বাবা, দেখো টিভিতে ডা. নিশাত নামে একজন মহিলা ডাক্তার তোমার কথা বলছে। উনি এ বছর আমেরিকান সোসাইটি অব মেডিসিন থেকে কোন একটা রিসার্চের ওপর পুরস্কার পেয়েছে। বাংলাদেশের কোন ডাক্তার প্রথম এই পুরস্কার পেলো।
– আমার নাম বলছে কিভাবে বুঝলে? আমার নামে বুঝি বাংলাদেশে আর কোন মানুষ নেই, মামনি?
আমি ভিডিওটা রেকর্ড করে রেখেছি। তুমি দেখলেই বুঝবে কেন বলেছি।
‘ আমি মেডিকেলে ভর্তির জন্য এক ভাইয়ার কাছে প্রাইভেট পড়তাম। রায়হান আহমেদ নাম ওনার। ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র ছিলেন উনি। গ্রুপে পড়াতেন। একবার কথা প্রসঙ্গে উনি আমায় বলেছিলেন, সবার জীবনে কিছু অপ্রাপ্তি থাকা উচিত। তাহলে মানুষ কিছু পাওয়ার খোঁজ করে। তোমার মা বাবা যদি তোমার সব শখ মিটিয়ে ফেলে তাহলে তোমার জীবনে নিজের জন্য কিছু চাওয়ার থাকবেনা। সফলতা তাঁরাই পায় যাদের জীবনে চাহিদা থাকে।’ আমি সেদিন বাড়ি ফিরে কথাগুলো ডায়েরীতে লিখে রেখেছিলাম। বলতে পারেন আমার জীবনের ঐ কথাগুলোই মোটিভেশনাল স্পিচের মতো ছিল।
– আপনার ঐ শিক্ষকের সাথে কোন যোগাযোগ আছে?
‘ না। মেডিকেল ভর্তির পর এক আধবার ফোন করেছিলাম। এতো ব্যস্ততার মাঝে আসলে সবার কথা ওনার মনেও থাকার কথা না। তাই আর পরবর্তীতে যোগাযোগ থাকেনি।’
……………..
টিভিতে কথা বলা মানুষটি আমার পরিচিত নিঃসন্দেহে। টিভি বন্ধ করে এক লহমায় হারিয়ে যাই পঁচিশ বছর আগে। মেয়েটাকে আমার মনে আছে অন্য কারণে। ওর চেহারায় একটা দৃপ্তভাব ছিল সবসময় যেটা আমার অন্য খুব কম ছাত্র ছাত্রীর মধ্যেই দেখেছি। একটা ডাকনাম ছিল মেয়েটার। নামটা মনে পরছেনা যদিও।
সেসময় কোচিংয়ে ক্লাস নেয়ার পাশাপাশি প্রাইভেটেও নিজে নোটস করে ছাত্র পড়াতাম আমি ও আমার মতো অনেকে। মেয়েটা কোচিংয়ে সব ক্লাসে খুব মনোযোগী থাকতো। মনোযোগী ছাত্রকে যেমন সব শিক্ষক পছন্দ করে তেমনই একটা আলগা এটেনশন মেয়েটাকে দিতাম আমি। কাপড়চোপড় চলাফেরাতেই বোঝা যেত নিতান্তই মিডল ক্লাস থেকে উঠে আসা মেয়ে। আমার কাছে পড়া অনেকেই মেডিকেল চান্স পেতো দেখে আমার প্রাইভেট পড়ানোর রেট বেশ উঁচুতে ছিল। আমি যাদের পড়াতাম তাদের বেশীর ভাগই দারুন বিত্তশালী লোকের ছেলেমেয়ে ছিল। টাকাপয়সা বলা চলে যাদের হাতের ময়লা।
একদিন খুব সকালে হোস্টেলে রুমে নক দেয় একজন ভদ্রলোক। জানায় তার মেয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আমার কাছে পড়তে চায়। কিন্তু আমার যা রেট তা দেয়ার সামর্থ্য তার নেই। এদিকে মেয়েকে উনি কথা দিয়ে এসেছেন আমার সাথে কথা বলবেন। আমি বুঝতে পেরেছি উনি কার কথা বলছেন কিন্তু এতো কম টাকায় পড়াতে মন সায় দিচ্ছিলোনা। তাই তখুনি না বলে দেই সেই ভদ্রলোককে। দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় শুতে গিয়েই মনে হলো এটা আমি কি করলাম? এই মেয়েটার একটু যত্ন নিলেই সে নির্ঘাত মেডিকেলে চান্স পাবে। আমার নাম আরেকটু পসার পাবে। বলা চলে নিজের স্বার্থেই মত বদলালাম। দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখি ভদ্রলোক তখনো চলে যাননি।
– এই যে শুনুন, ওকে কাল আসতে বলবেন। এই ঠিকানায়। পাঁচজনের একটা গ্রুপে আমি পড়ানো শুরু করবো কাল থেকে। আর আপনি যা পারেন দিবেন। না পারলেও সমস্যা নেই।
– তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো বাবা, আমার জানা নেই। মেয়ের কাছে আমার মুখ রাখার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। দোয়া করি তুমি জীবনে অনেক বড় হও।
পাঁচজনের যে গ্রুপে মেয়েটাকে নিয়েছিলাম সেখানে সে বড্ড বেমানান ছিল। দারুন বড়লোকের পাঁচ মেয়ের গল্প গাছার মাঝে ও ছিল বড় ম্রিয়মান এক চরিত্র। শুধু যখন পরীক্ষা নিতাম বা কোন পড়া ধরতাম সে ছিল সবচেয়ে সপ্রতিভ তখন। সেবার মেডিকেল পরীক্ষার আগে আগেই ছিল ঈদ। ঈদের ছুটি দেয়ার আগে এমনিতেই কথার কথা হিসেবে জিজ্ঞেস করেছিলাম কে ঈদে কি কিনেছে? দেশ বিদেশের সেরা সব দোকানের নাম বাকী সবাই নিয়ে ফেললেও ঐ মেয়েটা মুখ নিচু করে জানায় সে কেনাকাটা করেছে তার বাড়ির পাশের এক মার্কেট থেকে। মেয়েটার মলিন হয়ে যাওয়া মুখ দেখে নিজের ওপরেই রাগ লাগে আমার, কেন যে এমন প্রশ্ন করতে গেলাম?
সেদিন পড়ানো শেষে বাকী সবাই যে যার গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেও নিশাতকে পেয়ে যাই বড় রাস্তার মুখে রিকশার জন্য দাঁড়ানো।
– কি নিশাত, রিকশা পাওনি?
না ভাইয়া, দেখেন না কোন রিকশা যেতে রাজী হচ্ছেনা।
– চলো একটু সামনে এগিয়ে দেখি পাই কি না।
আপনি ওদিকেই যাবেন?
– গেলাম আর কি। নিশাত শোন, আমি খুব সরি। আসলে ওভাবে হয়তো শপিংয়ের কথা না জিজ্ঞেস করলেও পারতাম।
আমি কিছু মনে করিনি ভাইয়া। সবাই কি আর এক ক্লাসের হয় না সবার বাবা মায়ের একই রকম সামর্থ্য থাকে?
ওর মন খারাপ ভাব ভালো করতেই পরের কথাগুলো আমি বলি। সেরকম কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বা গুছিয়ে বলা কোন কথা না। কিন্তু কেউ আমার ঐ সামান্য কয়েকটা কথা মাথায় নিয়ে জীবনে এতোদূর চলে যাবে সেটা অবশ্য আমার জন্য একটা বড় চমকই ছিল। আর এতো বছর পরেও জনপ্রিয় এক টিভি চ্যানেলে এভাবে সেসব কথা বলবে সেটাও আমার জন্য বিস্ময়েরই ছিল।
………………
হঠাৎ করেই মনে হলো ঐ চ্যানেলে ফোন করলে হয়তো ওর ফোন নাম্বার পাওয়া যেতে পারে।
– হ্যালো, নিশাত বলছি।
নিশাত আমি রায়হান। রায়হান আহমেদ। তুমি আমার কথাই কি সেদিন টিভিতে বলছিলে?
– রায়হান ভাই, সত্যি আপনি? কেমন আছেন? হুম আপনার কথাই বলছিলাম।
অভিনন্দন তোমার এমনতর প্রাপ্তিতে। আর এরকম প্রাপ্তির সাথে আমিও খানিকটা জড়িয়ে আছি জেনে নিজের কাছেও খুব ভালো লাগছে।
– আমার বাবা মারা যাওয়ার আগে আমায় বলেছে আপনি সেসময় আমাকে পড়ানোর জন্য কোন টাকা নেননি। আমি তারপর থেকে আপনাকে শুধু একটু ধন্যবাদ দেবার জন্য কত যে খুঁজেছি, জানেন? আমি সামনের সপ্তাহে আবার আমেরিকা চলে যাচ্ছি। বাসায় আসবেন একবার? একবার মুখোমুখি ধন্যবাদ দিতাম।
নিশাত, কিছু কিছু প্রাপ্তির খবর খুবই সুখের। কিছু ঋণে কাউকে ঋণী রাখাটাও আনন্দের। তোমার সাথে সামনাসামনি দেখা হলে সে আনন্দ হয়তো বা কমে যেতে পারে। তোমার আগামী দিনের পথচলা আরো অনেক অনেক প্রাপ্তির হোক। এতোদিন পরেও কৃতজ্ঞতাভরে আমার নাম নিয়েছো সেটাই যে শিক্ষক হিসেবে আমার পরম পাওয়া।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস