#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৭
মিতুলের আজ ছুটি। মালিক বেড়াতে যাওয়ায় দোকান বন্ধ। বাড়িতে অলস সময় পার করছিলো সে। হঠাৎ বাইরে থেকে ডাক এলো। অতি পরিচিত এক কণ্ঠ। উঠে এলো মিতুল। বিড়বিড় করে বলল, “চাচার ছেলে মেয়ে মানুষের মতো আমার পিছনে লাগছে।”
ইতমিনান এক হাতে ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল ভুরু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কি হয়েছে?”
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইতমিনান। মালিহা হলে একটা ধমক দিয়ে গেট খুলতে বলা যেতো। কিন্তু মিতুল নিজেই যেখানে রেগে বো’ম হয়ে আছে সেখানে তাকে আবার ধমক দেয়ার কোনো মানেই হয় না। আমতা আমতা করে ইতমিনান বলল, “কি করছিস?”
“ঘুমাই।” ত্যাড়ছা স্বরে জবাব ছিলো মিতুল। ইতমিনান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “চল ক্রিকেট খেলি।”
“অন্য মানুষের ব্যাট দিয়ে আমি খেলি না।” মিতুলের স্বরে স্পষ্ট ক্ষোভ।
“ব্যাট তো তোরই।”
“কে বলেছে আমার? এই ব্যাট আমার না। আমার কোনো ব্যাট ফ্যাট নাই।”
কিছুক্ষণ থেমে ইতমিনান বলল, “কেউ একজন আমার কাছে একটা ব্যাটের আবদার করেছিল। তার আবদার কিন্তু আমি রেখেছি।”
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মিতুল। যে বছর তাদের ঝগড়া হয় সে বছরই ইতমিনানের কাছে একটা ব্যাট চেয়েছিল সে। তখন সে কীসে পড়ত? ক্লাস ফোর হবে বোধহয়। আর ইতমিনান তখন ভার্সিটির ছাত্র। সে কি কথাটা মনে করে রেখেছ?
“এতদিন পর আবার ব্যাট কেনার কি মানে? ছোট মানুষ নাকি তুমি?”
হালকা হেসে ইতমিনান বলল, “এটা তো এখন কিনিনি। আরো তিন বছর আগেই কিনেছি।”
“তাহলে আমাকে দাওনি কেনো?” মিতুলের চোখের পলক পড়ছে না। নোনাজল এসে জমতে চাইছে সেখানে। অনুমতি পাচ্ছে না।
চকচকে ব্যাট দিয়ে মাটিতে শব্দ করলো ইতমিনান। সেটার দিকে তাকালেই বোঝা যায় মাঝে মাঝেই তার যত্ন নেয়া হয়। ধীর কণ্ঠে বলল, “তুই তো আমার সাথে কথা বলতিস না। তাই দিইনি।”
“এক কথা তুমি বারবার বলো ইতু ভাই! কই তোমার সাথে কথা বলিনি? তুমি ছুটিতে বাড়ি আসলেই ছুটে ছুটে যেতাম। চাচী তো বলতো তুমি নাকি আমার সাথে আর খেলবে না। আপার সাথে আর দেখা করবে না। এরপর আরেকবার যখন গিয়েছি চাচী কি বকাটাই না বকলো! তুমি তো আমাদের খোঁজও নাওনি। একবার আসোওনি।”
ইতমিনান সব ছেড়ে প্রথম বাক্যের ইতু ভাইয়েই আটকে রইলো। অভিমানের বরফ কি তবে গলতে শুরু করেছে? ইতিমিনান দরজার দিকে এগিয়ে যেয়ে বলল, “ভুল হয়ে গেছে। আর এমন হবে না মিতু! প্রমিস! আয় বাইরে আয়। চল এক ম্যাচ খেলে আসি।”
“মিতু বলবা না তো! শুনতে কেমন মেয়ে মেয়ে লাগে!” বিরক্ত কণ্ঠে বলল মিতুল।
“আয় মিতু। আমার ছুটি শেষ হয় যাচ্ছে। কাল পরশু চলে যাবো। আয় ভাই।”
মিতুল পাষাণ নয়। তার ইতু ভাইয়ের এমন করুন ডাক সে ফেরাতে পারলো না। দরজার ছিটকিনি খুলে সন্তর্পনে বেরিয়ে গেলো বাইরে। ইতমিনান হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়ার মতো করো তাকে আগলে নিলো। মিতুল ব্যাটটা হাতে নিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, “আর কখনও কথা বলা বন্ধ করবে?”
“প্রশ্নই ওঠে না!” মিতুলের ঘাড় জড়িয়ে ধরলো ইতমিনান।
••
মালিহা খেয়াল করেছে মিতুল ইতমিনানের সাথে কথাবার্তা বলছে। সুন্দর করে বলছে। ভালো লাগলো মালিহার। সম্পর্কগুলো ঠিকঠাক হয়ে যাক। আপন মানুষের সাথে মুখ কালো করে থাকা কি ভালো বিষয়! শ্বাস ছাড়লো মালিহা। চাচীর সাথেই কথাটা হয়ে ওঠে না। কি যে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি। কথা বলতে গেলেই আয়েশা এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন! মালিহা বোঝে এ কিসের ব্যস্ততা। মা’কে যেয়ে বলে চাচীর সাথে কথা বলতে। তার কোনো হেলদোল নেই।
“মা।”
নাজিয়া শুয়ে ছিলেন। মেয়ের ডাকে উঠে বসলেন।
“ঘুমাচ্ছিলে?”
“না। এমনি শুয়ে ছিলাম। কিছু বলবি?”
“বলবো। মা তুমি একবার ঐ বাড়ি যাও না কেনো? একটু চাচীর সাথে কথাবার্তা বলো।”
“সেও তো আসতে পারে।”
“চাচীও হয়তো এটা ভেবেই বসে আছে।”
“থাকুক। তিনি মনে করেন তার স্বামীর আর ছেলের মাথা খেয়েছি আমরা। জমির কথা তোলায় কতো কথা শুনিয়ে গেলো!”
“আবার চাচীই কিন্তু পরে আমাদের ঐ জমিগুলো দিতে বলেছে।”
“দয়া করেছে।”
“এভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকলে কেমন হয় মা? শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য। সেসবও ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে।”
“তুই কি আর কিছু বলবি?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মালিহা, “চলে যাবো মা। পরশু ইনশাআল্লাহ্।”
“আচ্ছা।”
মালিহা হাল ছাড়লো। চলে গেলো নিজের ঘরে।
নাজিয়া বেগম তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। প্রথম সন্তান। আবেগ, অনুভূতি দুটোই অন্যরকম। মেয়েটা হওয়ার পর তাকে পারতেন না মাথায় রাখেন। মানুষ দেখে মুখ টিপে হাসতো। বাঁকা কথা বলতো। নাজিয়া বেগম শুনেও শুনতেন না। কিন্তু একদিন ভ’য়ংকর এক স্বপ্ন দেখলেন। মালিহাকে বুকে চেপে বসে রইলেন সেই সারাটাদিন। সন্ধ্যার দিকে রাশেদার এক বান্ধবী দেখতে এলেন তাদের। কথায় কথায় বললেন এতো আদর করলে মেয়ের কপালে দুঃখের শেষ থাকবে না। মায়ের আদর নাকি মেয়ের বিপদ ডেকে আনে। রাশেদা প্রতিবাদ করলেন। ভিত্তিহীন কথা তিনি কোনোকালেই বিশ্বাস করেন না, সমর্থনও করেন না। কিন্তু নাজিয়ার ভীত মনে কথাটা গেঁথে গেলো। স্নেহের প্রকাশ কমিয়ে দিলেন তিনি। আস্তে ধীরে মেয়েটার সাথে কেমন দূরত্ব তৈরি হলো। সাথে জড়তা। সম্পর্কে শীতলতা চলে এলো। মিতুলকে যেমন বুকে টেনে আদর করা হয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া হয় তার কোনোটাই মালিহার সাথে আর করে হয় না। মেয়েটাও অভিযোগ করে না। হয়তো এটাই সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
••
যাওয়ার আগের দিন রাতে ইতমিনান আয়েশার কাছে গেলো। হাত ধরে বলল, “আমার সাথে কথা বলবে না মা?”
“কথা বলছি না কই? বলছিই তো।”
“এমন করে বললে তো আমার ভালো লাগে না। তুমি কি এখনো আমার সাথে রাগ করে আছো?”
“না।”
“তাহলে আমার সাথে চলো।”
আয়েশা অবাক হয়ে বললেন, “কোথায়!”
“আমার ওখানে।”
“পাগল নাকি! আমি যেয়ে কি করবো?”
“আমি কোথায় থাকি কিভাবে থাকি দেখে আসবে। চলো না মা।”
“পাগলামী করিস না ইতু। আমি গেলে তোর বাবার দেখভাল করবে কে?”
“বাবা দুটো দিন একাই থাকতে পারবে। দেখভাল কর লাগবে না। চলো তুমি। নাহলে আমি ভাববো আমার উপর তুমি এখনো রাগ করে আছো।”
আয়েশা হাল ছাড়ার ভঙ্গিতে বললেন, “জেদ করিস না। আমার কথা..”
ইতমিনান উঠে চলে গেলো। আয়েশা নিশ্বাস ছাড়লেন। এই জেদি ছেলেকে এখন বোঝাবেন কিভাবে তিনি?
মকবুল আলী হিসাব কষছিলেন। ইতমিনান অনেকক্ষণ তার পাশে চুপচাপ বসে রইলো। মকবুল আলী মাথা উঠিয়ে বললেন, “কি রে! কিছু বলবি?”
“হু।”
“বল। বসে আছিস কেনো?”
নড়েচড়ে বসলো ইতমিনান, “আমি কি অন্যায় কিছু করেছি বাবা?”
“কিসের অন্যায়?”
“ইদানিং আমি কি এমন কিছু করেছি যাতে তুমি কষ্ট পাও?”
মকবুল আলী ভেবে চিন্তে বললেন, “মনে তো হচ্ছে না।”
“তুমি কি আমার পাশে আছো বাবা?”
এই পর্যায়ে ছেলের কথার মর্ম উদ্ধার করতে সক্ষম হলেন তিনি। ইতমিনানের পাশে যেয়ে বসলেন। কাঁধে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বললেন, “মতির সাথে আমি অন্যায় করেছি। ওর মেয়েকে কাছে পেয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কে হবে?”
বাবার হাতটা শক্ত করে ধরলো ইতমিনান। ধীর কণ্ঠে বলল, “তুমি আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করো বাবা।”
“অবশ্যই করি বাবা। অবশ্যই করি। তোর মা’কে ভুল বুঝিস না। সে মানুষ খারাপ না।” গলায় কান্না আটকে বললেন মকবুল আলী। ইতমিনান মাথা নাড়ল। মা’কে ভুল বোঝার প্রশ্নই ওঠে না।
••
গোছগাছ করে ইতমিনান যখন বের হলো তখন দরজার কাছে একটা ব্যাগ রাখা। ভুরু কুঁচকে এলো ইতমিনানের। এটা কার ব্যাগ? সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে আয়েশা এলেন। তৈরি হয়ে। ইতমিনানের কপালের ভাঁজ মুছে গেলো। চকচক করে উঠলো দুই চোখ।
“তুমি আমার সাথে যাচ্ছো মা!”
“যেভাবে মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস না যেয়ে উপায় কি?”
“আরো কত কিছুর জন্য মুখ কালো করেছি তাতো দেখছো না।” বিড়বিড় করলো ইতমিনান। তবে সেটা আয়েশার কান পর্যন্ত পৌঁছুল না। বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। পথে এসে আয়েশার মেজাজ খারাপ হলো।
মালিহা দাঁড়িয়ে আছে বড় চাচার বাড়ির সামনে। ইতমিনান এলে মিতুল বোনের ব্যাগ সাইকেলে উঠিয়ে নিল।
“ও এখানে কী করছে?” শক্ত কণ্ঠে বললেন আয়েশা।
“মালিহাও তো যাবে।”
“আমাদের সাথে যাবে কেনো?”
“আহা মা! আমরা একই জায়গায় যাচ্ছি। এখন যদি আলাদা যাই মানুষ কি বলবে বলো! খারাপ বলবে না? আমি তো তোমাকে বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম।” বুদ্ধির ওপর কথা আসায় আয়েশা চুপ করে গেলেন। দম ছাড়লো ইতমিনান। মিতুলকে ইশারা করলো মালিহাকে নিয়ে আগে চলে যেতে। পেছন পেছন এলো ইতমিনান।
আয়েশা সেই যে মুখ বন্ধ করলেন সেই মুখ আর খুললেন না। মালিহার অস্বস্তি হলো, খারাপ লাগলো। চাচীর ব্যবহার মেনে নিতে কষ্ট হলো। সেই ক্ষণে মায়ের কথাও মনে পড়ল। তার সাথে চাচী এমন ব্যবহার করবে এটা জানলে মা কথা বলবেই বা কেনো! ট্রেনের ঝিকঝিকির মাঝে সারাটা পথ মালিহা ভাবলো কিভাবে সম্পর্কের অবাঞ্ছিত কাঁটাগুলো সরানো যায়। তার পাশে বসেই ভাবনায় বুদ রইলেন আয়েশা। ভেবে চললেন কিভাবে ছেলের মন মালিহার থেকে ফেরানো যায়। পাশাপশি দুজন সফর সঙ্গীর কি নিদারুণ বিপরীত চিন্তা!
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৮
হলে পৌঁছে দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও রিকশা ডেকে তাতে মালিহাকে উঠিয়ে দিতে হলো। সাথে আয়েশা আছেন। ইতমিনান মা’কে রাগাতে চায় না, না চায় মায়ের মনে কষ্ট দিতে। অথচ তার খুশিতেই মা কষ্ট পান। ভাবনাটা ইতমিনানকে দুঃখ দিলো। দম ছেড়ে সে দেখলো মালিহার রিকশা চলতে শুরু করেছে। একটিবার পেছন ফিরেও তাকাল না মালিহা।
মা’কে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে গেলো সে। আয়েশা ঘুরে ঘুরে ছেলের ঘর দেখলেন। দেখার মতো কিছুই নেই। দুটো ঘর। এক ঘরে নিচে তোশক বিছিয়ে রাখা। সেটাও একজনের জন্য। প্রস্থ কম। তার উপরে শোভা পাচ্ছে মলিন একটা চাদর। পাশে একটা টেবিল। সেটাও বেশ নিচু ধরনের। নিচে বসেই কাজ করা যায়। তার পাশে একটা ট্রাংক। ভার্সিটিতে ভর্তির সময় এটা কেনা। কোনো এক বিচিত্র কারণে ছেলেটা এই ট্রাংকটা হাত ছাড়া করতে চায় না। একপাশে দেয়ালের সাথে লাগোয়া একটা আলনা। আরেক ঘর সম্পূর্ণ ফাঁকা। রান্নাঘরটা বেশ গোছালো। এক চুলার একটা গ্যাস। চাল, ডালসহ বেশ কিছু জিনিস সুন্দর করে গোছানো। বিছানার চাদরের দিকে ইশারা করে আয়েশা বললেন, “চাদর আর নেই ইতু? এটা তো ময়লা হয়ে গেছে।”
“আছে মা। ওটা বেশি বিছানো হয় না। তুমি হাত মুখ ধোও আমি বিছিয়ে দিচ্ছি।”
ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুমে গেলেন আয়েশা। বের হয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “একটা ঘর নিয়ে থাকিস তাহলে মেসে উঠলেই পারিস। শুধু শুধু একগাদা টাকা ভাড়া দেয়া।”
“মেসে হাজার রকম মানুষ থাকবে। আবার রান্নারও ছিরি নেই। আমি ওখানে থাকতে পারি না।” মুখ কুঁচকে বলল ইতমিনান।
“তোশক তো দেখছি একটা। তুই থাকবি কোথায়?”
“ওসব নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তুমি কি খাবে বলো। আজকে আমি তোমাকে রান্না করে খাওয়াই।”
আয়েশা হাসলেন ছেলের ছেলেমানুষী দেখে।
“আমি থাকতে তুই রান্না করবি কেনো?”
“সবসময় তো তুমিই করো। আজকে আমার হাতের রান্না খাও। বলো কি খাবে।”
“লাউ চিংড়ি।”
“আর?”
“করলা ভাজি।”
ইতমিনান মুখ বাঁকা করলো, “এই তিতা জিনিসটা যে তোমার এতো পছন্দ!”
ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে বাজারে গেলো সে। দেখে দেখে লাউ, চিংড়ি, করলা আর টুকটাক কিছু জিনিস নিয়ে এলো। বাড়িতে আসতেই চক্ষু চড়কগাছ। আয়েশা ইতোমধ্যেই ঘরে থাকা জিনিস দিয়ে রান্না করতে শুরু করেছেন। ছেলেকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, “আমি তোর রান্না খাবো, তুই আমার রান্না খাবি। শোধবোধ।”
“তুমি আমার সাথে শোধবোধ করতে নেমেছ। ভালোই!” একবার বলতে চাইলো মালিহার ভার্সিটি কাছেই। এতো রকম তরকারি রান্না করছো, ওকে একবার ডাক দিই। কিন্তু আয়েশা রাগ করতে পারেন ভেবে সেকথা আর বলল না।
হঠাৎ আয়েশা বললেন, “ওর কথা কি আর মনে হয়?”
ধ্যান ভাঙলো ইতমিনানের, “কার কথা?”
“মালিহার।”
ইতমিনান কিছুনা বললেও তার মুখের ভাষা পড়তে আয়েশার কষ্ট হলো না।
“তুই ওর সাথে সুখে থাকবি না বাপ। বুঝতে পারছিস না কেনো?”
“মা দোয়া না করলে কারো সাথেই সুখে থাকতে পারবো না। বুঝতে পারছি।” মাথা নাড়ল ইতমিনান।
“আহা! দেখ ওর মা বাবা সম্পত্তির জন্য আমাদের সাথ কেমন করলো। তাদের মেয়ে আর কতো ভালো হবে। ভবিষ্যতে তোর আর মিলির ব্যাপারেও এমন বলবে নাকি কে জানে!”
ইতমিনান শান্ত কণ্ঠে বলল, “আমার বাবা মা একই কাজ করা সত্ত্বেও যদি একটুখানি বোধ আমার ভেতরে থাকে তাহলে ওর আরেকটু বেশি থাকার কথা। কারণ সম্পর্ক রক্ষার প্রচেষ্টা ওদের বেশী ছিলো।”
আয়েশার মুখটা থমথমে হয়ে গেলো, “আমার সাথে তুলনা দিচ্ছিস?”
“তুমি মা। তোমার সাথে কারো তুলনা চলে!” হেসে বলল ইতমিনান। “আমার জীবনে যাই হয়ে যাক না কেন, তোমার জায়গাটা আমার কাছে সবসময় বিশেষ থাকবে মা। তোমাকে খুশি রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করবো। তাতে আমি যতো কষ্টই পাই না কেনো।” রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে পড়ল ইতমিনান। শেষ কথাটা সরাসরি আয়েশার বুকে আঘাত দিলো যেনো। ছেলেটা তাকে খুশি রাখার জন্য নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে! সত্যিই কি তাই?
°
ইতমিনান দুপুর থেকে লক্ষ্য করছে আয়েশা একটু পরপর হাঁচি দিচ্ছেন। খাওয়ার সময় সে চিন্তিত কণ্ঠে বলল, “তোমার কি ঠান্ডা লেগে গেলো মা?”
“পানি পাল্টেছে না? এজন্য একটু হাঁচি কাশি হচ্ছে। এসব একাই ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্।”
বলতে বলতেই কয়েকবার হাঁচি দিয়ে ফেললেন তিনি। ইতমিনান দেখলো আয়েশার নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। পুরো মুখেও একটা লালাভ ভাব। স্বস্তিতে থাকতে পারলো না সে। জোর করে টেনে এনে মাকে অস্বস্তিতে ফেললো না তো?
হাঁচি কাশি থেকে জ্বর আসতে সময় নিলো না। ইতমিনান যখন মাগরিবের নামাজ পড়ে এলো তখন দরজা খুলতে আয়েশা এগিয়ে যেতে পারলেন না। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে তালা খুললো ইতমিনান। ঘরে যেয়ে দেখলো আয়েশা অচেতনের মতো বিছানায় পড়ে আছেন। ভয়, শঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে এলো। দ্রুত এগিয়ে গেলো মায়ের কাছে। কিছুক্ষণ ডাকলো একভাবে, “মা! মা! এই মা! মা ওঠো!” শেষবার ওঠার জন্য বলার সময় আয়েশার হাতে হাত রাখতেই চমক উঠলো ইতমিনান। পুরো শরীর আগুন গরম হয়ে আছে। গালে, কপালে হাত রাখলো ইতমিনান। আ’গু’নের হলকা বের হচ্ছে যেনো। সে খেয়াল করে দেখলো আয়েশার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। কতক্ষন ঝাকাঝাকি করার পরও যখন আয়েশা সাড়া দিলেন না তখন ছুটে পানি নিয়ে এলো ইতমিনান। খুঁজে খুঁজে একটা কাপড়ের টুকরো বের করলো। সে বুঝতেই পারছে না এইটুকু সময়ের মাঝে এতোটা জ্বর এসে গেলো কিভাবে! মাগরিবের নামাজের আধা ঘণ্টা আগে সে বেরিয়েছে। সর্ব সাকুল্যে এক ঘণ্টার কাছাকাছি কিছু সময় আয়েশা একা ছিলেন। এরই মাঝে এতো জ্বর চলে এলো!
কাপড় ভিজিয়ে আয়েশার কপালে কিছুক্ষণ ধরে রাখলো ইতমিনান। পুরো চেহারায়, হাতে, পায়ে পানি দিয়ে মুছে দিলো। আয়েশার কোনো সাড়া শব্দ নেই। ইতমিনানের না ঘুরে উঠলো। এই একা বাড়িতে মাকে নিয়ে সে কি করবে! হাসপাতাল বেশ অনেকটা দূরে। সে পর্যন্তও তো আয়েশাকে একা একা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। কি করবে কি করবে ভাবতেই মালিহার নামটা মাথায় এলো। মালিহাকে নিয়ে এলে কেমন হয়? এমন অবস্থা শুনলে মেয়েটা নিশ্চয়ই না করবে না? ছুটে বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে গেলো সে। একজনকে আয়েশার কাছে বসিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ বেল বাজানোর পর এক বাচ্চা ছেলে দরজা খুলল। ইতমিনানকে হতাশ করে দিয়ে জানালো বাড়িতে কেউ নেই। কোমরে হাত রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ইতমিনান। ডান হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছে আবার ছুটে গেলো মায়ের কাছে। আয়েশা নড়াচড়া করছেন। কাছে গিয়ে নরম কণ্ঠে সে বলল, “মা! ও মা! খারাপ লাগছে তোমার? একটু কথা বলো না মা!” গলাটা কেঁপে উঠল ইতমিনানের। নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো তার। আয়েশা চোখ টেনে খুলতে চাইলেন। পারলেন না। কিছুক্ষণ হু হা করলেন খুব কষ্টে। ইতমিনান আয়েশার কপালে হাত রেখে উঠে দাঁড়ালো। এই অচেনা শহরে তার কেউ নেই। কিন্তু আল্লাহ সবসময় সব জায়গায় তার সাথে আছেন। সাহায্যকারী হিসেবে তাঁর চাইতে উত্তম আর কে হতে পারে? দরজার দিকে ছুটতে ইতমিনান বিড়বিড় করে বলল, “আমার মা’কে তোমার হেফাজতে রেখে গেলাম আল্লাহ। একটু দেখে রেখো! প্লিজ!”
হাঁটা পথ রিকশায় গেলো সে। পারলে উড়ে যেতো। তার হৃদস্পন্দন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। একা একা আয়েশা কি করছেন ভাবতেই বুকটা আরো জোরে ধক ধক করে উঠছে। হলের সামনে রিকশাটা দাঁড়াতেই ইতমিনান বলল, “ভাই একটু দাঁড়ান। আমি এখুনি চলে আসছি। আপনার রিকশাতেই ফেরত যাবো। একটু দাঁড়ান ভাই!”
দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো ইতমিনান। ওয়েটিং রুমে ঢুকে মনে হলো সে তো মালিহাকে কিছুই জানায়নি। তৎক্ষণাৎ পকেটে হাত দিলো ফোনের আশায়। আতিপাতি করে খুঁজেও কোথাও ফোন পেলো না। সে ফোন আনতে ভুলে গেছে! কষিয়ে একটা থাপ্পর দিতে মন চাইলো নিজেকে। রুমের ওপাশে ভেতরে যাতায়াত করা কিছু মেয়েকে ডেকে মালিহার কথা বলল। দুইজন চেনে না। তিনজনের বেলায় মেয়েটা যেনো চিনলো। ইতমিনান অনুনয় করলো একটু ডেকে দেয়ার জন্য। মেয়েটা মাথা নেড়ে ভেতরে গেলেও গেলো নিজের রুমের দিকে। তার মাঝে মালিহাকে ডাকার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। ইতমিনান সেসব আর দেখতে পেলো না। কপালের দিকের চুলগুলো মুঠি করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মালিহার নাম্বারও তো তার মুখস্থ নেই। কি করবে সে?
নিচে এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসেছিল নাজিফা। ইতমিনানের উচ্চকন্ঠে মালিহার খোঁজ তার কানে গেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়ল। আড়াল থেকে শুনে বুঝতে পারলো লোকটা মালিহাকেই খুঁজছে। দেরি করলো না সে। ছুটে গেলো মালিহার রুমে।
আঁখি অর্ডার করা জিনিসগুলো বের করেছিল। সবাই ভাবছিল নীতিকে এগুলো পড়লে ঠিক কতটা সুন্দর দেখাবে। আগামীকাল আসবে সে। মেয়েটাকে খুব একটা চমক দেয়া যাবে ভাবতে পেরেই পুলকিত হলো সকলে। সেই ক্ষণে ছুটে এলো নাজিফা। লোকটার চিন্তিত মুখ দেখে তার মনে হয়েছে ঘটনা গুরুতর। নয়তো এভাবে নিশ্চয়ই খুঁজতো না! আর যেভাবে মালিহার বর্ণনা দিচ্ছিল বোঝা যায় তার অতি পরিচিত কেউ। ছুটতে ছুটতে এসে ঘরে ঢুকে পড়ল নাজিফা। দরজায় নক করার কথা ভুলে গেলো। নাজিফাকে দেখে উচ্ছ্বসিত স্বরে মালিহা বলল, “এই নাজিফা এদিকে আসো। দেখো এগুলো নীতির জন্য কিনেছি।”
নাজিফা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এই শহরে তোমার পরিচিত কেউ আছে মালিহা?”
মালিহার ভুরু কুঁচকে এলো, “আছে। কেনো বলো তো?”
“কে সে?”
“আমার চাচাত ভাই।”
“উনিই সম্ভবত ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য। একটু দেখবে চলো তো। কয়েকজনের কাছে তোমার কথা বলছিলেন। ফোন আনতে ভুলে গেছেন মনে হয়। উনাকে দেখে ঘটনা বেশ সিরিয়াস মনে হলো। ”
মালিহা দৌড়ে বের হলো। মিনিটের মাঝেই পৌঁছে গেলো ওয়েটিং রুমে। ইতমিনান তখন পায়চারি করছে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে। মালিহাকে দেখে যেনো হালে পানি পেলো সে। তৎক্ষণাৎ এগিয়ে যেয়ে ভগ্ন কণ্ঠে বলল, “মালিহা মা.. মায়ের খুব জ্বর এসেছে। একটু যাবি তুই?”
মালিহার মনে পড়ল না এতো করুন স্বরে কবে ইতমিনানকে কথা বলতে শুনেছে সে। মাথা নেড়ে সে বলল, “একটা মিনিট দাঁড়াও। প্রভোস্ট ম্যামের কাছে বলে আসি।”
ছুটে ওপরে গেলো মালিহা। কোনরকমে বোরখা পরে গায়ের ওড়নাটাই ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। আঁখি, মনিকাকে সংক্ষেপে সবটা বলে ব্যাগে ফোন আর বই নিয়ে নিচে চলে গেলো। প্রভোস্ট ম্যাম হলে নেই। তার পরিবর্তে আরেকজনকে জানিয়ে ইমারজেন্সি ছুটি নিলো মালিহা। মহিলা মালিহার নাম্বার, ইতমিনানের নাম্বার, ঠিকানা সব রেখে দিলো। তড়িঘড়ি করে বের হলো দুজনে।
রিকশায় বসতেই ইতমিনান যখন তার পাশে বসলো মালিহা হতভম্ব হয়ে গেলো। ইতমিনান কখনোই তার সাথে এক রিকশায় বসেনি। আগে পিছে দুটো রিকশা নিয়ে দুজন যাত্রা করেছে। মালিহা বুঝলো আজ ইতমিনানের সেই হুশ নেই। দ্রুত গতিতে সে রিকশাওয়ালাকে বলছে, “যেখান থেকে উঠেছিলাম ওখানেই চলুন মামা। একটু দ্রুত চলুন।”
ইতমিনান খেয়াল না করলেও মালিহার অস্বস্তির শেষ রইলো না। কাঁধের ব্যাগটা দুজনের মাঝে রেখে একপাশে চেপে বসলো সে। ইতমিনান সেসব খেয়াল করলো না। সে আবার বলল, “মামা! একটু দ্রুত চালান।”
“গাড়ি তো মামা পিলেন না। আমি তো আর উইড়া যাইতে পারি না।” বিরক্ত কণ্ঠে বললেন রিকশাওয়ালা। ইতমিনান তবুও থামলো না। বলেই চলল সে কথা। মালিহা বুঝলো চাচীর হঠাৎ অসুস্থতা ইতমিনানকে ঠিক কতটা আতঙ্কে ফেলেছে।
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৯
ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢুকেই থমকে গেলো ইতমিনান। বিদ্যুৎ চলে গেছে! মা তাহলে কিভাবে আছে! এই চিন্তা করে দরজা খোলা রেখেই ঘরের দিকে ছুটলো সে। মালিহা মোবাইলের টর্চ জ্বে’লেছে একটু আগেই। সেটা দিয়েই দরজা আটকে সিটকিনি তুলে দিলো।
ইতমিনান বিছানায় বসে আয়েশার হাত পা মালিশ করছে। ডায়নিং থেকে সেই দৃশ্য দেখে এগিয়ে গেলো মালিহা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো ইতমিনানের অস্থিরতা। আবার ডায়নিংয়ে যেয়ে বোরখা খুলে ওড়নাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। ইতমিনানের ঘরে ঢুকে আলনার এক কোনায় রেখে দিলো বোরখা। আয়েশার কাছে বসে এক পলক তার দিকে তাকালো। গালে, গলায় হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করলো জ্বরের উত্তাপ। অস্থির ইতমিনানকে বলল, “জ্বর কতো?”
“মাপিনি। থার্মোমিটার নেই।”
মালিহা অনুমান করলো একশো তিন তো হবেই। চারও হতে পারে। আয়েশার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে তার নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মালিহা এক পল ইতমিনানের দিকে তাকালো।
“বাসায় নাপা আছে?”
“না।” মাথা নাড়ল ইতমিনান।
“তাহলে নিয়ে আসো। আমি চাচীর কাছে বসছি।”
দেরি করলো না ইতমিনান। ছুটে গেলো। বাথরুম থেকে পানি ভর্তি বালতি নিয়ে এলো মালিহা। বিছানাটা মাটিতে। কিভাবে পানি দেবে মাথায়? উপায় না পেয়ে ইতমিনানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। দশ মিনিটের মাঝেই ফেরত এলো ইতমিনান। মালিহা ভাবলো আগে ওষুধটা খাওয়ানো দরকার। কিছু না বলেই উঠে পড়ল সে। ছোট্ট ফ্ল্যাট। কাজেই রান্নাঘর পেতে কষ্ট হলো না। অল্প কিছু ভাত নিয়ে তরকারি নিতে যেয়ে দেখলো লাউ চিংড়ি থেকে টক টক গন্ধ বের হচ্ছে। বুঝতে কষ্ট হলো না যে ওটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটু পানি ভাতে দিয়ে করলা ভাজি নিয়ে গেলো। বিছানায় বসে বলল, “ভাইয়া চাচীকে উঠিয়ে ধরো। খাইয়ে ওষুধ খাওয়াই।”
আয়েশাকে ওঠাতে ইতমিনানকে বেশ বেগে পেতে হলো। শরীরটা যেনো তিনি ছেড়েই দিয়েছেন। একপাশ থেকে তাক জাপটে ধরে রইলো ইতমিনান। মালিহা আস্তে ধীরে পুরোটা খাবার খাইয়ে দিল। আয়েশা বারবার মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন। চোখ বন্ধ করেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন মুখটা কি বিশ্রী তিক্ত হয়ে আছে। মালিহা বারবারই জোর করে খাওয়ালো। অল্প খাবারটা শেষ হতেই ওষুধ খাইয়ে দিলো। প্লেট রেখে এসে ইতমিনানকে বলল, “চাচীকে এভাবেই ধরে রাখো। শুইয়ে দিও না।”
একপাশে রাখা বালতিটা এগিয়ে নিয়ে এলো মালিহা। ইতমিনানের পাশে বসে আয়েশার গলার চারপাশে গামছা জড়িয়ে দিলো। আরেকটা ছোট বালতি এনে রাখলো তার মাথার নিচে। চুলগুলো খুলে ধীরে সুস্থে পানি দিয়ে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আয়েশা গোঙাতে শুরু করলে ইতমিনান উত্তেজিত হয়ে বলল, “এই কি হলো! মা এমন করছে কেন? পানি ঢালা বন্ধ কর। মা’র মনে হয় খারাপ লাগছে।”
“চুপ করো। ভালো লাগছে বলেই এমন করছে। এতক্ষণ একটা কথাও বলেছিলো?” ইতমিনান যতোটা অস্থির ঠিক ততটাই শান্ত মালিহা। পানি দেয়ার সাথে সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। আয়েশা চোখ পিটপিট করে একবার কি যেনো দেখলেন। আবার চোখ বন্ধ করলেন। পানি দেয়ার বিশ পঁচিশ মিনিটের মাথায়ও যখন জ্বর কমলো না তখন মালিহা বলল, “দোয়া টোয়া কিছু করতে পারো?”
“হ্যাঁ?” ইতমিনান যেনো বুঝলো না কথার মানে।
“তখন থেকে তো চ্যা চু করে যাচ্ছো। একটু দোয়া পড়ে তো মা’র চোখে মুখে ফু দিতে পারো।”
“আমি দোয়া করলে হবে?”
কণ্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে মালিহা বলল, “তাহলে যাও কাবা শরীফের ইমাম ধরে আনো।”
পরপর নিজেই বিড়বিড় করতে শুরু করলো। তার দেখাদেখি ইতমিনানও জানা দোয়া আউড়ে আয়েশার মুখে ফু দিলো। এই পর্যায়ে মালিহা বলল, “বাইরে যাও তো তুমি।”
“কেনো? কি করবি?”
“উফ! এতো প্রশ্ন করো কেনো? চাচীর গা মুছবো। যাও।”
নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ইতমিনান। মালিহা দরজা চাপিয়ে দেয়ার সময় ফেরত এসে বলল, “আলনার পাশে মা’র ব্যাগ রাখা। ওখান থেকে কাপড় নিস।”
“নেবো। তুমিও এখন রোগী হতে না চাইলে এই গেঞ্জি পালটাও।”
নিজের দিকে তাকিয়ে ইতমিনান দেখলো বুকের কাছ থেকে গেঞ্জি ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।
“একটা গেঞ্জি দে।”
আলনার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো মালিহা, “কোনটা দেবো।”
“দে, একটা দিলেই হলো।”
গাঢ় সবুজ রঙের একটা গেঞ্জি ইতমিনানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দরজা আটকালো মালিহা। আয়েশার সারা শরীর মুছে দিলো হালকা ভেজা গামছা দিয়ে। আয়েশা বিড়বিড় করে একবার কি যেনো বললেন মালিহা কিছুই বুঝল না। শুকনো একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে আয়েশাকে শুইয়ে দিলো মালিহা। হাঁফ ছেড়ে বসলো সে। একা একা কাজটা করা কঠিন ছিল বটে। কিন্তু সাহায্যকারী কেউ নেই। তাই কষ্ট করে হলেও তাকেই সবটা করতে হলো। উঠে দরজা খুলে দিলে ইতমিনান এমনভাবে ঢুকলো যেনো সে দরজায়ই দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষন। আয়েশার গালে, গলায় হাত রেখে তার মনে হলো জ্বর বোধহয় কিছু কমেছে।
মালিহা এশার নামাজ পড়েনি। ওযু করে এসে জায়নামাজ হাতে নিয়ে বলল, “পশ্চিম কোন দিকে?”
তখনই ইতমিনানের মনে পড়ল সেও নামাজ পড়েনি। জামায়াত তো ছুটে গেছেই আবার দেরিও হয়েছে।
“এই দিকে।” হাত দিয়ে দেখালো ইতমিনান। মায়ের হাত জোড়া ধরে বসে রইলো শিয়রেই। নামাজ শেষে মালিহা বলল, “চাচার সাথে কথা হয়েছে?”
“না।”
“ফোন দিয়ে কথা বলো। চিন্তা করবে না! চাচীর কথা বলার দরকার নেই। বলো ঘুমিয়ে গেছে।”
কথা বলে নামাজে দাঁড়ালো ইতমিনান। বই বের করে আয়েশার পাশে বসলো মালিহা। এক হাতে কপাল টিপতে টিপতে পড়তে লাগলো। সেই দৃশ্য দেখে ইতমিনানের বুক জুড়িয়ে গেলো। ইশ! মা’কে যদি একবার দেখানো যেতো কতোটা অসুখী লাগছে তার!
“তুমি শুয়ে পড়। দরকার হলে আমি ডাক দেবো। ঐ ঘরে শোয়ার জায়গা আছে?”
“আমি যাবো না।”
“সারারাত জেগে বসে থাকবে আর সকাল বেলা রোগী বাড়াবে? যাও তুমি। এখনও বসে আছো কেনো? ওঠো!”
রাত জাগলে ইতমিনান প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাড়ির সকালেই এটা জানে। একবার স্কুলের পরীক্ষার আগের দিন রাত জেগে পড়াশোনা করে সকালে এমন অসুস্থ হলো যে সেই পরীক্ষাই আর দিয়ে পারলো না। সেই থেকে তার এই কাহিনী মোটামুটি সবাই জানে। আয়েশার কপালে হাত রাখতেই জ্বরটা আগের থেকে কম মনে হলো। সে উঠলে মালিহা বইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “খেয়ে শোবে। নাহলে ভাত আমি তোমার মুখে ঢালবো।”
খাওয়ার কথা শুনতেই যেনো খিদেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। মনে হলো দুপুরের পর থেকে আর কিছুই খাওয়া হয়নি। মালিহাকে জোর করতে হলো না। ইতমিনান নিজেই খেয়ে নিলো। তাকে খেতো বললে মালিহা বলল, “সন্ধ্যা বেলা মুড়ি মাখা খেয়েছি। পেট ভরে আছে আমার। খাবো না।”
ইতমিনান জোর করলো না। ক্লান্ত শরীরে জায়নামাজ নিয়ে অপর ঘরে গেলো। সেটা ফ্লোরে বিছিয়ে হাতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। মায়ের কাছে মালিহা আছে ভেবেই নিশ্চিন্ত মনে চোখ বন্ধ করলো সে।
••
রাত তখন পূর্ণ যৌবন লাভ করেছে। তার তিমিরে ছিদ্র পাওয়া দায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে মালিহা। তার ভারী নিঃশ্বাসের বাতাস ঘুরছে রুমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। একটা হাত তখনও আয়েশার কপালে।
জ্বর ছাড়ায় ঘেমে উঠেছেন আয়েশা। শরীর ভেজা লাগায় ঘুমটা পাতলা হয়ে এলো। বিশ্রী একটা ঢেঁকুর উঠলো তখনই। চোখ মুখ কুচকে নিলেন তিনি। নড়াচড়া করলেন। উঠে বসতে চাইলেন। পারলেন না। কিন্তু মালিহার হালকা ঘুম ভেংগে গেল। ধড়ফড় করে উঠে সে আয়েশার দিকে তাকালো। তার মুখে হয় রাখলো। আয়েশা ভগ্ন কণ্ঠে বললেন, “ইতু!” তখনও তার চোখ বন্ধ। মালিহা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “খারাপ লাগছে চাচী? ভাইয়াকে ডাক দেবো?”
চোখ খুললেন আয়েশা। অন্ধকারে কিছু দেখলেন না। কিন্তু নাভির আশপাশে তীক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করলেন। বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ব্যাথাটা হঠাৎ হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠছে। মালিহা লাইট জ্বালালো। আয়েশার অস্বস্তি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচী? কি হয়েছে আপনার?”
আয়েশা তাকালেন। কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে বুঝলেন এটা মালিহা। তবে তখন রাগ করার শক্তি তার নেই। ধীর কণ্ঠে বললেন, “বসবো।”
মালিহা এগিয়ে গেলো। পিঠের পেছনে হাত রেখে আরেক হাতে আয়েশার হাত ধরে তাকে ওঠাতে চাইলো। সেসময় আয়েশার পেটে আরেকবার ঝিলিক দিয়ে উঠতেই গলগলিয়ে বমি করে দিলেন তিনি। সবটা পড়ল মালিহার গায়ে। একভাবে বমি করে রাতের অল্প স্বল্প খাবারের পুরোটাই উগড়ে দিলেন। শক্ত করে খামচে ধরলেন মালিহার ডান হাত।
আকস্মিক কান্ডে মালিহা হকচকিয়ে গেল। সরে যাওয়ার সময়টুকুও পেলো না। তারপরই আয়েশা এমনভাবে হাতটা আঁকড়ে ধরলেন যে তার আর সরে যাওয়া হলো না। আয়েশার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো সে। মনে হচ্ছে যেন আয়েশার জীবনটা বের হয়ে যাচ্ছে।
বমি শেষে বিছানায় এলিয়ে পড়লেন আয়েশা। মালিহা পড়ল বিপাকে। নিজের কাপড় পরিষ্কার করবে নাকি চাচীকে ধরবে। কামিজের ঝুলন্ত অংশটা হাতে ধরে ইতমিনানের ঘরের সামনে যেয়ে তাকে ডাকতে শুরু করলো, “ভাইয়া! ভাইয়া? ইতু ভাই!”
ইতমিনান তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। আজ তার গাঢ় ঘুম হয়নি। অবচেতন মনের প্রতিটি অংশ যেনো মায়ের অসুস্থতা সম্পর্কে সজাগ ছিলো।
মালিহাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু বুঝতে পারল না সে।
“একটু চাচীর কাছে যেয়ে বসো তো।”
ছুটে মায়ের কাছে যেতেই ইতমিনান দেখলো তিনি শুয়ে আছেন। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন। পাশে বসে তার হাত ধরতেই চোখ খুললেন আয়েশা।
“ইতু!”
“বলো মা! খারাপ লাগছে?”
“পানি খাবো।”
ইতমিনান মা’কে পানি খাওয়ালো। কিছুটা ধাতস্থ হলেন তিনি। মালিহা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো ভেজা জামা কাপড় গায়ে। সে তো কোনো জামা আনেনি। এবার উপায় কি হবে? ওড়নাটা শুকনা ছিলো। সেটাই গায়ে জড়িয়ে রেখেছিল কোনরকমে। টিস্যু দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা বমির অংশগুলো পরিষ্কার করে বিছানায় তাকালো। কোথাও কোনো ময়লা নেই।
“তোর জামা ভিজলো কিভাবে?” অবাক কণ্ঠে বল ইতমিনান। মালিহা সংকুচিত হয়ে গেলো। আয়েশা শান্ত কণ্ঠে বললেন, “আমি বমি করেছি।”
মালিহা কি করবে বুঝতে পারছিলো না। ভেজা কাপড় গায়ে নিয়ে কোথাও বসাও যাবে না। অগত্যা অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আয়েশা ছেলেকে বললেন, “আমার ব্যাগটা দে ইতু।”
“কি করবে মা?”
“দে আগে।” আয়েশা বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলছেন। ইতমিনানের বুকের চাপ যেনো কিছুটা কমলো। মায়ের হাতে ব্যাগ দিতেই তিনি একটা শাড়ি বের করে দিলেন। মালিহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “পরতে পারো?”
মালিহা চমকে গেলো। এমন সাহায্য সে আশা করেনি।
“জ..জি পারি।” শাড়িটা নিলো মালিহা। ভাঁজ খুলে আনুষাঙ্গিক জিনিস পেয়ে বাথরুমে চলে গেলো। পানির ফোঁটাগুলো মিশে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।
ইতমিনান মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এতো শান্ত কণ্ঠে, স্বাভাবিকভাবে মা যে মালিহার সাথে কথা বলতে পারে এটাই যেনো সে ভুলে গিয়েছিল।
“যা শুয়ে পড়। আমার ভালো লাগছে এখন।”
“না তোমার কাছে থাকি।”
“আমি ঘুমাবো। থাক তুই।” আয়েশা শুয়ে পড়লেন। ইতমিনান যখন উঠলো তখনই মালিহা ঘরে ঢুকলো। মালিহাকে দেখে ইতমিনানের মনে হলো যেন সদ্য বিবাহিত বধূ শাশুড়ি সেবায় মগ্ন। খুক খুক করে কাশতে কাশতে মায়ের দিকে তাকালো সে। তার চোখ বন্ধ। দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ইতমিনান। এবার একটা জম্পেশ ঘুম দেয়া যাবে।
আয়েশার পাশে বসে তার মাথায় হাত রাখতে ইতস্তত করছিল মালিহা। জেগে আছেন। কিছু যদি মনে করেন। তখনই আয়েশা শান্ত কণ্ঠে বললেন, “সারারাত তো নিজেই সব করেছো। এখন তাহলে অস্বস্তি লাগছে কেনো?”
মালিহা চমকে তাকালো। আয়েশা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মালিহা সেই দৃষ্টির রহস্য উদ্ধার করতে পারল না। ঘৃণা, ক্ষোভ কিছুই তো নেই সেথায়। তবে?
চলমান।