উষ্ণতা পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
98

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৪

ছেলের চেহারা বোঝার চেষ্টা করছিলেন আয়েশা। ইতমিনান তার মুখের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “খাও মা।”
আয়েশা নিলেন না। ইতমিনান হাসলো। আয়েশার যাচ্ছে সে হাসি বড় অসহায় মনে হলো।
“আমার হাতে খেতেও তোমার আপত্তি?”
আয়েশা রা করলেন না। চুপচাপ ভাত মুখে নিলেন। তীর্যক কণ্ঠে বললেন, “মালিহা তোর সাথে অনেক যোগাযোগ করে?”
খাপছাড়া প্রশ্ন। মেয়েটার প্রতি যেই মায়াটুকু জড়ো হয়েছিল সেসব উধাও হয়ে গেছে। ছেলের এক স্বীকারোক্তিতে তিনি যেনো আগের রূপে ফিরে গেছেন। ইতমিনান বলল, “ও আমার সাথে যোগাযোগই করে না মা। এই দেড় দুই মাসে আমাকে একবার কল দিয়েছে। তাও বিপদে পরে। নয়তো আমিই দিই।”
“তুই দিস কেনো?”
উত্তর দিলো না ইতমিনান। এক মনে ভাত মাখতে থাকলো। চুপচাপ আয়েশাকে বোঝাতে চাইলো তার কল দেয়ার কারণটা। সেটা বুঝে আয়েশা ভেতরে ভেতরে জ্ব’লে উঠলেন। তবে ছেলের সামনে প্রকাশ করলেন না। এমন ভাবে ভাত চিবুলেন যেনো ওগুলো ভাত নয় আস্ত মালিহা আর নাজিয়া।

বিছানার সাথে লাগোয়া জানালাটা খোলা। কাত হয়ে সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে ইতমিনান। পাশেই পুকুর। পুকুরের সাথে বিরাট এক নারিকেল গাছ। এই গাছটার দিকে তাকালেই ইতমিনানের মনে পড়ে যায় বহু আগের একদিনের কথা।
কী এক কারণে যেনো মালিহার সাথে ঝগড়া করেছিল সে। সেই ঝগড়ার রেশ ধরে মালিহার হাতে মুঠো করে রাখা এক টাকার হলুদ কয়েন পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সে। মেয়েটার সে কি কান্না! কতো হবে তখন বয়স? দুই কি তিন। মালিহার উথাল পাথাল কান্নায় টিকতে না পেরে তাকেই আবার পুকুরে নামতে হলো। কাদায় মাখামাখি কয়েন হাতে দিতেই মালিহার কান্না থামলো। আয়েশা এক দফা বকলেন। তিনি তো আর জানতেন না ঘটনা তার সুপুত্রই ঘটিয়েছে।
হাহ! সেসব দিন যেনো চোখের পলকে চলে গেছে। টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে একটা জোনাকি উড়ে গেলো। ইতমিনানের মনে হলো মতিয়ার আলীর মৃ’ত্যুর পরদিন মালিহাকে দেখে ঠিক এমনই একটা আলো জ্বলেছিল তার মন কুঠিরে। টিমটিমে একটা আলো। ঠিক সেসময় সেই জোনাকিটা বের করে দিলে আজ তাকে ভুক্তভোগী অবস্থায় নির্ঘুম রাত কাটাতে হতো না। মালিহা তো বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মনে কোন অনুভূতি নেই, বোঝাও নেই। ইতমিনান নিজের জন্য স্বেচ্ছায় সব ডেকে এনেছে। সেই নজর। প্রথম দিনের অপলক নজরটাই তাকে কুপোকাত করে দিয়েছে। সেদিন ইমাম হুজুর খুতবার সময় বলছিলেন। কুরআনে নাকি মেয়েদের পর্দার আগে ছেলেদের পর্দার কথা বলা হয়েছে। ইতমিনান অবাক হয়েছিল। যখন শুনলো ছেলেদের নজর নামাতে বলা হয়েছে তখন হাড়ে হাড়ে সবটা টের পেলো। এই যুক্তি বুঝতে তাকে ঐ আয়াত দ্বিতীয়বার পড়তে হবে না। নিজের জীবন দিয়েই বুঝেছে সে। মালিহা তো কতবারই তার দিকে তাকিয়েছে। কিছুই তো হয়নি। কিন্তু সে বোকার মতো নজরের জালে আটকা পড়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে তার ইচ্ছানুযায়ী পরিস্থিতি তৈরি অসম্ভবই বটে। যদি সেটা নাই হয় তাহলে ভবিষ্যতে তার ঘরে থাকবে একজন, মনে আরেকজন। উফ! কি ভয়ানক! মুখ মুছলো ইতমিনান। মা একটু রাজি হলে খুব কি ক্ষতি হতো?

মিতুল নাজিয়াকে রাজি করিয়ে ফেলেছে। নাজিয়া যেনো তৈরিই ছিলেন। ছেলে একবার বলতেই তিনি গোছগাছ শুরু করে দিলেন। সাইফের মা কয়েকবার সাধলেন বটে। তবে তাতে বিশেষ জোর ছিলো না। নাজিয়া বুঝলেন সবটাই। মেনে নিলেন অব্যর্থ সম্পর্কের ব্যর্থ পরিণতি।
বিদায় বেলায় মকবুল আলী এবং ইতমিনান এসে হাজির হলো। নাজিয়া তো বটেই ইতমিনানকে দেখে মিতুলও অবাক হলো। সে তো চাচাকে জানিয়েছিল। ইতমিনান যে এখানে সেটাই তো সে জানতো না। জড়তা ঠেলে তাকে কিছু বলতেও পারলো না।
নাজিয়া মনে মনে আপ্লুত হলেন। ভাসুর আর তার ছেলের আগমনের বিষয়টা যে কতটা সম্মান দিলো তাকে সে আর কাউকে বুঝিয়ে দিতে হবে না। কি অদ্ভুত! যে ভাই ভাই করে ছেলেমেয়ের কথা অমান্য করে পাগল হয়ে ছুটে এসেছিলেন, সেই ভাই নিতে যাওয়া তো দূরের কথা একটা ফোন দিয়েও খোঁজ নেয়নি।
মকবুল আলী গাড়ি ডেকে ব্যাগপত্র উঠিয়ে দিলেন। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নাজিয়া বললেন, “তোমার বোনের বাড়ি যেও ভাই। আশা করি কখনও সেখানে অনাদর পাবে না।”
সাইফের বাবা কিছু বললেন না। মিতুল মামা মামীকে সালাম জানিয়ে গাড়িতে উঠলো। তার পাশে বসলো ইতমিনান। অটোর সামনে ড্রাইভারের পাশে বসলেন মকবুল আলী। নাজিয়া বিপরীতে বড় সিটে বসে ছিলেন। ইতমিনানকে বললেন, “কবে এসেছ?”
“গতকাল চাচী।”
“মালিহা বলল কয়েকদিন পর আসবে।”
“আমি শুনেছিলাম। আমার কিছু কাজ ছিল তাই আগে চলে এসেছি।” মাথা নাড়িয়ে বলল ইতমিনান। মকবুল আলী সামনে থেকে বিড়বিড় করলেন, “কাজ! হেহ!”
মিতুলের দিকে তাকিয়ে ইতমিনান বলল, “তোর কি অবস্থা?”
“ভালো।” শক্ত গলায় কাটকাট উত্তর দিলো মিতুল।
“আমার উপর এখনও রাগ করে আছিস?”
বাইরে তাকিয়ে মিতুল বলল, “যার তার সাথে আমি রাগ করি না।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান। ছোট্ট মিতুল হলে তো দুটো চকলেটের বদলেই রাগ কমে যেতো। এখন কি করবে সে?
মকবুল আলী নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেও ইতমিনান গেলো না। বহুদিন না থাকায় ঘরে মাকড়সা জাল বুনেছে। ধুলোবালিতে একাকার অবস্থা। মিতুলের সাথে মিলে সবটা পরিষ্কার করলো সে। নাজিয়া করতে চাইলে তাকে জোর করে বসিয়ে রাখলো। নাজিয়া শান্ত হয়ে বসে রইলেন। আজকাল কিছুতেই আর তিনি জোর পান না। কাউকে জোর করতেও পারেন না।
দুপুর গড়িয়ে আযান দিলে কাজ শেষ হলো। মিতুলকে ডেকে ইতমিনান বলল, “আমার সাথে আয়।”
“কোথায়।”
“জুজুর কাছে।” দুষ্টুমিটা ধরতে বেগ পেতে হলো না মিতুলকে। ছোট বেলায় এই জিনিসের নাম শুনলেই সে অর্ধেক অজ্ঞান হয়ে যেতো। কিন্তু এখন সে বড় হয়েছে। ইতমিনান সেটা ভুলে গেলেও সে মনে করিয়ে দিতে ভুললো না। যখন দেখলো ইতমিনান বাড়ির পথ ধরেছে তখন মিতুল বলল, “তোমার মা জুজু?”
“বেয়াদব!” ধমকে উঠলো ইতমিনান। মিতুল হাসি চাপলো। জুজুর কথাটা কে বলেছিলো?
ভাত তরকারি নিয়ে বসে ছিলেন রাশেদা। নাতিকে পেয়ে জড়িয়ে ধরলেন। ময়লা শরীরেই শীর্ণ হাত বুলিয়ে দিলেন। তার টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে মিতুল বলল, “গা ময়লা হয়ে আছে দাদি। এখন ধইরো না।”
“ময়লা হোক আর পরিষ্কার হোক। আমারই তো।”
মিতুলের বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেলো। এই বুঝি আপন!
খাবার হাতে নিতেই আয়েশাকে নজরে পড়ল। বিনয়ী কণ্ঠে সালাম জানিয়ে মিতুল বলল, “ধন্যবাদ চাচী।”
আয়েশা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এদের পরিবারের কাউকেই তার সহ্য হচ্ছে না।

মালিহা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে পনেরো মিনিটের কাছাকাছি। মিতুল বারবার বলেছে যেন তার জন্য অপেক্ষা করে। উঠলো মালিহা। ভাবলো একরু এগিয়ে যায়। প্লাটফর্ম থেকে বের হয়ে প্রবেশ পথে দাঁড়ালো। তারও প্রায় তিন মিনিট পর মিতুলের চিৎকার ভেসে এলো, “আপা!”
চকিতে তাকালো মালিহা। তার বুকটা ধ্বক করে উঠেছে। মিতুল সাইকেল চালিয়ে আসছে। কাছে আসতেই ধমক দিল মালিহা, “এভাবে ডাকে কেউ? ভয় পাইনি?”
“তোর টিকটিকির হার্ট। ভয় পেলে আমি করবো?”
“চিৎকার করবি না তাতেই হবে।”
“দেখ সাইকেল এনেছি তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কাউকে ওঠাইনি জানিস? তুই উঠে যাত্রা শুরু কর।”
মালিহা তখন সাইকেলটা খেয়াল করলো।
পেছনের সিট ধরে বলল, “ধারের জিনিস।”
“আমি কি টাকা মে’রে দেবো ভেবেছিস? মিতুল ম’রে গেলেও ধাপ্পাবাজি করবে না। নে বিসমিল্লাহ বলে ওঠ।”
হঠাৎ করেই ইরিনার কথা মনে পড়লো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মালিহা বলল, “ইনশাআল্লাহ্।” পরপর আবার বলল, “এই বেলুন লাগিয়েছিস কেনো?”
“তোকে ওঠাবো তাই।” লাজুক কণ্ঠে বলল মিতুল। মালিহা হাসলো। বাবাকে এতো মনে পড়ছে কেনো? সিটের পেছনে তিনটা বেলুন ঝুলছে। সেগুলো খুলে হাতে নিলো মালিহা। বলল, “ফেঁটে যায় যদি!”
মিতুল ব্যাগ সামনে নিয়ে নিলো। মালিহা বসলে তার হাত টেনে নিজের পেটের উপর রেখে বলল, “আপা সাবধানে ধরিস। সুড়সুড়ি দিস না প্লিজ!”
সাথেই সাথেই সুড়সুড়ি দিলো মালিহা। মিতুল লাফিয়ে উঠে বলল, “ভরা রাস্তায় পড়ে গেলে তোর আমার দুজনেরই মান সম্মান যাবে। যা করার বাড়ি যেয়ে করিস।”
মালিহা শান্ত হয়ে বসলো। সুতোয় বাঁধা বেলুনগুলো হাওয়ায় উড়ছে। মিতুল পিঠের দিকে তাকালো মালিহা। ভাইটা এতো বড় হয়ে গেলো কবে?
“আপা!”
“হু!”
“জানিস কি হয়েছে?”
“কি হয়েছে?”
“চাচার ছেলের জন্য মেয়ে দেখছে। সেদিন নাকি এক মেয়ে দেখে এসেছে। সেই বড়লোক!”
চট করে মিতুলের মুখের দিকে তাকালো মালিহা। সম্বোধন নতুন হলেও চিনতে বেগ পেতে হলো না তাকে। মিতুল লোকমুখে শোনা বর্ণনা দিতে ব্যস্ত। মালিহার মনে পড়ে গেলো ইতমিনানের অপলক দৃষ্টিগলো। ওয়েটিং রুমে, সিঁড়িঘরে কাঁচের আড়াল থেকে সদর দরজায়, হাসপাতালে। নিজেকে কষে ধমক দিল মালিহা। নীতিটার কথার জন্যেই মনের মধ্যে ওসব এসেছে। নয়তো ইতমিনান কি কখনও তাকে কিছু বলেছে?

পুকুর পাড়ে নামলো মালিহা। বাকিটা হেঁটে গেলো মিতুলের সাথে গল্প করতে করতে। বেলুন হাওয়ায় ওড়ানোর এক ফাঁকে দৃষ্টি গেলো মকবুল আলীর বাড়িতে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে ইতমিনান। তার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা মালিহার অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিলো যেনো। তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে ফেললো সে। মালিহা বুঝতে পেরেছে কাপড়ের পর্দা হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে, তার ক্ষমতা নেই দৃষ্টির তীক্ষ্মতার আঘাত থেকে অন্তরকে রক্ষা করার। সেজন্য নেত্র পল্লব আছে। ছোট্ট ঐ পর্দা দিয়ে চোখদুটো ঢেকে দিলেই মনকে বাঁচানোর প্রাথমিক কাজটা সহজ হয়ে যায়। মালিহা তাই করবে। পরিণত বয়সে অযৌক্তিক ছেলেমানুষী করার কোনো মানেই হয় না।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৫

আয়েশা চুলে তেল দিচ্ছিলেন। ছেলের দিকে সরু চোখে তাকালেন। টেবিলে কি যেনো ঘাটাঘাটি করছে। আজকাল ছেলেকে খুব চোখে চোখে রাখা শুরু করেছেন তিনি। মাথা বিগড়ে গেছে। জীবনটা বিগড়ানোর আগে লাগাম টানতে হবে। এতদিন মিলির কথায় বিরক্ত হলেও আজ যখন তার কথা সত্যি হতে দেখলেন তখন মনে মনে মিলির দৃষ্টির প্রশংসা না করে পারলেন না। তিনি মা হয়ে যেটা বুঝতে পারেননি সেটা মিলি বুঝে ফেলেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আয়েশা। ছেলেকে চিনতে কি বেশি ভুল হয়ে গেলো?

রাবেয়া চলে গেছে নিজের বাড়িতে। তাকে বারবার বলে দেয়া হয়েছে বিষয়টা পাঁচকান না করতে। তিনিও আশ্বস্ত করেছেন আয়েশাকে। আড়ালে ইতমিনানকেও। রাবেয়া বেশ অনেকক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেছেন। ইতমিনান মালিহাকে পাশাপাশি খারাপ লাগে না। বেশ মানায়। ছেলে তো রাজি। কিন্তু মেয়েটা রাজি না হলে তো বেচারারা মায়ের সাথে এই দ্ব’ন্দ্ব সং’ঘা’ত বিফলে যাবে। রাবেয়া ভেবে রেখেছেন মালিহার মনের খবর টেনে বের করবেন। আশা করা যায় খুব একটা কঠিন হবে না।

আয়েশা বারবার করে ইতমিনানকে বললেন মিলির সাথে দেখা করতে যেতে। ইতমিনান হু হা করলো। সেদিনই রাবেয়া ফোন দিয়ে ইতমিনানকে তার বাড়িতে দাওয়াত করলেন। ফুপুর দাওয়াত, না করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু মালিহা, মিতুলকেও বলা হয়েছে শুনে আয়েশার মাথা গরম হয়ে উঠলো।
“রাবেয়া! তুমি কি প্যাঁচ বাঁধাতে চাইছো বলো তো?”
“কি বললেন ভাবি? আমাকে আপনার প্যাঁচ বাঁধানো ননদ মনে হয়?”
“তাহলে মালিহাকে দাওয়াত করেছো কেনো?”
“ইতু যেমন আমার ভাতিজা ওরাও তো এমনই। তাছাড়া মালিহাকে একা করিনি তো। মিতুলকেও করেছি।”
“যা ইচ্ছা করো। কিন্তু আমার ছেলের গলায় মালিহাকে ঝোলানোর চিন্তা করবে না বলে দিলাম।”
“আপনার ছেলেই মালিহাকে গলায় নেয়ার জন্য লাফাচ্ছে। আমি কি করলাম?” বিড়বিড় করে বললেন রাবেয়া। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। ছেলে বলে কিছু করো, মা বলে খবরদার কিছু করবে না। আর ওদিকে আরেকজন মনের কোনো খোঁজ নেই। কি একটা হযবরল অবস্থা!

বইখাতা নিয়ে বসে আছে মালিহা। তবে পড়াশোনার প ও হচ্ছে না। বাড়ি এলে এই এক অবস্থা হয়। ব্যাগ ভর্তি বই আনা হয়। তারপর সেভাবেই ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। মাঝের ছুটিতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। তবে মালিহা মনে মনে রুটিন করেছে। এবার পড়তেই হবে। ইয়ার ফাইনাল বলে কথা। যেনো তেনো বিষয় তো নয়।
সেই বিকেলের সময় কোত্থেকে মিতুল ছুটতে ছুটতে এলো।
“এই আপা!”
“কি হয়েছে? ছুটে এলি কেনো?”
“এমনি। কিছু হয়নি। তুই রেডি হ।”
“কোথায় যাব?” মালিহার ভুরু কুঁচকে এলো।
“বাজারে। চল।”
“আমি বাজারে যাবো কেনো?”
“এতো কথা বলিস কেনো? কাজ আছে। চল চল! এক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে এসেছি। দেরি করলে হবে না। ওঠ না রে!”
মালিহাকে ঠেলেঠুলে পাঠালো মিতুল। সে রেডি হতেই সাইকেলে করে নিয়ে গেলো বাজারে।
চারদিকে হরেক রকম দোকান। জামা, জুতা, প্রসাধনীসহ নানান রকম দোকানের মাঝে এনে সাইকেল থামলো মিতুল। মালিহা নামলে লাজুক কণ্ঠে বলল, “আপা এক হাজার টাকা বাজেটের ভেতর তোর যা ইচ্ছা নে।”
সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ালো মালিহা। চারদিকে তাকিয়ে বলল, “এক হাজার টাকা কি লটারি পেয়েছিস?”
“না। আমার প্রথম মাসের বেতন। ওখান থেকে এক হাজার টাকা তোর জন্য রেখে দিয়েছিলাম।”
শীতল দৃষ্টিতে মিতুলের দিকে তাকালো মালিহা। ছেলেটা চুল কেটেছে। একদম কদম ছাট। উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটা রোদের যত্নে লালাভ রঙ ধারণ করেছে। ধীর গতিতে ডান হাতটা ভাইয়ের মাথায় রাখলো মালিহা। আজ নিজেকে সত্যিই তার ছোট বোন মনে হচ্ছে।
কয়েক দোকান ঘুরে টুরে একটা পার্স কিনলো মালিহা। কালো কাপড়ের উপর লাল সীতার হাতের কাজ। হালকা ডিজাইনের মাঝে চমৎকার। তার খুশি দেখে মিতুল বলল, “আপা যখন আমার আরো টাকা হবে তখন এই ব্যাগ তোকে দশটা কিনে দেবো।” মালিহা হাসলো। প্রশ্রয়ের হাসি।
পার্সের পেছনে এক হাজার টাকা শেষ হলো না। মালিহা বলল, “মা’র জন্য কি নিয়েছিস?”
“কিছু না।”
“মা’র ঘরে পড়ার পন্সটা দেখলাম নষ্ট হয়ে গেছে। চল একজোড়া জুতা কিনি।”
নাজিয়ার জন্য জুতা কিন রাশেদার জন্য গোটা দশেক পান নিলো মিতুল।
“দাদি আমাকে খুব ভরসা করে আপা। নাহলে আমি চাইতেই টাকা দিয়ে দিতো? এই ভরসার মর্যাদা আমাকে রাখতেই হবে।”
বাড়ি যাওয়ার পথে রাশেদার সাথে দেখা করতে গেলো মালিহা। সদর দরজায় ইতমিনানের মুখোমুখি হলো। মুখ নিচু করে চলে যেতে চাইলেও পারলো না। ইতমিনান বাঁধা দিল।
“কি রে! চোরের মতো করে কোথায় চলে যাচ্ছিস? আমি কথা বলছি শুনতে পারছিস না?”
এক পলক ভাইয়ের দিকে তাকালো মালিহা। মিতুল গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
“ভালো আছি।”
“আদব লেহাজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি যে বয়সে বড়, আমাকেও তো শুনবি নাকি?”
“তুমি কেমন আছো?”
“যা ভেতরে ঢোক। আমার থাকা না থাকা দিয়ে আর কিছু চিন্তা করা লাগবে না।”
ইতমিনানের অসন্তোষ কণ্ঠে লজ্জিত হলো মালিহা। নিজের মনের ভেতর কি হয়েছে তাতে আরেকজনের সাথে লুকোচুরি করলে চলবে কেনো? এতে তো বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটবে। ইতমিনানের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। দুইদিন পর বিয়েও হয়ে যাবে। কাজেই এই লুকোচুরি করা বোকামি।
নিজেকে হাজার রকম বুঝ দিলো মালিহা। শেষতক স্বাভাবিক ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলো।
দাদির কাছে পানের প্যাকেট তুলে দিতেই তিনি বেজায় খুশি হলেন। মিতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “বড় হয়ে গেছিস দেখি ভাই! ইতু জীবনে এক প্যাকেট পান এনে দিলো না। আল্লাহ তোরে হেদায়াত দিক।”
“দাদি আমাদের বাসায় চলো।”
মালিহার দিকে ঘুরলেন রাশেদা, “যাবো রে। আজকেই যেতে চাইছিলাম। হঠাৎ পায়ের শিরায় টান পড়ল। এই দেখ, ডান পা নড়াতেই পারছি না। আল্লাহ ভালো করলে কালকে যাবো ইনশাআল্লাহ্।”

মালিহা মিতুল চলে গেলো। তবে এর মাঝে আয়েশা একবারের জন্যেও ঘর ছেড়ে বের হলেন না। মালিহা ভাবলো বোধহয় ঘুমাচ্ছে। রাশেদা মনে মনে কষ্ট পেলেন। ছেলেমেয়ে দুটো খালি মুখে চলে গেলো। তিনি একটু আগেই দেখেছেন আয়েশা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। এর মাঝেই ঘুমিয়ে গেলো? ভাবনার মোড় ঘোরাতে চাইলেন রাশেদা। জীবনের এই পর্যায়ে অনেক কিছু অদেখা করে চলতে হয়।
মিতুল বাড়ির দিকে না যেয়ে দোকানে ফিরে গেলো। এক ঘণ্টার একটু বেশি হয়ে গেছে। বকা না শুনলেই হয়েছে।
তারা দুজন বের হতেই দাদির কাছে ছুটলো ইতমিনান। আয়েশা মাত্রই কোথায় বেরিয়ে গেলেন। অথচ এতক্ষন ঘরের দুয়ার দিয়ে ছিলেন। এই সুযোগে যদি কিছু করা যায়।
“দাদি আসি?”
“আয় আয়।”
“মিতুল দেখি পান কিনে তোমারে হাত করে ফেলছে।”
রাশেদা হেসে বললেন, “মিতুলটা বড় হয়ে গেছে বুঝলি।”
“আর মালিহা?”
“মালিহা তো বড় হইছেই। বিয়ের সময় হয়ে গেলো। কোন বাড়ি যে যায়!” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রাশেদা। ইতমিনান সন্তর্পনে রাশেদার পাশে বসে বললেন, “আচ্ছা দাদি ছেলে হিসেবে আমি কেমন? আমার মন রাখার জন্য বলতে হবে না। সত্যি কথা বলো তুমি।”
রাশেদা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “চলনসই।”
ইতমিনানের মনটা টুকরো হয়ে গেলো। দাদি একটা মানুষ বটে! কোথায় আহ্লাদ করে বলবে তোর মতো ছেলেই হয় না! বলে কি না চলনসই! গুছিয়ে রাখা কথাগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো ইতমিনানের। ধীর কণ্ঠে বলল, “মালিহাকে তোমরা কেমন ছেলের সাথে বিয়ে দিবা? চলনসই ছেলে হলে হবে না?”। রাশেদা সতর্ক চোখে তাকালেন, “কি বলিস খোলাসা করে বল।”
এই পর্যায়ে দাদির হাত ধরলো ইতমিনান, “দাদি! মা’কে একটু বোঝাও না!”
কথার মানে বুঝতে পেরে রাশেদার চোখ কপালে উঠলো, “এই কি খেলনা ভাই? চাইলাম আর পেয়ে গেলাম।”
ইতমিনান কথা বলল না। করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দাদির দিকে। রাশেদা দম ছেড়ে বললেন, “নিজেই নিজের উপরে বোঝা নিয়েছিস। মালিহা কি বলে?”
“জানিনা।” রাশেদা বুঝলেন, সবটা একপাক্ষিক।
“মন সামলাতে হয় ভাই। মনের বাঁধন একবার ছুটে গেলে তারে আর আটকানো যায় না। মন বাঁধার জন্যে প্রথমেই চোখ নামাতে হয়। দেখ, তুই পু’ড়ছিস। কিন্তু যার জন্যে পু’ড়ছিস তার কোনো বিকার নাই। সে এসব পছন্দ করবে কি না তাও জানিস না।”
ইতমিনানের ছোট্ট বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গেলো, “মালিহা আমাকে পছন্দ করবে না?”
“আমরা তো জানিনা করবে কি না।”
“একটা চেষ্টা করে দেখা যায় না দাদি?”
“ধর মালিহা মানলো। কিন্তু তাও তো তোরা শান্তিতে থাকতে পারবি না। নাজিয়া তোরে পছন্দ করে। সে মানলেও আয়েশা মানবে না। বিয়ের পরে মা বউকে কে অপরের শত্রু হিসেবে দেখতে পারবি?”
ডানে বায়ে মাথা নাড়ল ইতমিনান।
“তাহলে আগে এর প্রতিকার কর।”

মিতুল ছুটি নিতে পারেনি। দুপুরে খাবার সময়টুকু শুধু ফুপুর বাড়িতে থাকতে পারবে বলে জানিয়েছে। বোনকে বলেছে আগেভাগে চলে যেতে। রাশেদা আসায় নাজিয়া আর একা রইলেন না। স্ফূর্ত চিত্তে বের হয়ে গেলো মালিহা। তবে বড় চাচার বাসার সামনে আসতেই ইতমিনান কোত্থেকে এসে পাশ ধরলো।
“তুই কি ফুপুর একমাত্র ভাতিজি? আর দুনিয়ায় কেউ নাই? সৌজন্য রক্ষা করার জন্যেও তো একটু বলতে পারিস।”
মালিহার মাথা থেকে ইতমিনানের কথা একেবারেই বেরিয়ে গিয়েছিল। তার মনেই হয়নি যাওয়ার বেলায় ইতমিনানের খোঁজ নিতে হবে।
“সরি।” মিনমিন করে বলল মালিহা।
দম ছাড়লো ইতমিনান। সরি দিয়েই সব ঠিক করা গেলে সকাল, দুপুর, বিকাল সে আয়েশার কাছে সরি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো। কিন্তু আয়েশা তো মনে বজ্র আঁটুনি গেথেছে। ছেলেকে অবিবাহিত রাখবে তবু নাজিয়ার মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে না। সে মালিহা হোক আর যেই হোক না কেনো।
“তোর পরীক্ষা কবে থেকে?”
“ছুটির দুইদিন পর থেকেই।”
“ওহ। টিউশনি কেমন যাচ্ছে?”
“আর টিউশনি! আমার কপালে ঐসব নাই। বিকালে যেখানে পড়াতাম ওরা না করে দিয়েছে।”
ইতমিনানের কপালে ভাঁজ পড়ল, “কেনো? পড়াতে পারিস না?”
রুষ্ট হলো মালিহা। ইতমিনানকে পুরো ঘটনা বলল। ইতমিনান বলল, “টিউশনি করতে হয় চোখ কান বন্ধ করে। ছাত্রীর মুখের দিকেও তাকানো যাবে না। চোখ থাকতে হবে শুধু তার বই আর খাতায়।”
“মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে ভাইয়া। ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওর মা বুঝতেই পারছে না।”
ইতমিনান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পৃথিবীতে মানুষ আসে হাজার রকম সীমাবদ্ধতা নিয়ে। আর মানুষের আকাঙ্ক্ষা সব সীমাবদ্ধতার শিকল ছিন্ন করার।

রাবেয়া ছুটোছুটি করে রান্না করছেন। মালিহা এক কোনায় বসে আছে। রাবেয়া বললেন, “বোরখা খুলে আয় মালিহা। এই রান্না ঘরে বোরখা পরে থাকলে একটু পরই ঘেমে গোসল হয়ে যাবি।”
মালিহা বোরখা খুলে এসে ফুপুর পাশে বসলো। রাবেয়া ভালো করে একবার মেয়েটাকে দেখলেন।
“এই মালিহা!”
“হু!” মালিহা মেঝেতে আঁকিবুঁকি করতে ব্যস্ত।
“তোর কি কাউকে পছন্দ হয়? তেমন কেউ আছে?”
মালিহা চোখ তুলে সবিস্ময়ে ফুপুর দিকে তাকিয়ে রইলো।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৬

“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? কথা বল।”
মালিহার পেছনে দরজার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালেন রাবেয়া। ইতমিনান উঁকি দিচ্ছে।
“কেমন পছন্দ?”
“বিয়ে করার মতো পছন্দ।” নির্বিকারে বলে পেঁয়াজ ছোলায় মনোযোগ দিলেন রাবেয়া।
“তুমি আবার এসব নিয়ে পড়লে কেনো?”
“যা জিজ্ঞেস করি তাই বল। এতো কথা বলিস কেনো!”
“না কোনো পছন্দ নেই।”
“আসলেই নেই?” সন্দেহী চোখে তাকালেন রাবেয়া।
মালিহা মাথা নাড়ল, “না।”
দরজার পাশে একটা ছোট প্লাস্টিকের বালতি ছিলো। উঁকিঝুঁকি দিতে যেয়ে কখন সেটার পাশে চলে গেছে ইতমিনান খেয়াল করেনি। মালিহা যখন বলল আসলেই তার পছন্দ কেউ নেই তখন ইতমিনানের পায়ে লেগে বালতিটা পড়ে গেলো। শব্দে মালিহা ঘুরে তাকালে সাথে সাথেই দেয়ালের সাথে সেটে দাঁড়ালো ইতমিনান। রাবেয়া বেজায় বিরক্ত হলেন। মালিহাকে বললেন, “এদিকে ঘোর। যতো দুনিয়ার অশান্তি রান্নাঘরের দরজায় এসে ঘোরে।” মালিহা ভাবলো ফুপু বিড়ালকে বকছে। ইতমিনানের মুখটা ছোট হয়ে এলো। ভাঙলো মন, পড়ল বালতি, বকা দিলো ফুপু। এই নাহলে কানেশন!
রাবেয়া উঠে দাঁড়ালেন। বেরেস্তার জন্য কাটা পেঁয়াজ গরম তেলে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “তা কেমন ছেলে বিয়ে করবি?”
“কেনো? তোমার ছেলেকে!” মুখ টিপে বলল মালিহা। তোমার ছেলে বলে সবার আগে ইতমিনানের কথাই রাবেয়ার মনে হলো। তৎক্ষণাৎ ঘুরে তিনি বললেন, “কি বললি!”
“আমাকে তুমি তোমার পুত্রবধূ করবে না?”
রাফির কথা বুঝতে পেরে রাবেয়া বললেন, “ঢং করো! আমার কচি ছেলের জন্য কচি বউ আনবো। তুই তো বুড়ি হয়ে গেছিস।”
“আমি বুড়ো হলে তুমি হয়েছো এক্সপায়ার্ড। ফুপা নিতান্তই ভালো মানুষ বলে তোমাকে রেখে দিয়েছে।”
কটমট করে তাকালেন রাবেয়া। কিন্তু টপিক থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে বললেন, “ইয়ার্কি করিস না তো। বল কেমন চাইলে বিয়ে করবি?”
“মনে তো হচ্ছে তুমি আটঘাট বেঁধেই নেমেছো। অবশ্যই ভালো ছেলে বিয়ে করব। সবদিক দেখে যাকে ভালো বলা যায়। পারফেক্ট টাইপ না। চলনসই হলেই হবে। তোমার স্টকে কেমন ছেলে আছে বলো।”
চলনসই কথাটা শুনে ইতমিনানের বুকটা ধুক করে উঠলো। দাদি বলেছিল সে চলনসই। তখন কি কষ্টটাই না লেগেছিল! আহা! এখন এতো সুখ সুখ লাগছে কেনো? সেই ক্ষণে নিজের ফোনের রিংটোন শুনতে পেয়ে ঘরের দিকে ছুটলো ইতমিনান। রাফিকে ফোন দিয়ে বসিয়ে এসেছে। নয়তো এতো আরাম করে সব শুনতে পেত?
মালিহার কথাবার্তা মন দিয়ে শুনলেন রাবেয়া। তার মুখে অস্বস্তির কোনো ছাপ নেই। চাপা দেয়া কষ্ট নেই। কাজেই ধরে নেয়া যায় ইতমিনানে প্রতি আলাদা কোনো অনুভূতিও তার নেই।
“আমি কি ছেলে নিয়ে ব্যবসা করি যে সবসময় দু চারটা স্টকে থাকবে? আশ্চর্য কথাবার্তা!”
মালিহা হাসলো, “ফুপু এখনই আমার বিয়ের জন্য এতো তোড়জোড় করতে হবে না।”
“কেনো?”
“এই অবস্থায় কি আমার বিয়ের কথা চিন্তা করা ঠিক?”
“কি অবস্থা? বাপ ম’রলে মেয়েরা বিয়ে শাদি কিছু করে না নাকি?”
“না সেটা না। কিন্তু মিতুলটা ছোট। আবার মা কেমন যেনো হয়ে গেছে। দিন দুনিয়ার কোনো খোঁজ নেই।”
“তুই বিয়ে না করলে সব ঠিক হয়ে যাবে? আর এমনিতেও থাকিস তো সারাবছর আরেক দেশে। বিয়ের মতোই। তাহলে আবার?”
“বিয়ে হলে তো আরেক পরিবারে চল যেতে হবে। আমার মা ভাইকে দেখভাল করার বিষয়টা যদি তারা পছন্দ না করে?”
“তোর মা ভাইকে তুই দেখবি না তো কি পাড়ার মানুষ দেখবে? এমন বিষয়ে যাদের আপত্তি তাদের সাথে বিয়ে দেবই বা কেনো?”
এই পর্যায়ে মালিহা কিছু বলল না। তরকারি ঢেকে চুলার আঁচ কমিয়ে রাবেয়া নরম কণ্ঠে বললেন, “শোন মালিহা, সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। ছয় বছরের আগে প্রাইমারীতে ওয়ানে ভর্তি নেয় না। আবার দু চার বছর পর ঐ একই ওয়ানে ভর্তি হতে গেলে তখন আর সেই পড়া ভালো লাগে না। কারণ সময়। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটা করে ফেলতে হয়। তুই বড় হয়েছিস, বুঝতে শিখেছিস। যদি মনে করিস একটা পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার মতো মানসিকতা তোর তৈরি হয়েছে তাহলে আমি বলব আর দেরি করার কোনো মানে হয় না। একুশ বছরের কাজ আঠাশ বছরে করলেও চলে। কিন্তু একুশ বছরের আবেগ, অনুভূতি কোনোটাই তখন আর কাজ করে না। কেবল করার জন্যই করা।”
মালিহা মাথা নিচু করে বসেছিল। তার কিছুটা লজ্জা লজ্জা লাগছে। মেঝেতে আঁকিবুঁকি করতে শুরু করলো সে।
“মেঝেতে হাত লাগাস না। নোংরা হয়ে আছে।” মালিহা হাত উঠিয়ে ফেললো। ঝেড়ে কোলের উপর রেখে দিলো।
“তোর যেমন পছন্দ তেমন খোঁজ খবর করে নিবি। তাহলেই হলো। আমার হাতে ভালো একটা ছেলে আছে। কি বলিস?”
মুখ নিচু করে মালিহা বলল, “মায়ের সাথে কথা বলো ফুপু।”
“তার নিজেরই খোঁজ নাই। আচ্ছা বলবো।”
রাবেয়া স্বস্তির শ্বাস নিলেন। অর্ধেক ঝামেলা মিটলো। ইতমিনানের কথা শুনে কি বলে কে জানে। আগে ভাগেই জানানোর কোনো মানে নেই। আগে ছেলেটা মা’কে রাজি করাক।

দুপুরে মিতুল এলো চিপস, চকলেট নিয়ে। ইতমিনানের সাথে চোখাচোখি হলেও কথা বলল না। রাবেয়া খেয়াল করে বললেন, “কি রে! তুই ইতুর সাথে কথা বলছিস না কেনো?”
“কিছু বলার নেই।”
“বড় ভাইকে তো মানুষ সৌজন্য করেও দুটো কথা বলে।”
“কথা না বলে যে বছরের পর বছর পার করে দিতে পারে তার জন্য আমার কোনো সৌজন্যবোধ আসে না।”
ইতমিনান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। খানিকটা হাসলো। বড় ভাই বলতে মিতুল তাকেই চেনে। সেই ভাইয়ের হঠাৎ দূরত্ব সে মেনে নিতে পারেনি। বুকে অভিমানের পাহাড় জমেছে। ইতমিনান মায়ের আদেশ ডিঙিয়ে চাচার বাড়ির সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে চাচার সাথে অন্তরালের যোগাযোগটুকু সে কখনো ছিন্ন করেনি। সেটুকু তো কেউ জানেনা।
মিতুলের রাগ জায়েজ। প্রতিবাদ করে না ইতমিনান। ভাবে একবার তার কাছে ক্ষমা চাইবে। মিতুল বুঝদার ছিল। তার বয়সে এমন শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারতো না ইতমিনান। তাকে বোধহয় খানিকটা মেরুদন্ডহীন ভাবে মিতুল। মালিহাও কি?
ভাবনাটা তাকে শান্তিতে খেতে দিলো না। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকলো। হঠাৎ মালিহা বলল, “তোমার জন্য নাকি মেয়ে দেখাদেখি চলছে? তা ঘটনা কি বিয়ে পর্যন্ত গড়ালে বলবে? কি ফুপু তুমিও তো কিছু বললে না।”
রাবেয়া ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন। মিলি, ইতমিনান, মকবুল আলী যার ওপর যতটুকু রাগ ছিল সবটা প্রকাশ করে দিলেন। মিতুল বলল, “এখন তো তাও চেহারা দেখা যায় তখন দেখবি একটা চুলও আর দেখা যাচ্ছে না। দেখে নে দেখে নে! বংশের বড় ভাইকে দেখে নে।”
ফেরার পথে মিতুল দোকানে চলে গেলো। বাড়ি পৌঁছে ইতমিনান রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলো মিতুলের জন্য। তার বারান্দার পাশ দিয়ে যখন সে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল তখন ডাকলো ইতমিনান। মিতুল থামলো। কথা বলল না। দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে।
“আমার উপর তোর অনেক রাগ তাই না মিতুল?” গ্রিলের এপাশ থেকে প্রশ্ন করলো ইতমিনান।
“হওয়াটা কি ভুল?” আরেকদিকে তাকালো মিতুল।
“না। অবশ্যই না। আমি যদি তোর কাছে ক্ষমা চাই তুই কি আমাকে ফিরিয়ে দিবি?”
“তুমি ক্ষমা চাইলেই বা কি? আমি কি আমার গত পাঁচটা বছরের ইতু ভাইকে ফেরত পাবো?” মিতুল দাঁড়ালো না। সাইকেলের বেল বাজাতে বাজাতে চলে গেলো। ইতমিনান দাঁড়িয়ে রইলো গ্রিলের এপাশে। গ্রিল ডিঙিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা যে তার নেই।

আয়েশার ছটফটানি ইতমিনানের চোখ পড়েছে। ছুটির শেষ দিকে এক সন্ধ্যায় মায়ের পাশে বসলো সে। আয়েশার হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, “তুমি কি আমার উপরে রেগে আছো মা?”
আয়েশা হাত সরিয়ে নিলেন। ইতমিনান ক্লান্তির শ্বাস ছাড়লো।
“ছুটি শেষ হয়ে আসছে। আমি কি তোমার রাগ নিয়ে ফেরত যাবো?”
“আমার রাগের কোনো দাম আছে তোর কাছে?”
“অবশ্যই আছে।”
“তাহলে মালিহার বিষয়টা ভুলে যা।” একগুঁয়ে কণ্ঠে বললেন আয়েশা। ইতমিনানের স্বর আহত শোনালো, “মনের ওপর কি জোর চলে মা?”
“আমি কি তোর খারাপ চাই?”
“ভালোটা আমার সাথেই কেনো চাও না?”
“বুঝেছি। বড় হয়ে গেছিস। যা ভালো বুঝিস কর।”
ইতমিনান বসে রইলো ঘাড় নিচু করে। ভারী শ্বাসগুলো বুকের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকটাও ভারী হয়ে উঠেছে। চোখ ভিজে আসতে চাইলো ইতমিনানের। মিতুল তার ওপর রেগে আছে, মা তার ওপর রেগে আছে। অথচ সে সবার রাগ থেকে সবসময় দূরে থাকতে চেয়েছে। রুদ্ধ কণ্ঠে ইতমিনান বলল, “আল্লাহ বলেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। আমি সেই পা সারাজীবন যত্ন করতে প্রস্তুত। কিন্তু সন্তানের কিছুতে বোধহয় মায়েদের বেহেশত নেই। নাহলে তুমি এতো কঠোর হতে পারতে না। বলো মা?”
কথা শেষ করে চলে গেলো ইতমিনান। এমনিতেই সে সবার রাগ না চাইতেই পেয়ে গেছে। এবার চোখের জল দেখিয়ে করুণা পেতে চায় না।
আয়েশা ছেলের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মালিহার সাথে জীবনে যে সে সুখী থাকতে পারবে না এই সহজ সমীকরণটা কেনো বুঝতে চাইছে না ইতমিনান?

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে