#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫৭
ভার্সিটিতে এসে চমকপ্রদ এক তথ্য পেলো মালিহা। তুষারের ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়েছে। চমকে যাওয়ার মতোই খবর। এক প্রফেসরের থিসিস পেপারে কাজ করছিল সে। গুগল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেটা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে সেই পেপারে। প্রফেসর পেপার জমা দিলে কর্তৃপক্ষ সেটা বাতিল করে দেয়, কারণ হিসেবে বলে তথ্য চুরির কথা। প্রফেসর তুষারকে চার্জ করলে সে এক বাক্যে অস্বীকার করে। সেখান থেকেই বাক বিতণ্ডার শুরু। একে একে বেরিয়ে আসে আরো তথ্য। নিজের লেখা বিভিন্ন ছোটখাট আর্টিকেলেও নাকি তুষার এই কাজ করেছে। কেলিয়ে দিয়েছে নিজের নামে। পুরো ভার্সিটিতে যখন তার কুকর্মের চর্চা চলছে তখন তার আক্রমণের শিকার হওয়ার মেয়েগুলো হঠাৎ কিভাবে যেনো একত্রিত হয়ে গেলো। গ্রুপে অ্যানোনিমাস পোস্টের মাধ্যমে বলতে থাকলো তুষারের কীর্তি। একজনকে দেখে সাহস পেলো আরো দুইজন। এভাবে একের পর এক ইস্যু তুষারের দিকে সরাসরি আঙুল তোলায় পালানোর জায়গা পেলো না তুষার। মেয়েগুলোকে গোপন ভিডিও দিয়ে হু’মকি দেয়ার সময়টুকুও পেলো না। থিসিস পেপার কেলেঙ্কারির চারদিনের মাথায় ভিসি নিজে তাকে পুলিশি হেফাজতে পাঠালো। ভার্সিটিতে শৃঙ্খলা রক্ষায় এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না।
পুরো ঘটনা শুনে মালিহার ভালো লাগলো। ভয়ংকর থাবা থেকে সে বেঁচে গেলেও অনেকেই হারিয়েছে জীবনের উচ্ছ্বাস। তাদের আওয়াজ তোলার দরকার ছিল। আরো ভালো হয়েছে অধিকাংশ মানুষের কাছে মেয়েগুলোর পরিচয় গোপন থাকায়। গ্রুপের অ্যাডমিন ছাড়া অন্যকেউ তাদের সম্পর্কে জানে না। এবং অ্যাডমিন দুজন কথা দিয়েছে মেয়েগুলোর কথা কাউকে জানাবে না। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে মালিহা। ঠোঁটে জায়গা নেয় এক টুকরো হাসি। নীতি ধাক্কা দিয়ে বলে, “তুই হাসছিস কেনো?”
ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসে মালিহা, “আজকে যদি আমার সাথে তুষার ভাই এমন কিছু করত তাহলে তুই খুশি হতি না?”
নীতি ভুরু কুচকে বলল, “খুবই বাজে উদাহরন। এমন কথা বলার কোনো দরকারই ছিলো না।”
হাঁটতে থাকা বান্ধবীর হাত আঁকড়ে ধরলো মালিহা। মেয়েটা এমন কথায় রাগ করেছে।
“কতদিনের ছুটিতে যাচ্ছিস! এভাবে আমার সাথে রাগ করে যাবি?”
“তুই এমন আলতু ফালতু কথা বলবি কেনো?”
“আচ্ছা আর বলবো না। কিন্তু নীতি?”
“হু।”
“আমাদের অনার্সের আর তিন বছর। তারপর তুই এক জায়গায়, আমি এক জায়গায়। আমাদের এমন যোগাযোগ কি আর হবে?”
থমকে দাঁড়ালো নীতি। চোখ ঘোরালো মালিহার দিকে। ঢোক গিলে বলল, “সেন্টি খাওয়াচ্ছিস কেনো? চিন্তা করতে এতো মন চাইলে সারপ্রাইজ টেস্টের কথা চিন্তা কর। যখন তখন নিয়ে স্যারেরা হার্ট ব্লক করে দেয়ার শপথ নিয়েছে।”
নীতির কথা ঘোরানো দেখে মালিহা হাসলো। শক্ত করলো হাতের বাঁধন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠল রুমের যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ক্যান্টিনে দেখা হলো নাজিফার সাথে। মেয়েটার মুখে সেই চিরচেনা এক টুকরো হাসি। মালিহা অবাক হয়ে। নাজিফার কি কখনও মন খারাপ হয় না? অথবা কষ্ট? মেয়েটার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। যেনো পৃথিবীর সব সুখ তার কাছে আছে। নীতিকে টেনে নিয়ে ক্যান্টিনে গেলো মালিহা। নাজিফার সামনে দাঁড়িয়েই বলল, “এই নাজিফা! তোমার কখনও মন খারাপ হয় না?”
সরাসরি এমন প্রশ্নে নাজিফা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল, “কেনো বলো তো?”
“তোমাকে তো কখনও মন খারাপ করতে দেখি না।”
নাজিফা হেসে বলল, “মন যখন আছে খারাপ তো হবেই। কিন্তু মনের ডাক্তারের কাছে সেই কথা না বলে চারপাশের মানুষকে দেখাবো কেনো? মনটা যিনি বানিয়ে দিয়েছেন তাঁর কাছে কাছেই মনের সব জমা আছে।”
হুট করে নাজিফাকে জড়িয়ে ধরলো মালিহা, “তুমি আমার অনেক উপকার করেছো নাজিফা। তোমাকে এর বিনিময় দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই।”
মালিহার পিঠে চাপড় দিয়ে নাজিফা বলল, “পাগলি! বিনিময় চেয়েছ কে? জান্নাতে তোমার বাড়ি একদিন দাওয়াত দিও। হিসাব টিসাব যা আছে সব ওখানেই উসুল করে নেবো।” মালিহা হাসলো। কৃতজ্ঞতার হাসি।
নীতির ব্যাগ গোছাতে সাহায্য করলো মালিহা।
“কয় মাসের সফর?”
“আর মাস! সাত দিনই ভালো মতো কা’টে নাকি দেখ।”
“কেনো? আমি তো ভাবলাম অন্তত এক মাস ঘুরবি।”
নীতি মিনমিন করে বলল, “সে তো একমাস ঘোরার কথাই বলেছে। কিন্তু তার তো হুটহাট ফোন আসে। দেখা যাবে বাসে উঠেছি তখনই ফেরত যেতে বলবে।” মন খারাপ করে বলল নীতি। তার হাত ধরে মালিহা বলল, “অযথা চিন্তা ভাবনা করিস না। আল্লাহ ভাগ্যে যতদিন রেখেছেন ততদিনই ঘুরতে পারবি। এদিকে দেখ। এসব কিছু নিবি?” কসমেটিকসের ঝুড়ি দেখালো মালিহা। নীতি কয়েকটা জিনিস বেছে নিলো। তার স্বামী কর্মক্ষেত্র থেকে এক মাসের ছুটি পেয়েছে। সেটা সে কাটাতে চায় নব বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে। পুরো দেশ ঘুরতে চায় এক এক করে।
“মালিহা! তোর সাইয়্যার কি খবর?”
এক চোখ টিপ দিলো মালিহা, “বিন্দাস!”
“বিয়ে করে মুখে বুলি ফুটেছে দেখি!”
“সাইয়্যা শিখিয়েছে!” ফিসফিসিয়ে বলল মালিহা। নীতি খিলখিল করে হেসে ফেললো।
“ব্যাটাকে দেখে মনে হয় না এতো কথা বলতে পারে। তুইই শিখিয়ে দিস।”
“তোর দেখতে হবেও না। নিজের ব্যাটার দিকেই মন দাও নীতি!” শাসন করার ভঙ্গিতে বলল মালিহা। আঁখি ঘরে এলো সেই ক্ষণে, “বিবাহিত মহিলা দুজন ভালোই আছে মনে হচ্ছে!”
“ভালো মানে ভালো! আমাকে চোখেই দেখছে না।” অনুযোগ ভরা স্বরে বলল মনিকা। সে বিছানায় শুয়ে ছিল। মালিহা তাকালো, “আমি ভেবেছিলাম আপনি ঘুমাচ্ছেন আপু! তাই ডাকিনি।”
“হু বুঝি বুঝি! তোমরা এখন জামাই ছাড়া আর কিছু দেখছোও না।”
নীতি যেয়ে মনিকাকে ধরলো আর মালিহা আঁখিকে। দুজনে একসাথে বলল, “তাহলে আপনাদেরও আপনাদের জামাই দেখাই চলুন!”
হেসে উঠলো সবাই। আরো এক টুকরো স্মৃতি জমা হলো মনের সিন্দুকে।
হঠাৎ করেই মালিহা চিন্তা করলো এক বছরের সম্পর্কটার কথা। বেঁচে থাকলে তিন বছর পর দুইজন থাকবে দুনিয়ার দুই দিকে। এই রুমের চারটা মানুষ চারদিকে। নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। স্বামীর সংসার, বাচ্চাদের লালন পালন। হঠাৎ এক ব্যস্ত দুপুরে এই রোদ পড়ে যাওয়া বিকেলের কথা মনে হবে। মনে হবে ক্যান্টিনে বাকি খাওয়ার প্রত্যেকটা হিসাব। চাঁপা ফুলের গন্ধে ভেসে আসবে মন খারাপের সুবাস। মন হাহাকার করবে। কিন্তু ফিরে আসা যাবে না এই রংচটা সিঁড়িঘরে। নোংরা বারান্দা দেখে আর নাক সিটকে বলা হবে না, “ইশ খালা! একটু দেখে পরিষ্কার করবেন তো!”
••
বিকেলে ইতমিনান বলল, “চল মালিহা তোকে একজনের সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি।”
“কার সাথে?”
“আরে চল আগে।”
গোছাতে গোছাতে মালিহা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “তুমি কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে আমাকে তুই করে বলবে না। মানুষ কি বলবে?”
“কি বলবে?”
“তোমাকে অশিক্ষিত বলবে। বউকে তুই তোকারি করে।”
“তাহলে মানুষের সামনে কি বলব?”
“কিছুই বলতে হবে না। চুপচাপ বসে থাকবে।”
“আচ্ছা। বউয়ের আদেশ শিরোধার্য।”
মালিহা দেখলো ইতমিনান একটা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়েছে। পেঁয়াজু ভাজতে দেখেই তার লোভ লেগে গেলো।
“এই পেঁয়াজু খাবো কিন্তু!”
ফিসফিসিয়ে বলল মালিহা। ইতমিনান শুনলো কি না বোঝা গেলো না। হাক ছেড়ে সে ডাকলো, “মানিক মিয়া!”
ভেতর থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এলো। মালিহা স্পষ্ট দেখলো ইতমিনানকে দেখে তার চোখ চকচক করে উঠেছে। কিন্তু মুখে নির্বিকার ভাব। যেনো কিছুতেই তার কোনো যায় আসে না।
ইতমিনান চওড়া হেসে বলল, “মালিহা এটা আমার বন্ধু!”
মানিক বিবশ চোখে ইতমিনানের দিকে তাকালো। বন্ধু? এই প্রথম! এর আগে কেউ কি বলেছে, দেখো দেখো এই ছেলেটা আমার কি হয়!
মানিকের দিকে ঝুঁকে ইতমিনান ফিসফিসিয়ে বলল, “বড়লোক হয়ে গিয়েছি মানিক মিয়া! এই যে আমার সম্পদ!”
মানিকের মাথায় হাত দিয়ে মালিহা বলল, “তোমার নাম কি?”
“মানিক মিয়া এভিনিউ!” উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল ইতমিনান। মানিক মুখ বাঁকা করে বলল, “এই নামে আর ডাকন যাইবো না।”
“কেনো?”
“নিজেই ঝামেলা করসি। কি আর কমু! সেই হুজুরে আমারে তার মাদ্রাসাত ভর্তি করাইসে। নাম শুইনা বলসে “জায়গার নাম মানুষের নাম হবে কেনো? মানুষের নামে জায়গা হবে।” একদম ভঙ্গি নকল করে বলল মানিক। ইতমিনান অবাক হয়ে বলল, “তুমি এখন মাদ্রাসায় পড়?”
“শুরু করি নাই। আগামী বছরের শুরু থিকা। ততদিন হুজুর কুরআন পড়াইবো।”
ইতমিনান খুশি হলো। বলল, “এই খুশিতে কয়েকটা পেঁয়াজু খাওয়া যাক। কি বলো মানিক মিয়া? আচ্ছা এখন তোমার জীবনের লক্ষ্য কি?”
“যেই মসজিদে মা’ইর খাইসি সেই মসজিদে ইমামতি করা।”
মানিক ভেতরে চলে গেলো। ইতমিনান অবাক হয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “ওকে আমি ভালো ভাবছিলাম। এ তো দেখি ডে’ঞ্জা’রাস!” মালিহা ভুরু কুচকে তাকিয়ে রইলো। কিছুই বুঝতে পারেনি সে। কোত্থেকে ছুটে এলো লালপাহাড়। ইতমিনানের পায়ের কাছে এসে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলো। মালিহা ভয় পেয়ে একপাশে গেলে ইতমিনান বলল, “ভয় নেই। ও বকা দিচ্ছে।”
“বকা দিচ্ছে!” মালিহা অবাক হয়ে বলল।
“হু।”
“তুমি চেনো নাকি?”
স্মৃতিকাতর দৃষ্টিতে ইতমিনান বলল, “অবশ্যই! এটা আমার ডান হাত।”
ইতমিনান লালপাহাড়ের সাথে কি কি যেনো বলতে শুরু করলো। মালিহা অতো খেয়ালও করেনি। হঠাৎ মানিক পেছন থেকে পেঁয়াজুর প্যাকেট এনে নিচু কণ্ঠে বলল, “আপনে ভালা মানুষ! আপনার বর কিন্তু পাগলা আছে। রাস্তার পোলাপান ধইরা মসজিদে নিয়া যায়। ব্যাডার মাথা ঠিক নাই। খেয়াল রাইখেন।”
সেই কথা ইতমিনানকে বললে সে হাসলো। প্রশ্রয়ের হাসি। যেনো এমন পাগল সে সারাজীবন থাকতে চায়।
ইতমিনান চলে গেলো মসজিদে। এটুকু পথ একাই বাড়ি গেলো মালিহা। পথে দেখা হলো ইরিনের সাথে।
বিদ্ধস্থ তার অবস্থা। ছুটে এসে মালিহাকে বলল, “মালিহা তোমার টাকাটা আমি কালই দিয়ে দেবো। এই সময়ে কালকে এখানে আসতে পারবে?”
হঠাৎ ইরিনকে দেখে মালিহা চমকেছে বটে। একে তো ভার্সিটিতে যায় না তার ওপর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যেন কয়েকমাসের রোগী। মালিহা অবাক হয়ে বলল, “কি হয়েছে তোমার? ভার্সিটিতে যাও না আর। কেনো?”
“কিছু না। কিছু হয়নি। বলো মালিহা কালকে এখানে আসতে পারবে? তোমার টাকাটা..”
সুন্দর করে হেসে মালিহা বলল, “দান করে দেয়া টাকা কেউ ফেরত নেয় নাকি? আমি তো নিই না।” তার চোখে ভাসলো কালো মেঘে ঢাকা সেই রাত। কয়েকটা ফোনকল, একই যান্ত্রিক কণ্ঠ।
ইরিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মালিহা বলল, “আসি। ভালো থেকো।”
••
লতা মালিহাকে সুন্দর একটা শাড়ি উপহার দিয়েছেন। কালো পাড় লাল শাড়ি। লাল জমিনের কার্নিশ ঘেষে চিকন কালো সুতার কাজ। মাঝে মাঝে কিছু চুমকি বসানো। সুন্দর করে শাড়িটা পড়ে চটপট করে সাজলো মালিহা। ইতমিনান এলে বেশ একটা চমক দেয়া যাবে।
শাশুড়ির ফোন পেয়ে তটস্থ হলো মালিহা। আয়েশার প্রতি ভয়টা তার আর কাটবে না বোধহয়।
“মালিহা তোমার মা কে বলবে আমার ওপরে এতো দয়া দেখানো লাগবে না।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল।
“কি হয়েছে।”
“সেটা তোমার মায়ের কাছেই শুনে নিও।” খট করে কেটে দিলেন আয়েশা। নাজিয়ার কাছে ফোন দিলে জানা গেলো আয়েশা অসুস্থ থাকার কারণে নাজিয়া রান্না করে ছেলেকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। এতেই ক্ষেপে গেছেন আয়েশা। মালিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এটুকু যে পুরো কথা নয় সেটা সে জানে। আয়েশা কি বলেছেন সেটা যেমন তিনি বলবেন না। আবার নাজিয়া কি বলেছেন সেটা তিনি বলবেন না। নিজের দোষটা কেউ দেখছে না। আবার কাউকে একটু ছাড় দেয়ার মানসিকতাও তাদের নেই। তাদের মাঝে চাপা পড়েছে মালিহা। একূল অকূল, দুই কূলের ঢেউ আছড়ে পড়ে তার ওপর। উপরি পাওনা হিসেবে আছে মিলি। যে করছে চোরাবালির কাজ। মালিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ইতমিনান যদি তার জন্য প্রশান্তির জায়গা না হতো তাহলে সম্পর্কের এসব টানাপোড়েন সে অদেখা করতে পারতো না। সকলের মাঝে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যেতো। আবার ফোনকলের শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। মিতুল ফোন দিয়েছে।
“আপা! জীবনে আমি বিয়ে করবো না। নিজের শান্তিপূর্ণ জীবন ধ্বং’স করার কোনো ইচ্ছাই আমার নাই।”
এক নিশ্বাসে বলে রাশেদার কানে ফোন দিয়ে চলে গেলো মিতুল। মালিহা বলল, “ও এসব বলল কেনো দাদি?”
“ওর কথা! মা চাচীর ঝগড়া দেখে এসব বলেছে। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্।” ক্লান্তির শ্বাস ছেড়ে বলল মালিহা। রাশেদা টের পেলেন সেই ক্লান্তি।
“এটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে গেলে হবে? তোমার ভূমিকা এখানে অনেক গুরুত্বপুর্ন। ইতুরও। একদিকে ঝুঁকে যাওয়ার উপায় নেই।”
“এজন্যই তো ভয় লাগে দাদি। পড়া ঝগড়া করবে তার ঝড় উঠবে আমাদের সম্পর্কের উপর দিয়ে।”
“অস্বাভাবিক না। তোমাদের মায়েরা একজন আরেকজনের সাথে সবসময় এমন ঝগড়াঝাঁটি করলে তো তার কিছুটা প্রভাব তোমাদের ওপরেও পড়বে। তোমরা নিজেরা শক্ত না থাকলে, বুদ্ধি দিয়ে বিচার না করলে টিকে থাকা কষ্ট। তখন সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই সেখানে অশ্রদ্ধা জায়গা করে নেবে। অনেক সাবধানে থাকবে।”
“দোয়া করো দাদি।” নিচু কণ্ঠে বলল মালিহা।
“আপাতত রাফির জন্য বেশি বেশি দোয়া করছি। ও যেনো একটা ভালো বউ পায়। তারপর সময় পেলে তোমাদের জন্য দোয়া করবো ইনশাআল্লাহ্।” হেসে ফেললেন রাশেদা। হাসলো মালিহা নিজেও।
কলিংবেলের শব্দ দরজা খুলতেই ইতমিনানের সাথে আরো একটা পুরুষ কণ্ঠের আভাস পেলো মালিহা। দরজার নবে ধরে কান এগিয়ে নিলো দরজার দিকে। কেউ একজন আছে ইতমিনানের সাথে। তালা খোলার শব্দ ইতমিনান নব মুচড়ে দরজা ঠেলে দিলো। মালিহার কপালে লাগলো দরজা। শাড়ি সামলে এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো সে।
ইতমিনান ঘরে এসে দেখলো তার ঘরের রানী রাগে ফুসছে। সে যেতেই ফেটে পড়ল যেনো।
চাপা কণ্ঠে হিসিহিসিয়ে বলল, “তোমার কোনো আক্কেল জ্ঞান আছে! ঠাস করে একটা পুরুষ মানুষ নিয়ে চলে এসেছ। আমাকে আগে থেকে জানাবে না?”
থতমত খেয়ে গেলো ইতমিনান।
“একদমই মনে পড়েনি।”
“নিজেকে এখনও ব্যাচেলর ভাবল মনে পড়বে কিভাবে?”
“আরে তোর স্টুডেন্টের মামা। ঐ যে রনি। লামিয়ার মামা।”
“তো তার সামনে এভাবে আমি শাড়ি টাড়ি পড়ে যাই আর কি!”
এতক্ষণে ভালো করে মালিহাকে খেয়াল করলো ইতমিনান। তখনই মনে হলো এই যে মালিহা তাকে ঝাড়ি দিচ্ছে! সে হেসে বলল, “সরি। ভুল হয়ে গেছে।”
“তোমার বন্ধুকে নিয়ে ঐ ঘরে ঢোকো। আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।”
“ডান চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। ঐটা ঠিক কর তুই। আমি চা দিচ্ছি।”
ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা দেখলো মালিহা। আসলেই লেপ্টে গেছে। ক্যামেরা দিয়ে কি আর সাজুগুজু করে যায়! একটা ছোট দেখে আয়না কিনতে হবে।
বন্ধুকে বিদায় দিয়ে বউকে মানাতে এলো ইতমিনান।
“তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি?”
“আয় দেখবি।”
মালিহা বের হলো ঘর থেকে। ডায়নিং রুমে একটা সাইকেল রাখা। ফুল দিয়ে সাজানো। মালিহা বলল, “সাইকেলটা কবে নিয়ে আসলে? আমাকে তো বলনি।”
“এটা নতুন। আজকেই কিনেছি।”
“আবার সাইকেল কিনেছো কেনো? বাড়িতে তো একটা আছেই!” এই কথা বললেও মালিহা সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেলো। ফুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো।
“বাড়িরটা বাড়িতেই থাকুক। এটা এখানে থাকবে। কতসময় কতো কাজে লাগে। তোকে এটায় করে ভার্সিটিতে দিয়ে আসবো।”
মালিহা হাসলো, “আচ্ছা।”
“মিতুর মতো সাজানোর চেষ্টা করেছি। হয়নি।”
“মিতুর মতো হয়নি। ইতুর মতো হয়েছে।”
“মালিহা বাইরে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চল সাইকেলে করে ঘুরে আসি।”
একবাক্যে রাজি হলো মালিহা।
“চলো।”
এদিকের নিয়ন বাতিগুলো সম্ভবত নষ্ট হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার বেশি একটা সুবিধা করতে পারছে না। চাঁদ যে আছে তার তো আর লোডশেডিং হয় না। তার জোৎস্না চুয়ে চুয়ে পড়ছে পুরো এলাকায়।
“তোর সেই প্রেমিকের কি খবর?”
সুন্দর আবহাওয়া উপভোগ করছিল মালিহা। ইতমিনানের পেটে রাখা ছিল তার হাত। সেখানে চিমটি দিয়ে বলল, “উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। ও কোনোকালেই আমার প্রেমিক ছিলো না।”
“উঃ! সাইকেল থেকে আমি একা পড়বো না। তোকে নিয়েই পড়বো কিন্তু!”
“ভালো হবে।।দুজন একসাথে বাড়ি বসে আহা উহু করবো।” হেসে বলল মালিহা। নিজেই আবার বলল, “এহসান আর্মিতে জয়েন করেছে।”
“তাই! কবে?”
“এই ইয়ার ফাইনালের পর। কয়েকদিন আগেই শুনলাম।”
“ভালোই হয়েছে।”
“আমি ভাবছি নরম সরম একটা ছেলে। আর্মিতে টিকবে কিভাবে?”
“ওকে নিয়ে তোর এতো ভাবা লাগবে না। আমাকে নিয়ে ভাব।”
“ভাবছি। আচ্ছা বলো তো তোমার শাশুড়ি আর আমার শাশুরি সবসময় এভাবে ঝগড়া করতে থাকলে আমাদেরও ঝগড়া হবে না?”
“আমাদের ঝগড়া ওরা না করলেও হবে। তুই যখন বলবি আমি শুনবো আর আমি যখন বলবো।”
মালিহা সন্দেহী কণ্ঠে বলল, “তারপর সরি কে বলবে?”
“অবশ্যই আমি!”
খিলখিলিয়ে হেসে ফেললো মালিহা। বাহবা দিলো ইতমিনানকে। জোৎস্না ছেয়ে যাওয়া সেই নীরব রাস্তায় তারা দেখলো না লাইটপোস্টের পাশেই বসে আছে এক জোড়া পাখি। কি সুন্দর তাদের কিচিরমিচির!
সমাপ্ত।