উষ্ণতা পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
95

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩২

তুষারকে কুকুর কামড়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। কোচিংয়ে মোটামুটি হুলুস্থুল পড়ে গেছে। সব টিচার তুষারকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে নিতু নির্বিকার। তার অতো হেলদোল নেই। ম’রে টরে গেলে একটা কথা ছিল। সে এসেছে বেতন নিতে। তুষারের অনুপস্থিতিতে সমস্যা হবে না। সে নিজেরটা নিজে নিয়ে নিতে পারে। সেই এখতিয়ার তার আছে।
তুষারের টেবিলের ড্রয়ারে এই দুইদিনের বেতন রাখা আছে। অনেক স্টুডেন্ট বেতন দিয়ে দিয়েছে। মাসের পাঁচ তারিখের মাঝে অগ্রিম বেতন দেয়া নিয়ম। সেখান থেকে গুণে গুণে নিজের বেতনটা নিয়ে নিলো নিতু। কয়েকজন বাঁকা চোখে তাকালো। শব্দ করে ড্রয়ার বন্ধ করে নিতু বলল, “আপনারা না রোগী দেখতে যাবেন? যাচ্ছেন না কেনো? নিজেরাই রোগী হয়ে গেলেন নাকি?”
বয়স এবং পদে বাকি টিচাররা নিতুর থেকে নিচের দিকে আছে। কাজেই কেউ উচ্চবাচ্য করলো না। সবাই হাসপাতালের পথ ধরলে নিতু কোচিং বন্ধ করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ক্লাস টাইম হয়ে এসেছে। টেবিলের উপর নতুন তালা চাবি। দরজাটাও নতুন। তুষার বেশ গুছিয়ে এনেছিল। বোঝাই যাচ্ছে।
নিতু ব্যাগ হাতে নিতেই আঁখি এসে হাজির হলো। দুজনে ক্লাসমেট হলেও কথা বার্তা খুব কম হয়। নিতু হলে থাকে না। দেখা সাক্ষাৎও সেভাবে হয় না। তবুও আঁখিকে দেখে নিতু চমকালো না। যেনো জানাই ছিল আঁখি আসবে। ফের চেয়ারে বসলো নিতু। বিনা বাক্য ব্যয়ে সামনের চেয়ার ঠেলে দিলো। আঁখিকে আসন গ্রহণের নিঃশব্দ আহ্বান।
“কেমন আছো?”
“ভালো। তুমি?” নিতু আঁখির চোখের দিকে তাকালো। সেখানে চাপা একটা ক্ষোভ আছে। প্রকাশ না করার সর্বোচ্চ চেষ্টায় রত মেয়েটা। তবুও নিতু বুঝে ফেললো। কেনো? তার নিজের ভেতরেও কি ওরকম ছাই চাপা ক্ষোভ আছে? কে জানে।
“আছি। কোচিং বন্ধ করে দিচ্ছিলে নাকি?” আশপাশে তাকিয়ে বলল আঁখি। কেউ নেই। বোঝাই যাচ্ছে।
“হ্যাঁ। ক্লাস টাইম শেষ। আমারও ক্লাস আছে। ক্যাম্পাসে যাবো।”
“ওহ। আমি মালিহার বেতনটা নিতে এসেছি।” নিতুর দিয়ে তাকিয়ে বলল আঁখি। নিতুর ভুরু কুচকে এলো।
“মালিহার বেতন কি ওর নিয়ে যাওয়া উচিত না? এখানে প্রক্সি দেয়ার মানে কি?”
আঁখির মনে হলো নিতু তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে খোঁচা দিচ্ছে। কারণটা বুঝলো না সে। নিতুর সাথে তো তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এই নিয়ে আর মাথা ঘামালো না আঁখি। সোজাসাপ্টা বলল, “মালিহা প্রচণ্ড অসুস্থ। কয়েকদিন আগে সিরিয়াস জ্বর এসেছিল। দুর্বল হয়ে পড়েছে। ক্লাসও করছে না। আর ও আমাকে পাঠায়নি। ও এই বিষয়ে জানেও না। আমি নিজেই এসেছি। ভেবেছিলাম তুষারের সাথে দেখা করবো। কাজেই প্রক্সি দেয়ার কথাটা ভিত্তিহীন।”
“রাগ করলে নাকি? মালিহা সম্ভবত এখানে আর আসবে না। ওর এই মিনমিনে ভাবটা আমার পছন্দ না। যাই হোক। মনে হচ্ছে তুমি সবটা জানো। আরো একটু জেনে যাও। তুষারকে গতকাল কুকুর কামড়েছে। সিভিয়ার অ্যাটাক। ভালোই হয়েছে।”
আঁখি দৃশ্যত চমকে গেলো। বিস্ময় ভাব তাকে ঘিরে রইলো। তুষারের ঘটানো ঘটনা, তুষারের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। কোথাও যেনো খুব সূক্ষ্ম একটা মিল আছে, একটা যোগসূত্র আছে। আঁখি মেলানোর চেষ্টা করলো। পারলো না। নিতুর কণ্ঠে তার ধ্যান ভাঙলো।
“এই যে মালিহার বেতন।” পরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার একটু তাড়া আছে। কিছু মনে করো না। বের হতে হবে।”
“সমস্যা নেই। ধন্যবাদ। আমি আসছি।”
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আঁখি ভেবে ভেবে কাহিল হয়ে গেলো। তার সিক্সথ সেন্স বলছে ঘটনাটা যেনো কাকতালীয় নয়। পরিকল্পিত। তবে ভাবনার কুল কিনারা পেলো না সে। আঁখি বেমালুম ভুলে গেলো জগতের কোনকিছুই আসলে কাকতালীয় নয়। অদৃশ্য এক সত্তা সব ঘটনার মাঝেই যোগসূত্র রেখে দেন। খুব সূক্ষ্মভাবে।

অনেকদিন পর চুলা জ্বা’লিয়েছে ইতমিনান। এতদিন হোটেলের খাবারে খেয়ে খেয়ে তার পেট পচে গেছে। এমনটাই তার ধারণা। বাজারে নতুন টমেটো এসেছে। কিনে নিয়ে আসা টমেটো চচ্চড়ি আর গরম ভাত। খাবারটার চেহারা মনে করতেই পেটে আরেকটা পাক দিলো। ভাত তখনও হয়নি। মাত্র চাল ফুটতে শুরু করেছে। মনটা ঘোরানো দরকার। নয়তো খাবারের চিন্তায় চোখ অন্ধকার হয়ে আসবে।
টমেটো চচ্চড়ি ঢেকে রেখে ঘরে গেলো সে। ভেজা হাত গেঞ্জিতে মুছে ফোন হাতে নিলো। নিজের সর্বনাশ নিজে কিভাবে করে কেউ তার কাছে শিখুক। ভাবতেই ইতমিনানের হাসি পায়। যে মেয়েটার কণ্ঠ শুনলে, যে চেহারাটা দেখলে প্রতিনিয়ত সে দুর্বল হয়ে পড়ে তাকেই বারবার দেখতে চাওয়ার, শুনতে চাওয়ার কি আকুলতা। এজন্যই বুঝি পোকার দল ছুটে ছুটে আগুনের কাছে যায়।
চারবার রিং বাজার পর ফোন ধরলো মালিহা। শোনা গেলো তার দুর্বল কণ্ঠ, “আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আছি আলহামদুলিল্লাহ্। ঠান্ডা লেগেছে নাকি?”
“একটু জ্বর এসেছিল।”
“কবে?” ইতমিনান শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো।
ইতস্তত কণ্ঠে জবাব দিলো মালিহা, “ঐদিন রাতে।”
কিছুক্ষণের নীরবতা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতমিনান বলল, “ঠান্ডা কি বেশি? ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?”
“না। ক্যাম্পাসের মেডিকেল সেন্টার থেকে চেকাপ করিয়ে এসেছি। ওষুধ দিয়েছে।”
“আচ্ছা। বেশি খারাপ লাগলে বলিস।”
“আচ্ছা।”
“মালিহা?”
“হু।”
“বিকেলের ঐ টিউশনিতে যাচ্ছিস?”
“এই কয়দিন যাইনি। আজ থেকে যাবো ভাবছি।”
“আমি এক জায়গায় কথা বলেছিলাম। আমার ফ্রেন্ডের বোনের ছেলে না মেয়ে যেনো। ছোট বাচ্চা। তোর আগ্রহ থাকলে কথা বলব। দুই এক ঘন্টা ওকে সময় দিতে হবে। এই আর কি। গেলে বলিস।”
মালিহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
“বাসা কোথায়?”
“আমিও জানি না। রনি, আমার ফ্রেন্ড যেতে বলেছে একদিন। সেদিন যেয়েই নাহয় কথাবার্তা বলে দেখলাম। সুবিধা হলে যাবি নাহলে বাদ। এখানে তো কোনো জোর নেই।”
“তোমার কেমন ফ্রেন্ড?” ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো মালিহা। ইতমিনান বুঝলো।
“ভালো বন্ধু। তবে ওটা তো ওর বাড়ি না। ওর বোনের বাড়ি। ও তো ওখান থাকেও না। আর গেলে তো সব দেখে শুনেই আসবো। যাবি?”
মালিহার মন হলো ইতমিনানের আগ্রহ আছে। এই উপকারী মানুষটার কথায় সে না বলবে কিভাবে?
“আচ্ছা যাবো ইনশাআল্লাহ্।”
“আচ্ছা রাখি।”
“হু।”

.

রাত নামতেই নাজিফা এলো। মালিহার হাত ধরে বলল, “কেমন আছো? ক্লাসে যাচ্ছো না। অসুস্থ?”
মালিহা প্রথম প্রশ্নটা নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করলো। কেমন আছে সে? বিপদের মুখ থেকে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে এনেছেন। আর একটু এদিক সেদিক হলে কি হতে পারতো সেটা মালিহা চিন্তাও করতে পারে না। দুঃসহ ভবিষ্যতের হাতছানি থেকে বেঁচে আসা একটা মানুষ কেমন থাকে?
দৃঢ় কন্ঠে মালিহা বলল, “আলহামদুলিল্লাহ্। অনেক ভালো আছি। একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। শরীরটা তাই ভালো লাগছিল না। এজন্য ক্লাসে যাইনি।”
“দ্রুত ভালো লাগিয়ে ফেলো। আর ক্লাস মিস দিলে মাথা আর মাথা থাকবে না।” নাজিফা হাসলো। যোগ দিলো মালিহাও। যাওয়ার সময় কি মনে করে মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে গেলো নাজিফা। মালিহার মনে হলো ঐ স্পর্শটুকুর তার খুব দরকার ছিল। খুব বেশি।

রাত আটটার দিকে আঁখি রুমে এলো। মালিহার হাতে তুলে দিলো বেতনের সাত হাজার টাকা। মালিহা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “আপনাকে দিয়ে দিলো?”
“নিতু দিয়েছে। তুষারকে নাকি কুকুর কামড়েছে। হসপিটালাইজড।”
মালিহা চমকে উঠলো। যে লোকটা দুদিন আগে নিজে হিং’স্রাত্মক আচরণ করেছে তার সাথেই আবার একই ঘটনা ঘটলো!
ফোন বেজে উঠল কথা থামালো মালিহা। নিতু ফোন দিয়েছে। খোঁজ খবর নেয়ার পর নির্বিকার কণ্ঠে নিতু বলল, “কোচিংয়ে আসা বাদ দিলে তুষারের কি যাবে আসবে? তার চেয়ে ওর সামনে দিয়ে সব কাজ করবে। ও দেখবে আর ফুলবে। কিছুই করতে পারবে না।”
“কিছুই করতে পারবে না?” যেনো নিজেকেই জিজ্ঞে করলো মালিহা। কে নিশ্চয়তা দিলো যে তুষার একই কাজ পুনরায় করার চেষ্টা করবে না?
“এভাবে ভীতু হয়ে থাকলে তো জীবনে চলতে পারবে না।”
নিতুর কথার বিপরীতে মালিহা ভাবলো সে ভীতু? বেশ! ভীতুই সই।
“এভাবে সারাজীবন আমি চলতেও চাই না আপু। শুধু কয়েকটা দিন। ভাইটা বড় হলেই আমি ইস্তফা নেবো।”
নিতু আর কিছু বলল না। ফোন রেখে মালিহা ভাবলো, তুষারদের মুখোমুখি না হওয়াকে ভীতু বলে? এড়িয়ে যেয়ে সে যদি বিপদ থেকে বেঁচে যায়? তবুও?

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৩

অফিসে এসে চমকপ্রদ এক তথ্য পেলো ইতমিনান। বস নাকি নোটিশ দিয়েছেন। সেই নোটিশ পড়ে সকলে বসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ইতমিনান নিজেও সেটা পড়লো। প্রশংসা করার মতোই বটে। অফিসের সকল নারী কর্মীর জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি হিসেবে চার মাস সময় বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রশান্তির হাসি হাসলো ইতমিনান। লতা আপা শেষ মেষ ছুটি পেয়েই গেলো। ফুরফুরে মন নিয়ে তার দিন শুরু হলো। ঘণ্টা খানিক পর বসের রুমে ডাক পড়ল তার। মনে মনে হিসাব করলো কোনো কাজ উল্টাপাল্টা হয়েছে নাকি। উহু! মনে পড়ছে না। প্রমোদ গুনলো ইতমিনান। বস তো আলাদা করে কাউকে ডাকেন না। যা বলার মিটিংয়েই বলে দেন। কপালে কি আছে আল্লাহই জানেন।
দুরু দুরু বুক নিয়ে অনুমতি চাইলো ইতমিনান। ভদ্রলোক দরাজ গলায় ভেতরে ঢুকতে বললেন। লোকটা চোখ থেকে চশমা খুলে ল্যাপটপের শাটার আধ বোজা করে রাখলেন। ইশারায় ইতমিনানকে বসতে বললেন। ইতমিনান বসলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “আজকে নোটিশ বোর্ড চেক করেছেন?”
“জি স্যার। করেছি।”
“এটার ক্রেডিট কিন্তু আপনার!”
“সরি। ঠিক বুঝলাম না স্যার।”
“আমার মিসেস তো ঘটনা শুনে রেগে-টেগে একাকার। মহিলা কর্মী অফিসে আছে অথচ ম্যাটার্নিটি লিভ নেই। আপনার আবেদনের কথা শোনার পর তো বাড়িতে টেকাই দায় হয়ে পড়েছিল। হা হা!”
বসকে আজ বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। ইতমিনানের কাছে তাই মনে হলো। বউয়ের ঝাড়ি খেয়ে এতো আনন্দ? বিয়ের সমীকরণ বড়ই জটিল!
“আপনার জন্য কফি বলবো নাকি চা?”
থতমত খেয়ে গেলো ইতমিনান। কিসের ভেতর কি। বসের অফার ফিরিয়েও দিতে পারল না।
“চা।” ভেতরে ঢোকার সময় ইতমিনানের বুক দুরু দুরু করছিলো। এখন মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তাও ভালো। বসের থেকে চায়ের অফার পেয়েছে। চাট্টিখানি কথা নাকি!
ভদ্রলোক পিয়নকে ডেকে দুই কাপ চা দিতে বললেন। হাসিমুখে ইতমিনানের দিকে তাকালেন। বললেন, “আপনি একটা অস্বাভাবিক আবেদন করেছিলেন। ভাবতেই কেমন অযৌক্তিক লাগছিল। লং টাইম তো এভাবে কারো প্রক্সি দেয়া সম্ভব না। তার চেয়ে আপাতত রুল সেট করে দিলাম। কিন্তু আপনি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?”
“কোন বিষয়ে স্যার?”
“এই যে, ম্যাটার্নিটি লিভ নিয়ে।”
কিছুক্ষণ ভাবলো ইতমিনান। মাথা নাড়িয়ে বলল, “না স্যার। কোন বিষয়ের কথা বলছেন ধরতে পারছি না।”
ভদ্রলোক আবার হাসলেন। কণ্ঠ নিচু করে বললেন, “লতা ছাড়া কিন্তু অফিসে বিবাহিত আর কোনো মহিলাই নেই। কাজেই এই রুল আপাতত অ্যাপ্লাই হওয়ার কোনো চান্স নেই।”
ইতমিনান ভাবলো। আসলেই। এই অফিসে একমাত্র বিবাহিত মহিলা লতা। আবার বিধবাও বটে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান। বস হেসেই যাচ্ছেন। তার কাছে সম্ভবত মনে হচ্ছে তিনি খুবই চালাকি একটা কাজ করেছেন। বউয়ের ঝাড়ি খেয়ে বিবেক নড়ে উঠেছে। ম্যাটার্নিটি লিভ সেট করেছেন। প্রশংসা পেয়েছেন। অথচ কেউ ছুটি পাচ্ছে না। চালাকি বটে। খুশি হওয়ারই কথা। ইতমিনান অল্পবিস্তর হাসলো। তৃপ্তি করে উচ্চপদস্থ চা খেলো।

পরের শনিবারে রনির বোনের বাড়িতে মালিহাকে নিয়ে গেলো ইতমিনান। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান। তার ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আর যার উপর দিয়ে পুরোটা গেছে তার না জানি কেমন লাগে। মালিহার দিকে তাকালো ইতমিনান। একভাবে বসে আছে। কোনো নড়চড় নেই। একটু পর রিপা এলো। রনি তার পিছু পিছু। রনি হাসিমুখে সকলকে পরিচয় করিয়ে দিলো। রিপা মালিহার হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে গেল। মালিহার কাছে মনে হলো রিপা বেশ মিশুক। ইতমিনানের কাছে সে শুনেছে, রিপা নাকি বিদ্যুৎ অফিসে বড় পোস্টে চাকরি করে। সাধারণত যেমন হয়, বড় পদে চাকরিরত ব্যক্তি সবসময় একটু অন্যরকমভাবে চলতে পছন্দ করে। যেনো তার কথা বার্তায়ই পদ মর্যাদা বোঝা যায়। সাধারণভাবে চলতে তাদের অনেকের নারাজ। রিপাকে দেখে তেমন কিছু মনে হলো না। খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে বিছানায় খেলতে থাকা মেয়ের পাশে তাকে বসিয়ে দিলো রিপা।
“এই যে তোমার ছাত্রী। ও কিন্তু খুব জ্বালাতন করে। বুয়াদের কাউকে এক দণ্ড স্থির থাকতে দেয় না। বাড়ি এসে সবই শুনি। তুমি কতদিন টিকতে পারো সেটাই দেখার পালা।” মালিহা স্মিত হাসলো। হাত বাড়িয়ে দিলো মেয়েটার দিকে। সে চোখ বড় বড় করে মালিহার দিকে তাকিয়ে ছিল। নতুন কাউকে দেখে সম্ভবত পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। তার মাঝে মালিহা হাত বাড়িয়ে দিলে ঝট করে কোলে চলে এলো। মালিহা প্রায় বিছনায় শুয়েই পড়ছিল। সে মনে করেছিল অচেনা মানুষের কাছে বাচ্চাটা আসবে না। অপ্রস্তুত থাকার কারণে এলোমেলো দশায় পড়তে হলো। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠলো। যেনো খুব মজা পেয়েছে। রিপা গলা মোটা করে বলল, “লামিয়া! এমন করে না।”
লামিয়া একবার মায়ের দিকে তাকালো। তবে মায়ের আদেশ নিয়ে আর ভাবলো বলে মনে হলো না। মালিহার গালে এক আঙুল দিয়ে চিকন গলায় বলল, “তোমার নাম কি?”
মালিহা হাসলো। মেয়েটা বেশ চটপটে।
“মালিহা।”
“পুরো নাম বলো। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে পুরোটা বলতে হয়।” একদম বড়দের মতো করে বলল লামিয়া।
“মালিহা ইসলাম।”
“আমার নাম ইয়াশা জান্নাত লামিয়া। তোমার আর আমার নামের একটা মিল আছে। কি বলো তো?”
“জানি না তো।”
“তোমার নাম মালি আর আমার নাম লামি। মিল না!”
“হ্যাঁ! তাই তো!”
“আমার বয়স পাঁচ বছর। তোমার কতো?” পাঁচ আঙুল তুলে দেখালো লামিয়া।
“তোমার থেকে ষোলো বছরের বড় আমি। তাহলে বলো আমার কতো বছর।”
“একটু সহজ করে বললে কি হয়? আমি তো ষোলো পর্যন্ত গুনতেই পারি না। বারোর পরে শুধু বাইশ চলে আসে। তেরোটা আসতেই চায় না।” ঠোঁট উল্টে বলল লামিয়া।
রিপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “শুরু হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা এতো কথা বলতে পারে!” পরপর লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন থেকে মালিহার কাছে তোমাকে পড়তে হবে। মিস বলে ডাকবে তাকে। নামো এখন।”
পড়ার কথা শুনে লামিয়ার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। মালিহার দিকে তাকিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে নরম কণ্ঠে বলল, “তুমি আমাকে পড়াবে? মা’রবে? গল্প করবে না?”
“মা’রব কেনো? এমন মিষ্টি পাখিকে কেউ মা’রতে পারে? গল্পই তো করবো। গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে একটু পড়বো।”
লামিয়া নিরস গলায় বলল, “মা’রতে পারে। সবাই আমাকে মা’রে।”
রিপা বিব্রত হয়ে বলল, “যাও লামিয়া বুয়া চা বানিয়েছে নাকি দেখে আসো। দ্রুত যাও।”
লামিয়া ছুটে গেলো। মালিহা বুঝলো মেয়েটার মন ঘোরানো খুবই সোজা। কিন্তু রিপার লুকোছাপা তার চোখ এড়ালো না।

বেশ কিছুক্ষণ থেকে দুজনে বের হলো। ঘড়িতে তখন সকাল এগারোটার কাছাকাছি সময়। ইতমিনান বলল, “কেমন লাগলো?”
“ভালোই। ভার্সিটির কাছে আছে। যাতায়াতে সুবিধা হবে।”
ইতমিনান মাথা নাড়লো। মালিহা ইতস্তত করে বলল, “বেতনের কথা তো কিছু বলল না।”
“তোকে বলেনি? রনি যে বলল আমাকে।” মালিহা ইতমিনানের মুখের দিকে তাকালো। ইতমিনান আবার বলল, “দশ দেবে বলেছে।”
“দশ হাজার!” মালিহার কণ্ঠে বিস্ময়।
“লামিয়ার আগের টিচারকেও এমনই দিত। কিন্তু লামিয়া নাকি বেশি দুষ্টুমি করে তাই ছেড়ে দিয়েছে।”
ঢোক গিললো মালিহা। কতো দুষ্টুমি করে যে দশ হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে দিলো!
“খাটনিও তো কম হবে না। প্রতিদিন দুই আড়াই ঘণ্টা সময় দিতে হবে। এসব বাচ্চা কাচ্চা সামলানো ধৈর্যের বিষয়। তাছাড়া রনির দুলাভাই বিশাল বড়লোক। সেই রমরমা ব্যবসা। এই মাসে দুবাই যায় ঐ মাসে অস্ট্রেলিয়া যায়। বিশাল ব্যাপার স্যাপার। ওদের কাছে দশ হাজার কোনো বিষয় না।”
মালিহা মনে করলো বিদায়ের সময়ে রিপার করা আকুতি। সে হাত ধরে বলেছিলো তার মেয়েটার যেনো খেয়াল রাখে। মালিহার ভয় হলো। সে পারবে তো?

ইতমিনানকে কে যেনো ফোন করলো। হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে পড়লো সে। মালিহা ঘাবড়ে গেল। নানান দুশ্চিন্তা খেলে গেলো মাথায়। ইতমিনান ফোন রেখে বলল, “তোকে হল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার এক কলিগকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ইমারজেন্সি অবস্থা। তুই একা যেতে পারবি না?”
“পারবো। কি হয়েছে তার?”
“প্রেগনেন্ট ছিলো। পেইন উঠেছে।” বলতে বলতে একটা রিকশা ডেকে দিলো ইতমিনান। ভাড়া মিটিয়ে দেয়ার সময় মালিহা নিষেধ করলেও শুনলো না। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, “পৌঁছে আমাকে একটি মেসেজ দিস।”
মালিহা কণ্ঠ উঁচু করে বলল, “সাবধানে যেও।”
ইতমিনান ততক্ষণে বিপরীত দিকে ঘুরে গেছে। আতিপাতি করে রিকশা খুঁজছে। মালিহার রিকশা ছেড়ে দিলেও সে পেছনে তাকিয়ে রইলো। ইতমিনান ফোনে কথা বলছে। কি যেনো বলে পেছনে তাকালো। মালিহার রিকশার দিকে ছুটতে শুরু করলো। মালিহা দ্রুত রিকশাওয়ালাকে বলল, “মামা! দাঁড়ান দাঁড়ান!”
রিকশা থামতে থামতে ইতমিনান পাশে চলে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “মালিহা তোর ব্লা’ড গ্রুপ কি?”
“এ পজেটিভ।”
“ব্লা’ড দিতে পারবি? ইমারজেন্সি দুই ব্যাগ লাগবে।”
“পারবো।”
ইতমিনান রিকশাওয়ালাকে হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে দিলো। নিজেও আরেকটা রিকশা নিয়ে ছুটলো হাসপাতালের দিকে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৪

ওয়েটিং রুমে বসে আছে বয়স্ক দুজন ব্যক্তি। দুজনেরই চোখে মুখে ভয়। ঘামে জবুথবু হয়ে সেখানে এলো ইতমিনান। তার পেছনে মালিহা। ইতমিনানকে দেখে যেনো বৃদ্ধ মানুষ দুজন হালে পানি পেলো। তড়িৎ গতিতে উঠে এসে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। কান্নার শব্দ এতোই জোরে ছিলো যে অপারেশন থিয়েটার থেকে নার্স বেরিয়ে এলো। বিরক্ত মুখে বলল, “এখানে এতো শব্দ করবেন না। ভেতরে ডাক্তার, রোগী সবার সমস্যা হচ্ছে।” বলেই ফিরে যেতে চাইলো নার্স মহিলাটি। আবার ফিরে এসে বলল, “আপনাদের র’ক্ত ম্যানেজ করার কথা বলেছিলাম। করেছেন?”
ইতমিনান এগিয়ে এলো, “জি। হয়েছে। রোগীর কি অবস্থা? নরমালে হবে?”
“বেবীর পজিশন উল্টো হয়ে আছে। নরমাল সম্ভব না। সি সেকশনে যেতে হবে। রোগীর শরীরে র’ক্ত নেই বললেই চলে। কে র’ক্ত দেবে?”
মালিহা এগিয়ে এলো, “আমি।”
“কিছু টেস্ট করতে হবে। দ্রুত আসুন।”
নার্স মহিলা অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে গেলো। পরপরই বের হয়ে এসে মালিহাকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও ছুটলো। ইতমিনান বৃদ্ধ লোকটার হাত ধরে বলল, “কান্নাকাটি করবেন না আঙ্কেল। আল্লাহ ভরসা।”
লোকটা উপর নিচ মাথা নাড়ালো। লতার শাশুড়ি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। দেখে মনে হলো যেন শরীর ছেড়ে দিয়েছে।
“আঙ্কেল আন্টি কি অসুস্থ?”
“না। আমরা আর কি অসুস্থ হবো। মেয়েটার চিন্তায় এই অবস্থা..”
ইতমিনান আর কিছু বলল না। অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে লাগলো। গলার কাছের দুটো বোতাম খুলে দিলো। উপরে তাকিয়ে দেখলো ফ্যান আছে। আশপাশে তাকিয়ে সুইচ খুঁজলো। সুইচ বোর্ডের ভয়ানক অবস্থা। এক জায়গা থেকে লাল কালো তার বেরিয়ে আছে। গরমটা সয়ে নিলো ইতমিনান। জীবন বাঁচানো ফরজ।
মালিহা ফিরে এলো। সেই নার্সটি এসে বললেন, “কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স আসবে। তার সাথে যেয়ে র’ক্ত দিয়ে আসবেন।” মালিহা সম্মতি জানালে মহিলা অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়ল।

দুই ব্যাগ র’ক্ত নিয়ে মালিহা আর নড়তে পারছে না। নার্স মালিহার হাত থেকে ক্যানোলা বের করে ইতমিনানকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, “ওনাকে একটু গ্লুকোজ খাইয়ে দিন। কিছুক্ষণ রেস্ট করলে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্।”
ইতমিনান তখনই গ্লুকোজ কিনে আনলো। দুইদিন আগের জ্বর আর আজ রক্ত দিয়ে মেয়েটা একদম নেতিয়ে পড়েছে। কিছুটা গ্লুকোজ খেয়ে মালিহা বলল, “আমি এখানেই একটু শুয়ে থাকি। থাকতে দেবে না?”
ইতমিনান কর্মরত নার্সের দিকে তাকালো। তিনি আশ্বস্ত করে জানালেন থাকা যাবে। মালিহা রোগীর স্পর্শ মাখা মলিন সাদা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। হাতটা ব্যথায় নাড়ানো যাচ্ছে না। ইতমিনান মালিহাকে বলল, “তুই এখানে থাক। আমি ওদিকে যাই। সমস্যা হলে ফোন দিস।”
মালিহা দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ইতমিনান ছুটলো অপারেশন থিয়েটারের সামনে। ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ আসছে। ডেলিভারি হয়ে গেছে? লতার শ্বশুরকে আশপাশে দেখা গেলো না। লতার শাশুড়ি অস্থির হয়ে উঠে বসেছেন। বাচ্চার কান্না সম্ভবত তাকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি জুগিয়েছে। ইতমিনান তাকে বলল, “আন্টি আংকেলকে দেখছি না।”
“কোথায় যেনো গেলো। একটু আশপাশে দেখো তো বাবা।”
মহিলা নিজেই জানেন না। ইতমিনান তাকে আর ঘাটালো না। এদিক ওদিক ঘুরল। ভদ্রলোককে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বাচ্চার কান্না যেহেতু শোনা যাচ্ছে আশা করা যায় আর কিছুক্ষণের মাঝেই তাকে বের করে আনবে। এর মাঝে লোকটা গেলো কোথায়।
করিডোরের শেষ মাথায় একটা ঘর। তার দরজা অর্ধেক বন্ধ। ইতমিনান একবার সেই ঘরে উঁকি দিলো। ভেতরটা নজরে আসতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেলো। লতার শ্বশুর মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছেন।
লতার শশুরের সাথে ইতমিনানের বেশ কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। একবার আযানের সময় তাকে মসজিদে যাওয়ার কথা বললে তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান। ইতমিনান বুঝে আর তাকে জোর করেনি। এ তো জোর জবরদস্তির বিষয় নয়। সেই একই মানুষটাকে আজ স্বেচ্ছায় মালিকের দরবারে ধর্না দিতে দেখে ইতমিনান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মানুষ বড়ই আজব প্রাণী। নিজ প্রয়োজন কড়ায় গন্ডায় বোঝে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তা তার মাঝে থাকে না। প্রয়োজনের সময় যার কাছে নিজেকে উজাড় করে দেয়, প্রয়োজন মিতে গেলে তাকে ভুলে যায় বেমালুম।
প্রায় দশ মিনিট পর সিজদাহ থেকে উঠে বসলেন ভদ্রলোক। আস্তে ধীরে সালাম ফেরালেন। ইতমিনান দরজা নক করে বলল, “আঙ্কেল বাবুকে মনে হয় নিয়ে আসবে। আসুন?”
ভদ্রলোক তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলেন। ইতমিনান তার পিছু পিছু গেলো। ওয়েটিং রুমে পৌঁছাতেই মনোরম এক দৃশ্য দেখে চোখ জুড়ালো দুজনে। লতার শাশুড়ি বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাউমাউ করে কেঁদে চলেছে। লতার শ্বশুর এগিয়ে যেয়ে বাচ্চাকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বুকে ঠেকালেন। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ্!”
তার দরাজ গলার শব্দ ইতমিনানের ধ্যান ভাঙলো। লোকটা তখনও চোখ বন্ধ করে আছে। কাকে মনে করছে? মৃ’ত ছেলেকে নিশ্চয়ই?
“ছেলে নাকি মেয়ে?”
মিহি কণ্ঠের শব্দে পেছনে তাকালো ইতমিনান। মালিহা দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
“তুই উঠে আসলি কেনো?”
“ওখানে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। মেয়ে নাকি ছেলে হয়েছে?”
“শুনে নিই দাঁড়া।”
ইতমিনান লতার শ্বশুরের কাছে যেয়ে উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করলো। মালিহা বেজায় বিরক্ত হলো। শুনলেই হয়। এমন উকি দেয়ার কি আছে। মালিহা নিজেই মহিলার দিকে এগিয়ে গেলো।
“আন্টি ছেলে নাকি মেয়ে?”
“ছেলে।” চোখ মুছে তৃপ্ত কণ্ঠে বললেন মহিলা।
“আপা কেমন আছেন?”
“কিছুক্ষণ পর কেবিনে দিয়ে দেবে। ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ্।”
মালিহা ইতমিনানের কাছে যেয়ে বলল, “বাচ্চার বাবা কই? দেখছি না যে।”
এক নজর মালিহার দিকে তাকালো ইতমিনান। বলল, “মা’রা গেছে।”
মালিহা কথাটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না। ভেবেছিল বাচ্চার বাবা বোধহয় দূরে কোথাও। কিন্তু সেই দুরত্ব যে অসীম সেটা বুঝতে পারেনি। মুহূর্তেই বাচ্চাটার জন্য বুকে এক সাগর মায়া অনুভব করলো সে। সে তো তার বাবাকে দেখেছে, বাবার আদর স্নেহ পেয়েছে। যথেষ্ট স্মৃতি আছে সারাজীবন ধরে মনে করার জন্য। কিন্তু এই ছোট্ট বাচ্চাটা তো বাবাকে চিনলোই না। বাবা কাকে বলে সে তো জীবনে বুঝবেই না। ধীর পায়ে হেঁটে লতার শ্বশুরের সামনে গেলো মালিহা। র’ক্তাভ মুখটায় নজর রেখে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো।
“নেবে মা?”
লতার শ্বশুরের নরম কণ্ঠ। মালিহা মাথা নাড়লো, “না আঙ্কেল। হাতে জোর পাচ্ছি না। পরে যায় যদি!”
ইতমিনান অবশ্য এগিয়ে এলো। আগ্রহ করে ছেলেটাকে কোলে নিলো। ইতস্তত করে লতার শ্বশুরকে বলল, “ইয়ে আঙ্কেল.. বাচ্চার কানে তো আযান দিতে হয়। আমি দিই?” বলেই মনে হলো ভুল গিয়ে গেছে। তিনি বাচ্চার দাদা। তার নিশ্চয়ই ইচ্ছে মৃ’ত ছেলের শেষ চিহ্ন হিসেবে পাওয়া নাতির কানে তিনি আযান দেবেন। ভদ্রলোক সৌজন্য করে হ্যাঁ বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই ইতমিনান বলল, “না থাক। আপনিই দিন। বাচ্চার দাদার হক বেশি।”
হাসিমুখে বলে ছেলেকে এগিয়ে দিলো ইতমিনান। ভদ্রলোক বেশ আপ্লুত কন্ঠে আযান দিলো। এর মাঝেই লতাকে কেবিনে নিয়ে গেলো। ইতমিনান গলা নিচু করে মালিহাকে বলল, “লতা আপার সাথে তো চেহারার কোনো মিলই নেই। তুই পেয়েছিস?”
“আমি তো লতা আপাকেই দেখিনি।”
“ওহ তাই তো!”

লতা নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আছে। মালিহাকে দেখে সম্ভবত চিন্তে পারেনি। লতার শাশুড়ি এগিয়ে এসে বললেন, “ইতমিনানের চাচাতো বোন। ওই তো তোমাকে র’ক্ত দিলো।”
লতা কৃতজ্ঞ চোখে তাকালো মালিহার দিকে। মালিহা তার হাত চেপে ধরলেও কিছু বলতে পারলো না। শ্বাস নিলেও মনে হচ্ছে সেলাইয়ে টান পড়ছে।
কি মনে করে মালিহা লতার শাশুড়িকে বলল, “আন্টি ওর নানা নানী কেউ বেঁচে নেই?”
মহিলা নাতিকে জড়িয়ে বসে ছিলেন। এক পলক মালিহার দিকে তাকিয়ে বললেন, “না গো মা। অভাগীর কেউ নেই। ভাই যা আছে, সৎ ভাইও তার চেয়ে ভালো হয়। বিয়ের পর থেকে একটা দিন মেয়েটার কোনো খোঁজ নেয়নি।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মহিলা। মালিহা চট করে লতার দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কথাগুলো শুনেছে নাকি বোঝা যাচ্ছে না।
মালিহার শরীর ততক্ষণে দুর্বল ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি বুঝতে বেশি সময় লাগলো না তার। দরজার বাইরে বসে থাকা ইতমিনানের কাছে গেলো সে। তার পাশেই লতার শ্বশুর বসে আছে। ইশারায় ইতমিনানকে ডাকলো মালিহা।
“কি হয়েছে?”
“লতা আপার কেউ নেই?”
“শ্বশুর শাশুড়ি আছে। এই যে ছেলে হলো।”
“বাপের বাড়ির?”
“না থাকার মতোই।”
“তাহলে আমি হলে চলে যাই।”
“এর সাথে তোর হলে যাওয়ার কি সম্পর্ক?”
“কিছু রান্না করে আনতে হবে না? মহিলা মানুষ শুধু আপার শাশুড়ি। তাকে এখন মা ছেলের কাছেই থাকতে হবে। উনি কি রান্না করে আনতে পারবেন?” লতার শশুরকে ইশারা করে বলল মালিহা। “তাছাড়াও রোগীকে এখন হালকা পাতলা খাবার খাওয়াতে হবে। বাইরের জিনিস তো একদম না।”
“এই জিনিসটা তো আমার মাথায়ই আসেনি।” ঘড়ির দিকে তাকালো ইতমিনান একটা তের বাজে। মালিহাকে বলল, “তুই একটু বস। আমি নামাজটা পড়ে বাজার করে আনি।”
মালিহা নিষেধ করল না। এই শরীর নিয়ে বাজারে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার ছিলো না।
লতার শ্বশুরকে ডাকলো ইতমিনান, “আঙ্কেল আযান দিচ্ছে। চলুন নামাজটা পড়ে আসি?”
ভদ্রলোক বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাল মেলালেন ইতমিনানের সাথে। ইতমিনান স্মিত হাসলো।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে