#এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা
#লেখিকাঃতামান্না
#তৃতীয় পর্ব
ডাক্তার ইভা- “আন্কেল আপনি বুঝতে পারছেন না?
ওর মস্তিষ্কে এই গঠনার এতই প্রভাব পরেছে যে এখন ও মানসিক রুগী হয়েগেছে। ওকে একজন ভালো সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সিলিং করান আপনারা,
ইমেডিয়েটলি যা করার করুন। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আপনারা মেহরিনকে কোনভাবেই সুস্থ করতে পারবেন না। ও এমনিতেই দূর্বল, দুবার অপারেশন, অফিসের কাজের চাপ! সাংসারিক চাপ, তারপর আবার স্বামীর দিনের পর দিন অত্যাচার মেয়েটাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিয়েছে।”
মেহরিনের ভাইয়ের বুকের উপর দিয়ে যেন বিরাট বড় রকমের পাথর কেউ চাপিয়ে দিয়েছে। কি ভাবে এত কিছু হয়েগেল মেয়েটার সাথে। এত অমানুষ ও আজকাল আছে?
মেহরিনের বাবা স্তব্ধ! মেয়েটার বিয়ের সময় কত আশা করে দিয়েছিলেন। মেহরিন চেয়েছিল অন্তত বিসিএস টা দিয়ে ভালো কিছুতে চান্স পাওয়ার পর কোথাও কিছু করতে। তারপর বিয়ের কথা না হয় পরে ভাবলে হতো।কিন্তু এতে অনেকটা বেকে বসলেন তিনি, বিয়ের পর যা করার করো মাস্টার্স তো শেষ! ভালো ব্যাংকে চাকরি করছে তাহলে আর সমস্যা কি? বিয়ের পর না হয় পড়াশুনায় মন দিবে!সেখানেই তো তিনি চরম রকমের বোকামি করে ফেললেন! মেয়েটার স্বপ্নভঙ্গ করে দিলেন, আজ নিজের কাছেই যেন বড় অপরাধি হয়েগেলেন তিনি।
ডাক্তার ইভা-” আন্কেল আমি কি বলছি তা শুনতে পারছেন?”ডাক্তার ইভার কথায় ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। চোখে তার অশ্রু! চোখ মুছে, ইভার দিকে তাকালেন। ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলেন –
“বলো মা কি করতে হবে আমাকে? আমার মেয়ের জন্য আমি সব করতে রাজি! তোমরা শুধু বল মেয়েটা আমার আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে তো?”
ডাক্তার ইভা- জ্বী ফিরবে, ওর সমস্যাটা তেমন বেশি সিরিয়াস ও নয় আবার হেলাফেলা ও করা যাবে না।
তাই বলছি ভালো কোন সাইকোলজিস্টের মাধ্যমে সমস্যা টা সমাধান করুন।
মেহরিনের বাবা আর ভাই উঠে দাড়ালেন। দাড়াতে ও খুব কষ্ট হচ্ছে তাদের। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে মেহরিনের কেবিনের সামনে এলেন। মেহরিনের মা মেয়ের জন্য বসে আছেন সীটে। কখন কি হয়, মেহরিন ঘুম থেকে জেগে আবার কোন কান্ড গঠায় তার জন্যই ভিশন চিন্তায় ছিলেন তিনি।
কেটেগেল দুটো দিন, হাসপাতালের কেবিনে থাকতে থাকতে মেহরিন বিরক্তবোধ করছে অনেকটা। একটু
পরপর নার্স ও আয়াদের দেখলেই বলছে –
“আমি বাড়ি যাবো! আমার না দুটো বাবু আছে!
তোমরা দিবে আমাকে যেতে?”
ডাক্তার আর নার্সগুলো তখন কোন জবাব দিতে পারেনা। মেহরিনকে শান্ত করে বেরিয়ে যায় তারা। কি জবাব দিবে তারা? দুটো বাচ্চা, বাবু, এটা সেটা বলে যেই মেয়েটা পাগলামি করছে সে নিজেও হয়তো ভুলে গেছে।
বাচ্চাদুটোর একটি ও এই পৃথিবীর বাসিন্দা নয় এখন!
অনর্থক মিথ্যে আশ্বাস দিয়েও তো লাভ নেই।
হাসপাতালে যখন কোন বাচ্চার চিৎকার সে শুনতো।
অনেকটা হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠার চেষ্টা করতো।
কখনো বা বলতো – “আমার বাবুটার কাছে নিয়ে যাবা?
বাবুটা কাদছে! মাথার চুলগুলো সব যেন ছিড়ে ফেলবে সে।”
তাই ডাক্তার ইভার কথামতো তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
_______________________________________
আকাশ সেদিনের পর আর আসেনি। তারমতে এখনই সুযোগ বুঝে মাকে গলানোর। এখন তো মেহরিন ও অসুস্থ, মেহরিন আর সুস্থ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
আর মাকে বুঝিয়ে বললে মা হয়তো মেহরিনকে আর এই বাড়িতে রাখতে চাইবে না। তাই সে ভেবেনিলো যেভাবেই হোক সে মাকে রাজি করিয়ে ফেলবে।
এখন শুধু ডিভোর্স পেপারটা রেডি করার বাকি!
মেহরিনের বাবা তাকে কাল কল করে জানিয়ে দিয়েছেন
খুব শিঘ্রই ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবেন তিনি। মেয়েকে আর শেষ হতে দেখতে পারবেন না। যে ভুল তিনি করেছেন সেই ভুল তিনি সংশোধন করে ফেলবেন।
আকাশ এ নিয়ে কিছুই বলেনি, মেহরিনের বাবা নিজ থেকে ডিভোর্স করাবেন এতে তার ঝামেলা কমলো।
মেয়েতো পাগল তাকে দিয়ে আর কি লাভ হবে! চুলোয় যাক সব!
বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে মেহরিন। চোখ তার পাশের বিল্ডিং এ দাড়ানো একটি মেয়ে আর তার কোলে থাকা বাচ্চাটির দিকে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে।অনেকক্ষণ ধরে বাচ্চাটি চিৎকার করে কেদেঁ চলেছে।মেহরিন বেলকনি থেকে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে হাতের ইশারায় ডাকছে। মেয়েটি তাকে যেন একদমই দেখছে না। মেহরিন এবার ডেকে উঠলো সেই মেয়েটিকে –
“এই শুনছো! এই মেয়ে! শুনো না ওকে একটু দিবে আমার কাছে? দাও না,
– মেয়েটি শুনার জন্য আরেকটু কাছে এসে দাড়িয়ে পরলো। আর বলল -” কি কন আফা শুনি! ”
” আরে বলছি ওকে একটু নিয়ে আসো না!.”
– “আমি পারুম না, ভাইজান আমারে বকবো! ”
মাথা চুলকে মেহরিন হেসে বলে উঠলো- “তোমার ভাইজানকে আমি মেরে দিবো!”
মেয়েটি এই কথা শুনে হেসে, আরেকটু কাছে এসে বললো – “ভাইজানের মেলা রাগ বুঝছেন, এই বাবুটার ও মেলা রাগ! হের মত হইছে! আমি পারুম না নিতে। আমনে আইয়া নেন ” বলেই মেয়েটি ভিতরে চলেগেল।
মেহরিন মেয়েটির চলে যাওয়া দেখতে লাগল। মেয়েটি অনেকবার ডাকলো। কিন্তু মেয়েটি একবার ও তার দিকে ফিরলো না। কিছু একটা মনে পড়তেই মেহরিন বেলকনি ছেড়ে দৌড়ে মেইন দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। বিকেলের এই সময়টা সবাই ঘুমেই থাকে। তাই কেউ নজর দিতে পারেনি। মেহরিন নিচে গেইট খুলে দেখলো তার ভাই দাড়িয়ে আছে।
মাহিন- “মেহরিন তুই এখানে? তোর শরীর তো খারাপ, কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
মেহরিন-” বাবুটাকে নিয়ে আসতে, ঐ বাবুটা কাদছে ভাইয়া!”
মাহিন বুঝলো মেহরিন বাচ্চা দেখে আবার পাগলামি করবে। তাই মাহিন তার হাত ধরে বললো-
মাহিন-“বাবুকে এখন দেখতে যাওয়া যাবে না।
-” না,আমি যাবো! দেখিসনি ও কিভাবে কাদছে?
মাহিন- “সম্ভব নয় তুই চল আমার সাথে। ”
মেহরিনকে জোড় করে ঘরে এনে বসিয়ে দিলেন। আর সবাইকে ডেকে বলেদিলেন মেহরিনের বাইরে বের হওয়ার কথা।
মাহিন মেইন দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। মেহরিনের রুমে ভিতর যত ধরনের কেচিঁ,ছুরি, আঘাত করার মত সব জিনিস বের করে মেহরিনকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
মেহরিন চিৎকার করে কাদছে আর বলছে -” তোমরা আমাকে বাধা দিও না! আমাকে যেতে দাও, ও আমার সন্তান! ও আমার, ও কাদছে! ”
মাহিন- “ও তোর বাচ্চা না!”
মেহরিন – “রুমের সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে, আমি মানি না! ওকে তোমরা নিয়ে আসো। মেহরিন সারাটাদিন কেদেছে, একটু ও থামেনি।
মাহিন রাতের বেলায় মেহরিনের রুমের দরজা খুলে ঢুকে দেখলো মেহরিন ফ্লোরে পরে আছে। মেহরিনের পাশে বসে ডাকতে লাগলো মাহিন।
মেহরিনের ভিজে যাওয়া চোখ দুটো দেখে মাহিনের বুক কেমন কেপেঁ উঠলো। মেহরিন ভাইকে দেখে আবার ডুকরে কেদেঁ উঠলো।
” কাদতে কাদতে ক্লান্ত মেহরিন মাহিনের পা চেপে ধরলো।
চেপে ধরে বলতে লাগল –
” আমার বাবুটাকে এনে দেয় না ভাই!”
” আমার কলিজাটাকে এনে দেয়!”
বিড়বিড় করে কিসব বলতে বলতে মাহিনের পায়ের কাছেই পরে গেল সে। মাহিন ও আজ যেন পুরোপুরি নির্বাক। মেহরিনকে বুকে জড়িয়ে ধরলো সে।
চলবে।