ঊষালগ্নে
পর্ব-৪
বাড়িতে পৌঁছুলাম সন্ধ্যায়। সেই চিরাচরিত দৃশ্য! বাবা বাড়িতে নেই, মা রান্নাঘরে বসে, আর ছোটো বোন কলি বারান্দায় বসে পড়ছে। লোডশেডিং এর কারনে বাড়িঘর অন্ধকার। বারান্দায় শুধু একটা বাতি জ্বলছে। সৌরবিদ্যুতে জ্বলে বাতিটা। আমি বাড়িতে পা রাখতেই কলি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমায়৷ তবে ওর উল্লাস অন্য সবসময়ের মতো নয়। একটু যেন ফিকে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
কলি মাথা নেড়ে বলল, “কিছু না। তুমি হঠাৎ চলে এলে যে?”
ছোট্ট উত্তর দিলাম, “এমনি।”
মায়ের আচরণ আমার প্রতি কখনোই খুব উষ্ণ ছিল না। আর এবার একেবারে শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছো মা?”
মা শুষ্ক গলায় উত্তর দিলেন, “ভালো।”
আমাকে পাল্টা কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেন না। বললেন, “হাতমুখ ধুয়ে আয়। খেতে দেই।”
আমি অভিমানে স্তব্ধ হয়ে আসা গলায় বললাম, “খিদে নেই৷ পথে এটা সেটা খেয়ে এসেছি।”
“ওহ।”
আমি চুপচাপ চলে গেলাম নিজের ঘরে। নিজের ঘর মানে আমার আর কলির ঘর। আমাদের বোনদের জন্য বরাদ্দ ঘর ছিল দুটো। তাতেই ভাগাভাগি করে থাকতাম। এখন একটা গেস্টরুম হয়েছে, অন্যটায় আমি আর কলি থাকি। মধ্যবিত্ত বাড়িতে গেস্টরুম শব্দটা হাস্যকর হলেও, আমাদের ক্ষেত্রে জোরালো একটা কারণ আছে। বড় আপা বছরের বেশিরভাগ সময় এখানে এসে থাকে৷ আপা দশদিন থাকলে দুলাভাই আসেন সাত দিন। ওটা তাই বড় আপার ঘরও বলা চলে।
হাতমুখ ধুয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আরাম লাগছে। ভালো শীত পড়ে গেছে। জানালা দিয়ে হিম আসছে। গা শিরশির করছে, তবু ইচ্ছে করছে না গায়ে কিছু জড়িয়ে নিতে।
কলি এলো একটু পর। আমার হাতে একটা প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “খাও।”
দেখি তাতে চিতই পিঠা। সাথে দু’রকমের ভর্তা।
আমি তৃপ্তি করেই খেলাম৷ খিদে পেয়েছিল খুব। মা বোধহয় চেহারা দেখে বুঝেছেন৷ পলাশ সবসময় বলে, বাইরে থেকে দেখে অনেক কিছু আমরা বুঝি না৷ অনেক সময় ভেতরে এমন কিছু থাকে যেটা কল্পনাও করা যায় না।
খাওয়া শেষে কলিকে জিজ্ঞেস করলাম, “বল এবার তোর কী হলো?”
কলি ম্লান মুখে বলল, “বাবা বলেছে ঢাকায় পড়তে যেতে দেবে না। অথচ আমার কত ইচ্ছে ছিল বুয়েটে পড়ার!”
আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। কলি আমার চেয়েও ভালো ছাত্রী৷ এবার এইচএসসি দেবে। ওর ইচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমিই বলেছিলাম ঢাকায় নিয়ে এসে কোচিং করাব৷ তারপর সব জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা দেয়াব। আমার জন্য যদি ওর ভবিষ্যত নষ্ট হয় তাহলে কী হবে? বাবা কেন এত অবুঝ হচ্ছে? কথা বলতে হবে তার সাথে।
বাবা এলেন রাত এগারোটায়। সাথে আমার জন্য বড় একটা সারপ্রাইজ। তার সাথে এসেছে পলাশ! আমি ওকে দেখেই ভয়ে এই শীতের মধ্যেও ঘেমে গেলাম। সে এখানে চলে আসবে কে জানত! কী হবে এবার?
আমার অবশ্য বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হলো না৷ পলাশ বাবাকে এর মধ্যেই হাত করে ফেলেছে। এবার মাকেও অজস্র কথা দিয়ে ভুলিয়ে ফেলল। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম। ভাবলাম বাবাকে ভুলিয়েছে কী বলে? কিন্তু উত্তর পেলাম না।
নতুন করে খাবারের আয়োজন হলো তার জন্য। বাবা আর পলাশ খেতে বসল রাত বারোটায়৷ আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। মা পরিবেশন করছেন খাবার।
বাবা এখনো আমার সাথে কথা বলেননি। সুযোগও হয়নি। খেতে বসে পলাশ অনবরত কথা বলে গেল।
“বাবা জানেন, আইড় মাছ আমার খুব পছন্দ। ছোটোবেলায় বাবার সাথে বাজারে গিয়ে কিনে আনতাম। মা সাথে সাথে কুটে রান্না চড়িয়ে দিত। কী অপূর্ব স্বাদ! মা, আপনার হাতের রান্না খেয়ে মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই।”
আমি জানি, এসব মন ভোলানো কথা না৷ সে মন থেকেই বলছে। তবু অস্বস্তি হচ্ছে। সে আমার মা বাবাকে মা আর বাবা বলে ডাকছে কেন? আর তারাও মেনে নিচ্ছেন কেমন করে?
খাওয়া শেষে একটা পান মুখে দিয়ে পলাশকে নিয়ে বাবা গিয়ে বসলেন বৈঠকখানায়। পলাশও পান মুখে দিয়ে চিবিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখতে হাস্যকর লাগছে। এদিকে ভয়ে আতঙ্কে আমার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আসন্ন ঝড়ের প্রস্তুতি চলছে শান্ত আবহাওয়ায়।
বাবা আমাকে আর মাকে ডেকে পাঠালেন৷ মা কাজ ফেলে হাত মুছতে মুছতে হাজির হলেন বৈঠকখানায়৷ আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম৷ বাবা আমাকে বললেন, “এবার বলো, বিয়ে করেছ কবে?”
আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিয়ে করলাম কখন? পলাশ কি এটা বলেছে বাবার কাছে?
আমাকে কিছু বলতে হলো না, পলাশই গলা খাকারি দিয়ে পানভর্তি মুখে বলল, “বাবা, আপনি একটু ভুল বুঝছেন। আমাদের বিয়ে হয়নি।”
বাবা মুহূর্তেই রেগে গেলেন যেন। “বিয়ে হয়নি মানে? তাহলে কী হয়েছে? তুমি যে আমাকে..”
পলাশ শান্ত সুরে বলল, “আমি আপনাকে একবারও বলিনি আমাদের বিয়ে হয়েছে। শুধু বলেছি আমি শিউলির বন্ধু।”
“তাতে কী? বাবা বলে ডাকছ কেন তাহলে? এমনভাবে কথা বলছ যেন তুমি…”
বাবা কথা শেষ করতে পারছেন না৷ তার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তার ভুল বোঝার কারনও ছিল৷ পরে সব জেনেছিলাম পলাশের কাছে।
সে বাবাকে পেয়ে গিয়েছিল বাজারে। দেখে চিনেছে কারন বাবার চেহারার সাথে আমার খুব মিল। সে বাবাকে পেয়েই তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছে। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর বলেছে সে ঢাকা থেকে এসেছে৷ বাবার ভুল ভাঙতে এসেছে। সে যেন রেগে না থাকে, ভুল না বোঝে আর তাকে আর আমাকে দোয়া করে দেয় ইত্যাদি৷
বিয়ের কথা না বললেও এসব কথায় আর বাবা ডাক শুনে বাবার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে, ওর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা বাড়ি এসে মাকেও একই কথা বলেছে। বাজারে তো কিছু বলা যায়নি, তাই বাবার ইচ্ছে ছিল বাড়ি ফিরে ধীরেসুস্থে বিচারসভা বসাবেন৷ এদিকে কথা তুলতেই সব উল্টে গেল।
পলাশ পরিস্থিতি সামলাতে ওস্তাদ। সে বাবার হাত ধরে বলল, “বাবা, আমরা বিয়ে করে ফেলতে পারতাম৷ কিন্তু আমি চাইনি মা বাবার দোয়া ছাড়া কিছু করতে। আমার নিজের তিন কূলে কেউ নেই। এখন আপনারাই আমার সব। আপনাদের অসন্তুষ্টি নিয়ে আমি আপনাদের মেয়েকে বিয়ে করতে পারি না। মেয়ে আপনার, আপনি আমাকে মেয়ে দেবেন, তবেই আমি ঘরে তুলব। আর আপনারা যা ভাবছিলেন সেরকম কিছু নয়। আপনারা আপনাদের মেয়েকে চেনেন না? সে কি তেমন মেয়ে? ঘরের কথা বিশ্বাস না করে পরের কথা বিশ্বাস করবেন?”
বাবা এসব কথায় ভিজল না৷ ভেজার কথাও নয়। পরে পলাশকে বলেছিলাম ওর ডায়লগটা সস্তা বাংলা সিনেমার মতো হয়ে গেছে।
বাবা না গললেও বাংলা সিনেমার ডায়লগে মা আংশিক গলে গেল। আরও কিছু কথায় সে বাবা মাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করে গেল। ত্রুটি দেখা দিল না একটুও। মা পুরোপুরি গলে গেলে বাবাও মায়ের দেখাদেখি গলতে শুরু করলেন৷ তবে ব্যাপারটা মোটামুটি মেনে নেয়ার পর শুরু হলো কঠিন জেরা৷
পলাশের পরিবার, পড়াশোনা, অতীত, বর্তমান ইত্যাদি নিয়ে কয়েকশো প্রশ্ন!
অনেক কিছু জানতে পারলাম যেগুলো আগে আমি জানতাম না৷
পলাশের বাবা দরিদ্র ছিলেন৷ তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে দিন গুজরান হতো। সম্পত্তি থাকলেও সেসব নিয়ে বিরাট ঝামেলা লেগে ছিল। গ্রামে স্কুলমাস্টারি করে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার টেনেটুনে চলত। ওদের আর্থিক অবস্থা ভালো হতে শুরু করে ও যখন কলেজে পড়ে তখন থেকে। বাবা অল্প কিছু টাকা জমিয়ে একটা কাপড়ের দোকান দিয়ে ফেলেন। তা থেকে ভালো আয় হতে থাকে। অনেকদিন পর সংসারপ্রদীপে সুখের বাতি জ্বলে ওঠে। কিন্তু সুখ বেশিদিন সহ্য হয়নি। কিছুদিন পরেই সব আঁধার করে দিয়ে একসাথে সবাই মারা যায় দুর্ঘটনায়।
পলাশ ঢাকায় ছিল। সবাই মারা যাবার পর ওর এক আত্মীয় ফোন করে জানায় ওর বাবা খুব অসুস্থ, জলদি যেন বাড়ি যায়। বাবার জন্য দোয়া করতে করতে পুরো পথটা পাড়ি দিয়ে বাড়ির উঠোনে দেখতে পায় পরপর সাজানো চারটা লাশ…
এই পর্যন্ত বলার পর গলা ধরে আসে ওর। মা শব্দ করে কেঁদে ফেলেন। পানি চলে আসা আমার আর বাবার চোখেও। কান্নাকাটির ফায়দা এই হয় যে, বাবা মা শুধু গললেন না, তরলের মতো দ্রবীভূত হয়ে গেলেন। সেদিন রাত্রি নাটকের সমাপ্তির পর্দা টানা হলো এটা ঠিক হয়ে যে আগামীকাল আমাদের বিয়ে পড়ানো হবে। বিয়েটা হবে গোপনে। কারন গ্রামের লোকেরা ইতিমধ্যে কানাঘুঁষা করছে। বিয়ে হলে বাবা বলবেন বিয়ে আগেই হয়েছে আর নিজেরাই বিয়ে দিয়েছেন। নইলে গ্রামের লোক বলবে কলঙ্ক ঢাকতে বিয়ের চাদর ব্যবহার করেছি আমরা।
পরদিন সকাল থেকে সত্যিই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। তবে ধুমধাম করে কিছু নয়, সব চুপচাপ। মা বাহারি রান্নাবান্না করলেন৷ আমাকে পরিয়ে দিলেন মায়ের বিয়ের লাল টকটকে শাড়ি। বড় আপা তার তিন বাচ্চা নিয়ে হাজির৷ বিয়ের অতিথি বলতে সে একাই। সেজো আপা আসতে পারেনি তার বাচ্চা হবে বলে। ডেলিভারির সময় সন্নিকটে।
বড় আপার বাচ্চাদের সাথে খেলে সময় পার করে দিলাম৷ পলাশকে বাবা বগলদাবা করে রেখেছেন৷ মনে হচ্ছে হবু জামাইকে তার একটু বেশিই পছন্দ হয়ে গেছে।
আমার বিয়ে বিয়ে কোনো অনুভূতি হলো না। বরং মনে হলো ঈদের দিন। বাড়ির বাতাস খাবারের গন্ধে ম ম করছে। আমি ন্যাপথলিনের গন্ধ জড়ানো শাড়ি পরে বাড়িময় ঘুরছি।
দুপুরের কিছু আগে কাজি সাহেব এলে বিয়ে পরানো হয়ে গেল। ঠিক কাবিননামায় সই করার মুহূর্তে গা শিরশির করে উঠল। হাত পা মনে হলো অবশ হয়ে গেছে। আর আমি দূর তেপান্তর পাড়ি দিয়ে জড়তার দেশে চলে এসেছি৷ এরপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত কী হয়েছে আমি ধরতে পারিনি।
বিকেলটা আড্ডা দিয়ে কাটল। আমরা তিন বোন আর পলাশ মিলে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। পলাশের ভাবভঙ্গি দেখে মনেও হলো না সে প্রথমবার এখানে এসেছে। এই বাড়ির লোকেদের সাথে তার পরিচয় একদিনের মাত্র!
রাতে বাসর ঘরও সাজানো হলো। বাসর ঘর মানে বিছানার পাশের টেবিলে একটা ফুলদানিতে দুটো তাজা গোলাপ আর বিছানায় নতুন চাদরের ওপর কিছু গোলাপের পাপড়ি দিয়ে বানানো লাভ শেইপ। তবু কী ভালো লাগল! নিজের ঘরটা অচেনা লাগতে লাগল। আজ সেই মানুষটা আমার হয়ে গেছে ভাবতেও ভয় ভয় করা আনন্দে গা কেঁপে উঠছে। নিজেকে মনে হচ্ছে জ্বরের ঘোর লাগা মানুষ।
অনেক রাত পর্যন্ত এই দু’দিনের ঘটনা আমরা বিস্তারিত আলোচনা করলাম৷ সে এখানে আসার পর কথা বলারই সুযোগ হয়নি। সে নাকি সব প্ল্যান করেই এসেছিল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত এসব কাহিনী শেষে সে আমাকে নিয়ে গেল জানালার ধারে। বাইরে কুয়াশার চাদরে ছড়িয়ে আছে ফ্যাকাসে চাঁদের আলো। পরিবেশটা ভুতুড়ে, আরামদায়ক নাকি রোমান্টিক কোনটা বলব বুঝতে পারলাম না।
সে এই প্রথমবার গভীর আবেগে আমার হাত ধরল। ধরেই থাকল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, “আজকে আমরা সারারাত গল্প করব কেমন? তোমাকে আমার গল্প বলব।”
“তোমার গল্প তো সব জানি।”
“উহু, আমার যতটুকু তুমি জানো, ততটুকু ওই বাইরের কুয়াশার মতোই অস্পষ্ট। বাকিটা জানতে হবে। অনেক কিছুই আছে অতীতে। আমি তোমার কাছে লুকোতে চাইনি। বলতে চেয়েছিলাম সবই৷ কিন্তু সময়টা আর হলো না।”
আমি তার হাত শক্ত করে ধরে বললাম, “অতীতের কথা থাক না। সেসব দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। আমরা বরং ভবিষ্যতের কথা বলি?”
সে হেসে বলল, “উহু, বলতে হবে। তোমাকে না বললে পেট ফেটে মরে যাব৷ তখন তোমার কী হবে?”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু