#এই_ভালো_এই_খারাপ(৪)
#Jannat_prema
আবদ্ধর কথায়,চমকে গেলো ভোর
এতো রাতে আবদ্ধর কল দেখে ভয় পেলেও ওর কথা শুনে চমকে গেলো। ভোর পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত ছোট্ট সকালের দিকে তাকালো। আস্তে করে খাট থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। আবদ্ধর কথায় নিরবে হাসলো ভোর। না আর মজা করা যাবে না। ভোর ফিসফিস করে কলের ওপাশে আবদ্ধকে বললো,
” তুই কাঁদছিস আবদ্ধ? ”
ভোরের কথায় আবদ্ধ নাক টানলো। ভোর কিভাবে যে বুঝে গেলো সে যে কান্না করছিলো? আবদ্ধ ভোরকে বুঝতে দিলো না তাও। কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,
” না। কাঁদছি না তো। ”
” মিথ্যে বলছিস কেনো? তোকে আমি ভালো করে চিনি বুঝলি! তোর স্বভাব আমার জানা আছে। ”
” তাহলে আমাকে ভালো বাসতে ক্ষতি কি? আমাকে যখন এতো চিনিস তাহলে আমার পাশে থেকে যা। আমি তোকে আগলে রাখবো। ”
ভোর হাসলো৷ হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো ওর খোলা চুল৷ আকাশের চাঁদটা একবার মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যায় তো আবারো তার কিরণ ছড়াতে বেরিয়ে আসে। ভোর এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছে গুজে বলে উঠলো,
” যদি তুই কখোনো বদলে যাস? ”
” তখন না হয় তুই আমায় তোর ভালোবাসায় শাসন করে শুধরে দিবি। ”
” তবে ঠিক আছে। ”
আবদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো,
” কি ঠিক আছে? ”
ভোর লজ্জা পেলো। কিভাবে কথাটা বলবে ভেবেই পেলো না৷ তবুও নিজেকে সংযত করলো। বললো,
” আবদ্ধ আমি তোকে ভালোবাসি। ”
কথাটা বলেই দ্রুতগতিতে কল কেটে দিলো ভোর৷ আকর্ষাত ভোরের এমন কথা আর কাজে বিমূঢ় হয়ে আছে আবদ্ধ। মস্তিষ্কের ভিতর টনক নড়তেই আবদ্ধ থমকে গেলো। থমকানো অবস্থায় ফোনের দিকে তাকালো। হৃদয়ের কোথাও যেনো খুশির ঢেউ বয়ে গেলো। পরেরদিন থেকে ভোর একটা কথাও বলতে পারেনি আবদ্ধর সাথে৷ লজ্জায় জুবুথুবু অবস্থা। ভোরকে এমন লজ্জা পেতে দেখে আবদ্ধ চোখ ছোটো ছোটো করে বললো,
” যে হারে লজ্জা পাচ্ছিস মনে হচ্ছে আজকে তোর বিয়ে। ”
ভোর তপ্ত চাহনি নিক্ষেপ করলো আবদ্ধর দিকে। আবদ্ধ কি জানে না ওরা বেস্ট ফ্রেন্ডের পাশাপাশি আরো অন্যকিছু। ভোরকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে আবদ্ধ ডান ভ্রূ উঁচু করে বললো,
” এভাবে চেয়ে আছিস কেনো? নজর লাগবে আমার ভোর৷ ”
আবদ্ধর কথায় ভোর দাঁতে দাঁত পিষলো। রাগ্বত স্বরে বললো,
” তোকে আমার চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে মন চাইছে। বেশরমের মতো কথা বলা বাদ দিবি না তুই? ”
আবদ্ধর সহজ জবাব, না।
.
দুইজনের এমন মিষ্টি, ভালোবাসার খুনসুটিতে প্রায় অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গিয়েছিলো। দিন দিন আবদ্ধর পাগলামোগুলো যেনো বেরে গেলো ভোরের প্রতি। নিজের প্রতি আবদ্ধর এতো কেয়ারিং দেখে মুগ্ধ হয় ভোর। ছেলেটা যেনো আগের থেকেও আরো পজেসিভ হয়ে উঠেছে।
সেদিনকার একটি ঘটনা। ভোর কলেজের ক্যান্টিনে একা একা বসে সকালের নাস্তা করছিলো৷ খাচ্ছিলো কম ভাবছিলো বেশি। তখন ভোরের ভাবনা জুড়ে ছিলো আবদ্ধ। ছেলেটা এখনো আসেনি । নিজের ভাবনায় মশগুল থাকা অবস্থায় কারো গলার আওয়াজে চোখ তুলে তাকালো ভোর। তার সামনেই দাড়িয়ে আছে একটি ছেলে। অগ্যাত ছেলেটি ভোরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো,
” হাই! আমি নিহাল রহমান। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা বিভাগের ছাত্র। ”
সহসা বিরক্ত হলো ভোর। মুখে তা প্রকাশ না করে জোরপূর্বক হেসে বললো,
” হ্যালো ভাইয়া। ”
” এক্সচুয়ালি তুমি কিছু মনে না করলে, আমি কি তোমার পাশের খালি সিটটায় আসন করতে পারি? না মানে তুমি একা একা বসে আছো। ”
নিহালের প্রশ্নে কি বলবে ভেবে পেলো না ভোর। কারণ পাশের সিটটা ছিলো আবদ্ধর জন্য। ভোর মনে মনে চটে গেলো আবদ্ধর উপর। বজ্জাতটা আসার নামই নিচ্ছে না এখনো। নিহাল উত্তরের জন্য তাকিয়ে আছে ভোরের দিকে। ভোরকে একা বসে থাকতে দেখে সে ভাবলো একটু সিমপ্যাথি দেওয়া যাক। ভোর যখন মুখ ফুটে কিছু বলবে, ঠিক তখন নিহালের পিছন থেকে আবদ্ধ বললো,
” জ্বি না। আপনি ওই সিটে বসতে পারবেন না৷ কজ ওই সিটটা আমার। ”
আবদ্ধকে দেখে মনে মনে খুশি হলো ভোর৷ নিহাল আবদ্ধর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
” হেই ব্রো। ডোন্ট মাইন্ড! আমি জাস্ট ওর সাথে গল্প করতে এসেছিলাম। আমার কিন্তু গার্লফ্রেন্ড আছে। ওই যে সাদা থ্রিপিস পড়া সুন্দরী মেয়েটাকে দেখেছো? ”
নিহালের হাতের ইশারায় তাকালো ওরা। ক্যান্টিনের কর্নারে তিনটা মেয়ে আর একটি ছেলে মিলে গল্প করছে। নিহাল আবারো বলে উঠলো,
” ওই মেয়েটা আমার গার্লফ্রেন্ড। আচ্ছা আমি এখন যাই। তুমি যখন এসেছো তখন আর থেকে কি লাভ। বাই! ”
” বাই! ”
নিহালকে বাই বলে আবদ্ধর দিকে তাকাতেই ভোর চমকে উঠলো৷ আবদ্ধর মুখ চোখ আংশিক লাল হয়ে আছে৷ যা কিছুক্ষণ আগেও ছিলো না। শুকনো ঢোগ গিলে ভোর বললো,
” এই ভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? ”
আবদ্ধ কিছু না বলে ভোরের হাত টেনে ক্যান্টিন থেকে মাঠের এক কোনায় নিয়ে আসলো। ক্লাস শুরু হতে এখনো ঢের সময় আছে। ওনেকে মাঠে বসে গল্প করছে। ভার্সিটি আর কলেজ এক সাথে হওয়ায় সিনিয়ররাও আছে৷ আবদ্ধর আচমকা এমন টেনে আনার বিষয়টা বোধগম্য হলো না ভোরের৷ চোখে মুখে প্রশ্নের বাহার নিয়ে তাকিয়ে আছে আবদ্ধর দিকে। আবদ্ধ ভোরকে শুকনো ঘাসের উপর বসিয়ে নিজেও হাটু মুড়ে বসলো। ভোর আরো কৌতুহল নিয়ে তাকালো আবদ্ধর দিকে। যবে থেকে ওদের প্রণয় শুরু হয়েছিলো, তবে থেকেই আবদ্ধ কেমন যেনো হয়ে গেলো। হুটহাট রাতের বেলা বাসার নিচে এসে বলবে, নিচে আয় তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ভোর তখন বিপাকে পড়ে যায়। বাসায় তখন বাবা থাকেন। আর মাকে ফাঁকি দেওয়া চারটে খানিক কথা না। হাজারটা অজুহাত দেখিয়ে যখন আবদ্ধর সামনে যায় ভোর। আবদ্ধ তখন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকেই বলবে,
” আই লাভ ইউ ভোর পাখি। ”
সাথে সকালের জন্য কিছু চকলেট দিয়ে বলবে,
” এখন যেতে পারিস। রাতে শান্তির ঘুম দিবো। ”
আবদ্ধর এমন পাগলামোতে ভোর বিরক্ত হয়ে বলতো,
” তুই এমন করছিস কেনো আবদ্ধ? এমন করার মানে আছে তুই বল? তুই জানিস আম্মু আব্বুকে কত অজুহাত দেখিয়ে আমাকে এখানে আসতে হয়? ”
আবদ্ধ নির্লিপ্ত সুরে বলতো,
” তোকে না দেখে আমি রাতে ঘুমোতে পারি না। ”
” ভিডিও কল দিলেও তো দেখা হতো। ”
আবদ্ধ তখন বাইকের হেলমেট পড়তে পড়তে বলতো,
” ওই দেখাতে কি আর মন ভরে। ”
ভোর কিছু বলার আগেই সাই করে আবদ্ধ বাইক চালিয়ে নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতো। ভোর তখন মনে মনে আওড়াতো,
” পাগল ছেলে! ”
হাতে শক্ত চাপ অনুভব হতেই চোখ খিচে আবদ্ধর দিকে তাকালো ভোর৷ অবাক হয়ে বললো,
” আবদ্ধ আমি ব্যাথা পাচ্ছি হাতে। কি করছিস তুই? ছাড়! ”
আবদ্ধ ছাড়লো না। আগের মতোই ভোরের হাতটাকে শক্ত করে ধরে শক্ত কন্ঠে বললো,
” আমাকে যে ব্যাথা দিলি সেটা? ”
ভোর আকাশ থেকে পড়ার মতো করে বললো,
” আমি কখোন তোকে ব্যাথা দিলাম? আর কোথায় ব্যাথা দিয়েছি আমি। ”
” দিয়েছিস তো। ”
এরপর আবদ্ধ বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে বললো,
” এই যে, ঠিক এখানটায়। প্রচুর ব্যাথা করছে এখানটায়। সহ্য হচ্ছে না তোকে অন্য কোনো ছেলের সাথে হেসে কথা বলতে দেখে। ”
ভোর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে আবদ্ধর দিকে। আবদ্ধকে আজকে কেমন অচেনা লাগছে তার কাছে। ভোর ব’লে উঠলো,
” তুই কি যাতা বলছিস আবদ্ধ? ওই ভাইয়াটা শুধু একটু গল্প করতে এসেছিলো আমার সাথে। আমাকে তখন ওভাবে বসে থাকতে দেখেই ভাইয়াটা এগিয়ে এসেছে৷ দ্যাট্স ইট। ”
আবদ্ধ ভোরের হাত ছেড়ে দিলো। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ভোরের দিকে তাকালো৷ ভোরের যে হাতটা চেপে ধরেছিলো সেখানে ধীরে হাত বুলিয়ে বললো,
” সেই যাই হোক আমার ভালো লাগেনি৷ আর কোনো অচেনা না না আমি বাদে আর কোনো ছেলের সাথে হেসে কথা বলবি না। ”
বলেই অন্যদিকে চলে গেলো আবদ্ধ। ভোর অবাক হয়ে দেখে গেলো আবদ্ধর প্রস্থান নেওয়া। আবদ্ধ যে এমন পজেসিভ হবে ধারনার বাইরে ছিলো ভোরের।
.
আজ পাঁচদিন যাবত পাগলের মতো আবদ্ধকে কল করেই যাচ্ছে। যতবার কল দিচ্ছে ততবার ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে বলছে, আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন, তা এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিরক্তিতে ‘ চ ‘ সুচক শব্দ করে ফোনটাকে আছাড় মারলো বিছানায়। হুট করে আবদ্ধর এমন লাপাত্তা ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না ভোরের। চুল খামচে ধরে বিরবির করে বলে উঠলো,
” কোথায় তুই আবদ্ধ? আজ পাঁচটা দিন তোর কোনো খোজ নেই। পাগলের মতো কল দিয়ে যাচ্ছি আমি৷ আমাকে মনে পড়ছে না তোর? কেনো এতো কষ্ট দিচ্ছিস? অসহ্য লাগছে সব কিছু৷ তোকে ছাড়া আমার ভালো লাগছে না আবদ্ধ। ”
চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো ভোরের। যেই আবদ্ধ ওর সাথে কথা না বলে থাকতে পারতো না। এমনকি এইচএসসি পরিক্ষার সময়ও হাতে সময় নিয়ে ভোরকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসতো সেই ছেলেটা আজ পাঁচটা দিন কোনো খবর নিচ্ছে না তার। ভোরের কাছে আবদ্ধর পরিবারের কারো নাম্বার নেই বলেই এতো চিন্তা। আর না ভোর কখোনো আবদ্ধর বাসায় গিয়েছিলো। আবদ্ধ অনেকবার ভোরকে নিয়ে যেতে চাইলে ভোর নিষেধ করতো। বলতো,
” একবারে তোর হাত ধরে আমি আমার শ্বশুর বাড়ি যাবো। তখন তুই হবি আমার বর আর আমি তোর অর্ধাঙ্গীনী। ”
আবদ্ধ হাসতো। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলতো,
” ইনশাআল্লাহ! ”
এরপর কত মাস গেলো। দিন পেরিয়ে মাস, তো মাস পেরিয়ে বছর। আবদ্ধর আর কোনো খোঁজ পেলো না ভোর। প্রায় তিন মাসের মতো পাগলের মতো খুজেছে আবদ্ধকে। কিন্তু পেলো না। নাওয়া খাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছিলো ভোর। ভোরের এই হাল দেখে বাদল সাহেব চুপ থাকলেও শ্রাবন্তী চুপ থাকলেন না। মেয়েকে কেঁদে কেঁদে জিগ্যেস করেছে,
” কি হয়েছে তোর? মাকে বল। চোখ মুখ শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছিস। কেউ কিছু বলেছে তোকে? ”
মাকে মিথ্যে স্বান্তনা দিয়ে বুঝ দিলেও নিজের মনকে বুঝাতে পারতো না ভোর।
সময়টা তখন গোধূলি লগ্ন। পাখিরা তখন নিজ নিজ নিড়ে ফিরতে ব্যাস্ত। প্রকৃতি তখন কেমন নির্জীব হয়ে আছে। যেনো তারা ভোরের সাথে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টায় আছে। ভোর বারান্দার কেদারায় নির্জীব হয়ে হাটুতে থুতনি রেখে প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত। শ্রাবন্তী তখন সকালকে প্রাইভেট থেকে আনতে গিয়েছেন। টেবিলের উপর থাকা ফোনটা বেজে উঠায় সেখানে তাকালো ভোর। কল রিসিভ করে কিছু বলার আগেই ওপাসের ব্যাক্তিটির কথা শুনে হাত থেকে ফোন খসে পড়ে গেলো ভোরের। চোখে নামলো বাদলের মুষলধারের বৃষ্টির মতো পানি৷ আচমকা ভোর চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। জামা খামচে ধরে ফ্লোরে বসে কান্না করতে করতে বললো,
” তুই আমাকে এতো বড় ধোকাটা না দিলেও পারতি আবদ্ধ। আমাকে জানালি না তুই। এই তোর ভালোবাসার নমুনা ছিলো? আমি কখোনো তোর থেকে এটা আশা করিনি আবদ্ধ। আমার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে, আবদ্ধ। তোকে আমি কখোনো মাফ করবো না। কখোনো না। ”
কলটা করেছিলো ভোরদের ক্লাসমেট রিতু। রিতুর আপুর শ্বশুর বাড়ি আবদ্ধদের বাড়ির ঠিক দুই বাসার পর। ভোর তখন রিতুকে রিকোয়েস্ট করে বলেছিলো আবদ্ধর খোজটা তাকে জানাতে। তবে রিতু ব্যাস্ত থাকায় আবদ্ধর কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিল। আজকে হুট করে মনে পড়ায় ভোরকে কল দিয়ে জানালো, আবদ্ধ বিদেশে চলে গেছে৷ কানাডা তার মামার কাছে। সেখানে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে৷ ব্যাস এতোটুকু কথা শুনে আকাশ ভেঙে পড়লো যেনো ভোরের। আজ ছয়টা মাস পর আবদ্ধর খোজ পেলো। ভোর ভাবলো, এমন কি কারণ ছিলো যে ভোরকে না জানিয়ে অনত্র্য পাড়ি জমালো আবদ্ধ?
চলবে!