটা জীবন আমি তোর নামে সেই কবে উৎসর্গ করেছি৷ তোকে সারাজীবন পাওয়ার আশায় কত বছর তোকে নয়ন ভোরে না দেখে দুরে থেকেছি৷ আর সেখানে কেউ হুট করে এসে হস্তক্ষেপ করবে কিভাবে? দেখি এদিকে তাকা। তাকাতে বলছি না। ”

ভোর তাকালো আবদ্ধর দিকে৷ অতি যত্ন নিয়ে আবদ্ধ ভোরের চোখের কোণে থাকা পানিগুলো মুছে দিয়ে বললো,

” ভালোবাসি তোকে৷ তাহলে কাঁদছিস কেনো? তোর চোখের পানি আমার হৃদয়ের ভিতর পিড়া দেয় বুঝিস না। আজকে থেকে যেনো অকারণে চোখে পানি না দেখি। ”

.

রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আচমকা প্রেমা থমকে দাড়িয়ে পড়লো। প্রেমাকে দাড়িয়ে পড়তে দেখে নাঈমাও কপাল কুঁচকে দাড়ালো। প্রেমার দৃষ্টি অনুসরণ করে রেস্টুরেন্টের ভিতর তাকাতেই কপালের ভাজগুলো মিলিয়ে গেলো। চোখে মুখে ফুটে উঠলো অজানা ভয়। প্রেমা যদি কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট করে! নাঈমা শুষ্ক ঢোগ গিলে প্রোমার দিকে চাইলো। সে কেমন নির্লিপ্ত ভাবে ওদিকে তাকিয়ে আছে।

” ওটা আবদ্ধ স্যারের ওয়াইফ? ”

নাঈমা চমকে উঠলো। প্রেমার কন্ঠটা কেমন শান্ত শুনালো। নাঈমা মৃদু স্বরেই বললো,

” হ্যাঁ! উনিই আবদ্ধ স্যারের ওয়াইফ ভোর ম্যাডাম। ”

ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো প্রেমার। এই হাসি বিষাদের। হৃদয় ভাঙ্গার হাসি। চরম ভাবে পাওয়া কষ্টের হাসি যেনো ঠোঁটের কোণে ফুটে আছে৷ নাঈমা যেভাবে ভোর ম্যাডামের বর্নণা দিয়েছিলো তার থেকেও অধিক সুন্দর স্যারের বউ। প্রেমার বক্ষপিঞ্জরটা যেনো জ্বলে উঠলো। তার গায়ের রঙ আর ভোরের গায়ের রঙের তো আকাশ পাতাল অমিল৷ নিজের ভাবনায় নিজেই ধিক্কার জানালো প্রেমা। গায়ের রঙ নিয়ে তার ভাবা উচিত নয়। প্রেমা চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলো নাঈমার অগোচরে মুছে বললো,

” ম্যাম ঠিক ভোরের মতোই স্নিগ্ধ, শীতল! কি সুন্দর মানিয়েছে দু’জনকে। তাই না নামু? ”

নাঈমা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে প্রেমার মুখের দিকে৷ কান্না গিলার কি আপ্রাণ চেষ্টা মেয়েটার। চোখের পানি না গড়ালেও নাক লাল হয়ে আছে। হঠাৎই প্রেমা নাঈমার হাত চেপে ধরে বললো,

” চল তো! স্যারের বউয়ের সাথে একটু পরিচিত হয়ে আসি। ”

নাঈমা হকচকিয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠে বললো,

” কোনো দরকার নেই আমাদের সেখানে যাওয়ার। প্রেমা আমার কথাটা শুন৷ তোর কষ্ট হবে সেখানে গেলে। ”

” কোনো কষ্ট হবে না আমার৷ প্রেমা এতো সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে নয় নামু। তুই আবারো হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিস। ”

” করবো না৷ তোর কষ্ট হবে এমন জায়গায় আমি যাবো না। ”

” তুই যাবি! তোর পুরো বডিও যাবে। ”

নাঈমা মুখটাকে কাঁদো কাঁদো করে আছে। তার প্রচুর অসহ্য লাগছে আবদ্ধ স্যারদের কাছে যেতে। অথচ প্রেমা কিভাবে হাসি মুখে সেখানে যাচ্ছে। যেনো কিছু হয়নি তার। সব স্বাভাবিক।

” আমরা কি বসতে পারি? ”

আবদ্ধ, ভোর একসাথে তাকালো প্রেমার দিকে। প্রেমা হেসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোর প্রেমার নিচ থেকে উপরে একবার চোখ বুলালো। শ্যামবর্ণের গায়ের বরণ৷ কালো কুর্তি পড়ায় সুন্দর লাগছে। হাসার কারণে দু গালের টোলগুলো স্পষ্ট হয়ে আছে। সব মিলিয়ে মায়াবী একটা মুখ মেয়েটার। নাঈমা প্রেমার পিছনে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে। তার অস্বস্তি হচ্ছে এখানে৷ আবদ্ধ অবাক হয়ে বললে,

” মিস, প্রেমা আপনি? ”

ভোর অবাক হলো অনেকটা। এই মেয়েটাই তাহলে প্রেমা! ভোর আবারো মেজাজ খারাপ করতে গিয়েও করলো না। কেনো যেনো মেয়েটার প্রতি এখন তার রাগ আসছে না। আবদ্ধ বলেছে সব তাকে। প্রেমা জানতো না আবদ্ধ বিবাহিত। প্রেমা হেসে আবারও বললো,

” হঠাৎ আমাকে দেখে চমকে গেছেন স্যার! সমস্যা নেই, আমি শুধু আপনাদের সাথে আড্ডা দিতে এসেছি। ”

” বসো! ”

ভোর হেসে বললো৷ প্রেমা আর নাঈমা মুগ্ধ হয়ে বসলো চেয়ারে। কি সুন্দর হেসে তাদেরকে বসতে বললো। আচ্ছা ভোর ম্যাম কি জানে সে যে আবদ্ধ স্যারকে ভালোবাসে? হয়ত জানে না! জানলে কি আর এতো সহজে মিশতো? প্রেমা আড়চোখে একবার আবদ্ধর দিকে তাকালো। সে ফোনে ব্যাস্ত।

” কি খাবে তোমরা? ”

প্রেমা স্মিথ হেসে বললো,

” তোমরা যেটা খাবে সেটা অর্ডার করো। ”

” আচ্ছা! তুমি এভাবে কাচুমাচু হয়ে আছো কেনো? কোনো সমস্যা? ”

নাঈমা মেকি হাসলো। সোজা হয়ে বসে বললো,

” না ম্যাম। আ’ম ফাইন। ”

রাস্তার এক পাশে দাড়িয়ে আছে, ভোর, প্রেমা আর নাঈমা। আবদ্ধ রাস্তার ওপাশে গেল সবার জন্য আইসক্রিম আনতে। অবশ্য আবদারটা ভোর করেছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রেমা আর ভোরের সম্পর্কটা কেমন জমে উঠলো। প্রেমার চেহারায় বিষাদের ছায়াটা এখন নেই। নাঈমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে সব সময় হাসি খুশিতে মানায়।

” আবদ্ধকে ভালোবাসো প্রেমা? ”

কাথাটা শুনে নাঈমা ভড়কে উঠলো। অথচ ভড়কালো না প্রেমা আর না চমকালো। অমায়িক হাসি দিয়ে বললো,

” বাসতাম! এখন বাসি না। যে আমার হবার নয় তাকে পাওয়ার আশা বোকামি বইকি কিছুই না। উল্টো আমি আপনাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হতাম। ”

নাঈমা আর ভোর বিমোহিত হয়ে আছে। মেয়েটা কি অবলীলায় তাকে ‘ বাসতাম ‘ মিথ্যে কথাটা বললো৷ ভালোবাসা কখোনো শেষ হয় না। হয়ত ভালোবাসার মানুষটা তার নয়। কিন্তু ভালোবাসাটা তো এতো সহজে ভুলা যায় না।

” তবে আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখতে খুব সুন্দর লাগে। নজর না লাগুক কারো। ”

ভোর প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে হাসলো। আর কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। নাঈমার কল আসায় সে একটু সাইডে চলে গেলো। আবদ্ধ আইসক্রিম নিয়ে রাস্তার ওপাশ থেকে হাত নেড়ে জানালো, ” দাড়া ওখানে আমি আসছি। ”

ভোর মাথা নাড়লো৷ প্রেমা আবদ্ধর দিক থেকে চোখ সরালো। ভোরের হঠাৎ মনে হলো নায়েলি বেগমকে একটা কল করা উচিত৷ দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করতে গিয়ে ভুলবশত সেটা হাত ফস্কে রাস্তায় গিয়ে পড়লো। বিরক্তিতে ‘চ ‘ সূচক শব্দ করে ফোনটা নিতে গিয়ে পায়ের সাথে লেগে রাস্তার মাঝখানে চলে গেলো। পিছন থেকে প্রেমা বলে উঠলো,

” ম্যাম! সাবধানে! পিছনে থেকে গাড়ি আসবে। ”

গাড়ির হর্ণের শব্দে ভোর প্রেমার কথা ভালো ভাবে শুনতে পেলো না। আবদ্ধ আইসক্রিমওয়ালাকে টাকা দিয়ে পিছনে ফিরতেই জমে গেলো। রাস্তার প্রায় মাঝামাঝিতে ভোর। আবদ্ধর হাতের আইসক্রিম গুলো খসে পড়ে গেলো। প্রেমাও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ঠিক ভোরের কাছ থেকে কয়েক দূর থেকে ধেয়ে আসছে বড় একটা মালবাহী ট্রাক। নাঈমাও কলে কথা বলার মাঝে স্তব্ধ হয়ে আছে। আবদ্ধর গলার স্বর রোধ হয়ে আছে৷ বুকের ভিতর প্রচন্ড ভাবে ঢিপঢিপ করছে। প্রেমা পিছন থেকে চিল্লিয়ে বললো,

” ম্যাম! সুরুন ম্যাম! আপনার পিছনে ট্রাক আসছে। ভোর ম্যাম! ”

অথচ ভোর শুনলো না। রাস্তা থেকে ফোনটা নিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। বিস্তর এক হাসি দিয়ে নিজের পিছনে তাকাতেই আঁৎকে উঠলো। সরে যাওয়ার শক্তিটুকুও যেনো ক্ষয় হয়ে গেলো। আবদ্ধ দেখলো ট্রাকটা ভোরের খুব সন্নিকটে। কিছু না ভেবে ছুটে আসতেই দেরি হলো খুব। ততক্ষণে ভোরেকে পিছন থেকে ধাক্কা মারলো প্রেমা। মুহুর্তে বিকট শব্দে থেমে গেলো আবদ্ধ। নাঈমা হাত থেকে ফোন ছেড়ে দিলো। ভোর পিছনে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ব’লে উঠলো,

” প্রেমাআআআআ! ”

চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে