উষ্ণতা পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
98

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৫

এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো মালিহার হলে এসেছে ইতমিনান। তবে এবার উল্টোটা হয়েছে। মালিহা ডেকেছে আর ইতমিনান সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে। প্রতিবার তো মালিহাই চমকে যায়।
দুর্বল শরীর নিয়ে রান্না করতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। ভ্যাপসা গরম যেনো আগুনের তাপকে আর উত্তপ্ত করেছে। ঘামে জবুথবু অবস্থা মালিহার। নিজের কাছেই বিরক্ত লাগলো তার। একেবারে গোসল করে নামবে? কিন্তু ইতমিনান তো মেসেজ দিয়েছে। নিশ্চয়ই নিচে বসে আছে। থাক খাবারটা আগে দিয়ে আসা যাক।
পরিষ্কার বড় একটা ওড়না গায়ে জড়িয়ে ব্যাগ দুটো হাতে নিলো মালিহা। সিঁড়ি ভেঙে নেমে যখন ওয়েটিং রুমের সামনে এলো তখন ইতমিনান তাকে আবার ফোন দেয়ার পাঁয়তারা করছে। মালিহাকে দেখে সে ফোন রেখে দিল। পরিশ্রান্ত কণ্ঠে মালিহা বলল, “সরি বেশি দেরি হয়ে গেলো।”
মালিহার মুখটা দেখলো ইতমিনান। চুলার আঁচ যেনো এখনও মুখে লেগে আছে।
“সমস্যা নেই।”
“এই ব্যাগটা ওদের। একটা বাটিতে লতা আপার জন্য স্যুপ দিয়েছি। এখন খেতে দেবে কি না জানিনা নাহলে রাতের জন্য রেখে দিতে বলবে। আর নিচেরটায় আঙ্কেল আন্টির জন্য খাবার।”
“কি রান্না করেছিস?” ব্যাগ হাতে নিয়ে সেদিকে নাক দিলো ইতমিনান। মালিহা কপাল কুঁচকে বলল, “যা বাজার করে এনেছিলে তাই রান্না করেছি। এটা তোমার।” আরেক হাতের ব্যাগ এগিয়ে দিলো মালিহা। ইতমিনান ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার জন্য রান্না করেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“তুই?”
“হু।”
ইতমিনানের নজরে চমক। মালিহার কেনো যেনো অস্বস্তি হলো সেই চোখে চোখ মেলাতে।
“কই ধরো।”
ইতমিনান ঢোক গিললো। তার বাজার করাই উচিৎ হয়নি। আর না উচিত হয়েছে আজকে হলে আসা। এই রান্না বান্না করে খাইয়ে মেয়েটা তার স্মৃতিতে ঘাটি গেড়ে বসে থাকতে চাইছে। ভয়ংকর পরিকল্পনা!
ইতমিনানকে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মালিহা বলল, “তাড়াতাড়ি যাও। ওরা সবাই না খেয়ে বসে আছে।”
“তুই যাবি না?”
“না আজকে আর যাচ্ছি না। শরীরটা ভালো লাগছে না। গোসল করব। শোনো ওনাদের বলবে খাবার নিয়ে যেনো টেনশন না করে। এই দুই দিন আমিই রান্না করে দেবো ইনশাআল্লাহ্। ”
“আচ্ছা।”
“মনে করে বলবে কিন্তু!”
“আচ্ছা।”
ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো ইতমিনান। মুহূর্তেই আবার ফিরে এলো মালিহার সামনে। মালিহা হকচকিয়ে গেল। মাত্রই না বের হলো!
“তোর জন্য রেখেছিস?”
“কি?”
“খাবার?”
“রেখেছি।”
“আচ্ছা খেয়ে নিস। আরেকটা গ্লুকোজ কিনে দিয়ে যাবো?”
“না বিশ্রী লাগে।” মুখ বেঁকিয়ে বলল মালিহা। ইতমিনান আর কিছু বলল না। চলে গেলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

বৃদ্ধ দম্পতি অনাকাঙ্খিত সম্মানে আপ্লুত হলেন। ইতমিনান যখন বলল, “হাসপাতালে যতদিন আছেন খাওয়ার ব্যাপারটা আমার ওপরে ছেড়ে দিন। আপনারা মা আর বাচ্চার খেয়াল নিন।”
“এক বেলা যে নিয়ে এসেছো এই অনেক বাবা। রোজ রোজ তোমাকে কষ্ট করতে হবে না।” লতার শাশুড়ি জবাব দিলেন।
“মালিহা আমাকে বারবার বলে দিয়েছে। ও তো রান্না বান্না করে বসে থাকবে। আপনারা যদি সেই খাবার না গ্রহণ করেন তাহলে আর কি করা..” হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল ইতমিনান।
লতার শ্বশুর বললেন, “কিন্তু প্রতিদিন কেমন দেখায় বলো? তোমাদেরও তো কষ্ট হয়।”
“ডাক্তার বলেছে আপাকে পরশু রিলিজ করে দেবে। আজকের দিনের খাবারের পাঠ শেষ। থাকলো বাকি একদিন। শুনুন আঙ্কেল! রিজিকের বিষয় আসমানে সেট করা আছে। আপনি আমার সাথে জোরাজুরি করলেও তো আর সেটা পাল্টে যাবে না!”
এরপর আর কোনো কথা বলার থাকে না। ঘুমন্ত লতার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন লতার শাশুড়ি। একটা চিন্তা কমলো।

দুপুরে খেয়ে একটু শুয়েছিল মালিহা। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। ঘামটা কি শুধুই গরমের? ধপ করে উঠে বসলো সে। হঠাৎ ঘুম থেকে এভাবে ওঠায় মাথাটা ঘুরে উঠলো। এক হাত মাথায় রেখে চারপাশে তাকালো মালিহা। না তুষার কোথাও নেই। উহু ঠিক হলো না। তুষার বাস্তবে নেই। কিন্তু তার সত্তা যেনো মালিহার পিছু ছাড়ছে না। দুঃস্বপ্নের মতো ঘুমের ঘোরেও মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। দম ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল মালিহা। এই ভোগান্তির শেষ কোথায়?

পড়ন্ত বিকেলে নাজিফার রুমে গেলো মালিহা। রুমের ভেতর সিনিয়র দুজন তখন পড়াশোনায় ব্যস্ত। নাজিফা বের হয়ে বলল, “চলো ছাদে যাই?”
“চলো।”
দিনভর পৃথিবী উত্তর করে সূর্য একটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাপ কমে এসেছে। এই তো নিয়ম। যৌবনে দাপিয়ে বেড়ানো লোকটা বৃদ্ধ বয়সে লাঠি খোঁজে। সূর্যের কি এখন বৃদ্ধ বয়স চলছে?
“নাজিফা সূরা ফাতিহাটা একবার শোনাবে?”
নাজিফা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। মালিহার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে হেসে বলল, “সুরা ফাতিহা কেনো? অন্য সুরা না কেনো?”
“জানিনা। এই সুরাটা শুনতেই বেশি ইচ্ছা করে।” মাথা নেড়ে বলল মালিহা। নাজিফা কণ্ঠ নিচু করে মুখের একপাশে ডান হাত রেখে বলল, “একটা গোপন কথা শোনো। কারো যদি কোনো সুরা একটু বেশি প্রিয় হয়, অন্য সুরার থেকে বিশেষ বলে মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে সেই সুরাটায় আল্লাহ তার জন্য কোনো গোপন মেসেজ রেখেছেন।”
মালিহা চোখ বড় করে বলল, “সত্যি?”
চোখ বন্ধ করে আশ্বস্ত করলো নাজিফা, “ইয়েস।” গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “শুরু করি তাহলে?”
“আচ্ছা।”
দুইবার কাশি দিলো নাজিফা। গলা পরিষ্কার করে পড়তে শুরু করলো কুরআনের মা’কে। ছাদে আরো কয়েকজন গল্পে মশগুল ছিলো। হঠাৎ নাজিফার কণ্ঠে সকলে অঘোষিতভাবে চুপ করে গেলো। কেউ যেনো তাদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছে “কোনোভাবেই এখন কথা বলা যাবে না!”
মালিহার মনে হলো নাজিফা তার ভেতরে জমে থাকা সবটুকু বিনয় ঢেলে দিয়ে তিলাওয়াত করলো। সাত আয়াতের সুরাটা মিনিটেই শেষ হয়ে গেলো। নাজিফা থামলে মালিহা বলল, “তুমি কি এটা আমাকে রেকর্ড করে দেবে? মাঝে মাঝে শুনতাম।”
“অবশ্যই দেবো। কিন্তু শর্ত আছে।” হেসে বলল নাজিফা। ম’রা রোদ পড়া সেই হাসিটুকু মালিহার কাছে চমৎকার লাগলো।
“কি শর্ত?”
“কোনো ছেলে মানুষ যেনো না শোনে।”
“আচ্ছা।”
“ইনশাআল্লাহ্ বলো। ভবিষ্যত নিয়ে কিছু বললে ইনশাআল্লাহ্ বলতে হয়। এর অর্থ যদি আল্লাহ চান।”
“ইনশাআল্লাহ্।”
নীরবতা নেমে এলো দুজনের মাঝে। স্বচ্ছ নীলাকাশে পাখিদের ছোটাছুটি দেখা যাচ্ছে। সবাই নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত। কর্ম ব্যস্ত দিন পার করে সকলে ছুটছে শান্তির নীড়ে।
“নাজিফা?”
“হু?”
“চারপাশে যে এতো সমস্যা হয়, ছেলেরা মেয়েদের টিজ করে, হ্যারাস করে এর সমাধান কি? আল্লাহ নিশ্চয়ই কিছু বলেছেন?” আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল মালিহা। নাজিফাও সেদিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো, “অবশ্যই বলেছেন। এতো এতো কথা বলেছেন। মেইন কথা হলো পর্দা করতে হবে।”
“মেয়েরা পর্দা করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? কিন্তু বোরখা পড়া মেয়েরাও তো কম ভোগান্তির শিকার হয় না।” সেদিনের চিত্রটা মানসপটে ভেসে উঠলো। সে নিজেই তো বোরখা পড়ে ছিলো।
নাজিফা হেসে বলল, “লম্বা উত্তর। ধৈর্য ধরে শোনো।” জোরে একটা শ্বাস টানলো নাজিফা। সম্ভবত প্রস্তুতি নিয়ে নিলো।
“আমাদের একটা কমন সমস্যা হচ্ছে পর্দা মানেই বুঝি বোরখা পড়া মেয়ে। অথচ পর্দা নারী পুরুষ দুজনের জন্যই।”
“ছেলেদেরও পর্দা আছে নাকি?” মালিহার চোখে বিস্ময় দেখা দিলো।
“অবশ্যই আছে। নারীদের আগে কুরআনে পুরুষদের পর্দা করতে বলা হয়েছে। তাহলে বোঝো তাদের পর্দা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ!”
“ছেলেরাও কি বোরখা পড়বে নাকি?”
“আরে নাহ! ওদের হলো চোখের পর্দা। নজরে পর্দা। বেগানা নারী মানে যাদের সাথে বিয়ে করা জায়েয তাদের দিকে ভুলে একবার দৃষ্টি চলে গেলে সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইচ্ছা করে কোনো মেয়ের দিকে তাকানো তাদের জন্য হারাম। আর পোশাকের কিছু রুলস রেগুলেশন আছে।”
“বাপ রে! এটা তো কঠিন। এটা কি মেইনটেইন করা যায় নাকি?”
“সম্ভব হওয়া না হওয়াটা পরের বিষয়। মূল কথা হলো চেষ্টা। তুমি চেষ্টা করছ নাকি সেটা আল্লাহ দেখবেন। তোমার আপ্রাণ চেষ্টাই তাঁর কাছে ধর্তব্য। ফলাফল যা হয় হোক। একমাত্র তিনিই আছেন যিনি আমাদের ফলাফলের আগে মনের নিয়তকে, আপ্রাণ চেষ্টাকে যথার্থ মূল্যায়ন করেন।”
মালিহা বেশ কিছুক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবলো। বলল, “কিন্তু আমাদের আশেপাশে কয়জন ছেলে চোখ নামিয়ে চলে?”
“আল্লাহই জানে এমন কেউ আছে নাকি। না থাকলেও এটা আল্লাহর বিধান। ছেলেদেরকে নজর নামাতে হবে, মেয়েদের সৌন্দর্য ঢেকে রাখতে হবে। এই দুটো কাজ হলো গাড়ির দুই পাশের দুই চাকার মতো। ব্যালেন্স করে চলতে হয়। মেয়েরা নিজেদের ঢেকে চললো কিন্তু ছেলেরা নজরের হেফাজত করলো না, আবার ছেলেরা নজরের হেফাজত করলো কিন্তু মেয়েরা নিজেদের সৌন্দর্যের সস্তা প্রদর্শনী মেলে বসলো তাহলে ব্যালেন্স হবে না। চাকা ছোট বড় হয়ে যাবে। সমাজ নামের গাড়ি এদিক সেদিক বেঁকে গিয়ে খাদে পড়ে যাবে। তারপর এই যে আশপাশে যা হচ্ছে..” কাঁধ শ্রাগ করে বলল নাজিফা।
“কিন্তু মেয়েরা পর্দা করেও যদি লাঞ্ছনার শিকার হয় তাহলে আর পর্দা করার দরকার কি?” মালিহার ভেতর থেকে যেনো তুষারের প্রতি জমাট বাঁধা ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে। সে তো নিজেও বোরখা পড়ে। তাহলে কেনো তাকে ঐ অবস্থায় পড়তে হলো।
“আসলে দেখো আমরা পর্দা বলতে বুঝি বোরখা পড়া আর মাথা ঢাকা। বিষয়টা কিন্তু এমন না। কুরআন বা হাদীসে বোরখার কথা বলা হয়নি। কিছু শর্ত দেয়া হয়েছে। সেই শর্ত অনুযায়ী তুমি যেই পোশাক পড় সেটাই চলবে। কিন্তু আজকালকার বোরখাগুলো বোরখা কম লেহেঙ্গা বেশি। বডি স্ট্রাকচার বোঝা যায় যে বোরখা পড়লে সেটা কোনো বোরখা হলো? আবার কেউ ঢিলা বোরখা পড়লো, মাথা ঢাকলো কিন্তু বের করে রাখা মুখটা সেজেগুজে বের হলো। তাহলে লাভ কী হলো? সেই তো সৌন্দর্য প্রদর্শন। পর্দার সঠিক পোশাক পড়েও অনেকে বাকিটুকু মানে না। কুরআনে, হাদীসে বেগানা পুরুষের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বলা হয়েছে, বিনা প্রয়োজনে দেখা সাক্ষাৎ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলেকে বন্ধু ভেবে তার সাথে ঘুরতে যায় তাহলে আর বোরখার কি কাজ হলো? নবীজী স্পষ্ট করে বলেছেন নির্জনে কোনো মহিলা যেনো কোনো বেগানা পুরুষের সাথে এবং কোনো পুরুষ যেনো কোনো বেগানা মহিলার সাথে দেখা না করে। কারণ সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হয় শয়তান। মদদ দেয়ার কাজটা সে করে দেয়। তাই তাকে সেই সুযোগটাই দেয়া যাবে না।”
দম ছাড়লো নাজিফা। মালিহা এই যাত্রায় চুপ করে গেলো। সেদিন কোচিংয়ে সে তুষারের সাথে একা ছিল। একদম একা।
“দেখো মালিহা যদি কেউ আল্লাহকে মানে তাহলে তার বিধান মানতে আর সাত পাঁচ ভাবার দরকার হয় না। তিনি বলেছেন, আমি মেনেছি। এই হলো নীতি। যুক্তিগুলো হলো মনকে ঠান্ডা করার জন্য বোনাস। কিন্তু পৃথিবীর কেউ যদি পর্দার বিধান না মানে তবুও সেটা আল্লাহর কাছে বলবৎ থাকবে। এর জন্য অবশ্যই জবাব দিতে হবে। নিশ্চয়ই তোমার হয়ে অন্য কেউ জবাব দিয়ে দেবে না? আর চেষ্টা করে যে মানুষ চাঁদে চলে গেছে সে চাইলে নজরের হেফাজতও করতে পারে। এটা আমার বিশ্বাস। আল্লাহর বিধান মানতে কেউ চেষ্টা করবে আর আল্লাহ সাহায্য করবেন না এমন হতেই পারেনা। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া তো কিছুই সম্ভব না। তাই আমাদের চেষ্টা আর সেই অনুপাতে আল্লাহর সাহায্য। কাম তামাম!”

মালিহা তার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। একে একে সবটা মেলাতে তার এক মুহুর্ত লাগলো। সমাজ, চাকা, বিধান সবটা যেনো পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। বুকের ভেতর প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো। পর্দা যে শুধু কয়েক গজ কাপড়েই নয়, খানিকটা মনে, খানিকটা মস্তিষ্কে, অনেকটা চোখে এটা বুঝতে পেরেই সব জট খুলে গেলো।
মাগরিবের আযান দিলে উঠে দাঁড়ালো নাজিফা, “মালিহা চলো যাই। আযান দিচ্ছে।”
মালিহা উঠে দাঁড়ালো। প্রশান্ত একটা মন নিয়ে সে আজ তার রবের সামনে দাঁড়াবে।

পেঁপে ঘন্ট দিয়ে খুব আয়েশ করে খেলো ইতমিনান। খেয়েই যেনো তার বুদ্ধি খুললো। চট করে রাবেয়াকে ফোন দিয়ে দিলো। হঠাৎ ভাস্তির ফোন পেয়ে রাবেয়া অবাক হলেন।
“ব্যাপার কি? এতদিন পর ফুপুরে মনে পড়ল?”
“উল্টা ঝাড়ি। তুমিও তো খোঁজ নাও না।”
“এমনই বলে সবাই।”
“কেমন আছো?”
“ভালোই।”
“ফুপু তোমার কাছে একটা আবদার আছে।”
“কি আবদার?” রাবেয়াকে উৎসুক দেখা গেলো। এ যেনো ছোট্ট ইতমিনান বায়না ধরছে।
“এখন বলবো না। সামনের ছুটিতে বাড়ি এসে বলবো। আমি কিছু জানি না। সব তুমি করবা।”
“কিছু বলে না আবার বলে তুমি সব করবা। আগে খোলাসা করে বল দেখি।”
“এখন না। বাড়ি যাই আগে।”
“বেয়াদ্দব ছ্যাড়া! এক্ষণ তাইলে এই কথাটা বলে আমার মাথা নষ্ট করার কি দরকার ছিল? এই অশান্তি নিয়ে এবার আমি ঘুমাবো কেমনে?”
ফুপুর ধমকানিতে হাসলো ইতমিনান। অনেকদিন পর ফুপুকে জ্বালিয়ে শান্তি শান্তি লাগছে।
“বেশি না ফুপু। আর মাত্র বিশ দিন পর আমি আসছি। ততদিন একটু সবুর করো। আর হ্যাঁ! মা’মলা কিন্তু সিরিয়াস!” শেষটুকু গম্ভীর কণ্ঠে বলল ইতমিনান।
“হতচ্ছাড়া..!” বাকিটুকু শোনার আগেই কল কেঁটে দিলো ইতমিনান। সাথে সাথেই ফোন বন্ধ করে দিলো। ফুপু এখন ফোনের পর ফোন করবে। ধরার প্রশ্নই ওঠে না।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৬

নীতি ফোন করেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু কাজের কথা কিছুই বলছে না। মালিহার মনে হচ্ছে নীতি কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।
“নীতি কি আগডুম বাগডুম শুরু করলি? আমাকে কিছু বলবি তাই নিয়ে ভাবা ভাবির কি আছে?”
“সিরিয়াস কথা দোস্ত। আমার প্রেশার একবার হাই হয়ে যাচ্ছে আবার লো হয়ে যাচ্ছে।” বিমর্ষ কণ্ঠে বলল নীতি।
“আঙ্কেল আন্টি সবাই সুস্থ আছেন তো?”
“খালি সুস্থ? বিন্দাস আছে। আলহামদুলিল্লাহ।”
“তাহলে আবার কি হচ্ছে?”
“তোকে আসার আগে কি বলেছিলাম?”
“কি বলেছিলি?”
“একটু ভাববি তো নাকি!”
মালিহা ভেবে ভেবেও কিছু মনে করতে পারলো না।
“বিশেষ কিছু বলেছিস বলে তো মনে পড়ছে না।”
“তা কেন মনে থাকবে?” পরপর দম ছাড়লো নীতি। কণ্ঠ নিচু করে বলল, “তোর আঙ্কেল আন্টি তো ঘটনা ঘটায় ফেলসে!”
“কি করেছে?” মালিহাও ফিসফিসিয়ে শুনলো।
“পাত্র টাত্র দেখে একাকার। এখন আমারে বলে বিয়ে নাকি পড়ায় রাখবে পরে তুলে নিবে।” শেষেরটুকু কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল নীতি। কথাটা বুঝতে পারেই মালিহা চেঁচিয়ে উঠলো, “তোর বিয়ে!”
সেই চিৎকারে ঘুমে ঢুলতে থাকা মনিকা তড়াক করে উঠে বসলো, আঁখি মুখের পানি গিলতে যেয়ে কাশতে শুরু করলো, ফোনের ওপাশে থাকা নীতি কান থেকে ফোন সরিয়ে বলল, “কালা করে দিবি নাকি বইন?”
মালিহা বিব্রত বোধ করলো। আঁখি, মনিকা দুজনকেই সরি বলল।
“নীতি! সত্যিই তোর বিয়ে?”
“কথাবার্তা চলছে।”
“তুই রাজি?”
“ছেলেটা ভালোই বুঝলি?” জামার সুতা টানতে টানতে বলল নীতি।
“কি করে?”
“মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।”
মালিহা হতাশ কণ্ঠে বলল, “এ তো বারো মাসের ভেতরে তেরো মাসই সমুদ্রে ভেসে বেড়াবে। তোর সাথে সংসার করবে কখন?”
“ছুটিতে এসে।”
মালিহা চোখ বড় করে বলল, “তার মানে তুই রাজি হয়ে গেছিস? ছুটিতে সংসার করবি সেই প্ল্যানও করা হয় গেছে। কতো ফাস্ট রে তুই নীতি!”
“আমি আর কি ফাস্ট! ছেলেরা টার্বো স্পিডে চিন্তা করে। ঐ ছেলে দেখ গা ভাবনায় আমার নাতি নাতনির দাদা, নানা হয়ে গেসে।”
এবার মালিহা কাশতে শুরু করলো। নীতির হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই হাসি নিভে গেলো, “কতো প্ল্যান করেছিলাম বিয়ে নিয়ে। কিন্তু কিছুই তো হলো না।”
“এই যে বললি এখন শুধু বিয়ে পড়িয়ে রাখবে। তাহলে প্রোগ্রামের সময় তো সব হবে।”
“কিন্তু এখন তো তুই নেই।”
ছোট্ট একটা কথা। পাঁচটা শব্দের। কিন্তু সেই বাক্যের ওজন যে কি বিশাল, সেটা কি অবলীলায় বলে ফেলা নীতি জানে? যেতে পারবে না এই কথাটা মালিহার একবারও এমন কথা মনে হয়নি। খারাপ লাগা তো পরের বিষয়। অথচ মেয়েটা সেটা মনে করে মন খারাপ করে বসে আছে।
“পাগলী মেয়ে! তুই কি এখনই শশুর বাড়ি চলে যাচ্ছিস? প্রোগ্রামের সময় আমি থাকবো ইনশাআল্লাহ্।”
“বিয়ে তো বিয়েই। ওটা হবে বাসি বিয়ে। টাটকা বিয়ের সময় আর তুই থাকলি কই!”
মেয়েটার মন খারাপ কমছে না। মনটা ঘোরানো দরকার। কি মনে করে মালিহা বলল, “নীতি! নতুন একটা টিউশন পেয়েছি জানিস?”
“আবার আরেকটা? এতগুলো করবি কখন তুই?”
“কোচিংয়েরটা ছেড়ে দিয়েছি।” মলিন কণ্ঠে বলল মালিহা।
“কেনো?”
“ভালো একটা পেলাম। ছোট্ট একটা বাচ্চা। পাঁচ বছরের। ওকে পড়ানো আর কি। কিন্তু দশ হাজার টাকা দেবে বলেছে। তাহলে এটা বেশি লাভের না?” কৌশলে কোচিংয়ের বিষয়টা এড়িয়ে গেলো মালিহা। নীতি বলল, “আঁখি আপু মাইন্ড করবে না তো?”
“না আপু জানে। সমস্যা নেই।” আঁখি জানে বটে, কিন্তু সেটুকু নীতি জানে না।
“পি এল দেবে কবে?”
“আর তিনটা ক্লাস হবে। তারপর একেবারে পূজার ছুটি সহ পি এল দিয়ে দেবে।”
“আমার পড়াশোনা লাটে উঠে গেলো।”
“কারেকশন! বলো সমুদ্রে ভেসে গেলো!”
নীতি হাসলো লজ্জার হাসি। মালিহা মনে মনে দোয়া করলো, এই হাসিখুশি মেয়েটা সারাজীবন খুশি থাকুক।

একটু আগে আগেই বের হলো মালিহা। লতাকে দেখে একেবারে তিশাকে পড়াতে যাবে। জ্বরের অজুহাত দিয়ে বেশ কয়েকদিন পিছিয়ে গেছে। ইতমিনানকে ফোন করেছিল। তার অফিস ছুটি হতে এখনও ঘণ্টা খানিক দেরি হবে। কাজেই মালিহা একাই গেলো। সঙ্গে নিলো খাবার। সকালেরটা ইতমিনান এসে নিয়ে গিয়েছিল।

মালিহা ভাবছিল আজ মুখ ঢাকবে কি না। বেশি কিছুই করতে হবে না। গলার কাছে থেকে স্কার্ফের কিছুটা অংশ নাকের উপর ফেলে দিলেই হলো। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাসের পরিবর্তন করতে ইতস্তত লাগলো। বাইরের রোদ জড়তাকে আরেকটু জোরালো করলো। গরম লাগবে না? এই চিন্তাটাই মালিহাকে আটকে দিল। কয়েকদিন যাক, তারপর থেকে শুরু করবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো মালিহা। ভাবনার দরজা বন্ধ হলো সেখানেই।

হাসপাতাল তখন নীরব। রোগীদের গোঙানি নেই, প্রিয়জনদের আহাজারি নেই। সব শান্ত। ভাতঘুম পর্ব চলছে। আলস্য জেঁকে ধরেছে দিনের মাঝখানে। মালিহা আরেকটু আগেই আসতে চেয়েছিল। লতার শাশুড়ি তাকে এই সময়ে আসতে বলেছে। দরজা ধাক্কা দিলে ভদ্র মহিলা খুলে দিলেন। হাসি মুখে মালিহাকে স্বাগত জানালেন। মালিহা ভেতরে এসে দেখলো লতা বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে। বেডের মাথার কাছে অংশটা একটু উঁচু করা। যেনো শোয়াও হচ্ছে আবার বসাও। মালিহা মুখ হাত ধুয়ে লতার শিয়রে বসলো। লতা তার দুই হাত ধরে বলল, “কাল খুব উপকার করেছো ভাই। কিন্তু কিছু বলার সাধ্য আমার ছিলো না।”
“কিছু বলতে হবে না আপা। এমন কিছুই করিনি।”
“র’ক্ত নাহয় কতো মানুষই দেয়। কিন্তু নিজের ঘাড়ে এই ঝামেলা কে টেনে নেয়?” শাশুড়ি খাবার বাড়ছিলেন। সেদিকে ইশারা করে বলল লতা।
“আপা রিজিক তো আপনার আমার হাতে নেই। যার যখন যেখানে রিজিক আছে সে তখন সেখান থেকেই খাবে। এই তো নিয়ম।”
লতা হতাশ কণ্ঠে বলল, “ভাই বোন সব একই কথা বলে। চেহারার মিল লাগবে না। কথা শুনেই বোঝা যায় এক কোম্পানির প্রোডাক্ট।”
মালিহা খিলখিল করে হেসে ফেললো। সেই হাসির শব্দে বাচ্চাটা পিটপিট করে তাকালো।
“ও কি খুব বিরক্ত করে আপা?”
“কাল থেকে ঘুমাচ্ছে তো ঘুমাচ্ছেই। ওর বাপও হওয়ার পর এক সপ্তাহ ঘুমের উপর দিয়ে গেছে। ও সেদিকেই যাচ্ছে মনে হয়।” সদ্য দাদি হওয়া মুখটায় ছেলের স্মৃতিচারণ করলেন মহিলা। লতা হাসলো। স্বামীকে হারানোর দুঃখের হাসি, ছেলেকে পাওয়ার সুখের হাসি।

খাওয়া দাওয়া শেষে লতা বলল, “আরেকজন আসবে কখন?”
“ভাইয়া? অফিস ছুটি হলে তারপর আসবে বলল তো।”
“তোমার ভাই নিজেকে খুব চালাক মনে করে। কিন্তু আমি যে বয়সে ওর বড় সেটা মনে হয় ভুলেই গিয়েছে।”
মালিহা ভুরু কুঁচকে বলল, “কেনো? কি হয়েছে?”
“ও কি করেছে শুনবে? বসকে বলে আমার জন্য ছুটি নিয়েছে। আমাদের অফিসে তো এমন লং টাইম ছুটির কোনো সিস্টেম নেই। তাই উনি হাতেম তাই হয়ে আমার ভাগের কাজ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। এবং আমাকে কিছুই জানাননি। আমি তো আর ঘাস খাই না। ঠিকই জেনে গিয়েছি। মহাপুরুষ হতে চান তিনি! ওসব করতে যেয়ে যে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে বান্দার?”
লতার কথায় ক্ষোভ, মুখে কৃতজ্ঞতা, চোখে জল।
“ভালোই তো করেছে।” চিকচিক করতে থাকা জোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে বলল মালিহা।
“তা তো তুমি বলবেই। ভাইয়ের হয়ে সাফাই গাইতে হবে না!”
লতা হেসে ফেললো, “ও হলো ছুপা রুস্তম। ভাবে মানুষ যেনো চোখে পট্টি বেঁধে চলে। আর কোথায় কোথায় কি করেছে আল্লাহই জানে।”
মালিহা দেখলো বিরক্তিমাখা কথার আড়ালে ঝরে পড়া স্নেহ, কৃতজ্ঞতা।

কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথেই তিশা ছুটে এসে দরজা খোলে। নিত্যকার চিত্র। আজ ব্যতিক্রম হওয়াতে মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল। বাড়িতে কেউ নেই নাকি? আরো কয়েকবার বেল চাপলো মালিহা। আজিজা বেগম এলেন পাঁচ মিনিট পর। এই কাঠফাটা রোদে বাইরে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেই ব্যাপারে তার কোনো উদ্বিগ্নতা নেই। শান্ত ভঙ্গিতে দরজা খুললেন তিনি। মালিহা সালাম দিল।
“কেমন আছেন ফুপু?”
“আছি। যেই জ্বরের জন্য এই সপ্তাহ মিস দিলে সেই জ্বর সেরেছে?”
মালিহা চুপ করে গেলো। এক সপ্তাহ তো সে মিস দেয়নি। সাকুল্যে চারদিন। কিন্তু জ্বরের পেছনের কাহিনী তো কেউ জানে না।
“জি সেরেছে।”
কথা বলতে বলতে ঘরে চলে এলো দুজনে। আজিজা বললেন, “তোমার জ্বর ছাড়লেও তোমার ছাত্রী জ্বর বাঁধিয়েছে। আজ পড়তে পারবে বলে মনে হয় না।”
মুহূর্তেই মালিহার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এই কথাটা কি তাকে ফোন জানানো যেতো না? তাহলে এতোটা পথ তাকে কষ্ট করে আসতে হতো না। সে যে কয়েকদিন আসতে পারবে না সেটা তো ঠিকই জানিয়েছিল। বড় করে নিশ্বাস নিল মালিহা। কোনোভাবেই এখানে রাগ দেখানো যাবে না। ভাবলো এসেই যখন পড়েছে মেয়েটার সাথে অন্তত দেখা করে যাক।
“তিশা কি ঘুমাচ্ছে? ওর সাথে একবার দেখা করে যেতাম।”
“যাবে। তার আগে তোমার সাথে আমার কথা আছে।” আজিজার কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো যা মালিহাকে চিন্তা করতে বাধ্য করলো।
“জি বলুন।”
“তুমি জানো তিশা একটু কম বোঝে। একটু না অনেকটাই কম বোঝে। তাকে কোথায় সিলেবাসের পড়া বোঝাবে তা না করে তুমি ওকে নতুন নতুন পড়া শেখাচ্ছো। তাতে হচ্ছে টা কি? ওর টেস্টের রেজাল্ট আগের থেকেও খারাপ হচ্ছে। শোনো মালিহা! ওকে নতুন কিছু শেখাতে হবে না। গল্প লেখার উৎসাহ দিতে হবে না। তোমার কাজ স্কুলের পড়া পড়ানো, ঐটুকুই ভালো মতো করো।”
অপমানে মালিহার মুখ থমথমে হয়ে এলো। সবটা শুকনো ঢোকে গিলে সবটা অপমান পেটের ভেতর পাঠিয়ে দিলো। যতক্ষণ গলার কাছে থাকবে ততক্ষণ ব্যাথা হতে থাকবে।
আজিজা চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে তুলনামূলক শান্ত কণ্ঠে বললেন, “এসো। তিশা ওর ঘরেই আছে।”
মালিহা ছোট ছোট পদক্ষেপে তিশার ঘরে গেলো। অন্ধকার রুম। দরজা খুলতেই এক ফালি আলো মেঝে স্পর্শ করলো। বিছানায় শুয়ে থাকা তিশার রুগ্ন দেহ নজরে এলো। আজিজা দরজা খুলে বিদায় নিলেন। মালিহা হাঁপ ছাড়লো। মহিলা সামনে থাকলে সে আরাম করে কথা বলতে পারতো না।
“তিশা?” তিশার মাথায় হাত রেখে ডাকলো মালিহা। মেয়েটা চোখ খুলল। জ্বর যেনো একেবারে কাবু করে ফেলেছে। উঠে বসতে চাইলে তাকে মালিহা সাহায্য করল।
“আজকে তো পড়তে পারবো না মিস।”
“পড়তে হবে না তিশা। আমি তোমাকে দেখতে এসেছি।” জোর করে ঠোঁটে হাসি টেনে আনলো মালিহা।
“আমার তো মাঝে মাঝেই এমন জ্বর আসে মিস। সেজন্য পড়ায় আরো পিছিয়ে যাই।”
“তাহলে ডাক্তারের কাছে যাও না কেনো? মাঝে মাঝে এভাবে জ্বর আসা তো ভালো কথা না।” তিশার দুর্বল মুখে হাত বুলিয়ে দিলো মালিহা।
“ডাক্তার দিয়ে কি হবে? যতদিন আম্মু আমার সাথে এমন করবে ততদিন আমার এভাবে জ্বর আসবে?”
“আম্মু কি করেছে?”
“আপনি তো কয়দিন আসেননি মিস। প্রথম যেদিন এলেন না সেদিন আমার একটা টেস্ট হয়েছে। ইংলিশ টেস্ট। কালকে সেটার রেজাল্ট দিয়েছে। বিশে চার পেয়েছি। তাই আম্মু আমাকে অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছিল। আমি অন্ধকারে খুব ভয় পাই মিস। এজন্য সবসময় জ্বর চলে আসে।”
“নাম্বার কম পেলেই তোমাকে অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে?”
“হ্যাঁ।”
মালিহা যারপরনাই অবাক। কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। নিজের মেয়ের সাথ কেউ এমন করতে পারে? নাম্বার কম পেয়েছে কিন্তু মেয়েটার চেষ্টা দেখবে না? এমন তো না সে সময় নষ্ট করে। যথেষ্ট চেষ্টা করে তিশা। সব জিনিস এক দেখায় ক্যাচ করতে না পারলেও লেগে থাকার মনোবল মেয়েটার আছে। কিন্তু এই কাজের মাধ্যমে তিশাকে ভেতর থেকে গুড়িয়ে দেয়ার মানে কি?
কি মনে হতেই বালিশের নিচ থেকে একটা খাতা বের করলো তিশা। জ্বরতপ্ত শরীরে যেনো আনন্দ ফিরে এলো।
“মিস আপনার সব হোমওয়ার্ক করেছি। দেখুন একটু আগেও করছিলাম। কিন্তু ইংলিশটা আম্মু ছিঁড়ে ফেলেছে।” মলিন কণ্ঠে বলল তিশা। মালিহা খাতাটা হাতে নিলো। একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে গেলো। চেনা পদ্ধতির বাইরের প্রশ্নগুলো মেয়েটা খুব আগ্রহভরে করেছে। একটাও বাদ রাখেনি। ইংলিশও নিশ্চয়ই খুব সুন্দর করে লিখেছিল? তিশার লেখা ইংরেজি গল্পের উপর মালিহার এক ধরণের লোভ কাজ করে।
“মিস আমি ইংলিশ আরেকবার আপনাকে লিখে দেবো। লুকিয়ে লুকিয়ে লিখবো। আম্মু ধরতে পারবে না।”
ফিসফিসিয়ে বলল তিশা। মালিহা তিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। হাসার চেষ্টা করলো। ভেতর থেকে সায় পেলো না। সে কি আজিজা বেগমকে এমন অমানবিক আচরণের কারণ জিজ্ঞেস করবে? তাকে কি বোঝাবে? সেই অধিকার কি তার আছে?

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৭

বাড়িটা বেশ বড়সড়। গতদিন সেভাবে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। আজ দেখছে মালিহা। লামিয়াদের বাড়িতে তখন তোড়জোড়। রিপা ছোটাছুটি করছে বটে। তবে মালিহা দেখলো কাজ করছে সব বুয়ারা। কাজের লোকেরও অভাব নেই। একজন রান্নার জন্য, একজন ঘর পরিষ্কার করার জন্য, একজন লামিয়ার পেছনে সর্বক্ষণ লেগে আছে। মালিহাকে আসতে দেখে লামিয়ার জন্য বরাদ্দ জন লামিয়াকে ডাকতে গেলো। বুকে পুতুল আঁকড়ে ঢুলতে ঢুলতে বের হলো লামিয়া। তার পেছন পেছন ছুটে আসা মহিলার ভাষা শুদ্ধ। কাপড় চোপড়েও গোছালো ভাব। মালিহা ভাবলো একে বুয়া বলা যায় না। ন্যানি বললে ঠিক হয় কি?
ন্যানি লামিয়াকে কোলে নিয়ে বললেন, “এভাবে বের হয়েছো কেনো লামিয়া? মিস বলবে লামিয়ার কাপড় চোপড় নেই। অগোছালো মানুষকে কেউ পছন্দ করে?”
লামিয়া হু হা করলো। তার ঘুম পুরোপুরি ভাঙেনি। ন্যানি তার মুখ হাত ধুইয়ে, ব্রাশ করিয়ে, জামা পাল্টে দিলেন। লামিয়া এবার লাফাতে লাফাতে এলো। মালিহাকে জাপটে ধরে বলল, “মালি মিস কেমন আছো?”
“ভালো আছি লামিয়া। তুমি কেমন আছো?”
“আমি তোমাকে মালি বলেছি। তুমি আমাকে লামিয়া বললে কেনো? লামি বলবে। ঠিকাছে?” ঘাড় কাত করলো মালিহা। লামিয়ার ছোট ছোট চুলগুলো নেড়ে দিলো।
“মিসকে আপনি করে বলো লামিয়া। তুমি বলতে হয় না।”
লামিয়ার ন্যানি কিছুটা দূরে চেয়ার পেতে বসেছেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে পুরোটা সময় বসেই থাকবেন। কিন্তু এভাবে কেউ গ্যাট মে’রে বসে থাকলে যে মালিহার অস্বস্তি হয় সেটা তাকে কে বোঝাবে। মালিহা ইতস্তত করে বলল, “বলুক সমস্যা নেই। ছোট মানুষ কি অতো বোঝে।”
“বোঝে না বলেই বোঝাতে হবে। এটাই বোঝানোর বয়স।” স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন মহিলা। মালিহা ভাবলো ভালো ঝামেলায় পড়া গেছে। সে লামিয়াকে কি শেখাবে এই মহিলাই তাকে শেখানোর জন্য বসে আছে।
পুরোটা সময় এই অবস্থাই চলল। মালিহা লামিয়াকে একটা বলে ন্যানি সেটার প্রতিবাদ করে লামিয়াকে আরেকটা করতে বলেন। এক পর্যায়ে মালিহা বিরক্ত হলো। তার আসার দরকার কি? এই মহিলা একাই তো একশো। তবে মালিহার বিরক্তি বিস্ময়ে রূপ নিলো যখন লামিয়ার বাবা মা দুজনেই চলে গেলো কিন্তু তাকে কিছু বলে গেলো না। লামিয়াকেও উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেলো না। সম্ভবত সে ইতোমধ্যেই এসবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

মিতুল চুপচাপ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মকবুল আলির এতক্ষণে চলে আসার কথা। আসছে না কেনো? দুপুরে এই খাওয়ার সময়টুকুই তার ছুটি। এখুনি তো দৌড়ে আবার দোকানে যেতে হবে। খারাপ লাগে না মিতুলের। কাজের মাঝে থাকলে অযথা চিন্তা এসে মাথায় ঘুরপাক খায় না। মাস শেষে কিছু টাকা হাতে আসবে এই চিন্তাটাও আপন মামার বাড়িতে আশ্রিত জীবনে একটি স্বস্তি দেয়। মাথার পেছনে হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল মিতুল। আপাটার জন্য বড় চিন্তা হয়। ক্লাস সেভেনে উঠেই সে আপাকে ছাড়িয়ে লম্বা হতে শুরু করেছে। এখন দেখলে মনে হয় সে বড় ভাই আর আপা যেনো তার ছোট্ট বোনটি। সেই বোনটা ঐটুকু শরীর নিয়ে সকাল বিকাল টিউশনি করে কাহিল হয়ে পড়ছে। র’ক্ত ঘাম এক করে চিন্তা করছে কতো সহজে ঐ শহরে শিফট হওয়া যায়। মালিহা এসব কিছুই তাকে বলেনি। কিন্তু সে তো তার আপাকে চেনে। কণ্ঠ শুনে একটু হলেও আঁচ করতে পারে। মিতুল বোঝে না সহজ সমাধানটা কেনো মায়ের ভালো লাগে না। নিজেদের বাড়ি থাকতে এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানোর দরকারটাই বা কি?

অর্ধেক বন্ধ দরজার ওপাশে থেকে মামীর চিৎকার ভেসে আসছে। এমন চিৎকারের জন্যই মিতুলের কানটা পুরো মাস ধরে অপেক্ষা করেছে। গতকাল রাতে বেতন পেয়েছে সে। খুব কম হলেও প্রথম বেতনের আবেগ, অনুভূতি আলাদা। সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়ে স্কুল থেকে আসার পথে বাজার করে এনেছে। সেই বাজারের ব্যাগ নিয়েই হৈ চৈ বাধিয়েছেন মামী। সাইফের হাতেও একটা আইস্ক্রিম ধরিয়ে দিয়েছে মিতুল। ছেলেটার মনে প্যাঁচ নেই। বাবা মা যেদিকে চালাবে সেদিকেই চলবে। প্রকাশ্যে তার বিরোধীতা না করা পর্যন্ত ভাগের মায়াটুকু আটকে রাখত চায় না মিতুল। যেমনই হোক, তার ভাই তো।

“বলেন তো আপা! এইটুকু ছেলে কাজ করে তাই দেখতেই কষ্ট লাগে। সে আবার হাত ভরে বাজার নিয়ে আসছে। মিতুলের যা কাজ না!”
ভাই বউয়ের চোখ মুখের ভান ধরা বিরক্তিটুকু ধরতে বেগ পেতে হলো না নাজিয়াকে। এজন্যই মিতুল জোর করে কাজে ঢুকেছে। কি মনে করে তিনি বললেন, “তুমি তো গোসল করে ফেলেছো। মুরগিটা আমাকে দাও। কেঁ’টে রাখি।”
“ছি ছি আপা! কি বলেন? আমি থাকতে আপনি কাটবেন কেনো? গোসল দরকার হলে আবার করবো। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। ফ্রিজে লেবুর শরবত বানানো আছে। কষ্ট করে মিতুলকে দিন। যেই গরম! একটু পরই তো দোকানে চলে যাবে।”
নাজিয়া চুপচাপ সাইফের মায়ের উচ্ছ্বাস দেখলেন। মাসের উপরে এই বাড়িতে আছে তারা। একটা দিনও কিছু হাতে দিয়ে মিতুলকে দিতে বলেনি। আজ হঠাৎ লেবুর শরবত কোত্থেকে এলো? ইনিয়ে বিনিয়ে মাঝে মাঝেই বলতেন একা এতো মানুষে কাজ করতে পারেন না। নাজিয়া একটু হাত লাগলে সুবিধা হয়। কিন্তু সদ্য বৈধব্যের চাদরে মোড়া নাজিয়ার সংসারের প্রতি মায়া, টান উঠে গিয়েছিলো। হাত বাড়িয়ে কিছুই করতে মন চাইতো না। খাওয়াটুকু খেতেন শরীর চালানোর জন্য। আজ মহিলার অভিব্যক্তি দেখতে নিজ থেকে মুরগীটা কাঁটতে চেয়েছিলেন। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগলো না। ভারী বুক নিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত মিতুলের জন্য নিয়ে গেলেন।

মিতুল সবটাই শুনেছে। অভিজ্ঞতা যেনো হুট করে তার বয়স দশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। মাথার উপর ছায়া না থাকলে গ্রীষ্মের রোদ চিনতে দেরি হয় না। তারও হয়নি। আফসোস মা তার ভাইকে নিজের ছাতা ভেবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ডাট ভাঙা ছাতা যে কারো কাজে আসে না এটা বুঝতে দেরি করে ফেলেছেন।
মায়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে অর্ধেক শরবত খেলো মিতুল। বাকিটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিলো। নাজিয়া দুর্বল কণ্ঠে নিষেধ করলেন, “খাবো না। তুই খা।”
“খাও খাও। ঠুস করে আমিও নাই হয়ে গেলে তখন বুঝবা। তুমি তো আগে কিছুই বোঝো না।”
নাজিয়ার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। জাপটে ধরলেন ছেলেকে, “এমন কথা বলতে পারলি বাপ?”
“এমন কথা কি? হায়াত মউতের ভরসা আছে? আমরা এই আছি এই নাই। জীবন এমনিতেই অনিশ্চিত তার ভিতরে নিজেদের মানুষগুলোর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করার কি দরকার বলো?”
শেষটুকু নরম কণ্ঠে বলল মিতুল। মুখ শুকনো করে বসে থাকা মায়ের দিকে তাকালে তার বুকটা হু হু করে ওঠে। নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটা হারিয়ে মা যেনো নিজেও হারিয়ে যেতে চাইছে।
নাজিয়া অবশ্য মিতুলের কথার গূঢ় রহস্য বুঝলেন না। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন ছেলের ঘর্মাক্ত মুখখানি। মিতুলের আফসোস হয়। মা কেনো আপাকে কখনও এভাবে আদর করে না?

দুপুরে খাওয়ার আগে আগে মকবুল আলী এলেন। মিতুলকে জড়িয়ে ধরলেন সস্নেহে। নাজিয়া তার আগমনের কারণ বুঝতে চেষ্টা করলেন।

“পুকুরে মাছ ধরলো সেদিন। বেচে কিনে যা হলো তাই দিতে আসলাম। ওরা তো মিতুলকে সেভাবে চেনে না। তুমি বললে এরপর থেকে তোমার কাছে দিয়ে যাবে।”
নাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন মকবুল আলী। নাজিয়া একবার টেবিলে রাখা টাকার দিকে তাকালেন। তিনি কিছু বলার আগেই মিতুল বলল, “আমি এসব ঝামেলায় যাচ্ছি না। মা-র আরো আগে যাওয়ার দরকার নাই। আপনার যদি অসুবিধা না হয় তাহলে আপনি এই দিকটা একটু দেখেন।”
মকবুল আলী মাথা নাড়লেন, “অসুবিধা কি? আগেও তো ওরা আমার কাছেই দিত। আমি তোর দাদির কাছে দিতাম। এখন তোদের কাছে দিয়ে দিবো। সমস্যা নাই।”
কিছুক্ষণ নীরবতার পর মকবুল আলী বললেন, “মালিহা বলল ওখানে বাসা বাড়ি খোঁজা শুরু করবে। তোমার কি যাওয়ার নিয়ত পাকা করে ফেলেছো?”
মিতুল মায়ের দিকে তাকালো। নাজিয়া চুপ করে আছেন। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে।
মকবুল আলী নিজেই বললেন, “অনধিকার চর্চা হয়ে যায় তাও বলি। কিছু মনে নিও না। ওখানে মেয়েটা পড়াশোনার জন্য থাকে। বাসা ভাড়া নেয়া তো মুখের কথা না। একটা বাসা গোছগাছ করতে কতকিছু লাগে। সেসব কি এখন কিনবা নাকি এখান থেকে টেনে নিয়ে যাবা? দুইটাই কষ্টের বিষয়। আবার বছরের এই সময়ে মিতুলের ট্রান্সফার ওর জন্যে সমস্যার হবে। পরের বছর এসএসসির প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন যদি সেই স্কুলে খাপ খাওয়াতে না পারে তাহলে ওর পড়াশোনায় মনযোগ হারাবে। ওখানে নিজেদের মানুষ বলতে কেউ নাই। বিপদে আপদে কার কাছে যাবা? আমি বলি কি নিজের বাড়িঘর থাকতে এতো ভোগান্তির দরকারই বা কি? নিজের বাড়ি থাকবা কোনো ঘর ভাড়া লাগবে না। আশপাশে পরিচিত মানুষ। এখানে তোমার ভাই, ওখানে আমরা আছি। ছেলেটা কাজ করতে শিখেছে। আল্লাহ চাইলে তোমার বেশি কষ্ট হবে না। ঠান্ডা মাথায় ভাবো মালিহার মা। স্বামীর ভিটা একবার ছাড়লে ফিরে আসা জটিল হয়ে যাবে।”
এতক্ষণ পর নাজিয়া মুখ খুললেন, “তাহলে আমাকে কি করতে বলেন?”
মকবুল আলী আশা করেননি নাজিয়া তার করে পরামর্শ চাইতে পারে। মায়ের নরম কণ্ঠ শুনে মিতুলের মনে আশার সঞ্চার হলো। জন্মস্থানের সাথে নাড়ির টান থাকে। কেই বা সেই টান ছিন্ন করতে চায়।
“তুমি নিজের বাড়িতে ফিরে চলো। তোমার বাড়ি, তোমার সংসার। মতি তোমার হাতে ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব দিয়ে গেছে, তার বাড়িঘর ছেড়ে গেছে। সেগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব তো তোমারই। আগের মনোমালিন্য ভুলে যাও। আমি বড়, আমার উচিত ছিল ভাইয়ের সাথে ঝগড়ায় না যাওয়া। অথচ ঝগড়াটা আমিই জিইয়ে রেখেছি।” কৌশলে স্ত্রীর কথা এড়িয়ে গেলেন। জনসম্মুখে স্ত্রীর বদগুন বলে তাকে ছোট করায় কোনো ফায়দা নেই। তিনিও হুশ হারিয়েছিলেন। নয়তো স্ত্রীর অন্যায় কথায় তাল দেবেন কেনো!
“তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে যেয়ে সম্পদ হারিয়ে ফেললাম। তারপর হুশ ফিরল। কিন্তু মানুষটার ফেরার তো আর উপায় নাই।” কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো মকবুল আলীর। আজ শুধু ছোট ভাইটার কথা মনে হয়ে বুক পুড়ছে। কিন্তু আগে হলে ক্ষমা চাওয়ার কথা তিনি চিন্তাই করতে পারতেন না।
নাজিয়া হকচকিয়ে গেলেন। সম্পর্ক যেমনই হোক, তিনি ভাসুর হন, বয়সে বড় মানুষটার থেকে এমন কথা শুনে তার পাথর মন কেঁদে উঠলো। নিজে মায়ের পেটের ভাই তো কোনোদিন কাছে বসিয়ে দুইদণ্ড ভরসার কথা শোনালো না। যে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয় না তার কাছে ভরসার বাণী আশা করা যে বোকামি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন নাজিয়া।
“মালিহার সাথে একবার কথা বলে নেই ভাইজান। তারপর আপনাকে জানাবো।”
“ইনশাআল্লাহ্।” মকবুল আলীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। হাসলো মিতুলও। নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আশা এবং মায়ের মুখে বোনের প্রতি গুরুত্ব তাকে পুলকিত করেছে। এবার বুঝি এই পরগাছা জীবনের ইতি ঘটলো।

ফুরফুরে মন নিয়ে অফিস থেকে বের হলো ইতমিনান। তার মন ভালো করার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল মানিক এবং লালপাহাড়। উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে তাদের দিকে এগিয়ে গেলো ইতমিনান।
“আরে মানিক মিয়া যে! কি অবস্থা তোমার?”
“ভালা।” মানিকের চোখে মুখে ইতস্তত ভাব। ইতমিনান ভুরু কুঁচকে বলল, “কি হয়েছে?”
“কি হইবো? কিসুই না। বড়লোক মাইনষের স্বভাব খালি সন্দেহ করা।”
“আমি মোটেও বড়লোক নই মানিক। পকেটে টাকা নাই, বাড়িতে বউ নাই। বড়লোক বলার কোনো কারণ নাই।” হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল ইতমিনান। চলতে শুরু করল সে। তার সাথে মানিক। পেছনে লালপাহাড়।
“ক্যান আপনের বউ কই গেসে?” মানিকের কণ্ঠে চিন্তার আভাস।
“বিয়েই তো করিনি। বউ পাবো কোথায়?”
মানিকের চিন্তা বদলে বিরক্তি প্রকাশ পেলো। ঢোলা প্যান্টের পকেট থেকে ছোট একটা বোতল বের করে ইতমিনানের দিকে বাড়িয়ে বলল, “বউ আছে আপনের শশুর বাড়ি। আপনে মাল খান।”
বড় বড় করে মানিকের দিকে তাকালো ইতমিনান। তার হাতে ক্লেমনের বোতল। মানিক গলা ফাটিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “ভদ্দর লোকের ভয়। মালের নাম শুইন্নাই চোখ খুইলা আসতাছে।”
ইতমিনান ছোট্ট বোতলটা হাতে নিলো। আপ্লুত চোখে দেখলো কারো ইনকামের প্রথম খরচ।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে