#এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা
#লেখিকাঃতামান্না
#দ্বাদশঃপর্ব
তাই তো সে আকাশ যেভাবেই তাকে চাইতো, ঠিক সেইভাবেই আকাশের কাছে ধরা দিত। আকাশকে পাওয়ার জন্যই তো সবকিছু বিসর্জন দিল সে। এতকিছু বিসর্জন দিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। কলঙ্কের লালীমায় লাল রক্তবর্ণ ধারন করল তার জীবনের রঙ্গে। কেন সেদিন সেই ঘটনার পর নিজেকে সুধরালো না?
কেন আবার সেই ঘটনার পুনারায়বৃত্তি ঘটল? কেন সে নিজেকে সেখান থেকে সরিয়ে নিল না! মেহরিন আর আকাশের মাঝে এসে মেহরিনকে কাটার মত উপড়ে ফেলতে গিয়ে নিজেই, চোরাবালিতে ফেসে গিয়েছে সে। দুটোদিন সে খায়নি, কিভাবে এমন খাবার তার মুখে রুচবে? শুকনো মুখে চেয়ে আছে জেলের অন্য কয়েদিদের মুখেরদিকে। এক নিমিষেই জীবনটা তার শেষ হয়েগেল। অন্যান্য কয়েদিরা সবাই যার যার মত কাজ করছে। আজ কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করতে তবে তাদের পরিবার থেকে অনেকে এসেছে। শীলা সেদিকে চেয়ে আছে, কত কয়েদি খুনি, কত কয়েদি চোর, কত কয়েদি ভেজাল কারবারি, কিন্তু সবারই দিন শেষে কেউ না কেউ এসেছে, একবার তাদের দেখে যেতে, কিন্তু শীলার বেলায় একজনও আসেনি।
প্রত্যেক কয়েদির সিরিয়াল নাম্বার অনুযায়ী ডাকা হচ্ছে, প্রত্যেকের মুখে হাসি, হাসি না পেলেও মুখে তৃপ্ততার ছাপ। কতদিন পর তাদের আত্মীয়, তাদের পরিবারের লোকজন দেখতে এসেছে। ভীড় ঠেলে কত মা, বোন অশ্রুটুকু সন্তানের জন্য ফেলছে। শীলা নিজের অশ্রু ধরে রাখতে পারলো না। একটা ভুল পদক্ষেপ শেষ করেদিল তাকে। কান্নার শব্দে জেলার সাহেবা এলেন।
মহিলা জেলার এসেছিলেন দেখতে, সাপ্তাহিক ভিসিট থাকে। এই ভিসিটে জেলার সাহেবা ঘুরে ঘুরে সবকিছুর তদারকি করেন। অন্যদিন গুলোতে করলেও তেমন ভালোভাবে হাতে সময় থাকে না তাই একদিন তিনি পুরো কারাগারে প্রদর্শন করেন। সামনে হাটতেই শীলার দিকে তার চোখ পরে যায়। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে, ফর্সা শরীর, ফর্সা মুখটির খাড়া নাকটি লাল আভায় মেখে গেছে।
মেয়েটির দুচোখ জুড়ে টলমল জলের ধারা বয়ে চলেছে।
জেলার সাহেবা জেলা সুপার পুলিশকে ইঙ্গিত করে বললেন- “ম্যাডাম ও কি নতুন কয়েদি?”
জেলা সুপার -” হুম, ও নতুন কয়েদি!”
জেলার সাহেবা-” কাদছে কেন?”
জেলা সুপার -” কি আর করবে, ভুল করার সময় করেছে এখন কান্নাকাটি করছে। এগুলো এসব মেয়ের চাল। চলুন ওদিকে যাই!”
