উষ্ণতা পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
23

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৮

তিন ঢোকে বোতল খালি করে ফেললো ইতমিনান। ছুড়ে দিলো রাস্তার একপাশে পড়ে থাকা ভগ্নপ্রায় ডাস্টবিনে। মানিককে বলল, “একটা স্কুলে ভর্তি হও মানিক।”
“কি করতে?”
“পড়াশোনা শিখবা।”
“দরকার নাই। পড়াশোনা শিখলে মানুষ নিজেরে নিয়া অহংকার করে।”
“সবাই করে না। আমিও কিন্তু পড়াশোনা করেছি। তোমার কি আমাকে অহংকারী মনে হয়?”
এই যাত্রায় মানিক চুপ করে গেলো। ঘাড় চুলকে বলল, “পড়াশোনা তো ম্যালা কঠিন।”
“সব কাজই কম বেশি কঠিন। সারা দিন রোদে ঘুরে ভাঙা বোতল, প্লাস্টিক খোঁজা কঠিন, সামান্য একটা সাইনবোর্ডের কাগজকে সম্বল করে রাত কাটানোও কঠিন। অনেকের জন্য এক ঘুমে রাত কাবার করাও কঠিন। পৃথিবী দেখতে সহজ, টিকে থাকতে কঠিন।”
এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল ইতমিনান। মানিক চোখ বড় করে বলল, “আপনে দেখি জ্ঞানও দিতে পারেন।”
“কেনো আমাকে কি তোমার অজ্ঞ মূর্খ মনে হয়?”
“পাগল মনে হয়। কুত্তার নাম ঠিক করতে যেই ব্যাডা মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারে তারে আমার আস্তা পাগল মনে হয়।”
“প্রেস্টিজ তো আর রাখলে না মানিক। এমনিতেই বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। তুমি এসব কথা বললে তো নিজের উপর আর কনফিডেন্সও থাকবে না।” কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল ইতমিনান।
“আমার কারবার সব পাগল মাইনষের সাথেই হওন লাগে। হোটেলে পাইসি এক মিন্টু।”
“কেনো মিন্টু কি করেছে?”
“এতো কিসু আপনের জানা লাগবো না।”
মাগরিবের আযান দিতে শুরু করেছে। হঠাৎ কি মনে করে ইতমিনান বলল, “মানিক চলো মসজিদে যাই।”
ভুরু কুঁচকে মানিক বলল, “কি করতে?”
“নামাজ পড়তে। আবার কি করতে?”
“আমারে সহি সালামতে দ্যাখলে আপনের ভাল্লাগে না? আবার ‘মাইর খাইতে আমি যাই আর কি।”
“দেখি আজকে কে মা’রে। চলো!”
মানিকের হাত টেনে নিয়ে গেলো ইতমিনান। লালপাহাড় মসজিদের বাইরে জুতোর সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। ওজুখানায় মানিককে দেখে অনেকে আড়চোখে তাকালো। উদাম গা। রোদ পড়া রুগ্ন দেহের ভেতরে আবদ্ধ বুকের খাঁচা স্পষ্ট। চোখেমুখে রুক্ষতা। চুল এলোমেলো। পরনে ময়লা প্যান্ট। হাঁটুর বেশ খানেক নিচে তার অবস্থান। এদিক ওদিক অগুণিত ছেড়া।
মুসল্লিরা একে একে কাতারে দাঁড়াচ্ছে। মানিককে পাশে নিয়ে দাঁড়ালো ইতমিনান। অনেকে এসে ইতস্তত করছে। এমন ছেলের পাশে দাঁড়ালে গায়ে ময়লা লেগে যাবে। চকচকে পাঞ্জাবিতে ময়লার দাগ কে-ই বা চায়। তবে তার পাশ ঘেষে দাঁড়ানো শার্ট প্যান্ট পরিহিত যুবকের দিকে তাকিয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস করছে না। ছেলেটার ঘূর্ণায়মান চোখ দুটোই বলে দিচ্ছে সে যে ছেলেটার অভিভাবক। হঠাৎ বছর চারের এক বাচ্চা ছেলে এসে মানিকের পাশে দাঁড়ালো। মুখ ঘুরিয়ে মানিককে দেখে চওড়া একটা হাসি দিলো। তবে সেটা স্থায়ী হলো না। সম্ভবত সম্পর্কে ছেলেটার দাদা লোকটি তাকে বকতে বকতে সরিয়ে নিলেন।
“আগে আগে দৌড়ে গেছো কেনো? আমার সাথে দাঁড়াতে বলেছে না তোমার মা? যার তার সাথে দাঁড়ালেই হলো?”
মানিক অবশ্য কষ্ট পেলো না। এসব শুনতে শুনতে এখন আর গায়ে লাগে না। তবে ইতমিনান লোকটাকে দেখলো। শুভ্র দাঁড়ি মুখে। মাথায় টুপি। বাহ্যিক আবরণে মুসলমান বুঝতে ভুল হয় না। কিন্তু ভেতরটা?
ইকামতের পর সকলে নামাজ শুরু করলো। মানিকের পাশটা খালি পড়ে রইলো। অথচ পেছনের কাতার ভরপুর।
ফরজ নামাজ শেষে ইমাম সাহেব বললেন, “সুন্নত পড়ে আপনারা চলে যাবেন না। খুব বেশি তাড়া না থাকলে একটু দাঁড়াবেন। পাঁচটা মিনিট আপনাদের থেকে নেবো।”
বয়সে বৃদ্ধ, মর্যাদায় অধিষ্ঠিত লোকটার কথা সবাই শুনলো। সুন্নত শেষে কাউকে বের হতে দেখা গেলো না। ইমাম সাহেব সান্ধ্য জিকির সংক্ষিপ্ত করে বললেন, “ইসলামের প্রাথমিক যুগের গল্প আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি। সেগুলো শুনে সেই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের বিস্ময় জন্ম নেয়। মনে হয়, আহা একবার যদি তাদের সাথে দেখা করতে পারতাম। রূপকথার চরিত্রের মতো মানুষগুলোকে কি শুধু তখনই আমাদের মনে পড়ে? অন্য সময় কি ভুলে যাই?”
কয়েকজন মাথা নাড়লেন। না তারা ভোলেন না।
“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনারা ভুলে যান। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক দরিদ্র সাহাবী ছিলেন। সেই দরিদ্রের নমুনা জানেন? অনেকের নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত, এই লজ্জাস্থান ঢাকার এক টুকরো কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। নবীজী কি তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন? নাকি বলেছিলেন ওরকম পোশাক পড়ে মসজিদে যাওয়া নিষেধ অথবা তার মজলিশে? বলেননি। বরঞ্চ তাঁর আশপাশে এমন লোকের আধিক্য ছিলো। মক্কার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত বংশের, পৃথীবির শ্রেষ্ঠ মানুষটার চলাফেরা এঁদের সাথেই ছিলো। আমরা করা নিজেদের তাঁর অনুসারী দাবি করছি তাদের আশপাশে এমন লোকেরা ভিড়তে ভয় পায় কেনো? আপনারা ভাববেন। যতদিনই লাগুক না কেন ভাবনা শেষ হতে। ভাববেন। আপনাদের কাছে আমার আর্জি।”
ইমাম সাহেব কাউকে কটাক্ষ করলেন না। কোনো কটু বাক্য বললেন না। কিন্তু উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের দৃষ্টি গেলো মানিকের পাশের ফাঁকা কাতারের দিকে।
এক এক করে মানুষ বের হতে লাগলো। ইতমিনান দেখলো মানিক কখন যেনো ইমাম সাহেব কাছে চলে গেছে। কতক্ষন কথা বলল তারপর নিজেই ফিরে এলো।
“কি হয়েছে?”
“হুজুররে এট্টু টেশ করতে গেসিলাম। পাশ করছে।” নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল মানিক।
“কি টেস্ট?”
“বান্দায় বিরাট ভাষণ দিলো তাই দ্যাখতে গেলাম তার মনের ভিত্রে কি আছে। কইলাম আমারে আরবী শিখাইতে পারবেন? ট্যাকা পয়সা আমার নাই। দিতেও পারমু না।”
ইতমিনান আগ্রহ করে বলল, “কি বললেন?”
“খুশি খুশি রাজি হইসে। শালা নিজের ঘাড়ে নিজে বোঝা নিসি। বেশি বুঝলে যা হয়।” মানিক বিরক্ত হলো। সেই পড়াশোনাই তাকে এখন করতে হবে। তবে ইতমিনান উৎফুল্ল হয়ে ইমাম সাহেবের কাছে ছুটে গেলো। অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরে বলল, “ধন্যবাদ চাচা। অনেক ধন্যবাদ।” বলেই আবার মানিকের কাছে চলে এলো। ভদ্রলোক থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

মিতুল কলকল করে কথা বলছে। মালিহা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। কতদিন পর ভাইটাকে এমন খুশি হতে দেখছে! এক পর্যায়ে নাজিয়া ফোন নিলেন।
“মালিহা তোর চাচা বলছে ওদিকে না যেতে। বাড়ি চলে যেতে। তুই কি বলিস?”
“তুমি থাকতে পারবে মা?”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাজিয়া বললেন, “ওখানে গেলে তো আর তোর বাবাকে পাবো না। এখানেও পাবো না। একই বিষয়।”
মালিহা চুপ করে গেলো। এর বিপরীতে দেয়ার মতো কোনো স্বান্তনা তার জানা নেই।
“কালকে এগারো হাজার টাকা পাঠাবো মা। ইনশাআল্লাহ্।”
“টাকা নিয়ে সমস্যা হবে না মনে হয়। তোর চাচা আজকে মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে গেলো। ধান তোলার সময়ও এসেছে।”
“তাও রেখে দাও। যদি লাগে।”
“আচ্ছা। তোর ছুটি কবে?”
মালিহার বুকটা জুড়িয়ে গেলো। কতদিন পর মা এতো আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছে।
“আর দুইটা ক্লাস হবে। কিন্তু স্টুডেন্টদের তো এখুনি ছুটি দিতে পারব না। আর কয়েকটা দিন পড়াতে হবে।”
“বেশি ছুটোছুটি করিস না। আল্লাহ যেটুকু ভাগ্যে রেখেছেন তাই যথেষ্ট। রাখি।”
বহুদিন পর মালিহার বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেলো। মনে হলো নাজিয়ার মনটা যেনো একটু নরম হয়েছে। আশপাশ নিয়ে যেনো চিন্তা করতে শুরু করেছে। মালিহা কায়মনো বাক্যে রবের কাছে প্রার্থনা করল, তার মায়ের দুঃখের ভার যেনো রব কমিয়ে দেন।

মালিহা ঘুমাতে গেলো প্রশান্ত মন নিয়ে। শুতে যাওয়ার আগে আঁখির কাছে শুনলো তুষারের খবর। আঁখির ভাষ্যমতে সে ম’রতে ম’রতে বেঁচে ফিরেছে। হয়তো পথ পাল্টানোর একটা সুযোগ। কে জানে সে বুঝবে কি না..

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৯

বইয়ের উপর মাথা রেখে ঝিমুচ্ছিল মালিহা। ফোনের শব্দে ধড়ফড় করে উঠলো। নাজিফা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ফিসফিস করে বলল, “এই মালিহা! রুমে আছো?”
“আছি।”
“একটু আসলাম।”
দরজা খুলে ঢুকে পড়ল নাজিফা।
“তুমি কি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোন দিলে!”
“হু। একটা বিপদে পড়েছি। আজকে দুপুরের ক্লাসের শেষ একদম ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। কি যে করিয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। কয়েকজনের নোট দেখলাম কিন্তু সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। একটু হেল্প করবে?”
“অবশ্যই। দাঁড়িয়ে আছো কেনো বসো।”
টেবিল থেকে নোট খাতা টেনে নিলো মালিহা। খুঁজে খুঁজে আজকের লেকচার বের করলো।
“কোন জায়গাটা বোঝোনি?”
“শেষের দুইটা টপিক।”
“আচ্ছা। তোমার খাতাটা দাও। লিখে বোঝাই।” মাথা নেড়ে বলল মালিহা। তার চোখমুখ থেকে ঘুম উধাও। নাজিফা চটপট খাতা বাড়িয়ে দিলো। টানা বিশ মিনিটের মাথায় টপিক দুটো শেষ হলো। নাজিফা বলল, “আমি একটা সলভ করি। তুমি দেখো।”
“আচ্ছা করো।”
কয়েক জায়গায় ভুল করলো নাজিফা। মালিহা আবার বোঝাল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দশটা পার হয়েছে। নাজিফাকে বলল, “তুমি একটু ট্রাই করো। আমি নামাজটা পড়ে আসি।”
“এখনও পড়নি?”
“না।”
“দ্রুত যাও।”
ওড়না গায়ে জড়িয়ে দরজার কাছে গেলো মালিহা। কি মনে করে পেছন ঘুরল। মনিকা ঘুমাচ্ছে। একটু পর উঠে পড়তে শুরু করবে। আঁখি কানে হেডফোন দিয়ে বসে আছে। ধীর পায়ে আঁখির সামনে যেয়ে দাঁড়ালো মালিহা। আঁখি একবার দেখে হেডফোন সরিয়ে বলল, “কিছু বলবে?”
“জি আপু। আপনার নামাজ পড়া হয়ে গেছে?”
“না।” মাথা নাড়ল আঁখি।
“তাহলে চলুন একসাথে পড়ি।”
আঁখি কথায় কথায় রাগ করা ধরনের মেয়ে নয়। তাকে যেকোনো কথা ভয় ছাড়াই বলা যায়। কাজেই প্রথম বারের মতো কাজটা করতে মালিহার ভয় লাগলো না।
কিন্তু আঁখি বেশ অবাক হলো। কারণ প্রায় দুই বছরের এই দীর্ঘ সময়ে মালিহা কখনও এমন কথা বলেনি। কালে ভদ্রে সে নামাজে দাঁড়ায়। মালিহা নিয়মিতই পড়ে বলতে গেলে। কিন্তু কখনও তাকে ডাকেনি। তাই অবাক চোখেই মালিহার দিকে তাকিয়ে রইলো আঁখি। মালিহা ইতস্তত করে বলল, “কিছু মনে করলেন আপু?”
“না। তবে হঠাৎ বললে তাই একটু অবাক হয়েছি।”
“ওহ। পড়বেন না আপু?”
“তুমি পড় মালিহা।” শান্ত কণ্ঠে বলে হেডফোন দিয়ে কান ঢেকে দিলো আঁখি। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ল্যাপটপ স্ক্রিনে। মালিহা নড়লো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বললোও না। আঁখি নিজেই কিছুক্ষণ পর বলল, “কি হবে নামাজ পড়ে মালিহা? এলোমেলো জীবন গুছিয়ে যাবে? কতদিন তো পড়ে দেখেছি। কিছুই তো হলো না। নামাজ আমার মতো মানুষের জন্য না বুঝলে।” কি বোর্ডে খটখট করতে করতে বলল আঁখি। একবারও তাকালো না মালিহার দিকে। মালিহাকে বুঝি আঁখির দুঃখগুলো ছুঁয়ে গেলো। কিন্তু স্বান্তনা স্বরূপ কিছুই বলতে পারলো না সে। দাঁড়িয়ে রইলো আগের মতো করেই।
“আসসালামু আলাইকুম আপু!” নতুন কণ্ঠের দিকে তাকালো আঁখি। মেয়েটার মুখ চেনা তবে পরিচিত নয়।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
“আমি নাজিফা তাবাচ্ছুম। ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনমিক্স, সেকেন্ড ইয়ার।”
মাথা নাড়ল আঁখি, “কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। বেয়াদবি নেবেন না আপু। আপনার সাথে কি একটু কথা বলা যাবে?”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে হেডফোন খুলে রাখলো আঁখি। নাজিফা ইতস্তত করে বলল, “সরি আপু। আপনার কাজে বিরক্ত করলাম।”
“সমস্যা নেই। বসো। মালিহা বসো।”
নাজিফাকে কথা বলতে দেখেই মালিহার মনে হয়েছে সে কিছু একটা ভেবেছে। তার থাকার দরকার নেই। সে বলল, “আমি নামাজটা পড়ে আসি। আপনারা গল্প করুন।”
রুম থেকে বের হয়ে গেলো মালিহা। রুমে রয়ে গেলো তিনটি নিশ্চুপ প্রাণী।
কণ্ঠে যতোটা সম্ভব মায়া, বিনয় ঢেলে ধীর স্বরে নাজিফা বলল, “আপনার কি আল্লাহর প্রতি অনেক অভিযোগ আপু?”
আঁখি চুপ করে বসে ছিল। নাজিফার কথায় তার মুখের দিকে তাকালো। কাষ্ঠ হেসে বলল, “আমার কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। যার ভাগ্য খারাপ তার কোনো অভিযোগ থাকা না থাকা সমান।”
“ভাগ্য খারাপ হলে আপনি এখন হাসপতালের বিছানায় থাকতে পারতেন, অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া নিশ্বাস নিতে পারতেন না, কোমায়ও থাকতে পারতেন, আপনার বাবা মা’রা যেতে পরতো, মা প্যারালাইজড হতে পারতো। তেমন কি কিছু হয়েছে?
“তুলনা দিচ্ছো?”
“আপনি তুলনা করে ভাগ্যকে খারাপ বললেন। আমি তুলনা করেই দেখালাম সেটা এতটাও খারাপ নয়।”
আঁখি চুপ করে রইলো। তার মনের গভীরের কষ্টের কথা নাজিফা জানলো না। কিছু বললোও না। বসে রইলো এই আশায় আঁখি কিছু বলবে।
মনিকা পাশ ফিরলো। বিছানা থেকে মোটা একটা বই মেঝতে পড়ে গেলো। সেই শব্দে আঁখি বার কয়েক চোখের পলক ফেললো। নাজিফা হঠাৎ খেয়াল করলো আঁখির চোখদুটো দেখলেই তার মনের অবস্থা যেনো পরিষ্কার বোঝা যায়। টলটলে আঁখি জোড়ায় অভিমানের ঢেউ। না পাওয়ার বেদনা। কি গভীর দুঃখ!
“নামাজ পড়ে কি করবো? আল্লাহকে ডেকেই বা কি করবো? তিনি তো আমার ডাকে সাড়া দেন না।”
“এটা একটা কথা বললেন আপু! আল্লাহ সবসময় জেগে আছেন। তিনি সর্বত্তোম শ্রোতা। আপনি যেভাবে তাঁকে ডাকবেন তিনি সেভাবে আপনাকে স্মরণ করবেন। আপনি আল্লাহকে মনে মনে ডাকলে আল্লাহও আপনাকে মনে মনে স্মরণ করবেন। আপনি যদি মুখে বলে ডাকেন তিনিও আপনাকে সেভাবেই ডাকবেন। এক শাইখের লেকচারে একবার শুনেছিলাম, যখনই কোনো বান্দা আল্লাহকে ডাকে তখনই তিনি লাব্বাইক বলে সাড়া দেন। নেককার, নামাজী, রোজাদার কোনো ব্যক্তি একবার আল্লাহকে ডাকলে তিনিও একবার লাব্বাইক বলেন। কিন্তু কোনো গুনাহগার ব্যক্তি একবার ডাকলে আল্লাহ তিনবার বলেন। লাব্বাইক, লাব্বাইক, লাব্বাইক। কেনো এই পার্থক্য বলুন তো?”
আঁখি এক মনে শুনছিলো। নাজিফা বুঝলো না সে বিরক্ত হচ্ছে কি না। আঁখি বলল, “জানি না।”
“নেককার ব্যক্তির নিজের নেক আমলের উপর ভরসা থাকে যে হয়তো সেগুলোর উসিলায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু গুনাহগার ব্যক্তির সেই ভরসা নেই। আল্লাহর রহমত তার একমাত্র ভরসা। আল্লাহ বলেন আমি তাকে কিভাবে ফিরিয়ে দিই? আপনি ডাকতে চাইছেন না অথচ আল্লাহ আপনার ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
আঁখির নেত্রপল্লব কেঁপে উঠল। নাজিফা হেসে বলল, “আল্লাহ আমাদের সবচেয়ে নিকটে কখন থাকে জানেন? নামাজের সময়। সেসময় বান্দা এবং তার রবের মাঝে কোনো পর্দা থাকে না। বুঝতে পারছেন আপু? আল্লাহ আমাদের কণ্ঠনালীর চেয়েও বেশি কাছে থাকেন। একবার ভাবুন!”
আঁখি মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। নাজিফা কিছু বলল না। একবার দরজার দিকে তাকালো। মালিহা হারিয়ে গেলো নাকি!
“কিন্তু আল্লাহ তো আমার ডাকে সাড়া দেন না। আমাকে মনে হয় তিনি ভালোবাসেন না।”
মিষ্টি হেসে নাজিফা বলল, “ডাক্তার ওষুধ দেয়ার সময় বারবার বলে দেন ডোজ কমপ্লিট করতে। আমরা ধৈর্য ধরে সেটা করি। স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টের রেজাল্ট পেতে হলে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু এই বেলায়ই আমরা কেনো অধৈর্য্য হয়ে পড়ি? মায়ের চেয়ে এমনকি নিজের চেয়েও যিনি আমাদের বেশি ভালোবাসেন তিনি কি আমাদের ডাক শোনেন না? অবশ্যই শোনেন। তিনি আপনাকে ভালো না বাসলে আপনি এখন আল্লাহর সম্পর্কে শুনতেই পেতেন না আপু। এই যে আপনি শুনতে পারছেন অনেকে সেই সুযোগটুকুও পায় না। আমরা ভাবি আমরা নামাজ পড়ছি না আল্লাহ তো আমাদের কোনো শাস্তি দিচ্ছেন না। অথচ আমরা বুঝি না দিনে পাঁচবার তাঁর সাথে কথা বলার, সাক্ষাৎ করার সুযোগ আমরা পাচ্ছি না। তাঁকে একটা সিজদাহ আমরা দিতে পারছি না। এটা কি শাস্তি না?”
উঠে দাঁড়ালো নাজিফা। আঁখির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি ভাবুন আপু। মন দিয়ে ভাবুন। যে আপনার সবচেয়ে আপন তাঁর সাথে আপনার কেনো এই দূরত্ব। আসি। অনেক বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না।”
নাজিফা চলে গেলো। মালিহার খাতায় ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে রাখলো।
“তুমি তো লাপাত্তা হয়ে গেলে মালিহা। আমি টপিক বুঝেছি। এর বিনিময়ে তোমাকে ধন্যবাদ দেবো না। আল্লাহকে বলবো যেনো তিনি তোমাকে এর বেস্ট বিনিময় দান করেন। চলে গেলাম।”
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলো নাজিফা। আঁখি বসে রইলো। নড়চড়হিন অবস্থায়। সে অনুভব করছে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। জং ধরা হৃদয়ে টোকা লেগেছে। ঝরঝরিয়ে মরচে পড়ে যাচ্ছে। ঝাঁকি লাগছে মস্তিষ্কে। চোখে মুখে পানি দিতে গেলো আঁখি। অথচ সে বুঝলোই না কখন ওযু করে দাঁড়িয়ে পড়ল বাধ্য বান্দার মতো।

তিশাকে আজ দেখাচ্ছে প্রথম দিনের মতো। চুপচাপ। পাঁচটা কথা বললে একটা উত্তর দিচ্ছে। মালিহার কষ্ট হলো। মেয়েটা এমন মনম’রা হয়ে আছে কেনো।
“তিশা তোমার কি মনে খারাপ?”
“কথা বলো তিশা।”
“না মিস। মন খারাপ না।”
“তাহলে শরীর?”
“না।”
“তাহলে কি হয়েছে।”
বিষণ্ন কণ্ঠে তিশা বলল, “আমি ভালো মার্ক পাই না কেনো মিস? ভালো মার্ক না পেলে আম্মু আমাকে ভালবাসে না।”
“আম্মু তোমাকে সবসময় ভালোবাসে। কিন্তু বেশি মার্ক পেলে একটু খুশি হয়। এই যা।”
“না মিস। আপনি জানেন না তাই বলছেন। যেদিন কম মার্ক পাই আম্মু আমার সাথে কথা বলে না, আমাকে ভাত বেড়ে দেয় না। আমার দিকে তাকায়ও না। বেশি খারাপ করলে অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে। আমার খুব কষ্ট হয় মিস।” ফুপিয়ে উঠলো তিশা। মালিহার বুকটা ধুক করে উঠলো। এটুকু মেয়ে কতোটা কষ্ট বুকে চেপে আছে। তিশার মাথায় হাত দিয়ে এক হাতে তাক কাছে টেনে নিলো মালিহা।
“কেদো না তিশা। আমি তোমার আম্মুকে বলব যেনো এরকম না করেন। তিশা যে কতো সুন্দর পড়াশোনা পারে এটা তো তিনি জানেন না। কান্না থামাও তিশা।”
তিশা চোখ মুছলো। মালিহা বলল, “তোমার “গোল্ডেন বার্ড” গল্পটা পড়েছি। আমার তো মনে হচ্ছে তুমি কোনো বই থেকে কপি করেছো।”
“কপি করিনি মিস। একদিন আমি স্বপ্নে একটা সোনালী পাখি দেখেছিলাম। সেটাকে নিয়েই লিখেছি।”
উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে মালিহা বলল, “দারুন হয়েছে তিশা। এটা তো ম্যাগাজিনে দিলে প্রথমবারেই ছেপে দেবে।”
“আমার লেখা ছাপাবে?”
“ছাপাবে না কেনো? এতো সুন্দর লেখা যার ভালো লাগে না তার চোখ নষ্ট, মাথা নষ্ট।”
তিশা হেসে ফেললো, “লেখা পাঠায় কিভাবে মিস?”
“আমি পাঠিয়ে দেবো। কোনো চিন্তা নেই। তুমি শুধু মন ভালো করে থাকো। একটু হাসো তো।”
তিশা হাসলো। মালিহা চেয়ে দেখলো সেই মায়াবী মুখের হাসি।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মালিহা। দিনের দুই প্রান্তে দুটো বাচ্চা পড়ায় সে। একজন বাবা মায়ের আহ্লাদী কন্যা। অথচ তাদের প্রতি মেয়েটার কোনো টান নেই। মালিহা অবাক হয়ে দেখেছিল লামিয়ার দুই ঘণ্টার দীর্ঘ বকবকানির মাঝে কোথাও তার বাবা মা নেই। অথচ তারা মেয়ের মুখ থেকে ডাকটা শুনতেই মুখিয়ে থাকে। আর একজন এই তিশা। মেয়েটা শুধু মায়ের ভালোবাসা চায়। অথচ তিনি সংখ্যায় লেখা মেধার মানের আড়ালে নিজের ভালোবাসা চাপা দিয়ে বসে আছেন। পৃথিবী বড়ই বিচিত্রময়!

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪০

কাঁধের ওপর লাগানো ওড়নার সেফটিপিন আরেকবার দেখে নিলো রিপা। ডান হাতে ঘড়ি পড়ে চটপট চুল আঁচড়ে নিলো। লামিয়ার বাবা ডাকছে। কোনরকমে লাইট ফ্যান অফ করে ছুটলো ড্রয়িং রুমে। লামিয়া ওখানেই পড়ে।
মালিহার ধারণার চেয়েও লামিয়া একটু বেশি চটপটে। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ সব লিখতে পারে। কিন্তু সংখ্যার দিক দিয়ে একটু পিছিয়ে আছে। মালিহা বলল, “লামি দশ থেকে বলতে শুরু করো।”
“ভুল হলে কি করবে?”
“আবার পড়াবো।”
“আচ্ছা।” ঘাড় কাত করলো লামিয়া। চোখ বন্ধ করে বলতে শুরু করল, “দশ, এগারো, বারো, তেরো..”
মালিহা চুপ করে আছে। লামিয়া একটু পর চোখ খুলে ঠোঁট উল্টে বলল, “ভুলে গেছি।”
“তিনের পরে কতো?”
“চার।”
“চারের প্রথম অক্ষর কী?”
“চ।”
“তেরোর পর চৌদ্দ। তেরোর প্রথমে ত চৌদ্দর প্রথমে চ। একই না?”
“তাই তো!” লাফিয়ে উঠলো লামিয়া।
“লাফালাফি করে না। চেয়ার থেকে পড়ে গেলে তখন বুকরি হয়ে যেতে হবে?”
“বুকরি আবার কি?”
“দাঁত পড়ে গেলে তো বুকরিই বলে।”
“না না! আমার দাঁত পড়ে গেলে চকলেট খাবো কী দিয়ে? লাফানো যাবে না।” মুখের উপর দুই হাত রেখে বলল লামিয়া।
“আচ্ছা এবার পড়।”
“ত চ প।”
“এগুলো কি?”
“মিলিয়ে নিলাম। এবার পড়ছি। তিন, চার, পাঁচ। তেরো চৌদ্দ, পনেরো। কিন্তু পাঁচের পরে ছয়। পনেরোর পরে ষোল কেনো? ছ আর ষ এবার মেলাবো কিভাবে?” বইয়ে আঙুল রেখে বলল লামিয়া।
মালিহা হাফ ছাড়লো। দুই দিনেই সে বুঝে গেছে আগের টিচারগুলো কেনো দশ হাজার টাকা রেখেও চলে গেছে। বিড়বিড় করলো মালিহা, “হে আল্লাহ্! আমাকে ধৈর্য দান করো।”
সেই ক্ষণে ছুটে এলো রিপা। লামিয়াকে কোলে নিয়ে বলল, “মিসকে বিরক্ত করছো?” মেয়ের গালে চুমু দিল রিপা। লামিয়া বিরক্ত হলো। মুখ কুঁচকে বলল, “আমি ভালো মেয়ে। মিসকে বিরক্ত করবো কেনো?”
মালিহা হাসলো, “ও তেমন দুষ্টুমি করে না।”
“মুখ তো থামে না। দুষ্টুমি করবে কখন?”
লামিয়াকে নামিয়ে বিদায় নিলো রিপা, “থাকো মালিহা। আসি।”
আশপাশে তাকালো মালিহা। ন্যানিকে দেখা যাচ্ছে না। দ্রুত পায়ে রিপার কাছে যেয়ে বলল, “আপা!”
“বলো মালিহা।” পেছন ঘুরল রিপা।
“কিছু মনে করবেন না। আসলে পড়ানোর সময় কেউ সামনে বসে থাকলে আমার একটু অকোয়ার্ড লাগে।” ইতস্তত করলো মালিহা।
“এভাবে বলছো কেনো? তোমার যেভাবে পড়িয়ে সুবিধা সেভাবে পড়াবে। আজ থেকে নাহয় লামিয়ার রুমে বসো। আমি বলে যাচ্ছি ঘর গুছিয়ে দিতে।”
“ইয়ে আপা.. ওর ন্যানিরা কেউ না থাকলেও ভালো হয়।”
এতক্ষণে বিষয়টা বুঝলো রিপা।
“ওহ! ওর কথা বলছো? আসলে ছোট থেকে মেয়েটাকে কাছে কাছে রেখেছে তো তাই কাছ ছাড়া করতে চায় না আর কি।”
“সেটাতে অবশ্যই আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যখন আমি পড়াবো তখন আমাকে আমার মতো করে পড়াতে দিতে হবে।” স্পষ্ট কন্ঠে বলল মালিহা। পূর্বের জড়তা ভাবটা আর নেই। তার বক্তব্য যে স্পষ্ট করে বলতে হবে এটা সে বুঝতে পেরেছে।
এক পলক মালিহাকে দেখে রিপা বলল, “আচ্ছা। আমি ওকে বলবো।”
মালিহাকে নিজে ঘরে নিয়ে গেলো লামিয়া। বেজায় খুশি সে। এক এক করে খেলনাগুলো বের করতে গেলে মালিহা তাকে আটকালো।
“এখন পড়ার সময়। পড়া শেষ করে তারপর সব খেলনা দেখবো।”
“প্রমিস?”
“হ্যাঁ।”
চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখলো মালিহা। প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট যে লামিয়া পায় এটা এই দুই দিনে বুঝেছে। কিন্তু তার পরিধি যে এতোটা সেটা বুঝতে পারেনি। একেক দেয়ালের রং একেক রকম। কিন্ত সবগুলোর মাঝে সূক্ষ্ম একটা মিল আছে। বিছানাটা রাজকীয় ধরনের। বারান্দায় বিশাল এক দোলনা উঁকি দিচ্ছে। এতো আয়োজন তবুও মেয়ের মনে তাদের জায়গা নেই কেনো?
“লামি!”
“হু।” মন দিয়ে লিখছে লামিয়া। মালিহা উৎসুক কণ্ঠে বলল, “তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? আব্বুকে নাকি আম্মুকে?”
“কাউকে না।” স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল লামিয়া।
“কেনো?”
“ওরা আমার সাথে খেলে না, গল্প করে না, ঘুমানোর সময় আদর করে না। শুধু মাঝে মাঝে এটা সেটা এনে দেয়। আমি জারা মামনিকে বেশি ভালোবাসি।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল, “সে কে?”
“তুমি তো চেনো। আমার সাথে সবসময় থাকে যে? সে। আমাকে অনেক আদর করে। কোনো বুয়া আমাকে মা’রলে তাদের অনেক বকা দেয়। জানো?”
মালিহা স্থির হয়ে বসে রইলো। বাবা মা দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত আর এদিকে তাদের মেয়েকে নিয়ে যে কাড়াকাড়ি চলছে সে বিষয়ে বেখবর। মালিহার মায়া হলো রিপার জন্য। সন্তানের মনের কোথাও যে বাবা মা থাকতে পারে না তাদের দুঃখ কি এই বিশাল অর্থ সম্পদ দিয়ে মেটে?

আজকে শেষ ক্লাস। তারপর পি এল শুরু। পূজার ছুটির সাথে মিলিয়ে সেটা বেশ কয়েকদিন গড়াবে। তারপরই ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। এখন পড়া একটু এগিয়ে না রাখলে তখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে হবে।
ক্লাস থেকে এসে সিলেবাস দেখছিল মালিহা। মোটামুটি অনেকটাই কভার করতে পেরেছে সে। যেটুকু বাকি আছে আশা করা যায় সেটা এই বন্ধের মাঝে পড়ে ফেলতে পারবে। হাফ ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। পেটে ভয়ংকর ক্ষুধা। কিন্তু শরীরে আলস্য ভর করেছে। ক্যান্টিন থেকে খাবার যে আনবে সেটাও মন চাইছে না।
এলোমেলো চিন্তা করতে করতেই চোখ লেগে এসেছিল মালিহার। কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে চোখ খুলল সে। মাথা উঠিয়ে তাকালো। মনিকা একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মনিকার মুখ উল্টো দিকে থাকায় মালিহা কিছু বুঝতে পারল না। মাথা নামিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার আগেই মনিকা এসে তাকে ধাক্কা দিলো।
“এই মালিহা! এই! ওঠ। আঁখি আপুর কি হয়েছে রে?”
মনিকার চোখ মুখ অবিশ্বাস। মালিহা কিছু বুঝলো না।
“কি হবে?”
“কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। ঐ দেখ!” একপাশে সরে গেলো মনিকা। মালিহা দেখলো আঁখি রুকু দিচ্ছে। হালকা একটা হাসি ফুটল তার ঠোটে।
“আঁখি আপু তো নামাজ পরে না সেভাবে। আজকে পড়ছে কেনো? কোনো বিপদে পড়েছে নাকি?”
“জানিনা তো। এমনিতেই পড়ছে মনে হয়।”
“যারা নিয়মিত পড়ে না তারা বিপদে পড়লেই পড়ে। দাঁড়া আপুর কাছেই শুনি। নামাজটা শেষ হোক।”
“কিন্তু যদি আপু ভাবে এবার থেকে নিয়মিত পড়বে তাহলে আপনি এই প্রশ্ন করলে আপুর খারাপ লাগবে।”
মনিকা ভাবলো। খারাপ লাগতে পারে।
“তাহলে শুনবো না?”
“থাক। কিছু বলার হলে আপু তো নিজে থেকেই আমাদের বলবে। নাহলে কিছুতেই বলবে না।”
“ঠিক বলেছিস।”
“আপু আগামী শুক্রবার নীতির আকদ।”
“কিহ! সত্যি?”
“হ্যাঁ। এখন বিয়ে পড়িয়ে রাখবে। পরে উঠিয়ে নেবে।”
মনিকার অস্থিরতা চোখে পড়ার মতো। যতটুকু জানে বলল মালিহা।
“তাহলে তো আমাদের গিফট টিফট কিছু দিতে হয়। কি দিবি তুই?”
“বুঝতে পারছি না। কি দিলে ভালো হয়?”
“ভালোর তো শেষ নেই। চল সবার টাকা মিলিয়ে কিছু দিই।”
“আচ্ছা আপনি ভাবুন কি দেয়া যায়। তারপর বলেন।”
“আমিও আছি কিন্তু!”
পেছন থেকে আঁখি বলল। মালিহা তাকিয়ে দেখলো চারপাশে কালি হয়ে যাওয়া চোখের উজ্জ্বলতা।

মালিহা যখন তিশার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে তখন আকাশে কালো মেঘ। তবুও সে উত্তেজিত তিশার সাথে দেখা করার জন্য। মেয়েটাকে বলতে হবে তার লেখা সে জমা দিয়ে দিয়েছে। মালিহার দৃঢ় বিশ্বাস লেখাটা ছাপাবেই। হয়তো দুইদিন পর।
ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করলো মালিহা। বেজেই চলেছে। মালিহার বিরক্ত লাগে ফোন ধরতে। ফোন জিনিসটাই তার কাছে ভালো লাগে না।
ইতমিনান ফোন দিয়েছে। সময় দেখলো মালিহা। অফিস বাদ দিয়ে ফোন নিয়ে কি করছে সে!
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কোথায় তুই?”
“রাস্তায়।”
“কই যাস?”
“পড়াতে।”
“ওহ। আচ্ছা শোন। লতা আপা তোকে দাওয়াত দিয়েছে।”
“কিসের দাওয়াত?”
“ছেলের আকিকার। এই শুক্রবারে। আমাকে বারবার বলেছে যেন তোকে নিয়ে যাই।”
মালিহা ইতস্তত করলো। গেলে তো কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হবে। আজই সব টাকা পাঠিয়ে দিলো। আর আজই পর এক খরচে লিস্ট হাতে এসে উঠছে।
“আমি যেয়ে কি করবো? তোমার কলিগ তুমি যাও।”
“এসব কি কথা? রান্না বান্না করে খাইয়েছিস। ওরা তোকে দাওয়াত দিতেই পারে। রেডি থাকবি। বারোটার দিকে তোকে দিয়ে তারপর আমি জুমআ ধরবো।”
মালিহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেঁটে দিলো ইতমিনান। মালিহা ভাবলো ইরিনার কাছে ফোন দিয়ে টাকাটা চাইবে। নাহলে লতা আপার বাড়ি খালি হাতে যেতে হবে। তখনই ইরিনাকে ফোন দিলো সে।
“হ্যালো কে?”
“ইরিনা আমি মালিহা।”
“ওহ মালিহা। কেমন আছো?”
“এই তো ভালো। ক্লাসে আসছো না যে? অসুস্থ?”
“তা একটু।”
“ওহ। ইরিনা আমার টাকাটা কি আজ দিতে পারবে? একটু দরকার ছিল।”
“আমি তো হলে নেই। বাড়িতে এসেছি।”
“সমস্যা নেই আমি তোমার বাড়ি থেকেই নিয়ে আসবো নাহয়।”
“আচ্ছা। তিন রাস্তার মোড়ে এসে আমাকে ফোন দিও।”
“আচ্ছা। ধন্যবাদ ইরিনা। অনেক উপকার হলো।”
স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল মালিহা। টাকাটা আসলেই এখন দরকার।

মালিহা ভেবে রেখেছিল আজ আজিজার সাথে কথা বলবে। সেই অনুযায়ী তিশাকে পড়ানোর আগে আজিজার কাছে বলল, “ফুপু আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“বলো।” মালিহার বিপরীতে বসলেন আজিজা।
“তিশাকে আপনি কেমন ভাবেন আমি জানিনা। ও কিন্তু অনেক ট্যালেন্টেড। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ভয় পেয়ে যায়।” আজিজা কিছু বলছেন না, চুপ করে মালিহার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মালিহা আবার বলল, “পরীক্ষার বিষয়টাই ধরুন। যে প্রশ্নগুলো আসে সব ওর পড়া। আমি নিজে পড়িয়েছি, রিভাইজ করিয়েছি। কিন্তু পরীক্ষার হলে ও নার্ভাস হয়ে পড়ে এজন্য ঠিকঠাক লিখতে পারে না। মার্কও তুলতে পারে না। কিন্তু এজন্য আপনি যদি ওকে সাপোর্ট না করে উল্টো বকা দেন তাহলে সেটা ওর জন্য আরো কঠিন হয়ে যাবে।”
“কি বলতে চাও তুমি?”
“আপনি মা। ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ। সেই মানুষটার থেকে ও ভালোবাসা আশা করে, উৎসাহ আশা করে। আপনাকে খুশি দেখতে চায় তিশা। কিন্তু সেটা কখনোই পারে না বলে ও নিজে প্রতি ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছে। ওর মেন্টাল কন্ডিশন ভালো নেই।”
“আমি আমার মেয়ের সাথে কেমন ব্যবহার করব এটা তোমার থেকে শিখতে হবে?”
“ভুল বুঝবেন না ফুপু। আমি আপনার ছোট। কিন্তু কিছু বিষয় আপনি বুঝতে পারছেন না। এগুলোর ইফেক্ট সরাসরি তিশার উপরে পড়ছে। আপনি ওর..”
“তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি বেয়াদবি করছো? পারিবারিক বিষয়ে অনধিকার চর্চার অনুমতি তোমাকে কে দিয়েছে?”
“তিশা আমার স্টুডেন্ট। ওর ভালো মন্দের বিষয়টা আমি দেখব না?”
“না। তুমি আসবে, পড়াবে, চলে যাবে। এর বাইরের কিছু তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।”
দম ছেড়ে মালিহা বলল, “কি করলে ও ভালো করে পড়তে পারবে সেটাও চিন্তা করব না?”
আজিজকে চুপ দেখে মালিহা আবার বলল, “বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার কিছু অবুঝপনার জন্য তিশার ফিউচার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
এই পর্যায়ে আজিজা উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন, “তিশা অপেক্ষা করছে। যাও।”
আজিজা চলে যাওয়ার পরও মালিহা কিছুক্ষণ বসে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠলো তিশার ঘরে যাওয়ার জন্য। আর কি করতে পারে সে? কিন্তু সে জানলো না আগামীকাল তার জন্য কি অপেক্ষা করছে।

আকাশটা মেঘলা। যেকোনো সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। বিকেলের শেষ প্রান্ত হলেও মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে যেনো সময় আরো পেরিয়ে গেছে।
তিন রাস্তার মোড়ে এসে ইরিনাকে ফোন দিলো মালিহা। রিং বেজে বেজে ফোন কে’টে গেলো। আবার ফোন দিলো। এবার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। মালিহা ভাবলো নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়তো। জায়গা বদলে আরেক জায়গায় দাঁড়িয়ে ফোন দিলো সে। একই অবস্থা। সময় গড়ালো। মেঘ ঘনালো। অন্ধকার গাঢ় হয়ে রাত নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রকৃতির সাথে অন্ধকার হলো মালিহার মুখও। অযাচিত চিন্তারা হা’না দিল মন পাড়ায়। তাদের দুর করে দিতে চাইলো মালিহা। সম্ভব হলো না। ফোনের ভেতর থেকে যান্ত্রিক কণ্ঠ তখনও ইরিনার ব্যস্ততা জানান দিচ্ছে। হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো। অচেনা জায়গায় নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো মালিহার। লোকজন ছুটে এসে দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়াচ্ছে। একজন মহিলা জামা ঝাড়তে ঝাড়তে মালিহার পাশে এসে দাঁড়ালো। বৃষ্টি একভাবে ঝরেই চলেছে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। নিজের ফোন বন্ধ করলো মালিহা। পাশের মহিলার দিকে তাকালো। নরম কণ্ঠে বলল, “আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আপনার ফোন থেকে একটা কল দেয়া যাবে?”
মহিলা বিরক্ত মুখে সালামের উত্তর নিলো। মালিহার মনে হলো সে বোধহয় ফোন দিতে আগ্রহী নয়। বিষণ্ন দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো সে। হঠাৎ কথায় চমকে গেলো, “কি হলো নাও! ফোন চেয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে?”
মালিহা ফোন নিলো। কিন্তু কৃতজ্ঞের হাসি হাসতে পারলো না। মুখস্থ হয়ে যাওয়া ইরিনার নাম্বার ডায়াল প্যাডে তুললো ঝটপট করে। ফোন কানে ধরলো। তার বুক দুরুদুরু করছে। হঠাৎ কোথাও বাঁজ পড়ল।ছলকে উঠলো হৃদয়। ঠিক তখনই ওপাশ থেকে কেউ বলল, “হ্যালো! কে বলছেন?”
কিছুক্ষণ ফোন ধরে রইলো মালিহা।
“কি আজব! কথা বলছেন না কেনো?”
ফোন কেটে দিলো মালিহা। ধন্যবাদ জানিয়ে মহিলাকে তার ফোন ফেরত দিলো। বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে মালিহা ভাবলো, আকাশ কি কারো থেকে দুঃখ পেয়েছে?

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে