এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব-০৮

0
1234

#এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা
#লেখিকাঃতামান্না
#অষ্টমঃপর্ব [ স্পেশাল পর্ব ]

মেহরিন বাবুর পাশে শুয়ে আছে। ঘুম আসছে না তার কিছুক্ষণ আগেই শিমুর বাবা রুমে এসেছিল। শিমুর বাবাকে দেখে ভয় পেয়েছে সে। লোকটা শিমুকে আদর করে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। মেহরিনের ভাবনার মাঝে শিমু ঘুম থেকে জেগে গিয়েছে। জেগেই কাদতে শুরু করলো। মেয়েটার ডায়পার চেক করলো, প্রস্রাব করেছে সে। মেহরিন ডায়পার চ‍্যাঞ্জ করে দিয়ে শিমুকে ঘুম পাড়াতে লাগল। আর ভাবতে লাগল কালকের ঘটনা একটি মহিলা তাকে অনেকবার ডেকেছিল। কিন্তু তার বাবা তাকে কেমন ধমক দিয়ে উঠেছিল। মা আর ভাবী তাকে বের হতে দেয়নি ঘর থেকে,কে সেই মহিলা?

মহিলাটি আর কেউ নয় স্বয়ং আকাশের মা। আকাশের মা এসেছিলেন মেহরিনের সঙ্গে দেখা করতে, তার মনে হচ্ছিল তার ছেলের করা পাপ এই মেয়েটার জীবনে যেমন প্রভাব পরেছে ঠিক তেমনি প্রভাব পরবে তার পরিবারে, তারই কারন ধরে মেহরিনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। মেয়েটার এমন অস্বাভাবিক জীবনের কোন না কোন দিক থেকে তিনি ও দায়ী।ছেলের সঙ্গে মিলে তিনি ও কম অত‍্যাচার করেননি।অফিস করে যখন ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটু জিড়িয়ে নিবে তা আর হতো না। হালকা একটু ঘুম দিতে গেলেই ঠেস দিয়ে বলে উঠতেন –

” নবাবজাদী, নবাবের বেটির মত রুমের ভিতর ঢুকে গেলে চলবে?” ঘরে যে কাজ আছে কে সামলাবে?আমাদের সময় ঘর সামলাও, বাহির সামলাও কত কিছু করা যে লাগত! সারাদিন কাজ করে বিছানায় পিঠ লাগানোর সময়টাও পেতাম না।”

মেহরিন- “আম্মা আমিও তো ঘরের বাইরে যাই, ঘরে এসে কাজ করি।”

আকাশের মা – “আবার মুখে মুখে কথা বলছো! বাবার ঘর থেক কিছুই শিখায় নাই। আহারে আমাদের সময় আমরা একটা কথা বলতে কত ভয় করতাম, শাশুড়ির মুখের দিকে চেয়ে থাকতেও ভয় করতো। আর তুমি শাশুড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝগড়া করছো!”

আকাশ এই তর্কাতর্কির মধ‍্যে এসে ডুকে পরতো। অতঃপর মেহরিনের উপর চলতো এক অস্বাভাবিক মানসিক আর শারীরিক যন্ত্রণা।শারীরিক যন্ত্রণা যেমন তেমন মানসিক যন্ত্রণাটাই মেয়েটার জীবন ধ্বংস করে ফেলেছে। এই পাপের শেষ করতেই এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগেই মেহরিনের বাবা মঈন মির্জা তাকে ঘরের বাইরে থেকেই বের করে দিলেন। জানেন সব সম্পর্ক শেষ তারপরও মেয়েটা যদি চিনতে পেরে কিছু বলতো। কিন্তু মেহরিন তাকে একদন্ড ও চিনলো না।
_______________________________________
ঘুম থেকে জেগে গিয়েছে শিমু, ছোট ছোট হাত পা নাড়িয়ে মেহরিনের শরীরে সঙ্গে মিশে আছে সে। আর তার কালো চোখ জোড়া দিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে আছে।প্রতিদিন বাবার বুকের পাশে লেপ্টে থাকতো সে। সেখানে অচেনাএকজনকে দেখছে। দেখতে দেখতেই চিৎকার করে কাদতে শুরু করলো। মেহরিন ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে বলতে শুরু করলো

– “কি হলো আমার মা টার? কেউ কি মাকে মেরেছে?”
বকেছে? ওহ, খিধে পেয়েছে মায়ের?”
ছোট্ট শিমু তারদিকে চেয়ে কাদতে শুরু করলো। ময়না শিমুর কান্না শুনে চলে এসেছে।

ময়না-” ভাবী বাবুর মনে হয় খিধা লাগছে, আমার কাছে
দেন ফিডার বানাই দিমু আমি। ”

মেহরিন- ” ভাবী?”

ময়না- “কি যে কোন না ভাবী! ভাবীরে ভাবী কমু নাতো কি কমু? ভাইজানের বউ না আমনে!” ভাইজানের লগে আমনের কাল বিয়া হইছে!”

মেহরিন- ” আমার বিয়ে হয়েছে?” কার সাথে?”

ময়না- ” ও মা গো! ভাবী ভাইরে চিনেন না?”
মেহরিন মাথা দুলিয়ে না বুঝাতেই।

ময়না বেড সাইড টেবিল থেকে ছবিটা দেখিয়ে বলল –

“এইডা আমাগো ভাইজান! কি সুন্দর, লম্বা, এমন দৈত্যের লাহান বেডারে আমনের চোহে লাগে না! হায় হায় ভাবী!”

মেহরিন- “তাহলে বউটা?” বউটা কোথায়?”

ময়না- “বউ এই বাবুডারে জন্ম দিতে গিয়া মইরাগেছে।
এই জন‍্যই তো আমনেরে বিয়া করছে। আর বেশি কথা কইতে পারুম না ভাই যহন তহন আইয়া পরবো। দেন ওরে লইয়া যাই।

মেহরিনের মাথা কেমন ব‍্যাথা করছে। শিমুকে ময়নার কোলে দিয়ে সে বসে গেল খাটে।বারবার ময়নার কথাগুলো তার মাথায় এসে আঘাত করছে। তার সঙ্গে প্রচন্ড ভয় ও করছে। জোড়সড় হয়ে খাটের কর্নারে বসেছে সে।
____________________________________________

শাফায়েত রুমে এসে ডুকলো,

-” কি ব‍্যাপার নাস্তা করেননি?”
মেহরিন তাকে দেখে গুটিশুটি মেরে এককোণে বসে পরলো। শাফায়েত আরেকটু কাছে এসে চেয়ার টেনে বসতেই মেহরিন আরও জোড়সড় হয়ে বসে পরলো।

-” ভয় পাচ্ছেন?” মেহরিন ভিতু চোখে তারদিকে একবার নজর দিল।

-” আপনি আমার বর?”

শাফায়েত হাসলো,- “জী, আমি আপনার বর। ”

মেহরিন-” কাল বললেন না কেন?”

শাফায়েত – “সময় হয়ে উঠেনি, ” তা এই কথাটা কে জানালো আপনাকে?”

মেহরিন মাথা নিচু করে, বলল

-” ময়না বলেছিল,”

শাফায়েত – ” আমি চাইছিলাম আরেকটু সময় নিয়ে আপনাকে সব বলতে। হুট করে আপনার সাথে এই মুহূর্তে বোকামি হবে। আপনি আমাকে যেন না ভয় পান তার জন‍্য আমি আপনার সাথে আগেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চেয়েছিলাম। ”

মেহরিন-” বর কি কখনো বন্ধু হয়? বরেরা তো বন্ধু হয় না!”

শাফায়েত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাড়ালো, ওয়ালকাববোর্ড থেকে পোশাক নিতে নিতে বলল-

“বন্ধু অবশ‍্যই হওয়া যায়,যদি দুজনের মধ‍্যে সম্পর্কটা একআত্মার হয়। দুজনের বন্ডিং আন্ডারেস্টিং এক হয়।”
আমরা না হয় ছোটখাট চেষ্টা করলাম।”
মেহরিন শাফায়েতের দিকে নজর দিয়ে আবার চুপ করে বসে রইল। শাফায়েত অফিসের জন‍্য রেডি হতে লাগল আর সে আড়চোখে শাফায়েতকে দেখতে লাগল।

_________________________________________

হোটেল স্কাই ব্লুতে এসেছে আকাশ আর শীলা। পাচঁতারকা এই হোটেলটিতে প্রায় সময়ই দুজন মিলে আসে। আজও এসেছে অন‍্যদিনের মত, অফিস টাইম পেরিয়ে আকাশ চলে এসেছে একটু আগেই শীলা তার দশমিনিট পর এসেছে। দুজন মিলে রুমে ঢুকে নিজেদের মধ‍্যে অবলীলায় যখন কথা বলায় আর আবেগী মুহুর্তে ব‍্যাস্ত ঠিক সেই সময় দরজায় কড়া নেড়ে উঠলো।
চরম বিরক্ত হলো আকাশ, মেজাজ তার চড়া হয়েগেছ‍ে।
একবার,দুবার, তিনবার, নয় পাচঁবার। আকাশ চিন্তা করতে লাগল বেরিয়েই ওয়েটারকে উচিৎ শিক্ষা দিবে।
শার্টের বোতাম কিছু লাগিয়ে অর্ধেক খোলা অবস্থায় দরজা খুলেই বিকট জোরে গালি দিয়ে উঠলো, সঙ্গে একটা হাত তুলতে নিলেই সামনে থেকে তার হাত ধরে ফেললো একজন পুলিশ অফিসার। আকাশ তার সামনে দাড়ানো পুলিশকে দেখে তার পিছনে চেয়ে দেখল আরো কিছু পুলিশ দাড়ানো। আকাশ ভেবে পাচ্ছে না কি হচ্ছে এসব।

সামনের অফিসার, সাব- ইনস্পেক্টর আফজাল তার হাতে হাত কড়া পরিয়ে দিলেন। বলে উঠলেন –

– শার্টের বোতাম ঠিক নেই, একটা বাজারের মেয়ের সঙ্গে একরুমে অবৈধ ভাবে রয়েছেন এবং দরজা বারবার নক করার পরও খুলেননি। আবার একজন পুলিশ কর্মকর্তার গায়ে হাত তুলতে এসেছেন। তাও ইউনিফর্ম পরা অবস্থায়। একসাথে এতগুলো অপরাধ কি করে মাফ করি বলুনতো?

আকাশ -” আমাদের অবৈধ কোন সম্পর্ক নেই আমরা বিবাহিত।”

আফজাল-” থানায় গেলে বিবাহিত না অবিবাহিত তা বুঝা যাবে। বলেই আকাশের শার্টের কলার ধরে টান দিয়ে ছিড়ে ফেলল।” শীলা গুনগুনিয়ে কাদছে, একটু পরেই হয়তো মিডিয়া বা সোশ্যাল সাইডে তার ভিডিও ছড়িয়ে পরবে। শীলা মুখ ঢাকতে চাইলে মহিলা কন্সটেবল তার মুখ থেকে ওড়না টেনে নিয়ে নিল। লজ্জায় শীলা তাদের পায়ে পরেগেল। কিন্তু কোন লাভ হল না হোটেল থেকে টেনে হিচড়ে বের করা হচ্ছে দুজনকে। কেউ কেউ মোবাইল বের করে ছবি তুলছে। শীলার কান্না যেন আরও বেড়ে গিয়েছে।

আফজাল ওদের গাড়ির পিছনে উঠিয়ে দিয়ে , নিজে সামনের সীটে বসে পরলো। ফোনে রিং হতেই ধরলো সে।
সঙ্গে সঙ্গে ব‍্যাস্ত কন্ঠে একজন বলে উঠলো –

” কিরে কাজ কি হইছে?”

আফজাল- “হুম, দুইজনকে এখন থানায় নিচ্ছি, তুই চিন্তা করিস না! বাসায় আছিস, ছুটি কাটা ঠিক আছে।”

“হুম, আমাকে জানিয়ে দিবি ওখানে কি হচ্ছে।”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে