উষ্ণতা পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
64

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৯

মনিকা দম ছাড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। একবার জলপট্টি দিচ্ছে, একবার হাত পা মালিশ করছে, আবার মাথায় পানি ঢালছে। কিন্তু মালিহার জ্বর কমার কোনো লক্ষণ নেই। দিশেহারা হয়ে আঁখিকে বলল, “আপু একটু দেখুন। ওর তো জ্বর কমছে না। কি করবো?”
আঁখি চিন্তিত মুখে মালিহাকে দেখছিল। দুই বছর ধরে দেখছে মেয়েটাকে। হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার মতো মেয়ে সে নয়। হালকা বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে এটা কেনো যেনো মনে হচ্ছে না আঁখির। গম্ভীর মুখ মালিহার বিছানার সামনে এসে সে দাঁড়ালো। মনিকা তখন মালিহার পায়ে তেল দিচ্ছে। সামনে রাখা চেয়ারটা টেনে সেখান থেকে বালতি তুলে নিয়ে আঁখি বলল, “তুমি তেল মালিশ করো। আমি ওর মাথায় পানি দিচ্ছি।” মনিকা তাই করলো। পানি পাল্টে এনে বসলো আঁখি। মালিহার মাথার কাছে। চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ডান হাতে পানি ঢালতে শুরু করলো। বাম হাত বুলিয়ে দিলো মাথায়। তাপ যেনো শরীর থেকে বের হয়ে শেষ হচ্ছে না। এতো জ্বর কিভাবে বাঁধালো মেয়েটা?
ঘড়িতে তখন সাতটা দশ। নীতি বিরতিহীনভাবে ফোন দিচ্ছে মালিহার ফোনে। শেষমেষ মনিকা রিসিভ করলো।
“হ্যালো নীতি?”
নীতি ধমক দেয়ার জন্য মুখ খুললেও কথাটুকু গিলে নিলো। মনিকা আপু কেনো?
“মনিকা আপু?”
“হ্যাঁ। মালিহার খুব জ্বর রে! বেহুশের মতো পড়ে আছে।”
ঘাবড়ে যাওয়া কণ্ঠে নীতি বলল, “কখন জ্বর এলো? ওর তো জ্বর টর বেশি একটা আসে না। মেপেছিলেন? কতো ডিগ্রি?”
“মাপিনি। একশ তিন চার তো হবেই। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে মনে হয়। আমি তেল মালিশ করছি। আঁখি আপু মাথায় পানি দিচ্ছে। দেখি কিছু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেবো। দোয়া কর রে নীতি।”
নীতিকে শেষটুকু বলতে হতো না। তার মুখ বাক্য না সাজালেও মন ইতোমধ্যে মালিহার সুস্থতার জন্য রবের কাছে ধর্না দিতে শুরু করেছে।
মনিকা ফোন রাখতেই আঁখি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “ওকে ধরো মনিকা। কিছু খাওয়াতে হবে।”
আঁখি মাথা ওঠাতে চেষ্টা করলো। হঠাৎ করেই গুঙিয়ে উঠলো মালিহা। কান্না যেনো ছিটকে বের হলো তার বুক থেকে। বিড়বিড় করতে শুরু করলো সে। আঁখি চমকে গিয়েছিলো কান্নার শব্দে। পরপর মাথা নিচু করলো কথা বোঝার জন্য। ভগ্নকণ্ঠে মালিহা বলছে, “ছেড়ে দিন..না..তুষার ভাই..ছেড়ে দিন..আল্লাহ!”
আঁখির কপালের ভাঁজ সহসাই টান টান হয়ে গেলো। চোখ দুটো যেনো কোটর ছেড়ে বের হয়ে আসতে চাইলো। শুকনো ঢোক গিললো সে। মনিকা তাড়া দিলো, “আপু! ধরুন ওকে?”

মালিহা যখন কোচিংয়ের কথা বলেছিল তখনই ইতমিনান খোঁজ নিয়েছে। যতটুকু খোঁজ করা যায় সে করেছে। তুষারের মুখটা সে চেনে। সেই চেনা মুখটা খুঁজতেই বিকেলেও গিয়েছিলো ওখানে। পায়নি। ভাঙা দরজাটা কোনো রকমে লাগানো ছিল। আশপাশের মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করেছিল ইতমিনান। একজন অপরিচিত মানুষের মতো কোচিংয়ের খোঁজ নিয়েছে। তারা বলেছে আজ সকালে নাকি একটা মেয়ে ওখানে আটকে গিয়েছিলো, তারপর একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এসে দরজা ভেঙে ভেতরের মেয়েটাকে বের করে নিয়ে গেছে। কোচিংয়ের স্যারকে কেউ দেখেনি। মানুষগুলো গম্ভীর মুখে বলছিলো, “ভিতরে বহুত কাহিনী আছে বুচ্ছেন মামা?” ইতমিনান গুরুতর ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে চলে এসেছে। বুঝতে পেরেছে ওরা কেউ জন না আটকা পড়া মেয়েটা যে এই ভার্সিটিরই ছাত্রী।

পেটের ভেতর শব্দ হচ্ছে। দুপুরে দুই লোকমা খেলেও তারপর আর কিছু পেটে পড়েনি। খেতে ইচ্ছেই করেনি। খুঁজে খুঁজে এই শহরে চাকরি করার কি কারণ ছিলো তার? কেউ কি জানে? জানে না। শুধু তার মন জানে। আর জানে সেই মনের মালিক। সেই শহরের একমাত্র পরিচিত মানুষটা, তার মনকে অবাধ্য করে দেয়া মানুষটার ঐ অবস্থা ইতমিনানকে যেনো চোখের পলক ফেলতেও ভুলিয়ে দিয়েছে। আর একটু, শুধুমাত্র আর কিছুটা সময় পরে গেলে কি হতো? কেমন অবস্থায় দেখতো মালিহাকে? আদৌ দেখতে পেতো? ভাবতেই ইতমিনানের গায়ে কাঁটা দেয়। ভাবনার গতি রুদ্ধ হয়ে সাথে কাজের। মুখটা বিতৃষ্ণায় ভরে আসে। ক্ষুধা লাগলেও কিছু খেতে মন চায় না। চোখের উপর হাত রাখল ইতমিনান। একটু ঘুমানো দরকার। কিন্তু সেই উপায় কি আছে? চোখ বন্ধ করলেই মালিহার কান্নামাখা মুখটা ভেসে উঠছে। ধপ করে উঠে বসলো ইতমিনান। বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো। হু হু করে ছুটে এলো ঠান্ডা হাওয়া। জানালার জং ধরা গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো ইতমিনান।

চোখ বন্ধ করলেও ভাবনার গতি রুদ্ধ করা গেলো না। সে ছুটতে ছুটতে মালিহার কাছেই চলে গেলো। কি করছে মেয়েটা এখন? খুব কান্নাকাটি করেছে? কার সাথে মন খুলে কথা বলবে? কারো কাছে নিশ্চয়ই এই ঘটনা বলবে না? বাড়িতে কিছু বলেছে কি? নাহ, বলার কথা না। চাচীর সাথে তো ওর অতো খোলামেলা সম্পর্ক নয়। তাহলে? মেয়েটা কি একা একাই কেঁদে কেঁদে গুমরে বেড়াচ্ছে?
রিংটোন ইতমিনানকে আর ভাবতে দিলো না। আয়েশা ফোন দিয়েছেন। কিন্তু আজ তো মমতাময়ীর সাথে আন্তরিকতাসহ কথা বলতে পারবে না ইতমিনান। তার মুখ দিয়ে যে কথাই আসছে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন ধরলো ইতমিনান। আয়েশা প্রথমে সালাম দিয়ে বিজয়ী কণ্ঠে বললেন, “আজকে আমি আগে সালাম দিয়েছি!”
ইতমিনান হাসলো। অল্পবিস্তর সে হাসি।
“কেমন আছো মা?”
“ভালো আছি। তোর কি শরীর খারাপ? কণ্ঠটা এমন লাগছে কেনো?” আয়েশার কপালে চিন্তার ভাঁজ।
“না শরীর খারাপ না। অফিসে একটু কাজের চাপ।”
“অফিস অফিস করে তো তুই ম’রেই যাবি দেখছি। সেই কবে গিয়েছিস। বাড়িতে আয় আব্বা!” আকুতি করে বললেন আয়েশা।
ইতমিনান বলল, “কই কবে গিয়েছি? এক মাসের একটু বেশি হলো এলাম। এতো ঘন ঘন বাড়ি গেলে আমার আর চাকরি করা লাগবে না। তাছাড়া কয়েকদিন পরই দুর্গা পূজার ছুটি দেবে। তখন তো বাড়িতে যাবোই।”
“আমি এতো কিছু বুঝি না। পূজার ছুটি সেই কবে! এর আগে একবার আসবি না?”
“অনেক কাজ মা। এখন তো যাওয়া সম্ভব না।” নরম কণ্ঠে বলল ইতমিনান। সে তো আর কাউকে বলতে পারছে না যে দুজনের কাজ সে একাই করছে। কাউকে বলার দরকারও নেই। যে জন্য করছে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হলেই হলো। লতা আপা বাচ্চা সহ সুস্থ থাকলেই হলো।
“শোন ইতু! আমি তোর জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। এবার যখনই আসবি মেয়েকে দেখতে যাবো। তোর কোনো কথা আর শুনবো না। চাকরি ফাকরির কথা অনেক শুনেছি। তোকে তো আর রাক্ষসের সাথে বিয়ে দেবো না যে খাওয়াতে পারবি না। নিজে খেতে পারলে বউকেও খাওয়াতে পারবি। আর সবচেয়ে বড় কথা যার যার রিজিক তার তার। তাই ওসব নিয়ে চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। বিয়ে করলে আল্লাহ রিজিকে বরকত দেন।”
“মা!” একই সাথে বিস্ময়, চিন্তা তাকে ঘিরে ধরলো।
“কোনো মা না। আমি ওদের কথা দিয়ে দিয়েছি।”
“কিসের কথা দিয়েছো? বিয়ের?” ইতমিনানের স্বর আটকে গেলো।
“আরে না। ধুম করে আবার বিয়ের কথা দেয়া যায় নাকি? দেখতে যাবো এই কথা দিয়েছি। মেয়ে, মেয়ের পরিবার সব দিক দিয়েই আমার পছন্দ হয়েছে। মিলির ননদের কেমন আত্মীয়। যাক তুই আয়। তোর পছন্দ হলেই তারপর কথাবার্তা আগানো যাবে।”
শেষ কথাটুকু শুনে দম ছাড়লো ইতমিনান। পছন্দ হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। এবার যেয়েই রাবেয়া ফুপুর সাথে কথা বলতে হবে। একটা কিছু ব্যবস্থা না করলে হচ্ছে না।
“আচ্ছা।”
“আরেকটা কথা শোন ইতু।” এবার যেনো আয়েশার কণ্ঠটা আরেকটু গম্ভীর শোনা গেলো।
“বলো।”
“ওখানে কাছাকাছি আছিস, চাচাতো ভাই চাচাতো ভাইয়ের মতোই থাকবি। অবিবেচকের মতো কোনো কাজ করবি না। তোকে নিয়ে আমার অনেক শখ।”
ইতমিনান প্রতি উত্তর করতে পারলো না। আয়েশা কল কেঁটে দিয়েছেন। অব্যক্ত ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ইতনিনান যেনো খেই হারালো। শেষের কণ্ঠটা শখ নয় যেনো হু’মকির কথা বলল। সবটা এতো জটিল হয়ে যাচ্ছে কেনো?
ফোনের স্ক্রিন সামনে এলে অজান্তেই মালিহার নাম্বার খুঁজলো ইতমিনান। একবার ফোন দিয়ে দেখবে মেয়েটার কি অবস্থা? কিছুক্ষণ আগের আদেশ ভুলে ফোন দিলো সে। কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষটা সেই ডাকের প্রতি উত্তর করলো না। ইতমিনান ক্লান্তির শ্বাস ছাড়লো। ভাবলো হয়তো ঘুমাচ্ছে মালিহা।

সারা শরীর ঘেমে গেছে। ঘুমের মাঝেই মালিহার অস্বস্তি লাগলো। মশারি বোধহয় কোনো দিক দিয়ে পড়ে গেছে। সেই ফাঁক দিয়ে মশা ঢুকে উল্লাস প্রকাশ করে মুখের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সহসাই ফোন ধরতে পারলো না মালিহা। চোখ টেনেটুনে যখন খুললো তখন ফোন কেঁটে গেছে। ঘুম ভেংগে গেলেও উঠে বসলো মালিহা। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। কিছুক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলো সে। শরীরের ঘর্মাক্ত ভাবটা বিরক্ত করলে জামা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলো। আজ পুরো রুমের লাইট বন্ধ। কি ব্যাপার? সবাই ঘুমিয়ে গেছে নাকি?
আস্তে ধীরে খাট থেকে নামলো মালিহা। তবে সে খেয়াল করেনি নীতির বিছানায় কেউ শুয়ে আছে। তাকে দেখেই উঠে এলো আঁখি। অন্ধকারে মালিহা ভয় পেয়ে গেলো। আঁখি আশ্বস্ত করতে বলল, “আমি আঁখি। ভয় পেয়ো না।” আলগোছে মালিহার হাত ধরলো আঁখি। মালিহা দম ছাড়লো।
“কি হয়েছে? খারাপ লাগছে?”
“না আপু। ঘেমে গেছি। জামাটা পাল্টাবো। আপনাদের খুব বিরক্ত করলাম।” শেষটুকু বিব্রত কণ্ঠে বলল মালিহা। আঁখি সৌজন্য মাখা উত্তর করলো না। শুধু মাথা নাড়লো। ফের যেয়ে মালিহার বিপরীতে নীতির বিছানায় বসলো। মালিহা জামা নিলো। একটু পানি খেলো। আঁখি মাথা নিচু করে দুই হাত বিছানায় ঠেকিয়ে বসে আছে। মালিহা যখন দরজার সিটকিনিতে হাত রাখলো তখন আঁখির ফিসফিসানি কণ্ঠ শোনা গেলো, “তুষার তোমার সাথে কি করেছে মালিহা?”
মালিহার হাত সহসাই থেমে গেলো। সে অনুভব করতে পারলো তার হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে। হু হু করে

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩০

কোনো এক অজানা কারণে হল পাড়া আজ নিঝুম। রুমগুলো অন্ধকার। বাতি নিভিয়ে সবাই পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের দেশে। থেকে থেকে ভেসে আসছে হুতুম প্যাঁচা আর নাম না জানা এক পাখির ডাক। নিশ্ছিদ্র নীরবতাকে খুব যত্ন করে গভীর করে তুলছে গুটিকয়েক শব্দের উৎস। মালিহা অনুভব করছে তার শরীর আবার ঘেমে উঠছে। আঁখি জানলো কিভাবে? তুষার কি সবাইকে বলে দিয়েছে? সবাই জেনে গেছে? কতটুকু জেনেছে? কপালের স্বেদ বিন্দু মুছতে কম্পমান হাত তুললো মালিহা। আঁখি নীরবে সবটা দেখলো। বারান্দার আলো জানালার কাঁচ ভেদ করে রুমের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জানিয়ে দিচ্ছে ঘরটা কতো অন্ধকার।
“আমার পাশে বসো মালিহা।”
মালিহা দ্বিতীয় কোনো বাক্য ব্যয়ের প্রয়োজন মনে করলো না। চুপচাপ আঁখির পাশে বসলো। আঁখি ঘুরে বসলো মালিহার দিকে। ক্রমশ শীতল হতে থাকা মালিহার হাত জোড়া নিজের মুঠোয় নিলো। হালকা চাপ দিয়ে বলল, “আমাকে সবটা বলো মালিহা। তোমাকে ওখানে আমি পাঠিয়েছি। আমার ভরসায় তুমি সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের কাছে গিয়েছ। আমাকে জানতে হবে। বলো।”
মালিহা আঁখির দিকে তাকালো। আঁখির মুখে আলো লাগছে। মালিহা অন্ধকারে। তার মনে হলো এই বেশ। তার মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যাবে না। থেকেও না থাকার মতো করে কথাগুলো বলে ফেলবে। ফাঁকা ঢোক গিললো মালিহা। নিজের মতো করে বলতে শুরু করলো ঘটনা।
মনিকা “সর সর” করে উঠলো। ঘুমের ভেতরে কথা বলার অভ্যাস আছে তার। কি যেনো বিড়বিড় করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ঘুলঘুলি থেকে একটা টিকটিকি মাথা বের করে আশপাশ দেখলো। সুযোগ বুঝে ছাদের মাঝখানে যেয়ে ডাকতে শুরু করলো। টিকটিক টিকটিক..
আঁখি শান্ত ভঙ্গিতে সবটা শুনলো। কথার মাঝে বাঁধা দিলো না। হু হা করলো না। মালিহা যখন নিজের বক্তব্য শেষ করে চুপ করে বসে আছে তখন শুধু আঁখি বলল, “সরি মালিহা। না জেনে তোমাকে মানুষের মতো দেখতে একটা প্রাণীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। পারলে আমাকে মাফ করে দিও।”
কথাটুকু শেষ করে উঠে পড়ল আঁখি। মালিহা হঠাৎ করেই বলল, “কাউকে বলবেন না আপু। প্লিজ!” এক মুহুর্ত থামলো আঁখি। পরপর দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো। মালিহা উদ্বিগ্ন হলো না। রাত বিরাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিডিং রুমে কাটানোর রেকর্ড আছে আঁখির।
কিছুক্ষণ পর মালিহা নিজেও উঠলো। জামা পাল্টাতে গেলেও পানির সংস্পর্শে এসে গোসলের সিদ্ধান্ত নিলো। চুল তখনও আঁধভেজা। কাজেই ওটাকে দ্বিতীয়বার ভেজানোর ভাবনা বাদ দিলো।
ঝরঝরে শরীরকে ঘিরে ধরলো মসৃণ নীরবতা। মস্তিষ্ক সচল হলো। আজকের ঘটনার প্রভাব কতদূর গড়াবে? কোচিংয়ে যাওয়ার এক মাস হয়ে গিয়েছিল। তুষারের কথা অনুযায়ী দুই একদিনের মাঝে তার হাতে সাত হাজার টাকা আসার কথা ছিল। সে তো দ্বিতীয়বার আর ঐ কোচিংয়ে যাবে না। টাকাটাও পাবে না? আচ্ছা আশপাশের মানুষ কিছু জানে? জানলে কতোটা জানে? ভার্সিটিতে তার কথাটা কি প্রচার হয়ে যাবে? মানুষ কি তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে? আর ভাবতে পারলো না মালিহা। তার জীবনটা এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেনো?
টেবিলের উপরে রাখা কুরআন শরীফের উপর চোখ পড়ল। হাত বাড়িয়ে সেটা টেনে নিলো মালিহা। অপলক দেখলো তাকে। এই বইয়ের মাঝে লিখে রাখা প্রত্যেকটা কথা রবের। প্রত্যেকটা কথা। ভাবতেই কেমন যেনো লাগলো। অথচ গলা দিয়ে টু শব্দ করতে ইচ্ছে করছে না। দেয়ালে হেলান দিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো মালিহা। কুরআনটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলো। কুরআন কি শুষে নিতে পারবে তার হৃদয়ের সবটুকু জট?

লতার কাছে ফোন দিয়েছিলো ইতমিনান। ভালো আছে সে। রনির কাছে ফোন দেবে কি না ভাবছে। ছেলেটা তো আর কিছু বলল না। হ্যাঁ না কিছু তো একটা বলবে। ভাবতে ভাবতে ফোন দিলো ইতমিনান। বন্ধুর খোঁজ তো নেয়াই যায়। প্রথমবারে রনি কল রিসিভ করলো না। ইতমিনানও আর ফোন দিলো না। একটু পর রনি কল ব্যাক করলো।
“কেমন আছিস দোস্ত? সরি রে! এতদিন যোগাযোগ করতে পারিনি।”
“না সমস্যা নেই। আছি ভালোই। তোর কি অবস্থা?” ইতমিনানের গলায় স্বভাবসুলভ উৎফুল্ল ভাবটা নেই। তবে রনি সেটা ধরতে পারল না।
“আব্বু খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল মাঝে। আব্বুকে নিয়ে ছোটাছুটি করতে যেয়েই আর তোকে কল টল করতে পারিনি।”
“কি হয়েছে আংকেলের?”
“আর বলিস না। ছোটখাট স্ট্রোক করেছিল। তারপর এক ইতিহাস।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রনি।
“এখন কেমন আছেন?”
“আছে আলহামদুলিল্লাহ। এখন ভালোই আছে।”
“তুই সুস্থ আছিস তো?”
“বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেলো ইতমিনান। এই একটা মাসে আমাকে এই কথাটা কেউ জিজ্ঞেস করেনি। যে-ই ফোন দেয় আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করে, আব্বুর খোঁজ নেয়। তুই প্রথম আমার খোঁজ নিলি।” রনির গলায় স্পষ্ট অভিমান। বন্ধুর মনোভাব টের পেয়ে ইতমিনান বলল, “অসুস্থ মানুষের খোঁজই তো সবাই নেবে তাই না? তাকে নিয়ে ভয় বেশি। তোর কাছে ফোন দিয়ে তো জানতেই পারছে যে তুই ভালো আছিস।”
স্মিত হেসে রনি বলল, “বোঝাচ্ছিস? বোঝা। আর কারো থেকে না শুনতে চাইলেও অন্তত.. আচ্ছা বাদ দে এসব। তোর ঐ চাচাতো বোনটার কি খবর? আমি আপাকে বলেছিলাম। আপা বলেছে একদিন যেয়ে দেখা করে আসতে। তুইও আয় ওর সাথে। দেখা করি একদিন।”
ইতস্তত করলো ইতমিনান। সে যে কিছু করেছে এটা মালিহাকে জানাতে চাইছিল না। কিন্তু আজ যা হলো তারপর মেয়েটাকে একা কোথাও যেতে দেয়ার কথে মনে পড়লেই ভয় লাগছে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সম্মতি দিলো সে।
“কবে যাবো?”
“আচ্ছা আমি আপার সাথে কথা বলে তোকে জানাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”

দম ছাড়লো ইতমিনান। অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। আজকাল চিন্তা তার পিছু ছাড়ছে না। একটা শেষ হয় তো নতুন আরেকটা চিন্তা এসে যোগ হয়।

নীতিকে খুব বেশি মিস করছে মালিহা। আর কিছু না হোক নীতির হাতটা ধরে বসে থাকলেই তার শান্তি লাগতো। মেয়েটাকে ফোন করা দরকার। তবে কোনোভাবেই এদিকে আঁচ দেয়া যাবে না তাকে। নীতি অস্থির হয়ে যাবে।
বিছানায় শুয়ে এই চিন্তাই করছিলো মালিহা। মনিকা সকালে তাকে কি যেনো খাওয়ালো। বিদঘুটে স্বাদ। মালিহা কিছু বলতেও পারেনি। এতো আগ্রহ করে, যত্ন করে কেউ কিছু খাওয়ালে নিষেধ করা যায় না। নাক মুখ বন্ধ করে খেয়েছে মালিহা। কিন্তু একটু খেয়েই পেট ভরে গেছে। তারপর মনিকা জোর করে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। যদিও মালিহা বলেছিলো এখন তার ওষুধের দরকার নেই। কিন্তু মনিকা শোনেনি। আঁখির কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো তার। চোখ খুললো মালিহা। আঁখি রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“ক্লাসে যাবে না?”
“না আপু। ভালো লাগছে না।”
আঁখি চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “কোচিংয়ে যাবে না? মাসের বেতনটা..”
“পেলে তো ভালো হতো আপু। কিন্তু আমি আর ঐ লোকটার মুখোমুখি হতে চাচ্ছি না।”
আবার চোখ বন্ধ করলো মালিহা। শুয়ে পড়লো নিশ্চিন্তে। আসলেই নিশ্চিন্তে?
আঁখি মালিহার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। ব্যাগ ঘাড়ে বের হয়ে গেলো। তার মাথায় ঘুরছে নিতুর কথা। নিতুর সাথে দেখা করতে পারলে কাজ হতো। বেশ কয়েকজনের কাছে খোঁজ করে নিতুর নাম্বার সংগ্রহ করলো আঁখি।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩১

মানিক কিভাবে লালপাহাড়কে রাজি করিয়েছে ইতমিনান জানে না। তবে আজ কয়েকদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লালপাহাড় ইতমিনানের সাথে হাঁটতে রাজি হয়েছে। ইতমিনান অবশ্য বলেছে প্রতিদিন একটা করে পাউরুটি সে পাবে। তবে লালপাহাড় চুক্তিতে কতটুকু সায় জানিয়েছে সেটা জানা যায়নি।
পড়ন্ত বিকেলে লালপাহাড়কে নিয়ে হাঁটছে ইতমিনান। পকেটে তার ছোট্ট একটা পলিথিন। পলিথিন বের করে সেখান থেকে নির্দিষ্ট জিনিসটা লালপাহাড়ের নাকের সামনে ধরলো ইতমিনান। প্রথমে সে খুব আগ্রহ নিয়ে নাক এগিয়ে দিলো। কিন্তু একই জিনিস বুঝতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইতমিনান বিব্রত হলো। ঠিক কতবার এক জিনিসের গন্ধ পেলে সেই গন্ধ আর কোনো কুকুর ভোলে না এটা তো সে জানে না। কাজেই সকাল বিকাল হোমিওপ্যাথি ডোজের মতো কাজটা করে যাচ্ছে সে। তবে এই ক্ষণে লালপাহাড়ের প্রতিক্রিয়া দেখে ভয় পেলো ইতমিনান। বিরক্ত হয়ে আবার তার উপরে ঝাপিয়ে পড়বে না তো কুকুরটা?

ক্যাম্পাসের সেকেন্ড গেট। এখানে ছোটখাট একটা পার্ক আছে। বাচ্চাদের পার্কটা বিকেল হলে জমজমাট হয় ওঠে। বাবা মা বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে আসেন। কখনও কখনও দাদা দাদীকেও দেখা যায়। পকেটে হাত গুজে হাঁটছে ইতমিনান। একটা মুখের খোঁজ করে চলেছে কয়েকদিন ধরে। পাচ্ছে না। আজ হোক কাল হোক, আসবেই তো। সেই আশাতেই সকাল বিকাল এই এলাকায় চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে সে। কোচিংয়ের সামনে আসতেই সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো ইতমিনান। কোচিংয়ের সদর দরজায় আজ তালা নেই। হাট করে খোলা। ভেতরে আলো জ্বলছে। তার মানে নিশ্চয়ই মানুষ আছে? সন্তর্পনে মুখোমুখি একটা চায়ের দোকানে বসলো ইতমিনান। নিজের জন্য চা নিলেও লালপাহাড়কে আজ কিছু দিলো না। সে জানে দুপুরের পর থেকেই কুকুরটা না খাওয়া। মানিক কথায় কথায় বলেছে। লালপাহাড় ইতমিনানের পায়ের কাছে বসে আছে অনুগত ভঙ্গিতে। তবে সময় পেরিয়ে গেলেও যখন নিত্যদিনের মতো খাবার পেলো না তখন সে মনিবের মুখের দিকে তাকালো। ইতমিনান নিচু হয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “এখনকার জন্য সরি। আপাতত তোমার হাঙ্গার এবং অ্যাঙ্গার এই দুটো ইস্যুই আমাকে কাজে লাগাতে হবে। তবে প্রমিস! কাম তামাম করতে পারলেই স্পেশাল ট্রিট আছে। ওকে?”
লালপাহাড় কিছু বুঝলো কি না বোঝা গেলো না। তবে ইতমিনানের হাতের খাবারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। একটু দূরে যেয়ে সামনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসলো। ইতমিনান তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে দেখলো লালপাহাড়ের সামনের ডান পায়ে নতুন একটা ক্ষত। এখনও শুকায়নি। তার মানে ব্যাথা আছে নিশ্চয়ই? তার কুচকানো ভুরুর নিচে চোখদুটো চকচক করে উঠলো। জিহ্বা বের করে সে যখন শ্বাসকার্য চালাচ্ছে তখন পরিকল্পনার সাগরে ভেসে লালপাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট নেড়ে শব্দহীন ভাষায় ইতমিনান বলল, “মানুষ বড়ই স্বার্থপর লালপাহাড়!”

তিন কাপ চা শেষ করে ফেলেছে ইতমিনান। বড় শান্ত তার ভঙ্গি। বোধ হয় এই প্রথম একসাথে তিন কাপ চা শেষ করলো সে। তবুও তার মাঝে বিরক্তির লেশ মাত্র নেই। দরকার পড়লে আরো তিন কাপ খেতে পারবে সে। দৃঢ় চিত্তে বসে আছে ইতমিনান। দোকানীর অলক্ষ্যে একবার তাকে পরোখ করে নিলো সে। পকেটে হাত দিয়ে ফোন বের করলো। অযথাই হোম স্ক্রিনে হাত ঘুরিয়ে কানে ধরলো ফোনটা। সেকেন্ড দশেকের মাঝে কথা বলতে শুরু করলো ইতমিনান।
“কতো দুর তুই?”
“আমি তো সেকেন্ড গেটে বসে আছি।”
“এই হবে পনেরো মিনিট।”
“আচ্ছা আয়। দ্রুত আয়। মাগরিবের আগে বাসায় যাবো।”
ফোন পকেটে রাখলো ইতমিনান। কথাগুলো বেশ জোরেই বলেছে। দোকানীসহ দোকানে থাকা বাকি দুইজন ক্রেতা স্পষ্টই সব কথা শুনেছে। মনে মনে হাসলো ইতমিনান। ফোনের ওপাশে তো কেউ ছিলোই না!

পাখিরা যখন ঘরে ফিরে যেতে শুরু করেছে তখন আকাঙ্খিত মানুষটা বাইরে বের হলো। দম ছাড়লো ইতমিনান। এভাবে কবে কার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করেছে স্মৃতিপাতা ঘেঁটে ঘুটেও পেলো না। আস্তে ধীরে উঠলো সে। পাঁচ কাপ চায়ের দাম মিটিয়ে দিলো। তুষার কোচিংয়ের দরজায় তালা দিচ্ছে। ইতমিনান রুমালটা শেষবার লালপাহাড়ের নাকের সামনে ধরলো। লালপাহাড় স্পষ্টতই বিরক্ত হলো। এবার নিজের স্বভাববিরুদ্ধ একটা কাজ করলো ইতমিনান। লালপাহাড়ের অভুক্ত পেটে বেশ জোরে একটা লাথি দিলো। কেউ সেভাবে বিষয়টায় গুরুত্ব দিলো না। কুকুরের আবার জান! কিন্তু লালপাহাড় লাফ দিয়ে সরে গেলো। ইতমিনানের কাছে এমন ব্যবহার পেয়ে তো সে অভ্যস্ত নয়। তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো লালপাহাড়। ইতমিনান তুষারের দিকে তাকালো। রাস্তা পার হয়ে এদিকে আসবে। দুই দিকে তাকিয়ে যানবাহনের অবস্থা দেখছে। ইতমিনান লালপাহাড়ের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে ঠোঁট নেড়ে বলল, “সরি!” লালপাহাড় সেসব বোঝার সময় পেলো না। তার আগেই নিজের পায়ের ক্ষত স্থানে জোরে চাপ অনুভব করলো। চিৎকার করে উঠলো লালপাহাড়। আত্মরক্ষায় ইতমিনানের দিকে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে গেলো। ইতমিনান তড়িৎ গতিতে রাস্তা পার হয়ে তুষারের সাথে ইচ্ছা করে ধাক্কা খেলো। অপেক্ষা না করে পেছনে চলে গেলো। একদম পেছনে দেয়ালের ওপাশে লুকিয়ে পড়লো। তুষার বিরক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে একবার ইতমিনানের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। লালপাহাড় আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ইতমিনানের পিছু নিয়েছিল। তুষারের সাথে ধাক্কা খেলে পরিচিত গন্ধ, পেটের ক্ষুধা, পায়ের ব্যথা একাকার হয়ে লালপাহাড়কে চরম উত্তেজিত করে তুললো। কে তাকে লাথি দিয়েছে, কে ব্যথা দিয়েছে সব ভুলে সামনের মানুষটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তুষার গড়গড় করতে থাকা কুকুর দেখে স্বাভাবিকভাবেই ভয় পেলো। অজান্তেই দৌড় শুরু করলো আরেক দিকে যাওয়ার জন্য। লক্ষ্যকে দৌঁড়াতে দেখে লালপাহাড় খুশি হলো। তার উত্তেজনা বাড়লো। চার পায়ে দৌড়ে সে হামলে পড়ল তুষারের ওপর। প্রথম কামড়টা দিলো তার পায়ে। তুষার খেই হারিয়ে পড়ে গেলো রাস্তায়। হাত দিয়ে সরাতে চাইলো কুকুরটাকে। বাঁধা পেয়ে লালপাহাড় হাতেও কামড় দিলো। চিৎকার করে উঠলো তুষার। তার শরীরের র’ক্ত তখন মাটি ছুঁয়েছে। দেয়ালের ওপাশ থেকে তৃপ্তির হাসি হাসলো ইতমিনান। আরো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো।

তুষারের চিৎকারে রাস্তার লোকজনের মনোযোগ সেদিকে গেছে। অনেকেই আশপাশ থেকে হৈ হৈ করছে। তবে কুকুরটার এমন মা’রমুখো ভঙ্গি দেখে কেউ এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না। ততক্ষণে তুষারের শরীরের আরো কয়েক জায়গায় জখম করে ফেলেছে লালপাহাড়। ইতমিনানের চোখে ভাসছে মালিহার বাম গালের আঙুলের ছাপ। যখন লালপাহাড় তুষারের গালে কামড়ে ধরলো তখন ইতমিনান এমন ভঙ্গিতে ছুটতে ছুটতে এলো যেনো তার কি হারিয়ে গেছে। তুষারকে ধরাশায়ী এবং লালপাহাড়কে তার উপরে দেখে যেনো সে আতকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলো লালপাহাড়ের কাছে। লালপাহাড়ের তখন চারদিকে কোথাও খেয়াল নেই। ইতমিনান কাছে এসে জোরেশোরে ডাকলো, “লালপাহাড়!”
কুকুরটা তাকালো। ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে একবার ঘড়ড়ড় করে উঠলো। ইতমিনান আবার ধমকে উঠলো, “কি হচ্ছে এসব! সরে এসো। সরে এসো বলছি!”
ততক্ষণে লালপাহাড়ের উত্তেজিত ভাবটা থিতিয়ে এসেছে। আরেকবার ঘড়ড়ড় করে এক পা পিছিয়ে গেলো সে। সেই সুযোগে ইতমিনান তুষারের কাছে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “এখনও জ্ঞান আছে দেখছি! মালিহা কিন্তু জ্ঞান হারিয়েছিল।”
তুষারের চোখ তখন নিভু নিভু হয়ে আসছে। তবে জ্ঞান সে হারায়নি। কান ঠিকমতোই কাজ করছিল। মালিহার নাম শুনে চট করে ব্যাথাতুর চোখ দুটো বড় হয়ে গেলো। ইতমিনান ঘাড়টা আরেকটু নিচু করে তুষারের মাথার পেছনে হাত দিলো। দুর থেকে দেখলে মনে হয় যেন তুষারকে ওঠানোর চেষ্টা করছে সে। চাপা কন্ঠে ক্ষোভ ঢেলে দিলো। হিসহিসিয়ে বলল, “এক কুকুর আরেক কুকুরকে কামড়াচ্ছে। মালিহাকে দেখাতে পারলে কি যে শান্তি লাগতো!”

ইতমিনানকে এগিয়ে যেতে দেখে আর লালপাহাড়কে সরে আসতে দেখে আশপাশের লোকেরা ততক্ষণে এগিয়ে গেছে। তুষারের চারপাশে ঘিরে ধরেছে। ইতমিনান মাথা তুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “অটো ডাকুন কেউ। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
দুইজন অটো খুঁজতে গেলো। কয়েকজন ইতমিনানের পাশে এসে তুষারকে ধরে দাঁড় করালো। গাড়িতে ওঠানোর সময় ইতমিনান তুষারের কানে ফিসফিস করে বলল, “বেঁচে থাকলে ভালো হওয়ার সুযোগ আসবে। আর ম’রে গেলে তো হলোই। হয় কুকুরের কামড় মনে রেখে বাঁচতে হবে নয়তো কবরে ডান্ডার বারি হজম করতে হবে। Have a great journey!” চকচকে একটা হাসি দিলো ইতমিনান। গাড়িটা ছেড়ে দিলেও তুষার বড় বড় চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।

নিজের হাতের দিকে তাকালো ইতমিনান। র’ক্ত লেগে চটচট করছে। চায়ের দোকানের পাশের চাপকল থেকে হাত ধুয়ে নিলো। লালপাহাড় তখন এইটুকু মুখ করে ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইতমিনান একটু এগিয়ে দোকানগুলো ছাড়িয়ে সামনে গেলো। লোকচক্ষুর অন্তরালে যেয়েই হাতের ইশারায় লালপাহাড়কে ডাকলো। কুকুরটা মনিবের ইশারা পেয়েই দৌড়ে চলে গেলো। ইতমিনান যেয়ে থামলো একটা ফার্মেসীর সামনে। লালপাহাড় তার পিছু পিছু। তার চোখেমুখে অপরাধবোধের ছাপ স্পষ্ট। ইতমিনান হাতে গ্লাভস পড়ে লালপাহাড়ের পায়ের জখমে ওষুধ দিলো। ছোট একটা ব্যান্ডেজ করে দিলো। লালপাহাড় কুঁই কুঁই করে ডাকলে নীল গ্লাভস পড়া ডান হাতটা লালপাহাড়ের মাথায় রাখলো ইতমিনান। লালপাহাড় সাথে সাথেই আবার কুঁই কুঁই করলো। ইতমিনান হেসে বলল, “আজকে রাতে স্পেশাল ট্রিট। কসাইয়ের থেকে তরতাজা হাড্ডি এনে দেবো। চলবে?”
লালপাহাড় মাথা নামিয়ে কুঁই কুঁই করে উঠলো।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে