#এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা
#লেখিকাঃতামান্না
#সপ্তমঃপর্ব [ শুভ বিবাহ ]
মাথার উপর প্রকান্ড আকাশ, বিশাল এই আকাশ জুড়ে
কত রঙ্গের পাখি উড়ে যাচ্ছে, কত মেঘ উড়ে উড়ে ভেসে ভেসে এদিক ওদিক যাচ্ছে। সেই আকাশে চেয়ে আছে মেহরিন, খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, কিছুদিন ধরে বিয়ের আলোচনা চলছে, কার বিয়ে ভেবে পাচ্ছে না সে।
বিয়ের কথা বললেই মাথা তার ব্যাথা করে উঠে।
বিয়ের কথা মনে হলে শরীরটা কেমন কেপেঁ উঠে অজানা ভয়ে। ভেসে উঠে পুরোনো স্মৃতি! -“আবার কোন সর্বনাশের পুনরাবৃত্তি!”
মেহরিনের ছোট ভাই মেহেদী এসেছে, সাব- ইন্সপেক্টর সে, কাজ কর্ম নিয়ে ব্যাস্ত থাকতে হয় সব সময় ।
চট্টগ্রামের মিরশরাই থানাতে কয়েকমাস আগে বদলী হয়েছে সে। ছোটবোনের বিয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে।
এসেই বাবার সঙ্গে রাগারাগি করেছে একদফা। তার বোনের সঙ্গে এত কিছু হয়েগেছে অথচ বাবা সেই কালপ্রিটকে ধরিয়ে না দিয়ে উপর ওয়ালার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। মেহেদী আকাশের ব্যাপারে যা তথ্য আছে সব যোগার করতে লাগল হাজার হোক আকাশের এই জগন্য অপরাধ মাফ করে দেওয়ার মত না।
_______________________________________
শাফায়েত ড্রয়িং রুমের সোফাতে চুপচাপ বসে আছে।
হবু স্ত্রীকে এখনও সে দেখেনি। তার সাথে আগ বাড়িয়ে দেখাও সে করেনি, তারমতে মেহরিনকে অযথাই বিরক্ত করার প্রয়োজন নেই। পাশের সোফাতে বসে আছে মেহেদী নতুন জামাইয়ের সঙ্গে তার বন্ডিংটা খুব ভালোই,
সম্পর্কে ছোটবোনের জামাই হলেও মেহেদীর থেকে বয়সে বড় শাফায়েত। দুজন দুজনের পেশা নিয়ে গল্প করতে লাগল। শাফায়েতের মামা, মামাতো ভাই, চাচারা সবাই এসেছে। যেহেতু শাফায়েতের বাবা, আর তার বড় কোন ভাই ও নেই। পুরুষেরা সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। কাজি ডেকে এনে খুব সুন্দর আর সুশৃঙ্খলভাবে ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হয়েগেল। মেহরিনকে যখন বিয়ের কাগজে সাইন করতে বলা হয় সে নির্দ্বিধায় সাইন করে দেয়। সে না জানলেও উপস্থিত সবাই জানে মেহরিন আজ নতুন সম্পর্কে জড়িয়েগেছে।
সাইন করানোর পর মেহরিনের নানী শাশুড়ি কোথা থেকে ছোট্ট শিমুকে কোলে করে নিয়ে এসেছেন। শিমুকে মেহরিনের কোলে দিয়ে দিলেন। শিমু নানুমার কোলে হাতপা ছড়িয়ে কাদলেও নতুন মায়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। কান্না বন্ধ করে মেহরিনের ঘাড়ে তার মাথা ঘষতে লাগল। চোখগুলো আঙ্গুল দিয়ে একদম ঘষে ঘষে একবার সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার মেহরিনের বুকে লুকাচ্ছে। মেহরিন বুঝলো ঘুম পাচ্ছে তার, সে ও পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে বাচ্চাটার পিঠে হালকা করে চাপড় দিতে লাগল। সুলতানা বেগম পাশে এসে বসলেন –
” মা মেহরিন তুমি দেখেছো তো, আল্লাহ তোমার কোল থেকে দুটো সন্তান নিয়েছেন, স্বরযন্ত্রের কারনেই তারা নেই দেখো আজ আবার তোমার কোলে আরেকটি শিশু এসেছে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে সুখ দুঃখ সবকিছুই থাকে।
“মানুষ হিসেবে যখন এই পৃথিবীতে এসেছো সুখের স্বাদ, দুঃখের জল, আর মৃত্যর স্বাদ তোমাকে পেতেই হবে!”
কেউই চিরস্থায়ী সুখি হয় না, কারোর জীবনই চিরস্থায়ী দুঃখের হয় না। প্রত্যেকটা সময় প্রত্যেকটা পদে সুখ, দুঃখ মিশ্রিত পথ অতিক্রম করতে হয়। আজ দেখো তোমার মত অনেক,অনেক মেয়ে আছে প্রতিবাদ করতে পারেনা! আবার অনেকের পরিবারের লোকজন তোমার বাবা, মা, ভাই, ভাবীদের মত লড়াই করতে জানেনা। তাদের জীবনটা অনেক কষ্টের হয়। আমি নিজে দেখেছি এমন অনেক পরিবারকে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে চলেছি, তুমিও চলেছো হয়তো তাই কিছুটা হলেও বুঝেছো। আমি চাই তুমি আমার পরিবারের লক্ষীমন্ত বউ হয়েই এসো। ”
মেহরিনের মা ইশারা করলেন সুলতানা বেগমের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে। মেহরিন করতে গেলেই,
-” ইশশ কি করছো, ছুয়ো না! এসো বসো বসো! পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হয় নাকি! বসো আমার নাতনি মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে ওকে খাটে শুইয়ে দেও। ওতো এখন তোমার মেয়ে। ” মেহরিন শিমুকে খাটে শুইয়ে দিল। মেয়েটা মেহরিনের শাড়ির আচল হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে আছে। ছাড়তে চাইছে না, মেহরিন ঘুমন্ত মেয়েটির মুখে আর কপালে অসংখ্য চুমু দিল। তার সন্তান! আজ থেকে তার একার সন্তান! কেউ তার সন্তানকে তার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না।বুকের মধ্যে আগলে রাখবে সে এই রত্নটাকে।
_______________________________________
কিছুক্ষণ আগে মির্জাবাড়ী থেকে এসেছে সবাই, মেহরিনকে শাফায়েতের রুমে রেখে আসা হলো। মেহরিনের কোলে তখন ও ঘুমন্ত শিমু। খাটে শুইয়ে দিয়ে বাচ্চা মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে আছে সে। কি মায়া এতটুকু বাচ্চা মেয়ের মুখে। শিমুকে দেখা হলে সে পুরো রুমে একবার চোখ বুলালো, খাটের পাশে বেডসাইড টেবিলের উপর দম্পতির ছবি দেখা যাচ্ছে। পাশের জন কে সে দেখেছে, এতো কিছুক্ষণ আগে ওর সঙ্গে একই গাড়িতে ছিল!
-ও এই কি বর?
– বউটা কোথায়?
– বউ নেই, বর আছে!
– না বউ ও আছে! কিন্তু কোথায় আছে?
শাফায়েত ভিতরে প্রবেশ করলো, মাথা নিচু করে আছে মেহরিন। শাফায়েত হাতের ঘড়িটা ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বলল –
শাফায়েত -” আপনার কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?”
মেহরিন- ” না,”
শাফায়েত – “ঠিক আছে, তাহলে চলুন রাতের খাবার খেয়ে আসি, মেহমান কিছুটা কমেছে!”
মেহরিন উঠে দাড়ালো।”
ছবিটির দিকে চেয়ে বলে উঠলো –
” ঐ বরটা বুঝি আপনি?”
শাফায়েত হেসেদিল -” হুম আমি,”
মেহরিন- “বউটা আপনার?”
শাফায়েত- ” হুম, বউটা আমার ছিল, তবে এখন নেই ”
মেহরিন- “কেন?”
শাফায়েত – “পরে বলবো,”
মেহরিন- “আচ্ছা ঠিক আছে,”
মেহমান চলে যাওয়ার পর, মোটামুটি ফাকাই আছে পুরো বাড়ি। আত্মীয়স্বজন কেউই তেমন ছিল না। ছিল শুধু আশেপাশের বাড়ির কিছু মানুষ। এর বাইরে তেমন কেউ ছিল না। থাকার মধ্যে শাফায়েতের দূরসম্পর্কের জেঠি ছিলেন যিনি মেহরিনকে আগা গোড়া তীক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করছেন।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে, পানের বাটা নিয়ে বসলেন সোফায়।
মুখে এক খিলি পান ঢুকিয়ে ফোলা মুখে বলে উঠলেন-
জেঠি-“তা শাফায়েত এর মা, বউর কি সমস্যা আছিলো? বাঞ্জা আছিলো নাকি?”
সুলতানা বেগমের কাছে বিরক্ত লাগল এমন কথায়।
বড় জা বিধায় মুখে আসা কথাটা হজম করে বললেন –
” না ভাবি ও রকম কোন সমস্যা নেই।”
-” ও তাইলে কি শাশুড়ির লগে বনতো না? তাইলে কইলাম দেইখা রাইখো তোমার অজ্ঞা পোলা!” এই সমস্ত মাইয়া গুলান ভালা না!”
– “ভাবী আমার ছেলের বউ ইনশাআল্লাহ আমার মতই হবে।”
– “সব কথা ফালান যায় না! এক ছেলের মায়ের দুঃখ থাকে বেশী! এরুম কত দেখছি, পরে যে ছেলের মা এইসব কথা কইতো হের ও ঘর নাই, আর ছেলের ও মায়ের কথা মনে নাই।”
-” আমার ছেলে মাকে ও চিনে, বউকে ও চিনে! কিভাবে চলতে হয় ওটাও সে জানে।”
জেঠি গাল টাকে ডানে বামে ভেংচি কেটে চলেগেলেন।
সুলতানা বেগম সেদিকে নজর দিলেন না। গ্রামের মানুষদের কৌতুহল, আর কথায় কথায় উল্টোপাল্টা মন্তব্য চলতে থাকবেই।
_______________________________________
মেহরিন বাবুর পাশে শুয়ে আছে। ঘুম আসছে না তার কিছুক্ষণ আগেই শিমুর বাবা রুমে এসেছিল। শিমুর বাবাকে দেখে ভয় পেয়েছে সে। লোকটা শিমুকে আদর করে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। মেহরিনের ভাবনার মাঝে শিমু ঘুম থেকে জেগে গিয়েছে। জেগেই কাদতে শুরু করলো। মেয়েটার ডায়পার চেক করলো, প্রস্রাব করেছে সে। মেহরিন ডায়পার চ্যাঞ্জ করে দিয়ে শিমুকে ঘুম পাড়াতে লাগল। আর ভাবতে লাগল কালকের ঘটনা একটি মহিলা তাকে অনেকবার ডেকেছিল। কিন্তু তার বাবা তাকে কেমন ধমক দিয়ে উঠেছিল। মা আর ভাবী তাকে বের হতে দেয়নি ঘর থেকে,কে সেই মহিলা ?
চলবে।