জেলার সাহেবার কাছে বারবার মনে হলো মেয়েটি কোন ভুল করতে পারে? যার চোখে ভুলের জন্য জল! এমন একটা মেয়ে ভুল করতে পারে? পরে আবার মনে হলো –
-” অপরাধি অপরাধ করবেই, আবার শাস্তির ভয়ে তটস্থ হয়ে ক্ষমা চাইবে, কিন্তু এত সহজে তার ক্ষমা মঞ্জুর করা হবে না। তাকে দেখে অন্যরাও ভুল করতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।” জেলার সাহেবা সেই কথাগুলো মনের মধ্যে আওরাতে আওরাতে জেলা সুপারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলেগেলেন।
_________________________________
দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছে মেহরিনের, এই তো কিছুদিন আগেই ছোট্ট শিমুকে সে খাটে শুইয়ে রাখত সেই শিমু এখন পুরো খাটে হামাগুড়ি দিয়ে বেরায়। মেহরিন কিছু বললেই তার কথা গুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে উত্তর দেয়। তবে উত্তর গুলো কেউ বুঝতে পারেনা সাতমাস হয়েছে। মেয়েটা মায়ের মুখ চিনে, মাকে সারাদিন খুজে। মাকে পেলে তার আবদারের শেষ হয়না। মেহরিন যখন ঘরের কাজ, রান্না – বান্নায় ব্যস্ততা শেষ করতে একটুখানি দেরী করে ফেলে। শিমু চিৎকার করে মাকে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়!
আজকাল শাফায়েত ও মেহরিনকে স্ত্রীয়ের সম্মানটুকু দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুদিন আগেই সে মেহরিনকে শিমুর মা বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে নিশিতার জায়গা হয়তো মেহরিন কখনোই পাবে না। কিন্তু মেহরিন তো আর বাণের জলে ভেসে আসেনি!এই মেয়েটা তার স্ত্রী, তার অর্ধাঙ্গিনী, নিশীতার যেমন প্রাপ্য অধিকার আছে, ছিল। মেহরিনের ও আছে নিজের স্বামীর থেকে তার প্রাপ্য মর্জাদা সব অর্জন করার। কিন্তু মেহরিনকে সে ঠকাচ্ছে, অন্তত্য স্ত্রী হিসেবে আর তার সন্তানের মা হিসেবে তাকে ঠকানো মানে এই সম্পর্ককে নষ্ট করা! গড়াটাই ভেঙ্গে ফেলা।শাফায়েত মেহরিনকে সময় দিচ্ছে, মেহরিনকে সে সাহস দিচ্ছে। মেহরিনের ভিতরে পুরুষ নিয়ে ঘৃণার আভাষ বা তার প্রাক্তন স্বামীর ধারা অত্যাচারিত ও তিক্ত অভিজ্ঞতাকে সে কাটিয়ে তুলছে। স্বামী বা পুরুষ মানেই শরীর নিয়ে ছুকছুকানী, বা পুরুষ মানেই নির্যাতন। তা সে ভুলিয়ে দিচ্ছে, সব পুরুষ অমানুষ নয়! সব মানুষ জানোয়ার নয়! ব্যক্তিত্য, মনুষ্যত্ব সবার মাঝেই আছে। কেউ স্ত্রীকে ঘরের চাকরানী নয়, হৃদয়ের আর ঘরের লক্ষী বানিয়ে রাখতে জানে তাই দেখিয়ে দিচ্ছে সে।
অবশ্য এই কঠিন কাজটি করতে প্রায় মাস দুয়েক লেগেছে তার, মেহরিন তার সঙ্গে তেমন কথা বলত না।মেহরিন এরিয়ে চলতো, শিমুকে তার হাতে দিয়ে সুলতানা বেগমের কাছে, বা কখনো ঘরের কাজ দেখিয়ে তাল বাহানা করে তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকাই ছিল তার প্রাধান কাজ।
শাফায়েত সবই বুঝতো, তাই সে হাল ছাড়েনি প্রতিটা মুহূর্তে মেহরিনের সমস্যাগুলোকে সে সামলে নিয়েছে , মেহরিনকে আগলে রাখা, মেহরিনের চাওয়া পাওয়ার গুরত্ব সে সঠিক ভাবেই দিত।
_________________________________________
সুলতানা বেগম শিমুকে কোলে নিয়ে বসেছেন। আজ মেহরিনের আবার প্রথম অফিস জয়েন ছিল। বউমার জীবনটাকে তিনি নতুন ভাবে উপভোগ করতে দিয়েছেন। এখন তো তিনি নিজেই রিটায়ার্ড, তাহলে মেহরিনকে কেন আটকাবেন? করুক যেকটা সময় হাতে থাকুক না কেন চাকরি করুক, ঘরে বসে মেয়েটা যেন গম্ভীর হয়েগেছে। তাকে বাহিরে মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সুলতানা বেগমের কথা শুনে অনেকে চরম অবাক হয়েছেন। এই মধ্যবয়সি নারী এখনো বউকে দিয়ে চাকরি করাতে চাচ্ছে। তার কি মাথা খারাপ? নাকি টাকার অভাব? আর চাকরি যদি বউ করেই ছেলেকে কেন বিয়ে করালো এমন মেয়ের সাথে? বাচ্চা দেখার জন্যই তো বিয়ে! সেদিন ও একজন বেড়াতে এসে অনেকটা হেসেই বলে উঠলেন,
-” বাবাহ, আমি আমার ছেলের বউকে দিয়ে চাকরি করাবো না। এতবড় বাড়ি পরে থাকবে খা খা করবে বাড়িটা। আর ঘরের বউ বাইরে গিয়ে বসে থাকবে। নাতি-নাতনি সামলাবে কে?”
সুলতানা বেগম মনযোগ দিয়ে সব শুনলেন। তারপর বলে উঠলেন-
” চাকরি কি আমরা শুধু সামান্য কটা টাকার জন্য করি?”
চাকরি করি নিজের আত্মরক্ষার জন্য, এটা তোমার ভুল রত্না! চাকরি একটা মেয়ের সম্বল! তুমি দেখো আজ একটা পরিবারে স্বামী যদি কোন বিপদে পরে স্ত্রী তার সামান্য সম্বল বা সঞ্চয় টুকু স্বামীকে দিয়ে সাহায্য করতো। এখনকার মেয়েরা স্বামী যদি বাহির সামলায় মেয়েরা ঘর সামলায়। অর্জিত অর্থ দিয়ে সাংসারিক দৈনন্দিন চাহিদাগুলো মিটায়। আবার দেখো বাবা-মাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করে, এই টাকা কি স্বামীর কাছ থেকে নেওয়া যায়? আবার ভাবো এই যে অনেকের স্বামী স্ত্রীর থেকে যৌতুক চায়! এবং নির্যাতন করে সামান কটা টাকার জন্য তখন মেয়েটি কবার তার বাবার বাড়ি যাবে বলতো? ”
” তুমে আরেকটি কথা বললে বউকে দিয়ে চাকরি করাচ্ছি এত বাড়ি খালি পরে থাকবে। খা খা করবে কেন? আমি আছি আমার নাতনিরা আছে,সবাই আছে!বউকে আমি যেমন চাকরি করাবো তেমনি চাকরি ছাড়াবো ও!” ওর যখন সময় হবে তখন ও ছেড়ে দিবে।তোমার কথাটা আমার পছন্দ হয়নি রত্না! তুমি বউয়ের প্রসঙ্গ তুলে কথাটা আমাকে খোচাঁ মেরে বলেছো!”
– “ভাবী আপনি আমাকে ভুল বলছেন!”
– কোথায় ভুল? আমি ও চাকরি করতাম, আমার একটা মাত্র সন্তান তুমি জানো আমার শাশুড়ি আমার বাসায় আমার ছেলেকে মানুষ করেছেন। ঘর সামলিয়ে আমি বাইরে যেতাম। আমার স্বামী ব্যবসার কাজে বিভিন্ন যায়গায় চলেযেত। আমিই সব সামলাতাম কোথায় আমার শাশুড়ি তখনকার মহিলা হয়েও অত কথা শুনাতেন না , শাফায়েত হওয়ার পর ওকে স্কুলে ভর্তির পর আমি আবার প্রাইমারিতে জয়েন করি। এভাবে করিনি! শুনো সংসারি মেয়েরা সবকিছু আগে থেকেই সামলে নিতে জানে। আমার বউমাকে ও আমি ওমন ভাবেই গড়ে তুলবো!”
রত্না বেগম যেন তব্দা খেয়েগেলেন! এ কেমন শাশুড়ি?
অনেকটা কথায় না পেরে উঠে চলেগেলেন তিনি। কথায় পারা যায় না সুলতানা বেগমের সঙ্গে। খুবই দূর্ত মহিলা!
চলবে।