“তুমি সাদিয়া না!রাইটার সাদিয়া?”
আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,”জ্বি।”
“আল্লাহ,ভাবতেই পারিনি তোমার সাথে দেখা হবে!সত্যি বলছি আমি তোমার অনেক বড় ফ্যান।তোমার প্রতিটা গল্প আমি পড়েছি।এতো ভালো লাগে বলার মতো না!”
আমি হেসে বললাম,”আমরা এই জীবনে অনেককিছু ভাবিনা।তাও তো হয়,তাই না?”
“আসলে ভাবনার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।”।কল্পনার জগতটা আমরা নিজেরা সাজাই,তাই সুন্দর হয়।বাস্তবতাটা কঠিন হয়।কারণ সেখানে আমাদের কোনো হাত থাকে না।
‘হুম তা ঠিক।’মেয়েটা হেসে বলল,’সাহিত্যিক,সাহিত্যকের মতো কথা গুলো বললা।’
আমি দোলনায় দুলতে দুলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
তুমি কি এখানে প্রায়ই আসো?
হ্যাঁ,এটা আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা।আমি প্রায়ই এই দোলনায় দুলি।ঐ যে পুকুরটা দেখছো,ওইখানে মাঝেমাঝে পা ডুবিয়ে বসে থাকি।মাঝে মাঝে বসে বসে আকাশ দেখি।সময়টা খুব ভালো কাটে।খুব ভাল্লাগে।
‘আমিও তো এখানে প্রায়ই আসি।আমাদের আগে দেখা হলো না কেন?’
আমি দোলনাটা থামিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম,বোধহয় আল্লাহ চায়নি,তাই।
Can I have a autograph please?
মেয়েটা ব্যাগ থেকে ডায়রী আর কলম বের করে আমাকে দিল।
নাম?
দোলা।
আমি দুষ্টুমি করে বললাম,আনন্দ অশ্রুর দোলা?নাকি দেওয়ান খসরুর?
না,তেমন কিছু না।
আমি ডায়রীটা দোলার হাতে দিয়ে বললাম,এমনি দুষ্টুমি করলাম।কিছু মনে করো না।তুমি যে দেওয়ান খসরুর ‘দোলা’ না,সেটা আমিও জানি।
দোলা হেসে বলল,না আপু।কিছু মনে করিনি।
আমি হাসলাম।মেয়েটা গেট খুলে আমার সামনে থাকা সিঁড়িতে এসে বসল।
‘তো কি করা হয়?’
তেমন কিছু না।আমি স্টুডেন্ট, অনার্স ফাইনাল ইয়ারে ক্যামেস্ট্রি নিয়ে পড়ছি।
ক্যামেস্ট্রি! ওরে খোদা,তুমি দেখি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী।
দোলা লজ্জা পেয়ে বলল,না,আপু।তেমন কিছু না।
তো পড়াশুনার পাশাপাশি আর কি করা হয়?
একটা এনজিওতে ছোট খাটো চাকরী করি। স্বেচ্ছাসেবী বলা যায়।আমাদের কাজ হচ্ছে,গরীব-অসহায় এতীম বাচ্চাদের সাহায্য করা।ওদের জন্য ডোনেশন কালেক্ট করি।আর পাশাপাশি ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পেও কাজ করি।আমাদের গ্রুপ মানুষকে বিনামূল্যে ডোনার খুঁজে দেয়।
বাহ্!ভালো কাজ করো তো।শুভ কামনা রইলো।
Thank you.আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?
হুম,কর।
তোমার পুরো নাম তো সাদিয়া শাহরিয়ার আফরিন।আচ্ছা,এই ‘শাহরিয়ার’ টা কে?তোমার বাবা নাকি স্বামী?
আমার বাবার সারনেম রশিদ।আর আমি আনমেরিড।বিয়ে করিনি এখনো।
তাহলে এই শাহরিয়ার টা কে?
চিরচেনা সেই প্রশ্ন।এই জীবনে অসংখ্যবার যেটা শুনতে হয়েছে।তবে আমার উত্তর সারাজীবন একই ছিল।হয়তো এই জীবনে এই উত্তর বদলাবেনা কখনো।
আমি মেয়েটার প্রশ্নের উত্তরে রহস্যময়ী একটা হাসি দিলাম।তারপর আবারো দোলনায় দুলতে লাগলাম।
‘বললে না?’
আমি ঠোঁটের কোণে রহস্যময়ী হাসি ফুটিয়ে বললাম,কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না।এটাও তেমন একটা প্রশ্ন।
উত্তর দিলেই উত্তর হয়।বলনা শাহরিয়ারটা কে?
আমি ঠোঁটের কোণে আবার সেই রহস্যময়ী হাসি ফুটিয়ে বললাম,হবে কেউ একজন।
আচ্ছা,সাহিত্যিকরা কি তোমার মতোই উদ্ভট হয়?
দোলার কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম।নিজের পছন্দের মানুষকেও যে কেউ প্রথম দেখাতে এভাবে বলতে পারে,আমার সত্যি জানা ছিল না।
হ্যাঁ,সবাই এমন হয়।আর কেউ কেউ শুধু উদ্ভট না,পাগলও হয়।দেখ না,ছেলে রাইটারদের চুল-দাঁড়ি বড় থাকে।আমি যদি ছেলে হতাম,আমারও চুল-দাঁড়ি বড় থাকতো।আমি হিমুর মতো হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে,একজোড়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে,ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে রুপার খোঁজে ঘুরতাম।
হিমুরা তো রুপার খোঁজে ঘোরে না।
কিন্তু,আমি ঘুরতাম।আমার ইচ্ছা।
.
.
আজকের দোল দোল দুলুনি এখানেই শেষ।দোলনা থামিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
দোলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আপনি কি আমার কথায় রাগ করেছেন?
আমি কারোর কথায় রাগ করিনা।
তাহলে?
আমার সময় শেষ।যেতে হবে।
আবার আসবেন?
অবশ্যই।
আমি গেইট খুলে রাস্তায় নেমে গেলাম।আকাশে মেঘ করেছে।আজ বোধহয় আবার বৃষ্টি পড়বে।আমি পেছনে তাকাইনি।তবু জানি ও আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।খুব সম্ভবত আমার কথা শুনে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে।নাহলে সেলফির যুগে সেলফিই তুললো না।আশ্চর্য!অবশ্য এমনও হতে পারে,মেয়েটার মোবাইল নেই।
.
.
আমি হেসে ফেললাম।এটা সম্ভব না।এই যুগে
একজনের মোবাইল না থাকাটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।এমনও হতে পারে মোবাইল ফেলে এসেছে।কিংবা,আমার কথা শুনে যেই ঘোরে পড়েছিল সেটা এখনও কাটেনি।
.
.
আমি পেছনে ফিরে তাকালাম।আমি যা ভেবেছিলাম সেটাই।মেয়েটা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল।আমি তাকানোর সাথে সাথেই লজ্জা পেয়ে চলে গেল।আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
.
.
আচ্ছা,সত্যিই কি পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর হয় না?নাকি উত্তর দিলেই উত্তর হয়?আমি হেসে ফেললাম।হ্যাঁ,সত্যিই পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর হয় না।কখনো ভেবে দেখেছি,সৃষ্টিকর্তার রহস্য কি?কেন পৃথিবী আস্তিক আর নাস্তিক এই দুইভাগে বিভক্ত?একদল সৃষ্টিকর্তার হাজারো নেয়ামত দেখার পরেও কেন স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে?আরেকদলের কেন-ই বা সৃষ্টিকর্তাকে না দেখার পরেও এতোটা ভালোবাসে?আমাদের চারপাশে পারানর্মাল অনেক ঘটনাই ঘটে।এগুলোর আসলে ব্যাখা কি?সত্যিই কি এইসব আদিভৌতিক বিষয়গুলোর আদৌও কোনো ব্যাখা আছে?আমার তো মনে হয় না।ঘোলাটে পৃথিবীর সত্যটা আসলে আমরা কতটুকু জানি?
.
.
একটা পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটে কি সত্যিই সেই বাড়ির মানুষগুলোর আত্না থাকে?নাকি গুজবের আড়ালে চলে ড্রাগস স্মাগলারদের রমরমা ব্যবসা?কেন-ই বা মানুষের প্রথম প্রেম টেকেনা?প্রথম ভালবাসার মানুষটাকে কেনই বা কেউ ভূলতে পারেনা?কখনো ভেবে দেখেছেন,মাজারে দান করা টাকাগুলো আসলে কাকে দিচ্ছেন?যার কাছে নিজের অসহায়ত্ব জাহির করে কাঁদছেন।সেই কবরে শুয়ে থাকা মানুষটা তো আপনার চেয়ে অসহায়।সে আপনার সাহায্যটা করবে কিভাবে?এতো নেয়ামত অস্বীকারের পরেও সৃষ্টিকর্তা কেনই বা আমাদের পরম মমতায় আগলে রেখেছেন?
.
.
সত্যিই কি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়?
সত্যিই কি পৃথিবীর সব রহস্যের সমাধান হয়েছে?
রহস্যের চাদরে আবৃত এই রহস্যময়ী পৃথিবীর রহস্য,আমরা ঠিক কতখানি উদঘাটিত করতে পেরেছি?
দিনশেষে ধোঁয়াশা এক রাজ্যের রহস্যময়ী এক পৃথিবীতে বেঁচে আছি।আমাদের মতোই যেই পৃথিবী একদিন মরে যাবে।শেষ হয়ে যাবে।
.
.
বিদ্যুৎ চমকে মেঘ ডেকে উঠল।আমি চমকে উঠে আকাশের দিকে তাকালাম।গভীর মনযোগ দিয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বুঝতেই পারিনি কখন আকাশ কালো হয়ে গেছে!বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল।আমি হাত চোখ বুজে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।একটু হেটে জুতা খুলে পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রইলাম।বসে বসে মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম।জলের ফোঁটা পুকুরে পড়তে লাগলো।দৃশ্যটা কি যে সুন্দর লাগছে!
.
.
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গান মনে পড়ছে।খুব প্রিয় একটা গান।বৃষ্টির দিনে যেটা আমি প্রায়ই গাই।
____________ এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনা তো মন,
_____________কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ….
.
.
আমি হাসিমুখে বৃষ্টিতে গান গাচ্ছি।আচ্ছা,আশেপাশে কেউ কি শুনছে?
.
.
নামঃএই বৃষ্টিতে আজ আমি
Writter:Sadia Afrin