উষ্ণতা পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
25

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৬

চুলগুলো অগোছালো। সামনের দিকের কিছু চুল কপালে পড়ে আছে অবহেলায়। অযত্নে গোঁফ বড় হয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। চেহারার পরতে পরতে ক্লান্তির হাতছানি। মালিহা এসবই খেয়াল করলো এক দেখায়। ইতমিনানের চোখে চোখ পড়তেই পলক ফেলতে বাধ্য হলো সে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কি পিপাসার্ত, ক্লান্ত সেই চাহনি!
“কেমন আছিস?”
মালিহার কাছে মনে হলো খুব কষ্ট করে টেনে হিঁচড়ে ভেতর থেকে শব্দগুলো বের করলো ইতমিনান। সে কি অসুস্থ?
“ভালো আছি। তুমি কি অসুস্থ?”
“নাহ।”
“তাহলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“কেমন?” গালে হাত দিলো ইতমিনান।
“রোগী রোগী দেখাচ্ছে। কি হয়েছে?”
“অফিসে কাজের একটু প্রেশার।”
“তুমি নাকি অন্য জায়গায় চাকরি করবে?” অন্যদিকে তাকালো মালিহা। ইতমিনানের মুখটা দেখে তার অকারনেই মায়া লাগছে।
“তোকে কে বলল?”
“শুনলাম।”
“অন্য জায়গায় চাকরি খুঁজছি। চাকরি হলো সোনার হরিণ। খুঁজলেই পাওয়া যায় নাকি? মনে হচ্ছে এটা নিয়েই থাকতে হবে।” হতাশার স্বরে বলল ইতমিনান।
“ওহ।”
“আজকে বসতে দিবি না নাকি?”
মালিহা হতচকিত হলো। তাই তো! কথা বলতে বলতে বসার কথা বলতেই ভুলে গেছে সে। দ্রুত একটা চেয়ার টেনে দিলো। ইতমিনান হেসে বলল, “আরে তাড়াহুড়ার কিছু নেই।”
“তুমি সত্যিই অসুস্থ না?”
“না।” হাসলো ইতমিনান। এখানে তার খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। আয়েশা ফোনে শুধু কন্ঠ শুনতে পান। চেহারা দেখতে পেলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে ছুটে আসতেন। হাতের প্যাকেট মালিহার দিকে এগিয়ে দিলে সে বলল, “তুমি রোজ রোজ এসব নিয়ে আসো কেনো?”
“আমি তো এলামই এই দুইদিন। কিছু না নিয়ে আসা যায়। এসব নিয়ে আসার সময় মনে হয় তোকে শ্বশুরবাড়ি দেখতে যাচ্ছি।” ইতমিনান শব্দ করে হেসে ফেলল। মালিহা লজ্জা পেলো। বেহায়া দৃষ্টিতে লজ্জা রাঙা মুখটা দেখলো ইতমিনান। সহসাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে।
“বাড়িতে কথা হয়? জমির ব্যাপারে শুনেছিস কিছু?”
মাথা নেড়ে মালিহা বলল, “কথা হয়। কিন্তু জমি নিয়ে নতুন করে আবার কি হয়েছে?”
“বাবা দলিল পত্র রেডি করে ফেলেছে। সেদিন তো চাচীর সেটা কথা বলে এসেছে শুনলাম। জানিস না তুই কিছু?”
মালিহা ভাবুক হলো। মিতুল তাকে কিছু বলল না কেনো? পরক্ষণেই তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। ইতমিনান বলল, “ধানী জমি আর পুকুর তোরা পাবি আর..”
“দয়া করছো?” ইতমিনানকে কথা শেষ করতে দিলো না মালিহা। তার আগেই ঠান্ডা কণ্ঠে বলল।
“দয়া আবার কিসের? এগুলো তোদের হক।”
“হকের নামে দয়া।” একগুঁয়ে কণ্ঠে বলল মালিহা। ইতমিনানের এবার রাগ হলো।
“থাপ্পড় খাবি! এক ধাপ বেশি বুঝিস কেন সবসময়? চাচার অংশের জমি তোরা পাবি না?”
মালিহা মাথা নিচ করলো। জোরে শ্বাস ফেললো ইতমিনান।
“আমি যেনো না শুনি এসব নিয়ে তুই আর কোনো তর্ক করেছিস। বড়রা সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিশ্চয়ই বুঝে শুনে?”
মালিহা মাথা নিচু করেই রইলো। ইতমিনান অস্থির হলো। ঐ মুখটা দেখার জন্যেই তো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে সে। এভাবে মাথা নিচু করে দেখার জন্য নাকি!
“এই মাথা উঠা। তাকা আমার দিকে!”
মালিহা মাথা ওঠালেও ইতমিনানের দিকে তাকালো না।
“সমস্যা কি? তাকাতে বললাম না?”
“তুমি সেদিন রাস্তায় আমাকে বকেছো। আবার এখন ক্যাম্পাসে এসে বকছো। ভালো করে বললেই তো হয়। এতো বকাবকির কি আছে?”
ইতমিনান হাসলো। পরপর ত্যাড়া কণ্ঠে বলল, “তুই উল্টাপাল্টা কথা বলতে পারবি আর আমি বকলেই দোষ। আচ্ছা যা! সব দোষ আমার। তা বল কোচিং কেমন লাগছে?”
মুহূর্তেই মালিহার চেহারার রং পাল্টে গেলো। চামড়ার ভাঁজে খেলে গেলো এক রাশ চিন্তা। চোখের পাতায় ভেসে উঠলো তুষারের চাহনি। মালিহা সরাসরি কখনও ধরতে পারেনি। কিন্তু তার মনে হয় তুষার যেনো সুযোগ পেলেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অবশ্যই মুখে নয়। বেশ ঢোলা একটা বোরখা পড়ে সে। তাহলে তুষার কি দেখে? মালিহার চিন্তা হয়, অস্বস্তি হয়, ভয় হয়।
ইতমিনান স্পষ্ট দেখলো মালিহার কপালের ভাঁজ, চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ। অপেক্ষা করল মালিহার নিজ থেকে বলার জন্য। মালিহা বলল, “ভালোই।”
“শিওর?”
“হু।”
ইতমিনানের মন চাইলো মালিহার মাথায় হাত রাখে। ভরসা দিয়ে বলে ভয় নেই, আমি সবসময় তোর পাশে আছি। হাতটা রাখা হয় না। সম্পর্ক তার সীমারেখা টেনেছে বহু আগেই। সেই গণ্ডি পেরিয়ে আর কিছু করা হয় না। তবে মুখে বলতে তো বাঁধা নেই।
“কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবি।”
মালিহা তাকায় ইতমিনানের চোখে। তার লুকানো দুশ্চিন্তাটা কি ইতমিনান ধরে ফেলেছে? জানে না সে। কিন্তু ইতমিনানের চোখের ভরসাটুকু তাকে ভয়ের গুহা থেকে টেনে বের করে আনে। ফিসফিসিয়ে বলে, “এই যে আমি আছি না!”
“বলব।” শান্ত স্বরে বলে মালিহা। হঠাৎই তার চোখ যায় ইতমিনানের গেঞ্জিতে। ভালো করে খেয়াল করতেই হেসে ওঠে সে।
“তুমি গেঞ্জি উল্টা পড়েছো!”
মালিহাকে হাসতে দেখে ভুরু কুঁচকে যায় ইতমিনানের। পরপর মালিহার কথা শুনে নিজ গেঞ্জির দিকে তাকায় সে। লজ্জিত বোধ করে ইতমিনান। তাড়াহুড়া করার ফল। কালো গেঞ্জির উল্টা সোজা না দেখেই পড়ে ফেলেছে। সামনের দিকে কোনো ডিজাইন না থাকায় বুঝতে সময় লেগেছে। বিব্রত কণ্ঠে ইতমিনান বলল, “অন্ধকারে এখন কে আমার উল্টা গেঞ্জি দেখতে যাচ্ছে?”
“এই যে আমি দেখে ফেললাম।” হাসলো মালিহা। মন খুলে। অনেকদিন পর। ইতমিনান চেয়ে দেখলো অপলক। হাসি থামিয়ে মালিহা বলল, “মিলি আপা কেমন আছে?”
“তুই ফোন দিস না?”
“আমার ভয় লাগে।”
“ও কি তোকে ফোনের ভেতর থেকে মা’রতে পারবে? ভয় পাওয়ার কি আছে? নিজেই খোঁজ নিবি।”
ইতস্তত করে মালিহা বলল, “আচ্ছা নেবো।”
মোবাইলে সময় দেখে ইতমিনান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “এবার উঠি।”
ইতমিনানের আগে মালিহা উঠে দাঁড়ায়। ইতমিনান ওঠে ধীর গতিতে। ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত দিয়ে মালিহার দিকে তাকায় সে। কিছু পল। অপলক। সেই দৃষ্টির সামনে মালিহা সংকুচিত হয়ে যায়। যেনো ইতমিনান তার চেহারাটা মেপে নিচ্ছে। ঘনঘন পলক ফেলে মালিহা। হঠাৎ করেই নীতির কথাটা মনে হয়। ইতমিনানের এই দৃষ্টির অর্থ কী?
“আসি। কোনো সমস্যা মনে হলেই আমাকে ফোন দিবি। মনে থাকবে?”
“থাকবে।”
ইতমিনান বের হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সিঁড়ি ঘরে যায় মালিহা। সেখানে দাঁড়িয়ে হলের বাইরের অংশ দেখা যায়। সে জায়গাটায় পৌঁছাতেই নজরে পড়ে ইতমিনানের দেহাবয়ব। সদর দরজার ওপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ঢোক গিলে মালিহা। কাঁচের উপরে রাখা তার হাতটা কেঁপে ওঠে। কেনো দাঁড়িয়ে আছে ইতমিনান? মন মনের সহজ উত্তর মালিহাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়।

°

ইটের টুকরো তার পায়ের আঘাতে ড্রেনে পড়ে যায়। ঠোঁট কামড়ে মালিহার দুশ্চিন্তা মাখা মুখটা আরেকবার দেখে নেয় ইতমিনান। মনের গোপন কোণে ছোট্ট একটা সিন্দুকে মেয়েটার অনেক ভঙ্গির ছবি আছে। ইচ্ছে হলেই টুক করে সেই সিন্দুক খুলে একটা একটা করে দেখতে থাকে সে। কিন্তু তৃষ্ণা বাঁধ না মানলে সরাসরি মানুষটাকে দেখা জরুরী হয়ে যায়। ইতমিনান নিজেকে নিয়ে চিন্তিত হলো। এভাবে চলতে থাকলে মন আর মানবে না। মা মালিহাকে মানবে না। আজও একবার ফোন করে মেয়ে দেখার কথা বলেছে। ইতমিনানের শক্ত সন্দেহ হয় তার মা মেয়ে দেখা শুরুও করে দিয়েছে। পছন্দ হলেই হয়তো তাকে তাগাদা দিতে শুরু করবে। জোর হয়তো করবে না। কিন্তু ইতমিনান কতদিন ঠেকিয়ে রাখবে? একবার কি বলে দেখবে? নাহ্। মা মানবে না। বাবা? বাবা কি তাকে খারাপ ভাববে? মালিহার দুর্বল সময়ের সুযোগ নিচ্ছে এমনটা ভাবতেই পারে। তাহলে আর কে আছে? রাবেয়া ফুপু? হ্যাঁ! ফুপুর সাথে একবার কথা বলা যায়। কিন্তু কি বলবে ইতমিনান। তার কথা এলোমেলো হয়ে যায়। অনুভূতিরা সারিবদ্ধ হয়ে হাজিরা না দিয়ে ছুটোছুটি করতে শুরু করে। মালিহার চিন্তা মাখা মুখটা দেখলে আর নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না ইতমিনান। মেয়েটার কিসের এতো চিন্তা?

ভোর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বিছানাটা যেনো দুহাত বাড়িয়ে মালিহাকে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে। মালিহাও আলিঙ্গনে সায় জানিয়েছে। দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট। এমন করেই ফজরটা মিস হয়েছে। উঠতে উঠতে সাতটা বেজে গেলো। মালিহার শব্দ পেয়ে নীতি ধড়ফড়িয়ে উঠলো। বিছানার কাছে রাখা ব্যাগটা আরেকবার দেখে নিলো। আজ বাড়িতে যাবে সে। নীতির মা কয়েকদিন ধরেই যেতে বলছেন। নীতি বলেছিলো পরীক্ষা দিয়ে একেবারে যাবে। তারা মানলেন না। নীতি শেষমেষ মেনে নিয়েছে। দুই দিনের জন্য বাড়িতে যাচ্ছে সে। তবে তার সন্দেহ হচ্ছে তার বাবা মা তার জন্য পাত্র দেখছে। কেনো যেনো বাবা মা বাড়িতে যেতে বললেই তার এই কথা মনে হয়। ঘুম থেকে উঠেই মালিহাকে সে বলল, “ভালো করে চাঁদ মুখটা দেখে নে মালিহা। বিয়ে হয়ে গেলে তখন রূপ পাল্টায় যাবে।”
মালিহা হাই তুলে বলল, “ফালতু কথা বাদ দে। বিয়ে টিয়ে করলে ফোন দিস। পাত্রকে একবার সতর্ক সংকেত দিতে হবে।”
“বান্ধবী নামের কলঙ্ক তুই।”
“আচ্ছা।”
নীতি ধুপধাপ করে বাইরে চলে গেলো। মালিহার একটুও কোচিংয়ে যেতে মন চাইছে না। আঁখির বিছানায় তাকাতেই দেখলো হেডফোন কানে দিয়ে ল্যাপটপ চাপছে সে। তুষারের ব্যাপারটা কি একবার আঁখিকে বলবে। পরক্ষণেই মত পাল্টায় মালিহা। আঁখি যদি খারাপ ভাবে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠলো সে। কাযা নামাজ পরে বিছানায় বসে রইলো কতক্ষন। আজকে এতো বিরক্ত লাগছে কেনো?

দুজনে একসাথেই বের হলো। নীতি অটোতে উঠলের সেকেন্ড গেটের দিকে গেলো মালিহা। দূরে এহসানকে দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি একটু থামতেই মানুষ বের হয়ে পড়েছে। দ্রুত সেই রাস্তা পাল্টে ফেললো মালিহা। হঠাৎ এহসানের প্রতি একটা শ্রদ্ধা কাজ করলো। সেদিনের পর ছেলেটা তাকে আর বিরক্ত করেনি। না ক্লাসে, না অন্য কোথাও। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। আকাশে কালো মেঘ। মনে হচ্ছে যখন তখন ঝমঝমিয়ে আবার নামবে বৃষ্টি। তার ভাবতে দেরি হলো বৃষ্টি পড়তে নয়। হতভম্ব হয়ে গেলো মালিহা। বের হওয়ার সময় বৃষ্টি কমে গিয়েছিলো। ছাতা আর নেয়া হয়নি। শক্ত একটা ধমক দিলো নিজেকে। আশপাশে দোকানও নেই একটু দাঁড়ানোর মতো। এসব ভাবতে ভাবতেই ভিজে গেলো অনেকটা। দৌঁড়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। দোতলায় বারান্দা। তার নিচ বরাবরই দাঁড়ালো মালিহা। বোরখার দিকে তাকাতেই বিরক্তিতে মুখটা তিক্ত হয়ে গেলো। পিচ্ছিল কাপড়টা গায়ের সাথে এটে আছে। হলে ফিরে যাবে? ধমক নিশ্চিত। এর আগেও একদিন বৃষ্টির কারণে যাবে না বলে ফোন দিলে তুষার তাকে ধমক দিয়েছে। দম ছাড়লো মালিহা। এভাবেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ঘণ্টার কাঁটা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়েছে। বৃষ্টির গতি কমতেই রাস্তায় নেমে পড়লো সে। পাঁচ মিনিট হেঁটে কোচিংয়ে পৌঁছালো। ঢুকতেই মনে হলো শুনশান নীরবতা। কি ব্যাপার? ছেলেমেয়েরা এখনও আসেনি নাকি? অফিস রুমের লাইট জ্বলছে। বাকি সব রুমের লাইট বন্ধ। উঁকি দিতেই তুষার বেরিয়ে এলো। আলুথালু তার বেশ। পাশের ফ্ল্যাটেই সে থাকে। বলতে গেলে নিচ তলাটা তার দখলে। মালিহা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তুষার আপাদমস্তক তাকে দেখলো। মালিহা কাঠ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
“এখনও কেউ আসেনি?”
“এই ঝড় বৃষ্টিতে কে আসে?” তুষারের কণ্ঠটা কেমন যেনো শোনালো। মালিহা তাকালো তার দিকে। সে এখনও মালিহার বোরখার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ একদম সরাসরি। ধারণা সত্যি হলো। মালিহার মন চাইলো কলমের নিপ তুষারের চোখে ঢুকিয়ে দিতে।
“নিতু আপু আসেনি?”
“না। কেউ আসেনি। তুমি বসো। বোরখা টোরখা খোলো। ভিজে তো চপচপে হয়ে গেছো।”
পুরো কোচিংয়ে কেউ নেই। মালিহার কেমন যেনো লাগলো। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। নিতুর কাছে একবার ফোন দেবে? ছেলেমেয়েরা কেউ আসছে না কেনো? জড়সড় ভঙ্গিতে চেয়ারে বসলো সে। হঠাৎ শব্দে ধ্যান ভাঙলো। তুষার দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনের সদর দরজাটা বন্ধ। সে হেসে বলল, “বৃষ্টির পানি এসে তো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”
সেই হাসি দেখে মালিহার মনে হলো তার মাথা ঘুরছে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৭

কোচিংয়ের সামনে একটা টিনশেড দোকান। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অবাধ্যের ন্যায় ছুটোছুটি করছে। উল্লাস নৃত্য। তাদের উল্লসিত শব্দ গীতিকারের কাছে সুরের মূর্ছনা তৈরি করতে পারলেও মালিহার গায়ে শব্দগুলো যেনো কাঁটার ন্যায় বিধছে। শরীরে তখনও বৃষ্টির পানি। তার মাঝে নিজের জায়গা করে নিয়েছে স্বেদবিন্দু। তুষার তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি অটল হয়ে আছে মালিহার দিকে।

“এভাবে ভেজা কাপড়ে থাকতে ভালো লাগছে তোমার? তুমি চাইলে আমি হেল্প করতে পারি।”

মৃগী রোগীর ন্যায় মালিহার হাতটা কেঁপে উঠলো। দাঁতে দাঁত বারি খেলো প্রচণ্ড গতিতে। মালিহা বুঝলো তাকে শক্ত থাকতে হবে। কিন্তু কেনো শক্ত থাকতে হবে সেই চিন্তাটাই তাকে ভেতরে থেকে বিবশ করে দিলো। চেয়ারেই বসে রইলো মালিহা। পাথরের মূর্তির ন্যায়। তুষার এক পা এগিয়ে আসতেই কারেন্ট চলে গেলো। চোখের সামনে অন্ধকার দেখতেই যেনো মালিহা আসল আলোর দেখা পেলো। বুকটা উত্তেজনায় ধড়ফড় করতে শুরু করলো। ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করতে যেয়ে সে বাঁধা পেলো কয়েকবার।

“পরিবেশ মনে হচ্ছে আমাদের সাহায্য করছে। কি বলো মালিহা?”

ফোনের স্ক্রিন জ্বলে উঠতেই মালিহার মুখটা দৃশ্যমান হলো। তুষার এগিয়ে এলো। অন্ধকার ঘরে শুধু মালিহার মুখটা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি, ঘামের পানি মিলে একাকার অবস্থা। সন্তর্পনে মালিহার পাশের চেয়ারে বসলো তুষার। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, “মালিহা তোমার এই শক্ত শক্ত ভাবটা দেখেই কিন্তু আমি ভেতর থেকে নড়ে গিয়েছি। বি ইজি। এখানে অতিরিক্ত ভাবার কিছুই নেই।”
হঠাৎই মালিহার চোখ যেনো জ্বলে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তুষারের দিকে। হালকা হেসে তুষার বলল, “জবরদস্তি করতে কেমন লাগে তার অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে তুমি চাইলে আজ সেটাও হয়ে যাবে।” তুষারের মুখের হালকা হাসিটা মালিহার ভয়ের আগুনে যেনো হাওয়া দিলো। বসে যাওয়া গলা থেকে সে খুব কষ্ট উচ্চারণ করলো, “আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?”
“অবুঝের মতো কথাবার্তা বলবে না তো! এখানে ক্ষতির কিছুই নেই। শুধু লাভ আর লাভ।” আয়েশ করে বসলো তুষার।
“আমি চিৎকার করবো।”
“করতে চাইলে করো। এখানে আসার মতো কেউ নেই। আর সব টিচারদের আমি আসতে গ্রুপে নিষেধ করে দিয়েছি। গ্রুপ চেক করোনি এটা তোমার সমস্যা। আমি তো তোমাকে ডেকে আনিনি।”
পত্র পত্রিকা তেমন একটা পড়ে না মালিহা। তবে আশপাশের ঘটনা ফেসবুকের দৌলতে কানে আসতে দেরি হয় না। চোখে ভাসে বর্ণনা করা চিত্র। আত্মার মৃ’ত্যুর শুরুটা কি এমনই হয়? মালিহা ফাঁকা ঢোক গিললো। কাকে ফোন দেবে সে? কার কাছে সাহায্য চাইবে? ঠোঁটের আগায় অজান্তেই আল্লাহর নাম চলে এলো। ভাঙা কণ্ঠে কিছু বলার আগেই তুষার তার স্কার্ফে হাত দিলো। সেই স্পর্শের রুক্ষতা মালিহার ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। চট করে উঠে দাঁড়ালো সে। তুষার শক্ত কণ্ঠে বলল, “পালানোর চেষ্টা করবে না মালিহা।” বলতে বলতেই মালিহার কাছে যেয়ে দাঁড়ালো সে। মালিহা পেছাতে চাইলে খপ করে তার হাত ধরলো তুষার।
“আমাকে যেতে দিন তুষার ভাই।” খুব কষ্টে বলল মালিহা। তুষার কি আগে থেকেই পরিকল্পনা এটেছিল? সে জানতো মালিহা আসবে? এই একা কোচিংয়ে তার ম’রণ হবে?
“প্রশ্নই ওঠে না। দেখো মালিহা, বি লজিক্যাল! এখানে কে আমাদের দেখতে আসছে? কেউ জানবেই না কি হচ্ছে। জাস্ট একটু এনজয়। তারপর তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার। আমাকে কি তোমার রে’পিস্ট টাইপ লোক মনে হয় নাকি?”
মালিহার কান ঝা ঝা করে উঠলো। হাত ছড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা ফলস্বরূপ কাঁধ থেকে ব্যাগ আর হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো। টর্চ থেকে গেলো নিচে। মালিহার চিৎকার করতে মন চাইলো। ভেতর থেকে ভয়টা ফুপিয়ে কান্না আকারে বের হলো।
“আমাকে ছেড়ে দিন তুষার ভাই। আমি ম’রেই যাবো।”
“এসব কথা আমাকে টলাবে না মালিহা। প্রথম দিন থেকেই তোমার পার্সোনালিটি আমার কাছে অ্যাট্রাক্ট করেছে। এমন একটা দিনের অপেক্ষায়ই আমি ছিলাম। আজ দেখো তুমি নিজেই সুযোগ করে দিলে। কি মনে করো? এই আলখাল্লা পড়ে থাকলে মানুষ কিছু বুঝবে না? ছোট মানুষ!” মালিহার বোরখায় টান দিলো তুষার। কাঁধের কাছের সেফটিপিন টান লেগে চামড়ার ভেতর ঢুকে গেলো। হঠাৎ করেই জোরে ধাক্কা দিলো মালিহা। তুষার টেবিল ধরে দাঁড়ালো। হাত ছাড়া পেয়েই ফোন উঠিয়ে ভেতরের একটা ক্লাস রুমে ঢুকে পড়ল মালিহা। সাথে সাথেই দরজা বন্ধ করে দিলো। কপালের দুই পাশের শিরা দপদপ করছে। মালিহা বুঝলো না কি করবে। মন চাইলো নিজের গলা নিজের হাতে টিপে ধরতে।
“আল্লাহ আল্লাহ বাঁচাও। আল্লাহ বাঁচাও..” বলতে বলতেই ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো মালিহা। কম্পনরত হাতটা দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। ফোন হাতে নিয়েও বুঝলো না কাকে কল করবে। এলোমেলো চিন্তার মাঝেই মস্তিষ্কে ইতমিনানের মুখটা উঁকি দিলো। তার বলে যাওয়া কথাটা “কোনো সমস্যা মনে হলেই আমাকে ফোন দিবি। মনে থাকবে?”
মালিহাকে বেশি কষ্ট করতে হলো না। শেষবার ইতমিনানের সাথেই তার কথা হয়েছিল। একবার চাপ দিতেই ফোন চলে গেলো ইতমিনানের কাছে।
“হ্যালো ভাইয়া!”
খট করে শব্দ হলো। দরজা বাইরে থেকে খুলে ফেলেছে তুষার। মালিহার কানে আর কিছুই ঢুকলো না। তুষার যখন তাকে টানতে টানতে ঘরের আরেক কোণায় নিয়ে গেলো তখন মালিহা শুধু নিজের মৃ’ত্যুর দোয়া করলো। ফোনটা অবহেলায় পড়ে রইলো এক কোণে। ওপাশের অস্থির মানুষটার স্বস্তি ফেরাতে কেউ পাল্টা জবাব দিলো না।

মানিকের সাথে আজ বেশ কয়েকদিন যাবৎ দেখা সাক্ষাৎ নেই। ইতমিনান ভাবলো লালপাহাড়কে নিয়ে মানিকের ডেরায় যাবে। তবে আবহাওয়া তাকে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে কর্দমাক্ত পথে যেতে মন চাইলো না ইতমিনানের। পিচ ঢালা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো সে। বিশাল কালো ছাতাটা তাকে এবং লালপাহাড়কে বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখছে। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ভার্সিটির প্রথম গেটে এসে গেলো ইতমিনান খেয়ালই করলো না। লালপাহাড়ের কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো। সে একটা কুকুরের সাথে ঝগড়া করতে শুরু করেছে। আকাশের দিকে তাকালো ইতমিনান। বৃষ্টি আবার বেড়েছে। লালপাহাড়কে নিয়ে একটা দোকানের ছাউনিতে দাঁড়ালো। ছাতা বন্ধ করতেই মোবাইল বেজে উঠল। মালিহার নাম দেখে ঈষৎ হাসলো ইতমিনান। এখন তো কোচিংয়ে থাকার কথা। তাহলে আবার কি হলো? ভুরু কুঁচকেই কল রিসিভ করলো সে। ইথারে ভেসে এলো মালিহার অস্থির, ভয়ার্ত কন্ঠ,
“হ্যালো ভাইয়া!”
“হ্যালো? এই কি হয়েছে তোর?”
মালিহার আর কোনো শব্দ পেলো না ইতমিনান। শুধু ভেসে এলো তার কান্নার শব্দ। সাথে পুরুষালি একটা কণ্ঠের আভাস। চিন্তার গতি লাগাম ছেড়ে টগবগিয়ে দৌড়ে এলাকা ছাড়লো। ছাতা ফেলেই দৌঁড়াতে শুরু করলো ইতমিনান। একমাত্র লক্ষ্য সেকেন্ড গেটের পাশের কোচিংটা। ইতমিনানকে দৌঁড়াতে দেখে লাল পাহাড় ঘেউ ঘেউ করতে করতে নিজেও দৌড় দিলো। অঝোর ধারার বৃষ্টিতে বিরক্ত আশপাশের মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখলো এক যুবক এবং এক কুকুরের অস্বাভাবিক দৌড় প্রতিযোগিতা।

নিতু তিতিবিরক্ত। কোচিংয়ের বন্ধ দরজা দেখে তুষারকে ফোনের পর ফোন করে চলেছে সে। দরজায় ধাক্কা দিয়েছে বেশ কয়েকবার। এসেছে প্রায় পনের মিনিট হয়ে গেলো। এই বৃষ্টির মাঝে এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা যায়? কাপড় প্রায় পুরোটাই ভিজে গেছে। ছাতার কল্যাণে উপরের দিকটা রক্ষা পেয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে আবার কল করলো নিতু। তুষারের বাচ্চাকে শিক্ষা না দিলে তার শান্তি হবে না। এই সকালে গেট না খুলে থাকার মানে কি? ছেলেমেয়েরা নিশ্চিত এসে ফিরে গেছে। নয়তো তার ফোন এতোগুলো কল মিস হয়েছে কেনো?
নিজের উপর হওয়া বিরক্তিটা সরাতে পারলো না নিতু। ফোন সাইলেন্ট করার এই বদ অভ্যাসের জন্য কতো ভোগান্তিই যে পোহাতে হয়েছে তবুও স্বভাবটা বদলালো না। ডেটা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে গ্রুপ চেক করা হয়নি। সে যা হোক, তুষার নিশ্চিত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। আর ছেলেমেয়েরা তাকে না পেয়ে নিতুর কাছে ফোন দিয়েছে। সেও রিসিভ করতে পারেনি। কলিং বেল চেপে ব্যর্থ হলো নিতু। কারেন্ট নেই। আবার দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো সে। সে নিজে শান্তির ঘুম নষ্ট করে এসেছে। তুষারকেও ঘুমাতে দেবে না।
হঠাৎ কুকুরের ডাকে আতকে উঠলো নিতু। দরজার সাথে সেটে দাঁড়াতেই দেখলো কাকভেজা এক যুবক এবং তার পিছু পিছু আসছে বিশালদেহী লাল রঙের একটা কুকুর।

পেপার ওয়েট দিয়ে তুষারের কপালে আঘাত করেছে মালিহা। অন্ধকারে শুধু তুষারের আর্তনাদটা শুনেছে। বুঝতে পেরেছে তুষারের আঘাত লেগেছে। চোখে লাগলে বেশি ভালো হবে। কোথায় লাগলো কে জানে।
আঘাত পেয়ে জায়গাটা চেপে ধরলো তুষার। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। পরপরই মালিহাকে ছুড়ে ফেললো মেঝেতে। তার ফোনে কল এসেছে। টেবিলের উপর পড়ে আছে অবহেলায়। একবার এসে থামলো না। একের পর এক কলের শব্দে বিশ্রী গালি দিলো তুষার। মালিহা তখন উঠে দেয়ালের কাছে সেটে বসেছে। এক হাতে ধরে রেখেছে কাঠের চেয়ারের পায়া। ফোন সাইলেন্ট করে মালিহার দিকে এগিয়ে এলো তুষার। মালিহা চেয়ার তুলে তুষারের দিকে ধাক্কা দিলো। ছুড়ে দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও সেটা হলো না। শরীরের শক্তি ভয় শুষে নিয়েছে। হৃদপিণ্ডের অস্থিরতা বুকটা স্থির থাকতে দিচ্ছে না।
এবার শুরু হলো দরজা ধাক্কানো। তুষারের মনে হলো সাজানো গোছানো পরিবেশটা হঠাৎ করেই বিগড়ে গেছে। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে হাতের মুঠোয় মেয়েটাকে পেয়েও কার্য হাসিল না করতে পারার চিন্তা তাকে উন্মাদে পরিণত করলো। ছুটে এসে মালিহার খোপা করা চুলের গোছা এলোমেলো স্কার্ফের উপরেই টেনে ধরলো।
“কাকে ফোন করেছ? কে আসবে তোমাকে বাঁচাতে? কেউ আসবে না। কেউ না!” চিৎকার করলো তুষার। এভাবে হেরে যেতে হবে ভাবলেই তার র’ক্ত গরম হয়ে আসছে। প্রত্যেকবার তার প্ল্যান মাফিক সব হয়েছে। কেউ টু শব্দ করার সাহস পায়নি। এবার কেনো এমন হবে? মানবে না সে। কোনোভাবেই না।
কিন্তু তুষারের মানার আশায় আর কিছু থেমে রইলো না। সদর দরজার উপর যেনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একের পর এক আঘাতে দরজা তার স্থায়িত্ব হারাতে বসলো।

উপরের সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলো ইতমিনান। অস্থির ভঙ্গিতে নিতুকে বলল, “আজ কি কোচিং ছুটি? ছুটি হলে মালিহা কোথায়? কি হলো! কথা বলছেন না কেনো!” শেষের কথাটুকু চিৎকার করে বলল ইতমিনান। নিতু কেঁপে উঠলো।
“না কোচিং তো ছুটি না।”
“তাহলে দরজা বন্ধ কেনো?”
“জানিনা। আমিও তো কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছি।”
ইতমিনান আর কিছু শোনার প্রয়োজবোধ করলো না। আসতে আসতে মালিহাকে পঞ্চাশ বারের কাছকাছি ফোন দিয়ে দিয়েছে। রিসিভ হয়নি। অনুমানের ভিত্তিতে এখানে এসেছে ইতমিনান। ছুটি না হওয়া সত্ত্বেও বন্ধ দরজা তাকে আর কিছু ভাবতে দিলো না। অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো পুরোনো দরজাটার উপরে।

.

তুষার বুঝতে পারলো সে হয়তো ধরা পড়ে যাচ্ছে। মালিহাকে কষে একটা থাপ্পর মা’রলো।
“তোর ভাব আমি ছুটিয়ে দেবো ***। এই তুষারকে তো চিনিস না!”
মালিহার ঠোঁট ফেঁটে গেলো। দুর্বল শরীর নিয়ে সে আর নড়তে পারলো না। তুষার চলে গেলো আরেকদিকে। ওপাশের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়া তার লক্ষ্য।
ধরাম করে একটা আওয়াজ হলো। ভেঙে গেলো দরজার নব। ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো ইতমিনান। পিছু পিছু নিতু। এই লোকের কাজের আগা মাথা সে বুঝতে পারছে না। ভেতরে ঢুকতেই নিতুর চোখ কপালে ওঠার দশা। পুরো ঘরের উপর দিয়ে যেনো ঝড় বয়ে গেছে। বার কয়েক তুষারকে ডাকলো সে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। ইতমিনান অস্থির ভঙ্গিতে আরেক রুমে ঢুকলো। চিৎকার করলো, “মালিহা! মালিহা!” লালপাহাড় দরজায় দাঁড়িয়ে আগ্রহী চোখে ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো শুধু একটা ইশারার অপেক্ষা।
টেবিলের পেছনে কাপড়ের টুকরো নজরে আসতেই সেদিকে গেলো নিতু। ভয়ার্ত গলায় ডেকে উঠল, “মালিহা!”
তখন শুধু মালিহার শ্বাস চলছে। গালের একপাশ লাল হয়েছে নিজের রঙে। ফ্যাকাশে মুখটা একটু বেশীই সাদা লাগছে। চিৎকার শুনে দৌড়ে এলো ইতমিনান। নিতু হাঁটু গেড়ে মালিহার সামনে বসে আছে। তার হাত ধরে ওঠানোর চেষ্টা করছে। খুব কষ্টে চোখের পাতা টেনে খুললো মালিহা। ইতমিনানের মুখটা নজরে আসতেই জ্ঞান হারালো সে। ইতমিনান দেখলো মালিহার নাক থেকে বইতে শুরু করেছে র’ক্তে’র সূক্ষ্ম এক ধারা।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৮

অল্প কিছুক্ষণ। সেই ক্ষণের মাঝেই রিলেটিভিটির সূত্রটা হাড়ে হাড়ে টের পেলো ইতমিনান। মালিহার চোখ খুলতে লাগলো গুণে গুণে ছয় মিনিট। কিন্ত ইতমিনানের মনে হলো তার শ্বাস ছয় ঘণ্টার জন্য আটকে গিয়েছিলো। ছেঁড়া স্কার্ফ, কপাল থেকে বেরিয়ে আসা এক গাছি চুল, গালের সাথে লেগে থাকা টকটকে লাল র’ক্ত, কুচকে যাওয়া কর্দমাক্ত বোরখা, বন্ধ চোখ। ইতমিনানের মনে হচ্ছিল মালিহা চোখ না খুললে তার চোখ আর কিছুক্ষণের মাঝেই বন্ধ হয়ে যাবে।
সেই যাত্রায় ইতমিনান বেঁচে গেলো। মালিহা চোখ খুললো। সে নিতুর কোলে পড়ে আছে। এই বিষয়টা বুঝতে তাকে আরো কিছু সময় ব্যয় করতে হলো। সামনে দন্ডায়মান ইতমিনানকে দেখে আশপাশে তাকালো। তুষার নেই। কোথাও নেই। হালে পানি পেলো মালিহা। নিতু নরম কণ্ঠে ডাকলো, “মালিহা?”
ব্যস! ঐ ডাকটুকুর আশায়ই যেনো মালিহা ছিলো। হামলে পড়ল নিতুর বুকে। নিতু পরম মমতায় জড়িয়ে নিলো। ঠিক একজন বড় বোনের মতো। মালিহার হেঁচকি উঠে গেলো। নিতুর পিঠে নখ বসিয়ে দিয়েও ক্ষান্ত হলো না সে। তার চোখে খানিক আগের দৃশ্য জ্বলজ্বল করছে। বুকটা ওঠানামা করছে হাপড়ের ন্যায়।
পুরো ঘরে আর কোনো আওয়াজ নেই। লালপাহাড় একবার কুঁই কুঁই করে উঠেছিল। মালিহার কান্নার আওয়াজ থেমে গেছে। ক্লান্ত হয়ে মালিহা থামলো। তবে নিতুকে ছাড়লো না।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে। আশপাশের কয়েকজন এসে উঁকি দিতে শুরু করেছে। ইতমিনান বের হলো। কড়া কণ্ঠে ধমক দিয়ে বলল, “ভিড় জমিয়েছেন কেনো? এখানে কি?”
তারা বলবে কিভাবে এখানে কি? কি হচ্ছে তাই দেখতেই তো এসেছে। একজন কুকুর নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে দরজা ভাঙতে শুরু করলো তাহলে মানুষ জড়ো হবে না? যারা ছিল ইতমিনানের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে চলে গেলো। ইতমিনানের বুক আশঙ্কায় দুরু দুরু কাঁপছে। ক্ষতর চাইতে তার চিহ্ন বেশি ভয়ানক। মালিহার জীবনকে সে ভয়ানক হতে দিতে চায় না। দম ফেলে দোকানে গেলো সে। পানির বোতল হাতে ফিরে এলো। মালিহার সামনে ধরতেই চোখ তুলে তাকালো সে। বিপদের সময় অপরিচিত এই শহরে সবচেয়ে পরিচিত মানুষটাকে দেখে কেঁদে দিলো। ইতমিনান হাঁটু ভেঙে বসলো। শান্ত ভঙ্গিতে বোতলের মুখ খুলে মালিহার মুখের সামনে ধরলো।
“খা।”
মালিহা ধরলো বটে। কিন্তু খেতে পারলো না। পানি ছলকে পড়লো তার গায়ে। নিতু সাহায্য করলো। উঠে চেয়ারে বসলো মালিহা।
নিতু ঘটনা আগেই আঁচ করতে পেরেছে। এতক্ষণে মালিহা শান্ত হওয়াতে বলল, “জানোয়ারটা কোথায়?”
“পালিয়ে গেছে।” ঠোঁট ভেঙে এলো মালিহার। ইতমিনান পকেটে হাত গুজলো। তার হাত নিশপিশ করছে মালিহার মাথায় রাখার জন্য। রাখবে না সে। অদৃশ্য এক অভিমান তাকে ঘিরে ধরেছে। হাতছানি দেয়া দুর্ঘটনা তার চিত্তকে শিকড় থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে নিতু মালিহাকে বলল, “উনি?”
“চাচাত ভাই।”
“জানালে কিভাবে?”
“ফোন করেছিলাম।”
সূক্ষ্ম চোখে মেয়েটাকে দেখলো নিতু। কাপড় চোপড়ের বেহাল দশা হলেও তারা স্থানচ্যুত হয়নি। মেয়েলি চোখে ঘটনা আঁচ করতে অসুবিধা হলো না। পুনরায় মালিহাকে বুকে টেনে নিল নিতু। মেয়েটার প্রতি এমন স্নেহ আগে কখনোই অনুভব করেনি সে।

বেশ অনেকটা সময় পরে নিতু ইতমিনানের কাছে এলো। মালিহা চেয়ারে শক্ত হয়ে বসে আছে। একবার সেদিকে তাকিয়ে ইতমিনানের কাছে বলল, “কি ভাবছেন? কি করবেন এখন?”
ইতমিনান যেনো চমকে উঠলো। উদাস ভঙ্গি ভেঙে চোখ বড় করে তাকালো।
“হু?”
“বলছি এখন কি করবেন? মালিহা?” নীতি বিরক্ত হলো। লোকটাকে তার চটপটে বলে মনে হলো না। তখন থেকে একভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে। নট নড়ন চড়ন মার্কা অবস্থা।
“কি করবো?” অবুঝের ন্যায় প্রশ্ন করলো ইতমিনান।
“আশ্চর্য! এভাবে বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করছেন কেন? একটা ডায়েরি তো করতেই পারেন। প্রয়োজন হলে আমি সাক্ষী দেবো। বিষয়টা তো এভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না।”
“ডায়েরি?” যেনো নিজেকেই শোনালো ইতমিনান। পরপর আবার নীরবতা। লালপাহাড় সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছে। সকালে ঝগড়া করা সেই কুকুরটা খুঁজছে নাকি কে জানে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ইতমিনান ভাবলো। ডুব দিল চিন্তার অতলে। ডায়েরি, পুলিশ, ইনকোয়ারি, গল্প, গুজব, মালিহা? মালিহার দিকে তাকালো ইতমিনান। বড় বড় ভাব দেখায়। ভেতরটা তো ছোট থেকেই ইতমিনানের চেনা। শক্ত হয়ে থাকা মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কতোটা ভেঙে গুড়িয়ে গেছে সে জানে। ভাঙা মানুষটাকে আরো টুকরো করার প্রশ্নই ওঠে না।
ঢোক গিলে ইতমিনান বলল, “আমি কোনো ডায়েরি করবো না।”
“তাহলে কি করতে চান আপনি? এভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন? সরি টু সে কিন্তু মালিহার অভিভাবক হিসেবে কোনো কাজই আপনি করছেন না।”
“কীটটা মাস্টার্স করছে। কিছুদিনের মাঝেই বেরিয়ে যাবে। এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। মালিহা মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে। মানুষ তিল থেকে তাল বানাবে সেই তালের বোঝা মাথায় নিয়ে ওকে এখানে বছরের পর বছর থাকতে হবে। আমাদের এখানে চেনা পরিচিত কেউ নেই। একটা ডায়েরীই সমাধান না। একবার ওর সম্মান হারিয়ে গেলে সেটা মাটি খুঁড়েও আর ফেরত পাওয়া যাবে না।”
নিতুর রাগ হলো। কটমট করে সে বলল, “আপনাদের মতো মানুষগুলোর এমন চিন্তার কারণেই এসব জানোয়ার আরো আশকারা পায়। আপনারা যদি প্রতিবাদ না করেন তাহলে ও আবার সুযোগ পাবে না?”
ঈষৎ হাসলো ইতমিনান। নিতুর কাছে মনে হলো তাচ্ছিল্য মাখা হাসি। লালপাহাড়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে ইতমিনান বলল, “আপনি নিজেও তো প্রতিবাদ করেননি। চুপ করে গিয়েছিলেন কেনো? শুধু ক্লাসমেট বলে?” ফের লালপাহাড়ের দিকে তাকালো ইতমিনান। নিতু ভয়ানক চমকে গেলো। এতটাই যে শেষ পর্যন্ত না ইতমিনানের দিকে সরাসরি তাকালো না-ই বা আর একটা শব্দও খরচ করলো।
টেবিলের নিচে এক জোড়া জুতা পেলো ইতমিনান। বইয়ের নিচ থেকে একটা রুমাল। জিনিসগুলো এনে লালপাহাড়ের সামনে রাখলো সে। লালপাহাড় একবার মুখ উঠিয়ে ইতমিনানের দিকে তাকালো। ইতমিনান চোখ দিয়ে ইশারা করল জিনিসগুলো শুঁকে নিলো নিজের নাক দিয়ে। গন্ধটা গেঁথে নিলো মস্তিষ্কে। খুঁজে খুঁজে একটা প্যাকেট পেলো ইতমিনান। সেটায় রুমাল রেখে প্যাকেটটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।

মালিহাকে বিদায় দিলো নিতু। চলে গেলো ভার্সিটিতে। ইতিমিনান কিছু না বললেও মালিহা তার পিছু নিল। একটা অটো দাঁড় করালো ইতমিনান। বড় সিটে মালিহা বসলে লালপাহাড়কে ওঠালো। অটোওয়ালা গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলেন। ইতমিনান তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আর কাউকে নিয়েন না মামা। পুরা ভাড়া দিয়ে দিবো।”
মালিহার কোনাকুনি বিপরীতের সিটে বসলো ইতমিনান। লালপাহাড় জিহ্বা বের করে বাইরে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত জার্নি বাই অটো উপভোগ করছে।
মালিহা আরেকটু গুটিয়ে গেলো। ঝাঁকি লাগলেই পা কুকুরটার গায়ে লাগছে। তখনই তার দিকে তাকাচ্ছে কুকুরটা। ইতমিনান বিষয়টা খেয়াল করে লালপাহাড়কে সরিয়ে আনলো।
হলের সামনে এসে নামলে ইতমিনান মালিহার হাতে তার কাঁধ ব্যাগটা ধরিয়ে দিলো। মালিহা অবাক হলো না। আপাতত সে অনুভূতি শূন্য অবস্থায় আছে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ইতমিনানের মুখের দিকে সসংকোচে একবার তাকিয়ে চলে গেলো হলের ভেতরে।
চোখের সামনে থেকে মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো ইতমিনান। তারপর চোখ বন্ধ করলো। মুখ ওঠালো আকাশের দিকে। লালপাহাড় দেখলো ইতমিনানের কণ্ঠনালি ওঠানামা করছে। টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার বন্ধ চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে।

খুব কষ্টে শরীরটা টেনে দুই তলা পর্যন্ত নিয়ে গেলো মালিহা। ব্যাগ থেকে চাবি বের করতে যেয়ে ব্যাগটা পড়ে গেলো। তালার গায়ে চাবি ছোয়ানোর আগে আবার চাবিটা পড়ে গেলো। নীরব বারান্দায় দরজার সিটকিনি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো মালিহা। জোরে জোরে শ্বাস নিলো কয়েকবার। ক্লাস টাইম। পুরো হলে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ আছে। কাঁপতে থাকা হাতে তৃতীয়বারের চেষ্টায় তালা খুললো। রুমে ঢুকতেই যেনো দম ঠেকে এলো তার। সব জানালা খুলে দিলো। বৃষ্টির পানি দিয়ে গোসল সেরে সজীব রোদ হুটোপুটি খেয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। মালিহা নিজেও সেই রোদের সাথে তাল মেলালো।
শরীর ঠাণ্ডা ফ্লোর ছুঁতেই চোখ বন্ধ করলো। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠলো তুষারের চেহারা। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো মালিহা। আশপাশে তাকালো। না কেউ নেই। এক হাতে স্কার্ফ খুললো। বোরখা টান দিয়ে খুলতেই বাম কাঁধ ব্যথায় টনটনিয়ে উঠলো। চুলগুলো এক হাতে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো মালিহা। কোনো রকমে এক সেট কাপড় নিয়ে বেডের নিচ থেকে বালতি টেনে বের করলো। এলোমেলো পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করল। ধপ করে ফ্লোরে বসতেই ভিজে গেলো তার সর্বাঙ্গ। নোনতা জলের মিশ্রণে মালিহা ধুয়ে ফেলতে চাইলো সবটুকু নোংরা স্পর্শ।

দীর্ঘক্ষণ ভেজার পর যখন মালিহা বের হলো তখন তার শরীর হিম শীতল। চেহারাটা দেখাচ্ছে র’ক্তশূন্য। রুমে ঢুকে বালতি রেখে ওড়না মাথায় জড়ালো মালিহা। ফ্লোরে বসেই মাথা ঠেকিয়ে দিলো সেখানে। অবাধ্য অশ্রু পথ পেলো। ভেজা চুলের পানি শুষে সেই হিম পরশ সন্তর্পনে মালিহাকে ফিরিয়ে দিলো মেঝে। এক সময় মালিহার ঠান্ডা শরীর গরম হয়ে এলো। ঝাপসা চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে খুব কষ্টে বিছানায় গেলো সে। পরিশ্রান্ত চোখের পাতা যখন বন্ধ করলো তখন মালিহার আশপাশে কেউ নেই। কেউ না।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে