উষ্ণতা পর্ব-১৯+২০+২১+২২

0
99

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৯

হলের দুপুরে তখন সূর্যের একপেশে আলো। কেউ ক্লাস থেকে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে তো কেউ বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানে ব্যস্ত। আজ ক্লাস ছিলো না। সবাই গেছে কাছের একটা রিসোর্টে। সেই হিসেবে আজ মালিহা এবং নীতিকে মেহমানদারী করবে নাজিফা। ছোটাছুটি করে রান্না করছে সে। রান্নাঘর ব্লকের এক কোনায়। ছুটতে ছুটতেই যেনো হাফ লেগে যায়। একবার তেল আনতে ভুলে যায় তো একবার লবণ। রুমে ইনডাকশন ব্যবহারের উপায় নেই। ইনডাকশন কানেক্ট করলেই বাতিগুলো নিভু নিভু শুরু করে। হল কর্তৃপক্ষের চালাকি। মেয়েরাও চালাক কম নয়। রাইস কুকারেই সব রান্নাবান্না সেরে ফেলে।
মুরগি রান্না শেষ হতেই চাল ধুয়ে নিলো নাজিফা। একবার ভাবলো প্রেশার কুকারে দেয়। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে আবার ভাত কেমন দলা দলা হয়ে থাকে। প্রেশার কুকারের চিন্তা বাতিল করে হাড়িতেই ভাত রান্না করে ফেললো নাজিফা। ফ্যানা যখন হাড়ির মুখ থেকে পড়ে যেতে চাচ্ছে তখনই সে ফুঁ দিয়ে সেগুলোকে আবার হাড়ির ভেতরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই করতে করতে কয়েকবার হাতে ছ্যাকা খেলো। নিজের মনেই হাসলো নাজিফা। ফ্যান গলানো তাকে দিয়ে হবে না। ভাত রান্না শেষ করে চটপট একটা গামলায় ভাত বেড়ে নেড়েচেড়ে ফ্যানের নিচে ঢাকনা দিয়ে রেখে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখ কপালে ওঠার দশা। দুইটা বেজে দশ। জামা নিয়ে ছুটলো বাথরুমের দিকে। লাইনে না দাঁড়াতে হলেই হয়েছে।

নামাজ শেষ করে যখন নাজিফা সালাম ফেরালো তখন ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা তিন ছুঁই ছুঁই করছে। তড়িঘড়ি করে মালিহাকে ফোন দিলো নাজিফা। তক্ষুনি চলে আসতে বলল।

নীতি মোজোর বোতল ডান হাতে রেখে বাম হাত দিয়ে মালিহাকে খোঁচা দিলো।
“দোস্ত! মনে হচ্ছে বেড়াইতে যাচ্ছি।”
“বেড়াতেই তো। এক ব্লক থেকে আরেক ব্লকে।” মালিহা হাসলো। নাজিফার রুমের সামনে পৌছুতেই দেখলো সে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাতে দুজনের হাত ধরে নাজিফা মলিন কণ্ঠে বলল, “অনেক দেরি করে ফেললাম। একদম সরি!”
“আরে না না! কোনো সমস্যা নেই। অন্যদিন এমন সময়ই তো আমরা খাই।” সম্মতির আশায় নীতির দিকে তাকালো মালিহা। নীতি মাথা ঝাঁকালো। নাজিফা তাদের ঘরে নিয়ে গেলো।
নাজিফার বেডের সামনে যেয়ে নীতি যারপরনাই অবাক হলো। তার মুখ দেখেই সেটা বোঝা গেলো। মালিহা পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল, “মুখ বন্ধ কর নীতি!” নাজিফার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাকি রুমমেটরা কোথায়?”
মেঝেতে পাটি বিছিয়ে নাজিফা বলল, “ঐ কর্ণারের আপু মাস্টার্সের। তার বিয়ে হয়ে গেছে। ওখান থেকেই যাতায়াত করেন। আপুর অপজিট সাইডে আমাদের ব্যাচের একজন। অন্য ডিপার্টমেন্টের। আর আমার পাশে সেকেন্ড ইয়ারের একজন। কেউ নেই। সবাই যার যার বান্ধবীর সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল নাজিফা। মালিহা হাসলো।
নীতি তখনও অপলক নাজিফার টেবিল, আলমারি, বিছানার সাথে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকার অবশ্য কারণ আছে। পুরো রুমের দেয়াল সাদা রঙের। কিন্তু নাজিফার পাশের দেয়ালটা হালকা গোলাপী রং করা। তার মাঝে আবার ছোট ছোট ফ্লোরাল পেইন্টিং। বিছানার চাদর যেনো দেয়ালের রঙের সাথে ম্যাচ করে কেউ বিছিয়েছে। টেবিলের বইগুলো সব সারি সারি করে গুছিয়ে রাখা। এক কোনায় আবার ঝুড়িভর্তি কসমেটিকস প্রোডাক্ট দেখা যাচ্ছে। নীতি বিস্মিত হয়ে নাজিফাকে বললে, “তুমি ওগুলো ইউজ করো!”
নাজিফা দেখলো নীতি তার স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টের দিকে আঙুল তাক করে আছে। স্মিত হেসে নাজিফা বলল, “ঐ আর কি। টুকটাক করি।”
কিন্তু নীতি দেখেই বুঝলো টুকটাক নয়, পুরোদস্তুর ব্যবহার করে নাজিফা।
“এই তোমরা বসো।” খেতে ডাকলো নাজিফা। খাবার দাবার সব সাজানো হয়ে গেছে। মালিহা মোজোর বোতল পাশে রাখতেই নাজিফা খেয়াল করলো। হৈ হৈ করে উঠলো সে, “আরে! তোমরা কি বাইরের মানুষ নাকি! কিছু নিয়েই আসতে হবে এটা কেমন কথা?”
“তুমিও তো বাইরের মানুষ না। তুমি আমাদের খাওয়াতে পারলে আমরা পারবো না কেনো?” মালিহা রগড় করে বলল। নাজিফা হেসে বলল, “আচ্ছা হার মানলাম। চলো খাওয়া শুরু করি। এই নীতি! কোথায় হারালে তুমি?”
নীতির বিস্ময় তখনও কাটেনি। নাজিফা ক্লাসে যায় বোরখা, নিকাব করে। চোখদুটো কোনরকম দেখা যায়। হাত, পাও ঢাকা থাকে। অনেকে আড়ালে তাকে প্যাকেট বলে হাসাহাসি করে। এজন্য কেউ তার সাথে তেমন মেশে না। অবাক করার বিষয় হলো ক্লাসের আরো কয়েকজন মেয়েও এভাবে চলাফেরা করে। কিন্তু ছেলেদের সাথে তাদের সে কি খাতির! ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট চালাচালি থেকে ক্লাসে হাসি তামাশা। সবটাই সবাই দেখে। তাদের ধারণা নাজিফাও সেই কাতারেরই একজন। দুদিন গেলেই বোঝা যাবে। তবে নীতির কাছে নাজিফাকে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু বোরখা পড়ে, নিকাব করে নাকমুখ ঢাকা নাজিফার সাথে সানস্ক্রিন, টোনার মেখে রূপচর্চা করা নাজিফাকে কিছুতেই মেলাতে পারে না সে। শেষমেষ নীতি বলেই ফেলল, “নাজিফা! তুমি যে এমন রূপচর্চা করতে পারো এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
প্লেটে ভাত বাড়া শেষে নাজিফা তখন আলু ভাজি তুলে দিচ্ছে। হেসে বলল, “কেনো বলো তো?”
“না তুমি তো বোরখা টোরখা পড়। হুজুর টাইপ মানুষেরা আবার এগুলোকে অপচয় মনে করে। তাই আর কি..”
“নাও শুরু করো।” প্লেট এগিয়ে দিলো নাজিফা। পানি ভর্তি গ্লাস আর ছোট একটা বাটি দিলো হাত ধোয়ার জন্য। ভাতে হাত দিয়ে হাসিমুখে বলল, “তোমাকে ভালোবেসে কেউ কিছু উপহার দিলে তুমি কি করবে নীতি? যত্ন করবে না?”
“অবশ্যই করবো।” মুখে ভাত নিয়েই বলল নীতি। মালিহা চোখ রাঙালো। মুখে খাবার নিয়ে কথা বলা আবার কেমন অভ্যাস!
“আল্লাহ আমাকে অনুগ্রহ করে, দয়া করে রোগমুক্ত স্কিন দিয়েছেন। কতো মেয়েদের ত্বকে সমস্যা। এটা না ওটা লেগেই থাকে। কতো ট্রিটমেন্ট নিতে হয়! সেখানে আমি না চাইতেই সুস্থ ত্বক পেয়েছি। আমার কি উচিৎ না সেই নিয়ামতের যত্ন নেয়া?”
নীতি মাথা নাড়লো। এভাবে তো ভেবে দেখে হয়নি।
“আমাদের দেহের এমন কোনো অংশ নেই যেটায় সমস্যা হলে তার ইফেক্ট আমাদের উপরে পড়বে না। ছোট থেকে ছোট প্রত্যেকটা অংশ মূল্যবান। ঠিকমতো খাবার না খেলে শরীর চলে না, চুলের যত্ন না নিলে চুল পড়ে যায়, দাঁতের যত্ন না নিলে সেখানে সমস্যা হয়। তাহলে স্কিনের যত্ন নিতে হবে না? আমরা ভাত খেলে কি সেটা অপচয় মনে করি? তাহলে এগুলো অপচয় হবে কেনো?”
“সেটাই তো।” মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলল মালিহা। নাজিফার প্রত্যেকটা কথা শুনতে তার ভালো লাগছে।
“কিন্তু তুমি তো মুখ-টুখ ঢেকে থাকো। যত্ন আত্তি করো আর যতোই সাজো না কেনো কেউ তো দেখবে না।”
“আমি তো ছেলেদের সামনে মুখ ঢেকে থাকি। মেয়েদের সামনে না। আর এগুলো তো করছি নিজের জন্য। নিজেকে ভালো রাখার জন্য। তাহলে কেউ দেখলো কি দেখলো না তাতে কি যায় আসে?”
নীতি থমকে গেলো। নিজের জন্য? নিজেকে ভালো রাখার জন্য? কথা দুটো তাকে ভাবনার অতলে পাঠিয়ে দিলো। তার চেনাজানা বেশিরভাগ মেয়েরা বাইরে বের হওয়ার সময় বেছে বেছে সবচেয়ে সুন্দর জামাটা গায়ে জড়ায়। কৃত্রিম প্রসাধনীতে নিজেকে সাজায়। এমনকি সে নিজেও। কিন্তু হলে অথবা বাড়িতে নিজেকে সেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয় না। কেমন আলস্য জেঁকে ধরে। কেই বা দেখতে আসছে? এই কথাটাই ভাবনাকে আরো প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। কিন্তু নিজের জন্যেও যে নিজের যত্ন নেয়া যায় এই বিষয়টাই যেনো নীতির মাথায় কখনও আসেনি।
“এই নীতি তুমি কি আলু ভাজি দিয়েই সব ভাত খাবে নাকি? তরকারি নাও।” নিজের হাতে তুলে দিলো নাজিফা। লাজুক হেসে বলল, “মুরগির মাংসে না লবণ একটু কম হয়েছে। রান্নার সময় বুঝতে পারিনি। কিছু মনে করো না প্লিজ! আমি লবণ নিয়ে আসছি।”
“থাক আনতে হবে না। আমার কাঁচা লবণ খাই না। আর তাছাড়া লবণ বেশি হয়ে গেলে সমস্যা। অতোটাও কম হয়নি। তুমি বললে বলেই এখন খেয়াল করছি।”
গল্পে কথায় সময় গড়ালো। নীতিকে ঘুরেফিরে তার বেডের চারপাশটা দেখতে দেখে নাজিফা কাছে এসে বলল, “আল্লাহ সুন্দরতম। তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। তাহলে কেনো আমরা নিজেকে আরেকটু সুন্দর করে তার কাছে উপস্থাপন করবো না?” নীতি তাকিয়ে রইলো অপলক। তার চিন্তার গতি সেকেন্ডে কিলোমিটার ছুঁয়েছে। আল্লাহর সামনেও নিজেকে উপস্থাপন করা যায়?
বিদায় বেলায় নাজিফা বিনয়ী কণ্ঠে বলল, “পরশু তো শুক্রবার। সেদিন রাতে এশার আগে আগে নামাজ ঘরে আসতে পারবে? একটু গল্প করতাম।”
মালিহা মাথা নাড়ল। মেয়েটার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে। না করার কারণ নেই।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি ইতমিনান। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত ফেসবুকিং করার ফল। প্রয়োজনীয় কোনো কাজ ছিল না। শুক্রবারকে সামনে রেখে একটু বিনোদনের আশায় নীল সাদার জগতে ডুব দিয়েছিলো। আঙুলের অদরকারি ব্যায়াম হিসেবে স্ক্রল করে গেছে মিনিটের পর মিনিট। সম্মোহনী নীল রশ্মি চোখের ঘুম যেনো চম্বুক দিয়ে শুষে নিয়েছে। ক্লান্ত হয়ে ফোন রেখে দিলেও ঘুম এসেছে তারও পরে। ফলাফলস্বরূপ ফজর মিস। যখন তার ঘুম ভেঙেছে সূর্য তখন উঁকি দিচ্ছে ঘুমের চাদর ছেড়ে। নিত্যকার অভ্যাস অনুযায়ী বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই কুকুরতার দেখা মিললো। লেজ নাড়াতে নাড়াতে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকালো ইতমিনান। সাড়ে ছয়টা বেজেছে। ব্রাশ করে কাযা নামায পড়ে বাড়ি থেকে বের হলো। কুকুরটা তাকে দেখেই এগিয়ে এলো। ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলো। ইতমিনান ভুরু কুঁচকে তাকালো। মানিক মিয়াকে দেখে কুঁই কুঁই করে আর তাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করছে। এই ডাকের পার্থক্যের মাধ্যমে কি প্রকাশ পায়?
“তোমার তো একটা নাম দেয়া দরকার মানিকের কুকুর। তোমার মনিব কই?” কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বলল ইতমিনান। যদিও সে জানেনা কুকুরটা তার কথা বুঝবে কি না। তবে দেখা গেলো কুকুরটা তার দিকে একবার তাকিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে ঘুরে যেয়ে রাস্তা ধরলো। ইতমিনান তার পিছু নিলো। আজ শুক্রবার। ছুটির দিনে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরতে পারলে মন্দ হবে না।

পথ চলতে চলতে রেল লাইনের পাশে এসে থামলো কুকুরটা। সেখানে ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর। প্রকৃতপক্ষে এগুলোকে ঘর বললে পরিচিত ঘরকে উপহাস করা হয়। ঘর মানুষের আশ্রয়স্থল, শান্তির নীড়। কিন্তু রাস্তাঘাটে সাইনবোর্ড বানানো কাগজ দুপাশে ফেলে এখানে যেটা তৈরি করা হয়েছে সেটা তাবুর কাছাকাছি একটা জিনিস। যার ক্ষমতা নেই এর নিবাসীকে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফানের নিষ্ঠুর তান্ডব থেকে রক্ষা করার। এ যেনো শিশুমনের অবুঝ খেলা, এই জায়গা আমার, ঐ জায়গা তোমার। ইতমিনান নিশ্বাস ছাড়ল। চিত্র শিল্পীরা নাকি রঙের হাজার ধরন চেনে। কিন্তু যে জীবনের রং চিনেছে তার কাছে সেই হাজার রকম রঙের বাহার নস্যি বৈ কিছু নয়।

কুকুরটা একটা তাবুর মাঝে ঢুকে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেলো মানিক ইটের টুকরো কুকুরটার দিকে নিক্ষেপ করতে করতে বেরিয়ে আসছে। কুকুর ছুটে ইতমিনানের পায়ের কাছে এসে থামলো। মানিক মিয়া ঘুম ভাঙ্গা কণ্ঠে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। ইতমিনান গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “মানিক মিয়া এভিনিউ! আছো কেমন?”
মানিক থেমে গেলো। এই পর্যন্ত তাকে কেউ এই নামে ডাকেনি। খুঁচিয়েছে, মজা করেছে। এমন নাম কারো হয় নাকি? গম্ভীর স্বরে মানিক বলল, “এইখানে আপনের কি কাম?”
ইতমিনানও মানিকের মতো স্বর গম্ভীর করে বলল, “খুবই গুরুত্বপুর্ন কাজ মানিক মিয়া। কুকুরটার একটা নাম ঠিক করতে এসেছি। কিছু বলে ডাকতে পারছি না।”
কুকুরটা কুঁই কুঁই করতে করতে মানিকের পা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মানিক গোল গোল চোখে ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি নতুন কোনো পাগলের পাল্লায় পড়লো? কুকুরের নাম ঠিক করতে এখানে এসেছে! কি আশ্চর্য!

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২০

ট্যুর থেকে ঘুরে এসে সবাই সেই গল্প নিয়ে বসেছে কমন রুমে। একদল সামনের দিকে টিভি দেখছে। সম্ভবত সিনিয়র কেউ। নাহলে পেছনে এতো মেয়ে দেখে সাউন্ড কমাতো। সাউন্ড তো কমলোই না বরং মেয়েদের কিচির মিচির আওয়াজে খানিকটা বেড়ে গেলো। কেউ কেউ তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো। সিনিয়র বলে দাপট দেখাচ্ছে? হুহ!

নীতি টেনে ধরে মালিহাকে গল্প শোনাতে নিয়ে এসেছে।
“দোস্ত তোর মধ্যে তো স্বাদ আহ্লাদ কিস্যু নাই। আয় মানুষের স্বাদ দেখে যদি তোর মনে মধ্যে কিসুমিসু তৈরি হয়।” এই কথা বলে মালিহার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে নীতি। কিন্তু নীতি কি জানে মালিহার মনের গভীর গোপনে কতো স্বাদ আহ্লাদ দায়িত্বের বিশাল আস্তরণের নিচে চাপা পড়ে গেছে?

আসর জমে যখন জমজমাট তখন এলো ইরিনা। নীতি মালিহাকে খোঁচা দিয়ে ইরিনাকে দেখালো। ইরিনা তাদের পাশেই বসেছে। তবে তাদের খেয়াল করেনি। মালিহা আস্তে করে বলল, “ইরিনা! কেমন আছো? আঙ্কেল কেমন আছে?”
বড় বড় চোখে মালিহার দিকে তাকালো ইরিনা। অপ্রস্তুত হয়ে একটা হাসি দিল। সেই হাসি চোখ দিয়ে মাপলো নীতি। তার চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে আছে।
“আচ্ছা তোমার সাথে পরে কথা বলছি কেমন?”
বলেই গল্পে মজে গেলো ইরিনা। এক ফাঁকে উঠে অন্য চেয়ারে বসলো। মালিহার কাছে অবাক লাগলো। ইরিনা এমন করলো কেনো? নীতি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “চ্যাং মাছের মতো চ্যাঙ চ্যাঙ করো? ছাই দিয়ে এমন করে ধরবো না!”
সত্যি সত্যিই আসর শেষে ইরিনার হাত খপ করে ধরলো নীতি। ইরিনা যেনো ফেঁসে গেলো। মালিহা বলল, “আঙ্কেল কেমন আছে?” নীতির কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “হাতটা ছেড়ে দে। কেমন দেখা যায়?” নীতি ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর তুই!” পরপর ইরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাবা নাকি এক্সিডেন্ট করেছে? ঘটনা কি? কেমন আছেন আঙ্কেল?” ইরিনা নীতির সন্দেহী দৃষ্টির সামনে বিব্রত বোধ করলো। কোনমতে বলল, “ভালো।” হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। পারলো না।
“আঙ্কেল এক্সিডেন্ট করেছে আর তুমি ঘুরতে চলে গেলে? এটা একটা কথা হলো?”
“আসলে আম্মুই বলল মন টন খারাপ যেয়ে যেনো বান্ধবীদের সাথে ঘুরে আসি।”
“ওওও! আচ্ছা আজকে তো শুক্রবার, মালিহার টিউশনি নেই। বিকালে চলো আঙ্কেলকে দেখে আসি। আমাদের একটা মানবিক দায়িত্ব আছে না? এই মালিহা! গ্রুপে মেসেজ দিই। তাহলে কয়েকজন মিলে একসাথে যেতে পারবো। ভালো হবে না ইরিনা? তোমাদের বাড়ি আমাদের নেবে তো?”
“আব্বু তো এখনো হাসপাতালে। বাড়ি নিয়ে গেলে তারপর যেও কেমন?” ইতিউতি করে বলল ইরিনা।
“আর কতো মিথ্যা বলবে ইরিনা? তোমার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে অথচ ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়েও জানে না। কিন্ত হাসপাতালে থাকা অসুস্থ সে মানুষটা ফোন করে বেশ ভালোভাবেই তোমাকে বকছে! কি আশ্চর্য না?” এখানে আসার আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কারো সাথে ইরিনাকে ঝগড়া করতে দেখেছে নীতি। কথার এক পর্যায়ে আব্বু বলে ডাকতেই সে বুঝলো ফোনের অপর পাশে ইরিনার বাবা তারপর একটু কাছে গিয়ে ভালো করে বাকি কথা শুনে এসেছে সে। নিশ্চিত হয়েছে ইরিনা তার বাবার সাথেই কথা বলছে। সন্দেহ তো নীতির তখনই হয়েছে যখন শুনেছে ইরিনা ট্যুরে যাচ্ছে। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে কেউ ইরিনার বাবার এক্সিডেন্টের খবর জানে না। সন্দেহ গাঢ় হয়েছে নীতির। তার বিশ্বাস এই মেয়েকে চেপে ধরলেই কথা বের করা যাবে, “সত্যিটা বলবে নাকি আমি তোমার বাড়িতে ফোন দেবো? আমার কাছে কিন্তু তোমার বাবার নাম্বার আছে।” আজ সকালেই নাম্বারটা সংগ্রহ করেছে নীতি। ইরিনা এবার বাস্তবিকই ভয় পেলো। মালিহার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল, “তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে এসব কথা কাউকে বলবে না।”
মালিহা অবাক হয়ে নীতির কথা শুনছিল। কিন্তু ইরিনার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে এটা কেউ শুনলেই বা কি? সেটাই বুঝতে পারলো না মালিহা।
“আরে আমার দিকে তাকাও ইরিনা। বলো ফোন দেবো নাকি ডিপার্টমেন্টের গ্রুপে বলবো তুমি মালিহার টাকা মে’রে দিয়েছো? কোনটা?” ভুরু উঁচু করলো নীতি। আশপাশে তেমন কেউ আর নেই। টিভিও ততক্ষণে বন্ধ হয়েছে। ইরিনা চমকে আশপাশে তাকিয়ে বলল, “না না নীতি! আমি মালিহার টাকা মে’রে দেবো কেনো? সব ওকে আমি ফেরত দেবো।”
“কিন্তু সেই টাকা দিয়ে তুমি করেছো কি?”
তাকে ইতস্তত করতে দেখে নীতি ফোন হাতে নিলো। ইরিনা গড়গড় করে বলল, “আব্বু আম্মু আমাকে একদম কোথাও যেতে দিতে চায় না। ট্যুরের কথা বললেও এক বাক্যেই না করে দিয়েছে। আবার সামিরের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগটাও মিস করতে পারছিলাম না। তাই মালিহাকে মিথ্যে বলেছি।”
ইদানিং সামিরের সাথে ইরিনার চলেফেরা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছিল। সেসব কথায় কান দেয়নি মালিহা। এক ইরিনা নিজেই স্বীকার করলো। নীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইরিনার হাত ছেড়ে দিলো।
“তাই বলে এভাবে মালিহাকে মিথ্যে বলবে?”
মালিহার বুকের ভেতর ঢোল পেটানোর আওয়াজ হলো। বিশ্বাস ভাঙার কষ্টের চেয়ে ভয় হলো বেশি। তার চার হাজার টাকা সে ফেরত পাবে তো?

মানুষের অনুভূতির কি রং হয়? কেনো হয় না? যেই অনুভূতির কবলে পড়ে পাল্টে যায় পৃথিবীর ইতিহাস, উল্টে যায় সব নিয়ম সেই অনুভূতি দেখতে কেমন? শাড়ি পরিহিতা রমণীর আভিজাত্যে ভরপুর কুচি নাকি এই রেল লাইনের পাশে বেড়ে ওঠা এক শিশুর শীর্ণ দেহ। অনুভূতির কতগুলো রং? ঠিক কতগুলো? গুণে কি শেষ করা যাবে?

চারপাশে গাঢ় চোখে তাকালো ইতমিনান। তার পরনে ট্রাউজার এবং একটা টি শার্ট। কিন্তু এই পরিবেশে নিজেকে তার বড়ই বেমানান লাগছে। কোনো পুরুষের গায়ে জামা নেই। তবে লুঙ্গির গিটটা বড় মজবুত। নারীদেহের বসন মলিন হলেও সম্মান রক্ষা করার মতো। নিজেকে এখানে উটকো মনে হলো ইতমিনানের। অস্বস্তি কাটাতে মানিকের দিকে তাকালো। তার চোখ দুটো স্বাভাবিকের তুলনায় বড় দেখাচ্ছে। কুকুরটা মানিকে পায়ের কাছে যেয়ে ঘেঁষে বসলো। বসলো মানিক নিজেও। ইতমিনান তার দিকে এগিয়ে যেয়ে বলল, “এভাবে কুকুরের শরীর ঘেঁষে বসা ঠিক না। ওর গায়ে কতো রোগ জীবাণু আছে জানো?”
তাচ্ছিল্য মাখ হাসি ফুটে উঠল মানিকের চোখেমুখে। কুকুরের কাঁধে হাত রাখলো। যেনো সে কতকালের পুরনো বন্ধু।
“এইখানে যতো মানুষ থাকে তারা জন্ম থেইকাই রোগ জীবাণু গায়ে মাইখা বড় হয়। আপনেগো ভূষণ শার্ট প্যান্ট আর আমাগো ভূষণ রোগ জীবাণু। আর কথা হইলো গিয়া বড়লোক মাইনষের কাছে এই আমরাই আস্তা রোগ জীবাণু। তয় আর সমেস্যা হইলো কই?”
কুকুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলো মানিক। এই প্রথম মানিককে কুকুরটার সাথে নরম ব্যবহার করতে দেখলো ইতমিনান। তার কাছে মনে হলো হাজার আঘাতের মাঝে এই এইটুকু স্নেহমাখা স্পর্শের জন্যই কুকুরটা মানিকের পিছু ছাড়ে না। আচ্ছা এই স্নেহ নামের অনুভূতিকে ল্যাবে নিয়ে ক্লোন করা যায় না? ঢুকিয়ে দেয়া যায় না নিষ্ঠুর মানুষগুলোর অন্তরে? বিজ্ঞান কি পারবে অনুভূতিকে কণিক্যাল ফ্লাস্কে মুখ বন্ধ করতে? ডান হাত হাঁটুতে রেখে বসলো ইতমিনান।
“কুকুরটার একটা নাম ঠিক করি মানিক। বলো কি রাখা যায়?”
“কুকুরের আবার নাম লাগবো ক্যান? বড়লোক মাইনষের যতসব ঢং!”
মুখ বাঁকিয়ে বলল মানিক। ইতমিনান থতমত খেয়ে গেল, “কুকুরটা মনে হয় আমার কথা বুঝতে পারে বুঝলে? তো ওকে কিছু বলার সময় কি বলে ডাকবো? কুকুর কুকুর বললে কেমন একটা লাগে না?”
“কেমুন আবার লাগবো? কুকুর হইলো কুকুর। লাগালাগির কি আছে?” মানিকের বলা শেষ হতেই কুকুরটা কুঁই কুঁই করে উঠলো। ইতমিনান বুঝলো না সে মানিককে সায় জানালো নাকি নিজের জন্য একটা নাম চাইলো। তবু ধরে নিলো মনিবভক্ত কুকুর মানিকের পক্ষ নিলো।
“আচ্ছা কালাপাহাড় রাখলে কেমন হয়? এই নামের কিন্তু ইতিহাস আছে।” আর কোনরকম যুক্তি দেখালো না ইতমিনান। মানিক চোখ কুঁচকে নিলো, “ইতিহাস পাতিহাঁস দিয়া আমি করুম কি? আমার কুত্তা কি কালা? নাকি গরীব মাইনষের জিনিস দ্যাখলেই আপনেগো সব কালা কালা লাগে? কালাপাহাড় কওন যাইবো না। তয় লালপাহাড় চলে।” কুকুরটার গায়ের লাল রঙ্গা পশমে হাত বুলিয়ে দিলো মানিক। কুকুরের রুগ্ন দেহের দিকে তাকালে কোনো দিক দিয়েই তাকে পাহাড় বলা যায় না। দেহের কিছু জায়গায় সাদা ছোপ ছোপ দাগ থাকলেও শরীরজুড়ে লাল রঙের আধিক্য।
ইতমিনান সম্মত হলো।
“বেশ! তাহলে লালপাহাড় বলেই ডাকবো।”
চোখ মটকে মানিক বলল, “মাইনষের মতো নাম রাখলেন তাইলে আকীকা দিবেন না?”
আবারও থতমত খেলো ইতমিনান। তার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মানিক পড়াশোনা করলে নির্ঘাত ঘাগু আইনজীবী হতো। কথার মারপ্যাঁচে বিড়ালকেও ঘেউ ঘেউ করতে বাধ্য করতো। তবে মনের ভাব লুকাতে ইতমিনান মোটামুটি পারদর্শী। উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে বলল, “আজ শুক্রবার। একটা ভুঁড়িভোজ করাই যায়। আকীকা না করে বিরিয়ানি খেলে চলবে না?”
মানিক শুরুতেই বুঝেছে এই লোকের মাথার স্ক্রু ঢিলা। একে ফুঁসলিয়ে যে কাজ উদ্ধার করা সম্ভব সেটা তার চতুর মস্তিষ্কে ধরা পড়তে এক মিনিটও লাগেনি। এই মানুষগুলো আছে বলেই তো এখনো চোখ বন্ধ করে হেঁটে হেঁটে পয়সা পাওয়া যায়। ইতমিনানের জন্য মায়া হলো মানিকের। আহারে বোকা মানুষ!
“সইত্য খাওয়াইবেন নাকি ঢপ?”
“সত্যিই খাওয়াবো।”
“তাইলে আইজকা আর কামে যামু না।”
“কি কাজ করো তুমি?”
“টুকাইগিরি করি।” হাই তুলে বলল মানিক।
“আচ্ছা আজকে আমার বাসার সামনের মসজিদে আসো। একসাথে নামাজ পড়ে তারপর বিরিয়ানি ভোজ হবে।”
“মশকরা করেন আমার লগে?” চোখ রাঙিয়ে বলল মানিক।
“কেনো? তুমি কি হিন্দু?”
“মা বাপ তো চিনলাম না। তাই কি র’ক্ত যে গতরে আছে কইতে পারি না। তয় একবার মসজিদে গেসিলাম। শুক্কুরবার জিলাপি দেয়। ভাবলাম নামাজ পইড়া দুইটা জিলাপি খামু তাইলে দুপুরের খাওন হইয়া যাইবো। মসজিদে ঢুইকা বইসি কি বই নাই মানুষ এক্কেরে দৌড়াইয়া আইসে। আমি নাকি চুরি করতে গেসি। কইলাম না নামাজ পড়তেই গেছি। তা আমারে জিগায় গায়ে জামা কো? আমার কি কুনু জামা আছে যে পইড়া যামু? তারপর মাইরা ধইরা বাইর কইরা দিসে। মসজিদ হইলো জামা কাপড় ওয়ালা, আতর ওয়ালা মাইনষের। আমগো না। আপনে যান।”

ইতমিনান থমকে গেলো। আহা মানুষ!

সেই দুপুরে মানিক ইতমিনানের বাড়ির সামনে গেলো না। দেখা গেলো না লালপাহাড়কেও। তবু ইতমিনান নামাজ শেষ করে তিন প্যাকেট বিরিয়ানি কিনলো। চলতে শুরু করল মানিকের নড়বড়ে তাবুতে। মানিক তখন পুকুরে দাপাদাপি করতে ব্যস্ত। ইতমিনান যেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। মানিক এসে তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইলো। ইতমিনান বিনা আহ্বানে সাইনবোর্ডের কাগজে বানানো তাবুর ভেতরে অনায়াসে ঢুকে পড়ল। ময়লা, ছেড়া একটা চটের বস্তার উপর বসে বিরিয়ানির প্যাকেটগুলো খুলে রেখে হাসিমুখে বলল, “মসজিদ আতর ওয়ালা মানুষের হলেও আল্লাহ কিন্তু সবার। জানো মানিক মিয়া এভিনিউ? তোমার, আমার, এই যে লাপাহাড়ের। সব্বার!”
মানিক অবাক হয়ে দেখলো লালপাহাড় কুঁই কুঁই করতে করতে ইতমিনানের পাশে যেয়ে বসছে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২১

মালিহা থমকে গেছে। কমন রুম থেকে এসে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি সে। নীতি বুঝতে পারছে মালিহার মনের অবস্থা। মালিহার পাশে বসে সে ধীর কণ্ঠে বলল, “এর আগেও একবার ও এমন করেছে। তোর মনে নেই? ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে?” কথা শেষ করে মনিকা এবং আঁখির দিকে তাকালো নীতি। তারা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। মালিহা কথা বলল না। চুপ করে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। নীতির ফোন বেজে উঠলে নিজের বিছানায় গেলো সে।

চোখ বন্ধ করতেই ইরিনার মুখটা ভেসে উঠলো। মনে পড়ল নিজের ভাইকে পড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে ইরিনাই সবার আগে এগিয়ে এসেছিল। মেয়েটার চোখে নিজের জন্য স্পষ্ট সমবেদনা দেখেছিল মালিহা। হঠাৎ করেই তাচ্ছিল্য মাখা একটা হাসি মালিহার ঠোঁটে জায়গা করে নিলো। সমবেদনা? আসলেই কি কেউ অনুভব করতে পারে সমবেদনা? আরেকজনের কষ্টের সেই অনুভূতির সমান বেদনা? মালিহার ভাবনায় ছেদ পড়ল। ফোন বাজছে। চোখ বন্ধ করেই ফোন কানে ঠেকালো মালিহা।
“আসসালামু আলাইকুম আপা। কেমন আছিস?”
সন্তর্পনে একটা ঢোক গিললো মালিহা। দুঃখ বড়ই সংক্রামক। বাতাসের আগে ভেসে আরেকজন মন মস্তিষ্ক দখল করে ফেলতে পারে।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোর কি অবস্থা?”
“আপা তোকে একটা কথা বলব। রাগ করবি না বল?”
মালিহা চোখ খুলল। ভুরু কুঁচকে গেলো তার।
“কি করেছিস?”
“আগে বল রাগ করবি না?”
“রাগ করার মতো কথা হলেও করবো না?”
“না। আমার সাথে তোর কিসের রাগ? আমি তোর একমাত্র ছোট ভাই না?” আহ্লাদী কণ্ঠে বলল মিতুল। মালিহা হাসলো।
“আচ্ছা বল। আগে শুনি।”
মিতুলের কণ্ঠ হঠাৎ ধীর হয়ে গেলো। ফিসফিসিয়ে সে বলল, “বাজারে একটা সারের দোকানে কাজ নিয়েছি আপা।”
“কি!” মালিহা চমকে গেলো, “কাজ নিয়েছিস মানে?”
“পার্ট টাইম জব। স্কুল ছুটির পর থেকে এশা পর্যন্ত থাকবো। মাসে তিন চার হাজার পাওয়া যাবে বুঝলি।”
মালিহা উঠে বসলো। রুমে থাকা তিনজনের দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো। বারান্দায়ও বেশ অনেকেই আছে। সিঁড়িঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বলল, “তোকে কে বলেছে কাজ করতে?”
“কেউ না।”
মিতুলের ভাবলেশহীন কণ্ঠ মালিহাকে আরও রাগিয়ে দিলো, “তাহলে এতো বেশি বুঝিস কেনো? তোর কাজ এখন পড়াশোনা করা। ঐটাই মন দিয়ে কর। এইসব কাজ টাজ বাদ দিবি।”
মিতুল নরম কণ্ঠে বলল, “এই বাড়িতে থাকতে আমার ভালো লাগে না আপা। মামা মামীর ব্যবহারও ভালো লাগে না। শুধুমাত্র মায়ের জন্য আছি। মা’কে কি ফেলে দেয়া যায়? কিন্তু আমি তো অথর্ব না। তাহলে এমন ব্যবহার মানবো কেনো? মাস শেষে হাতে টাকা এনে তুলে দেবো। দেখবি অশান্তি অর্ধেক কমে গেছে।”
মালিহা নিভলো। সে তো এখানে আরামে আছে। অন্তত থাকা, খাওয়া নিয়ে তাকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। কিন্তু মিতুল অন্য একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ব্যবহারও পাচ্ছে সেরকম। মালিহা মলিন কণ্ঠে বলল, “ওখানে খুব কষ্ট হচ্ছে সোনা?”
মিতুল হাসলো, “জীবন যদি গোলাপের গালিচা হয়, কাঁটার উপস্থিতি তো সেখানে আবশ্যক।”
মালিহা চুপ করে গেলো। ছোট্ট মিতুলটা কেমন বড় বড় কথা বলছে।
“পড়াশোনাটা ঠিক মতো করবি মিতুল। আমি একটা টিউশনি করছি। আরেকটা কোচিংয়ে ঢুকেছি। তুই চিন্তা করিস না।”
“আপা আরেকটা কথা।”
“কি?”
“আমি দাদীর থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছি।”
পুরো ঘটনা শোনালো মিতুল। মালিহা বলল, “ভাইয়ার সাইকেলটা নিলে কি হতো?”
“যেই লাউ সেই কদুই থাকতো। আচ্ছা শোন, মানুষের ছেলেপেলে পড়াতে যেয়ে আবার নিজের পড়াশোনার কথা ভুলে যাস না।”
মালিহা হেসে ফেলল, “আচ্ছা বড় ভাই। মনে থাকবে।”
“হু। একদম মাথায় গেঁথে রাখ।”
“মা কেমন আছে?”
“ভাইয়ের বাড়িতে আছে না? দুইবেলা করলা ভাজি খাওয়ালেও সে বিন্দাস আছে।”
“মা যে কেনো জেদ ধরে আছে!”
ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করে মালিহার মনে হলো একবার বড় চাচার সাথে কথা বলা দরকার। মানুষটা তাদের জন্য ভেবে ভেবে কাহিল হয়ে পড়ছে। ভাবনা চিন্তা করে ফোনও দিলো মালিহা। কিন্তু ফোন ধরলেন আয়েশা।
“কেমন আছেন চাচী?” ইতস্তত করে বলল মালিহা। এই মানুষটার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা হয় না ঠিক কতগুলো মাস হয়ে গেছে?
“আছি ভালো। তুমি কেমন আছো?” কণ্ঠে গাম্ভীর্য আনার খানিকটা ব্যর্থ চেষ্টা করলেন আয়েশা।
“জি আলাহামদুলিল্লাহ ভালো। চাচা কেমন আছেন? আর দাদি?”
“সবাই ভালো আছে। শুনলাম তুমি নাকি খুব খাটাখাটনি করছো?”
“না সেরকম না। ঐ টুকটাক কাজ করছি।”
“যাই করো নিজের শরীরের যত্ন নেবে। ওখানে কেউ নেই তোমাকে দেখেশুনে রাখার। নিজের যত্ন তোমাকে নিজেই নিতে হবে।”
মালিহার চোখ ভিজে আসতে চাইলো। মাও তো এভাবে বলতে পারে। কই বলে না তো। ঢোক গিলে মালিহা বলল, “জি চাচী।”
“নাও তোমার চাচা এসেছেন। কথা বলো।”
ফোন দিয়ে হাফ ছাড়লেন আয়েশা। মেয়েটার জন্যে খারাপ লাগছে। এতটুকু বয়সে বাপের ছায়া হারিয়ে অকূল পাথারে পড়েছে।

মেয়ের কল দেখে মনে মনে প্রমোদ গুনলেন আয়েশা। গলা খাঁকারি দিয়ে কল রিসিভ করলেন। যতোটা সম্ভব কন্ঠস্বর নরম করে বললেন, “আমার মা কেমন আছে?”
মিলি খেঁকিয়ে উঠলো, “রাখো তোমার মা! কি করেছো তুমি হ্যাঁ? আমি তোমাকে কি বলেছিলাম?”
“আচ্ছা। আমি কি বলি শোন।”
“কিচ্ছু শুনতে পারবো না। আমার শ্বশুরবাড়িতে কি বলব? আমাকে ফকিন্নি মার্কা জমি দিয়েছে?”
“মিলি! আমার কথা শোন!” ধমকে উঠলেন আয়েশা। মিলি থামলো।
“ফকিন্নি মার্কা কোনো জমি তোমাকে দেয়া হবে না। দরকার হলে আমার ছেলের ঘাড়ে সেই জমি গছিয়ে দেবো। আমাদের ভাগের সবচেয়ে ভালো জমি তোমাকে দেবো। নিজের স্বার্থের চিন্তা করা দোষের কিছু নয় মিলি। কিন্তু সেজন্য অন্যের ক্ষতির চিন্তা করা কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষের হতে পারে না। অন্তত আমি তোমাদের সেই শিক্ষা দিইনি। মালিহা বা মিতুল কেউ বাইরের মানুষ নয়। একই র’ক্ত তোমাদের শরীরে। তোমার আপন ভাইবোন হলে কি করতে মিলি? নিজেকে মালিহার জায়গায় ভাবতে পারো?…”
টুট টুট করে শব্দ হলো। কান থেকে ফোন নামিয়ে আয়েশা দেখলেন মিলি কল কেঁটে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। মেয়েটা এমন অন্ধ হয়ে গেলো কিভাবে?

সেদিন তুষারের আচরণে মালিহা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। তুষারের অব্যক্ত ইঙ্গিত বুঝতে তার কষ্ট হয়নি। কিন্তু সহকর্মী এমন মন মানসিকতা রাখলে তার সাথে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অস্বস্তির। বিশেষ করে প্রস্তাব প্রার্থী যখন সেদিকে এগিয়ে যেতে চায় না। কিন্তু মালিহার ভুল ভাঙতে সময় লাগলো না। যখন সে খেয়াল করলো তুষারের এমন সহজলভ্য মন্তব্যের শিকার নিতুও। অর্থাৎ ওটা তুষারের স্বভাব। হাফ ছাড়লো মালিহা। নিজের পূর্বের চিন্তায় লজ্জিত হলো। সবসময় একধাপ বেশি বোঝা অভ্যাস হয়ে গেছে।
মালিহা অবাক হলো নিতুকে দেখে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই গতদিন কি একটা ঝামেলা করে সে বিদায় নিয়েছে। নিতুর সাবলীল ব্যবহার মালিহাকে ধন্দে ফেলে দেয়। মনে হয় আদৌ তেমন কিছু হয়েছিল কি? স্মৃতিপাতায় সেসব ঘটনা জ্বলজ্বল করতেই মালিহার কণ্ঠনালীতে একটা প্রশ্ন এসে মশার মতো পিনপিন করতে থাকে। নিতুকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো সে তার নাম পাল্টে ফেলবে কি না। জিজ্ঞেস করা হলো না। এখনও সে নিতুর অ্যাসিস্টেন্ট কি না!

নিতু নির্দিষ্ট টপিক বুঝিয়ে পড়া দিয়ে ক্লাস থেকে বিদায় নেয়। ক্লাস ওয়ার্ক দেখা এবং ভুল ধরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব মালিহার। একটা করে খাতা দেখে এবং ভুলগুলো তুলে সবার সামনে বুঝিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীদের হাতে কোনো কাজ না থাকায় গল্পের আসর জমে উঠছিল। মালিহা টেবিলে স্কেল দিয়ে শব্দ করলো। সবাই চুপচাপ হয়ে বসলো। দৃষ্টি নামিয়ে খাতার দিকে তাক করতেই মালিহার কপাল কুঁচকে গেলো। আবার সামনে তাকালো সে। একদম পেছনের বেঞ্চে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসে আছে। সব ক্লাসেই ছেলেমেয়েরা একসাথে বসে। প্রতি বেঞ্চে দুইজন করে। তবে পেছনের বেঞ্চে বসা ছেলেমেয়ে দুটোর অভিব্যক্তি তার কাছে সুবিধার মনে হলো না। হাতের খাতাটা তুলে সে বলল, “এটা কার?”
পেছনের দিক থেকে দ্বিতীয় বেঞ্চের একটা মেয়ে হাত তুলে বলল, “মিস আমার!”
মালিহা খাতা নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। উহু! ছেলেমেয়ে দুটোর কোনো হেলদোল নেই। নিজেদের মাঝেই তারা বিভোর। খুব সন্তর্পনে একটা রাউন্ড দিয়ে খাতাটা মেয়েটার কাছে দিয়ে এলো সে। যেই দৃশ্য অবলোকন করলো তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। মেয়েটার এক পা ছেলেটার পায়ের উপরে। দুজনে দুজনার হাত এমনভাবে ধরে রেখেছে যেনো শক্ত কোনো গিট বাঁধা। মাথা নিচু করে কি যেন ফিসফিস করে চলেছে। মালিহার কপালের দুই পাশের শিরা দপদপ করে উঠলো। এই করতে এরা এখানে আসে!
ডাস্টার দিয়ে টেবিলে জোরে শব্দ করলো মালিহা। ক্লাসরুম মোটামুটি চুপচাপ ছিলো। ফলে শব্দটা আরো বিকট হয়ে সবার কানে বাজলো। কেঁপে উঠলো যেনো সবাই। দৃষ্টি তাক করলো মালিহার মুখের দিকে।
চোখমুখ শক্ত করে মালিহা বলল, “কাল থেকে ছেলেরা একপাশে আর মেয়েরা আরেকপাশে বসবে। অন্যথা যেনো আমি না দেখি।”
সকলে অবাক হয়ে তার কথা শুনল। এমন আদেশ তো কেউ তাদের কখনও দেয়নি। স্কুলেও তো তারা একসাথেই বসে।
“কি বলেছি বুঝতে পেরেছো তোমরা? মনে থাকবে?” চড়া কণ্ঠে বলল মালিহা। তার দৃষ্টি একদম শেষের বেঞ্চের ছেলেমেয়ে দুটোর উপর। তাদের খানিকটা দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে। বসেছেও একে অপরের চেয়ে এক হাত দুরত্বে। তার প্রশ্নে সবাই একসাথে বলল, “ইয়েস মিস!”
মুখ গোল করে দম ছাড়লো মালিহা। নিজেকে শান্ত করলো। এরা এখনও ছোট। নরম কাদামাটি। ভালোবাসা দিয়ে বোঝালে নিশ্চয়ই বুঝবে। সেই পথই অবলম্বন করবে মালিহা। চোখ ঘুরিয়ে এক নজরে সবাইকে দেখে নিলো। শেষ বেঞ্চের ছেলে মেয়ে দুটোর মুখে ছেয়ে আছে আষাঢ়ের কালো মেঘ।

বসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইতমিনান। ভেতরে ভেতরে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে সে। এভাবে একভাবে তাকিয়ে থাকার কি মানে? তার কি রূপ খুলেছে? পেছনে হাত মোড়া করে দাঁড়িয়ে আছে সে। নয়তো মুখটা একবার ছুঁয়ে দেখা যেতো।
বস চোখের রিমলেস চশমাটা আরেকটু নিচে নামিয়ে চশমার ফাঁকা দিয়ে বললেন, “যা বলছেন ভেবে বলছেন তো?”
“জি স্যার।” দৃঢ় কন্ঠে বলল ইতমিনান। সে বোঝে না চশমার ফাঁকা দিয়েই যদি দেখবে তাহলে চশমাটা পড়ার দরকার কি?
“আপনাকে কিন্তু অফিস টাইমের মাঝেই একস্ট্রা কাজ করতে হবে।”
“জানি স্যার।”
“ওকে। আমি বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখবো।” মাথা নাড়িয়ে বললেন ভদ্রলোক। ইতমিনান বিনয়ী কণ্ঠে বলল, “বেয়াদবি নেবেন না স্যার। যদি সম্ভব হয় আপনার মেয়েকে তার জায়গায় রেখে ভাববেন। এবং আপনার কাছে আমার রিকোয়েস্ট থাকবে ম্যাম যেনো এই বিষয়টা না জানেন।”
“ওকে।”
“ধন্যবাদ স্যার। আসসালামু আলাইকুম।”
সালাম দিয়ে রুম ত্যাগ করলো ইতমিনান। ঊর্ধ্বতন চেয়ে দেখলেন হালকা পাতলা গড়নের এক যুবককে।
রুম থেকে বের হয়ে লতার ডেস্কের দিকে তাকালো ইতমিনান। ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে সে। পরপরই আবার কি বোর্ডে আঙুল চালানো শুরু করলো। অনাগত জীবনকে আরেকটু আরামে রাখার চেষ্টা। খটখট খটখট…

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২২

তিশার গালে তিন আঙুলের ছাপ। চোখমুখ ভয়াবহ রকমের ফোলা। বাম গালটা বেশি ফুলে আছে। প্রচ্ছন্ন একটা লাল আভা পুরো মুখে রাজত্ব করছে। থেমে থেমে নাক টানছে তিশা। মালিহা আনমনে মেয়েটার গাল ছুঁয়ে দিতেই কেঁপে উঠল তিশা।
“মিস গালে ব্যাথা।”
“কি হয়েছে তিশা?” নরম কণ্ঠে বলল মালিহা।
চোখ মুছে তিশা বলল, “আম্মু মেরেছে।” মেয়েটা অল্পতেই কান্না করে দেয়।
“কেনো মেরেছে? দুষ্টুমি করেছো?”
“না। ইংলিশ টেস্টে কম নাম্বার পেয়েছি। তাই।”
মালিহার ভুরু কুঁচকে এলো। ইংলিশে কম? “কতো পেয়েছো?”
“পঞ্চাশে পনের।” মাথা নিচু করে বলল তিশা। মালিহা এবার বাস্তবিকই অবাক হলো। ইংলিশে কম পাওয়ার মেয়ে তিশা নয়। এটা সে চোখ বন্ধ করে বলতে পারে। অন্তত এতদিন পড়িয়ে এটুকু মালিহা বুঝতে পেরেছে। ফলে তার সন্দেহ হলো।
“আমাকে প্রশ্নটা দেখাও তো। কাছে আছে?”
“না। আমি ঘর থেকে নিয়ে আসছি।”
তিশা উঠলো। ছোটখাট মেয়েটা সবসময় ফ্রক পড়ে থাকে। দেখতে আরো ছোট লাগে।
কাগজ হাতে ফিরে এলো তিশা। মালিহা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব প্রশ্ন দেখলো। গদ বাঁধা প্রশ্ন। মডেল বইয়ে এমন হাজারখানেক নমুনা আছে।
“এগুলো পারো নি?”
ডানে বায়ে মাথা নাড়লো এক তিশা।
“কেনো পারোনি?”
“পরীক্ষায় বসলে আমি আর কিছু মনে করতে পারি না মিস।”
“ভয় করে?”
“হু।”
“সব সাব্জেক্টে নাকি শুধু ইংলিশে?”
“সব সাব্জেক্টে।”
মালিহা চুপ করে গেলো। ভাবলো কিছুক্ষণ। পরপর প্রশ্নটা আবার দেখলো। সেটা একপাশে থেকে রেখে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, “তিশা আমি তোমাকে একটা টাস্ক দেবো। পাজল টাস্ক। কমপ্লিট করতে পারলে গিফট পাবে। রাজি?”
তিশা কয়েকবার পলক ফেললো, “কি টাস্ক?”
“একটা কমপ্লিটিং স্টোরি লিখবে। The Hair and Tortoise. একদম নিজের মতো করে। একটা প্যারাগ্রাফ লিখবে, My Country। কিন্তু কোথাও যেনো My শব্দটা না থাকে। অংক বইটা দাও দাগিয়ে দিই।”
মালিহা আড়চোখে দেখলো তিশা সবটা খুব আগ্রহের সাথে পরোখ করছে। ফোলা মুখেও মৃদু ঝলকানি দেখা গেলো। পড়ানো শেষে বলল, “টাস্কগুলো করবে কিন্তু?”
“করবো মিস।”
“তোমার আম্মুকে ডেকে দাও তো একটু।”
তিশা ঘরে যাওয়ার একটু পর আজিজা এলেন। মালিহা সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে বলল, “বেয়াদবি নেবেন না ফুপু। তিশার টিউটর হিসেবে একটা কথা বলছি। মেয়েটার লুকানো ট্যালেন্ট আছে। আপনি হয়তো কখনো খেয়াল করেননি। ও ইংলিশে দুর্দান্ত। সঠিক পরিচর্যা পেলে আরো ভালো করবে। আপনি ওর নোটবুকটা সময় পেলে একবার চোখ বুলিয়ে দেখবেন। আর পরীক্ষায় খারাপ করার কারণ আসলে ওর ভয়। অতিরিক্ত প্যানিক করার কারণে ও স্থির মস্তিষ্কে পরীক্ষা দিতে পারে না। আশা করি এটাও শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।”
আজিজা চুপচাপ প্রতিটা কথা শুনলেন। প্রত্যুত্তর দিলেন না। তিশার জন্য কম টিউটর তো রাখা হয়নি। কেউ এই কথাটা বলেনি কেনো?

লতার চোখেমুখে অবাক ভাব। বিষয়টা মেনে নিতে তাকে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। কাগজটা হাতে নিয়ে সে বসের দিকে তাকালো। ভদ্রলোক নির্বিকার। দরজায় খুটখাট শব্দ হতেই ধ্যান ভাঙলো তার। ফিরে গেলো নিজের ডেস্কে। ছুটির তখনও কিছু সময় বাকি। চেয়ারে বসে শরীর এলিয়ে দিলো লতা। মাথার ঘণ্টা টেনে চোখের উপর ফেলে দিলো। চোখটা ভিজে আসতে চাইছে। দয়া হোক আর অনুগ্রহ এটুকুর খুব দরকার ছিল লতার। আর পারছিলো না। শরীরটা আর চলছিল না। কিন্তু মাথার উপর শক্ত কোনো হাত নেই, চোখের পানি ফেলার মতো কোনো বুক নেই, নিজের একটা ঢাল নেই। যু’দ্ধের এই দুনিয়ায় সে নিজেই নিজের ঢাল। আরেকজন আসছে। তাকেও ছায়া দিতে হবে। এখনই পুড়ে ভস্ম হওয়া চলবে না। নিজেকে শক্ত করতে চাইলো লতা। ইতমিনান ডাকলো, “আপা? কোনো সমস্যা?”
ঘোমটার উপর দিয়েই চোখ চেপে ধরলো লতা। আলগোছে সেটা মাথায় রেখে বলল, “বসের সুমতি হয়েছে বুঝলি? আমাকে দুই মাসের ছুটি দিয়েছে।”
ইতমিনান অবাক হলো, “তাই নাকি! ভালো তো। আপনার সুবিধা হলো।”
“সুবিধা মানে সুবিধা? এই শরীর নিয়ে আর নড়তে পারছিলাম না। পায়ে পানি জমে ঢোল হয়ে গেছে। ওঠাতে গেলে মনে হয় এক মন ওজন। পেটের ভেতর আরেকটা। অস্থির অস্থির লাগে। যাক আল্লাহ ব্যাটাকে সুবুদ্ধি দিয়েছে। দোয়া করি এই কাজের বিনিময়ে সে জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার পাক।”
ইতমিনান শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বলল, “আমিন।” মুখে বলল, “তাহলে তো কাল থেকে আর আপনার দেখা পাচ্ছি না। যদি এই অধমকে করুণা করে দরকার হলে একটা ফোন দিতেন আমি কৃতার্থ থাকতাম।”
লতা হেসে ফেললো ইতমিনানের বলার ধরণে।
“দেবো দেবো। একেবারে মোক্ষম সময় ফোন দেবো। তখন বুঝবি ঠ্যালা।”
ইতমিনান তাকিয়ে রইলো ঘড়ির দিকে। নিজের সাথেই যেনো তার পাল্লা। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা। কেউ থেমে নেই। ইতমিনানের খুব ইচ্ছে হলো লতার হাত দুটো ধরে। তার ভয় হচ্ছে। ডেলিভারির সময় তো কতকিছুই হয়। লতার সাথে যদি আর দেখা না হয়? পলক ঝাপটালো ইতমিনান। পাল্টে ফেলতে চাইলো চিন্তার স্রোত।
“নিজের যত্ন নিয়েন আপা। ভাইয়ার সবচেয়ে দামী আমানত আপনাকে সে দিয়ে গেছে।”
চলে গেলো ইতমিনান। লতা সেই নিষ্ঠুর মুখটা মনে করলো। অকূল পাথারে তাকে একা ভাসিয়ে বিদায় নিয়েছে লোকটা। উহু, বিদায় নেয়নি। না বলেই চলে গেছে। বুকটা ভারী হতে চায় লতার। নিজেকে সামলে নেয় সে। পুরো শরীরটা ভারী। এর মাঝে আলাদা করে বুকের ভার সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।

অফিসের পাশের টং দোকানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ইতমিনান। দোকানটা ছোট একটা গলির ভেতরে। রাস্তা থেকে সহসাই অন্ধকারে ঘেরা জায়গায় দাঁড়ানো লোকগুলোকে দেখা যায় না। কিন্তু এদিকে দাঁড়ানো মানুষগুলো রাস্তাটা বেশ দেখতে পারে। দুই কাপ চা শেষ করেছে ইতমিনান। আর খাওয়ার ইচ্ছা নেই। কিন্তু যার জন্য সে দাঁড়িয়ে আছে তার দেখা নেই। কতক্ষন পড়ায় মেয়েটা? ঘড়ি দেখল ইতমিনান। সময় তো হয়েছে। অস্থির ভঙ্গিতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে গলির মুখে এসে দাঁড়ালো সে। সাই সাই করে বাস, ট্রাক যাওয়া আসা করছে। একটা নেড়ি কুকুর পুরোনো পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল ঘেষে ঘুমিয়ে আছে। সুখের ঘুম নাকি ক্ষুধা ভুলে থাকার ঘুম? ইতমিনান জানে না। শুধু জানে নিজের সর্বনাশ সে নিজে করেছে। এই অস্থিরতার জন্ম দেয়া মনকে লাই দিয়েছে। শব্দ দিয়ে সাহায্য না করলেও নীরবতায় সম্মতি দিয়েছে। সেই সম্মতি পেয়ে মন তার আনকোরা অনুভূতির পসরা সাজিয়ে বসেছে। ইতমিনান জানে না এই অনুভুতির উপযুক্ত কোনো ভবিষ্যত আছে কি না। বলা ভালো সে জানে, নেই। কিন্তু সেই জানাটুকু অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। বেহায়া চোখদুটোকে খিচে বন্ধ করে ইতমিনান। তাকিয়ে তাকিয়েই সর্বনাশটা করেছে সে। যখনই দৃষ্টি তার সূক্ষ্মতম দুর্বলতায় পা পিছলে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখনই তার উচিত ছিল তাকে ঘুরিয়ে দেয়া। লক্ষ্যবস্তুকে পরিবর্তন করে ফেলা। ইতমিনান সেটা পারেনি। নিজের মনকে শক্ত শিকলে বেঁধে রাখতে পারেনি। সে জানে ক্ষতি আসলে তারই হচ্ছে। মায়াটুকু বেড়ে মন থেকে মস্তিষ্ককে গ্রাস করতে চাইছে। সংযম ভেঙে দিতে চাইছে। তার ভবিষ্যত সঙ্গিনীর জন্য যেই অনুভূতিগুলো খুব যত্নে সাজিয়ে রাখার কথা সেই সাজানো গোছানো অনুভূতিকে উলোট পালট করে দিচ্ছে। ইতমিনান খেই হারায়।
“কি ভাই? ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?”
চোখ খোলে ইতমিনান। এক ভদ্রলোক তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। তাকানোরই কথা। দিনে দুপুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ ঘুমাতে শুরু করলে তার দিকে মানুষ অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাবে বৈ কি। বিব্রত বোধ করলো ইতমিনান। সর দাঁড়ালো একপাশে। তখনই দৃষ্টিগোচর হলো গাঢ় পেস্ট কালারের বোরখা পরিহিতা মেয়েটা এদিকেই আসছে। একই রঙ্গা কাপড়ে মাথা আবৃত। রোদে পুড়ে ক্লান্ত হওয়া মুখটা লাল হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপরই ডান হাত দিয়ে ঠোঁটের উপরের ঘামটুকু মুছে ফেলছে সে। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরা। যেনো কোনো অমুল্য রতন। এক লোকের সাথে ধাক্কা লাগার মতো অবস্থা তৈরি হতেই ভুরু কুঁচকে নিলো সে। কপালে তৈরি হলো সূক্ষ্ম কয়েকটা ভাঁজ। দ্রুত পাশ পরিবর্তন করে হাঁটতে লাগলো। পেছন ঘুরে লোকটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। আবার সামনে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। নাকের ডগার ঘাম মুছে নিলো। দেখতে দেখতে চলে গেলো অপলক দৃষ্টির আড়ালে। ইতমিনান চোখ বন্ধ করলো। মালিহা হেঁটেই যাতায়াত করছে। সে খেয়াল করলো তার মনের অস্থিরতাটুকু আর নেই। ইতমিনান জানে এই ক্ষণিকের স্বস্তি তাকে নিয়ে ফেলবে জটিল অস্থিরতার সাগরে। নিজেকে সামলাতে চায় ইতমিনান। পারে না। মন যে লাগামছাড়া হয়েছে।

কাহিল ভঙ্গিতে গলি ছেড়ে বের হলো সে। বাড়ি ফিরতে মন চাইলো না। শূন্য ঘর ভাবনার রশি গড়িয়ে কোথায় ফেলবে কে জানে। ইতমিনান দেখতে শুনতে এই মিষ্টি ভাবনাকে ভয় পাচ্ছে। পালিয়ে থাকতে চাইছে তাদের থেকে, পারছে না। একবারের দুর্বল দৃষ্টি মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলো ইতমিনান। আহা! স্মৃতিটুকু যদি মুছে দেয়া যেতো। কষ্টের কালো ছাপ, নাকে রুধিরার তরল ধারা, শক্ত কণ্ঠে আত্মসম্মান..সবটুকু যদি ভুলে থাকা যেতো! সবটুকু!

নিজের অজান্তেই যে ইতমিনান কখন খাবার হোটেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। মানুষের আনাগোনা একটু কম। এই বিকেলে কেই বা ভাত খেতে আসে। হোটেল বয় কাস্টমার পেয়ে যারপরনাই খুশি হলো। দ্রুত ইতমিনানের দিকে এগিয়ে এসে বলল, “টেবিল খালি হইসে। আসেন দুরুত কইরা বইসা পড়েন।”
ইতমিনান ছেলেটার খুশি কেড়ে নিতে চাইলো না। ক্ষুধার কোনো চিহ্ন পেটে না থাকলেও একটা খালি টেবিলে যেয়ে বসলো। এনার্জি বাল্ব জ্বলছে। যেনো সরাসরি চোখে এসে লাগছে। কিছু পোকা লাইটের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। ছেলেটা এসে গলার গামছা দিয়ে টেবিলের পানি মুছে দিলো। কিছু খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে ছিল। সেটাও মুছলো। ফের সেই গামছা গলায় ঝুলিয়ে বলল, “কি খাইবেন?”
“তোমাদের এখানে সবচেয়ে ভালো হয় কোনটা?”
ছেলেটা চকচকে চোখে বলল, “আমার তো ছুডু মাছের সালুন আর কলাইয়ের ডাইল বেশি স্বাদের লাগে।”
“আচ্ছা সেগুলোই আনো।”
ছেলেটা কিছুক্ষণের মাঝেই সব নিয়ে হাজির হলো। দোকানে তখন অবশিষ্ট খরিদ্দার বলতে শুধু ইতমিনানই আছে। বেশ গরম লাগছিলো তার। ছেলেটাকে বলল, “ঠান্ডা কিছু আছে?”
“আছে। কোকা কোলা আছে। দিমু?”
“না। ক্লেমন আছে?” মাথা নেড়ে বলল ইতমিনান।
“থাকার কতা। বন দেইখ্যা লই।”
যেমন চট করে গিয়েছিলো তেমন চট করেই ফিরে এলো ছেলেটা। হাতে ছোট একটা ক্লেমনের বোতল। তার গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি। ক্লান্ত নাকি বোতলটা?
“তুমি এখন কি করবে?”
“থাল বাসন ধুমু। আপনের কুনু দরকার হইলে ডাক দিয়েন। ওস্তাদ গ্যাছে বিড়ি খাইতে।”
ক্যাশ কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে ফাঁকা পেলো ইতমিনান। তার মানে কর্তা মহাশয় ছেলেটাকে বেশ বিশ্বাস করেন। সামনের চেয়ার দেখিয়ে ইতমিনান বলল, “একটু বসো। একা খেতে ভালো লাগে না।”
ছেলেটা অবাক হলেও বসলো। সম্ভবত এমন আদেশ কেউ তাকে কখনো করেনি। গলার গামছায় বুকের ঘাম মুছলো সে। ইতমিনান তার দিকে প্লেট এগিয়ে দিতেই ইবাকের চূড়ান্ত হলো ছেলেটা।
“কি হইলো?”
“খাও।”
“আমি খামু ক্যান? আপনে অডার দিসেন। আপনে না খাইবেন।”
“তোমার জন্যই দিয়েছি। তোমার পছন্দ শুনে নিলাম না?”
ছেলেটার বিস্মিত চোখে এবার সন্দেহ দেখা গেলো। কিশোর ছেলেটা শহরের নিয়ন বাতির নরম আলোর আড়ালের ঘৃণ্য দৃশ্য জানে। বাইরের চাকচিক্য তাই তাকে টানে না।
“আমি খামু ক্যান? খামু না। নিজে খাইবেন না তাইলে চাইলেন ক্যান? মশকরা করেন?” একটু শক্ত গলায় বলল সে। বেশি শক্ত হলে মুশকিল। ওস্তাদের কাছে খবর গেলে পেটে টান পড়তে সময় লাগবে না।
“আমি আসলে এখানে একা থাকি বুঝলে। বাবা মা সবাই গ্রামে। গল্প করার মতো মানুষ পাই না। তোমাকে দেখে মনে হলো গল্প করা যাবে। তাই বললাম। তোমার ভালো না লাগলে বাদ দাও।”
ইতমিনান দেখলো ছেলেটা গামছা ছেড়ে ভাতের মাঝে হাত ঢুকিয়েছে। প্রিয় ছোট মাছের সালুন দিয়ে ভাত মাখছে। চোখে তার লোভ।
ক্লেমনের মুখ খুলে এক ঢোক খেলো ইতমিনান।
“তোমার নাম কি?”
“মিন্টু।” ভাত ভর্তি মুখে উত্তর দিলো মিন্টু। দৃশ্যটা বড়ই বিদঘুটে দেখালো।
“বয়স কতো তোমার?”
“চইদ্দো।”
“এখানে কাজ করো কবে থেকে?”
“তিন বছর হইবো মনে হয়।”
“খাওয়া দাওয়া এখানেই করো?”
“হু।”
“স্কুলে যাও?”
“ইস্কুলে যাইয়া কি করুম? এই রাস্তায় সারাদিন ইদুর মা’রার বিষ ব্যাচে যেই ব্যাডা হ্যায় পড়ছে এইট পর্যন্ত। তয় হইসে কি? আকামের খাটনি। কাম করতাসি, খাওন পাইতাসি। আর কুনু চিন্তা নাই।”
“তোমার বাসায় কে কে আছে?”
“কেউ নাই। আইসি একা, রইসি একা, যামু একা।”
ঢকঢক করে পুরো পানির গ্লাস ফাঁকা করে ফেললো মিন্টু। ইতমিনানের সহসাই মানিকের কথা মনে পড়লো।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে