#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫০
রাত জাগার কারণে ইতমিনান ফজরে উঠতে পারেনি। এজন্য আয়েশা তাকে একটু পর পরই বকছেন। ইতমিনান মুখ গোজ করে আছে। যার জন্য করে চুরি, সেই কয় চোর। রাতটা সে জাগলো কার জন্যে? ফজর কি ইচ্ছে করে মিস করেছে সে? যেনো তার কষ্ট লাগছে না! জোরে জোরে প্যান্ট ঝাড়ল ইতমিনান। সেই শব্দ শুনতে পেয়ে আয়েশা ঐ ঘর থেকে রুগ্ন গলায় ধমকে উঠলেন, “বেয়াদব! রাগ দেখাস কার সাথে? তোর রাগের ধার ধারি না আমি। আল্লাহ যখন প্রশ্ন করবেন তখন কি উত্তর দিবি? মায়ের সেবা করতে যেয়ে নামাজ কাযা হয়েছে? মাফ চাই! এমন সেবা সারা জীবনে আমার দরকার নাই।”
ইতমিনান জামাকাপড় পাল্টে মায়ের কাছে গেলো। সোজা কপালে হাত দিয়ে জ্বরের অবস্থা দেখলো। হাঁফ ছেড়ে বলল, “আমি যাচ্ছি।” আড়চোখে একবার পাশে ঘুমিয়ে থাকা মালিহার দিকে তাকাতে ভুললো না। আয়েশা বললেন, “ওকে এভাবে রেখে যাচ্ছিস কেনো? ভার্সিটিতে দিয়ে আয়।” ইশারা করলেন মালিহার দিকে। ইতমিনান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “যাবে না। ঘুমানোর আগে আমাকে বলেছে। আচ্ছা যাই। আসসালামু আলাইকুম।” ধরাম দরজা লাগিয়ে তালা দিয়ে গেলো ইতমিনান। ডুপ্লিকেট চাবি মালিহাকে দেখিয়ে দিয়েছে। কাজেই চিন্তা নেই।
দরজা বন্ধ করার শব্দে আয়েশার মেজাজ খিঁচড়ে এলো। মালিহা কেঁপে উঠল। পরপর চোখ খুলে আশপাশে তাকালো। কাঁচা ঘুম ভাঙার ফলে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। আয়েশা বেগম সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন, “একটা কাজ যদি ঠিক করে করতে পারে!”
উঠে কতক্ষন বসে রইলো মালিহা। বাথরুমের দিকে গেলে আয়েশা ভাবলেন হাতমুখ ধুতে যাচ্ছে। কিন্তু অনেকটা সময় পর মালিহা বের হলো বালতি হাতে। ফ্ল্যাটের বারান্দাটা একেবারে এইটুকু। মালিহার কাছে মনে হয় যেন পুরান ঢাকার রাস্তা। সেখানে বেঁধে রাখা দড়িতে কোনরকমে কাপড় মেলে দিলো সে। রাতে তার আর আয়েশার পাল্টে রাখা কাপড় বাথরুমেই দলা পাকিয়ে রেখে দিয়েছিল। সেসব ধুতে যেয়ে শাড়ির পাড় ভিজে যাওয়ায় নিচের দিকে জড়িয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। কুচি ধরে এগিয়ে এলো ঘরে। আয়েশাকে বলল, “চাচী কি খাবেন আপনি?”
আয়েশা নীরবে মালিহাকে পরোখ করছিলেন। মনে মনে মেয়েটার প্রতি মুগ্ধ হতে বাধ্য হয়েছেন। তার চোখে ভাসছে শুধু কাল রাতে ঝাপসা চোখে দেখা সেই দৃশ্যটা। ছেলের বুকে মাথা এলিয়ে পড়ে ছিলেন। তখন কোমল ছোঁয়ায় তার কষ্ট লাঘব করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে মেয়েটা। কুচিন্তায় যাকে দুর ছাই করছিলেন তার সাহায্যের মুখাপেক্ষী করিয়ে দিলেন সৃষ্টিকর্তা। কি নিদারুণ খেলা!
“মুখটা তিতা তিতা লাগছে। কিছু খাবো না।”
“কিছু না খেলে তো ওষুধ খেতে পারবেন না।”
“ওর ঘরে যে কি আছে তাও তো ভালো জানি না। কাল। এক প্যাকেট সুজি দেখেছিলাম। ওটাই নিয়ে এসো।”
“দুধ তো নেই।”
“পানি দিয়ে জাল দিয়ে আনো।”
মালিহা রান্নাঘরে গেলো। সুজি এনে আয়েশার কাছে দিকে তিনি নিজেই খেলেন। বাটির সবটা খাবার শেষ করে শান্ত বললেন, “লবণ দিতে বোধহয় ভুলে গেছিলে। খেয়াল রেখো।”
জিহ্বায় কামড় দিলো মালিহা। একদমই ভুলে গেছে।
“তুমি কি খাবে?”
“চা আছে দেখলাম। এক কাপ চা আর বিস্কুট খেলেই হবে।”
“তোমার পরীক্ষা না?”
“জি।”
“কবে থেকে?”
“কাল থেকে শুরু।”
“তাহলে আজকে চলে যাও। আমি আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। ইতুর বাবাকে বলবো এসে নিয়ে যেতে। তুমি যেয়ে পড়াশোনা করো।”
মালিহা মাথা নিচু করে বলল, “বই নিয়ে এসেছি চাচী। সমস্যা নেই। কালকে পরীক্ষা শুরুর ঘন্টাখানেক আগে চলে গেলেই হবে। আপনাকে এভাবে রেখে যাবো না।” মাথা নাড়ল মালিহা। আয়েশার কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেলো। কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। মালিহা পাশে বসেই গুনগুন করে পড়তে লাগলো।
••
মালিহা তখন রান্নাঘরে। তরকারি সাজিয়ে বসে আছে। কিন্তু কি যে রান্না করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। ভাবলো একবার আয়েশার যাচ্ছে যেয়ে শোনে। কিন্তু তার গম্ভীর প্রতিচ্ছবি মনে ভয় ধরিয়ে দিলো। অস্বস্তিতেই আর গেলো না সে। নিজের মতো করেই রান্না করতে শুরু করলো।
মিলির কাছে কথায় কথায় মালিহার কথা বলতেই মেয়েটা ক্ষেপে উঠলো যেন।
“আমি জানতাম ঐ মেয়ে ভাইকে ঘোল খাইয়েছে।”
“তোর ভাই নিজেই খেয়েছে। ওকে খাওয়ানো লাগেনি।”
“ফালতু কথা বলবে না মা। তুমি বাড়ি আসো। এবার ভাইয়ার একটা বিয়ে দিয়েই ছাড়বো।”
“সেবা টেবা পাচ্ছি ভালোই লাগছে। আর দুইদিন পরে যাবো ভাবছি।”
মিলির কপালে ভাঁজ পড়ল, “কে তোমার সেবা করছে এতো? ভাইয়া?”
“না। মালিহা।”
“মালিহা! ও কোত্থেকে এলো?”
অসুস্থতার ঘটনা জানালেন আয়েশা। মিলির সন্দেহ মাখা উত্তাপে যেনো আগুনের হলকা বয়ে গেলো।
“মা! ভালো চাইলে ওকে বের করো। তোমার ছেলের বাড়িতে ও কেনো এসেছে? ইচ্ছে করে এতো থাকার মানে কি! তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছো না?”
“পারছি।”
“তাহলে!” অস্থির হয়ে উঠল মিলি
“আরেকটু বোঝার বাকি আছে। তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবো।”
“কিসের সিদ্ধান্ত? মা! তোমার কথাবার্তা আমার কাছে ভালো লাগছে না। ভবিষ্যতে যেনো আমি বাপের বাড়ি যেতে না পারি সেই ব্যবস্থা করবে না দয়া করে।”
“আচ্ছা। একটা কাজ কর। মালিহার নাম্বার আছে তোর কাছে?”
“আছে। কেনো?”
“জামাইকে বলে দোকান থেকে ওর নাম্বারে পাঁচ হাজার টাকা পাঠা।”
“কি আশ্চর্য! কেনো?”
“আমি বলছি তাই। তোর কাছে থাকলে দে। আমি বাড়ি যেয়ে দিয়ে দেবো। না থাকলে ম্যানেজ করে দে।”
“তোমার মাথা পাগল হয়ে গেছে মা!”
ক্ষোভের সাথে শুরু করলেও কথাটা আর্তনাদ করে শেষ করলো মিলি। তার মায়ের আর বুদ্ধি হলো না!
যোহরের সময় যখন মালিহার ফোনে ম্যাসেজ এলো সতর্ক চোখে তাকালেন আয়েশা। ম্যাসেজ পড়তে পড়তে মালিহার চোখ প্রকাণ্ড আকার ধারন করলো। আয়েশা নীরবে সবটা দেখার উদ্দেশ্যে বালিশে হেলান দিলেন। এক ভুল তিনি দুইবার করবেন না।
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫১
কেউ তাকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। মালিহা দিন দুনিয়ার সব হিসাব করেও পেলো না কে তাকে টাকা পাঠাতে পারে। হঠাৎ ইরিনার নাম মাথায় এলো। কিন্তু সে তো তার কাছে চার হাজার টাকা পেতো। পাঁচ হাজার নয়। তবুও তৎক্ষণাৎ তাকে ফোন দিলো মালিহা। ভেসে এলো পুরোনো সেই কণ্ঠ। জানালো ইরিনা ব্যস্ত আছে। মালিহা বুঝলো তার নাম্বার এখনও ইরিনার ফোনের ব্ল্যাক লিস্টেই পড়ে আছে। তাহলে কে দিতে পারে? মেসেজে দেখানো নাম্বারে ফোন দিলো মালিহা।
“হ্যালো কে?” ফ্যাসফ্যাসে একটা পুরুষ কণ্ঠের শব্দ এলো। হকচকিয়ে গেলো মালিহা। এবার কি বলবে? আমতা আমতা করে বলল, “এই নাম্বার থেকে একটু আগে আমার রকেটে পাঁচ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে।”
“তো?”
“কে পাঠিয়েছে এটা আমি জানতে চাই।”
“আজব কারবার! কাস্টমারের বংশ পরিচয় রেখে দেই আমরা? আমরা তো ভাই পুলিশ না। সারাদিন কতো মানুষ এসে টাকা পাঠায়, টাকা তোলে সবার কথাও তো মনে থাকে না। তার উপর আবার কে পাঠাইসে এইটা কেমনে বলবো! মাফ করেন।”
খট করে লাইন কেটে গেলো। লোকটার উত্তর যুক্তিসঙ্গত। এতো মানুষের খোঁজ তারা জানবে কিভাবে। আর তার নাম্বারে কে টাকা পাঠিয়েছে এটা বের করা দুঃসাধ্যই বটে। মুখ কালো করে ডাল নামিয়ে রেখে রান্নাঘর পরিষ্কার করলো সে। আবার ঘরে যেতেই আয়েশা বললেন, “কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
“কে যেনো আমার নাম্বারে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছে চাচী! কিন্তু কে পাঠাবে?”
মালিহার চিন্তিত জবাব। আয়েশা বললেন, “হয়তো তোমার পরিচিত কেউ।”
“না আমার পরিচিত কারো কাছে আমি এতো টাকা পাই না।” মাথা নাড়ল মালিহা।
“তাহলে তো ভালই হলো। বিনা পরিশ্রমে পাঁচ হাজার টাকা পেয়ে গেলে। রেখে দাও।”
“কি বলেন চাচী! কার না কার টাকা! হয়তো আমাকে ভুল করে পাঠিয়েছে। আজকের দিনটা দেখি। যে পাঠিয়েছে সে তো বুঝবেই যে ভুল জায়গায় টাকা গেছে।” ভাবুক স্বরে বলল মালিহা। আয়েশা মেয়েটার চেহারা পরোখ করলেন। দেখতে চাইলেন চেহারার ভাঁজে কোথাও কৃত্রিমতা আছে নাকি। এই মেয়েকে তার ছেলে পছন্দ করেছে। নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে। সেই মেয়েটার চরিত্র সম্পর্কে মা হয়ে খোঁজ নেয়া তার দায়িত্ব। মিলির শঙ্কা মালিহা লোভী এবং এই কারণেই তার সাথে ইতমিনানের বিয়ে হলে মিলি আর তার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে না। লোভী মেয়েটা রাখতে দেবে না। আয়েশা ঠিক সেকারনেই মালিহাকে পরীক্ষা করে নিতে চাইছেন। গত রাতে মেয়েটার আচরণে তার মন নরম হয়েছে। শুধুমাত্র মতি বা নাজিয়ার মেয়ে হিসেবে দূরে ঠেলে দেয়াটা তার কাছে অন্যায় মনে হচ্ছে। মালিহাও যদি এমন মনে করতো তাহলে তো পরীক্ষা সামনে রেখে তার কাছে ছুটে আসত না। কাজেই তিনি সুন্দর একটা সিদ্ধান্তে আসতে চান। মালিহা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ছেলেকে নিষেধ করার আর কারণ থাকবে না। আর যদি সে পাঁচ হাজার টাকাকে সম্বল করে এগিয়ে যায় তবে তার স্বরূপ ইতমিনানের সামনে তুলে ধরতে তিনি কসুর করবেন না। হয়তো বিষয়টা আহামরি কিছু নয়। তবুও এর মধ্য দিয়েই মালিহার মানসিকতা যাচাই করবেন তিনি।
••
ইমারজেন্সি কারণ দেখিয়ে ইতমিনান হাফ ডিউটি করে বেরিয়ে গেলো। পরিচিত এক ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়েশার জন্য কিছু খাবার কিনলো। ভেবেছিল বাড়ি যেয়ে গোসল করে তারপর নামাজে যাবে। কিন্তু সময় সংকুলান হলো না। পথেই আযান দিয়ে দিলে নামাজ পড়ে নিলো ইতমিনান। অন্ধকার আকাশ দেখতে দেখতেই বাড়ি পৌঁছুল। কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকক্ষণ। এই প্রথম বাড়িতে কেউ আছে। তার মন চাইলো না কষ্ট করে তালা খুলতে।
মিনিট তিনের মাঝে ওপাশ থেকে খুটখাট শব্দ হলো। দরজার নব ঘুরলে মুখ ওঠালো ইতমিনান। শাড়ি পরিহিতা মালিহাকে দেখে মনে হলো এ তার বহু আকাঙ্খিত স্বপ্ন। দৃশ্যটাকে স্বপ্ন রূপ দিতেই যেনো মালিহা বলল, “ব্যাগ আমাকে দাও।”
অভিভূতের মতো ব্যাগ এগিয়ে দিলো ইতমিনান। মালিহা চলে গেলো। ইতমিনান দম ছাড়লো। পরিস্থিতি তাকে, তার মনকে আরো অবাধ্য করে তুলছে।
দুপুরে যখন মালিহা খাওয়ার তদারকি করলো, আয়েশার দেখভাল করলো তার পুরোটা সময় ইতমিনান মুখ নামিয়ে রাখলো। ভুল করেও মালিহার দিকে তাকালো না। তার স্বপ্নদৃশ্য তাকে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। ইতমিনানের বুকটা দ্রুত গতিতে শব্দ করে। বারবার মনে হয় আয়েশাকে আরেকবার বোঝায়। আর একটা বার। একটা শেষ চেষ্টা। ভাবনা অনুযায়ী মুখ তুলতেই দেখে আয়েশা তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। ছেলের গোমড়া মুখ তার নজর থেকে আড়ালে যায়নি। তিনি মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেছেন সবটা। তবুও হুট করে কিছু করবেন না আয়েশা। বয়স হয়েছে। অভিজ্ঞতার ভারে চুলে পাক ধরেছে। ভুল করেছেন, শিক্ষাও নিয়েছেন। সেই শিক্ষা দিয়েই মালিহাকে যাচাই করবেন। ছেলের দুইদিনের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে তার ভবিষ্যত অদেখা করার মতো বোকা তিনি নন।
ইতমিনান ওষুধ খাইয়ে গেলে মালিহা ইতস্তত করে আয়েশার সামনে বসলো। এক নজর বারান্দায় ভেজা কাপড়ে দিকে তাকালো। মেঘলা আকাশের পর্দায় সূর্য গা ঢাকা দিয়েছে। রোদের উত্তাপ, উষ্ণতা কোনোটাই নেই। সকালে ধুয়ে দেয়া কাপড়গুলো সেই অবস্থায়ই আছে। ফলে গোসল করার ইচ্ছে থাকলেও তা পূরণ হয়নি। আয়েশার শাড়ি পড়েই দিন কাটাতে হচ্ছে।
“চাচী! ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
আয়েশা কাত হয়ে ছিলেন মালিহার বিপরীতে। তার কথায় উঠে বসলেন।
“না ঘুমাইনি। কিছু বলবে?”
বারকয়েক ঢোক গিলে মালিহা বলল, “চাচী বাবা মায়ের উপর রাগ রাখবেন না। অনেক সময় আপনাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে। একজন তো চলেই গেলো।”
চুপ করে গেলো মালিহা। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই মা কেমন যেনো হয়ে গেছে। আমার মায়ের উপর রাগ রাখবেন না চাচী। বাবাকেও মাফ করে দিয়েন।”
আয়েশার হাত জোড়া মুঠোয় নিলো মালিহা। তৎক্ষণাৎ আয়েশাকে ক্ষমা করে দিলো পূর্ববর্তী সকল তিক্ত কথার জন্য। সে ক্ষমা চাইছে তাহলে নিজে কেনো ক্ষমা করবে না?
আয়েশা ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন, “কেমন হয়ে গেলেও কথা শোনাতে ভোলেনি। তোমার মামা বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলো। ইতুর বাবা গেলো বোঝাতে। তাকে যা নয় তাই বলল। আমাকেও বাদ রাখলো না। যাক তার বুদ্ধি শেষ হলেও তোমার যে হয়নি দেখে খুশি হলাম।”
মালিহা চুপ করে রইলো। একবার বলতে চাইলো কথা তো আপনিও শুনিয়েছেন চাচী। আর বলল না। কথায় কথা বাড়ে। সে চায়না পুরোনো তিক্ত ঘটনার রেশ ধরে ভবিষ্যত নষ্ট করতে।
••
রাতে ভয়ে ভয়ে মায়ের কাছে গেলো ইতমিনান। মালিহা তখন নামাজ পড়ছে। আয়েশার হাত ধরে নিয়ে এলো আরেক ঘরে। আয়েশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
“মা।”
“বল। কি হয়েছে?”
ইতস্তত করলো ইতমিনান। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “তোমার শরীর এখন কেমন?”
“ভালো। কি বলতে চাচ্ছিস সোজাসুজি বল।”
“মা মালিহার ব্যাপারে আরেকবার যদি ভাবতে..”
আয়েশা চোখমুখ শক্ত করে বললেন, “এক কথা বারবার বলবি না।” ছেলের হাত ছাড়িয়ে ঘরে চলে গেলেন আয়েশা। ইতমিনান দাঁড়িয়ে রইলো শক্ত পাথরের ন্যয়। শেষ চেষ্টাটুকু বিফলে গেলো। নিজেকে ধিক্কার জানালো ইতমিনান। পছন্দের সম্মান আদায়ের সামর্থ্য যেহেতু তার নেই কাজেই পছন্দ করার অধিকারও তার নেই। মাথা নিচু করে দরজা আটকালো ইতমিনান। দরজার হাতলে হাত রেখে সে হঠাৎ বুঝতে পারলো তার মনে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া অনুভূতিকে বের করে দেয়ার সময় এসেছে। অবচেতন মনে যাদের রেখেছিল খুব যতনে, পূর্ণ জ্ঞান থাকাবস্থায় তাদের মন কুঠুরি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে হবে। নিজের কাছেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো ইতমিনান। আর কখনও মালিহার দিকে ইচ্ছা করে তাকাবে না। মালিহা কেনো, আর কোনো মেয়ের দিকেই সে তাকাবে না। অপারগতার যন্ত্রণা মাখা লালাভ আঁখি জোড়াকে নেত্রপল্লবের কোমল আবরণে ঢেকে শুয়ে পড়ল ইতমিনান। অনুভূতিহীন হওয়ার সময় বোধহয় এসে গেছে।
••
আয়েশা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মালিহা গোছগাছ করে নিলো। পরীক্ষা দশটা থেকে শুরু। ঘড়িতে এখন আটটা ত্রিশ। কয়েকটা রুটি বানিয়ে আলু ভাজি করে সকালের নাস্তা সেরেছে সবাই। আয়েশা বলেছেন দুপুরের রান্না তিনি নিজেই করতে পারবেন। ভরসা পেয়ে মালিহা আর রান্নায় হাত লাগায়নি। গোছাতে গোছাতে বিড়বিড় করে বলল, “আজকেই টাকা তুলে কাউকে দিয়ে দেবো। এই পাঁচ হাজার টাকার চিন্তায় আমার ঘুম আসছে না। এখনি দিয়ে যাবো। নাহলে পরীক্ষাও দিতে পারব না। ঝামেলা!” হিজাবের শেষ পিন লাগিয়ে আয়েশার কাছে গেলো সে। আয়েশা পুরো কথাটাই শুনলেন।
“চাচী আপনি বললে আমি পরীক্ষা দিয়ে এখানে চলে আসবো।”
“সমস্যা নেই। এখন তো সুস্থ হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ্। তুমি ভালো মতো পড়াশোনা করো।”
মালিহা মাথা নাড়ল। ইতমিনান দরজা খুলেছে। সেই শব্দে ঘর ছেড়ে বের হলো সে। ইতমিনানকে দেখে বলল, “ভাইয়া এখানে আশেপাশে কোনো দোকান থেকে ক্যাশ আউট করা যাবে? রকেটে?”
জুতার ফিতার দিকে মনোযোগ দিয়ে ইতমিনান উপরে নিচে মাথা নাড়ল।
“যাক বাঁচলাম! তুমি তো জানো না! কে যেনো আমাকে কালকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। সারাদিন সারারাত অপেক্ষা করলাম কেউ ফোন দিয়ে টাকার কথা বলবে। কারো কেনো খোঁজই নেই। এই টাকা এখুনি তুলে আমি কাউকে দিয়ে দেবো। নাহলে আমার অশান্তি লাগছে। তোমার পরিচিত কেউ আছে যাকে দেয়া যায়?”
এবারও মাথা নাড়ল ইতমিনান। আছে। সে বের হলে মালিহা তার পিছু নিলো। মালিহা আয়েশার দিকে তাকিয়ে সালাম দিলে তিনি মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আড়চোখে দেখলেন ছেলের লালাভ আঁখি। কিন্তু ইতমিনান এর কিছুই দেখলো না। মালিহাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিলেও পুরো রাস্তায় মেয়েটার দিকে সে তাকালো না। একবারের জন্যও না।
••
এক মাসের মাথায় মালিহার পরীক্ষা শেষ হলো। বাড়ি থেকে জরুরী তলব এলো। ডাকা হলো ইতমিনানকেও। একই ট্রেনে দুজনে আবার ছুটলো বাড়ির পথে। মনকে শক্ত শেকল পড়ালো ইতমিনান। একই ভুল বারবার করে নিজেকে পুড়িয়ে অঙ্গার বানাতে চায় না সে।
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫২
ট্রেন ছাড়তেই নীতিকে ফোন দিলো মালিহা। নীতি রিসিভ করলো সাথে সাথেই।
“কি রে! কই আছিস এখন?”
“ট্রেনে। ছাড়লো মাত্র।”
“ছেড়েও দিয়েছে!”
“হ্যাঁ।”
“তোর উজবুক ভাইটা কই?”
“উজবুক বলছিস কেন?” মুখ কুচকে নিলো মালিহা।
“আমার কাছে লাগে তাই। সে কোথায়?”
ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো মালিহা। কোথাও দেখা গেলো না ইতমিনানকে।
“আশপাশে তো দেখছি না।”
“দেখ তোকে রেখে কোথাও কেটে পড়ল নাকি!”
“অসম্ভব!” দৃঢ় স্বরে বলল মালিহা
“এত্তো কনফিডেন্স! বাব্বাহ!”
মালিহা কিছু বলল না। নীতি আফসোস করে বলল, “পরীক্ষা শেষ। কই ভাবলাম শাড়ি টাড়ি পরে ছবি তুলে ব্যাটার মাথা ঘুরাবো আর তুই গেলি চলে।”
“তুই ভালো মানুষটাকে এতো জ্বা’লাস নীতি!”
“আসছে আমার ভালো মানুষ! এহ! আমার ভাল্লাগে তাই জ্বা’লাই। সেজেগুজে ছবি পাঠাবো। ব্যাটা সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে দেখবে আর দুঃখ দুঃখ কণ্ঠে গান গাবে, “কেমনে বাধিব হিয়া! মোর প্রিয়া আনবাড়ি যায় লাল শাড়ি গায় দিয়া!” খিলখিল করে হেসে উঠলো নীতি। হাসি ফুটলো মালিহার ঠোঁটেও।
“শাড়ি পড়বি তুই, জামাইকে ছবিও পাঠাবি তুই। তাহলে আমি থাকলেই কি আর না থাকলেই কি?”
“একা একা শাড়ি পড়তে ভাল্লাগে না।”
“আপুদের নিয়ে পর।”
“হ গর্ধব! আপুরা তো আমার সই লাগে!”
“কোনটা পড়বি?”
“ভাবসিলাম তোরা যেইটা দিসিশ ঐটা পড়বো।”
“সত্যি! আমাকে কিন্তু ছবি দিবি নীতি! তোকে একবার ঐ সেটটা পরে দেখতেও পারলাম না।” দুঃখ করে বলল মালিহা।
নীতি গম্ভীর কন্ঠে বলল, “এসব কথা বাদ দে দোস্ত। আমার কথা শোন। আমি ড্যাম শিওর এইবার তোর গলায় কাউরে ঝুলানোর ব্যবস্থা করছে।”
“তোমার খালি এইসবই মনে হয়। আগের বার কি বলসিলি মনে আছে? শুধু শুধু ভাইয়ার নামে মিথ্যা কথা। আর ফুপু অসুস্থ। এজন্য যাচ্ছি। ভুলে গেলি?”
“তোমার ভাইয়্যা যে মনে মনে তোমার সাইয়্যা হইতে চায় এইটা আমি জানি। কিন্তু ব্যাটা হঠাৎ এমন ঠান্ডা মে’রে গেলো কেন তাই তো বুঝলাম না।” ভাবুক কণ্ঠে বলল নীতি। আবার নিজেই বলল, “থাকলো কথা অসুখের? সব বাড়িতেই দুই চারটা মানুষ অসুস্থ হয় একটা বিয়ে দেয়ার জন্যে।”
“ফালতু কথা বলবি না! ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখছে। বিয়ে হবে।”
“মেয়ে দেখলেই বিয়ে হয়ে যায় না রে পাগলা! শোন মাগনা দুইটা উপদেশ দেই। এক নাম্বার উপদেশ বিয়ের কথা শুনে মনে লাড্ডুও ফাটাবি না আবার নার্ভাস হয়ে অক্কাও পাবি না। ঠান্ডা মাথায় ভাবনা চিন্তা করবি। লাইফটাইমের বিষয়। আর দুই নাম্বার উপদেশ হলো এক নাম্বার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবি।”
মালিহা নিশ্বাস ছাড়ল, “ভাবছিলাম বিয়ে হইলে তোর মাথার তার দুই একটা দুলাভাই ঠিক করে দিবে। কিসের কি! আমার আশা ভঙ্গ!”
“গরীবের কথা বাসি হইলে সত্যি হয়। এখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি হইলাম বড়লোক। আমার কথা টাটকাই সত্যি হবে দেখিস। ইনশাআল্লাহ্।”
মালিহা ফোন রেখে দিল। এই পাগলের কথা শুনতে শুনতে কবে না সে নিজেই পাগল হয়ে যায়। তবে নীতির একটা কথা ফেলনা নয়। ইতমিনানের চাহনি কয়েকদিন তাকে ভাবতে বাধ্য করেছিল। সে ভেবেছিল ইতমিনান হয়তো তাকে পছন্দ করে। ভাবনাটা মনে অস্বস্তির জন্ম দিলেও খারাপ লাগা সেখানে স্থান পায়নি। মানুষ হিসেবে ইতমিনান ভালো। ভালো মানুষের পছন্দ বলেই বোধহয় খারাপ লাগেনি। মাঝে মাঝে মনে হতো ইতমিনান নীরবে কিছু বলতে চাইছে। তবে সে চেষ্টা করেও কোনোদিন বুঝতে পারেনি। দুর্বোধ্য সে ভাষা। তারপর হঠাৎ করেই সে কেমন পাল্টে গেলো। পাল্টে গেলো বলাও পুরোপুরি ঠিক হবে না। মানুষটা সে একই আছে তবে তার প্রতি আকুল সেই চাহনিটা আর নেই। গত একটা মাসে না তাকে দরকার ছাড়া কল দিয়েছে নাই বা অপ্রয়োজনে কোনো কথা খরচ করেছে। কোনোদিন সুযোগ পেলে মালিহা শুনবে ইতমিনান তার কথার বাক্সে তালা ঝুলিয়েছে কি না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার দিকে তাকালো মালিহা। এবার জানালার পাশে সিট পায়নি। তবুও বেশি একটা খারাপ লাগছে না। আবার ভাবনায় ডুব দিল মালিহা। ইতমিনানের সাম্প্রতিক ব্যবহারের কারণে তার মনে হয়েছে সে বেশি বেশি ভাবনা চিন্তা করেছে। শুধু শুধু উদ্ভট কিছু চিন্তা করে অবাস্তব একটা সমীকরণ দাঁড় করাতে চেয়েছিল সে। এটাই এখন মনে হয়। আবার তিন দিকে তাকালো মালিহা। ইতমিনান কি তার থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে? কি আশ্চর্য!
••
ভাগ্যক্রমে এবার জানালার পাশে সিট পেয়েছে ইতমিনান। মালিহা পায়নি। একবার ভেবেছিল মালিহাকে বলে তার সিটে এসে বসতে। পরপর মনকে শাসিয়েছে। জানালার পাশে না বসলে আহামরি কিছু হবে না। কিন্তু মালিহার সাথে কথার সুতো বাড়তে থাকলে ইতমিনানের ক্ষতি হবে। ভ’য়াবহ ক্ষতি। এতদিনের কঠোর সংযম এক নিমেষে ভেঙে যাবে। ইতমিনান নিজেকে আর কষ্ট দিতে চায় না। মালিহা তার জায়গায় ভালো থাকুক। ইতমিনানও ভালো থাকতে চায় নিজের জীবনে।
সিটে মাথা এলিয়ে দিলো ইতমিনান। লালপাহাড় এবার বাড়ির সামনে এসে এসে ঘুরে যাবে। মানিককে যদিও বলে এসেছে তবে মানিক বলল কুকুরটা নাকি তার কথা শোনে না। নিজের নিয়ম অনুযায়ী ইতমিনানের বাড়ির সামনে যেয়ে অপেক্ষা করে। সেই সন্ধ্যায়ও যখন সে ফেরে না তখন লালপাহাড় প্রস্থান নেয়। আগের বার বাড়িতে ফেরার সময় এমনই হয়েছে। আয়েশাকে কুকুরটার কথা বললে তিনি যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এটা কুকুরই তো?”
“দেখে কি মনে হচ্ছে তোমার?” ইতমিনান উত্তর দিয়েছিলো।
“দেখতে তো কুকুর। কিন্তু জ্বিন টিন আবার কুকুরের বেশ ধরে থাকতে পারে।” চিন্তিত স্বরে বলেছিলেন আয়েশা।
ইতমিনান অবাক হয়ে বলেছিলো, “আমার পেছনে জ্বিন লাগবে কেনো?”
“ভোলা ভালা ছেলেদের পেছনে লাগতেই পারে। তাদের জ্বা’লানো সহজ। তুই সাবধানে থাকবি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিন কুল পড়ে নিজের গায়ে ফু দিবি। ঠিকাছে?”
“ঠিকাছে।”
হেসে ফেললো ইতমিনান। মায়ের যতো ছেলেমানুষী চিন্তা! পরপর হাসিটা নিভে গেলো। তার কতো ইচ্ছে ছিল লালপাহাড়ের সাথে মালিহার পরিচয় করিয়ে দেবে! সেসব বোধহয় আর হলো না। সব ইচ্ছে দুনিয়ার বুকে পূরণ হয় না। হতে নেই।
••
রাবেয়ার কথা শুনে মালিহা মোটামুটি পর্যায়ের হতভম্ব অবস্থায় আছে। অবচেতন মনের ঝাপসা সন্দেহ যে এভাবে কঠিন বাস্তবতায় রূপ নেবে তা সে চিন্তাই করতে পারেনি।
“কি সব বলো ফুপু!” সংকোচ করে বলল মালিহা। ফোনের ওপাশ থেকে খেঁকিয়ে উঠলেন রাবেয়া।
“কি সব বলি? আমার ভাতিজা কি খারাপ?”
“এসব কথা আসছে কেনো। শুনলাম তুমি সিরিয়াস অসুস্থ। এই তোমার অসুস্থতা!”
“অবশ্যই। ভাইয়ের মেয়ে বেদিশা হয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার চিন্তায় আমার মাথার আগল পাগল অবস্থা। তাহলে আমি অসুস্থ না তো কি?”
“আমি বেদিশা কই! আর এসব শুনেও মা আমাকে কিছু বলল না কেনো?”
“বেদিশা না হলে আমার ভাতিজার চেহারা দেখে একটু হলেও বুঝতে পারতি। আর তোর মা’র তো কোনো চিন্তা ভাবনা নাই। কি বলবে?”
মালিহা কিছু বলল না। সে যে কিছু সন্দেহ করেছিল সেসব বললে ফুপু আরো পেয়ে বসবে।
“তাও। আমি যখন বললাম ফুপু অসুস্থ তাই আসবো। তাহলেও কিছু বলবে না? আর ভাইয়াই বা আসলো কেনো?”
“কারণ তাকে ডাকা হয়েছে তাই।”
মালিহা বোকা বনে গেলো। ফুপা ফোন করে বলেছিলেন ফুপু খুবই অসুস্থ। তাই ছুটে আসা। সে তো ইতমিনানকে এই নিয়ে প্রশ্ন করতে পারত। সেটাও করেনি। মালিহা বলল, “মা পছন্দ করবে না ফুপু। মা’কে কিছু বলো নি না?”
“বললে তো বাড়ি এতক্ষণে রণক্ষেত্র হয়ে যেতো। বাদ দে তুই। ভাবির চিন্তা আমি করবো যদি তুই রাজি থাকিস। ভাবনা চিন্তা কর। সারাজীবনের ব্যাপার। কোনো জোর নাই। কিন্তু ভালো ছেলে একবার হাত ফসকে গেলে পরে কপাল চাপড়ালেও কাজ হবে না। মুরুব্বীর কথা। মন দিয়ে ভাব।”
মালিহা ফোন রেখে দিতে চাইলে রাবেয়া আবার বললেন, “শোন!”
“বলো “
“তোর বাপ কিন্তু তার ভাতিজাকে খুব পছন্দ করত।”
দুর্বল জায়গায় আ’ঘাত। মালিহা স্পষ্ট টের পেলো বাবার কথা শুনতেই তার মন অর্ধেক নরম হয়ে গেছে। মা, ভাই কেউ এসবের কিছু জানে না। নিজে নিজে ভাবতে ভাবতে হয়রান হয়ে পড়লো মালিহা। নীতির কথাগুলো মনে পড়ল। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে বলেছে। কিন্তু মাথায় আ’গুন জ্বা’লিয়ে দিলে সেটা ঠান্ডা থাকে কি করে! রাশেদা তাদের বাড়িতেই ছিলেন। তার কাছে যেয়ে শুয়ে পড়ল মালিহা। রাশেদা নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “শরীর কি অসুস্থ নাকি?”
“না।” দাদির কোলে মুখ গুঁজে বলল মালিহা। রাশেদা মালিহার কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। দরজার দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বললেন, “কি ভাবনা চিন্তা করলা?”
“কিসের?”
“আমার নাতির।”
তড়িৎ উঠে বসলো মালিহা। অবাক চোখে রাশেদার দিকে তাকাতেই তিনি জানালেন এসবই তিনি জানেন।
“ইতু তো সবই বলছে আমার কাছে। সেই দুই মাস আগেই।”
“দুই মাস!”
“হ্যাঁ। কিছু সমস্যার জন্য তোমাকে বলা হয় নাই।” মাথা নাড়লেন রাশেদা। বললেন না বড় বউয়ের অমতের কথা। যার মত পাল্টেছে তার পুরোনো মতের রেশ ধরে খোঁচাখুঁচি করার কোনো মানে হয় না।
মালিহা গাট হয়ে বসে রইলো। দুই মাস! ইতমিনান তাকে কতদিন ধরে পছন্দ করে? তার আগের ভাবনাগুলোই তাহলে ঠিক ছিল? হঠাৎ অভিমান মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। এতো বছরের সম্পর্কচ্ছেদের পর এখন হঠাৎ করে এই পছন্দের কি মানে? দাদির কাছে অসহায় কণ্ঠে বলল, “আমি কি করবো দাদি? কিছুই বুঝতে পারছি না। মা তো রাজি হবে না।”
“তার কথা পরে। তুমি রাজি থাকলে তাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমাদের। পারিপার্শ্বিক চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের চিন্তা করো।”
ফোন হাতে নিলো মালিহা। মেসেঞ্জারে ঢুকতেই নাজিফাকে অনলাইনে দেখা গেলো। তার কাছে পরামর্শ চেয়ে মেসেজ পাঠাল মালিহা। ক্ষনিকেই উত্তর দিলো নাজিফা।
“আমার মনে হয় দ্বীনের বিষয়ে ধারণা নেয়ার পর মন মানসিকতা সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট। মানসিকতা না মিললে বছরের পর বছর এক ছাদের নিচে থাকলেও মনের লেনা দেন ঘটে না। ফলে বিয়ে দুটো মানুষের হয় এবং তারা সারাজীবন দুইই থাকে। এক আর হতে পারে না।”
পরপর আরো একটা মেসেজ এলো, “আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। তিনি যেনো তোমাকে পথ দেখান। কোনটা তোমার জন্য ভালো হবে সেটা যেনো বুঝিয়ে দেন। আর নিজেও চোখকান খোলা রাখো। হতে পারে তোমার আশপাশের খুব ছোট কোনো বিষয় দিয়েও আল্লাহ ইশারা করতে পারেন। কাজেই, বি অ্যালার্ট!”
ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলো মালিহা। রাশেদা বললেন, “মালিহা, ঐ বাড়িতে আমার একটা ওষুধ রেখে আসছি। একটু এনে দিতে পারবা? মিতুল তো নাই। নাহলে ওকেই বলতাম।”
“যাচ্ছি দাদি।”
ঘোমটা টেনে বাড়ি থেকে বের হলো মালিহা। দুই বাড়ি পরেই মকবুল আলীর ঘর। দরজা ধাক্কা দিলে খুললেন মকবুল আলী নিজেই। মালিহার অস্বস্তি লাগলো। এখন কিভাবে এই বাড়ির মানুষগুলোর মুখোমুখি হবে সে! মনে মনে অনবরত বলতে থাকলো, “আল্লাহ আমাকে সাহায্য করো! আমাকে পথ দেখাও!”
মকবুল আলী উচ্ছ্বসিত হলেন ভাতিজিকে দেখে।
“কতদিন পরে এলি মা! চাচার বাড়ীতে আসতে মন চায় না?”
বিব্রত হাসলো মালিহা। মকবুল আলী তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কাউকে না দেখে মালিহা বলল, “বাসায় আর কেউ নেই?”
“না। ইতু তো বাইরে গেলো সকালেই। তোর চাচী মনে হয় পাশের বাড়িতে গেছে। দাঁড়া ডেকে আনি।”
“থাক থাক। আমি দাদির ওষুধ নিতে আসছি। রেখে গেছে বলল। চাচীকে ডাকার দরকার নাই।” মকবুল আলী জোর করলেন না। নিজের কাজে চলে গেলেন। মালিহা রাশেদার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে যেয়ে খাটের মাথার কাছে ওষুধটা খুঁজলো। রাশেদা বলেছেন এখানেই আছে। চারপাশে খুঁজেও ওষুধ পেলো না। টেবিলের পাশে ছোট্ট একটা টুল মতো আছে। তার নিচে আবার তিন থাক ড্রয়ার। এক একটা করে সেগুলো খুলে ওষুধের খোঁজ করলো সে। প্রথম ড্রয়ারে পেলো কিছু কটন বাড আর ম্যাচ স্টিক। দ্বিতীয় ড্রয়ারে সেলাই করার সুতা। তৃতীয় ড্রয়ারে ধুলো পড়া কিছু ফাইল। শেষ ড্রয়ার আটকেই আবার খুলে ফেললো সে। মনে হলো যেনো নিজের একটা ছবি দেখলো। কৌতূহল বশত ফাইল বের করে তার উপরের ধুলো সরাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠল কলেজে থাকাকালীন একটা ছবি। কোনো একটা ফর্মের কোণায় পিন করা। নিজের ছবি দেখেই ফাইল খোলার প্রবোধ পেলো মালিহা। ফর্মটা বের করতেই স্পষ্ট হলো ভর্তি পরীক্ষার কাগজ। এক বান্ডিল কাগজের সবটাই তার শিক্ষা সংক্রান্ত। একটা কাগজে কিছু ভার্সিটির নাম লেখা। মালিহা লেখাটা চেনে। ইতমিনানের লেখা। তার পাশে পাশে একটা একটা ফোন নাম্বার। সাথেই কিছু নাম। নামগুলো চেনা চেনা লাগলো মালিহার। একটা মন পড়ল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যেয়ে ঐ ছেলেটার কাছেই মতিয়ার আলী ছিলেন। সেই ছেলেটা তাকেও থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। স্মৃতির লেজ ধরে আরো ঘটনা সামনে এলো। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেয়ে যাদের কাছে সাহায্য পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি এখানে তাদের নাম্বারগুলোই লেখা। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে মালিহার কষ্ট হলো না। সেসময় সে অবাক হয়ে ভাবত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে মতিয়ার আলীর চেনা মানুষ থাকে। একেকজন একেক দেশের। এই ক্ষণে সবটা পরিষ্কার হলো। তারা হয়তো ছিল ইতমিনানের বন্ধু। এবং এটার সম্ভাবনাই বেশি। সবগুলো কাগজ উল্টে পাল্টে দেখলো মালিহা। যেসব জায়গায় সে অ্যাপ্লাই করেছিল সবগুলোর ফটোকপি এখানে আছে। সাথে আছে বিশেষ কিছু নির্দেশিকা। তার মনে পড়ে মতিয়ার আলী পরীক্ষার আগের দিন রাতে এগুলো এনে দিতেন। বলতেন কম্পিউটার থেকে নামিয়ে এনেছেন। এই তাহলে সেই কম্পিউটার! প্রত্যেকটার কপি ইতমিনান নিজের কাছেও রেখেছে। কাগজগুলো রেখে দিতে গেলে কোণায় একটা মোচড়ানো কাগজ চোখে পড়ল। কৌতূহলে টইটুম্বুর মালিহা সেটাও বের করলো। পুরোনো কাগজটা টেনে ঠিক করে পড়তে বেশ বেগ পেতে হলো। মিনিট দুইয়ের মাথায় কাগজের লেখাগুলো বোধগম্য হলো তার। ইংরেজি লেটারটা চাকরি সংক্রান্ত। ঢাকায় প্রাইভেট একটা কোম্পানিতে উঁচু পদে চাকরি পেয়েছিল ইতমিনান। নিঃসন্দেহে তার বেতন বর্তমানটার চেয়ে ভালো। ইতমিনানের চাকরি সম্পর্কে জানে মালিহা। কাজেই এটুকু সে বলতে পারে। কিন্তু এই চাকরিটা ছাড়লো কেনো ইতমিনান? আবার সে নাকি ভালো চাকরি খুঁজেও পায় না। তবে এগুলো কি? প্রশ্নের ঘুরপাক ছোটখাট একটা সাইক্লোন বাঁধিয়ে দিলো মস্তিষ্কে। কাগজগুলো প্রমাণ করলো ইতমিনান সবসময় তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। নীরবে, নিভৃতে। যোগাযোগ..যোগাযোগ..! চট করে ধুলোমাখা ফাইলটা বুকে চেপে ধরলো মালিহা। তার বুকে যেনো কেউ ড্রাম পেটাচ্ছে। পরীক্ষার রেজাল্ট নেয়ার সময় যেমন লাগে ঠিক তেমন লাগছে। ইশারা, ইঙ্গিত বুঝতেই উঠে দাঁড়ালো সে। তখনই চোখ পড়ল খাটের নিচে, টুলের কোণায় রাশেদার ওষুধ। তুলে নিয়ে ছুটে গেলো সে। ওড়নার নিচে ফাইল নিয়েই ছুটলো বাড়ির দিকে। দরজার কাছে এসে চেঁচিয়ে বলল, “চাচা! দরজা লাগিয়ে দিন। ওষুধ পেয়েছি। চলে গেলাম।”
মকবুল আলী উত্তর দেয়ার আগেই পথে নামলো মালিহা। পথের তো কেবল শুরু।
••
ইতমিনান যখন শুনলো মেয়ে দেখতে যাওয়া হবে, নির্লিপ্ত রইলো সে। আয়েশা ছেলের কাছ থেকে একটু প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন। ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। ছেলেটা কি পাথর হয়ে গেলো! যেনো বিয়ে করতে বললেই করে নেবে। কাকে করছে সেসবে কোনো ধ্যান নেই।
“ছবি দেখবা না আব্বা?”
“যাচ্ছি তো মা। সামনাসামনি দেখতে পারবো।”
“তাও। আগে থেকেই দেখে নাও কেমন।”
“তোমার পছন্দই আমার পছন্দ মা।” হেসে বলল ইতমিনান। সেই হাসি তীরের ফলার মতো আয়েশার বুকে বিধলো।
ফুপুর বাড়িতে মেয়ে দেখার আয়োজন হয়েছে এটা শুনেও রা করলো না ইতমিনান। শান্ত ছেলের মতো বাবা মায়ের পিছু পিছু গেলো। রাফিকে কিছুক্ষণ আদর করে একটা ঘরে যেয়ে বসলো। সোফায় মাথা এলিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “জানাজা শেষ। এবার শুধু দাফনের পালা।”
হঠাৎ পরিচিত একটা কন্ঠস্বর এবং কিছু কথপোকথন তার চোখ খুলিয়ে দিলো। ইতমিনান অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন উসাইন বোল্টের রেকর্ড ভাঙার পথে ছুটছে। গিনেস বুক কি এই খবর পাবে?
চলমান।