#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫৬
হকচকিয়ে গেলো ইতমিনান। ফোন এনে সামনে ধরলো। মিলিই ফোন দিয়েছে। ভারী কণ্ঠে ইতমিনান বলল, “মিলি? কি হয়েছে?”
“ভাইয়া! ভাইয়া!”
“হ্যাঁ! কি হয়েছে? কাঁদছিস কেনো মিলি?” ইতমিনানের অস্থির কণ্ঠে মালিহা উঠে বসলো। ইতমিনানের ভাবভঙ্গি দেখে ভয় পেয়ে গেলো সে। বাহু আঁকড়ে ধরে বলল, “এই! কি হয়েছে?” ইতমিনান মালিহাকে থামতে ইশারা করলো। ফোন লাউডস্পিকারে দিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “মিলি বল কি হয়েছে?”
“ইমন.. ইমন এক্সিডেন্ট করেছে ভাইয়া।” আবার কাঁদতে শুরু করলো মিলি।
ইতমিনানের কণ্ঠ উঁচু হলো। লাফিয়ে উঠলো সে, “কখন? পাশে কে আছে? বাবা মা কেউ এসেছে?”
মকবুল আলীর আওয়াজ শোনা গেলো। ইতমিনান বিস্তারিত শুনলো। রাত এগারোটার দিকে এক্সিডেন্ট করেছে ইমন। স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করলেও তারা চিকিৎসা শুরু করেনি। মধ্যরাতে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায়নি। এই খবর শুনে সকলে বিচলিত হয়ে পড়েছে।
“তাহলে এখানকার মেডিকেলে নিয়ে এসো বাবা।”
“ওখানে তো কাউকে চিনি না।”
“চিনতে হবে না। আমি দেখছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো।”
ফোন রেখে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে শুরু করলো ইতমিনান। আলনার কাছে যেয়ে জামাকাপড় বদলাতে শুরু করলো। মালিহা উঠে এলো, “কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“হাসপাতালে।”
“কাউকে চেনো?”
মাথা নাড়লো ইতমিনান। চেনে না সে।
“তাহলে যেয়ে কি করবে?”
“কিছু তো করতে হবে। হাসপাতালের লোকদের সাথে কথা বলে দেখি।”
“তোমার ফ্রেন্ড, ঐ যে লামিয়ার মামা। কি যেনো নাম? তার সাথে যোগাযোগ করে দেখো।”
রনির নাম মাথায় আসতেই তাকে ফোন দিলো ইতমিনান। দুইবারের মাথায় ফোন ধরলো রনি। ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল, “বল ইতমিনান।”
“একটা বিপদে পড়েছি রে!”
বিস্তারিত বলতেই রনি সজাগ কণ্ঠ বলল, “তুই বের হ। ঐদিকে গাড়ি পাবি? থাক আমি বাইক নিয়ে আসছি। আমার ফুপাতো ভাই মেডিকেলে ইন্টার্নি করছে। ওকে বলে দেখবো। তুই রেডি হয়ে থাক।”
ঝটপট গুছিয়ে নিলো ইতমিনান। মালিহা বলল, “আমিও যাই?”
“না না! তুই এখন যেয়ে কি করবি? আমি আগ যেয়ে দেখি।”
“মিলি আপা আসবে। যাই না!”
“অযথা জেদ করিস না মালিহা!” শক্ত কণ্ঠে বলল ইতমিনান। ধমক শুনে চুপ করে গেলো মালিহা। বাকি সময়টুকু মুখ কালো করে রাখলো।
তালা খুলে হঠাৎ করে পিছু ঘুরল ইতমিনান। একটু দূরে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মালিহার কাছে এগিয়ে গেলো। জড়িয়ে ধরে বলল, “রাগ করেছিস? তোকে সকালে নিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ্। উঠেছিস যখন একটু নামাজ পড়। আমার বোনটার জন্য দোয়া কর মালিহা। ওর ওপরে রাগ রাখিস না!” ইতমিনানের কণ্ঠ কেঁপে উঠল। তার পিঠে হাত রাখলো মালিহা। তাকে ভেজা কণ্ঠে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাইকের হর্ন বাজলো। বেরিয়ে গেলো ইতমিনান। রনির পেছনে উঠে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মালিহার দিকে। চিৎকার দিয়ে বলল, “দরজা বন্ধ কর! ভেতরে যা!”
মালিহা ভেতরে ঢুকে শুনলো বাইক ছাড়ার আওয়াজ। ওযু করে দাঁড়িয়ে গেলো নামাজে। সে জানে এখানে, এই সময় তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না। কাজেই আশা ভঙ্গ হওয়ার দুরাশা নেই।
•
মিলির অবস্থা বেহাল। কাঁদতে কাঁদতে দুইবার জ্ঞান হারিয়েছে সে। মকবুল আলী একা রোগী এবং আধা রোগী দুজনকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন। একটু পরপরই ড্রাইভারের কাছে শুনছেন আর কতদূর। আরো কত দূরে? রাতের শঙ্কিত অন্ধকারের বুক চিরে মাইক্রো বাসটা ছুটে চলেছে বেশ গতি নিয়ে। জ্যাম নেই, আশপাশে মানুষের হল্লা নেই। মকবুল আলীর কাছে শহরের রাস্তা অপরিচিত মন হলো। দীর্ঘ তিন ঘণ্টার পথ শেষ হলো দুই ঘণ্টা বিশ মিনিটে। ড্রাইভার ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে নামতেই ছেলের দেখা পেলেন মকবুল। হাত ধরার লাঠি পেয়ে যেনো নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। ভেঙে করলেন ছেলের বুকে। ইতমিনান সামলে নিলো।
“এখন কান্নাকাটির সময় বাবা? আগে ইমনের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
সব গুছিয়েই রেখেছিল দুজনে। রোগীকে দেখেই ডাক্তার জরুরী নির্দেশে অপারেশন থিয়েটারে লাঠিয়ে দিলেন। ভাইয়ের বুকে আছড়ে পড়ল মিলি।
“তুমি আমার ওপরে রাগ করেছো ভাই? আমাকে বদদোয়া দিয়েছো? নাহলে আমার এই অবস্থা হলো কেনো!”
ইতমিনান কিছুই বলল না। শুধু হাত রাখলো মিলির মাথায়। কিছুক্ষণের মাঝে মিলি আবারো জ্ঞান হারালো। নিরীক্ষা করে জানানো হলো অতিরিক্ত চিন্তা এবং ভয়ের কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো মিলিকে।
তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অপারেশন চলল। লাল লাল চোখ নিয়ে বসে থাকলো ইতমিনান। তার গলা শুকিয়ে এসেছে। বোনের মুখ চোখে ভাসলেই বাস্তবিক জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। এই দুই ঘণ্টার পুরোটা সময় বারবার শুধু ইমনের সুস্থতা কামনা করে এসেছে ইতমিনান।
ক্লান্তিতে যখন চোখটা লেগে এসেছে তখনই কারো গলার আওয়াজে চোখ খুললো ইতমিনান। ডাক্তার বের হয়েছেন। বিস্তারিত শুনলো ইতমিনান। পায়ের গোড়ালিতে ফ্র্যাকচার হয়েছে। ডান হাত ভেঙে গেছে। বাইক থেকে ছিটকে পড়ায় শরীরের অনেক জায়গা ছিলে গেছে। হাসপাতালে সপ্তাহ খানেক থাকতে হতে পারে। তারপর টানা এক মাসের বেড রেস্ট। আশা করা যায় তারপর এমন সুস্থ হয়ে যাবে।
সব শুনে হাফ ছাড়লো ইতমিনান। মকবুল আলী চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিলেন। মালিহার কথা মনে পরতেই ফোন বের করলো ইতমিনান। কল করার সাথে সাথেই ধরলো মালিহা।
“হ্যালো?”
“হ্যাঁ বলো। কি খবর ঐ দিকের।”
বিস্তারিত জানালো ইতমিনান। মালিহা স্বস্তি প্রকাশ করলো। শেষে বলল, “অপারেশনে ঢোকানোর পর আমাকে একটা কল দিতে পারতে। আমি চিন্তায় ছিলাম।”
ইতমিনান অপরাধ বোধ করলো।
“সরি মালিহা। ভুলে গিয়েছিলাম।”
“শুধু আমাকেই ভুলে গেছো নাকি বাড়ির সবাইকেও ভুলেছো?”
জিহ্বায় কামড় দিলো ইতমিনান। “কাউকেই জানানো হয়নি!”
“ভেরি গুড! কারা কারা এসেছে?”
“মিলি আর বাবা।”
“আচ্ছা সকালে এসে খাবার নিয়ে যেও। আমি কি যাবো তখন?”
“আমি নিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ্।”
চটপট বাড়িতে ফোন করলো ইতমিনান। আয়েশার কাছে বকাও খেলো খানিক।
••
দীর্ঘ এক সপ্তাহের পুরোটা সময় মিলি ভাইয়ের বাড়িতে থাকলো। প্রথমদিন মালিহার সাথে চোখাচোখিও করতে চাইলো না। মালিহা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। ইতমিনানের অনুপস্থিতিতে একদিন মিলির কাছে যেয়ে বলল, “আপা!”
মিলি তাকালো না। ইমনের কাপড় গোছানোর কাজে আরো একটু মনোনিবেশ করলো।
“আপা! কথা বলবে না আমার সাথে?”
মিলি উঠে চলে যেতে চাইলে মালিহা হাত ধরে বলল, “আপা আমি তো আগে তোমার বোন। তারপর ভাইয়ের বউ। আমার ওপরে রাগ থাকলে তুমি বকো। দুই একটা চড় থাপ্পড়ও মা’রতে পারো। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে রেখেছো কেনো?”
এই কথার উত্তর মিলি না দিলেও পরর্বতীতে মালিহার কথা শুনল। মালিহা কিছু বললে না শোনার ভান করে এড়িয়ে গেলো না। আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা না বললেও তাকে মালিহার সাথে কথা অন্তত বলতে দেখা গেলো।
দুঃখ করে ইতমিনানের সাথে সবটা শেয়ার করলো মালিহা।
“আপা আমার সাথে কথাই বলতে চায় না।”
ইতমিনান মালিহাকে স্বান্তনা দিলো।
“কয়েকদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্। তুই চিন্তা করিস না।”
মালিহা উত্তর দিলো না। সে সেদিন মিলিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে এটাও বলল না। সম্পর্ক এমনভাবেই টিকে রাখতে মালিহা পারবে কি না সেই বিষয়ে মিলি সন্দেহ প্রকাশ করে গেছে সেটাও বলল না ইতমিনাকে। মালিহা বুঝলো সবার মন একজীবনে রক্ষা করা যায় না।
চলমান।