উষ্ণতা পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
85

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৩

নামাজ ঘরটা দোতলায়। একদম কোনার দিকে। পশ্চিম পাশে হওয়ায় পড়ন্ত সূর্যের তাপটা থেকে যায় রাতের বেলায়ও। ফ্যান ছাড়লেও দেয়ালের গরম শরীর ছুঁয়ে দেয়। গরম লাগে। গলা থেকে মাথায় প্যাঁচানো ওড়নাটা ঢিল করে দেয় মালিহা। একটু বাতাস লাগতেই হাঁফ ছাড়ে। নীতি মোবাইলে বুদ হয়ে আছে। মালিহা গুতা দিলো তাকে।
“কি রে? এখনও কেউ আসে না কেনো? আর তো মাত্র পাঁচ মিনিট আছে।”
নীতি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এ কি কোনো রাজা মহারাজা মিটিং ডেকেছে যে সবাই আড্ডাবাজি ফেলে এখানে আসবে? সবাই মহাব্যস্ত।”
“কিন্তু কমন রুমে তো দেখলাম অনেকে আড্ডা দিচ্ছে। ওরাও তো গ্রুপে আছে।”
“দেখ তো নাজিফার মেসেজটা সিন করেছে কতজন। আঠারজন। ধর বড় জোর আটজন খুব বিজি। তাহলে আর দশজন আসতো না? সবগুলো দেখ গিয়ে ওখানে আড্ডা দিচ্ছে। কার নতুন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে, কার ব্রেকআপ হয়েছে। দুনিয়ার ফাতরা আলোচনা।”
মুখ কুঁচকে নিলো নীতি। নাজিফা একটা মেসেঞ্জার গ্রুপে তাদের অ্যাড করেছে। নামাজ ঘরে কোনো কারণে একত্রিত হলে গ্রুপে ছোট্ট একটা মেসেজ দিয়ে দেয় নাজিফা। চল্লিশের কাছাকাছি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা। কিন্তু নিয়মিত খুব কমই। মালিহা বলল, “থাক বাদ দে।”
মালিহার কথা শেষ হতেই নাজিফা এলো। তাদের দেখে যেনো মুখের উজ্জ্বলতা বাড়ল মেয়েটার। তার পিছু কিছু এলো আরো দুজন। পাঁচজনের দলটা গোল হয়ে বসতেই নাজিফা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো।
“এই প্রথম আমরা পাঁচজন এখানে!”
“কেনো? এর আগে কতজন হতো?” নীতি প্রশ্ন করলো।
নাজিফা মলিন কণ্ঠে বলল, “এই দুই, তিন এমন।” তার ঠোঁটে তখনও ঝুলছে হাসি।
“গ্রুপে তো দেখলাম আটত্রিশ জন মেম্বার। মেসেজ সিন করেছে আঠারোজন। তাহলে এতো কম মানুষ আসে কেনো?”
“সবার তো টাইমিং মেলে না। ব্যস্ত থাকে হয় তো।”
“ব্যস্ত না ছাই।” বিড়বিড় করে বলল নীতি। নাজিফা বলল, “আজ হঠাৎ করেই ডাকলাম। তেমন জরুরী কিছু না। নতুন একটা লেকচার শুনেছি। সূরা ফাতিহার। সেটাই কিছুটা নোট করে এনেছি।”
চারজন খুব মনে দিয়ে নাজিফার কথা শুনছিল। মালিহা বাকি মেয়ে দুজনকে খেয়াল করলো। মুখ চেনা। অন্য ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
সম্ভাষণে কিছু কথা বলে নীতি যখন সূরা ফাতিহা পড়তে শুরু করলো তখন মালিহা এবং নীতি দুজনেই বিস্মিত হয়ে নাজিফার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ। পাঁপড়িগুলো হালকা কাপছে। সুর মিশিয়ে যেভাবে সূরা ফাতিহা নাজিফা পড়লো তাতে মালিহার মনে হলো জীবনে প্রথমবার এই সূরা শুনলো সে। নীতি ঢোক গিললো। নাজিফা চোখ খুলে সকলের দিকে তাকিয়ে বাংলা অর্থ বলল। টুকে আনা নোট থেকে দেখে ব্যাখ্যা বলল নাজিফা। কতরকম কতো কথা! নীতির মাথা ঘুরে গেলো। মাত্র সাতটা আয়াতে এতো কাহিনী! এতো গোপন তথ্য! তত্ত্বের এই আয়োজন মালিহা কখনও টের পেয়েছে? কতোই তো পড়েছে এই সূরা।

দীর্ঘ বিশ মিনিট একভাবে বলার পরে থামলো নাজিফা। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “তোমাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।”
মেয়ে দুটো কি যেনো বলল মালিহা বা নীতি কেউই সেটা লক্ষ্য করলো না। তাদের বিস্ময় তখনও কাটেনি। কিছু সময় পর সেই মেয়ে দুইজন চলে গেলো। মালিহা এবং নীতির দিকে তাকিয়ে নাজিফা বলল, “অনেক সময় চলে গেলো। আসলে আমার কথা অনেক বেঁধে যায় তো এজন্য সমস্যা হয়। নাহলে কথা বেশি ছিল না।” লজ্জিত কণ্ঠে বলল নাজিফা। কথা বলার সময়ই নীতি লক্ষ্য করেছে। শব্দের মাঝে যেনো হুটহাট বেঁধে যায়।
“আরবীর অনেক এক্সেন্ট আছে নাকি? ইংলিশের মতো?”
মালিহার প্রশ্নে নাজিফা বলল, “সে তো আছেই। সব ভাষায়ই কম বেশি এক্সেন্ট আছে।”
“সূরাটা তুমি কোন এক্সেন্টে বললে?”
“আরে না। আমি পারিই একরকম করে। তাজবীদ দিয়ে পড়লেই হলো। কয়েকটা পদ্ধতি আছে যদিও।”
“কিন্তু তোমার পড়া আমার কাছে অচেনা লাগলো। মনে হলো সূরা ফাতিহা এই প্রথম শুনলাম।” নীতি বলল। নাজিফা হাসলো, “একেকজন তো একেকরকম করে পড়ে তাই এমন লাগতে পারে।”
“আচ্ছা আমি একবার পড়ি। তুমি দেখো আমার পড়া হয় নাকি।” নীতি নাজিফার দিকে এগিয়ে বসলো। নাজিফা সম্মতি জানালে নীতি পড়তে শুরু করলো। কিছুক্ষনের মাঝেই শেষ হয়ে গেলো। নাজিফার দিকে তাকিয়ে নীতি বলল, “হয়েছে?”
“তাজবীদে একটু সমস্যা আছে। ঐটুকু ঠিক করলেই হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”
নীতির মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। এতদিনের এতোবার সুরাটা পড়া তাহলে ভুল হয়েছে? নীতির মুখ দেখে নাজিফা কি যেনো বলতে চাইলো। পরক্ষণেই চুপ করে গেলো। আর বলা হলো না।
নামাজ ঘর থেকে বের হয়ে নীতি মালিহাকে বলল, “দোস্ত পারিই দুই চাইরটা সূরা। এইগুলাও যদি ভুলে ভরা হয় তাইলে কেমনে কি?”
“আমিও তো তাই ভাবছি। সেই ছোটবেলায় হুজুরের কাছে শিখেছি। এতদিন তো এভাবেই পড়েছি। তাহলে ভুল হচ্ছে কেনো? হুজুর তো এভাবেই শিখিয়েছে।”
“হ্যাঁ বললেন উনি। শিখছিস কোন ল্যাদা কালে? এতো বছরে ভুলে গেছিস না? কতো রুলস আছে বলতে পারবি? আমরা নিজেরাই চর্চা করি না। আর দোষ হুজুরের না?”
মালিহা মুখ কাচুমাচু করলো। কমন রুম পার হওয়ার সময় ক্লাসের একজন আটকে দিলো। গল্প করলো বেশ কিছু সময়। সেখান থেকে আসার পথে এক রুমের সামনের খোলা বারান্দায় দাঁড়ালো দুজনে। এখান থেকে দূরে ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। টিমটিমে আলো জ্বলছে। হঠাৎ পাশের রুম থেকে সুরের মূর্ছনা ভেসে এলো।
“আমারও পরানো যাহা চায়। তুমি তাই তুমি তাই গো..”
ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে চলেছে মন মাতানো আওয়াজ। সেই আওয়াজের খানিকটা খুব সন্তর্পনে, খুব সূক্ষ্মভাবে ঢুকে পড়লো দুটো মনের গভীরে। যেখানে একটু আগেই চিন্তারা জায়গা করে নিয়েছিল, অস্থির হয়ে উঠেছিল। সেই মনটা হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলো। হারিয়ে গেলো সুরের আঁকাবাঁকা গলির রঙিন দুনিয়ায়। সেখানে নেই কোনো চিন্তা, কোনো অস্থিরতা।

নীতি সকাল সকাল উঠে জামাকাপড় বাছাই করছে। মালিহা বিরক্ত হলো এক পর্যায়ে।
“নিজে বস্তি বানাবি বানা। আমাকে বিরক্ত করছিস কেনো? এখন আমি বের হবো না?”
“একদম বকবি না মালিহা! একটা ড্রেস সিলেক্ট কেউ দিতে বলেছি বলে এতো ফুটেজ খাচ্ছিস। টাকা কামাই করা শিখেই তুমি পা দুটো আকাশে নিয়ে ঘুরছো? কয়দিন পর তো তোমাকে আর পাওয়াই যাবে না। বললেই হয়..”
হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো মালিহা। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, “থাম! আল্লাহর ওয়াস্তে থাম! দে শাড়ি চুড়ি সব নামা। আজকে আমার কোচিং গোল্লায় যাক।”
নীতি মুখ বাঁকিয়ে বিছানার উপর ছড়ানো জামা দেখিয়ে বলল, “শাড়ি না। থ্রি পিস। চোখ না চুলা?”
ক্ষিপ্ত চোখে নীতির দিকে তাকালো মালিহা। হিজাবে শেষ সেফটিপিন লাগিয়ে আয়নার সামনে থেকে সরে এলো। বিছানার দিকে যেতেই নীতি ঘুরে মালিহার বিছানায় যেয়ে বসলো।
“আজকে এত বেছে বেছে জামা পড়া লাগবে কেনো এটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। আজকে স্পেশাল কি আছে?”
“স্পেশাল কিছু থাকা লাগবে কেনো? এমনিতে সুন্দর জামা পড়তে পারি না আমি?”
“ঝগড়া করছিস কেনো? এমনিদিন তো এগুলো শিকেয় তুলে রাখিস। হঠাৎ কোন বুদ্ধির ঠেলায় এগুলো নামাতে মন চাইলো শুনবো না?”
চড়া কণ্ঠ নামিয়ে মিনমিন করে নীতি বলল, “কালকে আম্মু ফোন করে ঝেড়েছে। এগুলো কেনো এখনও পড়ছি না তাই। বের করে দেখি একটা জামা বুকের কাছে ফেসে গেসে। ঐটা আর পড়াও যাবে না। তাই এগুলো পড়ে ফেলবো ভাবছি।”
“চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।” বলেই একটা হালকা অক্ষী রঙের থ্রি পিস নীতির কাছে ছুড়ে দিলো মালিহা। নীতি বকবক করতে থাকলেও তার একটা কথাও আর কানে নিলো না। ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার সময় শুধু বলল, “আজকে আমার জন্য জায়গা না রাখলে রাতে তোর মশারি খুলে রেখে দেবো নীতি!”
নীতি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই মিটিমিটি হাসলো। মালিহা কোচিং থেকে নির্দিষ্ট সময়ে বের হতে পারে না। কিছুটা সময় আগে পরে হয়ে যায়। অনেক সময় স্যারও চলে আসেন। সেজন্য মালিহার জন্য জায়গা রাখাও সম্ভব হয় না। কিন্তু ও মালিহার পাশে না বসে অন্য করো পাশে বসেছে এজন্য কি সে হিংসে করছে? দারুন তো! আজ তো তাহলে নীতি জায়গা রাখবেই না!

তুষার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মালিহা ঢোকার সময় ইচ্ছা করে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটুর জন্য ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেলো মালিহা। দেয়াল ঘেঁষে ভেতরে ঢুকলো। কপাল কুঁচকে তাকালো তুষারের দিকে। তার কানে ফোন। কিছু একটা নিয়ে খুব গুরুতর ভঙ্গিতে আলোচনা করছে। বিরক্ত হয় মালিহা। তুষারের এই আচরণগুলো তার ভালো লাগে না। বিরক্তিভাব আড়ে আড়ে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টায় বালি ফেলে তুষার হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সে বলে, “এতো গুটিয়ে থাকো কেনো মালিহা? ফিল ফ্রি। নয়তো তোমার অভিব্যক্তি তো কেউ বুঝবে না।” মালিহা মাঝে মাঝে বলতে চায়, “ফিল ফ্রি মানে কি? ঝাঁপ দিয়ে আরেকজনের গায়ে পড়ে যাওয়া?” বলা হয় না। চাকরিতে টান পড়লে অসুবিধা। এক সিনিয়র। তার উপরে মাসের সাত হাজার যাবে হাওয়ায় ভেসে।
ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো মালিহা। সরাসরি ক্লাসে চলে গেলো। নিতু নেই। খোঁজ করতেই জানা গেলো আজ তার ছুটি। ক্লাসে ঢুকে মালিহা খুশিই হলো। ছেলে মেয়ে আলাদা দুটো সরিয়ে বসেছে। মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা রাখা। উৎফুল্ল চিত্তে ক্লাস নিলো সে। মনে হলো সবাই আনন্দ নিয়েই ক্লাসটা করেছে। মাঝে মাঝে গতদিনের ছেলে মেয়েদুটোর দিকে নজর দিতে ভোলেনি সে। মুখে মৃদু মৃদু মন খারাপের ভাব। সে হোক। দুদিন পরই ঠিক হয়ে যাবে।
ক্লাস থেকে বের হয়ে মালিহার সেই উৎফুল্ল ভাব কিন্তু আর রইলো না। তুষার তাকে ডাক দিয়েছে। হঠাৎ তলবের কারণ বুঝলো না মালিহা। তার তো আরো একটা ক্লাস আছে। অগত্যা অফিস রুমে গেলো সে।
তুষারের মুখটা গম্ভীর দেখাচ্ছে। মালিহা মনে করতে চেষ্টা করলো কোনো ভুল হয়েছ কি না।
“বসো মালিহা।”
“ক্লাস ছিলো ভাইয়া। আপনি বলুন।”
“আমি জানি ক্লাস আছে। বসো।” শেষটুকু বেশ জোর দিয়ে বলল তুষার। মালিহা ভড়কে গেলো। বসে পড়ল চেয়ারে।
“কোচিং কেমন লাগছে? ভালো তো?”
“জি ভাইয়া।” গম্ভীর কণ্ঠে এমন প্রশ্ন ঠিক মেলাতে পারলো না মালিহা। তুষারের মুখে স্বভাবসুলভ হাসিটা নেই।
“বুঝতেই পারছি। নয়তো নিজের মনে করে সিস্টেমে চেঞ্জ করা শুরু করতে না। একটু বেশিই ভালো লাগছে।” মাথা নেড়ে বলল তুষার।
“বুঝলাম না।”
“ক্লাস সেভেনের সিটিং সিস্টেম চেঞ্জ করেছো তুমি। কেনো?”
চট করেই বিষয়টা ধরতে পারলো মালিহা। এ কারণেই কি তুষার রেগে আছে?
“আমি একটা প্রশ্ন করেছি মালিহা। একটু পরেই সব টিচার এখানে চলে আসবে। আমি ম্যাটারটা তার আগেই ক্লোজ করতে চাইছি। এখন তুমি যদি সবার সামনে ক্ল্যারিফিকেশন দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করো তাহলে সেটা তোমার বিষয়।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে চেয়ারে হেলান দিলো তুষার। মালিহা ভেবে পেলো না ঘটনা ঠিক কিভাবে তুষারের কাছে বর্ণনা করবে। ছেলেমেয়ে দুটো কিভাবে বসে ছিলো এটা সে তুষারের কাছে কখনোই বলতে পারবে না। আমতা আমতা করে বলল, “মেয়েরা ছেলেদের পাশে বসে অতোটা কমফোর্টেবল ফিল করে না। তাই আর কি..”
“স্কুল, কলেজ পাশ করে ভার্সিটি শেষ করে ফেললাম। কোচিং চালাচ্ছি তিন বছরের বেশি হয়ে গেলো। আর তুমি দুদিন এসেই এতো বড় বিষয়টা বুঝে ফেললে? আমি তো দেখি অনেক মেয়ে আরো ইচ্ছা করে ছেলেদের পাশে বসে।” তুষারের কণ্ঠে স্পষ্ট খোঁচা। মালিহা সংকুচিত বোধ করলো। তুষার শক্ত কণ্ঠে বলল, “তোমার ধ্যান ধারণা নিজের ভেতরেই রাখো মালিহা। এটা তোমার নিজস্ব জ্ঞান ছড়ানোর জায়গা নয়। আসবে পড়াবে, টাকা পাবে, চলে যাবে। একস্ট্রা কোনো কাজ তোমাকে করতে হবে না। এবার যাও।”
অপমানে মালিহার মুখটা থমথমে হয়ে গেলো। মন চাইলো ছুটে পালিয়ে যেতে। হলো না। মাস শেষে টাকা দরকার। পরবর্তী ক্লাসের দশ মিনিট ইতোমধ্যে চলে গেছে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৪

মেজাজের অবস্থা বেজায় খারাপ। সেই খারাপ মেজাজ নিয়েই ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হলো। পরীক্ষা সমাগত। এমন সময় ক্লাস মিস দেয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা’রা। কাজেই অপমানের স্মৃতি বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে মুখে ব্যস্ততার ছাপ ধরে পা চালাচ্ছে মালিহা। চেহারায় প্রলেপ দেয়া আজকাল সে ভালই শিখেছে।

ক্লাসের সামনে আসতেই দেখলো স্যারও ঢুকছেন। শিক্ষকের আগে ঢোকার জন্য দৌঁড়ে গেলে অল্পের জন্য ধাক্কা খেতে খেতেও বেঁচে গেলো। কিন্তু স্যারের চোখ রাঙানি এড়িয়ে যাওয়া গেলো না। পরপরই নিজেকে ধমক দিলো মালিহা দরজা কি একটাই নাকি! অন্য দরজা দিয়েও তো ঢোকা যেতো।

রুমে ঢুকতেই মনটা বিষিয়ে গেলো। এখানেও ছেলেমেয়ে একসাথে বসেছে। মুহূর্তেই সেদিনের দৃশ্যটা আর আজকের অপমান মনে হয়ে গেলো। যতোই জিনিসগুলো ভুলে থাকতে চাইছে ততোই যেন মস্তিষ্কে সেগুলো জেঁকে বসছে। এমনটাই বোধহয় নিয়ম। যাকে ঠেলেঠুলে মস্তিষ্ক থেকে বের করার ইচ্ছা থাকে সেই যেনো চূড়ান্ত জেদ নিয়ে জেঁকে ধরে। মেজাজ খারাপ হওয়ার আরেকটু বাকি ছিলো। নীতিকে যখন দেখলো সেজেগুজে একটা মেয়ের সাথে বসে হাসাহাসি করছে সাথে সাথেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। মেয়েটাকে পইপই করে বলে এসেছিল যেনো ওর জন্য জায়গা রাখে। ফাজিল মেয়ে ইচ্ছা করে এমন করেছে। এমনই মনে হলো মালিহার। আরেকপাশে যেয়ে বসবে তারও উপায় নেই। একটা ছেলে ওপাশে বসেছে। উপায় না পেয়ে একদম শেষের দিকে যেয়ে বসতে হলো। দুইজন মেয়ের মাঝে একটা চেয়ার ফাঁকা ছিল। সেদিকেই গেলো মালিহা। নীতি মালিহার দিকে তাকিয়ে হাসতে ভুললো না। সেই হাসি দেখেই মালিহা বুঝলো এসব নীতি ইচ্ছা করেই করেছে।

খাতা কলম বের করেও কিছুই নোট করতে পারলো না মালিহা। ক্ষণে ক্ষণে শুধু তুষারের করা ঠান্ডা অপমানের কথা মনে হচ্ছে। তুষার অবশ্য সেই রেশ ধরে থাকেনি। পরের সময়টুকু এমন আচরণ করেছে যেনো কিছুই হয়নি। মালিহা ততোটা নির্বিকার থাকতে পারেনি। তার ছোট মুখটা ছোটই থেকে গেছে। নিজের উপরে অসন্তুষ্ট হয় মালিহা। কেনো সে মানুষের কথাগুলো উড়িয়ে দিতে পারে না? সবার কথাই কি ধরে বসে থাকতে হবে? ক্লান্তির শ্বাস ছেড়ে ঘাড় ঘোরায় দুই বেঞ্চ সামনে বসে থাকা নীতির দিকে। সহসাই ভুরু কুঁচকে আসে। নীতির পাশে বসে থাকা ছেলেটা একটু পরপরই নীতির দিকে তাকাচ্ছে। আড়চোখে। মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল। নীতির দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখলো মালিহা। আকাশী রঙের থ্রি পিস পড়া। হাত খোপা করা চুলের উপরে ওড়নার একাংশ অবহেলায় পড়ে আছে। সজীব দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। গোসল করে এসেছে নাকি? পাশের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে হাসছে। সেই হাসি চোখ দিয়ে গিলছে ছেলেটা। মালিহার উত্তপ্ত মেজাজে যেনো গরম হাওয়ার হলকা বয়ে গেলো।

ক্লাস শেষ হতেই নীতির কাছে ছুটে যেতে চাইলো মহা। তার আগেই নীতি উঠে সামনে এগিয়ে যাবে ঠিক সেসময় তার পাশের ছেলেটা নীতির বাহুর উপরে হাত রেখে টান দিলো। ঘটনা বুঝতে না পেরে ছেলেটার দিকে তাকালে সে বলল, “সবাই একসাথে গেলে ধাক্কা লাগবে তাই আটকে দিলাম। ফাঁকা হোক তারপর যেও।” মুচকি হাসলো ছেলেটা। নীতি কিছু বলল না। কিন্তু কাছাকাছি আসায় পুরোটাই শুনলো মালিহা। চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো তার। ক্লাসের মাঝখানে সে লক্ষ্য করেছে এই ছেলে নিজের টেবিল নীতির টেবিলের সাথে ঘেঁষে রেখেছিল। ফলে নড়াচড়ার কারণে হুটহাট স্পর্শ লেগেছে। নীতি সেদিকে ততোটা খেয়াল করেনি। তবে মালিহার এখন স্পষ্ট বুঝলো ছেলেটা সবটুকু ইচ্ছা করে করেছে। মালিহা যেয়ে একদম নীতির সামনে দাঁড়ালো। নীতি তাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছেলেটাকে শক্ত কণ্ঠে মালিহা বলল, “এখানে মিছিল হচ্ছে না যে ওকে আটকে রাখতে হবে।” নীতির হাত ধরে তাকে নিজের দিকে এনে ছেলেটার একটু কাছে যেয়ে কণ্ঠ নিচু করে বলল, “হাত পা সামলে রাখবে বুঝেছো? ওগুলো শুধু তোমার একার নেই।”
নীতির হাত ধরে হনহন করে রুম ছাড়লো মালিহা। নীতি আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। বেচারি হাঁটতে না পেরে প্রায় দৌঁড়াতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে বলল, “হইসে কি ভাই? দৌড়াস কেনো? থাম!”
মালিহার হাত টেনে ধরলো নীতি। মালিহা সহসাই তার হাত ঝেড়ে ফেলে দিলো। শক্ত কণ্ঠে বলল, “আমি ধরলে ভালো লাগছে না? ঐ ছেলে ধরছিল তখন ভালো লাগছিল? বলদ! বুদ্ধি হবে কবে তোর? ছেলেটার কোলে উঠে বসে পড়তে পারলি না? এই জন্যেই সেজেগুজে এসেছিস!”
নীতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মালিহা ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। নীতির চোখ ভরে আসতে চাইলো। মালিহা এভাবে বলতে পারলো!

লালপাহাড়ের দেখা নেই। গতকাল আসেনি, আজ সকালেও তাকে পাওয়া গেলো না। ইতমিনান মানিকের ডেরায় চলে গেল। দেখা গেলো লালপাহাড় মানিকের ঝাড়ি খাচ্ছে। তাকে দেখেই মানিক এক দফা ঝাড়ি দিলো।
“বড়লোক মাইনষের যতো ঢং! কুত্তারে বিরানি খাওয়ায় কে? খাইয়া যে হ্যায় ল্যাটকা মাইরা পইড়া রইসে অখনে এইডারে দ্যাখবো কে? যত্তসব ঝামেলা আমার ঘাড়ে আইয়া জুডে।”
ইতমিনান ইতিউতি করলো। কিন্তু বলার মতো কিছু পেলো না।
“এখন কি করতে হবে?”
“কিছুই করা লাগবো না। অর ব্যাপার অয় নিজেই বুঝবো। আপনে উদয় হইসেন কি মনে কইরা?”
এতক্ষণে ইতমিনানকে ভাবতে দেখা গেলো।
“মানিক মিয়া তুমি কি আমার সাথে এক জায়গায় যেতে পারবে?”
“কুন জাগা?” মানিকের সন্দেহ হতে শুরু করলো। এই লোক খাতিরদারি করে তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? পাচার টাচার করে দিবে নাকি?
“এই কাছেই। জামে মসজিদের পাশে। একটু চলো। পাঁচ মিনিটের মা’মলা।”
“আমারে দিয়া আপনের কি কাম? আপনের ভাব সাব আমার সুবিধার লাগে না।” বাঁকা কণ্ঠে বলল মানিক।
“খুব জরুরি দরকার মানিক মিয়া। এই দুনিয়ায় সবাই সবার দরকারেই আছে। চলো যাই?”
মানিক সন্দেহ করলেও ভয় পেলো না। এই শহরের অলিগলি তার চেনা। এই লোক উল্টা পাল্টা কিছু করতে চাইলে মানিক ছেড়ে দেবে নাকি?
ইতমিনানের দিকে তাকালো মানিক। একেবারে সাহেব সেজে এসেছে। মুখ ভেংচালো সে। এসব সং সাজা দেখলে তার গা জ্বলে। লালপাহাড়ের মুখের কাছে কিছু ঘাস রেখে তাবু থেকে বের হল। চকচকে শার্ট প্যান্ট পড়া একজন যুবকের পাশে খালি গায়ের মানিককে বোধহয় বেমানান লাগলো। আশপাশের অনেকেই তাকিয়ে রইলো কৌতূহলী দৃষ্টিতে।

ইতমিনান একটা হোটেলের সামনে এসে থেমেছে। মানিক ভাবতে শুরু করলো। এই লোক কি খাওয়াতে নিয়ে এসেছে? মনে তো হয় না। কুচকানো ভুরু নিয়েই চারপাশ পর্যবেক্ষণ করলো সে। ঊনিশ বিশ কিছু চোখে পড়লেই গায়েব হয়ে যেতে তার সময় লাগবে না। এদিক ওদিক দেখতে গিয়ে একটা ছেলের মুখ তার নজরে বিধলো। ছেলেটাও তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মানিককে দাঁড় করিয়ে ইতমিনান ভেতরে যেয়ে কি বলল সেসব মানিক শোনেনি। ইতমিনান বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। হাসি হাসি মুখ করে মানিকের হাত ধরে বলল, “চলো ভেতরে যাই।”
মানিকের বিস্ময় পাহাড় ছুঁয়ে গেলো। নিজের ডান হাতের দিকে তাকালো সে। কেউ কি কোনোদিন তার হাত ধরেছে? হ্যাঁ ধরেছে তো। মসজিদ থেকে যেদিন তাকে সবাই মিলে বের করে দিলো সেদিন ধরেছিল।
মানিক এমনভাবেই ঘোরে চলে গিয়েছিল যে চোখ দিয়ে শুধু দেখলো ইতমিনান মুখ নাড়িয়ে কিছু বলছে। কি বলছে কিছুই শুনতে পেলো না সে। যখন ইতমিনান তার ঘাড়ে হাত দিলো তখনই তার ধ্যান ভাঙলো।
“মানিক মিয়া এভিনিউ! এখানে কাজ করবে? ঐ যে ঐ ছেলেটার সাথে। হোটেল বয়দের যেসব কাজ আর কি। এখানেই খাওয়া দাওয়া করবে। রাতে থাকতে চাইলে থাকতে পারো। কিছু টাকাও পাবে। করবে?”

মিন্টু আপাদমস্তক মানিককে দেখলো। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে। বাদ পড়ল না তার বাম বাহুতে মিলিয়ে যেতে থাকা কাটা দাগটাও। ইতমিনানের কথা শুনে আবার তাকালো মানিকের দিকে। এই ছেলের জন্যই সেদিন লোকটা খোঁজ নিয়ে গিয়েছিল?

মানিক কিছু বলতে পারলো না। ইতমিনান ঘড়ি দেখল। তার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে। মানিকের ঘাড়ে রাখা হাত শক্ত করে বলল, “তুমি চাচার সাথে কথা বলে নিও। ভালো লাগলে থেকো। আমার সময় হয়ে যাচ্ছে। যাই কেমন?”

মানিক দেখলো ইতমিনান চলে যাচ্ছে। তার সামনের বদ্ধ জানালা খুলে শীতের নরম রোদ তার গায়ে মাখিয়ে চলে যাচ্ছে। তার হাতে ঘাড়ে রেখে গেছে ভরসা মাখা হাতের স্পর্শ। যেই স্পর্শ মানিকের কাছে ছিল অনাকাঙ্খিত, দুর্মূল্য।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৫

ভাগ্য মালিহা এবং নীতিকে এক করেছে দেশের দুই প্রান্ত হতে। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বরাদ্দকৃত রুম ভাগাভাগির মাধ্যমে সম্পর্কের শুরু। এক বিষয়, এক ক্লাস হওয়াটা সম্পর্কের পালে হওয়া দিয়েছে। সময়ের নদীতে স্রোতের সাথে ভাসতে ভাসতেই তারা আজ এক অপরের সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। সহযাত্রী থেকে সঙ্গী হওয়াটা সহজ নয়। সহযাত্রী তো কত মানুষই হতে পারে। লোকাল বাসে পাশের সিটের মানুষটাও সহযাত্রী। কিন্তু তার সঙ্গী হওয়ার দায় নেই। যখন তখনই সে নেমে যেতে পারে। ইতি টানতে পারে স্বল্পক্ষণ সফরের। কিন্তু সঙ্গী মানুষটা এমন নয়। সে একই সাথে সহযাত্রীও বটে। নীতি এবং মালিহা টুকরো টুকরো সময় একত্রিত করে সহযাত্রীর ধাপ পেরিয়ে আজ একে অপরের সঙ্গী।

ফুলের মালা গাঁথতে গেলে কতো সুতাই তো নষ্ট হয়। ছিঁড়ে যায়, গিট পাকিয়ে যায়। কিন্তু মালা তৈরি হয়ে গেলে ছেঁড়া বা গিট লাগা অংশটুকু আর চোখে পড়ে না। সম্পর্ক যদি ফুলের মালা হয় তবে সুতার গিট সেখানে অবাঞ্ছিত নয়। তার দিকে দৃষ্টি গেঁথে ফেলে আর ফুলের মালা গাঁথা হবে না। কিন্তু ছোট্ট একটু ছেঁড়া অংশ অথবা একটা গিট, অদেখা করে যদি মন মনন মালা গাঁথতে ব্যস্ত থাকে তবে সম্পর্কের মাঝে থাকা সেই গিটগুলো লুকিয়ে পড়বে তার সৌন্দর্যের আড়ালে।

দুই বছরের এই পথচলায় নানান জিনিস নিয়ে দুজনের মাঝে মন কষাকষি হয়েছে। প্রথম প্রথম এমন বেশি হতো। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। খাপ খাওয়াতে নিজের সাথে নিজেকে যখন যুঝতে হয়েছে তখন অপর পক্ষের মানুষটার আচরণ অপছন্দনীয় হয়ে সমস্যা যেনো বাড়িয়েছে। কিন্তু দিন কেঁটে যেতেই যখন চোখের মায়ার সাথে মনের টান তৈরি হলো তখন যেনো আচমকাই অপছন্দনীয় আচরণগুলো কর্পূরের মতো উবে গেলো। দুজনেই খেয়াল করলো অমিলগুলো সহ্য করার শক্তি তাদের মাঝে এসে গেছে। মিলগুলোর মিলিত শক্তি যেনো তাদের বন্ধন আরেকটু শক্ত করেছে।

সেই মালিহার কাছে এমন ব্যবহার পেয়ে নীতি কষ্ট পেয়েছে। মনের গভীরে যেয়ে আঘাত লেগেছে। ক্ষণে ক্ষণে নাক টানছে সে। মালিহা তাকে বকা দেয়। শক্ত কথা বলে। কিন্তু কখনও এভাবে আঘাত করে বলে না। আজ কেনো বলল? নীতি ভেবে পায় না। কষ্টে তার চোখটা ভরে আসে। পলক ঝাপটে অবাধ্য অশ্রুকে কঠোর শাসনে বেঁধে রাখে সে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে যায় হলের রুমে।

রুম বাইরে থেকে তালা দেয়া। কপাল কুঁচকে আসে নীতির। মালিহা এখনও আসেনি? “যেখানে খুশি যাক!” ভাবলেও মন মানে না। তার সাথে রাগ করে কোথাও গেলো নাকি? রুমে ঢুকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে নীতি। দরজায় ছিটকিনি দিতেও ইচ্ছা করে না।

শুয়ে থেকে কখন যে চোখটা লেগে এসেছিল নীতির খেয়াল নেই। যোহরের আযান কানে যায় এবং বুকে ব্যাথা শুরু হতেই ঘুম ভেঙে যায় তার। বুকে ভর দিয়ে শোয়ার কারণেই এই অবস্থা হয়েছে। ধীর গতিতে উঠে বসে সে। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে সামনে তাকাতেই চোখ স্থির হয়ে যায়। মালিহা নিচে পাটি বিছিয়ে খাবার সাজাচ্ছে। চট করে তখনকার কথা মনে হতেই আবার ঘুরে ধুয়ে পড়ে নীতি। মালিহা ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে দেখে সবটা।

খাবারের প্লেট দুটো ঠিক করে রেখে নীতির বিছানায় বসে মালিহা। নীতির গায়ে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলে, “আয় খেয়ে নে।”
নীতি ঝাড়া দিয়ে হাত ফেলে দেয়। মালিহা আবার হাত রাখে। নীতি আবার ফেলে দেয়। মালিহা এবার নীতির হাত শক্ত করে ধরে।
“মনিকা আর আঁখি আপু এলে ওদের ফ্রাইড রাইস দিয়ে দেবো কিন্তু!”
“কে চেয়েছে তোর কাছে? ফ্রাইড রাইস না খেয়ে কি আমি ম’রে যাচ্ছি?”
“সরি নীতি!” নমনীয় কণ্ঠে বলে মালিহা। নীতির অভিমান আরো বাড়ে।
“সত্যি সরি। ঐ ছেলেটা কি করছিলো তা তো তুই জানিস না। পুরো ক্লাসে ইচ্ছা করে তোর গা ঘেষে বসে ছিল। পা দিয়ে খোঁচানোর চেষ্টা করেছে। পারেনি। শেষে ইচ্ছা করে তোর হাত ধরেছে। ওখানে কি অতো ভিড় ছিল তুই নিজেই বল?”
নীতি চুপ করে খানিক সময় ভাবে।
“কিন্তু ও আমার সাথে এমন করবে কেনো? এমনও না যে আমাকে পছন্দ করে। দুই বছরে মনে হয় দুই দিনও আমার সাথে ওর কথা হয়নি।”
“যতো শয়তানি!” মুখ শক্ত করে বলে মালিহা।
“তাই বলে তুই আমাকে ঐরকম করে বকবি?” কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল নীতি। মালিহা বলল, “এতো সেজেগুজে গিয়েছিস কেনো ওখানে? অসভ্য ছেলেপেলের ভিড়ের মধ্যে তুমি রূপ দেখাতে গিয়েছ আর আমি বললেই দোষ!”
“আমি কি অতো শত ভেবে গিয়েছি নাকি?” মিনমিন করে বলল নীতি।
মালিহার কণ্ঠ তখনও শক্ত, “ভাববি না কেনো? সারা দুনিয়ার সব ভাবতে পারিস এই বেলা কি হয় তোর?”
“আরো কতো মেয়েরা কতরকম করে যায়। তুই দেখিস না? ওদের কিছু হয় না কেনো?”
“বিষয়টা হওয়া না হওয়া নিয়ে না। কেউ তোর দিকে তাকিয়ে তোকে স্ক্যান করছে, ফালতু মজা নিচ্ছে এটা যদি তোর কাছে স্বাভাবিক মনে হয় তাহলে তো আর ভাবাভাবির কিছু নেই। যাদের মিন করে তুই বললি তাদের প্রতি ওদের দৃষ্টি খেয়াল করে দেখবি। শয়তানের হাড্ডি সব!”
দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে গেলো। নীতির দিকে তাকিয়ে মালিহা বলল, “তোকে বাইরে বকার জন্য সরি। রুমে এসে বকা দরকার ছিল। আর লিপস্টিক দিয়েছিস কেনো? ক্লাস করতে যাস নাকি রূপ দেখাতে?”
“আবার বকবি না মালিহা!”
“একশ বার বকব! ঐ রাস্কেল তোর দিকে কীভাবে তাকিয়ে ছিল দেখেছিস? সেসব দেখবি কেনো? পরানের বান্ধবীদের সাথে তো গল্প করেই কুল পাস না। তাদের জন্যে আবার জায়গা ধরে রাখা হয়। আরেকদিন তোকে সেজেগুজে যেতে দেখি শুধু!”
নীতি বুঝলো মালিহার মেজাজ গরম। নিষ্পাপ মুখ করে বলল, “ফ্রাইড রাইসটা খাই? ক্ষুধা লেগেছে।”
বিনা বাক্য ব্যয়ে নিচে নেমে বসলো মালিহা। নীতিও সুড়সুড় করে বসে পড়ল। মালিহাকে আর ঘাটালো না। খেয়ে টেয়ে মেজাজ ঠান্ডা হলে মালিহা নিজেই কোচিংয়ের ঘটনা খুলে বলল। মুহূর্তেই মন খারাপের কথা ভুলে গর্জে উঠলো নীতি।
“শালা তো ট্যাটনা আছে। সাবধানে থাকবি মালিহা।”
বিরক্ত মুখে মালিহা বলল, “ট্যাটনা আবার কেমন শব্দ!”
“এমনই শব্দ। যেমন ব্যবহার এমন নাম। আমি বলছি তুই ঐ ছেলের থেকে দূরে দূরে থাকবি। টাকাটা কোনরকম নিতে পারলেই হলো।”
“থাম তুই। আঁখি আপুর সামনে আবার এভাবে বলিস না। উনি খারাপ ভাববে।”
নীতি ভেংচি কাটলো, “খারাপকে খারাপ ভাববে না তো কি জমজম কূপের পানি ভাববে?”

নাজিয়া আজকাল আরও চুপচাপ হয়ে গেছেন। নিজের সংসার না। তেমন কোনো কাজ নেই। কয়েকদিন হলো তিনি এগিয়ে গেলেও সাইফের মা তাকে আর তেমন কাজ টাজ করতে দেন না। সেই ব্যবহারের গূঢ় রহস্য বুঝতে পেরে ভেতর থেকে তিনি ভেঙে গেছেন। তার ভাই যখন স্ত্রীর সাথে আচরণে তাল দিয়েছে তখন থেকে তার মুখের কথা আরো কমে এসেছে। আজকাল মিতুল এটা ওটা নিয়ে আসে। সাইফের মা খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। তার ভাই মানুষের কাছে গর্ব করে বলেন মিতুল কতো বড় হয়ে গেছে। নিজেই কাজ করতে নেমে গেছে। এসব কথা নাজিয়ার ঘায়ে মলম লাগানোর বদলে বরং আরো খোঁচায়। আচরণের স্পষ্ট বদল না বোঝার মতো অবুঝ তিনি নন। এবং গতদিন যখন মালিহার বড় চাচা এসে জমি ভাগাভাগির বিষয়ে কথা বলে গেছে তারপর থেকে তাদের সাথে সবাই মেহমানের মতো আচরণ করছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন নাজিয়া। তিনি তো ভাইয়ের মেহমান নন। নিজের বোন। একই মায়ের পেটের। সেই ভাইটার কাছেও দুদিনেই বোঝা হয়ে গেলেন? মিতুলের কথা তো তাহলে কিছু ভুল নয়। আর না মালিহার কাছে নিয়ে যেতে চাওয়াটা মেয়েটার বাড়াবাড়ি। জানালার শিক ধরা হাতটা শক্ত হয়। চোখের জলে ভেসে যায় এক সুখ স্মৃতি। ছোট বোনের মুখে হাসি ফোঁটাতে পেরে বড় ভাইয়ের মুখে সে কি হাসি!

শার্ট খুলে রেখেও যখন মায়ের কোনো হেলদোল দেখলো না তখন মিতুল আস্তে করে ডাকলো।
“মা!”
নাজিয়া তড়িৎ ঘুরে তাকান। ছেলেকে দেখে সাথে সাথে চোখ মোছেন। সেটুকু মিতুলের চোখ এড়ায় না। ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় সে। কণ্ঠে নমনীয়তা টেনে বলে, “কি হয়েছে মা?”
“কিছু না। এই এমনি বসে ছিলাম। বস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসি।”
“লাগবে না। বসো তুমি।” হাত ধরে আটকালো মিতুল।
“আপার কাছে ফোন দাও তুমি?”
“মালিহাই তো দেয়।”
“আপা তো দিবেই। তাই বলে তুমি দিবে না? আমরা দুজন এখানে আছি। আপার সাথে তো কেউ নেই। গতকাল চাচা এসে কি বলে গেছে সেগুলো আপাকে জানিয়েছো?”
“না।”
“একটু ফোন করে জানিও। আপা খুশি হবে। আমাদের জন্যেই তো এতো খাটাখাটনি করছে। আপারও তো ইচ্ছা হয় তুমি ফোন দিয়ে আপার খোঁজ নিবে।”
“আচ্ছা বুঝেছি। বস তুই। পানি নিয়ে আসি।”
নাজিয়া সব বুঝলেও কিন্তু মালিহার কাছে ফোন দিলেন না। দিতে ইচ্ছা করলো না। জায়গা পাল্টানোর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তিনি। কারোর দয়া রাখবেন না তিনি। কারো না।

ইতমিনানের উপর দিয়ে যেনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দুটো মানুষের কাজ একা করতে যেয়ে তাকে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে। অফিসের মোটামুটি সবাই জেনে গেছে ইতমিনান লতার প্রক্সি দিচ্ছে। ইতমিনান বিব্রত বোধ করে। বিষয়টা তার একদমই ভালো লাগে না। কিন্তু আপাতত তাকে লতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না বলে বাঁচোয়া।
অফিস বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতে করতে মাঝে মাঝে মানিকের খোঁজে যায় সে। ছেলেটা ভালো আছে। নতুন এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে এখন সেটা দিয়ে লালপাহাড়কে লাথি মা’রে। কুকুরটাও সেই লাথি খেয়ে কুঁই কুঁই করে।
সময় কেঁটে যায়। দিন গড়িয়ে সপ্তাহ যায়। মালিহাকে আর দেখা হয় না। ইতমিনানের অবাধ্য মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। ইতমিনান লাগাম ছেড়ে দেয়। চোখ দুটো অশান্ত হয়ে গেলে যখন নিজেকে আটকে রাখা দায় হয়ে যায় তখন আবারো ছুটে যায় মালিহার ক্যাম্পাসে। এলোমেলো বেশে ছুটে যায় হলের সামনে।
নীতি গম্ভীর কন্ঠে মালিহাকে বলে, “মালিহা ইয়ার্কি না। সত্যি বলছি। আমার গাট ফিলিং হচ্ছে তোর এই ভাই তোর প্রতি উইক।”
ফোন হাতে ওড়না মাথায় টেনে নেয় মালিহা। নীতির কথা শুনলেও গা করে না। কিন্তু নিচে এসে যখন শক্ত সামর্থ্য ইতমিনানের অগোছালো রূপ দেখে তখন নীতির বলা কথাটা কানে প্রকট আকারে বাজতে শুরু করে।
“আমার গাট ফিলিং হচ্ছে তোর এই ভাই তোর প্রতি উইক।”

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে