#এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা
#লেখিকাঃতামান্না
#ত্রয়োদশঃপর্ব
– কোথায় ভুল? আমি ও চাকরি করতাম, আমার একটা
মাত্র সন্তান তুমি জানো আমার শাশুড়ি আমার বাসায় আমার ছেলেকে মানুষ করেছেন। ঘর সামলিয়ে আমি বাইরে যেতাম। আমার স্বামী ব্যবসার কাজে বিভিন্ন যায়গায় চলেযেত। আমিই সব সামলাতাম কোথায় আমার শাশুড়ি তখনকার মহিলা হয়েও অত কথা শুনাতেন না , শাফায়েত হওয়ার পর ওকে স্কুলে ভর্তির পর আমি আবার প্রাইমারিতে জয়েন করি। এভাবে করিনি! শুনো সংসারি মেয়েরা সবকিছু আগে থেকেই সামলে নিতে জানে। আমার বউমাকে ও আমি ওমন ভাবেই গড়ে তুলবো!”রত্না বেগম যেন তব্দা খেয়েগেলেন! এ কেমন শাশুড়ি?
অনেকটা কথায় না পেরে উঠে চলেগেলেন তিনি। কথায় পারা যায় না সুলতানা বেগমের সঙ্গে। খুবই দূর্ত মহিলা!
মেহরিন অফিস থেকে এসেছে মাত্র মাথা তার ধরে গিয়েছে। আগে ব্যাংকের চাকরি ছিল, আর এখন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র এক্সকিইউটিভ অফিসার হিসেবে জয়েন দিয়েছে। সবার সঙ্গে সারাদিন পরিচয় হতে হতে, আর কাজ বুঝে নিতেই সময় লেগে গিয়েছে তার। অফিসের সবাই খুব মিশুক ছিল, সবাই কাজ সেরে তার সঙ্গে সখ্যতা ও গড়ে তুলেছে নিজেদের মত।
মেহরিন সোফায় বসা মাত্রই উপর থেকে শিমুর কান্না শুনতে পেল। কোথায় তার বিশ্রাম কোথায় তার অফিসের চিন্তা , সব বাদ দিয়ে মেয়ের কাছে ছুটে গিয়েছে সে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে শিমুকে কোলে করে বলে উঠলো
-” কি মা! মা টাকে কেউ আদর করে না?”
শিমু কেদে দিয়ে মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো – “না! না! ” মেহরিন অবাক হয়েগেল মেয়ের কথায়।
শিমুর এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট কিছুই উচ্চারণ করতে পারার কথা নয়। যেখানে অনেক বাচ্চারা এই বয়সে মুখে দা,দা, দা, বা, বা, বুলি আওরাতে সময় লেগে যায়।
মেহরিন শিমুর গালে আদর করে বলল
– “একবার মা বলে ডাকতি মা! ডাক না মা! বল -মা, মা”
শিমু মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে কি বলছে মা তাকে। মেহরিন সেদিন সারাদিন আরও বেশি খুশি হয়েছিল শিমু তাকে মা ডাকবে। মেয়েটার মুখে বুলি ফুটবে, প্রথম বুলি উচ্চারিত হবে -” মা নামের এক ঐশ্বর্য পূর্ণ ডাক! এক পরিতৃপ্তময় ডাক। যে ডাক শুনলে প্রত্যেকটি নারীর শরীরে আলাদা শিহরণ বয়ে যায়।
___________________________________
আকাশের জেল থেকে মুক্তির দিন আজ, পাচঁ মাস জেলে থাকার পর ছাড়া পেয়েছে কেউ আসেনি দেখতে।
না কেউ কেসটা চালাতে চেয়েছে। মামলা মকদ্দমায় পরে জেলেই ছিল সে। প্রথম প্রথম আকাশের খুব রাগ লাগত! মনে হতো সবঠিক হয়ে যাবে, সব গুছিয়ে নিবে সে কিন্তু এখন সে নিজেই তিক্ততায় যেন ডুবে গিয়েছে।
জেল থেকে পুরোনো পোশাক পরে বেড়িয়ে গেল। পকেটে হাত দিয়ে দেখে মাত্র একশো টাকার নোট!
প্রথমেই আকাশের মুখ দিয়ে গালি বেড়িয়েগেল। যেই পকেটে পাচঁহাজার ছয় হাজার থাকতো এখন সেখানে মাত্র একশো! গেট থেকে বেড়িয়ে সামনে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে একটা লোকাল বাসে উঠেগেল সে।
বাড়ি পর্যন্ত না গেলেও রাস্তায় নামিয়ে দিলেই হয় বাকিটা পথ হেটেই যেতে পারবে।
সারাপথ বাস দিয়ে আসার পর, হেটে হেটে এসেছে সে। পথে যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রত্যেকের নানা ধরনের প্রশ্ন! কেউ বা নাক মুখ কুচকাচ্ছে। এলাকা অবদি এসে যেন আরও অবাক হয়েগেল সে! এখানকার লোকজন তার সঙ্গে কথা তো দূর, কেউ যেন ফিরে ও তাকাচ্ছে না।
কিছুদূর যেতেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হলো আকাশ। বাড়িটা কেমন সাজানো গুছানো হচ্ছে, নতুন নতুন লোক, সবাই বাড়ি গুছিয়ে রাখছে। আকাশ সামনে যেতেই একজন তার সামনে দাড়ালো।
আকাশ তাকে দেখে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল –
” আপনারা কি নতুন ভাড়াটিয়া?”
-” নতুন ভাড়াটিয়া না বাড়ি ওয়ালা!”
আকাশ অবাক হলো, বলল
-” কি বলছেন?”
-” আরে ভাই আমরা বাড়িওয়ালা!”
-” আপনারা বাড়িওয়ালা কেমন করে?”
-“আজব, এই তো দু সপ্তাহ আগে এই পুরো জায়গা ও বিল্ডিং আমি কিনেছি, দাম একটু কম ছিল! সস্তায় পেয়েছি কিনেছি! পুরো বাড়ির দাম তিন কোটি উঠত প্রায়! ওখানে মাত্র তিয়াত্তোর লাখ পরেছে।কিন্তু সবগুলো ফ্ল্যাট নাকি আগেই বিক্রি করে ফেলেছে। শুধু জায়গা আর তিনতলার একটা ফ্ল্যাট পেয়েছি! এটা নাকি পাচঁতলা ফাউন্ডেশন করা! তিনতলা পর্যন্ত আগের বাড়িওয়ালারা ছিলেন। দ্বিতীয় তলাটার ফ্ল্যাট নাকি বিক্রি করে দিয়েছে। আর রইল বাকি দুই তলা ফাউন্ডেশন। ওটা করলে ক্ষতি আর হবে কি!”
আকাশের মাথায় যেন বিরাট বড়সড় বাজ পরেছে। বাড়িটাও হাত ছাড়া হয়েগেল!
-”বাড়ির আগের মালিকরা কোথায়?”
-” ছেলের নাকি চরিত্র ভালো না, জেলে আছে। মা অসুস্থ, মা নাকি বলছে জায়গা বিক্রি করে ফেলতে।
এখন এই জন্য জায়গা বিক্রি করছে এতটুকুই জানি এর বেশি কিছুই জানি না। ওনারা বলেই যায়নি ঠিকানা!
আর শুনছি সম্পত্তি নাকি মেয়ের নামে দেওয়া হবে।”
আকাশ বুঝলো আয়েশা সবই হাতিয়ে নিয়েছে। আকাশ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কিছুদূর এসে ফোন নিল হাতে, শীলার মোবাইলে ফোন করল শীলা ও তো জেলে ছিল।
শীলা যদি ছাড়া পায়! শীলাকে ফোন করার পর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।
শীলা তার ফোন আগেই বন্ধ করে ফেলেছে। সেই সিম থেকে শুরু করে সব বন্ধ শীলার। জেলে থাকা অবস্থায় জেলার সাহেবা আফসানা আইয়ুব তার সঙ্গে কথা বলেছিল। আফসানা আইয়ুব খুব নরম ও দয়ালু মনের মানুষ। শীলার অন্যায় এবং নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হওয়া সব কিছুই তার চোখে পরেছে। জেল থেকে ছাড়া পাবার পরপরই তাকে একটি এনজিওতে কাজ দিয়েছেন তিনি। আফসানা আইয়ুব বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। সমাজের নানারকমের কর্মসূচিতে তিনি অংশ গ্রহণ করেন তাই তিনি জানেন কিভাবে কাকে কোথায় কাজে লাগাতে হয়।
_________________________________________
“শাফায়েত ছাদে এসেছে, পাশে মেহরিন। শাফায়েত আর মেহরিন আর পাচঁটা স্বামী স্ত্রীর মতই স্বাভাবিক ভাবেই জিবন ধারণ করলেও তাদের মধ্যে এখনো স্বামী স্ত্রীর গভীরতায় এখনো পৌছায়নি। শাফায়েত যেন কোন একটা জায়গা থেকে বাধা পায়! বাধা বলতে সম্পর্কটা আগাতে তো পেরেছে তবে পুরোনো স্মৃতি আর প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে দুজনের একজন ও ভুলেনি। মেহরিন হয়তো আকাশকে ভালোবাসতো কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা ঘৃণায় পরিনত হয়েছে। অপর দিকে শাফায়েত তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সারাজীবন কাটানোর প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিভাবে অন্য কাউকে সেই স্থান দিবে? দোটানায় পরতে তার ভালো লাগেনা অস্বস্তি লাগে!”
” মেহরিন সবই বুঝে, লোকটি যথেষ্ট ভালো মনের মানুষ! এমন মানুষ হয়তো এত সহজে পাওয়া যায় না। কত পুরুষ বিয়ের পর সন্তান ভুলে গিয়ে নতুন স্ত্রীকে নিয়ে পরে থাকে আর এই লোক দীর্ঘ চারমাসের সম্পর্কে একদিন ও তাকে ইচ্ছাকৃতি ভাবে ছুয়েও দেখেনি। নামাজ পরে স্ত্রীর জন্য কাদতে অনেক পুরুষদের কথা সে শুনেছে। কিন্তু তার সামনে বাস্তবে এমন পুরুষ পরবে সে ভাবতেও পারেনি। মাঝে মাঝে মনে হয় ভাগ্য হয়তো একেই বলে যে স্ত্রীর জন্য স্বামীর ভালোবাসাময় অশ্রুসিক্ত নয়ন সে স্ত্রীই তো আসল ভাগ্যবতি!
মেহরিনের গভীর ভাবনা আর আশপাশের নিরাবতা কাটিয়ে শাফায়েত বলল-
” কি ভাবছেন?”
-” কিছুই না,”
-” কিছুই না?”
-” না!”
-” আচ্ছা আমি কি স্বামী হিসেবে ব্যার্থ? এই যে এতমাস একটা মানুষের সঙ্গে এক ছাদে রয়েছেন অথচ স্বামী হয়েও আমি আপনার কাছে একদিন ও আসিনি। আপনার বিরক্ত লাগেনা? ”
-” অস্বাভাবিক বা বিরক্তি লাগার মত আপনি কিছুই করেননি। আপনার মধ্যে আমি তেমন কিছুই দেখিনি।
বরং আমি বলবো আমি আপনার আচরণে মুগ্ধ হয়েছি।”
কথাটা আপন মনে বলে মেহরিন দাত দিয়ে জ্বীভ কাটলো। হঠাৎ করে মুখ ফোসকে সত্য কথা বলে ফেলেছে সে।
শাফায়েত অবাক হয়ে চেয়ে আছে মেহরিনের দিকে।
মেহরিনের লজ্জা পাওয়া মুখের দিকে চেয়ে, চোখ শরিয়ে নিল সে। তারপর বলতে লাগল –
” মুগ্ধ হয়েছেন না ভিতরে ভিতরে অভিমান পুষে রেখেছেন তা আমি জানিনা। তবে এটুকু আশা রাখতে পারুন স্ত্রীর মর্যাদা যেহেতু দিয়েছি, স্ত্রীর হক টাও আপনি আমার কাছ থেকে যথাযথ পাবেন। আমি কথা দিচ্ছি আমি আপনাকে পূর্ণতা দিব।” শাফায়েতের এমন কথায় মেহরিন লজ্জায় মাথা নত করে ফেলেছে।
-” আপনি তৈরি তো?” মেহরিনের হাতদুটো ধরে।
-” জী,” শাফায়েত হ্যা শুনেই মেহরিনের হাত ধরলো। নরম হাত জোড়ায় ও কপালের চুল গুলিকে সরিয়ে একটা পবিত্রতার চুম্বন দিয়ে দিল। মেহরিন শাফায়েতের দিকে আর তাকাতে পারল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমেগেল। আর শাফায়েত তার পিছু পিছু মুচকি মুচকি হেসে যেতে লাগল।
সেদিন থেকেই দুজনের মাঝে তৈরি হতে লাগল দুষ্টু মিষ্টি কিছু মুহুর্তের। মেহরিনকে নিয়ে শাফায়েতের আগের সেই অচেনা অজানা বাধা যেন কেটে যাচ্ছে।
তবু মনের এককোণে তার প্রাক্তন স্ত্রীর প্রতি যে টান বা ভালোবাসা তা কোন অংশেই কম নেই । মেহরিন ও তার স্বামীর সেই সুপ্ত গোপন অনুভূতির একাংশ জানে। এ নিয়ে তার হিংসে হয় না কারন সে জানে প্রতিটা মানুষের পক্ষেই তার ভালোবাসার মানুষ থাকে। যেখানে অন্যদের হয়তো থাকে ঘৃণা শাফায়েতের আছে হারানোর শোক!
চলবে।