ঊষালগ্নে পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
1098

ঊষালগ্নে
পর্ব-৫

“আজকের আমিকে দেখে তোমার মনে হতে পারি আমি চিরকালই এমন ছিলাম। কিন্তু সত্যিটা হলো আমার যে ব্যক্তিত্ব তোমার বা তোমার পরিবারের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে সেটা সবসময় এরকম ছিল না৷ আমার ইচ্ছে ছিল প্রথমদিন সব বলে দেবার। কিন্তু আটকে গেলাম৷ তারপর বলি বলি করেও কিছু বলা হলো না৷

আমি মূলত রগচটা গোছের ছিলাম৷ খুব সহজে মানুষকে কষ্ট দিয়ে ফেলতাম৷ মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করেও মানুষকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতাম যাতে তারা কষ্ট পায়। আরেকটা জিনিস ছিল, ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। বাবার ভালো আয় ছিল না৷ আমার চাচাদের ছেলেমেয়েদের যেরকম জীবনধারা ছিল আমাদের তা ছিল না৷ কেউ কিছু না বললেও হীনমন্যতায় ভুগতাম। পড়াশোনায় মন বসত না, ভালো রেজাল্টও করতে পারতাম না৷ সারা বছর খবর থাকত না, রেজাল্টের দিন প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বসে থাকতাম৷ বাবা মা অনেক বোঝাতেন, লাভ হতো না। উল্টো তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলতাম৷ সহপাঠীদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল না। সব মিলিয়ে একঘরে হয়ে উঠছিলাম৷

তবে কিছু ব্যাপার ভালো ছিল। যেমন বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলতাম না। সবসময় সত্যি কথা বলতাম৷ কখনো কখনো মুখের ওপর সত্যিটাও বলে দিতাম বলে লোকে দেখতে পারত না।

সে সময়ে একটা বড় ধাক্কা খেলাম ক্লাস এইটে উঠে। ফেল করে বসলাম৷ বাবা জীবনে প্রথমবার খুব মারলেন৷ তার জোড়া বেতটা ভাঙলেন আমার পিঠে। আমিও কম জেদি নই। পরদিন কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম৷

মনে হয়েছিল পৃথিবীটা অনেক অ্যাডভেঞ্চারাস। ছোটোবেলা থেকে আমার একটা ভালো গুণ ছিল বই পড়ার। একাডেমিক পড়াশোনা না করলেও প্রচুর গল্পের বই পড়তাম৷ তো বাড়ি থেকে পালিয়ে সেসব গল্পের মতো অ্যাডভেঞ্চারে নেমে পড়ার একটা ইচ্ছে জেগেছিল। ট্রেনে চেপে চলে এসেছিলাম ঢাকা। প্রথম রাত কাটিয়েছিলাম রেলস্টেশনে। একটা টাকা নেই সাথে। ক্ষুধায় জীবন যায় যায় অবস্থা!

সেবার কী করে বাড়ি ফিরেছিলাম সেটা লম্বা কাহিনী। সেগুলা অন্য কখনো বলব৷ এই ঘটনা থেকে আমার শিক্ষা হলো যে যত যাই হোক, আমাকে বাড়ি থাকতে হবে, বাইরের দুনিয়া অনেক কঠিন।

বাড়ি ফেরার পর বাবা ঘোষণা করলেন বাড়ি থাকতে হলে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে, তাও ভালো নাম্বার নিয়ে। জেদ ধরলাম পাশ করে দেখাব৷ সত্যি পরেরবার ক্লাস এইটে সবচেয়ে বেশি নাম্বার নিয়ে পাশ করলাম৷ আমার মেধা ছিল, খাটাতাম না, এই যা!

তারপর নাইন টেনে প্রতি বছরই প্রথম হতে লাগলাম। আমার বদমেজাজ তাতে খুব একটা ভালো হলো না, উল্টো সাথে যোগ হলো অহংকার। কারো সাথে সমীহ দেখিয়ে কথা বলা কী জিনিস তাও জানতাম না।

কলেজে পড়ার সময় বাবার অবস্থা ফিরল। আমার অবস্থার কোনো উত্থান পতন হলো না। বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকি।

ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে আবার ঢাকায় এলাম৷ সেই কিশোর বয়সের ভয়টা কেন যেন আবার ভর করল। খুব একা লাগত, পড়াশোনা হতো না৷ ক্লাসের বাইরে সহপাঠীদের সাথে কোথাও যেতাম না।

আচ্ছা এবার বলো তো আজকের আমাকে দেখে চেনা যায় আমি এমন ছিলাম?”

আমি পলাশের কাহিনী শুনছিলাম তন্ময় হয়ে। কী অদ্ভুত লাগছিল! তার প্রশ্নে একটু চমকে উঠলাম৷ তার দিকে ভালো করে তাকালাম৷ মুখের ওপর পড়েছে চাঁদের আলো। বড় বড় পাপড়িতে চোখজোড়া অসম্ভব মায়াবী লাগছে।

সে সময় আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল নীরু। আমার প্রাক্তন প্রেমিকা। বলেছিলাম ওর কথা। কিন্তু সব বলিনি৷ ভীষণ সুন্দর এই মেয়ের পেছনে পুরো ইউনিভার্সিটির ছেলেরা পড়ে থাকত। কিন্তু সবাইকে ফেলে সে আমার দিকে আকৃষ্ট হলো। নারীদের অদ্ভুত সাইকোলজি!

প্রথমে সে আমার সাথে বন্ধুত্ব করার খুব চেষ্টা করল, আমি ফিরিয়ে দিলাম। সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল। অনলাইন, অফলাইন সব ভাবে। ধীরে ধীরে তার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়, তারপর প্রেম।

প্রেমের দিনগুলো খারাপ কাটছিল না। ও ছিল আমার জীবনের প্রথম বন্ধু এবং প্রথম প্রেম৷ তুমি মন খারাপ করো না শিউলি, ও এখন শুধুই স্মৃতি।

প্রথম দিনগুলি সুন্দরভাবে কাটলেও আমার স্বভাবেই সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করল। যে বদমেজাজি, সে সহজে ঠিক হতে পারে না৷ আমি ঠিক হওয়ার চেষ্টাও করিনি কখনো। মানুষের সাথে ভালো করে কথা বলার ধরণই জানতাম না৷

ওকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতাম, অন্য কারো সাথে কথা বললে প্রচুর চেঁচামেচি করতাম, ওর ফ্যামিলির সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছিল আমার। তাদের সাথেও খুব একটা ভালো আচরণ করিনি।”

পলাশ হঠাৎ চুপ করে গেল। তারপর হেসে বলল, “মেয়েদের প্রবণতা থাকে ভালোবাসা দিয়ে ভালো করে দেবার। কিন্তু ছেলেরা ছোটোবেলা থেকে শক্তের ভক্ত হয়, তুলতুলে ভালোবাসায় ভালো কী করে হবে? তারা ভালোবাসার মর্মই বোঝে না!

আমিও বুঝিনি। তাই দূরে সরে গিয়েছিল সে। কিন্তু আমাকে পুরোপুরি নির্ভরশীল করে গিয়েছিল তার ওপর। মানুষ ধীরে ধীরে সরে গেলে সহ্য করা যায়, কিন্তু সে আচমকা চলে গিয়েছিল ছেড়ে। হুট করে একদিন বিয়ে করে নিয়েছিল। বিয়ে করেছিল তার বড়লোক কাজিনকে।

আমি তখন প্রথমবার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খাই। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম৷ আমি যে তার ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম সেটা বুঝতে পারি।

অনেক চেষ্টা করেছিলাম তাকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সে ততদিনে পুরোপুরি পর হয়ে গিয়েছে৷ তবু যেতাম৷ নেশা করলে মানুষ যেমন আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তেমন হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন খুব নির্মমভাবে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছিল আমাকে। আর সেদিকে যাইনি।

এর মাত্র কয়েকদিন পরেই আমার পরিবার মারা যায়। দুটো শক একত্রে এমনভাবে লাগে যে আমি ভয়ানক ডিপ্রেশনে চলে যাই। দু’বার মরার চেষ্টা করেছিলাম৷ কব্জিতে দাগ এখনো আছে। এই দেখো।”

আমি দেখলাম দাগটা। তারচেয়েও গভীর ক্ষতের আভাস পেলাম তার হৃদয়ে। আমার জীবনেও অনেক কষ্ট ছিল, কিন্তু মরার কথা কখনো মনে হয়নি৷ মানুষের জীবনে এত দুঃখ কেন থাকে?

সে বলল, “ডিপ্রেশন থেকে ফিরে আসার গল্পটাও দারুণ। একদিন ফ্যানের সাথে দড়ি টানিয়ে বসেছিলাম। ইচ্ছে ছিল মাঝরাত হতে হতে ঝুলে পড়ব। বসে থেকে ঝিমুনি ধরে গিয়েছিল। স্বপ্নে দেখলাম মাকে। মা আমার বড় মায়াবী ছিল। মাকে দেখে মনে হলো সদ্য বিয়ে হয়েছে। আমি তখন ছোটো। বসয় পাঁচ-ছয়৷ পুকুরঘাটে খেলতে গিয়ে পড়ে গেলাম পানিতে। সাঁতার জানি না, হাবুডুবু খাচ্ছি। মনে হচ্ছে মরে যাব। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আজই জীবন শেষ।

হঠাৎ মা পাড় থেকে চিৎকার করে উঠলেন। ঝাপ দিলেন পুকুরে। প্রাণপণ চেষ্টায় আমাকে তুললেন। নিজে তখন মৃতপ্রায়। জীবন বাজি রেখে বাঁচালেন মা আমাকে। ডাঙায় তোলার পর দেখলাম মা আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।

আমার ঘুম ভেঙে গেল। শরীর ঘেমে গেছে। স্বপ্নটা আসলে সত্যি ঘটনা যেটা আমার জীবনে ঘটে গিয়েছিল সেই শৈশবে।

মায়ের এত কষ্টের ছেলেকে আমি নিজ হাতে মেরে ফেলব? খুব কাঁদলাম সে সময়। সারারাত কাঁদলাম। ভোরে প্রতিজ্ঞা করলাম, মরব না। ভালো হয়ে যাব। আজ থেকে কাউকে কষ্ট দেব না। যতদিন বাঁচব সবার ভালো করার চেষ্টা করে যাব।

নিজের সাথে লড়ে বাঁচাটা যত সহজ মনে হয় তত সহজ না। প্রতিদিন মনে হতো, আজ পারব তো? সারাদিন কষ্টের সাথে লড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জোর করে হাসতাম৷ মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার আয়ত্ত করেছি আরও অনেকটা সাধনার পর। কেউ ছিল না পাশে দাঁড়াবার। একটু মায়া বা যত্ন যে আমিও পেতে পারি তা ভুলেই গিয়েছিলাম। ধরে নিয়েছিলাম আমি এসবের যোগ্য নই। পৃথিবী থেকে আমার কোনো চাহিদা নেই, তবে পৃথিবীকে অনেক কিছু দেবার আছে।

তুমি সেদিন বাসে বসে আমার জন্য মায়া করে যে পানির বোতলটা বের করে দিলে, অতটুকুও কেউ আমার জন্য বহুকাল করেনি। তোমার স্নিগ্ধ চাহনি, মিষ্টি মুখ আর মায়াভরা মন দেখে সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমাকে কিছুতেই হারাতে পারব না।

তুমি আমার জন্য কী তুমি জানো না শিউলি। তোমার সাথে দেখা হবার পর আমি নতুন করে নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি৷”

সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমার চোখে পানি চলে এসেছে। সে বোধহয় খেয়াল করেনি। আমি তার বুকে মাথা রাখলাম৷ সে আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল, “অ্যাই, তুমি কখনো ভাবোনি আমি কেন তোমার হাত ধরিনি, প্রেমিকের অধিকার খাটাইনি, খুব কাছে যাবার চেষ্টা করিনি?”

আমি কিছু বললাম না। সেই বলে গেল, “আমার জানো, ভয় হতো। খুব ভয়। নীরুর বিয়ের পর ওর সাথে কাটানো অন্তরঙ্গ সময়গুলো অনেক বেশি মনে পড়ত। আমি আমার জন্য ভয় পেতাম না, ভয় পেতাম তোমার জন্য। তোমার কাছে যেতে ভয় হয়েছে সবসময়৷ যদি আবার কষ্ট পাই বা তোমাকে কষ্ট দেই?

কিন্তু আজ থেকে ভয়ের দিন শেষ। আমরা জমিয়ে প্রেম করব। তোমার আমার সব শখ পূরণ করব৷

শিউলি, তুমি ধারণা করতে পারবে না তোমাকে সব বলতে পেরে আমার কতটা ভালো লাগছে! বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে গেছে।

আমি নিজেকে বিশ্বাস করি না। তোমাকে কখনো কষ্ট দিলে আমাকে ছেড়ে যাবে না তো শিউলি?”

আমি তাকালাম তার দিকে। তার চোখে পানি৷ এই সুন্দর রাতে আমরা দু’জন কাঁদছি কেন?

জ্যোৎস্না ম্লান হয়ে এসেছে। শীতের দীর্ঘ রাত ফুরাতে এখনো অনেকটা দেরি৷ আমরা পরষ্পরকে কথা দিলাম, আমরা সারাজীবন একে অপরের জীবনে উষ্ণতা ছড়িয়ে যাব। যেমন পরিস্থিতিই হোক না কেন একে অপরকে ছেড়ে কোথাও যাব না। উঁচুনিচু কণ্টকাকীর্ণ পথে হাত ছেড়ে পালিয়ে যাব না। একটা জীবন মসৃন কখনোই হবে না, তবে ভরসার হাতটা ধরে হাঁটলে কঠিন পথও সহজে পাড়ি তো দেয়া যাবে!

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে