ঊষালগ্নে পর্ব-০১

0
1688

ঊষালগ্নে
পর্ব-১

বয়স পঁচিশ আসলে পরিণত বয়স৷ এই বয়সে এসে বয়ঃসন্ধির মতো উথাল-পাথাল প্রেম কোনোভাবেই মানায় না৷ তবু আমার বেলায় কেমন অদ্ভুতভাবে মানিয়ে গেল! আমি নিজেও বুঝতে পারি না কেমন করে কোনোদিন ছেলেদের ব্যাপারে আগ্রহ না দেখানো আমি একটা মানুষের জন্য পাগল হয়ে গেলাম৷

আমার জীবনটা ঠিক সরল নয়৷ অনেক জটিলতা এর মধ্যেই পার করতে হয়েছে। আমরা পাঁচ বোন৷ আমি চার নম্বর৷ অতএব, পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের থেকে আদরের চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি বিরক্তি৷ আমার ছোটো বোন আবার কেন যেন সবারই প্রিয়৷ অবস্থা এমন যে বড় বোন আর ছোটো বোনের জয়জয়কার, আমরা মাঝের তিনজন বানের জলে ভেসে আসা।

আমার ছোটোবেলাটা কেটেছে বড় আপাদের অতি পুরাতন বইপত্র পড়ে। সেগুলো বছরের শুরুতেই সেলাই করে পুরাতন ক্যালেন্ডার দিয়ে মলাট দিয়ে নতুন বানানোর চেষ্টা করতাম। মনে আছে একটা সময়ের স্বপ্ন ছিল নতুন বই পড়া! পাঁচজনের জন্য পাঁচটা পড়ার টেবিল অসম্ভব বলেই আমাকে আজীবন পড়াশোনা করতে হয়েছে বিছানা কিংবা মেঝেতে বসে।

আমি ভালো থাকতে চাওয়া টাইপের মানুষ। তাই সহজে মন খারাপ করতাম না। করলেও অবশ্য পাত্তা দেবার মানুষ ছিল না। যা পেতাম তাই নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকতাম৷

আমাকে নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিল না বলেই মনের সুখে পড়া বাদ দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখতে পারতাম৷ ভোরবেলা উঠে ছাদে বসে গল্প করতাম নতুন ফোটা গাঢ় লাল রঙের গোলাপের সাথে। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করার খুব একটা চাপ না থাকলেও আমি খুব পড়াশোনা করতাম৷ পড়তে ভালোও লাগত। পরীক্ষায় সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে খাতাটা বাবাকে দেখালে তিনি যে হাসিটা দেবেন শুধু তার জন্য। তখন সবকিছু না বুঝলেও অবচেতন মনে জেদ কাজ করত। পাঁচটা মেয়ে হলেই যে কারো জীবন ধ্বংস হয়ে যায় না সেটা বাবা মাকে বোঝাতে ইচ্ছে করত।

আমার বড় আপার বিয়ে হয়ে গেল আমি ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়৷ আপার সাথে আমার খুব একটা সদ্ভাব ছিল না বলে তার কথা তেমন মনে রাখিনি। শুধু একটা কথাই মনে পড়ে। আপার খুব শখ ছিল গা ভর্তি গয়না পরে বিয়ে করার। সেটা হয়নি৷ আপা শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল মুখ কালো করে।

তারপর তার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ক্রমাগত বাড়তে থাকা চাহিদার মুখে আমার চাকুরজীবী বাবার যে নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ তখনো তার কাঁধের বোঝা আমরা চার বোন তো আছিই।

মেজো আপা পালিয়ে বিয়ে করেছিল। বাইরে থেকে হম্বিতম্বি করলেও ভেতরে ভেতরে যে বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন সেটা বুঝতে পারতাম৷ আমার বুকটা ভেঙে যেত কষ্টে।

আমার ততদিনে এসএসসি শেষে কলেজে ভর্তি হয়েছি। সরকারি কলেজ বলে খুব চাপ দিয়ে পড়াশোনা করায় না৷ আমি রোজ কলেজে যাই। কখনো ক্লাস করি, কখনো করি না৷ কলেজের পেছনের বিশাল পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে খাতা খুলে কবিতা লিখি৷ কিংবা লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ি। বাড়ির অশান্তি ভুলে যাই তখন৷ আলতো করে কুয়াশা ছুঁয়ে দেবার কিংবা জলফড়িং এর পেছনে ছোটার ইচ্ছে তীব্র হয়৷ আমি খুঁজি এমন এক ঘ্রাণ যার আবেশ সব দুঃখ কষ্টকে ম্লান করে দেবে।

আমি বেশ ভালো রেজাল্ট নিয়ে এইচএসসি পাশ করলাম। আপারা কেউই এত ভালো রেজাল্ট কখনো করেনি৷ বড় আর মেজো আপার কলেজ শেষেই বিয়ে হয়ে গেছে। সোজো আপা ডিগ্রিতে পড়ছেন৷ আমি যে ভালো কোথাও পড়তে চাই সেটা বলার সাহস হচ্ছিল না৷ বলব বলব ভাবতে ভাবতে একদিন বাবাই খেতে বসে বলে ফেললেন আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়াবেন৷ তার বিশ্বাস আমি টিকে যাব৷

বাবার বিশ্বাস সত্যি প্রমাণিত হলো। আমি টিকে গেলাম৷ চলে এলাম ঢাকায়। হলে থেকে কাটতে শুরু করল আমার নতুন দিনগুলি। এখানে এসে যে নতুন সমস্যাগুলোর সামনে পড়লাম, সেসব খুব সহজ মনে হলো আমার কাছে।

আমি চেষ্টাচরিত্র করে কিছু টিউশনি জোগাড় করে ফেললাম৷ প্রথম কয়েক মাস শুধু বাবার কাছ থেকে চলার মতো স্বল্প টাকা নিয়েছি। টিউশনিগুলে স্থায়ী হয়ে যাবার পর বাড়িতে জানিয়ে দিলাম আর টাকা চাই না৷ এক বছর পর আমি নিজের খরচ চালিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে শুরু করলাম৷ মনে আছে, যেদিন প্রথমবার টাকা পাঠালাম, সেদিন মা ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, বাবাকে তিনি বহুদিন এত খুশি হতে দেখেননি৷

আমার নির্বিবাদ দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল এমনিভাবে। যতদিন না সেই মানুষটার আগমন আমার জীবনে ঘটে।

সেদিনটা আমি লিখে রেখেছি ডায়েরির পাতায়। শরতের এক ঝলমলে বিকেল। আকাশের গাঢ় নীলে সাদা মেঘেদের হুটোপুটি দেখছি বাসের জানালা দিয়ে, পাশে এসে বসল ছেলেটা৷ আমি পাশ ফিরে দেখলাম তাকে। একটু মায়া হলো দেখে। ঘেমে চুপচুপে হয়ে আছে৷ দৌড়ে এসেছে নাকি? চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। মুখ শুকিয়ে আছে৷ জোরে শ্বাস ফেলছে।

আমি ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে জিজ্ঞেস করলাম, “পানি খাবেন?”

সে বোতলটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে খালি করে ফেলল। তারপর বোকা বোকা একটা হাসি দিয়ে বলল, “আরেক বোতল হবে?”

আমি রাগ করব কী, হেসে ফেললাম৷ আমাদের আর কথা হলো না। আমি নেমে গেলাম শাহবাগে। ফুলের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় বরাবরের মতোই ইচ্ছে হলো সবগুলো ফুল তুলে নিয়ে যাই। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, বলো বৎস, কী বর চাও তুমি? আমি উত্তর দিতাম, একটা রজনীগন্ধার বাগান চাই।

হঠাৎ একটা ডাক শুনে পেছনে ফিরলাম৷ নাম ধরে ডাকা নয়, ‘সবুজ জামা আপা শোনেন’ বলে ডাক৷ আশেপাশে তাকিয়ে যখন নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো সবুজ জামা দেখতে পেলাম না তখন নিশ্চিত হয়েই পেছন ফিরলাম৷ একটা সাত আট বছরের ছেলে এগিয়ে এলো। হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। বোতলটা আমার হাতে দিয়ে চলে গেল সে। বোতলের গায়ে স্কচটেপ দিয়ে আটকানো একটা রজনীগন্ধা আর দুটো গোলাপ। সাথে এক টুকরো কাগজ। কাগজে তাড়াহুড়ো করে লেখা কয়েকটা লাইন।

“আমার পুরো জীবনটা কেটেছে একজন সত্যিকার নারীর দেখা পেতে। মনে হয় আজ পেলাম। এমন নারীকে দেবী করে মাথায় তুলে রাখা যায়, যদি সে হতে চায় তবেই। ভালোবাসায় ভালো থাকবেন৷ আমার নম্বর দিলাম, ফোন করলে নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম ভাগ্যবান মানুষ মনে করব।”

আমি লেখাটা বারবার পড়লাম৷ অস্বস্তি লাগল না, তবে বিব্রত বোধ হলো। এক বোতল পানির জন্য এতটা উচ্ছ্বসিত হওয়া বাড়াবাড়ি নয় কি? তবু আমি যত্ন করে চিরকুটটা রেখে দিলাম ব্যাগে। হলে ফিরে সেই বোতলের মুখ খুলে তাতে রেখে দিলাম রজনীগন্ধা আর একটা গোলাপ। আরেকটা গোলাপ রাখলাম বইয়ের ভাজে। আমার বুক কাঁপছে তখন থেকে। হাত পা কেমন যেন শিরশির করছে৷ আমি কখনো ভাবিনি আমাকে কেউ ফুল দেবে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, কিছু মানুষ জীবনে প্রথমবার ফুল পায় তার শেষকৃত্যের সময়৷ নিজেকে সেই শ্রেণীর মানুষ বলেই ভাবতাম।

ঢাকায় এসে আমার দুটো শখ পূরণ হয়েছে৷ একটা হলো পড়ার টেবিলে পড়তে পারা, অন্যটা নতুন বই পড়া।

নীলক্ষেত ঘুরে ঘুরে কম দামে অজস্র গল্পের বইও কেনা হয়েছে। সেসব দিয়ে ভর্তি আমার টেবিল। সামনে পরীক্ষা। বইখাতা ছড়িয়ে নিয়ে বসেও পড়া হলো না। কেন যেন একটা কন্ঠ তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল, “আরেক বোতল হবে?”

আমি ফোন করে ফেললাম একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে। ফোন বেজে বেজে শেষ হলো। কেউ ধরল না৷ আরও দু’বার করলাম৷ এই ফল। আমার চোখে পানি চলে এলো। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসতে থাকল। কেন ফোন করলাম ছেলেটাকে?

তবে আমি মন খারাপ জমিয়ে রাখবার মানুষ নই। ফোনটা বন্ধ করে ফেলে রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝিরিঝিরি বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মন খারাপ কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালালাম আকাশের গোল চাঁদটার দিকে তাকিয়ে। যে চাঁদকে গিলে খাওয়ার জন্য ধাওয়া করে আসছে সাদাটে মেঘ। চাঁদ একবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, আবার একসময় টুপ করে বেরিয়ে এসে ঝিলিক দিয়ে জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব।

মন একটু শান্ত হলে ঘরে চলে এলাম৷ অনুভূতির ক্লান্তিতে লুটিয়ে পড়লাম বিছানায়৷ সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন খেয়াল করলাম চোখের কোণে পানি জমে আছে।

পরদিন সন্ধ্যায় মোবাইল অন করলাম৷ ইচ্ছে করে এতক্ষণ বন্ধ রেখেছি তা নয়, সারাদিন ক্লাস আর টিউশনের চাপে ফোনের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। বুকে কাঁটার মতো কিছু একটা বিঁধে থেকে জানান দিচ্ছিল, তোমার আজ ভালো থাকার অধিকার নেই। তবু আমি জোর করে হাসি ফুটিয়ে রেখেছিলাম মুখে।

মোবাইল অন করার সাথে সাথে আমার ওপর বন্যার পানির মতো নামল মেসেজের ঝড়। সেই নাম্বার থেকেই এসেছে মেসেজ। ফোন বন্ধ পেয়ে পাঠানো এসব মেসেজের প্রায় প্রতিটাতেই ফোন ধরতে না পারার ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি আর ক্ষমা প্রার্থনা।

আমি প্রতিটা মেসেজ পড়লাম। নিজের আর তার দুজনের উপরই হাসি পেতে লাগল। কী ছেলেমানুষী কাজ হলো এটা!

তার ফোন এলো রাত আটটায়। আমি ধরতেই অপরাধী গলায় বলল, “কেমন আছেন?”

“আপনি জানলেন কিভাবে এটা আমার নাম্বার? অন্য কেউও তো হতে পারত!”

সে রহস্য করে হেসে বলল, “আমি জানি এটা আপনি।”

“কিভাবে?”

“একটু আধটু ক্ষমতা আছে এই আরকি।”

“বলেন কী!”

“সত্যি।”

“বলুন তো আমি কোথায় আছি?”

“শামসুন্নাহার হলে।”

“পিছু নিয়েছিলেন আমার?”

সে হেসে ফেলল।

কথা ঘুরিয়ে বলল, “কী করছেন?”

“আপনিই বলুন। সব তো জানেন।”

“পড়ার টেবিলে বসে আছেন।”

“আসলেই তাই। আপনি কিভাবে বুঝলেন? অবাক লাগছে।”

“বলেছিলাম না সব জানি?”

“আচ্ছা, বলুন তো আমি কী রঙের জামা পরে আছি?”

“কালো।”

“কচু! আমি পরে আছি বেগুনী রঙের জামা।”

“আহ! হলো না!”

“হিমু হতে চাইছিলেন?”

“সবসময় চাই। মহাপুরুষ হব বলে নয়, হিমুর আশেপাশে সবসময় সুন্দরী মেয়েরা ঘোরাফেরা করে বলে।”

আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। বললাম, “আমি সুন্দরী নই। হিমুরা কি অসুন্দর মেয়েদের পেছনে ঘোরে?”

“বলতে পারব না। আমার ধারণা সত্যি হয়নি। আমি হিমু না। আর আপনি অসুন্দরও নন।”

“আপনি কে? আপনার নাম?”

“ফুলের নামে নাম। বলতে পারেন কী হতে পারে?”

“শিমুল?”

“কাছাকাছি।”

“পারুল?”

“ধুর! ওটা তো মেয়েদের নাম হয়।”

“পলাশ?”

“হ্যাঁ।”

“ভালো নাম।”

“আপনার নাম এখনো জানি না মিস..”

“আমি মিস নাকি মিসেস এটা জানেন?”

“মিস।”

“কিভাবে বুঝলেন?”

“বঙ্গ ললনারা বিয়ের পর বিয়ের চিহ্ন হিসেবে নাকফুল, হাতের বালা পরে থাকেন।”

“অনেকে তো পরে না।”

“কিন্তু আপনি পরবেন। মানুষ দেখলে বোঝা যায় সে কী করতে পারে।”

“আপনার আর অলৌকিক ক্ষমতা জাহির করতে হবে না।”

“আরে না না, এটা জেনারেল অবজারভেশন।”

“আচ্ছা।”

“আমি রাত এগারোটায় ফোন করলে কথা বলতে পারবেন?”

“নাহ। আমি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি।”

“কথা বলতে চাইছেন না তাই তো?”

“তা নয়…”

“আচ্ছা, আমি কাল ফোন করব।”

অনেক ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি, এখন কোন জরুরি কাজে ফোন রাখা হচ্ছে? কিন্তু করতে পারলাম না।

আমি টেবিলে মাথা রেখে মুখ লুকিয়ে ফেললাম। জীবনে প্রথম কোনো ছেলের সাথে এতটা কথা হলো! মনটা ফুরফুরে লাগছে। এই অনুভূতির সাথে আমি কখনোই পরিচিত ছিলাম না।

একটু পরে একটা মেসেজ এলো, “নিচে আসবেন? এক কাপ চা খেয়ে যেতেন?”

সে এখানে চলে এসেছে! এত পাগলামি কেন করছে? এতটুকুতে প্রেম হয়? আমি তার দিকে আকর্ষিত হচ্ছি চুম্বকের মতো, অথচ মন দ্বিধাদ্বন্দে ভর্তি৷ নিজেকে বোঝালাম, দেখা করাই যেতে পারে। সবকিছু এত সহজ নয়। আমি শক্ত থাকব৷ এখনকার যুগ খারাপ, এটা মাথায় রাখব।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে